দর্শনের ইতিহাস কম-বেশি প্রায় তিন হাজার বছরের। এই দীর্ঘ সময়কালে ফ্রিডরিশ নীৎশের মতো এত বিপরীত চিন্তাধারার দ্বন্দ্বসংকুল উজান স্রোতে খুব কম দার্শনিককে তরী ভাসাতে দেখা গেছে। এত অশ্রুতপূর্ব কথা – এমন সৌন্দর্যময় কাব্যভাষায় দর্শনচর্চা – হাতেগোনা দু-একজন দার্শনিক ছাড়া বিরল।
স্পষ্টতই নীৎশের চিন্তন, মনন, সৃজন আপাতবিরোধী। তিনি এমন এক চিন্তক যাঁকে একাধারে বইতে হয়েছে বহু সুকৃতি ও দুষ্কৃতির অন্তরালের নায়ক এবং খলনায়কের অভিধা। এমন একজন দার্শনিকের জীবন আর দর্শনচিন্তা নিয়ে গ্রন্থ রচনা কিছু দুরূহ ব্যাপার বইকি।
কাজটি দুরূহ হলেও উনিশ-কুড়ি শতকের প্রধান সব দার্শনিক ধারার অঙ্কুরোদ্গম যেসব চিন্তাবীজে তার সঙ্গে সচেতন পাঠকের পরিচয় হওয়াটা দরকারি কাজ বটে। কৌশিক জোয়ারদারের লেখা নীৎশে বইখানি সেই কাজই করেছে। গুরুগম্ভীর দার্শনিক আলোচনার বদলে এখানে সহজ-সাবলীল ভাষায় প্রাঞ্জল বর্ণনায় নীৎশে-বয়ান রচিত হয়েছে।
শুরু হয়েছে নীৎশের জীবনের গল্প দিয়ে। ছোট্ট যিশুর বিদ্রোহী হয়ে ওঠার গল্প। বহিরঙ্গে ইস্পাতকঠিন, নির্মম আর অন্তরঙ্গে এক কোমলপ্রাণ দার্শনিকের গল্প। তাঁর দর্শন – তাঁর শিল্পবোধ আর জীবনচর্যার চড়াই-উতরাই। তারপর বড় অসময়ে, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনের প্রায় মধ্যাহ্নেই করুণ এক মৃত্যু। এরপর নীৎশে যখন প্রায় ভুলে যাওয়া এক নাম – তখন নিজের চিতাভস্ম দু-হাতে সরিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়ালেন তিনি। নীৎশে দর্শনের স্বাতন্ত্র্য আর দ্যুতি নিয়ে। নিজেই বলেছেন, বর্তমানের নন – তিনি ভবিষ্যতের। তাঁর সমকাল তাঁকে গ্রহণ করেনি। কিন্তু ভবিষ্যৎ তাঁকে যথার্থই জেনেছে যুগস্রষ্টা দার্শনিক হিসেবে।
নীৎশে বলেছেন – সমস্ত লেখার মধ্যে ভালোবাসেন সেই লেখা, যা লেখক নিজের রক্ত দিয়ে লেখেন। এই শোণিতের কালি – এই অন্তর্স্রাবী জীবনের প্রগাঢ় চেতনা অনুধাবনের শক্তি দরকার পড়ে যোগ্য পাঠক হতেও। আয়েশের পাঠে – নজরুলও যাকে বলেছেন – ‘রক্তলেখা’ – তার পাঠক হওয়া যায় না। তাই বোধহয় শতাব্দী লেগে যায় তাঁর দর্শনের মর্মার্থ উদ্ধারে।
হাইডেগার, ক্যামু থেকে ফুকো, দেরিদা পর্যন্ত চিন্তাবিদদের যিনি অনুপ্রেরণা – সেই দার্শনিককে সংক্ষিপ্ত পরিসরে চিনে নিতে সাত অধ্যায়ে ভাগ করা ঊনষাট পৃষ্ঠার এই বই বেশ কার্যকর। ঝরঝরে ভাষায় সাবলীল গতিতে বর্ণিত হয়েছে এই দার্শনিকের জীবন আর চিন্তার প্রধান দিকগুলো।
নীৎশের প্রথম বই বার্থ অফ ট্র্যাজেডি থেকে সবচেয়ে আলোড়ন তোলা রচনা – ‘দাস স্পোক জরাথুস্ত্র’র মূল দিকগুলো এই বইয়ে উঠে এসেছে সংক্ষিপ্ত অথচ সারগ্রাহীরূপে। ট্র্যাজেডিকে মানুষের শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি বলে মনে করেন নীৎশে। আর এই ট্র্যাজেডির বীজ নিহিত থাকে গ্রিক পুরাণের দুই দেবতা ডায়োনিসাস আর অ্যাপোলোর দ্বৈরথে। ডায়োনিসাস – বাঁধভাঙা স্রোতের উদ্দাম আতিশয্যের প্রতীক আর অ্যাপোলো সমন্বয় ও স্বতন্ত্র আকার দানের দেবতা। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে জন্ম নেয় ট্র্যাজেডি। শুধু দ্বন্দ্ব বললে ভুল হবে – বরং বলা ভালো, এই দুই বিপরীত দিকবলয়ের সামগ্রিক এক সামঞ্জস্যই যে-কোনো মহৎ সৃজনের প্রেক্ষাপট। নীৎশের সাধনা এই মহৎ সৃজনের শ্রেষ্ঠ কারিগর অতিমানবের জন্য – সত্য যাঁর হাতে আবিষ্কৃত নয় – নির্মিত হবে।
কে এই অতিমানব? কেনই বা তিনি মানব না হয়ে অতিমানব? লেখকের জবাব, ‘অতিমানব নিয়মের দাসত্বের বিরুদ্ধে, মাঝারিয়ানার বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষের প্রতিবাদের প্রতীক।’ নিজেকে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে চলা মানুষের আত্ম-অতিক্রমের দুর্লঙ্ঘ্য পথ পেরিয়ে পৌঁছতে হয় অতিমানবের স্তরে।
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রবক্তা নীৎশে জনতার নাম দিয়েছেন – যবৎফ। গরু-ছাগলের পাল যেমন স্বাতন্ত্র্যহীন – জনতাও তেমন। অন্ধ অনুসরণ, নিয়ম আর অভ্যাসের দাস যে মাঝারি মাপের জনমানুষ – তাঁদের বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান অতিমানবের। এই অতিমানবের স্থিরলক্ষ্য সৃজনশীলতা। লেখক অতিমানবের এ-আলোচনায় সফলভাবে যুক্ত করেছেন নীৎশের চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের ধারণাকে।
লেখক কৌশিক জোয়ারদারের নীৎশের জীবন-সৃজন-চিন্তন বিষয়ে এই বইখানি নীৎশে-আগ্রহীদের একঝলক নীৎশীয় মুক্ত বাতাস এনে দেবে নিঃসন্দেহে। সেই যে নীৎশে বলেছিলেন, আমাকে চিনতে হলে নামের বইয়ে – ‘যারা আমার লেখার ঘ্রাণ নিশ্বাসে গ্রহণ করতে পারেন তাঁরা জানেন যে, এই বাতাস অনেক উঁচু অবস্থানের এবং অনেক তেজি। এজন্য একজনকে প্রথমে যোগ্য হয়ে উঠতে হয় – না হলে ঠান্ডা লেগে যাবার ছোট একটা ভয় থাকে।’ আশা করি যোগ্য পাঠকেরা এই ক্ষুদ্রায়তন বইটিতে ফ্রিডরিশ নীৎশের অনেক উঁচু আর বৃহৎ আকাশের যে প্রতিবিম্ব দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে ভালো লাগার অনেক উপকরণ খুঁজে পাবেন। বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনশৈলী দুদিক থেকেই। লেভান্ত বুকস, কলকাতা থেকে প্রকাশিত এই মনোগ্রাহী বই দর্শন-অনুরাগীদের সমাদর পাবে – এ আশা করাই যায়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.