আমরা চেতনার দাসত্বে বিরোধহীনভাবে টি. এস. এলিয়টের কাব্যনাটক-সম্পর্কিত বক্তব্যকেই মেনে নিয়েছি। তিনি নাটকের জৈবিক ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে কবিতাকে দ্বিতীয় স্থান দিয়েছেন। এটা তো বাস্তববাদের প্রতিই শর্তহীন আবেগ, তার কারণ বোধ করি তিনি ছিলেন ‘রোমান্টিকতার বিরোধী ও ধ্রুপদী সাহিত্যের প্রতি আসক্ত’ (রাম বসু, নন্দনতত্ত্ব জিজ্ঞাসা, ১৯৯৪)। নাট্যমঞ্চ বহুমাত্রিকতা ধরার জন্য পরোক্ষভাবে কবিতার কাছেই হাত পেতেছে এবং বাস্তববাদ থেকে সরে যেতে চেয়েছে। যেমন আইরিশ নাটক প্রত্যক্ষভাবে কবিতার ব্যবহার করেছে। কিন্তু জৈবিক ঐক্যের চেয়েও কাব্যনাটকের আকাক্সক্ষা হলো মানবিকতার সামগ্রিক রূপকে ধারণ করা।
অতিরিক্ত নগরায়ণের ফলে এবং শেকড়ের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলার কারণে কাব্যনাটক ঝুঁকেছিল মহৎ উচ্চ চরিত্রায়ণের দিকে, উচ্চতম ভাবের দিকে। কিন্তু তাতে সমাজসত্যের গোটা রূপটি ধরা পড়েনি, অপস্রিয়মাণ যাত্রাপালা-নাটগান বা লোকরীতির কবিত্বময় বাণী প্রায় অবলুপ্ত নাট্যজগৎ থেকে। যদি এইসব ফর্ম থেকে উপাদান ও আঙ্গিক গ্রহণ না করে তবে কাব্যনাটকের ‘নিজস্ব ফর্ম’ তৈরি হবে না। সেই চেষ্টাই করেছেন সাজেদুল আউয়াল তাঁর ফণিমনসা নাটকে (রচনাকাল : ১৯৭৮-৭৯; মঞ্চায়ন : ১৯৮০)।
আমাদের সাহিত্যে আধুনিকীকরণের সমস্যা-সংকট ছিল। যেসব দার্শনিক-রাজনৈতিক মডেল উনিশ-বিশ শতকে সামনে এসেছিল সেগুলোতে স্বকীয়তা কমই ছিল, তার অনেকখানিই ইয়োরোপীয় ভাবনার প্রতিধ্বনি। আমাদের চিন্তা-চেতনা স্বাধীন ছিল না বলেই কোনো মডেলকেই জীবন্ত ও বিকশিত করা যায়নি, সাম্যবাদের যে-হাতছানি ছিল তাও অচিরেই হারিয়ে গেল সময়ের ধারায় প্রত্যাশা ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আলোড়নের পর। কিন্তু এর ফলে বদলে গিয়েছিল জীবনদৃষ্টি ও শিল্পসাহিত্যের বিষয়-আশয়। এক বৈপ্লবিক আশাবাদী স্বপ্নের মধ্য দিয়ে কেটেছে মার্কসবাদী পর্যায়।
তবে, আমরা বলতে চাইছি ১৯৬৮ সালের পরবর্তী পৃথিবীর কথা, যখন বিশ^ আণবিক যুগে প্রবেশ করে ফেলেছে, ব্যক্তি তুচ্ছ হয়ে গেছে, সময় হয়ে গেছে বিশৃঙ্খল, ভঙ্গুর, যার প্রকাশ আগেই রূপায়িত হয়েছিল বেকেটের অ্যাবসার্ড নাটকে। আমরা এখন এক কসমোলজিক্যাল সময়ের তীরে বাস করছি, আমরা যেমন বিচ্ছিন্ন নই গোটা ব্রহ্মা- থেকে, তেমনি বিযুক্ত নই ক্রমপ্রসারণশীল সৃষ্টিজগৎ থেকেও। কাজেই কাব্যনাটকের লক্ষ্য এখন সময়ের বিশৃঙ্খল তীরে বাস করছে না। তার অন্তরঙ্গ বসবাস মানুষের বৈশি^ক চেতনায়, জীবনের সামগ্রিকতার তটভূমে। এই সমগ্রতা খুঁজতে হলে যেমন যেতে হবে বিশ^সৃষ্টির ব্যাপ্ত প্রসারশীল প্রাণের কাছে, তেমনি নেমে আসতে হবে অনুভূমিক জীবনে – আমাদের শিকড়-বাকড়ে, মৃত্তিকায়।
রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ধারার সঙ্গে সংগতি রেখে নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন যে রীতিতে তার ফর্ম আগে জানা ছিল না। ইয়োরোপ থেকে ঋণ গ্রহণ করলেও তাতে প্রধান হয়েছিল দেশজ ফর্ম, একটা স্বকীয়তা, যদিও ভাব-ভাবনা ছিল উচ্চস্তরিক। ফলে একটা কসমিক আবহ অনিবার্যভাবেই তাঁর ভাবাশ্রয়ী নাট্যফর্মে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী বিশ^নাটকে আমরা যেসব লোকাচার, মিথ, রূপ-প্রতীক ইত্যাদি পাই – যেমন লোরকার নাটকে, সেখানে আধুনিকতা আর লৌকিকতা মিলেমিশে গেছে। সাজেদুল আউয়াল সম্পূর্ণতই একটি দেশীয় শিকড়ের পটভূমিতে বিশ^জনীন জীবন মর্মার্থ সন্ধান করতে চেয়েছেন তাঁর ফণিমনসা নাটকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী নাট্যভাবনায় সৃষ্টি হয়েছে দেশজতার জোয়ার। বাস্তববাদ আর চিরায়ত প্রকৃতিযুক্ত মানবজীবনের আখ্যান দেশজ ফর্মেই রূপায়িত করা হচ্ছিল সার্থকতার সঙ্গে। মঞ্চে সেগুলো অভিনীত হয়ে দর্শকের আনুকূল্যও পেয়েছে। ফণিমনসাও সার্থকতার সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল মঞ্চে, ১৯৮০-এর দিকে, এটি ঢাকা থিয়েটার মঞ্চস্থ করেছিল। এরপরেই এ-পথে হাঁটলেন সেলিম আল দীন তার কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই, চাকা নিয়ে। কাজেই নাটকের দিকে ফেরানোর প্রথম সূচনা ঘটিয়েছিলেন সাজেদুল আউয়াল, এই কৃতিত্ব তাঁর প্রাপ্য। একে সমালোচকেরা অভিহিত করেছেন সমষ্টি মানুষের উত্তরাধিকার বহনের কারুকাজ হিসেবে। আর এই উত্তরাধিকার রচিত হয়েছে এদেশের কর্মিষ্ঠ জনজীবনের প্রান্তিক মানববর্গের হাত দিয়ে।
ফণিমনসার কাহিনি-পটভূমি তিতাস নদীর পারঘেঁষে বসবাস করা নরনারীর সুখ-দুঃখ, জয়-পরাজয়, সংগ্রামের দৃশ্যপট, যেমনটি আমরা লক্ষ করেছি অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে। জানা গেছে যে, তিতাস পারের জেলেপল্লি – যাদের বলা হয়ে থাকে মালো, তাদের জীবনাভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছিলেন সাজেদুল আউয়াল। তিনি তাদের জীবনছন্দটাই তুলে এনেছেন ফণিমনসায়। মালোরা জীবিকার সন্ধানে ভেসে বেড়ায় তিতাসের বুকে, নিজেদের ভাষা-কথনে গান বাঁধে, নৈতিকতার ডিকশন গড়ে তোলে এবং নিজেদের জীবনের কথকতা রচনা করে। সবকিছুর মধ্যে আছে তাদের বেঁচে থাকার, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই; এ-লড়াই প্রাকৃতিকতায় মিশে থাকা মানুষের নিত্যনিয়তি।
তিনশো বছর আগের ঘটনা ধরতে চেয়েছেন নাট্যকার। ‘ফণিমনসা’ নামের নদী যখন শুকিয়ে যায় তখন তাতে চর জাগে। ‘ফণিমনসা’ নামের মধ্যে যেন রূপকার্থ লুকানো আছে। সাপের দেবী মনসার উচ্চবর্গীয় শিবের সঙ্গে সংঘাতের সমান্তরালতা যেন তৈরি হয়েছে এখানে, মনসা একে তো নারী, তায় আবার অন্ত্যজ। ঠিক তেমনি ফণিমনসার মালোরাও অন্ত্যজ, নারীর চেয়েও বঞ্চিত তাদের জীবন। জীবিকার প্রয়োজনে মালোরা যখন বদলে ফেলতে চায় তাদের জীবিকা, হতে চায় চাষি, তখনই চরের মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় ইটখোলার মালিকের সঙ্গে। মালিক এখানে শোষক, জবরদখলকারী এবং ভূমি লুণ্ঠনকারী। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মানুষের অস্তিত্বের লড়াই বারবার তাকে জীবিকা বদলানোর মধ্যে নিয়ে গেছে। এই রূপান্তরশীলতাই বৈশি^ক নিয়মের অধীন। বিশ^ মাত্রে রূপান্তরশীল, পরিবর্তনই একমাত্র অপরিবর্তনীয়।
মালোরা বাঁচার তাগিদেই জোটবদ্ধ হতে চায়। বন্ধুবিচ্ছেদকে ভুলে গিয়ে ঐক্য গড়ায় আকাক্সক্ষী হয়ে ওঠে। ছোট-ছোট দ্বন্দ্ব ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ফণিমনসার চরিত্রগুলোকে নাট্যপ্রাণতা দিয়েছে। কৃষ্ণ নামের যুবককে নায়কতুল্য করায় এখানে মহাভারতের মিথ ভেঙে দিয়ে নবনির্মাণ করেন নাট্যকার। দ্যূতক্রীড়ার পরামর্শ দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু মালিকপক্ষ এই দ্যূতক্রীড়ায় রাজি না হয়ে বলে দেয় : ‘দ্যূতক্রীড়া নি করতে চাও। সন্ধি করতে ইচ্ছা জানাও। হে? ছাড়তে কও তোমাদিগেরে জোতের জমি।/ এক লহমাও মাটি দিমু না/ হাউস কইরা লাভ হইবো না/ পারলে, ব্যূহ ভেদ কইরা কাইল চরেতে নামি।’ কিন্তু দৃঢ়তায় একতাবদ্ধ জেলেরা অবশেষে যুদ্ধের জন্যই প্রস্তুতি নেয়, তাদের আকাক্সক্ষা জয়ী হয়ে ‘নাবাল চরে’ লাঙলের ফলা বিঁধাবে। নাট্যকার তাদের আচার; কৃত্য, প্রথা – সব এখানে ব্যবহার করেছেন নাট্যোপাদান হিসেবে। শিব জলের দেবতা – যে নদী অন্যপথে বইয়ে দিয়েছে, যে জলের দেবতা সে তো শস্যেরও দেবতা – যদিও ধ্বংসেরও শক্তি। কিন্তু লাঠির জোরে, ন্যায়যুদ্ধে মালোরা পরাজিত হয়। তাদের পূজ্য শিবের পরাজয় ঘটে শোষকের কাছে। কিন্তু জনজীবনের বাঁচার আকাক্সক্ষা এতই দুর্বার যে, তারা এই পরাজয়কে খ-কালের ব্যর্থতা ধরে নেয় – ‘চিরবর্তমান নয় কোনো কাল;/ নয় অসম্ভব পরিবর্তন/ মানুষের অতীত কর্মযোগে।’
ইতিহাসের নিয়মেই জীবন এগিয়ে চলে, এই চলার ইশারাতেই কাহিনির সমাপ্তি। অর্থাৎ এ-নাটক জীবনমুখী, ভবিষ্যতে প্রসারণশীল এবং মানবিকতায় সার্বিক। কাহিনিটিকে সমালোচকরা, যেমন শান্তনু কায়সার বলেছেন যে পুরনো কাহিনি, যাকে বলে সচরাচর যা ঘটে, ঘটে আসছে চিরকাল। কিন্তু ফণিমনসার বৈশি^কতা হলো – যে বৈশি^কতা কাব্যনাটকের অন্বিষ্ট, ‘নতুন জীবনের ইঙ্গিতে’, স্বপ্নসম্ভাবনায়। স্বপ্নই প্রান্তিক মানুষের লড়াকু স্বভাবের অঙ্গীভূত সত্য, তাদের বষবসবহঃধষ ভড়ৎপব ড়ভ ষরভব। এটাই অশেষ প্রাকৃতিকতা, জীবনের সঙ্গে প্রকৃতির যোগ-বিয়োগ, যাকে বলা হয় ইকোলজি। কাব্যনাটক বর্তমানের যন্ত্রসভ্যতার আগ্রাসী পরিস্থিতিতে এই ইকোলজিকেই সন্ধান করে ফিরছে। কাজেই নাট্যকার বর্তমানের মূলস্বর আর চিরায়ত সুরকে এক মাল্যগাছিতে বেঁধেছেন।
বৈশি^কতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়, ঘটনা যখন ঘটছে তখন তাতে নতুন নতুন জীবনগল্প ঢুকে যাচ্ছে, ছোট-ছোট ঘূর্ণি তুলছে এবং নাটকটিকে প্রবহমান ও বৈচিত্র্যময় করছে। আবার তাতে যুক্ত করা যায় আমাদের নাট্যরীতির কথক চরিত্রের ব্যাখ্যা দানের সূত্র। নাটকের সময় ও ঘটনার পরিসরে সে প্রবেশ করে নাটকের কাহিনি ও দ্বন্দ্বসূত্রকে ধরিয়ে দেয় বা বেঁধে দেয়, নতুন কালোচিত ব্যাখ্যা প্রদান করে। ফলে নাট্যকারের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আর ধ্বনিত হয় না, নাট্যকণ্ঠস্বরই ঐকান্তিক হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যনাটকে দেখি তাঁর দর্শন ও কণ্ঠস্বর কোনো-না-কোনো চরিত্রের স্বরে অন্তঃস্বরের মতো ঢুকে পড়ে। প্রতিতুলনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বলতে চাইছি, সাজেদুল আউয়ালের ফণিমনসা যেমন সমষ্টির সংগ্রামশীলতার নাটক তাই তাঁর কণ্ঠস্বর ওই সংগ্রামের ভেতরেই খেলা করে,
আলাদা হয়ে চোখে পড়ে না, অথচ সমালোচকেরা বলে থাকেন, কাব্যনাটকে একটি তৃতীয় স্বর থাকবে, যা নাট্যকারের বিশ^বীক্ষাকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করবে।
উত্তরাধুনিক (?) বা লেট ক্যাপিটালিজমের সময়পর্বে এসে আমরা আর স্রষ্টাব্যক্তিকে খুঁজি না, সন্ধান করি সৃষ্টিকর্মকে। কিন্তু কোনো সৃষ্টিই স্রষ্টা-নিরপেক্ষ নয়, তাতে অবশ্যই তাঁর চিহ্ন চিহ্নক হয়ে থাকেই। ফণিমনসায় সাজেদুল আউয়ালের লোকায়ত জীবনাভিমুখিতা এবং ইতিবাচক সময়চেতনাই মূলস্বর হয়ে গোটা নাটককে সচল করে রেখেছে। তাঁর প্রাকৃতিকতায় প্রত্যাবর্তন, লোকজ ফর্মের নবায়ন এবং ডিকশনের মধ্যেই এই সচলতা রচিত হয়েছে, তাঁর দৃৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা পরিস্ফুট করেছে অনেক ক্লাসিক রীতিতে, বাস্তববাদী ধারার সংলগ্ন হয়ে। কারণ এই কাহিনি, স্থানকাল ও মানুষজন সবই একান্ত বাস্তব, তাঁরা ইতিহাসেরই চালিকাশক্তি, নাট্যকারের চরিত্রায়ণ পদ্ধতিতেও রয়েছে লোক-আখ্যানের পুনর্বপন। তাই মহাভারতের কৃষ্ণ হয়ে ওঠে ‘জল ও মৃত্তিকার’ সঙ্গে অন্তর্লীন, বাঙালির যে কৃষ্ণ প্রেমিক সেও এর মধ্যে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। অবশ্য নাটককে কাব্যনাটক হতে হলে নাট্যপরিণতিতে কবিতার সম্ভাবনাকে উজ্জ্বলিত থাকতে হয়।
কাজেই সাদামাটা গল্পের বুনন বা চিরায়ত শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব এর মুড বা প্লট মাত্র। আবেগগত পরম্পরার মধ্য দিয়ে কাব্যনাটকে যে-তরঙ্গ উত্থিত হয় তার উৎসে থাকবে মানবচরিত্রের মৌল সমস্যা ও আবেগ। আমরা ফণিমনসায় দেখি মানবচরিত্রের বৈচিত্র্যায়ণ যেমন আছে, প্রত্যেকের স্বর, কথন ও ভাবনা
আলাদা-আলাদা, তেমনি গ্রন্থিত সমস্যাটি অবশ্যই জীবনের মৌল সমস্যা। সাজেদুল আউয়াল চরিত্রের মৌল সমস্যাকে বয়ান করতে চাননি, তিনি চেয়েছেন প্রান্তিক জীবনের মৌল সমস্যাকে দ্যোতিত করতে – যা জমির জন্যে আদি লড়াইয়ের বিষয়, এখনো যা বর্তমান। যেসব পঙ্ক্তি-বাক্য, ছন্দিত উচ্চারণ ও মেটাফর নাট্যকার জড়ো করেছেন তা সিচুয়েশন অনুযায়ী অনিবার্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল গতিশীল। আমাদের সামনে যে দ্বন্দ্ব ও লড়াই উন্মোচিত করা হয়েছে তা নিয়ে এসেছে মৃত্যুর বিভীষিকা নয়, জীবনের আমূল পরিবর্তনের প্রত্যাশা।
আমাদের নগরমনস্ক মন প্রতিমূহূর্তে যেসব সংকট-জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে তাতে অসংগতি আছে, নৈরাজ্য আছে, বিশৃঙ্খলা আছে। সেই নগরমনস্কতার জটাজালের বাইরে এক আদিম জীবনের সংঘাত ও আশাবাদকে নাট্যকার তুলে এনে আমাদের চেতনাকে ঐক্যসূত্রের মূল তারটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন, এখানেই ঘটে আমাদের শিকড়ায়নে ফেরার আকুতির প্রকাশ এবং এক ধরনের নাগরিকতা থেকেও মুক্তি। আমরা জীবনের টোটালিটিতে যেন ফিরে যাই। এবং জনজীবনের সঙ্গে সংহতি, সাযুজ্য বোধ করি, আমাদের চিত্ত হারিয়ে ফেলা সুরটিকে যেন খুঁজে পায়, আমাদের জীবন সম্পর্কে ভাবতে শেখায়। শুধুই বৌদ্ধিক শ্রেণিবৃত্ত নয়, এর বাইরেও রয়ে গেছে বিপুল জীবনকর্মপ্রবাহ, যা আমাদের ভাবতে শেখায়, আমাদের মুক্তিও এনে দেয়।
সাজেদুল আউয়ালের নাটকে লিরিসিজম – যা কাব্যনাটকের একান্ত অর্জন তা ফণিমনসায় লভ্য। ছন্দিত প্রাকৃতিকতার অন্বেষণ এখন আমাদের কবিতারও বিষয়-আশয়। কবিরা মুখ ফিরিয়েছেন সেই আদি বহমান জীবনের লোকাচার আর অন্তর্নিহিত কাব্যিকতার দিকে – যদিও নগরের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসন এখন গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত, তবু এর প্রাণের সুরটি, কথনটি আজো নিছক আমোদ/বিনোদন হয়ে ওঠেনি, আজো তা অবৈকল্যে তাদের অনুভূতি, প্রেম ও দুঃখানুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই অনুভূতিকেই নাট্যতারে বাঁধতে চেয়েছেন সাজেদুল আউয়াল।
তিনি তাদের সঙ্গে আমাদের চৈতন্যের যে সেতু বাঁধতে চেয়েছেন, যে ভাষায় ও কথনে, তার মধ্যেই তো আমাদের বসবাস, শুধু তা অগোচর ছিল বা আমরা তা ছিন্ন করে ফেলেছি। সেই হারানো/ ছিন্ন সূত্রকে আমাদের চৈতন্যের কাছে এনে দেন নাট্যকার। সে অর্থে এখানে যেমন অনন্ত ‘ইনফিনিটি’ আছে, তেমনি আছে খ- সময়ের মানুষের অন্তর্জিজ্ঞাসাও। এ-নাটক আমাদের অনন্ত বিপুলের সামনে হয়তো দাঁড় করায় না, কিন্তু আমাদের পুনরুত্থান ঘটায়, জল দান করে আমার ভেতরে লুকানো শিকড়ের শিরায় শিরায়। ফণিমনসাকে আমরা তাই জনজীবনের, বিশেষ করে প্রান্তিক জীবনের, কাব্যনাটক বলতে পারি। প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের নাট্যায়নও বলা যায় – পাঁচালি বা কথকতা নয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.