ছোট গল্প

  • যেন একটি চিরন্তনী গল্প

    জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বড় সহজ গল্পটি। চিরন্তনী গল্প যেমন হয়। ইংরেজিতে ওইসব গল্পের বিবরণ এভাবে দেয় : ‘বয় মীট্স গার্ল, বয় লুজেস গার্ল, বয় গেটস গার্ল।’ কখনো আবারো হারিয়ে ফেলে, আবারো ফিরে পায়। আমাদের গল্পেও অমনি, তবে মূলত গ্রামীণ জনপদের দেশই তো, সব সময় এমন ঘটে না – অথবা তাই কি? দুই নদীর মোহনা নদীর মতোই…

  • তালবেতাল

    রেজাউর রহমান তুহিনের সঙ্গে ড. আরবাব সিদ্দিকীর দেখা হয় আমেরিকার ভার্জিনিয়ায়। দেখা হওয়াটা এখন তার কাছে দৈবচক্র বলেই মনে হয়। তুহিনের যতদূর মনে পড়ে, আরবাব ১৯৭২ সালের শেষের দিকে, নয়তো ১৯৭৩ সালের প্রথম ভাগের কোনো একসময় সে দেশ ছেড়েছিল। সে দেশ ছাড়ার আগেপিছের কোনো বিদায়ী অনুষ্ঠান-উপলক্ষ, নয়তো এয়ারপোর্ট তক তাকে পৌঁছে দেওয়া বা তেমন কোনো…

  • ওয়ে আউট

    ওয়াসি আহমেদ প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রীর কথাগুলো এলোমেলো শোনাচ্ছিল, যেমন – প্রায়ই শোনায় প্রসঙ্গ থেকে অপ্রসঙ্গে তার খেইহারা ছোটাছুটিতে। তবে গত তিন বছরে ইংরেজি-বাংলার জগাখিচুড়িতে ভদ্রলোক কথা বলার যে-প্যাটার্নটা জনসমক্ষে মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, তা ফলো করতে গিয়ে তারেকের মনে হলো, মন্ত্রী একের পর এক জটিল বিষয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করলেও সারকথাটা বেশ সোজাসাপ্টা। ইন্ফ্লেশন, স্টক মার্কেট, লিকুইডিটি…

  • পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি

    আনিসুল হক ‘আপনি আগামীকাল বিকেল চারটায়, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বিকেল চারটায় মারা যাবেন।’ এবিসির কাছে ফোনটা আসে সকাল দশটায়। তখন তিনি তার গুলশান অফিসে এসে কেবল বসেছেন। টেবিলে ভাঁজ করে রাখা ইংরেজি দৈনিকটা মেলে ধরেছেন। তার প্রিয় হলো এগারো নম্বর পৃষ্ঠার কমিক স্ট্রিপ। তিনি সেই পৃষ্ঠার দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। শীতকাল। বোধহয় পৌষ মাস। এ…

  • প্রভাতফেরি

    কানাই কুন্ডু একই টেবল। একই চেয়ার। টানা করিডোর পেরিয়ে ছোট সেই কাচের ঘর। একটা জানালা। একই কর্মধারা। পরিবর্তন কেবল খান-তিনেক প্রমোশন। এবং পাখার বদলে দেয়ালে লটকানো বাতানুকূল বাক্স। এই চক্রাবর্তে পঁয়ত্রিশটা দীর্ঘ বছর ছিল নিয়ন্ত্রিত। এবং আশ্চর্য, এই বৃত্তটাই পরিপূর্ণ। বাকি সব অর্ধবৃত্ত বা কাস্তের ফালি। এর মাঝে বউ-ছেলেমেয়ে। বাবা-মা এবং বউ মলির চলে যাওয়া।…

  • হরিচরণ মালো

    কাদের মাহমুদ হরিচরণ মালো। জাতে কৈবর্ত্য, – নিম্নবর্ণের হিন্দু। জাতের সুবাদে মালোরা বংশপরম্পরায় মৎস্যজীবী, ধীবর। লোকে বলে, জেলে। রাতের নিশুতি প্রহরে গ্রামের মানুষ ঘুমে অচেতন থাকে; সেই প্রহরে মালোপাড়ার জেলের দল ঘুম ছেড়ে উঠে পড়ে; মাছ ধরার জাল আর সরঞ্জাম বয়ে অাঁধারের পথ ধরে; ডাঙা থেকে জলে গিয়ে নৌকোয় চড়ে; যায় নদী, বিল আর হাওরে…

  • কড়ির বাজার

    পারভেজ হোসেন পোলাপানগুলারে সাহেব না বানাইয়া ছারবানা দেখছি? নবীন হাওয়ায় লাউয়ের ডগার মতো তরতরিয়ে মাচা ডিঙানো বউয়ের ওপর বিরক্ত হয় এমদাদ। কেন বানামু না? চাষার জাত জনম ভইরা চাষাই থাকবো, নাকি? জেদ ধরার মতো করে বলে রেহানা। কেবল দুটো কাঁচা পয়সার মুখ দেখেছে এমদাদ, এরই মধ্যে রেহানার আবদারের আর শেষ নেই। নতুন বাসা, ফার্নিচার, পুরনো…

  • মাছ ও মনসা

    তিলোত্তমা মজুমদার সেই আমাদের কালচিনির বাড়ি। আকাশে ঘন মেঘ, যেন কোনোদিন আর দেখতেও পাবে না কেউ তার নীল। এত মেঘ কবে সব ঝরে জল হবে? একশ দুশো পাঁচশো বছর? বৃষ্টি চলেছে আজ দশদিন। আকাশে যখন-তখন হিজিবিজি বিদ্যুৎ। ঠিক যেন অতিকায় বান মাছ লম্ফ দিয়ে পার হচ্ছে এক শহর থেকে আরেক শহর। ওরা গ্রাম ভালোবাসে। তাই…

  • মহিফুল বেওয়ার প্লাবনযাত্রা

    পাপড়ি রহমান ‘হেই সাতদিন শ্যাষ হইয়া গেলে দুনিয়াতে বাইস্যা নামলো। হেরও সতেরো দিন বাদে জমিনের তলায় বেবাক পানি বাইর অইয়া আইতে লাগল। আর আসমানও ফাইট্যা গেল। চল্লিশ দিন চল্লিশ রাইত ধইরা দুনিয়ার উপ্রে ম্যাঘ ঝরতে লাগলো। বাপরে বাপ – এমুন বিষ্টি আর বিষ্টি। এমুন ম্যাঘের নিদান। কষ্মিনকালেও এমুন ম্যাঘ কেউ-ই দেহে নাই!’ এরকম তন্ময় হয়ে…

  • ভাঙন

    হরিশংকর জলদাস বগলা নদীর উত্তরপাড়ে টেকেরহাট। আসলে টাকুরহাট। বহু বছর আগে জমিদার দীপেন চৌধুরীর নাতি কুলদীপ চৌধুরী এ-হাটের পত্তন করেন। পড়ন্ত জমিদার বংশের লোক কুলদীপ চৌধুরী। হাতে ক্ষমতা আসার পর তাঁর ইচ্ছা জাগল হাট বসাবার। তিনি একটা হাট বসালেন। দীর্ঘদেহী ছিলেন তিনি, টকটকে ফর্সা। নাক চিলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো। চিকন গোঁফ তার। ইংরেজদের মতো জুলপি…

  • যে আসার কথা ছিলো

    আকিমুন রহমান আমি নিশ্চিত, খুবই নিশ্চিত যে, আমি অবশেষে এসে যেতে পেরেছি সঠিক নগরটিতে। অবশেষে! অযুত-নিযুত বছর ধরে সন্ধান করেছি যার, যার সন্ধানে সন্ধানে বিরামহীন পরিব্রাজন – কতকাল থেকে কতকালে, কত লোকালয়ে লোকালয়ে, অন্তহীন ভিখিরি চোখে হেঁটে চলা! কতবার নৈরাশ্য এসে স্তব্ধ করে দিয়েছে আমাকে! অন্তর তখন আর বিশ্বাস রাখতে পারেনি আমার অনুসন্ধান শক্তিতে। আমি…

  • বিশুদ্ধ চাকরি

    মধুময় পাল বাসস্টপটা এখানে ছিল না। ছিল সত্তর-আশি মিটার আগে, নাম কামারশালা। লোচনদাস কামারের জন্মভূমি, কর্মভূমি। লোকে বলে, লোচনদাস বড় হয়ে অাঁতুড়ঘরে কামারশালা খোলে। আরো বড় হয়ে গ্রিল মেশিন বসিয়ে কারখানা করে। নিজে খাটত, লোক খাটাত। কদমগাছের নিচে বসে খদ্দেরদের সঙ্গে কথা বলত। টালিঘরে সারাদুপুর গ্রিলের ঘর্ঘর, চ্যাঁই…চুঁই…। কখনো কখনো মাঝরাত পর্যন্ত। লোকে বলে, অাঁতুড়ঘরেই…