কাজী রাফি

মেয়েটির চাউনিই শুধু যৌনাবেদনময় তা নয়, বরং তার দৃষ্টির ভঙ্গিমায় কি এক রহস্যময়তা! বুলেটের শব্দ, তরঙ্গিত সাগর-ঢেউয়ের মাঝে মানুষের ক্রন্দনরত আর্তনাদ সব ছাপিয়ে কৌশিকের দৃষ্টি গেল সাগরসৈকত পেরিয়ে বয়ে চলা রাস্তার পাশে বিরাট এক বিলবোর্ডে। এই শহরের ওপর সূর্য যেভাবে কড়া আলো ছড়িয়ে, আকাশের নীলটুকু সাগর আর পামগাছের সবুজের সঙ্গে মিশিয়ে অস্পৃশ্য যে দৃশ্যকল্প তৈরি…

বিকেলটা অস্তমিত হলো কুয়াশার ঘোমটা পরে। তিনতলার জানালার থাই গ্লাস খুলে সান্ধিক বাইরে তাকিয়েই থাকল কতক্ষণ। শহরের প্রান্তসীমায় তাদের এই বাড়ি ছোটবেলা থেকেই তার হৃদয়ের কাছে কী একতাল নস্টালজিয়ার ঝাঁপি খুলে দেয়! সান্ধিকের কাছে সবচেয়ে রহস্যময়, সবচেয়ে প্রিয় হয়েও এই সন্ধ্যাবেলাটাই তাকে কেন সারাজীবন আনমনা, সারাজীবন বিপন্ন করে রাখল – তা সে ভেবে পায় না।…

আমার ঘুমের ঘোরেই তিনি আমাকে ধর্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ধর্ষণ। ইচ্ছের অমতে যৌনকর্মকে ধর্ষণই তো বলে। কিন্তু যেহেতু সেই রাতে আমি তার স্ত্রীর তকমা গলায় জড়িয়েছি; সমাজ তাই আমার অভিযোগ গ্রহণ করবে না। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কথাগুলো বলেই আনমনা হলো রাখি –  এক আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে তারই সঙ্গে যিনি…

কাতারের মনোলোভা এয়ারপোর্টটি চোখ মেলে ভালো করে দেখার মতো সময় রুদ্রের হাতে নেই। সকাল দশটা ত্রিশ মিনিটের এয়ার মরক্কোর সংযোগ বিমানটি ধরার জন্য তার হাতে আর মাত্র সতেরো মিনিট সময় আছে। এমেরিটাস এয়ারলাইন্স  ঢাকা থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে যাত্রা শুরু করায় এই বিপত্তি। পরবর্তী ফ্লাইটের নিরাপত্তা ক্লিয়ারেন্স নিয়ে ৪৬ নাম্বার দ্বারের দিকে এক দৌড় দিলো…

মামা আর এক কাপ চা দাও তো। মোহনলাল এই বাক্যটা শোনার জন্য সারাজীবন এভাবে মগ্ন হয়ে চা বানিয়ে যেতে চায়। বাস করতে চায়, এই শহরের মানুষের জীবনের চায়ের স্বাদ হয়ে। হিন্দু-মুসলমান ভাবনা তো পরের কথা, ‘মামা’ ডাকটা শুনলেই মনে হয় এ-শহরের সবাই ক্যামেলিয়া অথবা তার মায়ের সহোদর! মনে হয়, সে মোহনলাল নয়, ‘ক্যামেলিয়া’র ডাকা ‘মোহন’।…

যমজ কন্যাদ্বয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অস্ফুট স্বরে তাদের বয়সী বাবা শুধু আওড়াতে শিখলেন – ‘আগুন’, ‘আগুন’। একসময় তার মুখে কোনোদিন আর কেউ ‘আগুন’ শব্দ ছাড়া অন্য কোনোই শব্দ উচ্চারিত হতে শুনল না। ‘আগুন’ ছাড়া পৃথিবীতে আর যত শব্দ আছে তার সবকিছু তিনি ভুলেও গেলেন; কিন্তু সব কথা ভুলে গেলেও তার বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা…

শুক্রবারের পূর্বাহ্ণ। জাহিন বসে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের পুকুরপাড়ে। চারদিকের প্রাচীন গাছগুলোর ছায়া নিয়ে পুকুরের জল আরো নিকষ নীলের গভীরে নিজেরাই গোসলে মগ্ন। প্রতি শুক্রবারের মতো হাফপ্যান্ট পরে সাঁতার কাটার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এলেও কী এক অনুভূতি তাকে অবশ করে রেখেছে। গ্রামের বাড়ির পুকুরটার সঙ্গে অনেক টুকরা টুকরা স্মৃতি নামের ভালোবাসা তাকে হয়তো ওভাবে আনমনা করে…

কাতার থেকে ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের বিমানটা জাহিনকে ক্যাসাব্লাঙ্কা এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিলো। এখানে এগারো ঘণ্টার জন্য ওর যাত্রাবিরতি। ক্যাসাব্লাঙ্কার বিমানবন্দরে জটলা কম হয়। ভালো লাগে তার বিমানবন্দরের ভূমির সমান্তরালের ওয়েটিং লাউঞ্জটা। জাহিনের ইচ্ছা ছিল কোনো একটা বেঞ্চ একাই দখল করে লম্বা একটা ঘুম দেওয়ার। কিন্তু আজ ওয়েটিং লাউঞ্জে যাত্রী গিজগিজ করছে। কোথাও বসার জায়গাটুকুও নেই। ঘড়ি দেখল…