মেলার অন্তর্লোক

মেলা বা উৎসব আসলে এক বহুত্ববাচক শব্দ। বহু মানুষের সমাগমে, সমন্বয়ে আর সংস্পর্শে জমে ওঠে যে-কোনো সামূহিক উৎসব ও মেলা। প্রথমদিকে তার সংগঠনে প্রচার ও আমন্ত্রণ করতে হয়, পরে ক্রমে ক্রমে তা জনতার মুখরিত পালনে ও অংশগ্রহণে জমে ওঠে, তারাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে, আরো পাঁচজনকে ডেকে এনে এ-ধরনের জমায়েতকে পূর্ণতা দেন। বাংলার নানাবর্গের মেলা ও বার্ষিক উৎসবের গতিপ্রকৃতি দেখে আরেকটা কথা মনে হয়। সারাবছরের সমাজ ও পরিবারবন্দি মানুষ তাঁদের যাপনে ও আচার-আচরণে একটা অনতিলম্ফ কিন্তু সুনিশ্চিত দেশজ সংস্কৃতির চর্চা ও পরিপোষণ করে চলেন। একদিকে যেমন জন্ম-মৃত্যু-বিবাহসংক্রান্ত রীতি কৃত্য, পালাপার্বণ, উপবাস-ব্রত-মাণ্সিক, দান-ধ্যান, দরগাতলায় বাতিজ্বালা, দেবস্থান-গমন, হরির লুট বা সত্যনারাণের সিন্নি – তেমনই চলে গোপালন, তুলসীবৃক্ষে জলদান, চন্দনচর্চা, ফুল ফোটানো, আকাশ-প্রদীপ জ্বালানো, গরিব মিসকিনকে দান-খয়রাত, ষেটেরা পালন আর দরিদ্রনারায়ণ-সেবা। এভাবেই এ-দেশের দেশজ সংস্কৃতি বহুদিন ধরে চলছে। নাগরিক-জীবনের যান্ত্রিকতাও কিন্তু এমনতর জাতীয় ও ভূমিজ আচরণকে পুরোপুরি পালটাতে পারে না। সে-কারণে কলকাতার গ্যাজেট-শোভিত এবং অতি আধুনিক গৃহসজ্জায় মোড়া কোনো কোনো ফ্ল্যাটেও সন্ধেবেলা বেজে ওঠে মঙ্গলশঙ্খ। ঝাঁ-চকচকে প্রকোষ্ঠের একটেরে কাঠের সিংহাসনে গৃহদেবতার সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে ধূপ জ্বালিয়ে দেন বঙ্গরমণী। সংস্কৃতির

অন্তঃশীল পরাক্রম এতটাই।

এই নিত্যদিনের জীবনের সঙ্গে জড়িত সংস্কৃতির যে-ধারা ও ধরন তার পাশাপাশি আরেক বিকল্প সংস্কৃতির ধরন দেখা যায় মেলা-মহোৎসবে। তাতে গৃহকোণের বদ্ধতা কিংবা পরিবারকেন্দ্রিক স্বার্থ থাকে না, তার সঙ্গে থাকে সকলের সংযোগ। সেখানে ছোঁয়াছুঁয়ি বা ছুঁৎমার্গ থাকে না, থাকে না জাতিবর্ণের আঁটাঘাঁটি। নাওয়া-খাওয়া-শোওয়ার কোনো বাঁধা নিয়মও থাকে না। থাকে না কাজের তাড়া কিংবা নির্ধারিত কার্যক্রম। এ হলো চিরায়ত ও লোকায়ত। উৎসবে বা মেলায় যাঁরা আসেন তাঁদের কোনো বাধ্যতা থাকে না, নিজের টানেই তাঁরা আসেন কিংবাউৎসবের টানে। তার মধ্যে কোনো স্বার্থপূরণের ক্ষুদ্রতা নেই। অবশ্য কারুর কারুর থাকতে পারে অনুচ্চারণীয় কোনো মানসিক সংকল্প বা অব্যক্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ। তবে সাধারণভাবে সমাগত জনতার বেশির ভাগ আসেন স্রেফ একঘেয়ে জীবনের ছক ভাঙতে, কেউ কেউ স্পষ্টত চান কদিনের মুক্তজীবনের ছন্দকে অঙ্গীকার করতে। অনেকে আসেন শুধু গান শুনতে – সারারাত তাঁরা অতন্দ্র হয়ে আসরে বসে গানই শোনেন শুধু। কদমখালির মেলায় আলাপ হয়েছিল এক যুবকের সঙ্গে, নাম প্রদীপ কংসবণিক – সারাবছর তার জীবিকা হলো বিড়ি বাঁধা। কিন্তু কোথাও বাউল গানের আসর বসেছে জানলেই সে চলে আসে তার হারমোনিয়াম নিয়ে। গানের সঙ্গে অবিশ্রান্তভাবে হারমোনিয়াম বাজানোই তার নেশা – তবে শুধু বাউল গানের সঙ্গে। মাঝে মাঝে পান খাওয়া আর চোখ বুঁজে হারমোনিয়ামের রিড টিপে কী যে তার পরিতৃপ্তি, দেখলে চোখ ভরে যায়।

তাহলে মুক্তি, মুক্তিই হলো বাঙালির মেলা ও মহোৎসবের প্রাণভোমরা। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথের কথা। পৌষমেলা বা মাঘমেলার উদ্ভাবন-কল্পনা তাঁরই। বাংলার মেলার নিজস্ব মর্ম আর স্বভাবধর্ম বারে বারে অনুভব করে তাঁর মনে হয়েছিল :

মেলা আমাদের দেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক। একটা সভা উপলক্ষে যদি দেশের লোককে ডাক দাও, তবে তাহারা সংশয় লইয়া আসিবে, তাহাদের মন খুলিতে অনেক দেরি হইবে। কিন্তু মেলা উপলক্ষে যাহারা একত্রিত হয় তাহারা সহজেই হৃদয় খুলিয়া আসে – সুতরাং এখানেই দেশের মন পাইবার প্রকৃত অবকাশ ঘটে। পল্লীগুলি যেদিন হাল-লাঙল বন্ধ করিয়া ছুটি লইয়াছে, সেইদিনই তাহাদের কাছে আসিয়া বসিবার দিন।

এখানে রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়েছেন হৃদয়-উন্মোচন, মন পাওয়া, অবকাশযাপন আর অবসরের আনন্দে। এসবেই তো সঠিক মুক্তি! মেলা বা উৎসবই সেই আত্মমুক্তিকে সম্ভাবিত করে, করতে পারে। ‘ছুটির বাঁশি বাজল’ তাঁর এক অমল উপলব্ধি।

অন্য এক উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ এই ছুটির ব্যাখ্যা করে বলেছেন :

আমাদের উৎসবটা কবে? যেদিন আমরা সময় করতে পারি সেইদিন।… আয়োজনটা এমনিই প্রতিদিনই ছিল, প্রতিদিনই আছে। জগৎ যে আনন্দরূপ, এইটে আজ দেখব বলে কাজকর্ম ফেলে এসেছি।… আজ বলেছি, থাক্ আজ দেনাপাওনার টানাটানি, ঘুচুক আজ আত্মপরের ভেদ, মরুক আজ সমস্ত কার্পণ্য, বাহির হোক আজ যত ঐশ্বর্য আছে। যে আনন্দ জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র বিরাজমান সেই আনন্দকে আজ আমার আনন্দনিকেতনের মধ্যে দেখব।

এই কবিকে আমরা চিনি, জগতের আনন্দযজ্ঞে যিনি স্বতঃই নিজের নিমন্ত্রণকে চিহ্নিত করতে পারেন, বিশ্বতানের ধ্রুবপদের সঙ্গে যিনি নিজের জীবনগানকে মেলাতে চাওয়ার আততি প্রকাশ করেন। কিন্তু উৎসবে বা মেলায় বাইরের আনন্দের সঙ্গে কোথাও কোথাও আত্মস্বরূপের বিভেদও ঘটে যায়। তাই তিনি ‘বেসুরে পীড়িত’ বোধ করেন, ‘তাপে তপ্ত’ হন। কেননা তাঁর চোখে না পড়ে পারে না যে, আনন্দময়ীর আগমনে যখন দেশজোড়া আনন্দ তখন ধনীর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে কাঙালিনি মেয়ে, দীনবেশে সজলনয়নে। স্নানযাত্রার সমারোহে এক পয়সায় একটা বাঁশি কিনতে না পারার দুঃখ এবং সেই দুঃখ পেরিয়ে যখন সত্যি বাঁশি বাজে, তখন তালপাতার বাঁশির আনন্দস্বর কেমন করে ছাপিয়ে যায় হাজার লোকের হর্ষধ্বনি – তারও বর্ণনা শুনেছি আমরা তাঁর সানন্দ লেখনীতে। কথাগুলো প্রাঞ্জল করে তিনি বুঝিয়ে দেন যে, প্রতিদিন আমাদের যে-সত্তা দীনভাবে নিরানন্দে কাটায় উৎসবের দিনে সে-ও বলতে চায়, আজ কেবল নেওয়া নয়, আজ আমিও সকলের সঙ্গে আনন্দ করব – আজ আর আমার দীনতা নেই, কৃপণতা নেই। একমাত্র ভাঙা হাট আর ভাঙা মেলা থেকে নিঃস্ব হয়ে ফিরতে পারে মানুষ।

এসব ভাবের কথা কিংবা দর্শনের গূঢ়তা তো সবক্ষেত্রে সত্য না হতেও পারে। কোনো কোনো গ্রামিক পরিবেশে বছর বছর প্রথার মতো আবশ্যিকরূপে যেসব মেলা বা উৎসব হয় তাতে সবটাই হয়তো আনন্দের অভিজ্ঞতা নয়। বিশেষত দরিদ্র পরিবারের পক্ষে কখনো কখনো আসন্ন গ্রাম-উৎসব যেন উৎপাতের মতো কিংবা আশংকার বেশে এসে পড়ে। সবাই তো এ-ধরনের উৎসবে প্রাণ খুলে যোগ দিতে পারে না, বা হাত খুলে খরচ করতে পারে না। তার উপরে এ-ধরনের উপলক্ষে বাড়িতে এসে পড়ে মেয়েজামাই বা অতিথকুটুম। শহুরে লোকের মতো তাঁরা ক্ষণিকের অতিথি নন, গ্রামদেশের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা তো দু-দশদিন থাকতেই আসেন, তাতে যে গেরস্তর সর্বনাশ। এমনই মনোভাবের একটা গান পেয়ে যাই বাংলাদেশের শ্রীহট্ট অঞ্চলের ধল গ্রামের লোকগীতিকার ও প্রখ্যাত গায়ক আশি-পেরোনো মানুষ শাহ্ আবদুল করীমের কাছে। আবদুল করীম বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত গায়ক, যিনি গান করতে বিলাতেও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ফাল্গুন মাসে করীমের গ্রামসন্নিহিত ধলমেলা-প্রসঙ্গে তাঁর শঙ্কিত উচ্চারণ :

ওরে মেলা দিতে জ্বালা, কার মন্ত্রণা পাইলে

এই দেশে কেন বা তুই আইলে।

প্রথম ফাগুন মাসে আসিলে নবীন বেশে

ধনীরে ভালোবেসে গরীবকে কাঁদাইলে।

আছে যাদের টাকাকড়ি মেলায় যাবে তাড়াতাড়ি

গরীবের মাথায় বাড়ি পড়িয়া ভেজালে

এই দেশে কেন বা তুই আইলে।

মেলাকে এখানে স্থানীয় উপভাষায় ভেজালের ব্যাপার অর্থাৎ অনর্থ ভাবা হয়েছে। তার আবির্ভাবে গরিবের মাথায় যেন আঘাত লাগে। কেননা,

ঘরে বেটার খাওন নাই

অতিথ আইল মেয়েজামাই

কুলমানে দিতে ছাই

      বড়ই সুযোগ পাইলে।

মেলা তোরে করি মানা

এই বেশে তুই আর আসিস না-

গরীবকে দুঃখ দিস্ না

        আবদুল করীম বলে।

এ-বিবরণ বড়ই মর্মন্তুদ ও করুণ, কিন্তু সত্য। মেলা যেন এখানে দেহধারী জীব যাকে বিপন্ন কবি আসতে মানা করছেন, কেননা তাঁর কুলমান মর্যাদা বিপন্ন।

আবদুল করীমের গান গরিবের পক্ষ নিয়ে আর্তি শুধু নয় – তাঁর বৃহত্তর চিন্তা ছিল সমাজ ও তার অবক্ষয় নিয়ে। প্রান্তিক চিন্তা থেকে আমরা অনেক সময় ভাবি বিশ্বায়নের ঘনঘটায়, ধনতান্ত্রিক পুঁজির কেরামতিতে বা মার্কিনি বৈদ্যুতিন প্রভাবে বোধহয় শুধু ভারতবর্ষেরসমাজ-সংস্কৃতি বিপন্ন। তা যে নয়, এটা যে গোটা উপমহাদেশের সমস্যা তা বুঝি না। সমস্যার সেই সামূহিক ব্যাধি এবং বিকৃতির ব্যাদান বাংলাদেশেও যে কতটা তৎপর তা বুঝিয়ে দেন আবদুল করীম, তাঁর গানে গানে। শ্রীহট্টের প্রত্যন্ত গ্রাম ধলের মেলায় তাঁর শৈশব থেকে দেখা অমলিন গ্রামীণ সারল্য ও মানুষের সামান্য উপচার নিয়ে আমোদ করার ক্ষমতা এখন যে আর নেই সেই বেদনা তাঁকে ব্যথিত করে। যেখানে করীমের বাপ-পিতামহের বাস্তু সেই হাওর এলাকায় প্রকৃতি খুব সদয় নয়। স্বচ্ছ সাবলীল ভাষায় তিনি লেখেন :

দিরাই থানায় বসত করি হাওর এলাকায়

অবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়।

হাড়ভাঙা খাটনীর বলে জমিতে যে ফসল ফলে

হয়তো নেয় বন্যার জলে নইলে নেয় খরায়।

ঘরে বসে ভাবাগুনা নৌকা বিনা চলা যায় না

বর্ষার দিনে রুজি পায় না গরীব নিরুপায়।

এমন যে অসহায় গরিব চাষিদের হা-অন্ন গ্রাম, সেখানে যখন পয়লা ফাল্গুন মেলার জৌলুস বসে তখন গৃহস্থের বিপন্নতার সঙ্গে আসে আরেক যন্ত্রণা – জুয়াখেলার নেশা। যারা মূলেই হৃতসর্বস্ব, সর্বনাশা জুয়ার নেশা সেই যুবসম্প্রদায়কে আরেকবার রিক্ত করে। তাই করীমের সতর্কবাণী :

ঠিক রাখিও মনের গতি

জুয়াখেলায় দিওনা মতি

ভাইরে ভাই দিনে ডাকাতি

        তিন তাসের খেলা।

মরমি গীতিকার যে ধলমেলাকে আসতে নিষেধ করেন তাঁর গানে, তার কারণ এটাও। অসহায় চোখে দূর থেকে তিনি আরো কত কী দেখেন। তাই জানান দেন :

দেখবে কত সার্কাসবাজি দেখলে মন হয় যে রাজি

হাতে যদি থাকে পুঁজি খাবে রসগোল্লা।

কিন্তু সবাই তো মেলায় রসগোল্লা খেতে পায় না। হায়, করীম নিজেও যে সেই দলে। তাই তাঁর দুঃখের জবানি হলো :

করীমের পয়সা নাই রসগোল্লা খাই না খাই

রস বিলাইতে আমি যাই ওগো সরলা।

এখানে রস বিলানো মানে গান গাওয়া। সরলা অর্থাৎ সরলা খাতুন করীমের স্ত্রীর নাম।

সুদূর শ্রীহট্টে সংবৎসরের ধলমেলা যদি এতটাই বিব্রত করে গরিব পরিবারকে তবে তার বৈপরীত্যে আমাদের মনে আসবেই এই বাস্তব তথ্য যে, শহরে বিশেষত ধনাঢ্য নগর-সংস্কৃতিতে এখন নানা পরিকল্পনায় গড়ে তোলা হচ্ছে নানাবর্গের মেলা বা উৎসব। তার মূলে পণ্যসভ্যতা তথা বাণিজ্যায়নের উৎকট বিলাসিতা। বিলাসী নগরবাসী বইমেলা, বিজ্ঞানমেলা, কারুশিল্পমেলা, চর্মজ মেলা, সাক্ষরতা মেলা, বিদ্যাসাগর মেলা ইত্যাদি নামের আড়ালে আসলে প্রসারিত করে তুলছে ভোগ্যদ্রব্যের প্রদর্শনী তথা বিনোদনসর্বস্ব সংস্কৃতি। তাতে মেলার জাত বদলে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত ২০০৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা কলকাতার বইমেলার এক প্রতিবেদনের অংশ দেখা যাক। ওই বছর ৪ ফেব্রুয়ারি কোনো কারণে বাংলা বন্ধ্ ছিল। তবে তাতে বইমেলার দর্শক-সমাগমে ভাটা পড়েনি। লক্ষণীয় যে, আমি বইমেলার ‘ক্রেতা’ না বলে সচেতনভাবে ‘দর্শক’ বলেছি, তার কারণ এখনকার বইমেলার দ্রষ্টব্য বস্তু বই হলেও তার ক্রেতা কম – বরং চারদিকে ভ্রাম্যমাণ দর্শকই (নারী ও পুরুষ – প্রধানত যুবক-যুবতী) বিশেষ প্রদর্শ। তাঁরা খাদ্যলোলুপ ও পানীয়-পিপাসু। রঞ্জনের চোখে পড়েছে :

বন্ধের বইমেলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল, বইমেলা কী ছিল, কী হতে পারত, কী হয়ে গিয়েছে, বিশুদ্ধ ও বহুমুখী বাণিজ্যের প্ররোচনায়। কলকাতা এখন মেলার শহর। চামড়া থেকে বিদ্যাসাগর, যে-কোনও জিনিস হেঁকে ডেকে মেলে ধরলেই মেলা হয়ে যায়। আর সব মেলাই এক মেলা : চারধারে রঙিন প্রবেশদ্বার, মাঠ জুড়ে তাঁবুর তাড়স, আলোর তাণ্ডব, একদিকে কল-বেরোনো ছোলা খাওয়ার বাঙালি লাইন, অন্যদিকে ফুচকা-ভেলপুরি, মেলার ভিতরে সারি সারি খাবার দোকান; মেলার বাঙালি, নারীপুরুষ-নির্বিশেষে সবাই ভিভ রিচার্ডস্, চোয়াল চিবিয়ে চলেছে সর্বক্ষণ।

বইমেলা দেখতে গিয়ে ঔদরিক বাঙালির ছয়লাপ দেখা তো কম বেদনার নয়। উৎসব তো পাল্টে যাবেই, কিন্তু তাই বলে বিকৃতি তো কাম্য নয়। শান্তিনিকেতনের শান্ত নির্জন উপাসনাময় পৌষমেলা এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে শুধু বিপণন ও কোলাহল, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের স্টল ও নাগর-মানসের আদেখলেপনা। দেখেশুনে লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন :

পৌষমেলায় রবীন্দ্রনাথকে কি খুঁজিনি? খুঁজেছি, তাঁর বইটই আছে স্টলে, মাইকে বোধহয় এক-আধটা গানও বেজেছিল, ঠিক মনে নেই। কিন্তু অন্য মেলার সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়?… শান্তিনিকেতনের বিশ্রুত পৌষমেলা দেখে যদি একটুও রবীন্দ্রনাথকে মনে না পড়ে বা তাঁর শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যকে, তাহলে দ্বিতীয়বার পয়সা খরচ করে যাবো কেন সেটাই প্রশ্ন।

কিন্তু কেন এতটা বদলে গেল পৌষমেলা? কেন অপ্রধান হয়ে গেল তার গ্রামীণ চারিত্রমূর্তি? তবে কি মেলার নিজস্ব কোনো বিশিষ্টতাকে আমরাই নষ্ট করতে চাই?

রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নিত পৌষমেলা কেমন ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছিল উপাসনা মন্দির-প্রাঙ্গণে আশ্রমবাসীদের সঙ্গে লোকায়ত ভূমিজ মানুষের অংশগ্রহণে তার সজীব বিবরণ পাওয়া যায় প্রখ্যাত শিল্পী প্রভাস সেনের লেখা থেকে। সমকালীন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন থেকে অংশবিশেষ উৎকলন করে তিনি দেখান :

পৌষমেলার সূচনাবর্ষে ১৮৯৪ সালে ‘দিবা দ্বিতীয় প্রহরে দীন-দুঃখীদের ভোজ্য ও বস্ত্র বিতরণ’ ও ‘সাধারণের হৃদয়ের সুশিক্ষার জন্য’ হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান গীত (গীতাভিনয়) হইয়াছিল।

১৮৯৬ সাল বরাবর মেলার নিজস্ব একটি চরিত্র গড়ে উঠতে থাকে। আগের দু’বছর শুধু মন্দিরের চারদিকে দোকানপসরা বসবার খবর পাওয়া যায়। এবছর জানা গেল ‘বেলা দু’প্রহরের পর হইতেই উদ্যানে ইতস্তত অনেকগুলি বাউলেরদল গোপীযন্ত্র বাজাইয়া ও তালে তালে নৃত্য করিয়া দেহতত্ত্ব প্রভৃতি নানা তত্ত্বগান করিয়া সকলকে মোহিত করিয়াছে।’

প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যাচ্ছে, আশ্রমবাসীরা মেলাপ্রাঙ্গণকে ক্রমশ শ্রীমণ্ডিত করে তুলছেন, ‘বৃক্ষমূলে সুরচিত বেদীতে’ বসে ‘অনেকে মহা আরামে উৎসব উপভোগ’ করছেন। ‘সাঁওতাল মেয়েরা খেলনা কিনছে।’ ১৮৯৭ সালের মেলায় বিক্রি হয়েছে ‘পুত্তলী’ এবং ‘সুশোভন কৃত্রিম ফলপুষ্প’। ১৮৯৮ সালে মেলাপ্রাঙ্গণে রাতে আতসবাজি পোড়ানোর প্রবর্তন হয়। সাঁওতাল মেয়েপুরুষরা আশপাশের গ্রাম থেকে ‘দল বেঁধে মাদল বাজিয়ে সন্ধ্যায় আসেন আতসবাজি পোড়ানো দেখতে। মেলায় খোলা জায়গা রাখা হয়েছে তাদের নাচগানের জন্য।’

১৯০১ থেকে রবীন্দ্রনাথ স্থায়ীভাবে এসে যান শান্তিনিকেতনে এবং পৌষমেলা তারপরে স্পষ্টত একটা আঁটোসাঁটো রূপ পেতে থাকে। সবরকমের গ্রামীণ শিল্পদ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় সংসারদ্রব্য, শৌখিন গ্রাম্যপুতুল, হাতপাখা, নক্শি কাঁথা, খেজুরপাতার চাটাই, সাঁওতালদের বোনা মোটা কাপড়ের থান, কাঠের ও পোড়ামাটির সন্দেশের ছাঁচ, কাঠের চিরুনি, তাঁতিপাড়ার গরদতসর, ইলামবাজারের গালাশিল্প, লাঙলের ফলা, কাস্তে প্রভৃতি বহু জিনিস বিক্রি হতে থাকে। ১৯২২ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় আচার্য নন্দলালের নেতৃত্বে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা নিজ নিজ অঞ্চল থেকে গ্রামীণ কারুশিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করে মেলায় আনত। এল্ম্হার্স্টের সহযোগী কালীমোহন ঘোষ শ্রীনিকেতনের তরফ থেকে ‘চাষিমেয়েদের হাতে তৈরি মাদুর, কাঁথা, দড়ির তৈরি শিকা, নানা নকশার পাখা আর মাটির ঘর সাজাবার বিবিধ জিনিস’ প্রদর্শন করতেন। ক্রমে বাটিক ও চামড়ার কাজ দেখানো চালু হয়। ‘এই দশকেই দশ-বারোটি ঘর জুড়ে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হলো মেলাপ্রাঙ্গণে। মেলা সরে এলো মন্দিরের চতুষ্পার্শের উদ্যান থেকে উত্তরের বিস্তীর্ণ মাঠে।’ আগে যে-পৌষমেলায় প্রধানত কলকাতা থেকে ব্রাহ্মভক্তরা আসতেন এখন ধীরে ধীরে সেখানে বিকশিত হতে লাগল শিল্প ও সৌন্দর্যের উদ্ভাস। গ্রাম ও শহরের মেলবন্ধন।

এখানে প্রভাস সেনের কলমে আমরা পড়ে নিতে পারি, কেন পরিকল্পিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, কী উদ্দেশ্যে? রবীন্দ্রনাথের সার্বিক ভাবনার ফসলই যে এ-মেলায় রূপায়ণ করার চেষ্টা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। সেই ভাবনাটা কী? প্রভাস সেনের মতে :

আশপাশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্যই প্রধানত পৌষমেলার আয়োজন বলে এই মেলায় একটি সহজ, সরল, গ্রামীণ পরিবেশ তৈরির চেষ্টা হতো সেকালে। যা-কিছু কেনাবেচা হতো তার প্রায় সবই গ্রামের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সীমার মধ্যে থাকত।

বিনোদন-ব্যবস্থাও হতো সাধারণ মানুষের মনোরঞ্জনের কথা মনে রেখে। কীর্তন, আউল-বাউল-মুরশিদদের গান, নাচ, তরজা বা কবিগান, যাত্রাভিনয়, সাঁওতাল আদিবাসীদের নাচগান, খেলাধুলা, তীর ছোড়বার প্রতিযোগিতা হতো প্রতি বৎসর। তরজা বা যাত্রার উপযুক্ত বিষয় ঠিক করে দিতেন মেলার কর্তৃপক্ষ। আশ্রমের ছাত্ররাও অনেক সময় খেলাধুলায়, বিশেষ তীর ছোড়বার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের গান রাত্রিশেষের বৈতালিক থেকে শুরু করে সারাদিন ও সন্ধ্যায় আশ্রমকে অনুরণিত করে রাখত মেলার কদিন।

দেখা যাচ্ছে, আদর্শ একটি মেলার মডেল বা ছাঁদ এবং সেইসঙ্গে সৃজনছন্দ ও আনন্দ পৌষমেলায় প্রথম থেকে ছিল। ছিল নিম্নবর্গ ও আশ্রমিকদের মেলামেশা। ছিল বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশ। ছিল রবীন্দ্রসংগীতের অবাধ     আয়োজন। তবু কেন ভ্রষ্ট হলো এই শান্ত-সুন্দর নিভৃত মেলা?

পূর্বাপর পৌষমেলার সঙ্গে জড়িত মরমি মানুষদের সতর্ক চোখ লক্ষ করেছে যে, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রশতবর্ষের ব্যাপক উপলক্ষ বদলে দিয়েছে মেলার চিত্রচরিত্র এবং মেলাস্থল। ওই বছর থেকেই মন্দিরের উত্তরের মাঠ থেকে মেলা চলে গেল পূর্বপল্লীর পাশে খেলার মাঠগুলো নিয়ে। এর ফলে শুধু স্থানগত নয়, মেলার গুণগত চরিত্র বদলে গেল – লক্ষ্যও বদলে গেল। ক্রমে ক্রমে শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও আবেগকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠতে লাগল সারা পশ্চিমবঙ্গের শহুরে মধ্যবিত্তদের বিনোদনী সমাবেশ – নাগরিক  ক্লান্তিমোচনের বিকল্প এক আয়োজন। এর ফলে দোকানপাটের বা বিকিকিনির ধরন গেল বদলে। ভোগী মানুষদের বহুমূল্য বিলাসদ্রব্যের বিপণি এবং সেই বিপণির চোখধাঁধানো চাকচিক্য ও আলোকোজ্জ্বল সমারোহ মেলার স্নিগ্ধতাকে ধ্বস্ত করে করে দিল। ‘গ্রামের মানুষদের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র সরতে সরতে হয় মেলার বাইরে নয়তো রাস্তার ধারে বা কোনো অবহেলিত কোণে স্থান পেল।’ সাজানো ফিটফাট মঞ্চে স্পনসরের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে আয়োজিত হলো বাউল-ফকিরদের গানের চমৎকৃতি। রবীন্দ্রসংগীত নয়, মেলাপ্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠল হিন্দি ফিল্মিগানের দৌরাত্ম্যে।

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার এমন ব্যবহারিক বিস্তৃতি, এত উচ্চকিত আড়ম্বর এবং রবাহুত ‘বোটু’ (বোকা টুরিস্ট)-দের বেআন্দাজি কেনাকাটায় ছত্রাকার দৃশ্যময় বিকৃতি আমাদের বুঝিয়ে দেয় উত্তর-আধুনিক সমাজের মতিগতি। বিপণনসর্বস্বতা আমাদের অন্তর্গত ধ্যানময়তাকে কীভাবে ভেঙে দেয়, কতটাই কোণঠাসা করে শ্রীসৌন্দর্যকে, তা দেখতে যে-কোনো আধুনিক মেলা বা উৎসবপ্রাঙ্গণ আদর্শ উদাহরণ। মরমি কবি শঙ্খ ঘোষ এখনকার পৌষমেলা দেখে ভাবেন স্রষ্টা ও রূপকার রবীন্দ্রনাথের বলা সেই বাণী, সেই আহ্বান, যা তিনি সগর্বে উচ্চারণ করেছিলেন এই ভাবে যে,

আপনাদের দেখে যেতে হবে আমাদের এই অনুষ্ঠান। দেখে যেতে হবে দেশের উপেক্ষিত এই গ্রাম, বাপ-মায়ের তাড়ানো সন্তানের মতো এই গ্রামবাসীদের… কোথায় আমাদের দেশের প্রাণ, সত্যিকার অভাব অভিযোগ কোথায়, তা আপনাদের দেখে যেতে হবে।

এই পর্যন্ত উদ্ধৃত করে লেখক একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মন্তব্য করেছেন : ‘মেলার থেকে হারিয়ে গেছে শুধু দেশের প্রাণের দিকে তাকিয়ে সেই দেখাটুকু।’ বাংলার সব উৎসবে-মেলায়-সমাবেশেই সম্প্রতি কি এই রিক্ততা দেখি না আমরা? অথচ রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন একটু অন্যরকম করে। তাঁর সংকল্প ছিল : ‘আমাদের উৎসবকে হঠাৎ একদিনেই সাঙ্গ করে দেবো না – এই উৎসবকে আমাদের দৈনিক উৎসবের মধ্যে প্রবাহিত করে দেবো।’