অনন্ত অন্ধকার

টানা দশ বছর চেষ্টার পর কাঁকন বিবি নিজের উপাধি বদলানোর একটা সুযোগ পেয়ে যায়। তার জন্য গ্রামে পড়ে থেকে খোদ ঢাকা শহরের সরকারি অফিসের একটা চ্যানেল খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। গ্রামের ঈদগাহ মাঠের পাশে বিশাল বটগাছ লাগোয়া স্কুলের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাকে দিয়ে আজকের আগেও দু-চারবার পতাকা উত্তোলন করানো হয়েছিল – ‘এবারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম বিলিয়ে দেওয়া আত্মত্যাগী বীরাঙ্গনা, কাঁকন বিবি’, রশিতে হাত দিয়ে শব্দগুলো কানে আসতেই তার কান গরম হয়ে যায়। তারপর ঝাঁঝাঁ করে। মাইকের আওয়াজটা যখন স্কুলের মাঠের আনাচে-কানাচে গমগম করে, পতাকার সরু রশিটা বাঁধতে গিয়ে তখন কাঁকন বিবির হাত থরথর করে কাঁপে। ‘একাত্তরে আমাদের হাজার-লক্ষ মা-বোনেরা হানাদারদের হাতে তাদের সম্ভ্রম খুইয়েছেন …’ – বয়স তেমন হয়নি, বয়সের ভার নয়, কাঁকন বিবির হাত কাঁপে মানুষের অমানবিক সম্মান প্রদর্শনের হিড়িকে। তখন লম্বাটে মুখে বয়সের আগে উঁকি দেওয়া কিছু বলিরেখা এঁকেবেঁকে ফুলে ওঠে প্রবল ঘৃণায়।

সরু রশিটা এক হাতে ধরে আরেক হাত দিয়ে নিচের দিকে টানার সময়ে কাঁকন বিবি ওপরে উঠতে থাকা পতাকার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায়। বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা পতাকার দিকে তাকালে গর্বে তার বুক ভরে যায় ঠিকই কিন্তু সূর্যের আলোয় চোখ যতটুকু কোঁচকানোর কথা, তার চেয়েও বেশি বিকৃত হয় এই ভেবে যে, সম্ভ্রম কি সে বিলিয়ে দিয়েছে অথবা খুইয়েছে? এ কি হাতে থাকা অগাধ ধনসম্পত্তি যে চাইলেই হাজি মুহাম্মদ মোহসিনের কায়দায় বিলিয়ে দেবে? সবচেয়ে বড় কথা, মানুষ সম্পদ বিলিয়ে দেয় নিজের ইচ্ছেতে, কিন্তু কেউ কি ইচ্ছে করে কিংবা পরিকল্পনা করে নিজের সম্ভ্রম বিলিয়ে দেয়? তাছাড়া, খোয়ানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। এই কথাটা শুনলে কাঁকন বিবির বিব্রত আর কোঁচকানো চোখ-ভুরু রাগে গজগজ করে ওঠে, কোন দুঃখে সম্ভ্রম খোয়াবেন তিনি? সম্ভ্রম যদি কেউ খুইয়ে থাকে তবে তার ওপরে যারা মাসের পর মাস নির্যাতন করেছে, খুইয়েছে তারা। তাদের আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকার কথা না। এতো মেয়ের ওপর নির্মম নির্যাতন করার পরেও তারা সারা দুনিয়ার লোকের সামনে মুখ দেখায় কী করে?

এসব ভাবতে ভাবতে কাঁকন বিবির স্বাধীনতা দিবস কাটে, কাটে বিজয় দিবসও। একবার-দুবার নয়, কমপক্ষে বিশবার তো কাটেই। প্রতিবার তার অন্তরে আফসোস গভীর হয়, আর প্রতিবারই তাকে বীরাঙ্গনা বলে সম্মান দেখিয়ে স্কুলের মাঠের লোকগুলো আগের চেয়েও বেশি পুলকিত বোধ করে।

তারপর আজকের অনুষ্ঠানে মুশফিক এসে উপস্থিত। একই গ্রামের ছেলে, ঈদের ছুটিতে শহর থেকে গ্রামে উদয় হয়েছে। অনুষ্ঠানের পরের দিন অতিথি হয়ে উঁকি দেয় কাঁকন বিবির বাড়িতে। কাঁকন বিবি তো অবাক! মেশিনে সেলাই করার জন্য কাপড় দিতে আর পোশাক উঠিয়ে নিতে বহু মানুষ অবশ্য তার টিনের পাঁচিলঘেরা বাড়ির শতাধিক ট্যাপ খাওয়া টিনের গেটে ঝনঝন শব্দ তুলে টোকা মারে। তবে ভরা সন্ধ্যায় নয়, বেলা থাকতেই আসে তারা, কাপড়ের নকশা বোঝানো আর বর্ডারের কাপড় বা বোতাম নির্বাচনের জন্য কাঁকন বিবির ষাট ওয়াটের বাল্বের টিমটিমে আলোর চেয়ে সূর্যের আলো নির্ভরযোগ্য। মুদির দোকানের জিনিসপত্র চালানের খবর নিয়েও আসে কেউ কেউ। তবে সবমিলিয়ে এলাকার লোকগুলো মোটামুটি চেনা। আবছা আলোয় বারান্দার পাশে বাতাসে শুকাতে থাকা শাড়ি সরিয়ে পায়ের গোড়ালি উঁচু করে তুলে ধরে কাঁকন বিবি অচেনা চুলের ছাঁট দেখে কৌতূহলী হয়। দিনভর দোকান আর সেলাইয়ের পরিশ্রমের পর খানিকটা বিরক্তও হয় হয়তো। ধীরে ধীরে যায় দরজা খুলতে।

মুখের কাছে কুপি ধরে কাঁকন বলে, ‘আরে তুমি, মানে, আপনে কে যেন?’

‘আপনে বলতেছেন কেন, খালা? আমি মোল্লাবাড়ির ছোট পোলা। ওই যে যুদ্ধের বছরে আপনি আপনের কোলের সন্তান যে বাড়িত রাইখা পলাইয়া গেলেন …  আমি তো তার লগে খেইলাই বড় হইতেছিলাম, অবশ্য যতদিন তারে তার বাপে ছোঁ মাইরা নিয়া না গেছিল। মনে পড়ছে আমার কথা?’

‘ও তুমি মুশফিক, তাই না?’

‘এই তো চিনতে পারছেন!’

‘তা তো পারছিই, কিন্তু অনেক বছর দেখি নাই তো, তাই এক দেখায় চিনি নাই আর কী।’

টিনের গেট ঘড়ঘড় করে সরে গেলে মুশফিক কাঁকন বিবির পেছন পেছন হাঁটে। উঁচু বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। কাঁকন বারান্দায় উঠে মুখের সামনে ঝুলতে থাকা শাড়িটা সরিয়ে দেয়। ওদিকে অবারিত আখক্ষেত বেরিয়ে পড়ে। তার পাশে বাঁশঝাড়ের ডগাগুলো উত্তরের বাতাসে কাঁপে। কাঁকন বিবি বলে, ‘ঠান্ডা লাগবে, ঘরে আইসা বসো।’

‘সামান্য শীত শীত ভালোই লাগতেছে, খালা।’

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হলেও তেমন শীত পড়ে না ঢাকার কাছেধারের এলাকায়। কাঁকন বিবি অবশ্য আবারো তাকে ভেতরেই নিতে চায়, বলে, ‘নিজের মতো ছোট একখান বাড়ি আমার। নিজের মতো কইরাই থাকি। তবু ভেতরে গিয়া বসলে কষ্ট হবে না হয়তো তোমার।’

‘না না এই জায়গাটা ভালো। ওইদিকে ছায়ার মতো বাঁশঝাড় দেখা যায়। ওই বাঁশঝাড় একাত্তরে এতো লম্বা তো আছিল না, নাকি?’

‘না না, তা কী কইরা থাকে, সেইভাবে কইতে গেলে এর অর্ধেক আছিল।’

‘ওই দিক দিয়াই পলাইছিলেন আপনে, তাই না? ওই যে বাঁশঝাড়ের ওই পারে নালা? তারপর পানিতে ডুইবা ডুইবা দেড়দিন পার করলেন, সত্য না? এই গল্প আমি বড় হইয়া মায়ের কাছে শুনছি। যখন এইসব গল্প শুনছি তখন অবশ্য স্বাধীন আর আমাগো বাড়িতে আছিল না। মনে আছে, আপনারে আমাগো বাড়ির সবাই বলত, স্বাধীনের মা। এখন অবশ্য বলে, বীরাঙ্গনা কাঁকন বিবি।’

কথা বলে নিয়ে মুশফিক দাঁত বের করে হাসে। পাশে টিমটিম করে কুপি জ¦লতে থাকায় তার বড় বড় দাঁত কিঞ্চিৎ হলুদ দেখায়। কাঁকন বিবি বলে, ‘বারান্দার বাতিটা ফিউজ ইইছে কয়েকদিন হইল। ওই জন্যই বললাম চলো ঘরে গিয়া বসি।’ মুশফিক কেন যেন উত্তর দেয় না; খানিক উদাস হয়ে বাঁশঝাড়ের দিকে তাকায়। সে ওদিকে তাকিয়ে কী ভাবে? কাঁকন বিবি চুপ করে থাকে। মিটিমিটি হাসতে চেষ্টা করে। স্বাধীনের কথার পিঠে অনেক কথা বলা যায়, কিন্তু কেন যেন বলতে ইচ্ছে করে না। এতো বছর পরে হঠাৎ করে শুধু স্মৃতিচারণ করতেই এসেছে মুশফিক? কে আজকাল কাজ ছাড়া তার কাছে আসে? আবার মুশফিকের যে তার কাছে কোনো কাজ থাকলেও থাকতে পারে তা-ও মনে হয় না। ভাবনা বাদ দিয়ে বরং কাঁকন প্রসঙ্গ বদলায়, ‘তোমার বাবা-মা ভালো আছেন?’

‘আছেন আর কী, নানান অসুখ-বিসুখ নিয়া থাকেন। আমি ঢাকায় সরকারি অফিসে কাজ করি। সচিবালয়।’

‘ও তাই নাকি? খুব ভালো’, আর তারপর কথা খুঁজে না পেয়ে কাঁকন বিবি বলে, ‘হঠাৎ আইলা, এই সময়ে কী খাইতে দিই তোমারে, বলো তো? ঝাল চানাচুর আর সিদ্ধ বুট দিয়া মুড়ি মাখা খাবা? রোজা তো মাত্র গেল, বুট সিদ্ধ করা আছে।’

‘খাওয়া নিয়া আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না, খালা। অ্যাদ্দিন বাদে আসছি, রাইতে আপনের লগে খাইয়া তারপর উঠব, সমস্যা আছে?’

‘সমস্যা নাই। তবে আমি একলা মানুষ, বেশিরভাগ একটাই সালুন রান্ধি। তোমার কি আমার খাওন ভালা লাগবে, বাবা?’

‘খুব লাগবে, লাগবে না ক্যান?’

কাঁকন বিবি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মুড়ি মাখতে বসে। মুড়ি মাখার পেঁয়াজ-মরিচ-ধনিয়া পাতা কাটার ফাঁকে বারান্দার এক কোণে পুরনো কড়াইয়ে বসানো ভ্রাম্যমাণ মাটির চুলায় চ্যালা কাঠ ঠেলে তাতে আগুন দেয়। দুধের হাঁড়ি চড়িয়ে বলে, ‘তোমার জন্য একটু পায়েস বসাই তাইলে। বাড়ির পিছনে দুইটা খেজুর গাছ আছে। নতুন গুড় বানানো হইল তো, নলেন গুড়। ওইটা দিয়া পায়েস খাইয়া দেখো।’

মুশফিক তৃপ্তির হাসি হেসে আকাশের দিকে তাকায়। তার যেন কোনো তাড়া নেই। হাতে সময় নিয়ে এসেছে এতোদিন পর – ভাবতে ভাবতে কাঁকন চোরা চোখে মুশফিকের দিকে তাকায়। তার ছেলে, স্বাধীন হয়তো এখন এরকম বড়োসড়োই হয়েছে। হয়তো এরকমই কপাল থেকে উলটো করে চুল আঁচড়ায়। তাতে করে তাকে হয়তো একটু বেশি লম্বা দেখায়। আচ্ছা, স্বাধীন কতটা লম্বা হতে পারে? তার বাবা পুরুষ হিসেবে মাঝারি উচ্চতার। তবে স্বাধীন তো লম্বা হতেও পারে, কাঁকন বিবি সাধারণ বাঙালি মেয়েদের তুলনায় লম্বা। আচ্ছা, স্বাধীন বাবার শেখানো বুলি অগ্রাহ্য করে কোনোদিন মুশফিকের মতো তাকে দেখতে চলে আসতে পারে না? 

মুড়ি খেতে খেতে কাঁকনের জীবনের কত কথাই না শোনে মুশফিক। আজ যেন সে শুনতেই এসেছে। কাঁকনও বহুকাল পরে শোনানোর মতো মানুষ পেয়ে বাঁধভাঙা নদীর স্রোতের মতো কথা বলে।

‘আমার কথা কী বলছিল তোমার মায়ে? আচ্ছা, স্বাধীনের কথা তোমার মনে আছে?’

মাখানো মুড়ির লোকমা মুখে দিয়ে মুশফিক তার দিকে তাকায়। খড়ির চুলার নীলচে-কমলা শিখার সামনে কাঁকন বিবির ফর্সা মুখে কখনো নীল কখনো কমলাটে আভা দেখা যায়। গালের ওপরটা একবার জ¦লে, একবার মøান হয়ে যায়। একটা সরু চুড়ি হাতে খুন্তি দিয়ে সে হাঁড়ির দুধে চক্রাকারে হাত ঘোরায়। সেদিকে তাকিয়ে মুশফিকের অদ্ভুত মায়া লাগে, হুট করে বলে, ‘খালা, জানেন স্বাধীন এখন ঢাকায় থাকে? কয়েক দিন আগে পল্টনে রাস্তা পার হইতে গিয়া দেখা।’

এতোক্ষণে কাঁকন বিবির কাছে মুশফিকের বাড়ি বয়ে আসাটা অর্থপূর্ণ হয়। মুখে চলে আসে, সে কি আমার কথা জানতে চায়? কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। মুশফিক বলে চলে, ‘এতো বছর আপনের কাছে না আইসা সে ঠিক করে নাই।’

‘এইটা সে নিজ মুখে বলল?’ হাঁড়ির মধ্যে খুন্তি থেমে যায় কাঁকনের।

‘না, ঠিক সরাসরি বলে নাই, তবে হাবেভাবে বুঝলাম।’

কাঁকন ছোট্ট করে ‘ও’ উচ্চারণ করে।

আবারো প্রসঙ্গ বদলানোর মতো করে চুলা থেকে পায়েসের হাঁড়ি নামিয়ে দুপুরে রান্না করে রাখা কই মাছের ঝোলের তরকারি গরমে বসায়।

‘আজকে কই মাছে ফুলকপি দিছি। খাইবা তো তুমি?’

‘এইটা তো আমার অনেক প্রিয়। আমি শীতকালে এইগুলা খাইতেই গেরামে আসি।’

‘স্বাধীন ওর বাপের গ্রামে যায় না?’

‘যায়, তবে এখন আসবে না। নতুন চাকরি। কিছুদিন পরে আসবে। আপনি এই বাড়িত থাকেন কি না জানতে চাইল।’

কাঁকন বিবি আবারো ছোট্ট করে ‘ও’ বলে। তারপর বলে, ‘সেলাই খুব আনন্দের কাজ, বুঝলা? তবে মার্কেটের দোকানের মতো টাকা নিতে পারি না আমি। তাইলে তো সবাই মার্কেটেই যাবে, এত্ত দূরে ভাঙা রাস্তা ডিঙাইয়া আমার বাড়িতে আসবে কেন? তবে আয়-রোজগার যাই হোক, আমার সেলাই করতে ভালো লাগে। এইটা তো একরকমের সৃষ্টি। সৃষ্টি সবসময় আনন্দের। তবে কথা হইল আমার একটু চোখটা দেখানো দরকার। ইদানীং সেলাই করতে অসুবিধা হয়। চল্লিশ বছর পার হইছে, চালশে হইব না?’      

‘তাইলে সোজা ঢাকায় চইলা আসেন, খালা। ওইখানে ভালো ডাক্তার পাইবেন। চোখের সমস্যা কিন্তু অবহেলা করা ঠিক না।’

‘হ, ঠিক বলছো। এমনিতেও ঢাকায় আসলে আমার একবার যাওয়া দরকার, অন্য একটা কাজে।’

‘কী কাজ?’

‘তুমি শুনবা? শুইনা কী করবা, কাজটা করার মতো মানুষ পাই নাই তো।’

‘বইলাই দেখেন। যদি আমি কিছু ব্যবস্থা করতে পারি?’

কাঁকন বিবি কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে। মুশফিককে বলবে কি না ভাবে। অযথা এসব কথা নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলার মানে হয় না। তবে মুশফিক তো আর সেদিনের বাচ্চা না, বড় হয়ে সরকারি চাকরি করছে। আর সরকারি লোক ছাড়া কাঁকন বিবির সমস্যা কে সমাধান করতে পারে! কাঁকন চুলা থেকে মাছের কড়াই নামিয়ে বেঞ্চে এসে বসে। মুশফিক বাটি এগিয়ে দিলে মুঠ ভরে মুড়ি মুখে দেয়। মুশফিক বলে, ‘মরিচে ভালো ঝাল আছে কিন্তু।’

উঠানোর একটা কোণ দেখিয়ে কাঁকন বলে, ‘হ্যাঁ, ওই যে ওইখানে বিচি ফেলছিলাম। গাছ হইছে। শীতকালের মরিচে ঝাল হয়।’

‘তবু খালা, গ্রামে বইসা কিছু খাইলে জিনিসের মজাই আলাদা। শহরে মনে হয় খালি বাঁইচা থাকার জন্য যা পাই গিল্যা ফেলি।’

কাঁকন বিবি মুচকি হেসে বলে, ‘আহা রে!’ তারপর বলে, ‘শোনো, বাবা, তোমারে আমার সমস্যাটা বলি। আমি হইলাম গিয়া মুক্তি। কিন্তু বীরাঙ্গনা বইলা মাতামাতি করা লোকজন আমারে বীরাঙ্গনা বানাইছে। এইটা কি ঠিক করছে তারা?’

মুশফিক পরিষ্কার বুঝতে না পেরে বিভ্রান্ত চোখে কাঁকনের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘তাইলে খালা আপনে কি বীরাঙ্গনা না?’

‘দেখো, মুশফিক, তুমি কী মনে কইরা বলতেছো আমার জানা নাই। আমি বীরাঙ্গনা মানে জানি। আমি যুদ্ধে থাকা বীর মাইয়া। কিন্তু গ্রামে প্রায় একঘরে হইয়া নিজের বাড়িতে চুপচাপ জীবন যাপন করলাম, স্বামী ছাইড়া গেল, সন্তান হারাইলাম, তারপরেও তুমি বুঝলা না যে বীরাঙ্গনা মানে কী? বুঝলা না এই সমাজে মুক্তি আর বীরাঙ্গনা যে এক না? এই খেতাবের পর বীরাঙ্গনার অর্থ দাঁড়াইছে, যারা পাকি আর্মিদের হাতে নির্যাতিত হইছে।’

এইবার হয়তো মুশফিক খানিকটা বুঝে উঠতে পারে। তাই মাথা নেড়ে বলে, ‘ও তাই বলেন। আপনি বীরাঙ্গনা আছেন, তয় মুক্তি হইতে চান।’

নিজেকে কারো সামনে জাহির করতে এতো বছর পর আর ভালো লাগে না কাঁকনের। কিন্তু কথাটা যখন উঠেছেই আর মুশফিক যেমন সরল ব্যাখ্যায় চলে যাচ্ছে তখন তার আর কথা না বলে উপায় থাকে না। ক্ষোভটা মুখের ভঙ্গিতে না এনে বরং দৃঢ়স্বরে বলে ওঠে, ‘হবো মানে?’ তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় করে ছেলেটার সন্দেহের ধকলটা সামলাতে চায়। কথা বলতে ঠোঁট শক্ত হয়, তবু বলে, ‘হবো মানে কী, আমি তো তখনই মুক্তি আছিলাম, সেই একাত্তরে।’

‘তা তো বটে, তা তো বটে। কিন্তু মুক্তি হইয়াও বীরাঙ্গনা হইছেন, এইটাই তো সমস্যা আপনের, নাকি?’

কাঁকন বিবি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে ভুলে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সমস্যাটা এতোই জলবৎ তরলং নাকি! যেন বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় পাওয়া আর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠা – সবই তুড়ির ব্যাপার। কাঁকন বিবির কৌতূহল হয়, ‘তাইলে আর কী বলি, এইটাই তো সমস্যা।’

‘ব্যাপার না। বললাম যে তখন, সরকারি অফিস, নাম তার সচিবালয়, চেনেন?’

কাঁকন বিবি আগের মতোই ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

‘বুছ্ছি। ওইখানে এইসব কাজ যেখানে হয়, সেইখানকার এক কেরানি আমার পরিচিত। খালি পরিচিত না, খাতিরের লোক। উপরে হাত আছে। ওইখানের একটা কেরানির ক্ষমতা যে কত তা আপনে চিন্তাও করতে পারবেন না। তারে কইলে একটা ব্যবস্থা না হইয়া যায় না।’

কাঁকন বিবি বেঞ্চের সামনে টেবিল টেনে আনে। টেবিলে ভাত-তরকারি দেয়। বহুদিন বাদে নিজ হাতে রান্না করা পায়েস বাটি ভরে ছেলেটার থালার পাশে রাখে। তারপর অনুরোধের কায়দা করা নিজের কণ্ঠস্বর বহুকাল বাদে নিজেরই অচেনা লাগে, ‘তাইলে একটু উনার সঙ্গে আলাপ কইরা লাইনটা ফিট কইরা দ্যাও না, বাবা!’ কাঁকন বিবির চোখ চকচক করে। সে আর কথা বাড়ায় না। হয়ে গেলে হয়ে যাক। এই ভুলজীবন আর ভালো লাগে না। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা হলে একদিকে সম্মান, অন্যদিকে ভাতাও পাওয়া যাবে, সব কারণের পর এটাও নিতান্ত কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেলাই-ফোঁড়াই কতদিন করতে পারবে তার তো ঠিক নেই। নিজের মুদির দোকানের হিসাব দেখারও ক্ষমতা থাকবে না একসময়। তার আগে জীবনের শেষ ইচ্ছা পূরণ আর আয়ের এই ব্যবস্থাটা হয়ে গেলে বাঁচা যায়।

মুশফিক কই মাছের ঝোলে মাখানো আঙুল চাটতে চাটতে বলে, ‘তা মুক্তি যে আছিলেন, তার পরে বীরাঙ্গনা হইছিলেন কী কইরা যেন?’

কাঁকন বিবির মুখে ভাষা জোটে না। মনে মনে বলে, কী করে বুঝবে তা মানুষ? বললে কী লাভ, গল্প শুনে কে কবে পৌঁছাতে পারে অতীতে? ভাবতে ভাবতে মুখে আঁচল চাপা দেয় কাঁকন বিবি। বিব্রত মুখটায় এই শীতেও ঠোঁটের ওপরে দ্রুত জমে ওঠা ঘামের বিন্দুগুলো আঁচলটা শুষে নেয়। জীবনের করুণ দিনগুলো ফর্সা মুখ থেকে মোহনীয় আবেদনটুকু উবে দিলেও কোথায় যেন একটা সারল্য এখনো জ¦লজ¦ল করে। সেই সারল্যের কারণে মানুষের কুৎসিত প্রশ্ন এখনো হজম করতে পারে। কিন্তু এরকম প্রশ্নের বিপরীতে সেই একই গল্প আবারো বলতে গেলে হয়তো ক্রোধ আসবে, আবেগ গলে বেরোবে অশ্রু হয়ে, তাই বলা থেকে বিরত থাকে।

কাঁকন বিবির নীরবতা হয়তো অনেক কিছু বলে দেয়। তাই মুশফিক চুপ হয়ে যায়। প্রশ্নের উত্তরও আর চাই না তার। বলে, ‘ঠিক আছে, খালা। আমি সব ফিট কইরা তোমারে ঢাকায় আসতে বলব। আইসা পইড়ো।’

‘কাজ হবে তো?’

‘হবে না মানে? মুশফিক ফালতু কথা বলে না।’

ছেলেটা চলে গেলে কাঁকন বিবি ভাবতে বসে। মাথার ভেতরে কথাগুলো পাক খেয়ে ওঠে বারবার – তা মুক্তি যে আছিলেন, তার পরে বীরাঙ্গনা হইছিলেন কী কইরা? গ্রামে কে না জানে কাঁকন বিবির এই কাহিনি, কিন্তু বিশ^াস করে কতজনে? তাই হয়তো বারবার শুনতে চায়। কই, জানার পরেও তো আজ পর্যন্ত কেউ তাকে মুক্তিযোদ্ধা বলেনি, বরং হাজারবার বলেছে বীরাঙ্গনা। যেভাবে সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেছে, তা ভাবলেও কাঁকন বিবির কাছে নিষ্ঠুর লাগে। স্বামী তো সম্মান দেখিয়ে রেপ ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হওয়ার পরে ধুমধাম করে ঘরে তুলল। কাঁকনের মা-বাবা মহাখুশি তখন। মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে চরিত্রের গায়ে কালিঝুলি মাখা মেয়েমানুষ, জামাই নিজের ইচ্ছেতে বাড়ি নিয়ে না গেলে তাদের কিছু বলার ছিল না। এতো কিছুর পরে মেয়ের সংসার নতুন করে বসলে কে না খুশি হয়, মুদির দোকানদার, কাঁকন বিবির বাবাও খুশি হলেন তাই।

তখন কাঁকনের বয়সইবা কত, একুশ কি বাইশ, তাই বোঝার মতো জ্ঞানও হয়নি যে, বীরাঙ্গনাকে কেউ দূর থেকে লোক-দেখানো সম্মান দেখাতে পারে ঠিকই কিন্তু ঘরের বউ করে রাখতে পারে না। বাস্তবে তাই হলো কাঁকন বিবির সংসারে। বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা ডাকলেন তার মতো মেয়েদের। কাঁকন বিবি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছিল তাই তখনই জানতে বাকি ছিল না যে বীরাঙ্গনা হলো গিয়ে রণাঙ্গনের বীর নারী। কিন্তু কদিনেই বুঝতে পারল, এ যেন অন্য কিছু বলা হলো। বলা হলো যে, তারা এই সমাজ থেকে আলাদা, যখন দেখল উঠতে-বসতে স্বামী চরিত্র নষ্ট বলে খোঁটা দেয়, পাড়ার লোকেরা অন্য চোখে দেখে। এসব শুনতে শুনতে তার মতো কত মেয়ে তখন কোথায় কোথায় ভেসে গেল! হারিয়ে গেল জীবন থেকে, জগৎ থেকে। কাঁকন বিবি ভাবল, তার তো অন্তত একটা ঘর হয়েছে! হোক না সে ঘর গঞ্জনায় ভরা। তবু টিকুক, বাবা-মা খুশি থাকুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ঘর কি টিকল! দিনের পর দিন পাকিস্তানি সেনাদের ছুঁয়ে দেওয়া মেয়েটাকে আর সহ্যই করতে পারল না জামাইটা। কাঁকনকে তখন নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে হলো। একদিন আজকের মতোই ভরসন্ধ্যায় টিনের গেটের পাশে মেয়েটাকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাবা-মা ডুকরে উঠেছিল। তারপর সেই শোকেই হয়তো ধীরে ধীরে দুজনে অসুস্থ হয়ে পড়ল। যুদ্ধের বছর দুয়েকের মধ্যে দুজনেই সাবাড় হয়ে গেল। কাঁকন টিকে থাকল একা। 

এই পর্যন্ত ভাবতে ভাবতে কাঁকনের হঠাৎ চেতনা আসে, কেন সে নিজেকে হাজারবার নিষেধ করার পরেও এসব ভাবনায় ডোবে? মনটা ঘোরাতে চেয়ে মনে হয়, মুশফিক যাওয়ার পরে বাইরের গেটটা লাগায়নি। দোকানের দারোয়ানের ছেলেটা রাতে এসে এ-বাড়িতে থাকে। দারোয়ান বলে, ‘সঙ্গে একজন পাহারাদার থাকুক, মা।’ প্রথম যেদিন বলেছিল কাঁকন তার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল। একাত্তরে তার পাহারাদার ছিল না, তখন যা হওয়ার হয়েছে। এখন স্বাধীন দেশে পাহারাদার লাগছে। তবে নিজের জন্য ভয়ের অনুভূতি তেমন না থাকলেও বাপের আমলের পুরনো পাহারাদারের কথা মেনে নিয়েছে। ছেলেটা বাপের সঙ্গে সারাদিন দোকানে কাটিয়ে রাতে খাওয়ার পরে চলে আসে। ছেলেটা হয়তো এলো বলে। কাঁকনের আলসেমি লাগে, মনে হয় গেটটা খোলাই থাক। জং ধরা ঝুরঝুরে গেটটা খোলা থাকলেইবা কী। আরো কত ভাবনা কাঁকনকে উঠতে দেয় না। মুশফিক হঠাৎ এসে স্মৃতির ভাণ্ডারে একটা আলোড়ন তুলে দিয়ে গেছে।

এরকমই একদিন সন্ধ্যার মুখে গেটটা আধাখোলা ছিল। মা হয়তো আশেপাশে কোথাও গেছিল। কাঁকন স্ফীত হতে থাকা

পেটের মধ্যে বাচ্চা নিয়ে এই বারান্দার সিঁড়িতে বসে ছিল। মাস চারেকের মধ্যে বাচ্চা হবে, সে- কারণেই বাপের বাড়িতে আসা। কিছুদিন ধরে থমথমে পরিস্থিতির কথা গ্রামের মানুষ বলাবলি করছিল। তাই নিরাপদ থাকার জন্য কাঁকন বিবি একটু বেশি আগেই বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। হঠাৎ করে তখনকার চকচকে গেটটায় ঝনঝন শব্দ শুনে চমকে তাকিয়েছিল। গ্রামের ছেলে মনির সঙ্গে দুজন মানুষকে নিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছিল তাদের উঠোনে। মনির বলছিল, ‘কাঁকন, এরে একটু পানি দাও।’ ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাঁকন দেখেছিল তাদের মধ্যে একজনের হাতের কনুই থেকে ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। উঠোনের শুকনো গায়ে শুঁষে নিয়ে কালো তিলের মতো হয়ে যাচ্ছে। কাঁকন তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে পানির জগ আনতে গিয়েছিল। তারা তিনজনও সিঁড়ি ডিঙিয়ে কাঁকনের পেছনে পেছনে ঘরের ভেতরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। ঢক্ ঢক্ করে পানি খেয়ে নিয়ে গায়ে জড়ানো চাদর খুলেছিল মনির। তাদের তিনজনের গায়েই ছিল রক্ত। পেটের মধ্যে বাচ্চার মৃদু নড়াচড়ার আভাসের মধ্যে হঠাৎ রক্তের ধারা আর দাগ কাঁকনের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিল। যেন কোমল কোনো বাগানে সাপ ঢুকে পড়েছে। কাঁকন বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মনির তখন দ্রুত বলেছিল, ‘তোমার মা কই, কাঁকন? আমরা ঢাকা থেকে নদী পার হয়ে আসলাম। খালের উপর দিয়া তোমাদের বাড়িতে আসছি। আজকে রাতটা এখানে থাকতে দিবা এদেরকে? আমার বন্ধু। ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। মিলিটারি বহু ছাত্রকে মেরে ফেলছে। রক্তে রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে। এদেরকে আমি বাঁচায়ে আনছি। গ্রামের ভিতরের দিকে নিয়ে গেলে আবার আর্মির হাতে ধরা পড়ি নাকি বলা যায় না … তাই তোমাদের বাড়িতে থাকলে হয়তো … তা তোমার মা কই বললা না?’

কাঁকন আগের মতোই বোবা ভঙ্গিতে ভেতরের দিকের ঘরে ইশারা করেছিল। তারপর গরম পানি আর গামছা এগিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে একে একে আঠারো দিন মনির আরো কিছু মানুষকে ধরে এনেছিল ওই বাড়িতে। গ্রামের স্কুলঘরে এনে রেখেছিল কয়েকজনকে। নদীর ওই পার থেকে উৎসবের আনন্দের মতো যে মুহুর্মুহু শব্দ আসত, তা ছিল মানুষের মৃত্যুর পরোয়ানা। হয়তো একেকটা শব্দে একজন মানুষের জীবন ঝরে যেত। মানুষের জীবন তখন রাস্তার কুকুরের চেয়েও কম দামি, আকাশে উড়ন্ত পাখির চেয়েও কম স্থায়িত্বের। স্রোতের মতো মানুষ তখন নদী পেরিয়ে আসত – ভোরের আজানের সময়, দিনে-দুপুরে, কি মধ্যরাতে। সময় নেই অসময় নেই শোনা যেত ঝুপঝাপ বৈঠার শব্দ বাড়ির পেছনের ঘাটে এসে থেমে যাচ্ছে। তারপর ফিসফিস। বাচ্চাদের মুখ চেপে ধরা হতো, তারা পরে কাঁদতেও ভুলে যেত। কচি বাঁশের শনশন শব্দে সেখানে তখন নিস্তব্ধতা নেমে আসত। বাঁশবাগান থেকে খালি পায়ে কখনো দুর্বল, কখনো আহত মানুষগুলোকে মনির আর তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কাঁকনের বাবাও ধরাধরি করে আনত। তারপর প্রাথমিক চিকিৎসার পর, পানি বা খাবার খাইয়ে স্কুলঘর বা গ্রামেরই অন্য বাড়িতে চালান করা হতো। এই কর্মযজ্ঞে কখন দুটো মাস কেটে গেছে কারো যেমন খেয়াল ছিল না, কাঁকনের নিজেরও খেয়াল ছিল না শরীরে প্রায় পরিণত বাচ্চা বয়ে বেড়ানোর কথা। সারাদিন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা, আশ্রয় নেওয়া লোকগুলোর জন্য দোকান থেকে খাবার, ব্যান্ডেজ আর ওষুধের ব্যবস্থা করা, এই করতে করতেই কাঁকনের দিন আর রাত এক হয়ে গেছিল। তারই মধ্যে মনির কোত্থেকে একদিন তিনজন মানুষ এনে পরিচয় দিলো বিশ^বিদ্যালয়ের ক্লাসের বন্ধু বলে। তাদের পিঠের ঝোলা থেকে বেশ কিছু রাইফেল আর গোলাবারুদ বেরোল। তারা নাকি খালি হাতে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে কাবু করে ওসব ছিনিয়ে এনেছে। কাঁকন ভাবে, মানুষের মনের জোরও হয়, খালি হাতে এতো গোলাবারুদের সামনে বুকটা পেতে দিয়েছিল কীভাবে ওরা! ওই গোলাবারুদ সামনে নিয়ে ইয়া বড় পেট ঝুলিয়ে কাঁকন বহুক্ষণ বসে থাকে, তখন মনটা কেন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। কোথায় চলে যায় কোমল সন্তানের জন্য মায়া তখন, শীতল গুলিগুলোকে ছুঁয়ে কেবল মনে হতে থাকে, বাচ্চাটা শরীর থেকে খালাস হতেই এই গোলাবারুদে পাকিস্তানিদের সে ঝলসে দেবে। ভেতরে ভেতরে দৃঢ় একটা প্রতিজ্ঞা তৈরি হয়।

মনিরের সঙ্গে বহু মানুষ আসে-যায় আর স্কুলঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু গোলাবারুদ নিয়ে আসা ছেলেদুটো আর বাড়ি ছেড়ে যায় না। দুদিনের জন্য গেলে আগের চেয়েও বেশি গোলাবারুদ সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়। কাঁকনের বাবা নিজের হাতে সেগুলোকে ছাদের মাচায় চালান করে। একজন রাতে এসে রেখে যায়, পরের রাতে আরেকজন পাখির মতো শিস দিয়ে বাঁশঝাড়ে এসে দাঁড়ালে কাঁকন ফোলানো পেটের নিচে সেগুলোকে বেঁধে বাঁশঝাড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে। এরকম দিন যেতে যেতে কবে কাঁকন আর তার মা-বাবা, প্রত্যেকে মনিরের এক গাদা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দিন-রাতের গোপন কাজে-কর্মে ভিড়ে যায় বোঝা যায় না। কাঁকনের যখন বাচ্চা হবে হবে, তেমন সময়ে গ্রামে একদিন পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি এসে থামে। মনিরের বন্ধুরা যেন কোত্থেকে ছুটে এসে মজুদ গোলাবারুদ নিয়ে বাড়ির পেছনের খালে গিয়ে নামে। যাওয়ার সময়ে কে যেন চিৎকার করে বলে দিয়ে যায়, ‘আর্মি আসলে তোমাগো ছাড়ব না, কাঁকন। পলাও গিয়া।’ কাঁকন ইয়া বড় পেট নিয়ে তাদের পেছনে পেছনে হামাগুড়ি দেয়। বাঁশঝাড়ে ঢুকে কাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় তার। বাঁচার আকুতিতে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে খালের ধারে ঢালু মাটির স্পর্শ পায়। তারপর পিছলে পানিতে পড়ে চুপচাপ ডুবে থাকে। এতোই ধীরে ডুবে যায় যে অন্ধকারের মধ্যে বয়ে চলা বাতাস পানিতে আলোড়নটুকুও তুলতে পারে না। 

আলোড়ন ওঠে না পরের দিন প্রায় দুপুর অবধি। নিজেদের অস্ত্র আর গোলাবারুদসহ মুনিরের তিন বন্ধু আর কাঁকন পানির নিচে ঠায় বসে থাকে। খানিক দূরে অন্ধকারের মধ্যে ছাইয়ের কুণ্ডলী পাক খেয়ে খেয়ে আকাশে গিয়ে মেশে। বাতাসে সহস্র জোনাকি পোকার মতো আগুনের ফুলকি ভাসে। পানির ওপরে নাকটা ভাসিয়ে দিলে ধোঁয়ার গুমোট গন্ধ এসে লাগে। আর চোখ ভাসালে দেখা যায় জোনাকিগুলো। উঁচু-নিচু বাঁশগুলোর মাঝখান দিয়ে তাকালে পুড়ে পুড়ে দ্রুত মাটিতে গড়িয়ে পড়া দেয়াল দেখা যায়, কাঁকনদের বারান্দা, ঘর,  পেছনের একটা জলপাই গাছ – চোখের সামনে সবকিছুর অস্তিত্ব ছাইয়ের গাদায় ছাই হয়। দূর থেকে আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসে। জোনাকি পোকার ঢেউয়ে সে-আর্তনাদ ধাক্কা লাগায়, মাথার ওপরের কালচে আকাশে এলোমেলো আলোড়ন ওঠে। মুখ দিয়ে যেন শব্দ না বেরোয় তাই কাঁকন পানির নিচেই মুখের ওপর হাত চাপা দেয়। নিশ^াসও নিতে ভুলে যায় মাঝে মধ্যে। পরদিন ভোর থেকে পেটের মধ্যে বাচ্চাটা আর নড়ে না। বাচ্চার কথা কাঁকনের খেয়াল হয় বহু পরে, তখন মনে হয় বাচ্চাটা হয়তো নিথর হয়ে গেছে। আগের রাতের মতোই আবারো দিশেহারা লাগে তখন। প্রাণের মায়া তুচ্ছ হয়ে যায়। আগের রাতের মতোই হামাগুড়ি দিয়ে সে মাটিতে ওঠে। শরীর মাটির ওপরের দিকে ওঠে কিন্তু বাচ্চাটা মনে হয় নিচের দিকে নেমে আসছে। পানি থেকে মাটির ওপরে ওঠার পরে সে বাঁশগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে বাড়ির দিকে তাকায়। সেখানে মিইয়ে যাওয়া ধোঁয়ার দু-একটা উৎস ছাড়া তেমন কিছু নজরে আসে না। টিনের পাঁচিল আগুনে ঝলসে জায়গায় জায়গায় ঝুরঝুরে হয়ে ঝুলে আছে। মনে পড়ে তারই ফুটোগুলো দিয়ে বাড়ির দিকে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে নিজের শরীর থেকে আলগোছে বাচ্চাটা বেরিয়ে যাওয়ার অনুভূতি টের পায়। ক্লান্তিতে আর যন্ত্রণায় চোখ বুজে আসে। এরপর যখন চোখ মেলে তখন কোনো এক বদ্ধ ঘরে শুয়ে আছে, গায়ে শুকনো কাপড়। চোখ মেলে চারদিকে খুঁজলে মোল্লাবাড়ির মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটা মুখের ওপরে ঝুঁকে আসে, ‘মরতে মরতে জানটা নিয়া বাঁইচা আইলি, কাঁকন। আমিও ওইদিকে পলাইছিলাম। ভাগ্যিস আগুন নিভার পর ওইদিক দিয়া বাড়ি আসতে গিয়া তরে পাইলাম। খালের একটা ঝিনুক দিয়া তর নাড়ি কাটছি। বাইচ্চাটা ভালা আছে, বুঝলি? ছেলেসন্তান হইছে তোর!’ কথা শুনে কাঁকনের দুই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। বহুদিন বাদে স্বামীর কথা মনে পড়ে। মাস চারেক আগে তাকে এখানে রেখে যাওয়ার পরে আর কখনো যোগাযোগ হয়নি। কাঁকন তখন তার কথা ভাবা বন্ধ করে বলে, ‘আমার বাপ-মা কই?’ মোল্লাবাড়ির মেয়েটা বলে, ‘কইতে পারি না রে। মিলিটারি আসলে কে কোন দিকে পলাইছে তার কি ঠিক আছে?’ কাঁকনের স্মৃতিতে তখন বাড়ি পুড়তে থাকা লাল-নীল শিখার স্মৃতি আসে। বাবা-মা কি বেঁচে আছে? ভাবনা বেশিদূর আগায় না। ক্লান্তি আর অবসন্নতায় চোখ আবারো বুজে আসে।

দুদিনেই কাঁকন ঠিকঠাকমতো চলতে ফিরতে পারে বটে কিন্তু বাচ্চা লালনপালনে যেন মন নেই তার। মোল্লাবাড়ির মেয়ের বাচ্চার বয়স তখন এক বছর মোটে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে দেখে তাদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে, এটুকুই হয়তো কাঁকনের জন্য অনেক হওয়ার কথা ছিল। অথচ তারপরও কাঁকন এক রাতে ক্রন্দনরত বাচ্চা কোলে নিয়ে মেয়েটার ঘরের সামনে দাঁড়ায়, লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলে, ‘তোমার বুকে তো দুধ আছে, বুবু, এরে একটু খাওয়াইয়া বাঁচায়ে রাখো না! আমার যে কাজ আছে মেলা।’

‘কী কস তুই, কাঁকন, বাচ্চারে খাওয়ানো ছাড়া তোর এখন কাজটা কী শুনি? আমরা যদি চাইরটা খাইয়া বাঁচি তাইলে তুইও বাঁচবি।’

‘কিন্তু আমার অনেক কাজ আছে, বুবু। এই দেশে কত মানুষ মরতেছে, কত বাইচ্চা না জানি ভাইসা যাইতেছে বানের জলের মতো, তাদের না বাঁচাইয়া শুধু নিজের বাচ্চা নিয়া বইস্যা থাকতে পারব না আমি। দেখি মনির ভাই আর তার বন্ধুরা কোনদিকে গেল। আমার সত্যি অনেক কাজ এখন।’

মোল্লাবাড়ির লোকেরা কাঁকনের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল হয়তো কিন্তু তাকে বাধা দিতে পারেনি। ওদিকে কাঁকন যেসব বাড়িতে দরকারি জিনিস আর গোলাবারুদ পৌঁছে দিত তারই একটাতে পেয়ে গিয়েছিল মনিরের বন্ধুদের। তারা তখন কেউ কেউ যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছে। কাঁকন দ্বিধাবিহীনভাবে তাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছিল। পেছনে ফেলে এসেছিল ধুঁকে ধুঁকে পোড়া বাড়িঘর, কাঁথায় মোড়ানো একতাল মাংসের দলার মতো ট্যাঁ ট্যাঁ করা শিশু। কারো কথাই মনে হয়নি তখন কাঁকনের। মনে ছিল শুধু ট্রেনিং নিয়ে যত শক্তি আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে একেকটা পাকিস্তানি সেনার ওপর। করেও ছিল তাই। ট্রেনিং শেষ হলে কাঁকনকে যেতে হয়েছিল সিলেটের পাঁচ নম্বর সেক্টরে। প্রথম কিছুদিন গুপ্তচরের কাজ করে তারপর কাঁকন বিবির সামনে সুবর্ণসুযোগ আসে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়ার। পরপর কয়েকটা মিশনের পর একদিন কাঁকনের জীবনের এক ভয়াল মিশন এসে পড়ে। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো কাঁকনের হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। সামনে যা থাকে ভাংচুর করে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশের উদ্দেশে রওনা দিতে সাধ হয়।

সুনামগঞ্জের এক গুদামে পাকিস্তানি সেনা থাকার খবর পেয়ে অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে গিয়েছিল তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিন বারোজনের দলের তিনজন সম্মুখযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরে বাকিরা হাতেনাতে ধরা পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে। প্রত্যেকের মাথার দিকে একেকটা গুলি বরাদ্দ হয়েছিল শুধু কাঁকন বিবি ছাড়া। নারী হয়ে জন্মানোর জন্য ওইদিনের মতো আফসোস আর কোনোদিন হয়নি কাঁকনের। কাঁকন চিৎকার করে বলেছিল তাকে মেরে ফেলতে, অনুনয় করেছিল কিন্তু সেনারা তখন হেসেছিল। মাসখানেক তাদের ক্যাম্পে রেখে নির্যাতনের পর তার স্থান হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের এক রেপ ক্যাম্পে।                          

যুদ্ধের পর কপালে বীরাঙ্গনার ছাপ এঁটে কাঁকন রেপ ক্যাম্প থেকে উদ্ধার হয়। নিজের গ্রামে ফিরে নতুন ভূমিতে উপনিবেশ তৈরির মতো করে কাঁকন নিজের ভিটায় পাঁচিল তোলে। ছেলেকে নিজের কাছে আনতে চাইলেও মোল্লাবাড়ির মানুষের ভালোবাসার কাছে হার মানে। তারা বলে, থাকুক না আরো কিছুদিন, তাদের ছেলে, মুশফিকের সঙ্গে খেলুক আরেকটু। কাঁকনের স্বামী নিতে এলে যাবে কি যাবে না – এই সিদ্ধান্তে মাসের পর মাস চলে যায় তার। শেষে একদিন যেতেই হয় বাবা-মায়ের চাপে। কিন্তু সেখানে ঠাঁই হয় না। বীরাঙ্গনাকে যতই সম্মান দেখাক কেউ, তার সঙ্গে ঘর করতে গেলে উঠতে-বসতে খোঁটা না দিয়ে থাকা কঠিন। রাগের মাথায় স্বামী মোল্লাবাড়ি থেকে ছেলেটাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। শোকে বিধ্বস্ত কাঁকনের তখন বলার থাকে না।

তারপর থেকে বাপের ভিটায় একাকী জীবন কাঁকন বিবির। সেলাই-ফোঁড়াইয়ে ব্যস্ত, কারো কথা গায়ে তোলার সময় নেই। নিজের সব সিদ্ধান্ত নিজেরই। ঠিক যেমন একদিন একার সিদ্ধান্তে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এসব কথা ভাবলে এখনো কাঁকন বিবির রক্ত চলাচল দ্রুত হয়, মাথার ভেতরে সাইরেন বাজে। কাঁকন মাথার দুদিক চেপে ধরে। বারান্দার খুঁটিতে মাথাটা কাত করে রাখে।

ট্যাপ খাওয়া টিনের গেটটা বন্ধ করার ঢ্যাপ ঢ্যাপ শব্দে সেদিকে তাকাতে হয়।

‘এতো রাইতে আন্ধারে বইসা আছেন ক্যান, খালাম্মা?’ পাহারাদারের ছেলেটা সামনে দাঁড়িয়ে। কাঁকন উঠে দাঁড়ায় কোনোরকমে, ‘ও, তুমি আইসা গেছো?’

‘চলেন ঘরে’, ছেলেটা বলে।

কাঁকন এমনভাবে খুঁটি ধরে দাঁড়ায় যেন এতো ক্লান্ত বহুদিন লাগেনি। যতবার এসব স্মৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটাচলা করে, ততবারই পরাজয়ের অনুভূতি আঁকড়ে ধরে। এ যেন তার কোনো বিজয় নয়, এই বিজয় যেন তার প্রাপ্য নয়। দেশভর এতো মানুষ স্বাধীন হলো, নিজের জীবন গুছিয়ে নিল, অথচ কাঁকন দিনে দিনে কেবল পরাজিত হলো, আগের চেয়েও বেশি একঘরে বন্দি হলো।

তবে মনে মনে পরাজিত হলেও কাঁকন প্রায়ই মুশফিকের অপেক্ষা করে। মনে মনে বলে, একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনো আশা ছাড়ে না। কাঁকন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, মুক্তিযোদ্ধাই থাকবে। শুধু সন্ধ্যা হলে আবছা অন্ধকারে কেন যেন কেঁপে কেঁপে কানের মধ্যে আওয়াজ আসে, তা মুক্তিযোদ্ধা আছিলেন, বীরাঙ্গনা হইলেন যেন কী কইরা?

মুশফিক আসে না। মাস যায়। বছরও যায়। কখনো ইচ্ছা করে নিজেই একটা খবর নেয়। কিন্তু সংকোচ হয়, হয়তো কাজটা খুব কঠিন। মুশফিক যদি পারত, তবে কি এতোদিনে তা করে দেখাত না? অপেক্ষায় থাকতে থাকতে একদিন কাঁকনের মুশফিকের কথা আর মনে পড়ে না। সেলাইয়ের ফোঁড় তোলার সময়ে যেমন কাপড়টা সুঁচের গুঁতোয় শতচ্ছিদ্র হয়ে যায়, কাঁকন ঠিক তেমনি প্রতি ফোঁড়ে নিজের মনকে একটা গুঁতো দেয়। যা চায় তা ভুলতে চায়, এ যেন নিজেরই পরাজয়ে নিজেকেই শাস্তি দেওয়া। মনকে ক্ষতবিক্ষত করার পরে কান্নাটা গিলে ফেলে।

তারপর বহুদিন বাদে এক কাকডাকা-ভোরে মুশফিক এসে টিনের গেটে ধাক্কা দেয়। পাহারাদারের ছেলে এসে বলে, ‘মুশফিক নামে একজন আপনের সঙ্গে দেখা করতে আসছে, খালাম্মা।’ কথা শুনে কাঁকন বিবি সকালের জায়নামাজ গুটিয়ে রাখে। অবাক হয় না, কিছু প্রত্যাশাও করে না, শুধু বলে, ‘তারে ভিতরে আসতে বলো।’

কাঁকন নির্লিপ্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলে, ‘আসো, মুশফিক। বসো।’

‘খালা, আপনে নিশ্চয় আমার উপরে রাগ করছেন’, মুশফিকের গলা অপরাধী শোনায়।

‘না না, রাগ তো করি নাই। শুধু ভাবছি, পারলে কি আর করতা না তুমি?’

‘সেইটাই, খালা। কাজটা যে এতো কঠিন হবে, এইটা খালা আসলে আমি ঠিক … যাই হোক, এখন ক্যান আসছি তা আপনারে বলি আগে। এখন মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় নামেই একটা মন্ত্রণালয় হইছে, খালা। আর কোনো চিন্তা নাই। এখন এই কাজগুলা অনেক সহজ হইয়া যাবে। আমি আগে আপনারে একজনের কাছে নিয়া যাই, সচিবালয়ে। তিনিই ব্যবস্থা কইরা দিবেন।’

‘কবে যাব, বাবা?’ কাঁকন যেন মাঝসমুদ্রে ভেসে থাকার একটা অবলম্বন পায়।

‘আইজই চলেন, আমার সঙ্গে, অসুবিধা আছে কুনো?’

‘না না, অসুবিধা কী? আমি যেইখানে খুশি যাইতে পারি। আমি তো স্বাধীন!’

‘সেইটাই, আপনে তো স্বাধীন।’

কাঁকন বিবির সত্যিই মনে হয়, দেশ স্বাধীন হয়েছে তিরিশ বছর আগে কিন্তু সে যেন এইমাত্র তার সুফল ভোগ করতে যাবে। ‘তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এখনই কাপড়টা পাল্টায়ে নিই’, বলে কাঁকন তৈরি হয়ে নেয়। তারপর ছুটে এসে বলে, ‘তা, নাস্তা খাবা না, বাবা?’

‘খাবো পরে। এখন চলেন, রাস্তায় দুইজনে খাইয়া নিবোনে।’

ঢাকায় অফিসটাতে পৌঁছতে দুপুর প্রায়। ভদ্রলোককে আগেই বলা ছিল। কাঁকনকে নিয়ে মুশফিক তার রুমে আসে। লোকটার দৃষ্টি থাকে কাঁকনের দিকে। অপলক। কাঁকন এক মুহূর্তের জন্য খেই হারিয়ে ফেলে। লোকটার তাকানো দেখে মনে হয় কাঁকনের শরীরে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিহ্ন খোঁজে সে। ধাক্কা খায় না কাঁকন। তার দিকে লোকেরা এভাবেই তাকায়। দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই সে নিজেকে সামলে নেয়। ভয় বা সংকোচে বাঁচার জন্য সে স্বাধীনতা চায়নি, জীবন বাজি রেখে লড়েনি। ছোট্ট নিশ^াস নিয়ে সোজা হয়ে বসে।

‘তা বলুন, কাঁকন বিবি, আপনার সমস্যাটা যেন কী?’

কাঁকনের জানামতে মুশফিক আগেই ভদ্রলোককে সবটা বলেছে। তা শুনেই তিনি সময় দিতে চেয়েছেন। কাঁকনের বুঝতে বাকি থাকে না যে তিনি তার মুখ থেকেই শুনতে চান। কাঁকন শুরু করে। দুঃসহ যন্ত্রণার পথ ধরে সে কে জানে কত দিন কত রাত অতিক্রম করেছে, না হয় আরেকবার! কাঁকন শুরু করে। ভদ্রলোক ইশারায় মুশফিককে চলে যেতে বলেন। কাঁকনকে তিনি এমনভাবে জেরা করেন যেন সে আসামির কাঠগড়ায়। একাত্তরের প্রতিটি রাত প্রতিটি দিনের হিসাব চান। কাঁকন বিব্রত হয় বটে তবে বিরক্ত হয় না। একমনে বলতে বলতে ভদ্রলোক নিজের চেয়ার থেকে উঠে কাঁকনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। তারপর আলতো করে একটা হাত রাখেন কাঁকনের খোলা ঘাড়ের ওপর। শখ করে নকশাদার একটা ব্লাউজ নিজের হাতে বানিয়েছিল কাঁকন। আজ তাড়াহুড়ো করে হলেও পরতে ভোলেনি। লোকটার আঙুল কাঁকনের গলার কাছে সুতোর নকশা খোঁটে। কাঁকনের কথা বন্ধ হয়ে যায়। সামান্য চুপ থেকে সে লাফিয়ে ওঠে চেয়ার থেকে। মাত্র দুই ফুট দূরে লোকটা লাল চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘আমি কিন্তু আশাই করিনি আপনাকে এরকম দেখব’, লোকটার কথা শুনে কাঁকন বিবির কৌতূহল হয়। ‘মানে, বয়স তো ছেচল্লিশ হয়ে গেছে, না? কিন্তু আপনাকে দেখতে এখনো একেবারে …’ লোকটা মুচকি হাসে। তারপর কী যেন ভেবে নিয়ে বলে, ‘তা, এতো বছর একাই কাটিয়ে দিলেন? মানে, তারপর আর বিয়েশাদি …’

কাঁকন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আঁচল টেনে ব্লাউজের নকশা ঢেকে দেয়। লোকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে। তারপর কাঁকনের ঘাড়ের ওপরে আবারো হাত রেখে বলে, ‘আরেকদিন আসেন। মুশফিককে দরকার নাই। আমি আপনার কাজটা করে দেবো। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন, আপনি যা করেছেন তাতে করে আপনার তো বীরপ্রতীক হওয়ার …’

লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই সেলাইয়ের সুঁচের গুঁতোয় জর্জরিত কাঁকনের শক্ত হাতের সটান থাপ্পড় পড়ে তার গালে। ‘আমি সম্ভ্রম বিলাই না। খোয়াইতেও জানি না’, কাঁকনের কণ্ঠস্বর গভীর আর দৃঢ়। লোকটা ছিটকে কিছুটা দূরে চলে যায়। আকস্মিকতার ধাক্কায় বোবা হয়ে যায়। কাঁকন আর মুশফিককে খোঁজে না। ঘরটা থেকে বের হয়ে সোজা ব্যস্ত রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। অসংখ্য গাড়ির শব্দের মাঝখানে বুকভরে শ^াস নেয়। কেমন যেন স্বাধীন স্বাধীন লাগে। স্বাধীনতা হয়তো এ-ই, জায়গামতো নিজের কথাটুকু বলতে পারা।