ছোট গল্প

  • মাছ ও মনসা

    তিলোত্তমা মজুমদার সেই আমাদের কালচিনির বাড়ি। আকাশে ঘন মেঘ, যেন কোনোদিন আর দেখতেও পাবে না কেউ তার নীল। এত মেঘ কবে সব ঝরে জল হবে? একশ দুশো পাঁচশো বছর? বৃষ্টি চলেছে আজ দশদিন। আকাশে যখন-তখন হিজিবিজি বিদ্যুৎ। ঠিক যেন অতিকায় বান মাছ লম্ফ দিয়ে পার হচ্ছে এক শহর থেকে আরেক শহর। ওরা গ্রাম ভালোবাসে। তাই…

  • মহিফুল বেওয়ার প্লাবনযাত্রা

    পাপড়ি রহমান ‘হেই সাতদিন শ্যাষ হইয়া গেলে দুনিয়াতে বাইস্যা নামলো। হেরও সতেরো দিন বাদে জমিনের তলায় বেবাক পানি বাইর অইয়া আইতে লাগল। আর আসমানও ফাইট্যা গেল। চল্লিশ দিন চল্লিশ রাইত ধইরা দুনিয়ার উপ্রে ম্যাঘ ঝরতে লাগলো। বাপরে বাপ – এমুন বিষ্টি আর বিষ্টি। এমুন ম্যাঘের নিদান। কষ্মিনকালেও এমুন ম্যাঘ কেউ-ই দেহে নাই!’ এরকম তন্ময় হয়ে…

  • ভাঙন

    হরিশংকর জলদাস বগলা নদীর উত্তরপাড়ে টেকেরহাট। আসলে টাকুরহাট। বহু বছর আগে জমিদার দীপেন চৌধুরীর নাতি কুলদীপ চৌধুরী এ-হাটের পত্তন করেন। পড়ন্ত জমিদার বংশের লোক কুলদীপ চৌধুরী। হাতে ক্ষমতা আসার পর তাঁর ইচ্ছা জাগল হাট বসাবার। তিনি একটা হাট বসালেন। দীর্ঘদেহী ছিলেন তিনি, টকটকে ফর্সা। নাক চিলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো। চিকন গোঁফ তার। ইংরেজদের মতো জুলপি…

  • যে আসার কথা ছিলো

    আকিমুন রহমান আমি নিশ্চিত, খুবই নিশ্চিত যে, আমি অবশেষে এসে যেতে পেরেছি সঠিক নগরটিতে। অবশেষে! অযুত-নিযুত বছর ধরে সন্ধান করেছি যার, যার সন্ধানে সন্ধানে বিরামহীন পরিব্রাজন – কতকাল থেকে কতকালে, কত লোকালয়ে লোকালয়ে, অন্তহীন ভিখিরি চোখে হেঁটে চলা! কতবার নৈরাশ্য এসে স্তব্ধ করে দিয়েছে আমাকে! অন্তর তখন আর বিশ্বাস রাখতে পারেনি আমার অনুসন্ধান শক্তিতে। আমি…

  • বিশুদ্ধ চাকরি

    মধুময় পাল বাসস্টপটা এখানে ছিল না। ছিল সত্তর-আশি মিটার আগে, নাম কামারশালা। লোচনদাস কামারের জন্মভূমি, কর্মভূমি। লোকে বলে, লোচনদাস বড় হয়ে অাঁতুড়ঘরে কামারশালা খোলে। আরো বড় হয়ে গ্রিল মেশিন বসিয়ে কারখানা করে। নিজে খাটত, লোক খাটাত। কদমগাছের নিচে বসে খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলত। টালিঘরে সারাদুপুর গ্রিলের ঘর্ঘর, চ্যাঁই…চুঁই…। কখনো কখনো মাঝরাত পর্যন্ত। লোকে বলে, অাঁতুড়ঘরেই…

  • পরীকাহিনি

    বদরুন নাহার পরীর গল্পটা আমি সাধারণত কাউকে বলি না। যদিও একদিন পরীর গল্পে হৃৎপিন্ডের সঞ্চালন বেড়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলাম! অনেকদিন বাদে আজ সে-গল্পকেই পুঁজি করে আমি যাচ্ছি আন্তর্জাতিক সেমিনারে। ল্যাপটপে সফট হয়ে যে-অক্ষরগুলো যাচ্ছে তা পরীকাহিনি। পরীর সঙ্গে আমার নিজেরও একটা গল্প আছে। সেটা আমার ভেতরের সফট কপি, ফাইলবন্দি। সেমিনারে আমি কেবল পরীর গল্পই বলব।…

  • পশমিনা

    বসন্ত লস্কর নীলের ওপর লাল গোলাপ ফুল অাঁকা টিনের তোরঙ, শাশুড়ির। বিয়ের কনের সঙ্গে এ-বাড়িতে ঢুকেছিল। গত বছর শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর, দু-তিন মাস পরে ছোট ননদ লফট থেকে নামিয়েছিল। মরা মানুষের তোরঙ খুলে কেউ হাটকাচ্ছে, সে হোক না মানুষটির নিজের মেয়ে, দেখে রুমেলির ভালো লাগেনি। ননদকে বলতেই ননদ মুখঝামটা দিয়েছিল, ‘থামো তো তুমি, আমার…

  • কাকতালীয়

    বিকাশ কান্তি মিদ্যা কাকতালীয় ব্যাপারটা কেবল মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে, এমনটা ভাবার কোনো যুক্তি নেই। যদি কেবল মানুষের ক্ষেত্রে ঘটবে, তাহলে কাকতালীয় হবে কেন, বলুন? নিশ্চয়ই কাকের ক্ষেত্রে ঘটার সম্ভাবনা আছে, আছে বলেই নাকি, কাকিটা সেদিন সকাল সকাল উঠে, হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, যখন কী খাই, কী খাই ডাকছিল, রতিকান্ত তরফদারের বাচ্চা মেয়েটা তখন টলমল…

  • মুখোমুখি

    মালেকা পারভীন বেডরুমের খাটের এক কোনায় বসে আছে সালমা। মুখটা কাঠিন্যের মুখোশে আটকে ফেলেছে সে। এতে করে তার অসচেতন অনিচ্ছায় যা ঘটেছে, তা হলো তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যের বলতে গেলে পুরোটাই ঢাকা পড়ে গেছে। যদি সে এখন আয়নায় তার আচমকা বদলে যাওয়া মুখের অাঁকাবাঁকা রেখাচিত্র দেখতে পেত, ঠিকঠিক সে নিজেই লজ্জা পেয়ে কাউকে কিছু বুঝে ওঠার…

  • রইস উদ্দিনের ফাঁসি

    মণীশ রায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে টবচর্চা করছিল দেয়া। বেশ কটি টব রয়েছে ওর দখিনমুখো ছোট বারান্দাজুড়ে। সবগুলোই গোলাপের চারা। বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে লতিয়ে উঠতে চাইছে। ফুটি-ফুটি করছে ফুল, তবু ফুটছে না বলে একবুক আক্ষেপ আর হতাশা নিয়ে এদের পরিচর্যা করে চলেছে সে। গাছেদের সঙ্গে দেয়ার বড় ভাব, গোপনে কথা বলে বিড়বিড় করে। রুম-লাগোয়া বারান্দা হওয়ায় গভীর…

  • দয়ালের বাড়িতে একটা ভিড় জমে ওঠে

    ঝর্না রহমান  জাইলা পাড়ায় দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে একটা দুর্দান্ত ভিড় জমে ওঠে। আজ অবশ্য এ-সময় দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে কোনো লোকসমাগমের কথা নয়। শুধু আজই বা কেন, দয়াল রাজবংশীর বাড়িতে কখনই লোকসমাগমের কথা নয়। যে-সমস্ত কারণে মানুষের বাড়িতে লোকজনের ভিড় জমে, যেমন জন্ম মৃত্যু বিয়ে অন্নপ্রাশন পূজাপার্বণ – ইত্যাদি উপলক্ষে আচার-অনুষ্ঠান – সে-সমস্ত কারণ এ-বাড়িতে একেবারে…

  • মুখোমুখি ব্রজনাথ

    মুর্শিদ এ এম জ্যামে আটকে পড়া বাস থেকে নেমে পড়লেন ব্রজনাথ। আরেকটু হলেই বাসটা চলতে শুরু করতে। গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে রিস্ক নিয়ে নামলেন। বাবুঘাট থেকে বসেই আসছিলেন। হেড অফিসে কয়েকদিন যাতায়াত করতে গিয়ে এই পথের পথিক। রোজই ভাবেন ব্রিজের ওপর গাড়ি স্লো হলে নেমে যাবেন। আজ করেই ফেললেন। সামনের গেট দিয়ে নামা ঠিক হয়নি – ভাবলেন তিনি।…