এক নষ্ট মেয়ের আপ্তবয়ান

আমার ঘুমের ঘোরেই তিনি আমাকে ধর্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ধর্ষণ। ইচ্ছের অমতে যৌনকর্মকে ধর্ষণই তো বলে। কিন্তু যেহেতু সেই রাতে আমি তার স্ত্রীর তকমা গলায় জড়িয়েছি; সমাজ তাই আমার অভিযোগ গ্রহণ করবে না। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাকে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। কথাগুলো বলেই আনমনা হলো রাখি – 

এক

আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে তারই সঙ্গে যিনি আমার বাবার সঙ্গে পরিচিত হলেও তার চেয়েও বয়সে কয়েক বছরের বড়। নারী হয়ে ওঠার অহংকারের সঙ্গে জড়িত আমার নারীময় অঙ্গগুলোর সৌন্দর্য গত কয়েক বছর ধরে নিজের চোখে দেখে যে গভীর আনন্দে মেতে উঠতাম, এই বিয়ের খবরে তা যেন চুপসে গেল। অথচ কারো সঙ্গে আমার একদিন এক ঘরে একা থাকা হবে – ভাবতেই কেমন করে আমার হাত দুটো পরির মতো পাখা হয়ে যেত। লজ্জামাখা আনন্দে ভাসতে ভাসতে দূর কোনো পথে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠার সব লক্ষণগুলোতে এতো জেল্লা লাগত যে, আমার চোখের ভাষায় সব স্বপ্ন একসঙ্গে খেলা করত। দুই-তিন বছর হলো – বসন্ত আর বর্ষা হয়ে শীতে নিজেকে নিজে জড়িয়ে ধরার, আয়নায় নিজের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার এই বদভ্যাস তৈরি হয়েছে।

আমার বিয়ের খবর এই সবকিছুকে ভেংচি কেটে উপহাস করল। আমার নিজের শরীরের ভাঁজগুলো বঁটি দিয়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছা করল। মাঘের শীতেও কম্বলের ভেতর শুয়ে দুটো পা নিজেদের ঘষে ঘষে আর উষ্ণতা খোঁজার আগ্রহ বোধ করছে না।

মায়ের মুখটা আবছা মনে পড়ে। উত্তরবঙ্গে এই মাঘের প্রবল শীতে তার কাছেই যাওয়ার ইচ্ছাটা তীব্র হয়ে উঠছে। টেলিভিশনে যতই বলুক নিম্নচাপের কারণে এমন আবহাওয়া কিন্তু আমি জানি আসলে বয়সী একজন মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ের খবরে এই মাঘ মাসেও আকাশে বিজলি চমকাচ্ছে। কালো মেঘে আকাশ ঢেকে যাওয়ায় শীতের বিকেলকেই রাত মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে, পালিয়ে যাই। হারিয়ে যাই – যেখান থেকে আর কখনোই ফিরে আসে না কেউ; কিন্তু বাবা! আমার বাবা অনেক টাকা ঋণ করেছেন সেই মানুষটার কাছ থেকে। চড়া সুদের তাণ্ডবে তাঁর ছোট্ট ব্যবসাটা ভেস্তে গেল। বারবার ঋণ করে ব্যবসাটা টেকানোর চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হলেন। এই বয়সে আর কৃষিকাজ অথবা কায়িক শ্রম করে তাঁর পক্ষে উপার্জন করা সম্ভব নয়।

আমি ভেবে পাই না, মাকে হারানোর পর আর বিয়ে-টিয়ে না করে, সবসময় ক্লাসে প্রথম হওয়া তাঁর একমাত্র মেয়েকে নিয়েই যে-মানুষটা শ্রম দিয়ে গেলেন, স্বপ্নকে সত্যি করবেন বলে মেয়েকে যিনি এতো কষ্ট করে পড়ালেন, তিনি কী করে এমন একজন বয়সী মানুষের কাছে সেই মেয়েকেই সোপর্দ করেন? শেষ বয়সের ব্যর্থতা বড় ভয়ানক – তরুণদের স্বপ্নকে তখন বিলাসিতা মনে হয় হয়তো। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাটাই তাঁর কাছে কি এখন একমাত্র স্বপ্ন? সেজন্যই আমার সব স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়েও তিনি কি একটা আশ্রয় খুঁজছেন?

বসে ছিলাম, বাসার পেছনে খড়ের পালাগুলোর দিকে মুখ করে। না, এই জীবন থেকে পালানোর পথ নেই।

দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির এই ভেজা ভেজা আকাশের মতো আমার দু-চোখ ভিজে উঠল। ঠিক তখনই আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক ঘর দূরের তায়েফ চাচার মেয়ে সাবেরা আমার কাঁধে হাত রাখল। বলল, শোন রাখি, মন খারাপ করিস না। বুড়ো ব্যাটার ছেলেটাকে আমি চিনি। ইস, কী যে সুন্দর সে আর ওর দুই চোখ! আর কি যে ভালো আর শান্ত একজন মানুষ।

তুই তাকে চিনিস মানে?

প্রেম করার খুব ইচ্ছা ছিল আবিরের সঙ্গে। কিন্তু সে পড়াশোনার বাইরে এখনো কিছুই বোঝে না। আমি আনন্দিতই বলতে পারিস। বেচারার মা নেই। তুই ওর মা হবি। হি-হি।

সাবেরার কথায় আমার কান্না পেল। সে যার সঙ্গে প্রেম করতে চায়, আমার সমবয়সী সেই ছেলেটার মায়ের ভূমিকা নিতে হবে আমাকে? আমি অবাক আর বিরক্ত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সে চোখে-মুখে রহস্য আর ইঙ্গিতময় হাসি দিয়ে বলল, নিজেদের ঘরে, পাশে অমন একজন থাকলে এতো দুশ্চিন্তার কী আছে? একসঙ্গে দুপুর-রাতের খাবার খাবি। বিকেলে কোকিল ডাকলে তার সামনে আনমনা হয়ে যাবি। তারপর রাত নামবে। রাতটা তো অন্ধকার, তাই না? বুড়ো ব্যাটা আর কয়দিন?

সাবেরার দুষ্টুমিভরা চোখের ভাষা তার ঠোঁটে, গালের টোলে গিয়ে খেলা করল। একটু পর মুখটা ভার করে সে বলল, কিন্তু ওর যে মাথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকে যাবে। অবশ্য একটু দূরে থাকাটা মন্দ নয়। তার অভাবটা তো তোকে বুঝতে হবে, তাহলেই না তুই বুঝবি কীভাবে তাকে বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ শেখাতে হয়।

বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ মানে?

মানে তো বুঝি না রে। কিন্তু চৈত্র-বৈশাখে মনটা আমার কেমন কেমন করে। কার জন্য মনের মধ্যে অমন হুহু চৈত্রের বাতাস বয়, কে সে – যার জন্য বুকের মধ্যে কালবৈশাখি ঝড় শুরু হয়? এসব ভাবতে গেলেই তো ওর মতন চেহারার অচেনা এক মানুষ উঁকি দেয়। কেন যে বড় হলাম? এসব দেখি নতুন যন্ত্রণা। ভাবিস না, তোকে আমি এতো ভালোবাসি – ওদিকটায় আমি নজর দেবো না।

ছিঃ, ছিঃ সাবেরা। এসব কী বলছিস তুই?

বুঝবি, বুঝবি – সাবেরা ঠিকই বলছিল। সমাজের ছিঃ ছিঃ কি তোর বাবার বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল? এই বালের সমাজের ছিঃ ছিঃ-র আমি গুষ্টি কিলাই। নিজের ভালোর জন্য যা করা দরকার, সব করবি। বুড়া বয়সে না হলে পস্তাবি, হুম।

এই বয়সেই মেয়েটা কেমন পাকনা হয়েছে, আমি ভাবছিলাম। কিন্তু সে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল এবং তার স্রোতস্বিনী চিন্তার মতো মাত্র ভাঁজজাগা শরীরটা বাতাসে এলিয়ে বাতাসের মতোই হারিয়ে গেল।

দুই

সন্ধ্যা নামল। বৃষ্টি এবার টিনের চালে ছন্দময় হয়ে উঠল। সেই ছন্দ আমাকে অন্ধকারে ভীষণ একাকী করে দেওয়ার পরিবর্তে আমার গোপন কীসব স্বপ্নের ভেতর আমাকে ডুবিয়ে নিল। পল্লীবিদ্যুৎ হলো আমার মতো উঠতি বয়সের ছটফটে নারীর মনের মতো। কোথায়, কখন আলো আর অন্ধকার করে সে তার মেঘকেশ ছড়িয়ে, কোন গ্রামের ছাতিমগাছে বসে থাকে – তার হদিস পাওয়া মুশকিল। ছেলেটার নাম আবির? আবির মানে কী? বাড়িতে একটা বাংলা অভিধান আছে। আমি চুপিচুপি সেটাই খুলে বসলাম। অভিধান দেখা গর্বের ব্যাপার; কিন্তু আজ অভিধান খোলার মাঝেও চুপিচুপি আর ‘গোপন’ শব্দ লুকিয়ে আছে ভেবে নিজেই অবাক হলাম। হারিকেনের সলতেটা বাড়িয়ে দিলাম। ওমা, এ কী দেখছি – আবির ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহৃত এক প্রকারের রঞ্জক পদার্থ। এটি গুঁড়া হিসেবেই ব্যবহার হয়, তরলভাবে নয়। হোলি খেলার সময় এটি ব্যবহার করা হয়। ফাল্গুন মাসে ব্যবহার, তাই এর অন্য নাম ফাগ। অপরাজিতা, গাঁদা, দোপাটি – এসব ফুলের নির্যাস থেকে আবির তৈরি করা হয়।

আমার ধারণা ছিল আবির মানে আকাশ। যাক, ভালোই হলো। আকাশকে তো ধরাছোঁয়া যায় না। ফুলের নির্যাস থেকে তৈরি রঙের গুঁড়া গায়ে, শরীরে মাখা যায়। আহা, কীসব দারুণ বসন্তের ফুল দিয়ে আবির তৈরি! সাবেরার কথা মনে হতেই মনে হলো, সাবেরা আমার কানে ফিসফিস করে বলছে – আগামী ফাল্গুনে তুই আবির মেখে প্রজাপতি হয়ে যাবি। তোর দুই ডানায় লেগে থাকবে আবিরের বিচিত্র রং।

আহা, আমার পাখনার নিচে যেন শিমুল আর পলাশ ফুলের একটু বর্ণচ্ছটা থাকে। ওই রংটা আমাকে দু-তিন বছর বড্ড বেশি জ্বালাতন করছে। আর পাখনার ওপরে ফণার মতো অংশে থাকে যেন চৈত্রের শনশন হাওয়ায় বয়ে চলা রোদের ঝলমল। এক প্রজাপতি তাহলে আবির মেখে তার ভুলভাবে জানা-অচেনা আকাশটার দিকে উড়াল দেবে। ভাবছেন আমি পাগলি? না। আমার মতো এতো অনুভূতি আর ভালো মাথা নিয়ে জন্মানো গ্রামের তরুণীকে আপনাদের পাগলিই মনে হবে! মানুষের অন্তর আর আত্মার তালাশ বাদ দিয়ে আপনারা মেতে আছেন টেলিভিশনের খবর আর ইউটিউবের ভাইরাল হওয়া ভাইরাসে। ওসব ভাইরাস আপনাদের মাথাকে গিলে খেয়েছে আর প্রকৃতির অবগুণ্ঠনে শিমুল-পলাশ থেকে অবারিত দ্রোণ ফুল, নাক ফুল, নটে শাকের পেত্নিভরা এই নির্জন গ্রামটা, আমার বাড়-বাড়ন্ত এই যৌবনবতী শরীরটার মধ্যে ভাইরাসের বদল এতো পুষ্টি ঢুকিয়েছে যে, আমার আসলেই পাগল হওয়ার দশা।

এই সময় মায়ের কথা মনে করে আর কাঁদলাম না। মনে হলো, আমি একজনের মা হতে যাচ্ছি – প্রবল শীতের রাতে এই ছন্দময় বৃষ্টির এক রহস্যময় সম্পর্কের মতো যার সঙ্গে আমার সম্পর্কের আঁকবাঁককে খুঁজতে বলে গেল সাবেরা। কেমন তার অবয়ব, এই গোপন স্বপ্নের সত্যিই কি কোনো রক্ত-মাংসের শরীর তৈরি হবে? এমন অনেক প্রশ্ন আমাকে ব্যাকুল করছে। এই ব্যাকুলতা কম্বলের মাঝে আমার নিজের শরীরের উষ্ণতা খুঁজছে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। অন্ধকার কি কাউকে খুঁজে বেড়ায়? সন্ধ্যার ছায়া আমাকে কেমন এক রহস্যময় অনুভূতিতে তলিয়ে নেয়। আকাশে একটি-দুটি তারা ফুটে উঠলেই মনে হয় – আমার বিষণ্নতার বিপরীতে তারাগুলো আমার স্বপ্নের এক-একটি বিন্দু। সেই অচেনা তারাগুলো আর অচেনা কোনো বিন্দু নয়। তারাগুলোকে আজ মনে হচ্ছে, আমি যে-বাড়ির বউ হতে যাচ্ছি, যার মা হতে যাচ্ছি, সেই তরুণটির মুখ। এসব ভাবতে ভাবতে এমন ঠান্ডাতেও আমি কেন ঘামছিলাম, জানি না। শুধু বুঝলাম, মানুষের শরীর একটা খোলস। যে-খোলস তার মন নামের যন্ত্রটা দিয়ে নরম-গরম হতে পারে।

বাইরে আরো গাঢ় হয়ে আসা অন্ধকার মেঘের সঙ্গে শীত কমানোর জন্য হয়তো দরকষাকষি করছিল; কিন্তু আমি চমকে উঠলাম মসজিদ থেকে এশার নামাজ শেষে ঘরে ফেরা মুসল্লিদের গলার আওয়াজে। বাড়ির পেছনের রাস্তা ধরে যাওয়ার পথে তারা কী বলে তা জানার আগ্রহ আমার কোনোকালেই হয়নি। কিন্তু আজ কেন যেন তাদের কথা শোনার জন্য কান পাতলাম। একজনের কথা একটু কানে এলো, হারামজাদিকে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলা উচিত!

বুকের ভেতরটা যেন বজ্রপাতে কেঁপে উঠল। কোন হারামজাদি? না, এসব আমি জানতে চাই না। তবে তাদের কথা শুনে আমার সাবধান হওয়ার প্রবণতা কেন বাড়ল, তাও জানি না। গ্রামের সব মেয়ে আজকাল প্রায় বিচিত্রভাবে নিজেকে ঢেকে রাখার কৌশল শেখাটাকে গর্বের একটা কারণ মনে করে; কিন্তু আমার প্রিয় কবিতার মতো করে এতোদিন আমিও ভাবতাম,

তোমার যখন পড়ছ এসব, স্বর্গ

                       পাওয়ার জন্য,

আমি না হয় পাখিই হবো পাখির

                          মতো বন্য।

কিন্তু আজ কেন আমার তাদের মতোই নিজেকে ঢাকতে ইচ্ছে করছে? নিজের আনন্দভুবনের স্বাধীনতা ইজারা হয়ে গেলে, নিজের কল্পনা অন্য কারো দখলে চলে গেলে কি এমন হয়? নাকি মানুষের এই জীবনের চেয়ে অজান্তেই লালিত গোপন এক জীবনকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এসব? আমি এসব প্রশ্নের কোনো কূল-কিনারা পাই না। শুধু জানি, আমার ছোট্ট এই জীবনে গোপন কিছু না থাকলেও, আমিও এখন অনেকের মতো কী যেন লুকাতে চাইছি। আবিরের কোনো গোপন ব্যাপার-স্যাপার আছে কি? আমার মন যখনই বলে – না, আবিরের জীবনে গোপন কিছু হয়তো আসেনি; কী আশ্চর্য, এমন কথা মনে হওয়ামাত্র আমি যেন একটু লজ্জা পাই, আর কিছু একটা লুকাতে চাই। হায়! এই বয়সেই আমার মনে হয়, এই সমাজ এসব আপন আপন গোপন অনুভূতিকে হারিয়েছে বলে তারা তাদের আনন্দ আর স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করতে শেখেনি। শিখেছে অনুভবকে লুকানোর কৌশল আর সেসবের ফল হলো, ভেতরের সব চাওয়া-পাওয়া লুকিয়ে অথবা সবকিছু গোপন করে ওপরে ওপরে শুদ্ধতার লেবাস পরে সমাজের কাছে ভালো মানুষ সেজে থাকা। শুদ্ধ মানুষগুলো পাখির মতো একটা বন্যজীবন কি চায়?

তিন

আমার বিয়ে হয়ে গেল। সে-ও প্রায় গোপনে। সেদিন পল্লীবিদ্যুৎ ছিল না বলে আমার বিয়েতে বিরাট এক বাতি জ্বলল। সেই হ্যাজাকের আলোতেই প্রথম চোখাচোখি হয়ে অন্ধকার জগতের একমাত্র ফুটে থাকা আলোটুকু আমার হৃদয়কে উদ্ভাসিত করল। তাকে আমি আগে কোনোদিন দেখিনি। আমাকে কেউ পরিচয় করিয়েও দেয়নি। তবু আমি বুঝলাম, ওর নাম আবির – ফাগুনের ফুলের নির্যাস! এতোক্ষণ কুঁকড়ে থাকলেও আমার হৃদয় হ্যাজাকের মতোই ঝলসে উঠে দুই চোখে উৎসুক আনন্দের উল্লাস বয়ে আনল। মুখে শব্দ ফুটল। ফিসফিস করে বললাম, আবির?

তুমি আমাকে চেনো, মা?

হুম, নামটার মানেও জানি। ফাগুনের ফুলের নির্যাস!

এই কথনের মধ্যেই আমার স্বামী এসে ধমকে আবিরকে তাড়াল, আজ আর বিদ্যুৎ আসবে না। গঞ্জ থেকে কেরোসিন আনার ব্যবস্থা করো।

আমার জীবনে একটা হ্যাজাক, তবু তার আলোর মতো উজ্জ্বল অথচ দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে থাকল। মনে হলো, আমার বয়সী স্বামী এই হ্যাজাক দিয়ে আমাকে সারারাত খুঁজবে। কিন্তু না, আমাকে ঘরে ঢোকানোর পর ঠিকই বিদ্যুৎ এলো। শূন্যশক্তির একটা বাতির এতো আলো! তিনি এসে খুব বেশি কথা খরচ করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তার শরীর থেকে রসুন আর গরুর মাংসের ঘ্রাণ আমার বমি বমি ভাবটাকে উসকে দিলো। আমি যতই নিজেকে লুকাতে চাইলাম, তিনি ততোই আমাকে স্বল্পবসনা করে ফেললেন। আমার বারবার শুধু আবিরের কথা মনে পড়ল। তিনি আমার ব্রা খোলার চেষ্টা করতেই আমি আপ্রাণ চিৎকার করে আবিরের নাম ধরে ডাকলাম। কী আশ্চর্য, সে কি আশপাশেই ছিল? একটু পরই জানালার বাইরে থেকে সে উদ্বিগ্ন গলায় কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, মা!

তরুণ ছেলের কণ্ঠ শুনে লোকটার কী হলো কে জানে, তিনি চুপ হয়ে গেলেন। সারারাত বৃষ্টির জলে ভাসা একজন মৃত মানুষের শরীরের ঘ্রাণে আমি শক্ত হয়ে থাকলাম। ভয় পেতে থাকলাম, কখন আবার লোকটা ঝামেলা শুরু করে। বিছানার এক প্রান্তে জড়োসড়ো আমি কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন আমার শরীরের মাঝে প্রবেশের সব আয়োজন তিনি শেষ করেছেন। যা বললেন তার সারমর্ম হলো, আমি যদি আবার চিৎকার করি, তাহলে আমার সতীত্ব ঠিক নেই – এই অপবাদে আমাকে পরদিনই বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন।

গ্রামে আজকাল এই ‘সতীত্ব’ বিষয়টি আমাদের মনে প্রকট করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরুষের স্বার্থ নিয়ে যত বয়ান – সবই এই গ্রামের নারীরা নীরবে মেনে তো নিয়েছেই, ধাঁড়িগুলো উলটো আমাদের মতো তরুণীদের জন্য খড়্গ হয়েছে। তারা আট-দশ বছরের মেয়েদেরও পর্দার আড়ালে বস্তাবন্দি করে কেড়ে নিয়েছে তাদের শৈশব। যাদের শৈশব নেই তাদের কৈশোর আসবে কীভাবে? অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যাদের কৈশোর থেকে তারুণ্য কেটেছে তুমুল খেলাধুলা করে, যাদের যৌবন শুরু গোপন গল্পের সব আসর মাতিয়ে – তারাই এসব নিয়ে সোচ্চার। পারলে তারা পর্দা দিয়ে মেয়েদের চোখটাও ঢাকার পক্ষে। ভাগ্যিস আমার বাবা এদের খপ্পরে পড়েননি! নারীবিহীন তাঁর জীবন বলে তিনি পুরুষ তো বটেই, নারীদের বয়ান থেকে বেঁচেছেন। বেগানা পুরুষের সঙ্গে কথা বলে কে ইজ্জত খোয়ানোর ঝুঁকি নেবে? এমন সমাজে বাস করে আমিও সতীত্ব হারানোর অপবাদের ঝুঁকি নিতে চাইলাম না।

আমি চুপ করে থাকলাম। কল্পনা যখন আর সহায় হলো না, যখন আমার স্বপ্নের পতনবিন্দু দেখলাম তখন ব্যথার চেয়ে মনের কষ্টে আমার দুই চোখ নীরবে গণ্ডদেশ ভিজিয়ে ফেলল; কিন্তু জীবন এবং স্বপ্নের পতনবিন্দু থেকে উত্তরণের জন্য মায়ের মুখের সঙ্গে আর একটা মানুষের মুখ মনে করে আমি কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠলাম। সেই কল্পনা যত বল্গাহীন হয়ে উঠল আমার ভেতরটা তত প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠল। 

হায়, এই বয়সেই আমাকে কত কিছু বুঝতে হচ্ছে! জীবনের আসন্ন সংকট মনে হয় পরিণত হওয়ার আগেই আমাকে বয়সী একজন মানুষে পরিণত করে দিচ্ছে। হাসি-আনন্দ এবং তুমুল সব অনুভূতিতে আনন্দিত অথবা বিষণ্ন হওয়ার এই বয়সটা বাইরে যে শিমুল গাছ তার তলায় গিয়ে আশ্রয় নিল। আমি সারাজীবন আমার এই শিমুলতলার মেয়েবেলায় বসে শীতশেষের চৈত্রের বাতাসে শিমুল তুলার উড়ে চলা দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।

যা হোক আমি আবিরের মা থেকে বন্ধু হয়ে ওঠার সংকেতপূর্ণ আচরণগুলো পরদিন থেকেই শুরু করলাম। তার কথার পিঠে এমনসব বাক্য বললাম যেন তার হাসি পায়। আবার হাসি থেমে গেলে একটা উদ্বিগ্ন ভাবনাও তাকে আমার জন্য অস্থির করে। তাকে মুগ্ধ করতেই আমার সর্বোচ্চ যত্ন দিয়ে রান্না করা খাবার খেয়ে সে প্রশংসার বান ছোটায়। দুপুরের পর আমার সব কাজ গোছানো হয়ে গেলে সে আমাকে বলত, মা, তোমার কাজ শেষ? দাবা খেলতে জানো।

না জানলেই বা কী? তুমি আমাকে শিখিয়ে দাও।

সে উৎফুল্ল হয়ে আমাকে দাবা খেলা শেখাতে শেখাতেই একদিন হেরেও গেল। চোখ কপালে তুলে বলল, ওহ, খোদা! তুমি তো স্বাভাবিক মানুষ নও, মা। তোমার মাথা এক্কেবারে কম্পিউটার।

মাথাটা না হয় অমন? আর আমি?

তোমার মাথাই তো তুমি।

নারীর মাথা দেখে প্রেমে পড়ে বোকা পুরুষগুলো। নারীর মাঝে যে-কোনো দামি মাথার চেয়েও অনেক বড় কিছু লুকিয়ে থাকে। সেটাকে খুঁজে নিতে হয়, আবিষ্কার করতে হয়।

আমার কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলো আবির। ভাষা হারানো দৃষ্টিতে অনিমেষ থাকিয়ে থাকল। ততোক্ষণে আমার অনভ্যস্ততায় শাড়ির আঁচলটা খসে পড়েছে। আমি ইচ্ছা করেই তা না দেখার ভান করলাম। সে একবার আমার থেকে দৃষ্টি নামিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। আমি আবিরকে স্বাভাবিক করতে প্রসঙ্গ বদলালাম, আর মাথায় সবকিছু রাখতে হয় না। যা কিছু মাথায় থাকে তা পায়ে পড়েও যেতে পারে। কিন্তু যা কিছু থাকে বুকে, দুই হাত তাকে আঁকড়ে থাকতে চায়। পড়ে যেতে দিতে চায় না। 

আমার কথা শুনে সে মনে হয় কিছু বুঝল না। কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, তুমি তো দারুণ এক ফিলোসফার। তোমার ভাবনার মধ্যে অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। তোমার আসলে পড়াশোনাটা থামানো ঠিক হয়নি।

খেয়াল করলাম এই প্রথম কথা বলতে বাক্যের শুরুতে ‘মা’ শব্দটা সে বাদ দিয়েছে। আমি আনন্দিত কণ্ঠে বললাম, পড়ে যদি ফিলোসফার হওয়া যেত?

তাহলে কীভাবে …

স্মৃতি এবং কল্পনার সঙ্গে ভালোবাসা যখন বিদ্রোহ করে, যখন মানুষ জয়ী হওয়ার জন্য পথ খুঁজতে থাকে, যখন নিজেদের সংগ্রামকে জীবনের সংস্কৃতি বানায়।

তোমার কথাগুলো আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল।

একটা কথা বলব, তোমাকে?

বলো।

আমি চারদিকে আড়চোখে দেখে নিলাম। না, আশপাশে কেউ নেই। আবিরকে ইশারায় আমি বাড়ির পেছনে নির্জন খড়-পালার স্তূপের কাছে যেতে বললাম। সেখানে গিয়ে বললাম, শোনো, আমি তো তোমাকে জন্ম দিইনি। আমাকে আর ‘মা’ বলে ডেকো না। নিজেকে বুড়ি ভাবার শাস্তি তুমি আমাকে কেন দেবে, বলো? আমাকে ‘রাখি’ বলবে। আর তোমার বাবার সামনে শুধু ‘মা’ বলবে। আমরা তো একই বয়সী। মা-ছেলে নয়,  আমরা একে-অন্যের পাশে ‘বন্ধু’ হয়ে থাকব।

কথাটা শুনে ধাতস্থ হলো সে। বাসার পেছনের এই বুনো লতাপাতার ভেতর এক গুদামঘর। পাশে খড়ের পালার নির্জন পরিবেশ তাকে আমার কথাগুলিকে আমার উপলব্ধির মতো করেই বুঝতে সহায়তা করল। সে মনোযোগ দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকাল। আমার হৃৎস্পন্দন ছলকে উঠল। অনেকবার একে অন্যকে দেখেও আজ প্রথম আমাদের দৃষ্টিবিনিময় হলো। বুঝলাম, আমরা মানুষের দিকে তাকাই, হাসি-কাঁদি; কিন্তু সবার সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় হয় না। এমনকি সঙ্গমের অধিকার পাওয়া মানুষের সঙ্গেও হয় না। আমার ভেতরের স্বপ্ন নামের শিমুল তুলাগুলো উড়ল বুঝি আকাশে। আবিরকে বললাম, শীত চলে যাচ্ছে। বসন্ত আসছে। আমার লাল টকটকে শিমুলতলা তুলা ওড়ানোর জন্য পূর্ণ হয়ে উঠছে।

সে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েই থাকল। সেই দৃষ্টিতে এই প্রথম মায়ার সঙ্গে দয়া দেখলাম। আমার মতো একজন সুন্দরী তরুণীর বাবার বয়সী কারো সঙ্গে বিয়ের জন্য তার দয়া একসময় বিদ্রোহ হয়ে উঠুক আমি তা-ই চাই। প্রথম ওর হাত ধরলাম। সে চমকে গেলেও বলল, তোমার রান্না কেন এতো ভালো, এখন আমি বুঝি। তুমি প্রচণ্ড মেধাবী।

তাকে বললাম, আমারও তো ‘মা’ নেই। ছোটবেলা থেকেই তাই রান্নাটা আমাকে শিখতে হয়েছে। এই সংগ্রামটুকুই রাখি নামের একটা মেয়ের জীবন-সংস্কৃতি। এখন থেকে তোমার জন্যই আমি মন দিয়ে রান্না করব। নাকের কাছে মৃতদেহের গন্ধ ভাসতে থাকলে রান্নাটা তেমনই হয়। কিন্তু স্বপ্নের ঘ্রাণ যদি বসন্তের ফুলের নির্যাস হয়ে ভাসতে থাকে, রান্নাটাও সেই ঘ্রাণটুকু ধারণ করে অপূর্ব হয়। রাতে কী খাবে বলো? 

সত্যিই শীতের সবজি দিয়ে ছোটমাছ আর দেশি মোরগের রান্না খেয়ে আবির বারবার প্রশংসা করল। যত দিন গড়াল আমার রান্না আর যত্নের প্রতি তার আসক্তি তৈরি হলো। এভাবেই ডিসেম্বর গড়িয়ে জানুয়ারি এলো। এলো আরেকটি শৈত্যপ্রবাহ। চলেও গেল। রোদ চড়া হতে শুরু করলে গরম কাপড়গুলো ধুয়ে ফেললাম। এক রাতে আমার তথাকথিত স্বামী ঘরে ফিরবে না জানালে মনে হলো আমার নিজেকেও ধুয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। আবির এসে বলল, আজ ভরা জোছনার রাত। বাড়ির পেছনের খড়ের গাদার ছোট ছোট লতাপাতায় কীসব ফুল ফুটে আছে। নারকেলগাছের পাতায় ঝিরঝির বাতাস কেমন করে তার ছায়াগুলো কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দেখবে?

আমরা বাইরে গেলাম। জোছনায় আমাদের দুজনের প্রলম্বিত ছায়া যেন একে অন্যের মাঝে মজে আছে। বললাম, দেখো, আমাদের ছায়া প্রেম করছে। এই কথা শুনে সে আমার কোমরে হাত রাখল। আমি বসন্ত আগমনীর বাতাসে নারকেল পাতার মতো কেঁপে উঠলাম। সে আমার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, মার্চের তেরো তারিখে আমাকে ঢাকা যেতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হবে। আমার কেন যেন খুব মন খারাপ লাগছে। তোমার মতো এতো যত্ন করে কে আমাকে খাওয়াবে?

তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে এবার আমার নিতম্ব পেঁচিয়ে নিল। আমরা নিবিড় থেকে নিবিড় হতে হতে মুখের সব ভাষা হারিয়ে ফেললাম। পালার নরম খড়ে আমরা বসলাম। সারাদিনের রোদের উষ্ণতা ধরে রাখা খড়গুলো আমাদের উত্তপ্ত ভেতরকে আলিঙ্গন করে তাদের মতো উন্মুক্ত হওয়ার আহ্বান করল যেন। তার চঞ্চল দুই হাত আমার শরীরকে আরো চঞ্চল করল। আমার স্বপ্ন-কামনার সব উচ্ছলতা আগুনের বানের মতো ছলকে উঠল। একই কর্ম, অথচ প্রিয় মানুষের সঙ্গে নারীর শরীর কেমন নারীময় হয়ে ওঠে। আমি বুঝলাম, প্রেমহীন মিলন মানে মৃত মানুষের শীতল ঘ্রাণ। আর প্রেমের মিলন মানে বসন্তের সব ফুলের নির্যাস হৃদয়ে মেখে তার মধ্যাহ্নরোদের নির্জন দিগন্তে উত্তাল অবগাহন।

কখন মধ্যরাত গড়িয়ে গেল। আমাদের শরীরের ঘামে ভেজা খড়গুলো একসময় শীতল আমাদের আরো শীত শীত অনুভূতি দিতেই আমরা গরম পোশাকগুলো পরে নিলাম। আমি তাকে আঁকড়ে ধরে বললাম, ঢাকায় অনেক সুন্দরী দেখে আমাকে ভুলে যেও না। প্রতিদিন ফোন কোরো।

আবিরের চোখ জলে ভরে এলো। বলল, ওখানে এতো এতো দালানকোঠার ভিড়ে তোমার মতো আর কিছুই সুন্দর হতে পারে না। তুমি এই জোছনার আলোয় ফুলগুলোর রঙের মতো। তুমি পূর্বাহ্নের রোদে শিমুল ফুলের মতো – টকটকে, সতেজ।

সেদিন থেকেই আমি তার শিমুল হয়ে হৃদয় থেকে রক্ত-রং ঝরাতে থাকলাম। 

চার

আবির চলে যাওয়ার পর আমার তিন মাসের অপেক্ষা যেন আর শেষ হতে চায় না। তিন মাস পর যখন সে এলো, বুঝলাম আমার আগের লাজুক আবিরটি সে আর নেই। বাবার প্রতি সে এতো উন্নাসিক হয়ে উঠেছে যে, তার সঙ্গে কথা বলতে সে বিরক্ত বোধ করে। তাকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্ব বোঝাতে গেলে সে ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, তোমার লজ্জা লাগে না একটা বুড়ো লোকের সঙ্গে ঘুমাতে?

আমার দুই চোখ জলে ভরে এলো। আমার ঝাপসা চোখের দৃষ্টিকে সে নিতে পারল না। চোখ মুছে দিয়ে বলল, আমার খুব কষ্ট হয়! কথাটা বলেই তার দুই চোখ বেয়ে অশ্রু নয়, যেন রক্ত গড়াতে চাইল। তখন গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপের পূর্বাহ্ন। বাসায় কেউ নেই। চুলায় রান্না করতে গিয়ে আমি প্রায় ভিজেই গিয়েছিলাম। সে আমার আদ্যোপান্ত দেখল। তারপর পাঁজাকোলে তুলে নিল। আমি অনুনয় করলাম, পাতিলের তরকারি সব পুড়ে যাবে।

যাক। তিন মাস আমিও পুড়েছি।

আবির, এখন নয়। বাড়ির বাইরের দরজা খোলা। মধ্যরাতে মানুষটা বেঘোরে ঘুমায়। মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে আমি একা একা পেছনের গুদামঘরের পাশে আমাদের খড়ের পালাটার কাছে গিয়ে বসে বসে কেঁদেছি। তিনি টের পাননি।

আবির শান্ত হলো। আমি তাকে তোয়ালে সাবান দিয়ে বললাম, ইস্, ঢাকায় গিয়ে শরীরটা সাদা হলেও গায়ে অনেক ময়লা জমেছে। আমি তোমাকে গোসল করিয়ে দেবো।

আমি আসলে তাকে আমার মতো করে প্রস্তুত করে নিলাম। কিন্তু আমার স্বামী মধ্যরাতগুলোতে আমার অনুপস্থিতি কি টের পেলেন? আবির বাড়িতে থাকার কারণেই তার স্নায়ুতন্ত্র সজাগ হলো কি?

পনেরো দিন পর আবির চলে গেলে তিনি বললেন, শুন, তোর চালচলন ঠিক নাই। মুই একটা হুজুর ঠিক কচ্চু, তাঁয় তোক নিত্যাও দুই ঘণ্টা করি আরবি আর এই হাদিস শিকি দেবে, এলায়। তোক একন থাকি পদ্দা-পুসিদা করির নাগবে।

তার কথা শুনে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল ঘাম বের হলো। তার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বললাম, আমি তো বাড়ির বাইরে কোথাও যাই না। কারো সঙ্গে চলাফেরাও তেমন নেই। পড়াবেন যখন তখন বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি করে দেন।

চুপ, হারামজাদি। তুই ঘরত

থাকিয়াও বেহায়া হচিস।

এরপর আমাকে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে এক মধ্যবয়সী হুজুর এলেন। বলা বাহুল্য, তার প্রতি আমার স্বামীর আস্থা দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি এতোটাই নিরাপদ বোধ করতেন যে, বাড়িতে লোকটা এলেও আমাকে একা রেখে নিশ্চিন্তে সুদের কারবার করতে গঞ্জে চলে যেতেন। দু-তিনদিন আমার নতুন শিক্ষক যতবার পানি চাইলেন, আমার হাত থেকে গ্লাসটা নিতে গিয়ে আমার আঙুলগুলো ইচ্ছা করেই যে ছুঁয়ে দিচ্ছেন, তা বুঝলাম। কয়েকদিন পর তিনি আঞ্চলিক ভাষা বাদ দিয়ে বই-পুস্তকের ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করলেন, এই গরমত এতো কাপড়ের মইদ্যে কি পড়া মাথায় ঢোকে?

আমি এই সুযোগের আশায় ছিলাম। কালো আলখেল্লা খুলে দূরে ফেলে দিলাম। গলা চড়িয়ে পড়ছি, দেখি শিক্ষকের সাড়াশব্দ নেই। তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, লোকটা আমার বুকের আলগা হয়ে যাওয়া ব্লাউজের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কাপড় সরালাম না। তাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করলাম। ব্লাউজ ঠিকঠাক করার ভান করতে গিয়ে তাকে আমার মেদহীন ঋজু শরীরে জেগে ওঠা বালিয়াড়ির মতো মাত্র ভারি হয়ে ওঠা বুকটা আর একটু দেখার সুযোগ করে দিলাম। লোকটা দুই ঠোঁট চেটে বই-পুস্তকের ভাষা ভুলে বললেন, আল্লাহ নিজ হাতত তোমাক বানাইচে। তবে, মোর মন খারাপ।

আমি পড়া বন্ধ করে বললাম, কেন?

উত্তরে তার মুখে এবার জাতভাষা, এতো সোন্দর তোর জ্ঞান-বুজ, এতো অস-কষ সৃষ্টিকত্তা তোর গোটায় শরীলে দেছে! কিসের জন্যি, কও?

আমি খেয়াল করলাম, এই প্রশ্ন করার সময় লোকটা কেন যেন ‘সৃষ্টিকর্তা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। বললাম, তা আমি জানি? জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য।

ওই আধমরা বুড়্যা ব্যাটা কি তোর এই জ্বলা আগুন সামলেবার পাইবে? এলা বাড়িত কাঁইও নাই …

পাপ হবে না? আপনিই না কইলেন, দোজখের একদিন দুনিয়ার হাজার বছরের সমান!

মোর-তোর মইদ্যে থাকলেই তো হলো …

এরপর যা কিছু তার পক্ষে সব বলে তিনি আমাকে বিছানায় নেওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। আমার স্থির ভাবাবেগে একসময় বিরক্ত হয়ে আমাকে জাপটে ধরতেই তাকে বললাম, শোনেন, শোনেন। হবে হবে – সব হবে। এখন আমার বান্ধা সময়।

একথায় লোকটা থামল। তার ভারি শ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, তুই তোর ভাতারক কইস, নতুন ভাষা শিকতে সময় নাগচে। এই ভাষার অক্কর চিনতে মোরই গেইচে ছয় মাস! মুই সারাটা জেবন তোক পড়বার চাঁও …

কিন্তু আমার একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

যার সঙ্গে ওই কাম করতে গিয়ে মরা লাশের গন্ধ পাই, তারা হয় পঙ্গু হয়ে যায়, নয়তো মরে যায়।

একথায় ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে লোকটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভয় কেটে গেলে বললেন, তার মানে, তুই আরো চ্যাংড়াগুলার সাতে জেনা কচ্চিস? ছি, ছি … তোবা, তোবা। তুই বোলে দোজখের আগুনত পুড়তে ভয় পাইস?

আগে তো জানতাম না যে, দুনিয়ার এতো হাজার বছর ধরে আমার এতো সুন্দর শরীর আগুনে পুড়বে। জানার পর তো মানুষকে ভালো হয়ে যেতে হয়, তাই না? আমার রূপটা কি শুধু আপনাকে একা জ্বালায়? নিজের বেলায় ‘তোবা’, ‘তোবা’, কেউ কয় না।

যাউক, অগুলা আর করিস না …

আপনার সঙ্গেও না?

মোর কতা কচু নাকি? তোর সাতে মোর সম্পর্ক আলাদা। ওগ্লা থাউক। তুই কি বা কচলু? ওই যে মরা মাইনষের গোন্দো পাইস …?

হুম, কারো সঙ্গে শোয়ার পর যদি রাতে মাথাকাটা ঘোড়াকে পুরো এক ট্রেন মানুষের লাশ নিয়ে পাতালপুরিতে হারিয়ে যেতে দেখি, তাহলে বুঝি আমার সঙ্গের জিন তাকে মেরে ফেলবে।

আমার কথায় লোকটার আত্মা বুঝিবা কেঁপে উঠল। জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো তার ঠোঁট কাঁপল। শরীর বাঁকা করে তিনি পেছনে হেলে আমার চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি রাখলেন। জাতভাষা ভুলে এবার জিনের সঙ্গে বেয়াদবি না করতেই বললেন, জিন! ওরে মাগো, তোমার সাথে জিন থুইচ?

এবার হাতের কাছে বিছানার চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ধারালো আর চকচকে চাকুটা আমি বের করলাম। একটা ভয়ংকর সুন্দরী জিনকে কল্পনা করে তার মতো চোখ বড় করে, মুখটাতে নিষ্ঠুর ভঙ্গি এনে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? জিন রে ভয় পাস? আল্লাহরে ভয় না পেয়ে আমার মতো সামান্য জিনকে তোর এতো ভয়? কয়েকদিন হলো মাথাকাটা ঘোড়ার রক্ত শুকিয়ে গেছে। তোর রক্ত পেলে সে আরো এক ট্রেন মরা যাত্রী নিয়ে আজ রাতে পাতালপুরির দিকে যাত্রা করবে।

আমার হাতে শক্ত করে ধরা চকচকে চাকু আর আমার বড় বড় দুই অগ্নিচোখের দ্রোহ দেখে তার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তার পাঞ্জাবি ভিজে গেছে ভয়ের ঘামে। হাত জোড় করে মিনতি করে তিনি বললেন, না, না … মোক ছাড়ি দেও মা। খোদার কসম কওচো, মোর ভুল হয়া গেইচে। আজ থাকি ভালো হয়া যাইম।

আমি তাকে তখন ছাড়লাম যখন আমার স্বামী এসে চাকু হাতে তাকে খুন করতে উদ্যত আমাকে আর মৃতপ্রায় শিক্ষককে উদ্ধার করলেন।

পাঁচ

আমি সারাটা বিকেল বুকে বালিশ চেপে খুব কান্না করলাম। আবিরকে একটু না দেখলে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এখনই মরে যাব। এই রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনেও আমার মাথার করোটির মাঝে সেই শৈত্যপ্রবাহের দিনগুলোর টিপটিপ বৃষ্টি আর মেঘলা-গুমোট অন্ধকার। আমার স্বামী একটু বের হতেই আমি মুঠোফোনে আবিরকে ফোন করলাম। ওর কণ্ঠ শোনামাত্র আমি সব কথা হারিয়ে ফেললাম। অস্ফুট রাখতে চাইলেও আমার কান্নাটুকু সে টের পেল, রাখি, কী হয়েছে? রাখি, বলো, কেউ কি তোমার গায়ে হাত তুলেছে? কথা বলো …

আমি আবেগ চেপে শুধু বললাম, তোমাকে খুব মিস করছি, আবির। আমার বুকের ভেতর কেমন কষ্ট! প্রতিদিন সন্ধ্যা নামে। নিভে যায় দিনের আলো। প্রতিটি রাতের আঁধার আমাকে পথহারানো হরিণীর মতো ভীতু করে তোলে। কতদিন দেখি না তোমাকে। মনে হচ্ছে, আমি মরে যাব। পৃথিবীতে শুধু আছে আমার এক ঋণগ্রস্ত জীবন্মৃত বাবা আর তুমি। অথচ আমার স্বপ্নগুলো তোমার অপেক্ষায় থেকে থেকে শিমুল তুলার মতো উড়ে যায়। পলাশের মতো ঝরে যায়।

তুমি ঠিক করে না বললেও আমি বুঝতে পারছি, সুদখোর শয়তানটা তোমাকে …। ঠিক আছে, আগামী সপ্তাহে শেষ পরীক্ষাটা দিয়েই আমি রওনা দেবো।

বাড়িতে আমার শিক্ষার পাট চুকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম, স্বামী বেচারা রাতে আমার সঙ্গে আর শোয় না। বাইরের বারান্দায়, অগ্রহায়ণ অথবা আষাঢ় মাসে যেখানে ধান কাটার ভাড়া করা কিষানরা ঘুমায়, তার পাশে উঁচু চৌকিতে তিনি ঘুমান আজকাল। শিয়রের পাশে রাখেন সেই চকচকে আর ধারালো চাকুটা। ঠিক আমারই মতো এক জিনের হাতে যে চাকু দেখে শিক্ষক লোকটার মরণাপন্ন অবস্থা হয়েছিল। আমার স্বামী নামধারী বেচারা মাঝে মাঝেই মধ্যরাতে চমকে উঠে ভীত কণ্ঠে বলেন, কে? কে ওখানে?

আমি দারুণ খুশি হয়ে উঠলাম। শিক্ষক রাখাটা আমার জন্য কেমন সাপেবর হয়েছে ভেবে আমার দুই ঠোঁটে হাসি ফুটল। আবিরকে নিয়ে রাতে লুকানোর পথটা সহজ করে দেওয়ার জন্য স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম।

কিন্তু আবির আসার কয়েকদিন পরই বুড়ার জিনভীতি মনে হয় কেটে গেল। আমিও তার বাবার সঙ্গে আমার বিয়ের পেছনের আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। আমার সকালে ঘুম থেকে না উঠতে পারা কি আবিরের বাবাকে আমার কাটানো বিগত রাতগুলো নিয়ে সন্দিহান করে তুলল? আবির আসার পর আমার চোখে-মুখে অপার্থিব প্রশান্তি ভর করল। আর বসন্তের সব ফুলের নির্যাসে যত ফাগুনের আগুন আগুন অনুভব – তার আস্বাদনের মাঝেই মনপ্রাণ উজাড় করে দেওয়ায় কয়েকদিনেই শরীরজুড়ে অদ্ভুত লাবণ্য জেগে উঠতে দেখে লোকটা কেমন রূঢ়চোখে তাকায় আজকাল। জিনের ভয় কাটিয়ে এক মধ্যরাতে তিনি উদ্দাম আমাদের দুজনকে গুদামঘরে আবিষ্কারই করলেন না শুধু, সেই ঘরটার সব আবর্জনা সরিয়ে কবে সেটাকে বাসরশয্যার মতো সুন্দর করে সাজিয়েছি তা দেখে আশ্চর্যান্বিত হলেন। হুজুর তাকে যতই বলুক, তোমার বউ একটা জিন, আমি নিজের চোখে দেখেছি তার চোখে জিনের আসর – আমি যে আসলে কোনো জিন নই, সেই রহস্য জানার পর তার পৌরুষ জেগে উঠল। তিনি ছেলের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়লেন। আবির একসময় উত্তেজিত হয়ে তাকে বলল, সুদের মারপ্যাঁচে ফেলে আপনি রাখির সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট করেছেন। যে-বাবা এতো জঘন্য হতে পারে তার সন্তানের কাছ থেকে কী আশা করেন?

এই কথায় স্বামী নামধারী লোকটা আক্রোশে ফেটে পড়লেন। সত্যি কথা দিয়ে মানুষকে উন্মোচন করলে অথবা আঘাত করলে মানুষ মনে হয় সবচেয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। মানুষ কি নিজেকে লুকিয়ে তার লালসাগুলো চরিতার্থ করার শিল্প অর্জন করেছে বলে তারা ‘মানুষ’? তিনি সেই চকচকে চাকু বের করে আবিরের পেট বরাবর চালিয়ে দিলেন। আবির দ্রুত শুয়ে পড়ে পাশ থেকে তাকে ধাক্কা দিলো। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েও ছেলের সঙ্গে চাকু নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে তিনি বাজেভাবে জখম এবং রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারালেন।

ছয়

থানার দারোগা জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্বামীকে ছুরিকাহত করেছেন কি আপনি নিজেই? রাখি এই প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে বলল, একই কথা আর কতবার বলব? আমি তাকে আসলে খুন করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু এবারের জন্য সে বেঁচে গেছে। সুদের জালে বন্দি ঋণগ্রস্ত বাবার তরুণী কন্যাকে বিয়ে করার নামে দিনের পর দিন ধর্ষণের অপরাধ শুধু নয়, সে এক হুজুরের সঙ্গে আমাকে জিনে ধরার অপবাদ দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আমি আদালতে মামলা করব।

আমার মুক্তি উদ্যাপন করতে বসন্তের সব ফুলের নির্যাস বুকে মেখে চাঁদ যেন মেলে দিয়েছে তার অবারিত আলোর ডানা। আবির সেই রাতে আমার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, শুনলাম, হুজুর গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। আর বাবা, তোমাকে-আমাকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেছেন। আমাদের সব দাবি তিনি মানবেন বলে আমতা আমতা কণ্ঠে ফোনে বলেছেন। রাখি বলল, আমি শুধু সেইসব মানুষকে বিশ্বাস করব, ভালোবাসার জন্য যাদের চোখ অশ্রুতে ভরে যায়। যা হোক, তার স্বাক্ষর করা চেকগুলো সব বাবার অ্যাকাউন্টে ক্রেডিট করে দিয়েছি। অনেক টাকার কিছু অংশ উঠিয়ে বাবা অপেক্ষা করছেন। যা আছে, সব গুছিয়ে নাও। তোমার সঙ্গে আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব – আমাদের দুজনের ডানা হয়ে উঠবে এক নীল আকাশ।