জিওল মাছ

কানাই কুণ্ডু

জিরানিয়া পেরোতেই পাহাড় শুরু। বাঁশ বেত শাল সেগুন কলা কাঁঠালের ঠাসা জঙ্গল। পাহাড়ের কোলঘেঁষে সর্পিল পাকদণ্ডিতে আগরতলা-গুয়াহাটি হাই-ওয়ে। আট-দশ মিটারের ব্যবধানে রাইফেল, মেশিনগান কোলে ঝিমন্ত পুলিশ-মিলিটারি। তাদের সশস্ত্র অস্তিত্ব প্রমাণ করে অঞ্চলটি উপদ্রুত। খুন-জখম পণবন্দি প্রতিদিনের খবর। তেলিয়ামুড়া পেরিয়ে আঠারোমুড়া আর লঙতরাইয়ের মাঝে ছোট সমতল আমবাসা। হাট বাজার দোকান আড়ত। এই অঞ্চলেরই এক পাহাড়ি গ্রামে নিজের মরণের পরোয়ানা পকেটে নিয়ে বিধুশেখরের নিরুপায় হাজির হওয়া।

বাঁচার তাগিদে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসা। অন্য বিকল্প ছিল না। আর মৃত্যুভয় আছে বলেই না এই চাকরি। নয়তো তার চেয়ে যোগ্যতর হাজার প্রার্থী থাকতে শেষে কি-না বিধুশেখর! অনার্স নেই, বি এড নেই, পাশ ডিভিশনের ডিগ্রি। এতেই সহকারী প্রধান!

অবশ্য বিজ্ঞাপনে ফুটনোট ছিল। লিখিত পরীক্ষার ফল অনুযায়ী একবছর প্যানেলে নাম। হিল/রিমোট এরিয়ায় কাজের ঐচ্ছিক সম্মতি এবং নিম্নবর্গ/ তফশিলিভুক্ত হলে বিশেষ অগ্রাধিকার।

বিধুশেখর হিল/রিমোট এরিয়ায় টিক দিয়ে দরখাস্ত পাঠিয়েছিল।

পার্টির দাদা, ভোটের বাবু ধরে কয়েকটা সরকারি-বেসরকারি পরীক্ষা-ইন্টারভিউ দিয়েও মাসিক রোজগার আঠারোশোর ওপরে তুলতে পারেনি। সকাল-বিকেলে টিউশনির পুরুত দৌড়। তবুও সংসার গলাডুবি গহ্বর। চারটে রাক্ষস হাঁ করে থাকে। মুদির দোকানে পাঁচশ টাকা ধারের মাত্রা প্রথম সপ্তাহেই ছুঁইছুঁই। ঠাকুরদা মার্কা বাড়ির অর্ধেক ভাড়া দেওয়া। তাই কি নিয়মিত পাওয়া যায়! যেমন বাড়ি, তেমন ভাড়াটে। জগৎবাজার ফুটপাথের হকার। প্রায়ই তার সিজিন খারাপ। সংসারে অনটন থাকলেও বাবার রক্তে চিনি অত্যধিক। মায়ের উচ্চচাপ। অ্যালোপাথি চালানো যায় না। ইদানীং কবিরাজি। ছোটবোন দাদার এলেম বুঝে টেইলারিং শিখে ব্লাউজ      কারখানায়। ব্লাউজপিছু মজুরি দশ টাকা। দিনে পাঁচটার বেশি উতরোয় না। শেষের দিকে তার কাছেই হাত পাততে মনে হয়, মরে যায় না কেন বিধুশেখর!

এই সময়েই পোস্টিংয়ের চিঠি। মা-বাবা আতঙ্কে আকুল, যাইস না বিধু। আমাগ লবণ আর বাত জুটলেই শান্তি। বন্ধুরা বলে, মাথা খারাপ! আগে প্রাণ।

কিন্তু বয়সের দৌড়ে বিধুশেখর মাঠের        প্রান্তসীমায়। এরপর সরকারি চাকরি দুর্লভ। সুযোগ দুবার আসে না। মাইনের স্কেল, হিল অ্যালাউন্স মিলিয়ে যোগফল ঘুমোতে দিচ্ছে না। তাছাড়া, নিজস্বতা বলে তো কিছু একটা আছে। প্লেইন চারমিনারের বদলে ফিল্টার, চায়ের সঙ্গে একটা সিঙ্গাড়া বা একটা মিষ্টিপাতা পান। চাকরিতে কেবল মাইনে নয়, প্রমোশন পি এফ গ্র্যাচুয়িটির নির্ভরতা।

নাহ, যে-শহর তাকে বেঁচে থাকার মতো মামুলি একটা চাকরি দিতে পারে না, তার জন্যে সে কেন হেদিয়ে মরবে!

অতএব বিদায়। বিদায় ছুটির বিকেলে গুমতির পাড়ে সবুজ বিছানায় শুয়ে থাকা। পাশে নন্দিতা। তার নরম হাত বুক ঠোঁট। মুগ্ধ চোখের অসফল স্বপ্ন। বিদায় নন্দিতা। বিদায় কামান চৌমুয়ানী মোড়ের রসালো আড্ডা। মন্ত্রীবাড়ি রোডে টিউশনির ছাত্রী রেশমির কাঁপাকাঁপা আধো ভেজা হাত। বিদায় আগরতলা।

চটি। সাধারণ নকশাকাজের পাঞ্জাবি। চশমা। কাঁধে গর্ভিণী ব্যাগ। বাস থেকে নেমে নিজেকে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে বিধুশেখর। সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। মনের মাঝে ছমছমে ভয়।

পেছন থেকে নিঃশব্দে কয়েকজন পাহাড়ি মানুষ তাকে ঘিরে ফেলেছে। একজন কাঁধের ব্যাগটা টেনে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়। বিধুশেখর প্রতিবাদ করতে পারে না। বুক ধড়াস ধড়াস করে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কাজে যোগ দেবার আগেই পণবন্দি! কিন্তু লাখ লাখ টাকার দাবি মেটানোর ক্ষমতা তাদের নেই। হয়তো বুকে রক্তাক্ত ফুটো নিয়ে নিথর নির্জনে পড়ে থাকা।

মধ্যবয়সী পাহাড়িটি দলনেতা। ভ্রƒহীন থ্যাবড়া মুখে খ্যাঁদা নাকের হাসি ছড়িয়ে বলে, আগরতলাথুন আইলেন নাহি?

হ্যাঁ… না… জড়িত স্বরে কী-যেন বলে বিধুশেখর।

পাশের মানুষটি লাল ঘোলাটে চোখে তাকায়। বলে, দেইখাই বুঝসি, আপনে আমাগ দ্যাশের মানুষ না।

তারা নিজেদের ভাষায় কী-যেন আলোচনা করে। একবর্ণও বোঝে না বিধুশেখর। পণবন্দি অথবা খতম। হয়তো এমনই কিছু আলোচনা। ষণ্ডামতো একজন এগিয়ে আসে। মধ্যবয়স্ককে দেখিয়ে বলে, হেরে নমস্কার দ্যান।

বিধুশেখর সন্ত্রস্ত নমস্কারে বলে, আপনাদের পরিচয় ঠিক জানা নেই। ভাষাও বুঝি না।

দ্যাশটারেত দখল করছেনই, ভাষাখানও চাপাইয়া থুইলেন। হেইডাই আবার সরকারি ভাষা। আমাগ পোলাপানও অখন দ্যাশের ভাষা ভুইল্যা আপনেগ ভাষা কয়।

বিধুশেখর নিরুত্তর। নিজেদের দেশ-মাটি ছেড়ে তার ঠাকুরদা অন্য অনেকের মতো এদেশে এসেছিলেন। ঠোঁটের ভাষাও সঙ্গী ছিল। কিন্তু তার জন্য বিধুশেখর দায়ী নয়। সে বলে, এটা আমারও দেশ। এখানেই আমার জন্ম।

ঠিক আসে। অখন চলেন।

বধ্যভূমিতে! আঁতকে ওঠে বিধুশেখর। জড়িত স্বরে জানতে চায়, কোথায়?

আরে আপনেরে তো কওয়াই হয় নাই। হে রিয়াংমশয়, আপনের ইস্কুলের ছেক্রেটারি। আমি অনাদি ত্রিপুরা, প্রেসিডেন্ট। হে গপাল বর্মা, মেম্বার। আর হে অইল আপনের বাহন। মানে পিয়ন, ছুবল দ্যাবনাথ।

বিনিময়ে ষণ্ডামার্কা লোকটির নোংরা দাঁতে আকর্ণ হাসি।

পাহাড়-জঙ্গল চিরে শীর্ণ সিঁথিপথ। ঢেউ ঢেউ উপত্যকায় গ্রাম জনপদ। নুড়ি পাথরের ওপর ঝকঝকে জলধারায় সর্পিল নদী-খাল। অবলীলায় তিনটি মোটর সাইকেল এগিয়ে চলে। সেক্রেটারির পেছনে বিধুশেখর হাতল আঁকড়ে বসে থাকে। যেতে যেতে অন্ধকার ঘনায়। টিমটিমে আলোর বিস্তারে নক্ষত্রময় গ্রাম। বাঁশবনে মাথার ওপর কাজলা দিদির চাঁদ। বাঁশের ডগালি হাওয়ার দোলায় বারবার চাঁদকে ছুঁয়ে যায়। দূর বনপথে পাহাড়ি সুরে কেউ গান গেয়ে হেঁটে যায়। দূরায়ত মূর্ছনায় বিধুশেখর বিহ্বল।

রিয়াংমশাই সংবিৎ ফেরায়, হোই দিকে কী দ্যাখেন? আইয়া পড়সি। নামেন। এই আপনের বাসা। ল ছুবলা, তালা খুইল্যা দে। বাতি জ্বালা। বাসায় খবর দে। চা মিষ্টি আনবার ক।

দরজা ঠেলে যে-ঘরে ঢুকেছিল বিধুশেখর, আজও সেটাই তার আস্তানা। টিনের চাল। পাকা দেওয়াল। তাপ এড়াতে দরমার শিলিং। সেখানে আলকাতরার গাঢ় পোঁচ। আলো জ্বালালে অন্ধকার বেশি মনে হয়। আকাঠের নড়বড়ে তক্তপোশ। হাতলভাঙা চেয়ার। টেবিল। দুটো বাঁশের মোড়া। এর জন্য সরকার থেকে ভাড়া পায় রিয়াংমশাই। জানালার ওপাশে ছড়ানো পাহাড়। ক্রমশ উত্তরের সীমায় ওপরের দিকে ছড়িয়েছে। চোখ বুজলে বরফের হিমেল স্পর্শ পায় বিধুশেখর। বছরের অধিকাংশ সময়েই শীতের কাঁপুনি। রাতের নক্ষত্র থেকে হিরণ্য জল ঝরে মিহিন নৈঃশব্দ্যে।

প্রায়ই এই নিসর্গ সুষমাকে ছিঁড়েখুড়ে কোনো মহল্লায় আর্তনাদ। গুলির শব্দ। খরপোড়া কালো আকাশ বিধুশেখরকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। ভেতরে হাতুড়ির শব্দে বাজতে থাকে, দেইখাই বুঝসি, আপনে আমাগ দ্যাশের মানুষ না!

স্কুলের চেয়ারে বসে বিধুশেখর প্রথম দিনই  টের পায়, সরকারি খাতায় সহকারী হলেও বাস্তবে সে-ই প্রধান। আরো বোঝে চেয়ারের পায়া রিয়াংমশাইয়ের হাতের নাগালে। ছোট্ট টুসকিতেই নড়ে যেতে পারে। অধস্তন তিন শিক্ষকের রিয়াংমশাইয়ের প্রতি বিনীত আনুগত্য অমূলক নয়। তারা আঞ্চলিক মানুষ। ধর্মনগর কৈলাশহরের দিকে বাড়ি জমি। কমিটি-মেম্বার থেকে পিয়ন, সবাই আঞ্চলিক এবং এই      চিরহরিৎ নির্জনতায় লুকিয়ে আছে আতঙ্ক ও প্রতিবাদের লড়াই। এদের মাঝে সরকার কেন যে তাকে নির্বাসনে পাঠাল, বিধুশেখর ঠিক বুঝতে পারে না।

তার ভাঙা জীবনের অসহায়তায় এই নিদারুণ আক্ষেপ তাকে ক্লান্ত করে। অনিচ্ছুক পেশার এই মুদ্রালোভ অভিশাপ মনে হয়। তবু ছাঁচ-বদলের নিয়ন্ত্রণে নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও জঙ্গলের লতাপাতায় জটপাকানো রহস্যময়তায় জটিল। যা কিছু উলটে দেখে, কেবল গোঁজামিল। রিয়াংমশাইয়ের আত্মঘাতী হিসাবের কাগজে তাকে সই দিতে হয়। মেনে নিতে হয়, স্কুলের পরীক্ষায় ঢালাও পাশের ব্যবস্থা। বিগত দশ বছরে বোর্ডের পরীক্ষায় পাঠানো ছাত্রের সংখ্যা পাঁচশ আশি। পাশের হার শতকরা তিন। বছরের পর বছর কেউই পাশ করে না।

মুক্তির পথ খুঁজে পায় বিধুশেখর। আগরতলা বা পাশের মফস্বলে বদলি পেতে হলে তাকে এলেমের প্রমাণ দিতে হবে। এবং আচমকা নয়, ক্রমান্বয়ে।

ক্লাসের সেরা ছাত্র বাছতে গিয়ে পাঁচজনও হয় না। তবু পাঁচজনকে বিনা পারিশ্রমিকে সান্ধ্য কোচিংয়ের শুরু হয় তার মুক্তির সাধনা। অমানুষিক শ্রমে ও নিষ্ঠায় দিনের পর দিন যায়। এবং স্কুলের ইতিহাসে এই প্রথম সেই পাঁচ জনই বোর্ডের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। দুজন দ্বিতীয় বিভাগে। রিয়াংমশাইয়ের হলুদ বরণ গালফোলা মেয়ে বিধুশেখরকে ঝুমকো জবার মালা দেয়। স্বয়ং রিয়াংমশাই অনাদি ত্রিপুরা ইত্যাদি কমিটি-মেম্বার এবং সফল ছাত্রের অভিভাবকরা হাতে তালি দিয়ে সংবর্ধনা জানায়।

বিধুশেখর খুশি হয় না। সাঁইত্রিশ জনের মধ্যে মাত্র সাতজন! এ-ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। কিন্তু তার আগে জমি তৈরি করতে হবে। নিজের অপরিহার্যতা বোঝাতে হবে। অতএব অপেক্ষা এবং ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখা।

পরের বছরও উনচল্লিশের মধ্যে ছয়। দ্বিতীয় বিভাগে এক। স্কুলের খ্যাতি পাহাড়ি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের গাঁ-গেরাম থেকে ছাত্ররা ভর্তি হয়। ক্লাসরুমে জায়গার অকুলান।        বাড়তি ফান্ড এবং স্কুল বিল্ডিংয়ের আবেদনপত্র নিয়ে বিধুশেখর রিয়াংমশাইয়ের দ্বারস্থ। বলে, এ-বছর থেকে ঢালাও পাশের ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে।

ভ্রƒহীন শান্ত চোখে রিয়াংমশাইয়ের প্রতিক্রিয়া, তয় আপনে এহানে থাকবার পারবেন না।

থমকে যায় বিধুশেখর। মাসিক সাড়ে সাত হাজার টাকার নির্ভরতা টাল খায়। বলে, আপনার সুনাম, স্কুলের সুনামের কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা চালু করা দরকার। দূরের বহু ছাত্র এসে ভর্তি হবে। হোস্টেল-বিল্ডিং গড়তে হবে। আপনার লাভ সরকারি খাতির এবং বাড়তি অনুদান।

পারবেন আপনে এইসব, যা কইলেন?

আপনি পাশে থাকলে পারব।

জাগাটা তো ভালা না মাস্টার। পোলাপানগ আজকাল মাথা গরম। তাগ হাতে বন্দুক।

কিন্তু বেশির ভাগ ছাত্র পড়াশোনা করতে চায়। পাশ করতে চায়। চাপ থাকলে ভালো ফল করবে।

অ্যাতগুলান টাহা সরকার দিত না।

নিশ্চয়ই দেবে। বাঁশবনে তো আর ক্লাস চলবে না। ছাত্রদের মাঠেও রাখা যাবে না। বিল্ডিং, হোস্টেল গড়ার টাকা দিতে বাধ্য হবে। আমাদের কেবল শিক্ষার মান বজায় রাখতে হবে।

জীবনের মান বজায় রাখতেই সরকার কিসু দেয় না, তয় আবার পাহাড়িগ শিক্ষা। খালি প্যাটে শিক্ষা হয় কেমনে, কন সাই!

স্কুল-বিল্ডিং, হোস্টেলের টাকা, ফান্ডের বৃদ্ধি আপনি চান না?

টাহা কুন শুয়োরের বাস্সা চায় না! তবে এতডা কাল তো এক ফইসাও বারে নাই। অপারগ না অইলে সরকার দিবার চায় না।

এখন স্কুলের ছাত্রসংখ্যা কত আপনি জানেন? বাড়তি ফিজ পাচ্ছেন প্রতি মাসে। বোর্ডের পরীক্ষায় স্কুলের সাফল্য প্রমাণিত। বোর্ডের চাপেই সরকারকে দিতে হবে।

বিল্ডিং, হোস্টেলের ঠিকা পামু তো?

স্থানীয় কন্ট্রাক্টরদের মধ্যে নিশ্চয় টেন্ডার বিলি হবে।

তয় ঠিক আসে। দ্যান, সই মাইরা দেই।

স্কুলে নোটিশ টাঙানো হয়। বোর্ডের নির্দেশ অনুযায়ী পাশ-নম্বর অর্জনে ব্যর্থ হলে ছাত্র অকৃতকার্য বিবেচিত হবে। ছাত্র বা অভিভাবকের আবেদন গ্রাহ্য হবে না।

ছাত্র বা অভিভাবকদের মধ্যে এ-ব্যাপারে কোনো গুঞ্জন নেই। সেই ঢিলেঢালা ভাব। বার্ষিক পরীক্ষা এবং টেস্টের পর বোর্ডের নোটিশে পাশের তালিকা ঝুলিয়ে স্কুলে সাতদিনের ছুটি।

আজ স্কুল খুলেছে। বিধুশেখর বোর্ডে পাঠানোর উপযোগী একুশ জন ছাত্রের তালিকা-পরীক্ষায়  ব্যস্ত। এদের মধ্যে দশজনকে বেছে নিয়ে বিশেষ কোচিং। এ-বছর অন্তত একজনকে প্রথম বিভাগে পাশ করাতেই হবে। বিশেষ নজর …

বাইরে হল্লা। বিধুশেখরের কলম থেমে যায়। সুবলকে খোঁজ নিতে বলে। সুবল বলে, ছার, ছাত্ররা বেবাক বাইরাইয়া পরসে। তাগ বাপ দাদা কাকারাও লগে আসে।

বিধুশেখর রিয়াংমশাইকে ডেকে পাঠায়। সুবল ফিরে আসে। বলে, কত্তা বাসায় নাই। ধর্মনগর গেসে।

তার বলার ভঙ্গিমায় মিথ্যা প্রকট হয়। বিধুশেখর বাইরে আসে। ছাত্রদের ধমক দেয়। তোমরা বাইরে কেন, ক্লাসে যাও। তোমাদের অভিভাবক আছেন। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলছি। অভিভাবকদের বলে, আপনাদের মধ্যে দুজন ভেতরে আসুন।

অভিভাবকেরা তিনজন আসেন। তাদের অভিযোগ, প্রমোশনের লোভে নিজের খ্যাতি বাড়িয়ে ছাত্র ফেল করানো চলবে না।

বিধুশেখর জানত, এই ক্ষোভের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। কিন্তু পাশে কেউ থাকবে না,       এমনকি সতীর্থ শিক্ষকরাও না, ভাবতে পারেনি। শান্ত গলায় বলে, এটা কমিটির সিদ্ধান্ত। আমার একার নয়। তাছাড়া আপনারা নিশ্চয়ই গ্রামের সুনাম চান। ছাত্ররা উচ্চশিক্ষিত হোক, দেখতে চান।

পাহাড়িগ চাকরিতে দশ ক্লাস পড়া লাগে। ফাস লাগে না।

সে তো নিম্নস্তরের চাকরি। সরকার এখন       পাহাড়ি ট্রাইব্যালদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। উন্নতমানের চাকরিতে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা। ছেলেদের মন দিয়ে পড়তে বলুন। পরিবারের গৌরব হয়ে উঠবে। দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।

দ্যাশের কথা কইয়েন না। হেডা আমাগ। আমরা হেই ইস্কুল রাখুম না। আমাগ ন্যাতারা ককবরক ভাষার ইস্কুল খুলব কইসে।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা আমরাও চাই। আপনারা বরং সেই আন্দোলন ঠিকভাবে করুন। আমি সঙ্গে থাকব।

আমরা আপনেগ বিশ্বাস পাই না।

বিধুশেখর ক্ষুব্ধ। বিপদে কেউ পাশে থাকে না। এবং এই বিপদ দীর্ঘস্থায়ী। অবস্থার পরিবর্তনে সময় এবং মানসিকতা দরকার। একক প্রচেষ্টায় একান্তই কঠিন। রিয়াংমশাই কেবল পয়সা চেনে। বিপদ দেখলে ঘাপটি মেরে থাকে। থিতিয়ে গেলে বাইরে এসে আবার কত্তামশাই।

রাত্রি মাত্র সাড়ে আট। অথচ চরাচরে মধ্যরাত্রির স্তব্ধতা। একটি কণ্ঠস্বরও নেই। জঙ্গলে শেয়াল খটাশের খুটখাট। দূরের হাইওয়েতে পাহাড় টপকানো মালবাহী ট্রাকের গোঙানি। সুবল      সন্ধ্যায় রান্না করে ঢেকে রেখে গেছে। সান্ধ্য ছাত্ররাও ফিরে গেছে। বাঁশবনে ঝিঁঝিঁর টানা বেহাগ। দরজায় কি কেউ টোকা দিচ্ছে? খুট খুট খুট খুট। ওই আবার। বই বন্ধ রেখে কান পাতে বিধুশেখর। কে?

চাপা গলায় উত্তর, আমি, মনোজ?

কোন মনোজ?

আপনের ছাত্র।

খুলে দাঁড়াতেই ভেতরে ঢুকে দুই পা ছুঁয়ে প্রণাম। বিধুশেখর বিরক্ত। এত রাত্রে! কী দরকার?

ছার, আমারে ত ফাশ করণ লাগে।

মানে!

আমাগ কমান্ডার কইসে, বোর্ডের পরীক্ষা দিলেই আমারে ছুবেদারের প্রমোশন দিব।

থমকে যায় বিধুশেখর। সে জানে, তার স্কুলের কিছু ছাত্র উগ্রপন্থি আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে। অ্যাকশানে যায়। নিরীহ মানুষ পুলিশ মিলিটারি খুন করে। পণবন্দি করে আটকে রাখে। দুই ছাত্র সম্প্রতি মিলিটারির গুলিতে নিহত। একজন মেধাবী ছিল। কিন্তু মনোজের সব বিষয়ের নম্বর যোগ করলেও একশ হয় না। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, একটু মন দিয়ে পড়াশোনা করো। একটা বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

হের সময় নাই। আগে আমার প্রমোশন। দ্যাশ।

ঠিক আছে। এখন যাও। ভেবে দেখব।

অভিভাবকদের বিক্ষোভ চলতে থাকে।

দেওয়ালে পোস্টার পড়ে। এতে সতীর্থ শিক্ষকরাও যে জড়িত, তাদের নীরবতায় বুঝতে পারে। একদিন রিয়াংমশাই রাতের অন্ধকারে হাজির। বলে, ঝামেলি কইরেন না মাস্টার। হগ্গলেরে বোর্ডে পাঠাইয়া দ্যান। ফাশ ফ্যাল অগ ভাইগ্যের ব্যাপার।

তা আর হয় না রিয়াংমশাই।

ইস্কুলের সুনামে আমাগ কুন কাম! ছ্যামড়াগ মনোভাব ভালা না।

তাহলে ফান্ডের বাড়তি টাকা, স্কুল-বিল্ডিং, হোস্টেল স্থগিত?

স্থগিত মানে, বাদ! হেই কথা কইলে জিব্বা ছিঁড়া ফালামু মাস্টার। কন্টাক পাইতে বিস্তর খরচা করসি।

দুরকম সুবিধা আদায় চলতে পারে না। চুয়াল্লিশ জনকে পাঠিয়ে পাঁচ জন পাশ করলে কাজ আটকে যেতে পারে।

এক কাম করেন, আপনে ছুটিতে আগরতলায় যান। দিন পনেরো পরে আইসেন। ততদিনে ঘুলা জল থিতাইয়া পড়ব।

বারো দিনের মধ্যে বোর্ডে লিস্ট পাঠাতে হবে।

তয়, দশেক দিন পরে আইয়েন।

বাস থেকে নেমে সোজা শিক্ষাদপ্তর। অনেকেই তার প্রশংসা করে। বলে, পাহাড়ের কোনো স্কুলে এমন রেকর্ড নেই। এই স্কুলও এতদিন ছিল লিস্টের নিচের দিকে। মাত্র তিন বছরে আপনি হাল বদলে দিলেন। সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে যান।

আশান্বিত বিধুশেখর। সেক্রেটারির কথায় কণামাত্র আশ্বাস পায় না। পাকা স্কুল-বিল্ডিং, হোস্টেল বা বাড়তি অনুদানে তার কী লাভ! তার একটাই প্রার্থনা। অপরিসীম শ্রম এবং বিপন্নতার বিনিময়ে ওই পাহাড় থেকে মুক্তি। বুক ভরে শ্বাস নেবার মতো কোনো আপাত শান্ত অঞ্চল, যেখানে অপমান ভয় হুমকি ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা আছে।

সেক্রেটারি তাকে ওই স্কুলেই রেখে পাহাড় অঞ্চলের আদর্শ বিদ্যায়তন গড়তে চান,           যাতে অন্যান্য স্কুলও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে   পারে। তবে তার প্রমোশনের কথাও না-কি ভাবা হচ্ছে।

অসহায় শূন্যতায় বাড়ির পথ ধরে বিধুশেখর। প্রায় সাড়ে তিন বছর পরে ফেরা। নন্দিতাহীন আগরতলা। অনেক বদলেছে। ঘিঞ্জি হয়েছে আরো। ছোট হয়ে যাচ্ছে আকাশ। সবুজ লোপ পেয়েছে। বিনা চিনির চায়ের মতো বিস্বাদ। মানুষের ভিড় যান্ত্রিক আবর্তনে ছোটাছুটি করে। সন্ধে হলে ঝিমোয়। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতেই পরিহাস। এই পাহাড়িটা আবার কবে এল! তরে অখনো বাঁচাইয়া রাখসে। পাহারি মাইয়া বিয়া করসস না-কি!

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে মাঝে একবার এসেছিল। মাত্র দিন তিনেকের জন্য। বছর দুয়েক আগে। কোথাও তেমন বেরোতে পারেনি। কিন্তু এবার সে নিজের বাড়িই চিনতে পারে না। রাস্তার দিকে তার ঘরের সামনে আধা চাঁদ সিঁড়ি। পাল্লাখোলা। ওপরে সাইনবোর্ড। বোনের রেডিমেড ব্লাউজের দোকান। তিনটে সেলাই মেশিন চলছে খরর খরর। উঠোনে পাকা দেওয়ালের বিভাজন। ওপাশে নতুন ভাড়াটে। সংসার এখন শামুকের মসৃণতায় গড়িয়ে চলে। রোজগেরে ছেলে বাড়ি আসায় রান্না হয়েছে বিশেষ পছন্দের। স্বাদ পায় না বিধুশেখর।

কেউ জানতে চায় না পাহাড়ের চাকরিতে তার কী অসুবিধা। বা কোনো বিপদ-আপদ। চাকরি ছেড়ে ফিরেও আসতে বলে না। এলেও তার থাকার ঘর এখন দোকান। তাকে নির্বাসিত   ভেবেই এই সংসারের সকাল-সন্ধে। নিজেরই বাড়িতে সে যেন মাত্র কয়েকদিনের অনাত্মীয় অতিথি। খাতির-যত্ন থাকতে থাকতে কেটে পড় বাবা!

আবার সেই ঢেউ তোলা বনপথ। সেই নুড়িপাথর। হিমেল ছোঁয়ার খাল নদী। পরান্মুখ শহর থেকে ছিটকে আসা বিধুশেখর। ছলকে পড়া বিকেলের আলোয় ফিরতে থাকে। হাওয়ায় বাঁশবন দোলে। হলুদ পাতা ঝরে। প্রজাপতি ওড়ে। কল্যাণপুরের আকাশে ধোঁয়া দেখা যায়। হয়তো অ্যাকশন হয়েছে।

পাহাড়ের ছায়ায় ঢাকা মুগ্ধ গোধূলি। পাখি ডাকে। অন্ধকার নামে। হঠাৎ বাঁশ কুল কন্টিকারির ঝোপ থেকে কে যেন সামনে লাফ দিয়ে পথ আগলায়। অল্প আলোয় ঠিক চিনতে পারে না বিধুশেখর। কালো প্যান্ট, কালো রঙের মাঝে লাল ছোপ দেওয়া গেঞ্জি। মাথায় টুপি। কাঁধে ঝোলানো খাটো বন্দুক। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই পেছনে সরে আসে বিধুশেখর।

আমারে চিনসেননি ছার?

কে?

মাথার টুপি খুলে হাসে মনোজ। বিধুশেখর অবাক। তুমি এখানে কেন! স্কুলে দেখা কোরো।

আপনে ছুটিতে সিলেন। তাই দেখা হয় নাই।

এবারে সম্ভব নয়।

হঠাৎ বদলে যায় মনোজ। আমার চ্যাম্বারে বিশখান গুলি আসে, বলে বন্দুকে থাবা দেয়। ক্যান খরচ করি নাই জানেন?

বিধুশেখর নিরুত্তর।

আমারে ফাশ করণ লাগে। নামডা পাঠাইয়া দিয়েন। আচমকাই বাঁশ সেগুন শালের বনে উধাও হয় মনোজ। পাহাড় জঙ্গল আবার আগের মতোই শান্ত ছবিটি। কেবল বিধুশেখরের মনে ঝড় দোলা দেয়। ভাবে, আজ মনোজ। কাল বিজন। পরের বছর সন্তোষ। অথবা…