বিহঙ্গডানার মেয়ে

বটমলি হোমের বারান্দায় সিস্টার মেরি পেটরা দাঁড়িয়ে আছেন অনেকক্ষণ। টান করা পিঠের পেছনে হাতজোড়া দৃঢ় আবদ্ধ আর চোখ দুটো গভীর মনোযোগে নিবদ্ধ মাঠের অ্যাসেম্বলির দিকে। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে তার পাশের দেয়ালেই স্বচ্ছ কাচবন্দি যিশু কাঠের ক্রুশের ওপর ঝুলছেন। দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে কাতর শীর্ণ শরীর – একদিকে কাত হয়ে থাকা আর্ত-ব্যথিত মুখে তবু সান্ত্বনা ও সাহসের হাসি। সেই করুণ মুখের ওপর চোখ পড়তেই কুর্নিশ করার মতো মাথা সামান্য নত করে বুকের রুপালি লকেটটি ডান হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে নিলেন সিস্টার। পূর্ণ ভক্তির আবেগে তাঁর চোখ দুটো আরো ছোট হয়ে এলো। তারপরই জামার আস্তিন সরিয়ে হাতঘড়ির কাঁটায় কী যেন দেখলেন একবার। বারান্দার ঘড়িতে তখনো নয়টা বাজেনি।

সিস্টার মেরি পেটরা বটমলি হোম আর স্কুলের সর্বময় দায়িত্বে। কাছের আমবাগানের ঘন ডালপালার ফাঁক গলে মোলায়েম রোদের টুকরো এসে পড়ছিল তাঁর নির্মল হাসিমাখা অস্থির ছোট মুখটিতে। দু-একবার চোখ কুঁচকে এদিক-ওদিক তাকালেও তাঁর সচেতন দৃষ্টি বারবার চলে যাচ্ছিল ডানের বিজ্ঞান ল্যাবরেটরির সামনে – স্কুলের পেতলের ঘণ্টা ও হাতুড়ি সেখানেই ঝোলানো। সকালের অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাস শুরুর আগে সকলেই মাঠে প্রস্তুত। শুধু কিছুটা অপেক্ষা জপমালার গির্জা থেকে আগত ঘণ্টাধ্বনির জন্যে। দিন শুরুর প্রার্থনা এখনো বাকি; কিন্তু ব্রাদার গঞ্জালেস সেখানে নেই।

সপ্তাহের অন্য দিনগুলো থেকে রোববারের সকালটা একটু ভিন্নরকম। হোম থেকে কাছেই রাস্তার ওধারে বিশাল জপমালার গির্জা। সেখান থেকে পেতলের ঘণ্টাগুলো সব একসঙ্গে ঢংঢং করে বেজে উঠে মিশে যায় হোমের বাতাসে। সাপ্তাহিক প্রার্থনাশেষে ক্লাসগুলো শুরু হতে একটু দেরিই হয়ে যায় সেদিন। তবু ধর্মপল্লির নির্দেশ অমান্য এখানকার নিয়ম নয়।

অ্যাসেম্বলি শেষে আস্তে আস্তে মাঠ শূন্য হয়ে গেল। অন্যান্য শিক্ষকও যার যার মতো ক্লাসে ঢুকে গেলেন। আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন সিস্টার মেরি পেটরা। হঠাৎ দূর থেকে তিনি দেখলেন স্কুলের ভারি লোহার গেট ঠেলে আর সাদা-সুদীর্ঘ ইউক্যালিপ্টাসের আড়াল থেকে হলুদ শার্ট পরিহিত ব্রাদার গঞ্জালেস তাঁর দিকেই ছুটে আসছে। কাছে আসতেই বুঝলেন তার ঘর্মাক্ত কালো মুখে তীব্র এক অস্বস্তি আর চোখের ভেতর অসহায় উদ্বিগ্নতা। সিস্টার খুব অবাক হলেন গঞ্জালেসকে দেখে। কারণ সে শক্ত করে ধরে রেখেছে বারো কি তেরো বছরের একটি কিশোরী মেয়ের হাত – যে কি না ভয়ে কাঁপছে জড়োসড়ো হয়ে।

গুড মর্নিং সিস্টার … মাথা নিচু করে হাঁপাতে হাঁপাতে মোটা স্বরে গঞ্জালেসের সম্ভাষণ।

গুড মর্নিং। সকালে কোথায় ছিলে গঞ্জালেস? তোমাকে যে দেখতে পেলাম না। ধর্মপল্লির কোনো নিয়ম তুমি ভঙ্গ করো এটা আমার পছন্দ নয়।

অবনত মাথায় কাঁচুমাঁচু মুখে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল গঞ্জালেস। শীতের সকালেও তার মুখমণ্ডল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওদিকে সিস্টারের ভর্ৎসনা শুনে মেয়েটার মুখেও ভীতি। হঠাৎ হকচকিয়ে যাওয়ায় দুজনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই।

আজ পবিত্র  রোববার। জপমালার প্রার্থনার ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে একই সময়ে হোমের ঘণ্টাগুলোও বেজে ওঠে – তুমি জানো। তোমাকে খুঁজতে গিয়ে ঠিক সময়ে বাজানো হয়নি আজ। শেষমেশ দৌড়ে গিয়ে জুপিটারই সে-কাজটি করল।

গঞ্জালেস ইতস্তত মুখে কিছু একটা বলতে যেতেই সিস্টার মুখ ঘুরিয়ে বললেন, মেয়েটি কে? ওকে আবার কোত্থেকে নিয়ে এলে?

আমায় মার্জনা করুন সিস্টার। আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি। ছেলেমেয়েরা সব প্রবেশ করার পর মূল ফটকে তালা লাগাতে গিয়ে ওকে খুঁজে পেলাম। গেটের সামনে বসে একা একা কাঁদছিল। সঙ্গে কে ছিল কিংবা কেউ রেখে গেল কি না মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। দেখে ভীষণ মায়া হলো বলে অনুমতি ছাড়াই নিয়ে এলাম।

বারান্দায় সিস্টার আর ব্রাদার গঞ্জালেসের কথোপকথন শুনে এগিয়ে এলো সিস্টার ফ্লোরেন্স। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চাইল। তারপর ঝাঁঝালো গলায় গঞ্জালেসকে উদ্দেশ করে বলল, সিস্টারের অনুমতি ছাড়া এমন কাজ করা তোমার মোটেও উচিত হয়নি। তাছাড়া ও তো হোমের কেউ নয়। কে মেয়েটি? কোত্থেকেইবা এলো?

আমিও জানি না সিস্টার। নাম জিজ্ঞাসা করতেই ভেতরে ঢুকতে চাইল জোর করে। আমি নিয়ে এলাম তাই … সুযোগ পেয়ে চেঁচিয়ে বলল গঞ্জালেস।

‌সিস্টার মেরি পেটরা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি কাজে যাও গঞ্জালেস। ওকে আমার কাছে রেখে যাও। হোমে আরেকটি মেয়ে বেশি হলে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। যা কিছু হবে ভালোই হবে। ঈশ্বর আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।

বারান্দার ধারঘেঁষে ব্রুনফেলশিয়া ফুলের কয়েকটি ঝোপ ছিল। সাদা, হালকা ও গাঢ় বেগুনি এমনি বিচিত্র মিশ্র্র রঙের ঝোপটি থেকে ফুলের সুমিষ্ট সুবাস ভেসে আসছিল অনেকক্ষণ ধরে। একটা পবিত্র গন্ধের মতো তা মনকে ভরিয়ে দিতে চাইল নিমিষে।

মানুষের মনের ভেতর অকারণে জমা যে হিংসা-দ্বেষ-ঈর্ষা কিংবা দুঃখ-কালিমা থাকে ঈশ্বরের আকাক্সক্ষা ও মহৎ কল্যাণ ইশারায় তা মিলিয়ে যেতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। নিশ্চয়ই এটা মহাপ্রভু যিশুর কৃপা। বুকভর্তি সুবাস নিয়ে গেটের কাছে ফিরে যেতে যেতে এমনটাই মনে ভাবছিল গঞ্জালেস।

ফুলের সেই আশ্চর্য সুগন্ধ মনকে প্রফুল্ল করে তুললে সিস্টার মেরি পেটরা মেয়েটিকে কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত রেখে বেশ নরম গলায় বললেন, মাথা তুলে আমার চোখের দিকে তাকাও। নাম কী তোমার? কোনো ভয় নেই … তুমি ঈশ্বরের আশ্রয়ে রয়েছো। প্রভু তোমার মঙ্গল করবেন।

মেয়েটি চুপ করে থাকায় সিস্টার আবারো জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে কান্নাভেজা চোখে একবার শুধু মুখ তুলে চাইল সিস্টারের দিকে। তারপরই আবার ঘাড় নিচু করে নিথর চেয়ে রইল মাটির দিকে।

সিস্টার ফ্লোরেন্সের দিকে তারপর নির্দেশের ভঙ্গিতে বললেন, মেয়েটি ভয় পেয়েছে। ওকে তুমি হোমের ভেতরে দিয়ে এসো। পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিয়ে কিছু খেতে দাও। বাকিটা না হয় পরে দেখা যাবে।

দুই

হোম আর স্কুলভবনের মধ্যবর্তী বিশাল ফাঁকা চত্বরের চারদিকে বড় বড় আমগাছ থাকায় জায়গাটা বেশ শীতল। সেখানে মাদুর পেতে গানের চর্চা হয় প্রায় প্রতিদিন। ব্রাদার বেঞ্জামিন হোমের গানের শিক্ষক। আচরণে খুব বিশেষত্ব নেই। তেল লেপটানো চুল আর শ্যামলা মুখে বসন্তের কয়েকটা দাগ নিয়ে অর্থহীন এক সংশয়পূর্ণ চেহারা। পায়ে চামড়ার চটি ছাড়া জুতো দেখেনি কেউ কোনোদিন। সবসময় হালকা ঢিলেঢালা পোশাকের কারণে আরো নিরুত্তাপ দেখায় মানুষটাকে।

ব্রাদার বেঞ্জামিন বিয়ে করেছিলেন কি না কেউ জানে না। শোনা যায় হোমে আসার আগে কিছুদিন সংসার করেছিলেন। তবে আজকাল গান শেখানো ছাড়া অন্য কোনো কিছুতে তার আগ্রহ ও মনোযোগ কোনোটাই দেখা যায় না। গলার সুমিষ্ট স্বরে যেন ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তাই তো হোমের ছেলেমেয়েদের খুব যত্ন নিয়ে ক্লান্তিহীন গান শিখিয়ে যাচ্ছেন এখনো।

আজ সকাল থেকে খুব আনমনা দেখাচ্ছে ব্রাদার বেঞ্জামিনকে। গান গাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলেও সেদিকে যেন খেয়াল নেই তার। হারমোনিয়াম আর তবলা পড়ে আছে মেঝের একপাশে, মাদুরের অন্যপাশে গানের খাতা। হোমে নতুন আসা মেয়েটিকে নিয়ে জুপিটারের উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। সে এখনো হোম থেকে আসেনি। এদিকে পঞ্চম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা সব এসে হইচই জুড়ে দিয়েছে।

উদ্বিগ্ন মুখে পায়ের চটিজোড়া খুলে মাদুরে পা রাখতেই ব্রাদারের নজর পড়ল দেয়ালে ঝোলানো যিশুর আঁকা ছবিটার ওপরে। মাথার চারপাশ থেকে সূর্যের মতো যে আলোকদীপ্তি বের হয়েছে তা দেখে বেশ স্বস্তি ও উৎফুল্ল ভাব অনুভব করলেন মনের ভেতরে। জুপিটারের অপেক্ষায় থেকে শেষে একাই বসে পড়লেন হারমোনিয়াম নিয়ে।

দেয়ালবিহীন খোলা চত্বরে শীতের রোদ-হাওয়া এসে ঢুকছে। কোথাও দু-একটা পাখি ডেকে উঠতেই রোদ মাড়িয়ে জুপিটারের ছায়া এসে পড়ল। তারপর নিশ্চুপ মিশে গেল রোদহীন মাদুরের গায়ে। ওদিকে সারবেঁধে বসে আছে ছেলেমেয়ের দল – ঠিক তাদের মুখোমুখি হারমোনিয়াম হাতে গানের ব্রাদার বেঞ্জামিন। পাশেই জুপিটারের দুহাতে ধরা তবলা। বোল উঠল মৃদু তালে। আমগাছের ডালে ডালে নেচে ওঠা শীতের হাওয়া ব্রাদারের সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর আর ছেলেমেয়েদের সুরেলা কোরাস নিয়ে চলল অনেকদূর। গাছের পাতায় পাতায় সুর তুলে পাখিদের ডানার ঝাপটায় মিশে গেল গোটা হোমের ভেতরে-বাইরে। দেয়ালে ঝোলানো যিশুর মুখ আরো প্রদীপ্ত হলো। সে-গান চলল অনেকক্ষণ। একসময় গানে গানে আরো ক্লান্ত হয়ে উঠলে অবশেষে দুজন থামল।

ব্রাদার বেঞ্জামিন বললেন, তোমার দেরি হলো কেন জুপিটার? গানের প্রতি আজকাল তুমি ভক্তি হারিয়ে ফেলছো।

ব্যাপারটা সেরকম নয় ব্রাদার। সব খুলে বলছি আপনাকে। মনের ইচ্ছে ব্যক্ত করার ভঙ্গিতে আগ্রহভরা চোখে জুপিটার জানাল। হোমের ভেতরে নতুন একটি মেয়ে এসেছে। সে কারণে হয়তো একটু …

কিছুদিন ধরে মেয়েটিকে নিয়ে ব্রাদারের মনেও কেমন চাপা অস্বস্তি। সে-কারণে কথা না বাড়িয়ে আবারো হাত রাখলেন হারমোনিয়ামের রিডে। সবাই জানে, জপমালার গির্জায় ঘণ্টা বেজে উঠলে কিছুক্ষণের জন্যে আবারো বিরতি। দুপুরের খাবার প্রস্তুত হলেই কেবল ছুটি পাওয়া যাবে ব্রাদারের ক্লাস থেকে।

ঠিক বেলা বারোটার দিকে গির্জার ঘণ্টাগুলো একসঙ্গে বেজে উঠল। নিশ্চুপ বসে থেকেই ব্রাদারের ডান হাতটি গলায় ঝোলানো ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রুপালি লকেটকে ছুঁলো তখন। তারপর তা পরম ভঙ্গিতে একবার বাঁ কাঁধ, তারপর ডান কাঁধ ছুঁয়ে ঈষৎ কপাল ছুঁলো প্রার্থনার ভঙ্গিতে। একসময় চোখ দুটো মুদিত হলো তার। অন্যদিন প্রার্থনারত ভঙ্গিতে তার মুখে যে উজ্জ্বল আলোর আভা খেলা করে আজ তেমনটি দেখা গেল না মোটেও। তবে পবিত্র অনাবিল হাসি হালকা ছুঁয়ে ছিল ব্রাদারের ঠোঁটে। এভাবে যতক্ষণ চোখ দুটো মুদিত ছিল ঠিক ততক্ষণ একটা সৌম্য নীরবতা দখল করে নিল চারদিক।

প্রার্থনা শেষ হওয়া মাত্র সিস্টার মেরি পেটরা কোনো আগাম ইঙ্গিত না দিয়ে প্রবেশ করলেন সেখানে। পরিচ্ছন্ন সাদা পোশাক আর মাথায় বিশেষ কায়দায় জড়ানো স্কার্ফে তাঁকে লাগছিল অন্যরকম। কানের দুপাশ দিয়ে সাদা চুলের বেরিয়ে থাকা অংশ তাকে ভীষণভাবে প্রস্তুত করে দিলো অমন কাঠিন্য নিয়ে দাঁড়ানোর জন্য। তাঁর সমগ্র মুখমণ্ডলে খেলা করা বিশেষ ধরনের আভিজাত্য ও কথার পরিমিতিবোধে দৃঢ়তার পরিপাট্য এক ধরনের জাদুমন্ত্র ছড়িয়ে দিলো গোটা ক্লাসে।

সকলে একযোগে চেঁচিয়ে উঠল তাঁকে দেখে – গুড আফটারনুন সিস্টার …।

সিস্টার মেরি পেটরা সর্বত্রই ঘুরে বেড়ান নিঃশব্দ ছায়ার মতো। তিনি প্রায়শ ক্লাসে ঢুকে শেষ বেঞ্চির কাছে দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের পাঠদান নীরবে প্রত্যক্ষ করলেও আজ ঠিক তেমনভাবে এলেন না। সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠা ছেলেমেয়েদের দিকে হাত ইশারায় থামতে বলে মুখোমুখি দাঁড়ালেন কিছু বলার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে। তারপর স্মিত হেসে ঈষৎ মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে রইলেন সামনে।

ব্রাদার বেঞ্জামিন নিজেও হারমোনিয়ামের রিড থেকে আঙুল সরিয়ে কৌতূহলী চোখে নিশ্চুপ চেয়ে রইলেন সিস্টারের মুখের দিকে। ডান হাতে মেয়েটির হাত মুঠো করে ধরে সিস্টার স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। গোটা ক্লাসের অসংখ্য চোখ অসীম কৌতূহল নিয়ে কান পেতে আছে কিছু শুনবে বলে। প্রথমদিনের সেই অপরিচ্ছন্ন জামা, করুণ দৃষ্টি কিংবা নিদারুণ অসহায়ত্ব ভরা চেহারা – কোনোকিছুর লেশমাত্র নেই মেয়েটির চোখে-মুখে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে হয়ে উঠেছে হোমের একজন।

সিস্টার মেরি পেটরা তাঁর সম্মোহনী চেহারা আর আবেশমাখা কণ্ঠ নিয়ে এবার তাকালেন ব্রাদারের দিকে।

গুড আফটারনুন বেঞ্জামিন। গুড আফটারনুন বাচ্চারা। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।

দুপুরের সম্ভাষণ বিনিময় শেষ হলে তিনি বললেন, বেঞ্জামিন … তোমাদের সামনে দাঁড়ানো এই মেয়েটি হোমের নতুন অতিথি। ওকে তোমাদের সঙ্গে এককোণে কোথাও বসিয়ে দাও। আজ কী গান গাইলে তোমরা?

‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান …’ রবিঠাকুরের … চলছে আজ তৃতীয় দিনের মতো। বেঞ্জামিন জানাল নিচু স্বরে।

খুব ভালো। তোমরা আবার শুরু করতে পারো। ক্লাস শেষে ওকে আবার আমার কাছে নিয়ে আসবে তুমি।

বেঞ্জামিন ঈষৎ মাথা ঝোঁকাল। ঠিক তখনই চোখ গেল মেয়েটির মুখের ওপর – গভীর চোখে তাকিয়ে দেখছে ব্রাদারকে। কিন্তু বেঞ্জামিনের মনে হলো তার চোখে-মুখে লজ্জা-সংকোচের চাইতেও সুগভীর কোনো কৌতূহলের ছায়া বেশি। খালি দুটো পায়ে ধুলোর আস্তরণ। হাঁটুঢাকা আকাশিরঙা ফ্রকের নিচে ঝুলে আছে হলুদ রঙের ঝালর। পিঠ পর্যন্ত গোলাপি ফিতে বাঁধা দুটো বেণী ঝুলে আছে আর দোল খাচ্ছে এদিক-ওদিক।

সবমিলিয়ে মুখে খানিকটা মলিনতা ছড়ালেও চোখ দুটো স্থির জ্বলন্ত। সেই চোখ দিয়ে কী যেন পরিমাপ করতে চাইছে চারদিকে। সিস্টারের হাত থেকে নিজের হাতখানা ছাড়িয়ে একবার দু-পা পিছিয়ে লুকিয়ে রইল তাঁরই শরীরের পেছনে। শুধু উঁকি দিয়ে গভীরভাবে কী যেন খুঁজছিল ব্রাদারের চোখের দিকে।

আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দেওয়া মাদুরের ওপর এক কোণে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে মেয়েটি তারপর বসল। সমগ্র ক্লাসের জোড়া চোখগুলো তখন কৌতূহল নিয়ে মেয়েটিকে দেখছে। ব্রাদার বেঞ্জামিনও আবার গভীরভাবে দেখল। জড়তা ভেঙে তারপর জিজ্ঞেস করল সিস্টারকে।

নাম কী ওর? অথবা আমরা ওকে কী নামে ডাকব সিস্টার?

ওর নাম জানা যায়নি। কোনো নাম দেওয়াও হয়নি এখনো। তোমরা আজ থেকে ওকে অনামিকা বলে ডাকতে পারো। অনামিকা গোমেজ।

তিন

সিস্টার মেরি পেটরা অনামিকাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ধর্মপল্লির অন্যদের কাছে। ঈশ্বরের আদেশে মহান যিশুর মতো উদার হতে পেরে সেদিন তাঁরও মন ভরে উঠেছিল পরম এক প্রশান্তিতে। ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ অনুভব করলেও মেয়েটির হঠাৎ আসার কারণ একটা রহস্য হয়েই থেকেছিল তাঁর কাছে। কিন্তু ব্রাদারের অস্বস্তি কিংবা জুপিটারের আগ্রহ দুটোই তাঁকে ভাবিয়ে তুলছে আজকাল। অনামিকাকে দেখে প্রথমদিন তারা দুজন শুধু দৃষ্টিবিনিময় করে সংযত রেখেছিল নিজেদের। মনে মনে হয়তো এটাও বুঝেছিল, হোমের এই নিয়মের গণ্ডি থেকে মেয়েটির মুক্তি নেই।

আমবাগানের প্রকাণ্ড একটা গাছের নিচে একদিন বসে ছিল জুপিটার। কোনো অনাথ হোমে এসে আশ্রয় নিলে সঙ্গে সঙ্গে একটা নতুন নাম পেয়ে যায়। এটা ওকে বরাবর মুগ্ধ করে; কিন্তু তার জন্মগত নামটি হারিয়ে যায় বলে চাপা দুঃখবোধ হচ্ছিল তার। একজন অনাথের ঠিকানাই যেখানে থাকে না সেখানে সামান্য একটা নামে কীইবা আসে-যায়!

জুপিটার কিছু বলবে ভেবে চাপা হাসি নিয়ে এসে ঢুকল বেঞ্জামিনের ঘরে। ব্রাদার তখন একমনে হারমোনিয়ামের রিডগুলো থেকে ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করছিলেন। একবার চোখের পাতা তুলেও চাইলেন জুপিটারের দিকে।

তোমার অতো উচ্ছ্বাসের কারণ কী জুপিটার? কেউ এলে তাকে আশ্রয় দিয়ে নাম-পরিচয় দেওয়াই তো হোমের ধর্ম। এই তুমিও যেমন অনেক বছর থেকে থাকছো।

আমি ভাবছি অনামিকার কথা। সে সম্পূর্ণ অদ্ভুত একটি মেয়ে। হোমের মধ্যে থেকেও তার মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। চোখ দুটোর আশ্চর্য অস্থিরতা গভীরভাবে খুঁজছে যেন অন্যকিছু।

শোনো জুপিটার। প্রথমে কারো মন না টিকলেও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়।

ব্যাপারটা সেরকম নয় ব্রাদার। জোর দিয়ে বলল জুপিটার। বাগানের কোণে কোণে একলা ঘুরে বেড়ায় সে। পাখিদের সঙ্গেও কথা বলে। আমাকে দেখে একদিন বলল, ডানা দুটো খসে গেছে তার। ওগুলো খুঁজে পেলে সে নাকি উড়ে যাবে কোথাও।

ব্রাদার বেঞ্জামিন জুপিটারের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, প্রথম এলে ওরকম কথা সকলেই বলে। তবে আমিও অবাক হয়ে খেয়াল করেছি ও সুযোগ পেলে আমার ঘরের কাছাকাছি এসে উঁকি দেয়। ডাকতে গেলেই ছুটে পালিয়ে যায়। অবিরাম কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মেয়েটি। ওকে আপাতত একা একাই থাকতে দাও।

সত্যি ব্রাদার … সে অন্যদের চেয়ে আলাদা। কেমন পাখির মতো – কখনো উদাস, আবার ছটফটে। আমি ওকে বন্ধু বানাতে চাই। জুপিটার স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো বলল।

হোমের ভেতর আরো অনেকেই আছে। তাদের যে-কোনো কাউকে কিংবা সকলকেই তুমি বন্ধু বানাতে পারো। এটা মহামতি যিশুর শিক্ষা।

আচ্ছা ব্রাদার, সিস্টার ওকে অনামিকা নাম দিলেন কেন? নামহীন মানুষকে ওরকম নাম দিয়ে কেমন নামের মধ্যেই তো আবদ্ধ করলেন তিনি।

মানুষ কখনো নামহীন থাকে না। কেবল দুঃসময়ে তার পরিচয় বদলে গেলে তখনই সে নতুন নাম ধারণ করে। এটা হোমের রীতি। তুমিও কি জানো জুপিটার তোমার পূর্বপরিচয়?

ব্রাদার বেঞ্জামিন ঘরের কোণে একটা তাকের ওপর হারমোনিয়াম তুলে রেখে খাটের ওপর রাখা তবলায় হালকা বোল তুলছিলেন। ইস্পাতের ছোট হাতুড়ির ঘায়ে আঁটসাঁট করে বাঁধছিলেন তবলার কিনারগুলো। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল জুপিটার। বেঞ্জামিনের কথাগুলো ওর মনের ভেতরে অদ্ভুত আলোড়ন তুলে যাচ্ছে। আরো কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।

ব্রাদার বেঞ্জামিন হাতের কাজটুকু শেষ করে বলল, তুমি অনামিকাকে চোখে চোখে রেখো। আমিও জানি না ও আসলে কী বলতে চায়। দুঃখী মেয়ে – মহাপ্রভু যিশুর দয়ায় এই হোমে সে আশ্রিত। সত্যি, ঈশ্বর কাউকে করুণাহীন রাখেন না।

চার

বটমলি হোমের ছেলেমেয়ের গল্পগুলো সব এক। অনামিকার মতো জুপিটারও একদিন এসেছিল এখানে। ছেলেগুলো পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর চলে গেলেও জুপিটারের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। সেই থেকে সে থেকে গিয়েছিল হোমের মধ্যে। আমাদের চাইতে বয়সে বড় হলেও সে এসে বসত শুধু আমাদের সঙ্গে। গানের ক্লাস বাদ দিলেও ওপরের শ্রেণির ল্যাবরেটরির ক্লাসগুলোতেও তাকে দেখা যেত মাঝে-মধ্যে। জুপিটার ছিল ভীষণ চটপটে। হোমের ভেতরের সব খবর সে নিয়ে আসত অন্যদের কাছে। বিশেষত অনামিকার খবরগুলো এনে আমার কাছেই বলত সবসময়।

বিশাল সবুজ মাঠের এক কোণে রাস্তার দিকে মুখ করে যে বড় টিফিনঘর তার পেছনে লম্বা দেবদারু গাছের ঘন আচ্ছাদন। সবুজ টিনের ছাউনি দেবদারুর ঘন সবুজের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে আরো জমাট সেখানে। ওদিকটায় বেমানান বলতে ইউক্যালিপ্টাসের বড় সাদা গাছ দুটো। তবু তার পাশে ছাতার মতো দেহ ধরে যে ঝাঁকড়া বকুলগাছ সেটার নিচে প্রায়ই দেখা যেত খালি পায়ের অনামিকাকে। ক্লাসে ওর তেমন মন ছিল না। সবার সঙ্গে পরিচিত হলেও অনামিকা কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলত না।

কখনো দেখা যেত, কিছুটা দূর থেকে অনুসরণ করছে জুপিটার। কাছে গিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করত আর শেষে খুব ভালো বন্ধুও হয়ে উঠেছিল দুজনে।

আমাদের সামনেই ব্রাদার বেঞ্জামিন জুপিটারকে ডেকে একদিন জিজ্ঞেস করলেন, আজকাল তোমাকে বিকেলের প্রার্থনায় দেখা যায় না কেন? কোথায় হারিয়ে যাও তুমি?

সবিস্ময়ে মাথা তুলে তাকাল জুপিটার। চোখ পিটপিট করে জানাল, ব্রাদার … বিকেলের দিকে অনামিকার সঙ্গে আমি টিফিনঘরটার কাছে হাঁটি। আমবাগানের কাছে ঝাঁকবেঁধে পাখি আসে। ওর মতো আমিও ডানা খুঁজি পালানোর … দূরের ওই আকাশে।

ব্রাদারের সংশয়পূর্ণ চেহারায় কেমন ভীতির সঞ্চার হলো। হালকা ধমক ও সতর্কতার সুরে বলল, হোমের অন্যদের কাছ থেকে তোমাদের এভাবে আড়ালে যাওয়া ঠিক নয়। বিশেষত প্রার্থনার সময়গুলোতে। সিস্টার জানতে পারলে …

কিন্তু জুপিটার অকাট্য যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইল ব্রাদারকে, তার সন্দিগ্ধ মন অন্যকিছুর সন্ধান করছে প্রতিদিন।

আমি অনামিকা সম্পর্কে অনেককিছুই জেনেছি ব্রাদার। ও আসলে অনাথ নয়।

ব্রাদারের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। সে-চোখে বিস্ময়ের চেয়েও আরো গভীর কিছু খেলা করছিল তখন।

বিকেলের প্রার্থনাশেষে হোমের ছোট্ট মাঠে যখন সবাই খেলায় মেতে ওঠে অনামিকা তখন আরো নিঃসঙ্গ। আমবাগানে ঘুরে ঘুরে অনেক পাখির পালক জড়ো করে একদিন আমাকে বলল, যা সে পেতে চেয়েছিল তা খুঁজে পেয়েছে। হয়তো পাখির মতো একদিন উড়েও যাবে হোমের এই বাঁধা গণ্ডি ছেড়ে। কথাগুলো সপ্রতিভ হয়ে খুব দ্রুত বলে গেল জুপিটার।

ব্রাদার বেঞ্জামিন মুখে হাসি এনে বললেন, তোমার কথাগুলো খুব আশ্চর্য শোনাচ্ছে জুপিটার। স্কুল আর হোমের বাগানে কত ধরনের ফুল ফুটে আছে। অনামিকা নিশ্চয়ই ফুল আর পাখির শোভাতে মুগ্ধ হয়ে হেঁটে বেড়ায় চারদিক। হোমের বন্ধু হিসেবে ওর দিকে খেয়াল রাখো ঠিক আছে কিন্তু … ব্রাদারের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছোঁ মেরে কথা কেড়ে নিল জুপিটার।

না না ব্রাদার, ফুল নয়; আমি ওকে আমবাগানের দিকে পাখির পালক খুঁজতেই দেখেছি। আমাকে দেখে ফ্রকের কোচড়ে লুকিয়ে ফেলেছিল একদিন। দুটি ডানার জন্যে কত পালক লাগে আপনার জানা আছে কি ব্রাদার?

কীসব বলছো? এমন হয় নাকি আবার?

মিথ্যে নয় ব্রাদার, অনামিকা তা-ই বলেছিল।

পাঁচ

গরমের ছুটিতে স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে অনেকদিনের জন্যে। ছুটির মধ্যে সেবার আমাদের কাজ দিয়েছিল পাখির একটা স্ক্র্যাপ বুক তৈরি করে আনার। পাখির পরিচিতি বর্ণনা ও ছবি এঁটে কিছু পালক গেঁথে দিয়ে যতদূর সম্ভব জীবন্ত একটা কিছু করার নির্দেশ ছিল সবার ওপর। স্কুল ছুটির পর আমরা যখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হোমের আনাচ-কানাচ ঘুরতাম তখন দেখা হতো অনামিকার সঙ্গে। একদিন পেয়েও গেলাম বকুলগাছটার নিচে। সেও আমাদের মতো পাখির পালক খুঁজছে তখন।

জুপিটারের কথার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্যে আমিও জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার তো স্ক্র্যাপ বুক তৈরির কাজ নেই। তুমি কেন পালক খুঁজছো অনামিকা?

অনামিকা সেদিন চুপ করে ছিল প্রথমে। তারপর বারবার জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, উড়ে যেতে ডানা লাগে আর সে-ডানার ভাঁজেই থাকে অজস্র পালকের গুচ্ছ। বিশ্বাস করো আমি অনাথ নই। আমি এসেছিলাম আমার পরিচয় জানতে। সেটা জেনেও গেছি। আমি এখন চলে যেতে চাই … হ্যাঁ, একদিন নিশ্চয়ই আমি যাব। কিন্তু দুটি ডানার সমান পালক না জমালে উড়ব কীভাবে?

আমি বিস্ময়ে শুধু বলেছিলাম, তুমি অনাথ নও? তবে কে এখানে রেখে গেল তোমাকে? আর মানুষ আবার উড়তে পারে নাকি?

মাথা নিচু করে ঘাসের একটা সুতো টান দিয়ে ছিঁড়ে বকুল গাঁথতে গাঁথতে জবাব দিয়েছিল, তোমাদের যিনি সংকোচ কাটাতে শেখান, উদার-বিশ্বস্ত কণ্ঠে গান গেয়ে বিশ্বজগৎকে চেনান নতুন করে, যার ভীতিভরা চেহারায় গোপনে সর্বদা আলোকদীপ্তি খেলা করে সেই সরল মানুষটিই …।

সেদিন আর কিছু বলেনি অনামিকা। বারান্দার আকাশ-নীল দেয়ালে কাঠের টেরাকোটায় উৎকীর্ণ একটা ছবির কথাই মনে ভাসছিল আমার। সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে পাখির মতো ভঙ্গিমায় যিশুর দুটো হাত দুদিকে প্রসারিত। মাথার পেছনে সূর্যের প্রখর আলোকদীপ্তি। প্রশান্তিমাখা মুখে বিহ্বল দুটো ডানায় যেন ঊর্ধ্বাকাশে ভেসে চলছেন তিনি।

ছয় এক মাস পর গরমের ছুটিশেষে আমরা যখন আবার ফিরে আসি তখন অনামিকার আর দেখা পাইনি। আমবাগানের কাছে প্রকাণ্ড একটা গাছের ছায়ায় পড়ে ছিল অজস্র পাখির পালক। ব্রুনফেলশিয়া ফুলের ঝোপের কাছে পেয়ে গেলাম জুপিটারকে। আমাকে দেখে বিষণ্ন মুখে জানাল, ব্রাদার বেঞ্জামিনও কাউকে কিছু না জানিয়ে কোথায় যেন চলে গেছে।