অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শিস

আশরাফ আহমেদ

শিশিরের বুকে শিস দিয়ে
আলমগীর খান
প্রকৃতি
ঢাকা, ২০১৯
১২০ টাকা

যার যার বাঁশি ও বন্দুক বইটির পর শিশিরের বুকে শিস দিয়ে আলমগীর খানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। আলমগীর খান শিক্ষা, নাটক, গল্প এবং সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। যাঁরা তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, তিনি আমাদের সমাজের অশিক্ষা, দারিদ্র্য, কূপমণ্ডূকতা, অসাম্য, দুর্বৃত্তায়ন, বিজ্ঞান-বিমুখতা এবং জাতীয় ও বৈশ্বিক যেসব ঘটনা পরিবেশ, মানুষ ও পৃথিবীর ক্ষতিসাধন করে, সেসবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন। একই সঙ্গে নৈরাশ্যবাদীদের মতো শুধু অভিযোগ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে সমস্যা সমাধানের পথ নিয়েও তিনি আলোচনা করে থাকেন।
গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলো আমাদের প্রাত্যহিক সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক সমস্যা কীভাবে একটি কবিমনকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে তারই একটি খণ্ডচিত্র। কবিতাগুলোর বিষয় বিচার করলে কবি যে মার্কসীয় দর্শনের অনুসারী তা খুব স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে এখানে সমস্যার কোনো সমাধান দেওয়া নেই। একজন কবি থেকে তা আশা করাও ঠিক নয়। কবির দায়িত্বও তা নয়। অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে লেখা কবির উপলব্ধি পাঠকমনে যদি কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে তবেই কবিতা হয় সার্থক।
বইয়ের প্রায় প্রতিটি কবিতা আমার মনকে কোনো না কোনোভাবে দোলা দিয়েছে। ভুলে যাওয়া ঘৃণিত ঘটনার কাব্যিক উল্লেখ আমার নিজের অপারগতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধতাকেও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। এসব কারণেই শিশিরের বুকে শিস দিয়ে একটি সার্থক কাব্যগ্রন্থ।
চার-পাঁচটি বাদ দিয়ে বইটির মোট চল্লিশটি কবিতার প্রায় সবই প্রতিবাদী স্বরের। দারিদ্র্য, সামাজিক অনাচার-অবিচার, কঠোর রাষ্ট্রীয়, সাম্রাজ্যবাদী নিপীড়ন ও বিধিনিষেধ, এবং মানুষ, সাহিত্য ও শিল্পকে পণ্যে রূপান্তরিত করার মতো ঘৃণিত প্রচেষ্টা বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। কখনো বিদ্রূপাত্মক, কখনো তিরস্কারের স্বরে, কখনো বিদ্রোহাত্মক, কখনো শুধুই অভিযোগ আকারে, আবার কখনো প্রেমের আবরণে।
বইটিতে অন্ত্যমিলযুক্ত এবং অন্ত্যমিলহীন দু-ধরনের কবিতাই আছে। গদ্য-কবিতা ‘পরিচয়পত্রহীন’সহ প্রায় অধিকাংশ কবিতায় অন্ত্যমিল না থাকলেও কোথাও ছন্দহীনতা টের পাইনি; কবিতার রসবঞ্চিতও হইনি। অন্ত্যমিলযুক্ত ‘চে মানে তারুণ্য’, ‘শিশিরের বুকে শিস দিয়ে’, ‘সত্য ও সুন্দর’, ‘আত্মধসকামী’, ‘সাম্যের উল্লাস’, ‘ভাতারের নাম’, ‘অঙ্গারাদি’, ‘স্বপ্নের ফালে স্বপ্নের শাণ’, ‘কেবলই সন্ধ্যা’ এবং ‘বিশ্বায়নে অস্ত্রের বংশবিস্তার’ এসবের মধ্যে একমাত্র শেষটিকে কিছুটা কৌতুকপূর্ণ ছড়া-কবিতা মনে হয়েছে। সত্যি বলতে কী, উপযোগী উপমা ব্যবহারে আন্তরিকতার ফলে এবং কবিতার পরতে পরতে ছন্দ থাকার ফলে পড়ার সময় অন্ত্যমিল আছে কি নেই তা কখনো মনে উদয় হয়নি।
বিদ্রূপ বা শ্লেষ বা স্যাটায়ারের বিচারে প্রথম কবিতা ‘অবৈধ সম্পাদকীয়’ একটি চমৎকার কবিতা। শুধু স্বার্থের প্রয়োজনে কিছু ‘শিক্ষিত’ তস্কর মুখোশ পরে কীভাবে সমাজের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি করে চলেছে, তির্যকভাবে তা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে ঝরনার গতিতে ও কাব্যিক ছন্দে। অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্যকে বাণিজ্যিক পণ্য করার বাসনায় ‘সাহিত্য সম্পাদক সাহেব’কে সরাসরি তিরস্কার করা হয়েছে। ‘শিশিরের বুকে শিস দিয়ে’ কবিতাটিও তেমনি তথাকথিত বিপ্লবীদের বিদ্রƒপ করে লেখা। ‘শব্দ উড়ে যায়’ এবং ‘ভাতারের নাম’ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমনি দুটি বিদ্রƒপ। সবচেয়ে দীর্ঘ ‘ঠোঁটের কোণে রক্তিম সূর্য’ কবিতায় গুপ্তবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে থাকা এক নিষ্পাপ যুবকের মুখ থেকে অবলীলায় বের হতে থাকে আর্থিক-রাজনৈতিক-সামাজিক অনাচারের ফিরিস্তি। অসহায় নারী ও শিশু ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং অত্যাচারের প্রতিকার ও বিচারহীনতার আলোকে ‘ভাল থেকো প্রিয় চাঁদ’ এবং ‘যারা মাতৃগর্ভে ঘুমোচ্ছো, ঘুমাও’ অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী দুটি কবিতা। তনু হত্যার বিচারহীনতায় অসহায় কবি আর ‘কাঁদবো না বলে দিচ্ছি’ লিখেছেন। শেষের এই তিনটি কবিতায় সমগ্র জাতির অন্তরের গভীর থেকে উঠে আসা অসহায় আর্তনাদই যেন ধ্বনিত হচ্ছে।
বাংলার ও পৃথিবীর মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনে রবীন্দ্রনাথ, লেনিন, নজরুল, মুজিব, ভাসানী, একুশ, ৭ই মার্চ, এবং ১৬ই ডিসেম্বরের মতো একেকটি সোপানকে চে বলে অভিষিক্ত করা হয়েছে ‘চে মানে তারুণ্য’ কবিতায়। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের নামে সাম্রাজ্যবাদী ভণ্ডামি, শোষণ ও মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে ‘হরিণ, খরগোস ও ফড়িং’, ‘হাতুড়ি নে, বাটাল নে’, এবং ‘পৃথিবী, সমাজ ও মানুষ’ কবিতায়। মাইকেল মধুসূদনের কাব্যচর্চাকে রূপক ধরে দেশপ্রেম এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবিতা ‘এক রূপকথার নায়ক’।
বইটির সব কবিতায় যা আছে তার বিপরীতে, অত্যাচারিতের জীবনবোধ নিয়ে লেখা ‘কোন গল্প নেই’ কবিতাটিতে নেই কোনো অভিযোগ, বিদ্রোহ বা বিদ্রূপ। কিছুটা হতাশাগ্রস্ত ‘অন্ধকারে পথ হাঁটি’ কবিতার শেষে কবি এক অন্ধবিশ্বাসে আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
‘পরিচয়পত্রহীন’ কবিতায় ধর্ম পরিচয়ের সঙ্গে গরিব পরিচয়ের তুলনাটি আমার কাছে খুব জোরালো মনে হয়নি। ‘সাত আসমানগামী’ কবিতাটি আমার জন্য কিছুটা আধুনিক হয়ে গেছে, মানে বোধগম্য হয়নি। ‘স্বপ্নের ফালে স্বপ্নের শাণ’-এর প্রতি লাইনে ছন্দ থাকলেও আমার মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি।
সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে এতসবের বিপরীতে ‘পাপ’ সম্পূর্ণ ভিন্নতর, সময়োত্তীর্ণ একটি কবিতা। নরনারীর দৈহিক মিলনকে অসম্ভব এক ভালোলাগার আবেশে প্রকাশ করা হয়েছে প্রথম লাইনে এভাবে : ‘কিছু কিছু পাপ আছে অনেক পুণ্যের চেয়ে বেশি পুণ্যময়’। ‘এরই নাম জীবন’ও একটি ব্যতিক্রমধর্মী, জীবন ভোগের সুন্দর কবিতা। ‘সত্য ও সুন্দর’ও তেমনি অভিযোগহীন একটি কবিতা, এক ব্যর্থ প্রেমের আভাসও যেন এতে পাওয়া যায়। কিন্তু এইসব ভালোলাগা, ভোগবাদী কবিতাকে ছাড়িয়ে ‘প্রেমের প্রার্থনা’ কবিতায় বইটির মূলমন্ত্র প্রকাশ পেয়েছে অধিকার অর্জনে নির্যাতিত মানুষকে বিদ্রোহে আমন্ত্রণ জানানোর ভেতর দিয়ে।
মাত্র একটি দিয়ে পুরোটা না হলেও বইটির বিষয় সম্পর্কে যদি কিছুটা আঁচ করা যায়, তবে সেটি হচ্ছে সর্বশেষ কবিতা ‘কেবলই সন্ধ্যা’। আমাদের সমাজের ঠিক কোন কোন সমস্যা কবিকে বিচলিত করে এরও প্রতিচ্ছবি মেলে এই কবিতায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে আলমগীর খান প্রায়ই পত্রিকায় কলাম লিখে থাকেন। শিশিরের বুকে শিস দিয়ে কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করে আমার এই ধারণাই হয়েছে যে, শুধু লেখার খাতিরে বা কলেবর বৃদ্ধির জন্য তিনি সেসব লেখেন না। সমস্যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও তা থেকে উত্তরণের চিন্তাই লেখককে আন্দোলিত করে বলে তিনি সেসব লিখে থাকেন।