ঘুমন্ত পাখি

বাজান খোলা বারান্দায় বইসা জাল বুনতাছে। আমারে ডাইকা কইল, এইদিকে একটু আয় মা। আমারে এক গ্লাস পানি দে। উর্মি একটা ইস্টিলের গেলাসে পানি দিয়া কইল, বাজান, জোনাকি ঘরে নাই।

– ক্যান, কই গেছে ভরদুপুরে?

– খালের ঘাটে পানি আনবার গেছে বাবা।

বাজান হুঁক্কা খাইতাছে আর জাল বুনতাছে।

– জাল বুনার সময় হুঁক্কা না খাইলে শরীর আরাম বোধ করে না।

– কবে থাইকা যে তোমার এইডা খাওন বন্দ অইবে, তোমার মাইয়ারা বড় অইতাছে, তোমার কোনো বোধ নাই। মা এমন কইরা মাঝেমইদ্যে বাবাকে গালমন্দ করত।

– আমার দুইডা নাম, আর এই নামেই সকলে আমারে চেনে বুঝলা। এক হইলো জাল আবছার, অন্যটা হুঁক্কা আবছার। আমি এহন খাওন বাদ দিলেই কি এই নামডা মুইছা যাইবো! কেউ আইলে এই নাম হুইন্নাই আইবো। আমি গরিব মানুষ বড় কোনো স্বপন দেহি না। যেমন রিকশাওলা প্রাইভেটকারওলার সঙ্গে দোস্তি করার স্বপন দেহে না। আমিও তেমন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাইড়া কইল বাজান।

– এর চাইয়া এইডা খাইলে আমার কিছু অইলেও দুঃখ কমে।

– ওইডা তুমি বুল কইছো, হুঁক্কায় মোনের যন্ত্রণা কমায় না, বরং শইলের যন্ত্রণা বাড়াইয়া দেয়, মা কইল।

– নেও ঢের অইছে, ঢের অইছে, অহন বাদ দাও। ভাত অইলে দুইডা দাও, এক মুঠ্ খাইয়ে আমগাছতলায় বাতাসে বইয়া জাল বুনুম।

বাবা ভাত খাইতে বহে, মারে কইল,

– তুমি খাইবা না?

– আমার দেরি হইবো। চইত মাইসা দিন, আতকা বিষ্টি আইতে পারে। ডালপালাগুলা ভিজ্যা যাইবো, ওইগুলা ঘরে তুইলা পরে খাবানে।

দুই

একদিন সকালে সলিমুল্লাহ ঘটক হাজির,

– কিরে আবছার মিয়া, অহন দিনকাল কেমন যায়? জালবুনা টেহা দিয়ে কি চলতে পারো?

– মোটামুটি চলতে পারি চাচা। ধরো চাচা একটান দাও।

কইয়াই হুঁক্কাটা তার হাতে দিলো বাজান।

– দিবা, তা দাও একটান দেই।

দুই-তিন টান দেওনের পর দিয়া দিলো বাজানের হাতে। দুইজনে ভাগাভাগি কইরা খায় আর আমার বিয়া নিয়ে কথা কয়।

– তোমার বড় মাইয়াডারে বিয়া দিবা?

– পোলা কেমন? কোনহানে, কী করে?

– সওদাগরবাড়ির একমাত্র পোলা রাসেদ, টেহা-পয়সা গাদা। মাইয়াডা তোমার বড্ড শুহি থাকব।

– হ, চাচা আমি রাজি।

– তোমারে কি ভূতে মাথা খাইছে! মায়ের কণ্ঠ, মাইয়া সামনে পরীক্ষা দিবো। পরীক্ষা না দেওন বাদে কোনো বিয়ের নামে সুর তুলবা না, কয়ে দিলাম।

খড়ি গুছাইন্না বাদ দিয়া বাজানের দিকে ছুইটা আসে মা।

– তোমার কাছে জ্ঞান ভিক্ষা চাই নাই। মাইয়া মাইনষের কাছে সংসারের ভার দিলে হেই সংসারে অবনতি ছাড়া উন্নতি নাই, অ আমার জানা আছে। কী চাচা, হাচা কইছি না?

ঘটকের দিকে চাইয়া কয় বাজান।

– কুনুদিন তো আমার কুনু কতার দাম দিলা না, ভাগ্যিস জালবুনাডা শিখছিলা, নইলে আমগো কপালে যে কী অইতো। ওইডা ছাড়া তো আর সক্কল কম্মে অজ্ঞ।

– অইছে অহন থামো।

– বড়লোকের ঘরে বিয়া দিতাম না মাইয়া, কয়ে দিলাম। বড়লোকেরা গরিবের মাইয়াগো ঝিয়ের দামও দেয় না।

বাবা ধমকাইয়া কয়,

– থামো তো। চাচা আপনি হেগোর নিয়া আইসেন।

– তুমি যদি কও তালি কালই নিয়া আহি।

– হ, চাচা আপনে নিয়া আহেন।

আমি বাবার ধারে গিয়া খোলা বারান্দায় বাঁশের খুঁটার লগে পিঠ লাগাইয়া বইলাম। তার দিকে তাকাইয়া মিনতির স্বরে কইলাম

– বাজান, আমারে বিয়া না দিলেই না? আমারে বিয়া দিও না বাজান। আমারে পড়নের খরচ আর দেওন লাগবো না। আমি আর পড়ুম না। সেলাই মেশিন চালায়ে যে টেহা পাই তা দিয়ে সুমি-ঊর্মির পড়ার খরচ চালামু।

– ওগুলা তোমার মায়ার ঘোর, অ বাদ দাও। বিয়া তোমার করতেই অইবো। অত পড়া দিয়া কাম নাই।

তিন

কুটোর পালার পাশে বকুলফুলের ডালে পাঁচটা দোয়েল পাখি কিচিরমিচির করতাছে। দৌড়াইয়া গেলাম হেগোর কাছে। খুব ভালোবাসতাম পাখিগোরে।

পাখি দ্যাখলেই এল্লা এল্লা কথা কইতাম, মাঝেমদ্যে, অগোর স্বরে কিচিরমিচির কইরা উত্তর দিত। বেশ বুঝতাম অরা কয়, তুমি ভালা আছ? ভাত খাইছ? শইলডা ভালা? আবার মাঝেমইদ্যে উত্তর না দিয়া পাখি উইড়া যাইত। মনডা বেজায় দুঃখ পাইত তহন, চোখ দুইডা নীরবে কানত; কিন্তু চোহে পানি আইত না। কিছু রাইতে স্বপন দেহি, আমি শাড়ি পইরা গাছের মগডালে পা ঝুলাইয়া দুলতে থাহি, আর পাখি আমার মাথায় বইয়া গান হুনায়। পরানডা বড্ড সতেজ অইয়া ওঠে। আমি কইলাম, ওই পাখি তরা মারামারি করছ ক্যান? তরা না বন্ধু! ওমা, বোবা পাখি উইড়া গেল, কিছু কইলো না। দুঃখমনে ঘরে ঢুকলাম। বাজান মনে হরছে আমি বিয়াতে রাজি হইছি। পরদিন বিহানের রোদ সিঁড়ি বাইয়া কুটার পালায় নামতে নামতেই হাজির হইলো চকচকা জুতা-টাই-প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজা সওদাগরবাড়ির রাসেদ সাব, ঘটকের লগে। সুমির কথা খুব চ্যাটাং চ্যাটাং।

– ওই ঘটক দাদা! তোমার বিয়ার পাত্র নিয়া হাঁটা দেও, বুবু বিয়ায় রাজি না – সুমি কইল।

– অই শালি কতা কম ক। নইলে

তরেও পার করুম।

– আমারে বিয়ে দেওন অত সোজা না বুঝলা!

বাজান আমারে কইলো, মা এই পানের ডালা লইয়া যা ওনাগোর সামনে। যাইয়া ছালাম দিবি।

বাজানের হুকুমে তাই করলাম।

ঘটক দাদা বইতে কইলো। টুলের উপর বইলাম, দেহি রাইতের আসমানোর তারাগুলা যেমন বাত্তির মতো জ¦লজ¦ল হইয়া ওঠে, তেমন একটা ঝলমলাইন্যা হাসি ছাইড়া দিলো গোঁফের নিচ দিয়া রাসেদ সাব। বেশ বুঝলাম, লোকটার আমারে পছন্দ অইছে। আমি আর কী বুঝাইমু, আমার তো কুনু মানুষই পছন্দ অয় না। আমার পছন্দ উড়াল পাখি, গাছর ফুল, খালর পানি, বিলর শাপলা, আসমানোর তারা। আমি জানি, এইগুলা মাইনষেরে কইলে মাইনষে আমারে পাগল কইবো। তাই কারুর লগে কই না। এল্লা এল্লাই অগোর লগে পেম করি। রাসেদ সাব ঘটক দাদার লগে ফিসফিসাইয়া কী যেন কইলো, শব্দগুলা শিমুল তুলার মতো উইড়া আইলো আমার কানে। বাড়ির পোলাপাইনগো ক্যাচরম্যাচর বাজনায় কিচ্ছু বুঝবার পারলাম না। রাসেদ সাব আমারে জিগায়, তোমার নাম কী? কইলাম, জোনাকি।

– মাশা আল্লাহ সুন্দর নাম, রাসেদ কইল।

আমি কইতে চাইলাম, একটুও সুন্দর না আমার নাম। আমার নাম যদি অইত পাখি, তারা, ফুল – তাইলে খুব ভালা অইতো, কইলাম না বাজানের ডরে। বাবায় যদি ঠাস কইরা একখান থাপ্পড় লাগাইয়া দেয়। কিন্তু জোনাকি নামডাও একবারে মন্দ না।

হেরা নাস্তাপানি খাওয়া শেষ কইরা দিন দিয়া গেল, আগামী শুক্কুরবার বিয়া। মা আর বাজান বারান্দায় বইয়া খুঁটার লগে পিঠ ঠেস দিয়া পা লম্বা কইরা বিয়ার গল্প করতাছে।

চার

আমার বাগানে খুব বেশি ফুলগাছ নাই। গেন্দা, গোলাপ, বকুল, জবা, সূর্যমুখী, ডালিয়া। রোজ বিহালে কিছু পাখি আইতো আমার বাগানে। অগোর লগে আমি কতা কইতাম, গুনগুনাইয়া গান গাইতাম। আমার ফুলবাগানের লগে বড় আমগাছে দোলনাটা বান্ধা। হেই দোলনায় আমি দোল খাইতাম।

আইজ সূর্যমামা যেই পশ্চিম পাটে নামতে শুরু করল, অমনি দোলনায় গিয়া বইলাম। পাখিরা আইবো, আমি অগোর স্বাগতম জানামু। দোলনায় দুলতে দুলতে কথার সুর তুললাম। পাখিরা তরা আসবি কখন, মনডা আমার ছটর-পটর করতাছে এখন। বাহ একখান কবিতা হইয়া গেল তো! আইজগো যাইয়া ডায়রিতে লেইহা থুমু। আতকা দেহি পাখির ঝাঁক আইয়া পড়ছে, কেউ বসছে জবার ডালে, কেউ বকুলের ডালে, একটা পাখি আইয়া আমার পাশেই বইলো, অরে জিগাইলাম – তরা কেমন আছোস? কয় – ভালা নাই। কইলাম – ক্যানরে তগোর কী অইছে? কইলো – তোমার বিয়ে অইয়া যাইতাছে তাই। কইলাম – তরা মন খারাপ করিস না। আমি যে পাগল, এইডা আমগো ঘরের কেউই জানে না। আমি খুব ভালা কইরাই জানি। আর পাগল মাইনষেরে কেউ ভালাবাসে না। আমার সে-বিশ্বাসখান আছে, আমার কপালে সংসার অইবো না। আমি আবার তগোর কাছেই ফিইরা আমু।

রাসেদ সাব বর সাইজা জাহাজ ভইরা লোক নিয়া আমগো বাড়ি আইয়া খাওন খাইয়া আমারে লাল শাড়ি পরাইয়া লইয়া যাইবো। আমি আমার ডায়রিডা ব্রিপকেসে ভরলাম। আমার সখীরা কয় – পাগল নাহি! অহন তুই নতুন বউ, ডায়রি নেওন দিয়া কাম নাই।

রা নাই, চুপচাপ বইসা আছি। সবার খাওনদাওন শ্যাষ। দুধ-ভাত খাওনের লাইগা আমার পাশে আইনা বহাইলো বরেরে। মালাবদল,

দুধ-ভাত সব হইলো। বাইরে নিয়া আইসা আঙ্গিনার মাঝখানে বাজান আমারে বরের হাতে তুইলা দিলো। দেওয়ার সময় কয়,

– অয় আমার বড় নরমদরম মাইয়া, সাত চড়ে রা নাই। অরে তুমি কোনো দুঃখ দিও না বাবা।

বাজান, মা, সবাই কানতাছে। আমার কান্দা নাই। আমি তো জানি, আমি আবার চইলা আসুম। যহন বাবার চোহের দিক চাইলাম, দেহি চোখ দুইডা ফুইলা গেছে। লাল চোখেরথন শুধু পানিই বাইরাইতাছে সমানে। মা আমার দুইডা হাত ধইরা কইতাছে, মা রে … শ্বশুর-শাশুড়ির, স্বামীর মন জোগাই চলিস, লাল শাড়ি পইরা যাইতাছোস, সাদা কাফন পইরা বাইরাবি, যত কষ্ট হোক বাপের বাড়ি আওনের চেষ্টা করবি না, আমার কথাডা রাহিস মা।

পাঁচ

চাচাতো ভাবি আর একমাত্র ননদ বাসরঘরে দিয়া গেল। ঘরডা দারুণ সুন্দর ফুল দিয়া সাজাইনা। সোফা, ফোমের খাট। ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়া খাড়াইলাম, দেহি আমারে রাজরানির মতো লাগতাছে। অবাক, আমি এত সুন্দর অইলাম কবে থাইকা! নিজেরে নিজে জিগাই। নিজেরে নিজে দেইহা মুহূর্তের মধ্যে এক ঝলক রক্ত ছলকাইয়া উঠল, মোনটা কেমন এক অদ্ভুত শিহরণে কাঁইপা উঠল। পাড়-বান্ধানো নতুন লুঙ্গি আর সেন্ডু গেঞ্জি পইরা রাসেদ ঘরে ঢুকল। আমি রাসেদকে সালাম করলাম। রাসেদ দুই হাত আমার দুই গালে দিয়া আমার দিকে চাইয়া আছে, দেহি মায়ার একটা সেতু। কেমন যেন বুকটার মইধ্যে খচাং কইরা উঠল, মনে হইলো, কইলজার ওপর দাগ কাইটা গেল। রাসেদের শইল্যে য্যান কাঁচা হলুদ ফুইটা উঠছে। খুব সুন্দর দেহা যাইতাছে। আমি কইলাম, আপনেরে অনেক ভালা লাগতাছে। আমারে কইলো – তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে। রাসেদ কইলো, এসো খাটের উপরে বসি। দুইজন সামনাসামনি বইলাম। রাসেদ কইলো, আমি একজনের সঙ্গে প্রেম করতাম। নাম ঝর্ণা, খুব সুন্দরী; কিন্তু বাবা-মা রাজি না, তাই আমিও বেশি জোর করলাম না। পোড়া দাগ কখনো কখনো মিলাইয়া যায়, আশা করি তোমার ভালোবাসায় তাই হইব। তুমি কি কাউরে ভালোবাসতে?

– হ, বাসতাম তো, অনেকেরে ভালাবাসতাম।

– মানে, তুমি অনেককে ভালোবাসতে?

– হ বাসতাম। আপনে দ্যাখতে চাইলে অহন দেহাইতে পারুম।

– ও গড! ওরা তোমার সঙ্গেই আইছে?

উত্তর না দিয়া জানালা খুললাম। দেহি বাগানের মধ্যে একটা ছোট কুঁড়েঘর, টিনের চালা হোগলা পাতার বেড়া। কইলাম – ওই ঘরটায় চলেন, আমি অগোরে দেহামু।

– ওখানে তো আমাদের রাখাল ছেলেটা ঘুমায়। আমি কোনোদিন ওইরকম বিছানায় ঘুমাই নাই।

– আইজ শুধু চলেন আর কুনুসম কমু না।

রাসেদ কথা না বাড়িয়ে বলে – ‘ঠিক আছে চলো।’ রাগে আগুন জ্বলতাছে রাসেদের চোহে; কিন্তু আমায় বুঝতে দিতাছে না। দুইজনে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। ভাঙ্গা একটা চকি খটমট করে। আমি কইলাম, ওই দ্যাহেন আসমানের চান, তারা – আমি অগোর লগে পেম করি। বিলের শাপলা, খালের পানি, গাছের ফুল, উড়াল পাখি – আমি ভারি ভালোবাসি।

– ভাবতাম গাইয়ে অশিক্ষিত মেয়েরা আদর্শবান হয়, স্বামীভক্ত হয় – এখন দেখলাম উল্টা। আসলে আমার বোঝা উচিত ছিল, রূপে-যৌবনে মানুষ যতই পরিপূর্ণ হোক না কেন, শিক্ষায় অপূর্ণতা মানেই সম্পূর্ণ শূন্য।

– আপনের কতাডায় আমি বড্ড কষ্ট পাইছি। আপনেরে যখন দেখলাম বাসরঘরে, বুকটার মধ্যে খুশিতে খচাং কইরা উঠছিল। ঠিক সেইখানেই আবার হাতুড়ির বাড়ি পড়ল।

চোহের কোনায় পানির জিলজিলে ফোঁটা আইলো, সেইডাও ঢোকের সঙ্গে চোহের মধ্যে নিয়া নিছি। কান্দনের অভ্যাস আমার নাই। আমার কানতে ভালা লাগে না। আমার চোহে কোনোদিন পানি তো দূরে থাক, বাষ্পও দেহি না।

– তোমার ওইসব ন্যাকা কথা বাদ দাও, ঘরে চলো।

বলেই হাত ধইরা টাইনা রুমে নিয়া গেল। হালকা ধমক দিয়া কইলো

– ঘুমাও তোমার মতো তুমি, আমার মতো আমি।

রাসেদ কোলবালিশ জড়াইয়া শুইয়া আছে, ঘুমানোর চেষ্টা করতাছে, হইতাছে না তা বুঝা যাইতাছে। আমি ডায়রিডা বাইর কইরা লেখলাম, ওই চান তুই কেমন আছিস? তর লগে বালা কইরা কতা কইতে পারি নাই। কেমনে কমু ক, আজরাইলের মতো ওই অদ্ভুত লোকটার ডরে কইতে পারলাম না। তরা কষ্ট পাইস না, কাইল রাতে কতা কইবানে তগোর সাতে। আমি গিয়া রাসেদের পাশে শুইয়ে কইলাম

– আপনে আমার ওপর রাগ কইরেন না।

– আমার সঙ্গে কথা না বললেই খুশি হবো।

আমিও অন্যদিকে ফিইরা ঘুমায় গেলাম। ভোরবেলা দোয়েল পাখির ঘুম ভাঙ্গনের আগে আমার ঘুম ভাইঙ্গা গেল। কিছুক্ষণ বইসা থাহার পর শাশুড়ির কামে সাহায্য করলাম। মায়ের আদেশ, হ্যাগো মন জয় করন লাগব। বাড়ির সব লোকে আমারে ভারি ভালো জানে। শুধু রাসেদ আমার সঙ্গে কতা কয় না। সবার সামনে কয় ঠিক। শুধু ঘুমানোর সময় কয় না। কোলবালিশটা কাছে রাইহা সটাং হইয়া শুইয়া পড়ে, আমি যে পাশে একটা মাইয়া মানুষ আছি – সেইটা তার বোধে নাড়া দেয় না। অ নিয়া আমি দুঃখ পাই না। কুনু দুঃখ আমারে ছুঁইতে পারে না। আমি কান্দি না। একদিন জানালার ভাঙ্গা গেলাস সরাইতে গিয়া রাসেদের অনেকটা হাত কাইটা যায়। ‘মাগো’ কইয়া চিক্কুর পাইরা হাতখানরে বুহের লগে জড়ায় ধরলাম। ন্যাকড়া দিয়ে বাইন্দা দিলাম। সারস পাখির লাহান চাইয়া রইছে আমার দিক। কইলাম

– আপনেরে মনে হয় আমি ভালাবাইসা ফালাইছি, আপনের রক্ত দেহনের লগে লগেই বুহের মধ্যে দেখলাম খানিক দরদ জমা অইয়া গেল।

– আপনে না, তুমি করে বলবা, আমি তোমার স্বামী না?

– হ, স্বামী তো।

– তাহলে আপনি বলবা কেন?

বাত্তি বন্ধ কইরা শুইয়া পড়লাম। পরদিন রাতে জানলা খুইলা আসমানে চান্দের লগে কথা কইছিলাম। আসমানের তারাগুলার উদয়াস্ত দেখছিলাম। কইলাম, ওই চান কত দিন অইলো তরে দেহি না। তগোরে না দেখলে কতা না অইলে, আমার কিচ্ছু ভালা লাগে না। চান্দে আমার চোহের উপর এক মুট জোছনা ফালাই দিলো, কেমনে য্যান রাসেদ আমারে দেইহা ফালাইলো। ঠাস কইরা একখান চড় মাইরা দিলো আমার গালে। কইলো – আর কত জ্বালাবে আমারে। এমন না করে বাপের বাড়ি চলে যাও। আমি আর সইতে পারছি না। ধৈর্যের একটা সীমা থাকে। আবার শুইয়া পড়ল রাসেদ। আমি পাশে শুইয়া মনে মনে কইলাম, আমি আর চান্দের লগে পেম করমু না। পাখি, ফুল, শাপলা, কারুর লগে আর পেম করমু না। মায় কইছে স্বামীর মন জয় করতে। অহন থাইকা আমি আমার স্বামীর লগেই পেম করুম। আমি আমার স্বামীরে কইতে চাইলাম – দ্যাহ আমি আর অগোর লগে পেম করমু না, আমি তোমার লগে পেম করুম। দেখলাম রাসেদ ঘুমায় গেছে। ভাবলাম – অহন কী ডাহুম। না থাক, কাইল ভোরবেলা কইবানে। সোয়াল বেলা রোইদ যহন সিঁড়ি বাইয়া মাত্র আমগাছের মগডালে আইয়া বইছে, দেহি আমার স্বামী ফোনে কতা কইতাছে। আমিও আমার মনের কতাগুনা কওনের লাইগা কাছে গেলাম আমগাছের আড়ালে, শুনি বন্ধুর লগে কইতাছে – বন্ধু, এমন বদ্ধপাগল নিয়া আমার সংসার করা সম্ভব না। আমি ওকে তালাক দিয়ে দেবো। এভাবে জীবন চলে না। আমার জন্য মেয়ে দেখ। আবার বিয়ে করব।

বাবা-মায়ের ইচ্ছায় আর না। এবার নিজে দেখে-বুঝে করব।

কতাখান শোনার লগে লগে বুকটার মধ্যে কষ্টরা জমা হইয়া উঠল। আমার মনের কতাখান আর কওন অইলো না। ভাবলাম, বাপের কাছে বোঝা না অইয়া অন্য কোনোহানে চইলা যাই। রাইতের শেষ প্রহর আজানের পর রাসেদকে সালাম কইরা রাসেদের একখান ছবি নিয়া বাইর হইয়া পড়লাম। ডায়েরির পাতায় লেইহা রাকলাম, রাসেদ আমি পেম করতাম ফুল, পাখি, চান্দের লগে। ভাবছিলাম আজ থাইকা তোমার লগে পেম করমু। তোমার লাইগা আমার বুকখানের মধ্যে এক চঞ্চল দরদ ব্যাধি জাইগা উঠছিল। তোমারে দেহাইবার চাইছিলাম। তা আর দেহানো অইলো না। তুমি তোমার বন্ধুর লগে যা কইছিলা আমি সব কথা শুইনা ফালাইছি। তাই বাবার বাড়ি না যাইয়া অন্যহানে চইলা যাচ্ছি। আমার কিন্তু তোমার লাইগা মন পোড়ে।

ছয়

সারাদিন দানা পড়েনি প্যাটে, প্যাটটা ক্ষিদেয় চেউ চেউ করতাছে। সূর্যডা লাল অইয়া ম্যাঘের পেটের মধ্যে ঢুইকা পড়ছে। দুনিয়াডা আন্ধার অইয়া আইতাছে। সামনে রাত – কই যামু কী খামু – কিচ্ছু জানা নাই। তবু চোহে এক ফোঁটা পানি নাই। এই দুঃখও আমারে গিলতে পারল না। কান্দন আহে না। নদীর পার দিয়ে হাঁইটা কিছুদূর যাওনের পর দেহি এক বাউল গান গাইতাছে। ‘খড়কুটোর এক বাসা বাঁধলাম বাবুই পাখির মতো।’ শইলে কালা আলখাল্লা, পা অবদি পাঞ্জাবি ময়লা মাহানো। ওর বয়সে মনে হয় সোডা লাগায়নি। মুখভরা দাড়ি, মোচে ঠোঁট দুইডা খাইয়ে ফালাইছে। হাতে একখান একতারা। বাউলের পাশে গিয়া বইলাম। বাউলের একটা ময়লা লুঙ্গির পোঁটলা, পোঁটলার মধ্যে দিয়ে খেচুড়ির গন্ধ আইতাছে। বাউল বাউলের মতো গান গাইয়াই যাইতাছে, আমি যে একটা মানুষ বইসা আছি পাশে, তার গন্ধ নাহে যায় না। গানের সুর আমার কানে যায় না, কিন্তু খিচুড়ির মধ্যে নাকডা বারবার যাইয়া ডুব দিতাছে। মুহে হাত দিয়া বাউলের মুহের দিক চাইয়া আছি, কোন সুম কয় দুইডা খাইয়া লও। বাউল গান শেষ কইরা আমার দিকে চাইয়া রইছে – মনে অইলো যেন জনম এতিম, এ-জগতে আপন বইলা কেউ নাই। আমি কইলাম, আমার খুব খিদা, প্যাটটা খিদার যন্ত্রণায় বিষ জ্বালায় জ্বলতাছে। আমারে দুইডা খাওন দাও। বাউল পোঁটলার মধ্যের বাটির খিচুড়ি বাইর কইরা দিলো। আমি খাইতে খাইতে কইলাম, তুমি খাইবা না? মাথা নাইড়া কইল, না। কইলাম – খাইবা না কেন? কতা কইতে পারো না? গান তো বালাই পারো। বাউলের চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়তাছে। কইলাম – শুধু শুধু চোক দিয়ে দুঃখের ফুলকি ঝরাইওয়া না। কান্দো ক্যান? গরিবের কান্দন কেউ দেহে না। অযথা চোহের জল ঝরাইও না। সংসার-ধর্ম কিছু নাই? এই অবেলায় গান গাইতাছো এইহানে বইসা! গান গাইলে সংসার চলব?

– আমার কোনো সংসার নাই, আপন বইলা কেউ নাই। আমার আপন নদীর জলতরঙ্গ আর আসমানের পাখি।

– তয় তুমি মরছ।

– ক্যান?

– আমিও তোমার মতো ভালোবাসতাম খালর পানি, বিলর শাপলা, পাখি, চান্দেরে, তাই তো আমার স্বামী-সংসার হারাইতে অইলো। তার লাইগাই তো অহন এইহানে আইলাম।

– অহন তুমি যাইবা কই?

– ক্যান, তোমার লগে যামু।

– আমার লগে যাইতে তোমার ডর লাগব না?

– তুমিও মাইনষেরে ভালাবাস না, আমিও মাইনষেরে ভালাবাসি না, তাইলে ডর ক্যান? মাইনষের কুনু কতায় আমি দুঃখ পাই না, আমার চোহে কান্দন আহে না। কিন্তু আমি আমার স্বামীরে ভালাবাইসা ফালাইছি কারণ, সে একখান দুঃখ দেওয়া কতা কইলে, বুকখানের মধ্যে জ্বইলা ওঠে। মনে অয় কইলজাডা পুইড়া যাইতাছে, তাই বুঝলাম স্বামীর লাইগা আমার অন্তরে একটু দরদ জন্মাইছে। স্বামী অইলো আমার বুহের বল, পরানের আগুন।

– পরানের আগুন কও ক্যান, বরফ কও। আগুন দিয়ে কি পরানডারে পোড়াইতে চাও?

– নারে, বরফে পোড়াইয়া কালা কইরা ফেলে, আর আগুনে স্বর্ণ পুইড়া খাঁটি অয়।

বাউল উইঠা হাঁটা দিলো। আমিও পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলাম, নদীর পাড়ে বাউলের একখান কুঁড়েঘর। সেইহানে গিয়ে বইলাম।

– তুমি ঘরে ঘুমাও আমি খোলা বারান্দায় ঘুমাই। কইলো বাউল।

ঘরে গিয়ে চকির উপরে শুইয়া পড়লাম। বাউল আবার গান ধরলো – ‘খড়কুটোর এক বাসা বাঁধলাম বাবুই পাখির মত, এই হৃদয়ের ভালোবাসা দিলাম আছে যত।’ গান শুনতে শুনতে কহন য্যান ঘুম আইয়া গেল।

সাত

ছয় মাস পর রাসেদ জাহাজে কইরা নদীর মাঝ দিয়ে যাইতেছিল। সহসা পানির পিপাসা পাইলো, জাহাজ ভিড়াইয়া আমার ঘরের দিকে আইতেছিল, আমি সেইডা আড়ালেই দেখলাম। আইসা কয়

– কে আছেন, একটু পানি খাওয়াবেন?

আমি মুখটা ঢাইকা গেলাসে পানি দিলাম। রাসেদ আমার ডান হাতের জন্মদাগ দেইখা চিনতে পারলো, রাসেদ কইলো – আমি জানি তুমি জোনাকি, এভাবে কেন চলে আসছিলা? আবার বিয়েও করে ফেলছ, বাহ ভালো, ভালো থেকো।

– ডায়রিটা পড়েন নাই আপনি?

কোনো উত্তর না দিয়া চইলা গেল। খানিক যাইয়া ফিরা আইসা বলে,

– ডায়রিটা দেখছি ঠিক, তবে সেকেন্ড ম্যারেজের পর।

বলেই চইলা গেল। বুঝলাম না চইলা যাওনের লগেই আমার কান্দন আইছে। ছবিখান বুহের লগে জড়াইয়া মেলা কানলাম। বাউল আইয়া দেহে আমি কানতাছি। বাউল কইলো,

– ওই ছবিডা বুঝি তোমার স্বামীর?

কুনু কতা কইলাম না।

– কতা কও না ক্যান? ওই লোকটাই তো মাত্র গ্যালো এইহানদা।

কুনু কতা কইলাম না। ছবিডা বুহের লগে লইয়া শুধু হুহু কইরা কাইন্দাই যাইতাছি। বাউল খাঁচার ভেতর থাইকা পাখিডা ছাইড়া দিলো। একতারাডা লইয়া নদীর ঘাটে চইলা গেল, ঘর থাইকা শুনতে পাইলাম বাউল গান গাইতাছে – ‘খড়কুটোর এক বাসা বাঁধলাম বাবুই পাখির মতো, এই হৃদয়ের ভালোবাসা দিলাম আছে যত।’