ব্যক্তি বদরুদ্দীন উমরের কথা এলে একজন চাঁছাছোলা, বেশ রাগী, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বশালী মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। মনে হয় একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি বুঝি সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে কঠিন কঠিন তত্ত্ব আলোচনা নিয়েই থাকতেন। তাঁর সাহস, কাউকে ছেড়ে কথা না বলার অভ্যাস তাঁর একটা আপসহীন ইমেজ তৈরি করেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বদরুদ্দীন উমর ছিলেন অতি সজ্জন, খুবই সহানুভূতিশীল, অতি উচ্চাঙ্গের রসবোধসম্পন্ন একজন ব্যক্তি।
বদরুদ্দীন উমরের জীবনের দুটি ধারা সমান্তরালভাবে বহমান ছিল। এই দুটি ধারা তাঁর দুটি পরিচয় তৈরি করে। একটি ছিল – একজন লেখক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক ও বিশিষ্ট পণ্ডিত। অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ মার্কসবাদী রাজনীতিবিদ, সংগঠক, অ্যাক্টিভিস্ট। এদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনে, সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, সকল প্রকার জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতার বিরোধিতায় তিনি ছিলেন সোচ্চার। সারা জীবন মিটিং-মিছিলে তিনি যেমন মাঠে সক্রিয় থেকেছেন, তেমনি সক্রিয় থেকেছে তাঁর কলম; অব্যাহত রেখেছেন পঠন-পাঠন, নিবিড় জ্ঞানচর্চা। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘রাজা রামমোহন রায় স্মারক বক্তৃতা’ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধের ওপর বক্তৃতা দেওয়ার জন্য শঙ্খ ঘোষ তাঁকে অনুরোধ করেন; ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি-আয়োজিত নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও তাঁর ডাক পড়েছে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্রের অনুরোধে বোম্বের ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে (EPW) তিনি লেখা শুরু করেন, আবার ক্লান্তিহীনভাবে মুসাবিদা করেন রাজনৈতিক দলিল, লিফলেট। ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বক্তৃতা করার পরের সপ্তাহেই হয়তো তিনি পাবলিক বাসে ঝুলে-দাঁড়িয়ে চলে গেছেন দেশের কোনো শ্রমিক এলাকায় কিংবা লঞ্চের খোলা ডেকে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে রওনা হয়েছেন বরিশালের কোনো গ্রামে, শীতের রাত কাটিয়েছেন কোনো কৃষকের দাওয়ায়।
বদরুদ্দীন উমরের রাজনীতিবিদ ও লেখক পরিচয়কে আলাদা করে দেখার একটি প্রবণতা আছে। অনেকে তাঁর লেখক সত্তাকেই প্রধান মনে করেন এবং তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাকে এড়িয়ে যান। আবার রাজনীতি-অঙ্গনের কেউ কেউ হয়তো তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়কে বড় করতে গিয়ে তাঁর লেখক ও পণ্ডিত পরিচয়কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চান না বা পারেন না। কিন্তু বদরুদ্দীন উমরের এই দুটি পরিচয় পরস্পর-পরিপূরক। একটি পরিচয় ছাড়া অন্য পরিচয় অর্থপূর্ণ নয়। উমর যা-ই লিখেছেন, তা একটি সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখেছেন। লেখক বদরুদ্দীন উমরকে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া বোঝা যাবে না; আবার তাঁর পাণ্ডিত্য ও লেখক পরিচয়কে বিবেচনায় না নিয়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে বদরুদ্দীন উমরের অনন্যতা উপলব্ধি করা যাবে না।
বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের গদ্য সম্পর্কে লিখেছিলেন, যে-কোনো দৈব দুর্বিপাকে যদি রবীন্দ্রনাথের সকল কাব্য ধ্বংস হয়ে যায় এবং কেবল গদ্য টিকে থাকে, তবু এই গদ্য পড়ে ভবিষ্যতের যে-কোনো পাঠক সহজেই বুঝতে পারবে যে, এই গদ্যের রচয়িতা একজন বড় কবি ছিলেন। বদরুদ্দীন উমরের গদ্য পাঠ করলেও বোঝা যায় এই গদ্যের লেখক একজন উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক, শিল্প-সাহিত্যের গভীর সমঝদার। সাহিত্য ও ইতিহাসে তাঁর নিবিড় পড়াশোনা এবং সংগীত, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদিতে গভীর আগ্রহ ছিল। এসব দিক দিয়ে তিনি তাঁর অধিকাংশ রাজনৈতিক সহকর্মী থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে স্বতন্ত্র ছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে আসার পর তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তাঁকে পার্টির পত্রিকা গণশক্তি সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময় তাঁদের পার্টি পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের পার্টির নকশালবাদী লাইন অনুসরণ করছিল। গণশক্তি পত্রিকাও সেই ধারায় পরিচালিত হতো। এ সময় পশ্চিমবঙ্গের নকশালীরা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের মতো উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরণের প্রধান ব্যক্তিত্বদের তীব্র সমালোচনা এবং নানা জায়গায় স্থাপিত তাঁদের মূর্তি ভাঙা শুরু করেন। কিন্তু সাধারণভাবে নকশালপন্থী অবস্থানে থাকলেও বদরুদ্দীন উমর গণশক্তি পত্রিকায় রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা ও মূর্তি ভাঙা তৎপরতা সমর্থন করেননি। তাঁর ইতিহাস সচেতনতা ও শিল্প-সাহিত্যবোধই এ-ধরনের স্থূল হঠকারিতার অসারত্ব উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল। তাঁকে পার্টি থেকে এ-বিষয়ে লিখতে বলা হলে তিনি বলেছিলেন, তাঁকে সম্পাদক রেখে এ-কাজ হবে না।
দুই
বর্তমান লেখাটি বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত আলাপচারিতার ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। তাঁকে আমি প্রথম দেখি ১৯৭৯ সালে, সুনামগঞ্জে। তখন তাঁর বয়স ৪৮ বছর। এরপর থেকে সব সময় তাঁর সঙ্গে আমার কমবেশি যোগাযোগ ছিল। আমি তাঁর পার্টির সঙ্গে কখনো জড়িত ছিলাম না। তবে লেখক শিবিরে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা নানা নির্দেশনা ও পরামর্শের জন্য ঘন ঘন তাঁর বাসায় যেতেন। আমিও মাঝে মধ্যে যেতাম। তবে আমি যেতাম তাঁর কথা শুনতে। কখনো আটঘাট বেঁধে, সময় নিয়ে যেতাম। সঙ্গে থাকতো নোটবই, কথাবার্তা রেকর্ড করার জন্য মোবাইল ফোন। একপর্যায়ে তিনি কানে কম শুনতে শুরু করলে জোরে জোরে কথা বলতে হতো; কিছু শুনতেন, কিছু শুনতেন না, একাধিকবার বলতে হতো। শেষদিকে কানে একেবারেই শুনতেন না। আমরা লিখে লিখে দিতাম। কিন্তু কানে না শুনলেও মাথা ছিল পরিষ্কার, মন-মেজাজ ফুরফুরে। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় রাজনীতিই ছিল মূল প্রসঙ্গ। তবে আমি এর ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে সাহিত্য, শিল্প, সংগীত, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে টেনে আনতাম। তিনি উৎসাহ নিয়ে আলোচনা করতেন। বলতেন, এসব নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী লোক তেমন পান না।
অন্য অনেকের মতো আমিও তাঁকে ‘উমর ভাই’ বলতাম। কিন্তু সাক্ষাতে আমি আমার এই গুরু ও শিক্ষককে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেছি। আমার রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ছাড়াও পঠন-পাঠন তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে বইয়ের নাম জেনে আমি সেগুলো দ্রুত সংগ্রহ করে পড়েছি। তিনি উনিশ শতক এবং সুনির্দিষ্টভাবে বিদ্যাসাগরের প্রতি আমার আগ্রহ যেমন সৃষ্টি করেছেন, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই সময় ও তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দেখার চোখটি তিনি তৈরি করে দিয়েছেন।
বর্তমান লেখার মূল ভিত্তি বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার আড্ডা-আলোচনা। এসব কোনো বিষয় ধরে ধারাবাহিক আলাপ বা কোনো বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ছিল না, ছিল খাপছাড়া, বিক্ষিপ্ত আলোচনা। এর কিছু কিছু রেকর্ড করা আছে। তাঁর সঙ্গে বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা হতো। এখানে কেবল সাহিত্য-ইতিহাস-শিল্প ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা থেকে কিছু তুলে ধরা হলো। এসব কথা যে বদরুদ্দীন উমর লিখছেন না – ঘরোয়া পরিবেশে, একান্ত আড্ডায় বলছেন, তা পাঠককে মনে রাখতে অনুরোধ করবো। পাঠকের সুবিধার জন্য তাঁর সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসা কোনো কোনো বিষয়ে পরিপূরক তথ্য ও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
তিন
বদরুদ্দীন উমর চোখের নানা সমস্যায় ভুগেছেন। শেষদিকে এক চোখে খুব কম দেখতে পেতেন। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়েই সব পড়াশোনা ও লেখালেখি চালাতেন। এই পড়াশোনার পরিধি ছিল বিস্মৃত ও বিচিত্র। শেষদিকে যতক্ষণ জেগে থাকতেন বেশিরভাগ সময়ই পড়তেন। গুরুগম্ভীর বিষয়ের পড়াশোনা তো আছেই, তিনি ছিলেন সাহিত্যের এক মুগ্ধ পাঠক। অসাধারণ ছিল তাঁর স্মরণশক্তি। রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল তো বটেই, ইংরেজি কবিতা, গালিব, ইকবালের নানা উর্দু শের মুখস্থ ছিল। মুখস্থ ছিল সংস্কৃত নানা কবিতা। একদিন কথা প্রসঙ্গে শঙ্করাচার্যের মোহমুদগর থেকে আউড়াতে লাগলেন –
কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ।।
সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদের সংগ্রহ ছিল তাঁর কাছে। কলকাতার এক প্রকাশকের কাছ থেকে বইয়ের রয়্যালটির বদলে সংস্কৃত সাহিত্যভাণ্ডার নিয়ে এসেছিলেন। একদিন সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বললেন :
– সংস্কৃত সাহিত্যের পুরো কালেকশন আমার কাছে আছে। যা বলবে তুমি, আছে আমার কাছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বাৎসায়নের কামসূত্র, অশ্ব ঘোষের বুদ্ধচরিত, আর …
-এর হর্ষচরিত … এর নামটা আমি কিছুতেই মনে রাখতে পারি না।
– বানভট্ট।
– হ্যাঁ, বানভট্ট। বানভট্টের কাদম্বরী-ও আছে। অশ্ব ঘোষের বুদ্ধচরিত লেখা হয়েছিল কণিষ্কের সময়, সম্ভবত থার্ড সেঞ্চুরিতে আর বানভট্ট হর্ষচরিত লিখেছিল হর্ষবর্ধনের সময় সেভেনথ্ সেঞ্চুরিতে। হিউয়েন সাংয়ের সময়।
(অশ্বঘোষ কুশান সম্রাট কণিষ্কের সভাকবি এবং দ্বিতীয় শতাব্দীর লোক ছিলেন। আর সপ্তম শতাব্দীর বানভট্ট ছিলেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি।)
– মহাভারত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ইন্টারেস্টিং। সে তুলনায় রামায়ণ কিছুটা একঘেয়ে, বোরিং।
– মহাভারত আপনি কি রাজশেখর বসুর অনুবাদে পড়েছেন?
– রাজশেখর বসু পড়েছি আর কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদও পড়েছি। কালীপ্রসন্নের দুই ভলিউম আছে আমার কাছে। ভাষাটা যাকে বলে একটু বনেদি, আদি ভাষা কিন্তু ভাষাটা-খুব-সুন্দর। তবে কালীপ্রসন্নের দুই ভলিউম পুরোটা পড়িনি, জায়গায় জায়গায় পড়েছি। তবে মহাভারতের বারোটা বাজিয়েছেন প্রতিভা বসু। মহাভারতের ওপর বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, মহাভারতের কথা। তারপর প্রতিভা বসু আরেকটা বই লিখেছেন; নাম মহাভারতের মহারণ্যে। তাতে মেঘনাদবধ কাব্যে মাইকেল মধুসূদন রামের যে অবস্থা করেছেন, প্রতিভা বসু শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির এদের অবস্থা একই রকম করেছেন। পড়োনি? নামটা লিখে রাখো। দারুণ একটা বই!
– কালিদাসের মেঘদূত নিশ্চয়ই পড়েছেন?
– কালিদাসের মেঘদূত আমি পড়েছি প্যারীমোহন সেনগুপ্তের একটা ছন্দোবদ্ধ অনুবাদে। শুরুটা ছিল এভাবে :
যক্ষ নিজ কাজে করিলা অবহেলা কুবের তারে দিলা কঠোর শাপ
নির্বাসনে রহো ত্যজিয়া প্রেয়সীরে দ্বাদশ মাস সহো বিরহ তাপ।
– বুদ্ধদেব বসু মেঘদূত-এর একটা অনুবাদ করেছিলেন। আমি এটি কিনেছিলাম। কিনে বর্ধমানে নিয়ে এলাম। বর্ধমানে আমার এক বড় ভাই, তিনি বললেন, এটা আমাকে দিয়ে দাও। আমি উনাকে দিয়ে দিলাম। দ্বিতীয়বার আমি আর কিনিনি। সেই অনুবাদটা আর পড়া হয়নি।
তারপর আওড়ালেন কালিদাসের দেওয়া সুন্দরীর সেই এক বিখ্যাত চিরায়ত বর্ণনা :
তন্বী শ্যামা শিখরদশনা-পক্ববিম্বাধরোষ্ঠী
মধ্যে ক্ষামা চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা
নিম্ননাভিঃ।
যার অর্থ : সে তন্বী, সে শ্যামা, সুন্দর শিখরযুক্ত তার দাঁত, পাকা বিম্ব ফলের মতন তার ওষ্ঠ, তার কোমর সরু, তার দৃষ্টি হরিণীর মতো চঞ্চলা, গভীর তার নাভি।
– স্যার, আজ তবে উঠি।
– আরে এখনই উঠবে কেন? আরো কিছুক্ষণ বসো। আরেক পেয়ালা চা খাও।
– আজ যাই। শীঘ্রই আবার আসবো।
– তোমার ‘শীঘ্র’ তো সাঁওতালদের মাইলের মতো। সাঁওতালদের মাইলের গল্প জানো?
– না!
– সাঁওতালদের মাইল কতদূর বুঝতে হলে তোমাকে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে হাঁটতে শুরু করতে হবে। যতদূর যাওয়ার পর গাছের ডাল শুকিয়ে যাবে, ততদূর এক মাইল। তোমার শীঘ্র আসা হলো সেরকম।
দুই
বহুদিন আগে তাঁর মুখে শুনেছিলাম T. S. Eliot-এর The Love Song of J. Alfred Prufrock থেকে আবৃত্তি করতে। একদিন সেই কথা তুলতেই আবার বলে গেলেন :
Let us go then, you and I,
When the evening is spread out against the sky
Like a patient etherized upon a table;
Let us go, through certain half-deserted streets,
The muttering retreats
Of restless nights in one-night cheap hotels
And sawdust restaurants with oyster-shells:
Streets that follow like a tedious argument
Of insidious intent
To lead you to an overwhelming question …
Oh, do not ask, ‘What is it?’
Let us go and make our visit.
In the room the women come and go
Talking of Michelangelo.
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই শেক্সপিয়র পড়েছেন। স্কুলে থাকতে Hamlet-এর বিখ্যাত স্বগতোক্তি ‘To be or not to be, that is the question.’ আবৃত্তি করেছেন। Tennyson-এর কথা মনে করাতে Ulysses থেকে কিছু মনে আছে কি না জিজ্ঞেস করলে বললেন, ‘মনে নেই।’ কিন্তু Lotus Eater থেকে মনে পড়লো দু-লাইন। ‘Music that gentlier on the spirit lies,/ Than tir’d eyelids upon tir’d eyes; এসব ছিটেফোঁটা মনে পড়ছে।’ শেলীর প্রসঙ্গ এলে Ode to the West Wind থেকে ‘Oh! lift me as a wave, a leaf, a cloud!/ I fall upon the thorns of life! I bleed!’ – এই বিখ্যাত লাইনগুলো আউড়ে বললেন, ‘এই কবিতাটার প্রভাব পাওয়া যায় বর্ষশেষ কবিতায়। সেই আছে না ‘শ্যেনসম অকস্মাৎ ছিন্ন করি ঊর্ধ্বে লয়ে যাও/ পঙ্ককুণ্ড হতে’, বাকিটা মনে পড়ছে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যৌবনকালে শেলীর খুব ভক্ত ছিলেন।’
আমার মনে পড়লো রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে শেলী পড়াতেন। মুজতবা আলী তাঁর কাছে শেলী ও কিট্স পড়েছেন। ইউরোপীয় সাহিত্য নিয়েও আলোচনা হতো কখনো, – হুগোর আমি দুটো বই পড়েছি। একটা হচ্ছে লে মিজারেবল। আরেকটা বই পড়েছিলাম, যেটা সাধারণত পড়ে না লোকে, কীভাবে যেন পেয়েছিলাম, বইটার নাম হচ্ছে নাইনটি থ্রি। এটা ফরাসি বিপ্লবের ওপর লেখা। ফরাসি বিপ্লবের সময় গ্রামাঞ্চলে কী অবস্থা হয়েছিল তার ওপর লেখা। দেখো তো এটা সার্চ করে পাও কি না। (তখনই মোবাইল ফোনে সার্চ করে বইটির পিডিএফ পাওয়া গেল)। সব মনে নেই। ফরাসি সাহিত্যের মধ্যে ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি পড়েছি। পড়েছি … নানা। নানার লেখকের নামটা মনে পড়ছে না। [লেখক এমিল জোলা]। মোপাসাঁর গল্প অনেক পড়েছি, রম্যাঁ রলাঁর জাঁ ক্রিস্তফ। বাংলায় রম্যাঁ রলাঁর একটা বই পড়েছিলাম শিল্পীর নবজন্ম।
[I will not Rest সরোজ দত্তের অনুবাদ] গুস্তাভ ফ্লবেয়ার ছিলেন মোপাসাঁর গুরু।
– মাদাম বোভারি ইউনিভার্সিটিতে আমাদের পাঠ্য ছিল। এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কার্ল মার্কসের মেয়ে এলিনর মার্কস।
– তাই নাকি। সেটি মনে পড়ছে না।
– জি স্যার। আমি তাঁর অনুবাদই পড়েছি। জার্মান সাহিত্য কি পড়েছেন মনে আছে? গ্যেটে বা হাইনে।
– না হাইনের কবিতা পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। (গ্যেটের কথা সম্ভবত শুনতে পাননি, সেদিন পরে আর জিজ্ঞেস করাও হয়নি)।
বহু আগে একটি বইয়ের নাম করে একদিন বদরুদ্দীন উমরকে বলতে শুনেছিলাম যে, তিনি ঔপন্যাসিক হলে সেই উপন্যাসের মতো একটি উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করতেন। বইয়ের নামটি আমি ভুলে গিয়েছিলাম। একদিন এই কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, – এরকম বলেছিলাম নাকি? সেটি নিশ্চয়ই ইলিয়া এরেনবুর্গের ফল অফ প্যারী। দারুণ ইন্টারেস্টিং বই। পারীর পতন নামে এটি অনুবাদও হয়েছে বাংলায়। এতে ১৯৩৫ থেকে জার্মান দখলদারির মধ্যবর্তী সময়ে ফরাসি সমাজের ক্ষয় এবং অধঃপতনের বর্ণনা আছে। কন্টেমপরারি রাজনীতিকে, সমসাময়িক ইতিহাসকে এভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করার আর দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নাই। আমি ইলিয়াসকে (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) বাংলাদেশের সিচুয়েশনের ওপর এরকম একটা পলিটিক্যাল উপন্যাস লিখতে বলেছিলাম। এটি ইলিয়াসই লিখতে পারতো। আর কেউ পারতো না। রুশ সাহিত্যের মধ্যে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনিভ, চেখভ, লারমনটফ আর কি যেন নাম? আরে কবি …
– পুশকিন?
– হ্যাঁ পুশকিন। লারমনটফ আর পুশকিন দুজনই ডুয়েল লড়তে গিয়ে কম বয়সে মারা যান। তারপর নিকোলাই গোগল, গোর্কি, ইলিয়া এরেনবুর্গ। তারপর কোয়ায়েট ফ্লোউজ দ্য ডন-এর লেখকের নামটা মনে করতে পারছি না। … ‘এস’ দিয়ে নাম।
– ধীরে বহে ডন নামে বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। (লেখকের নাম আমারও মনে আসছিল না।)
– সলোকভ। হ্যাঁ মনে পড়েছে, সলোকভ।
– হ্যাঁ। মিখাইল সলোকভ।
– অক্সফোর্ডে থাকার সময় একবার সালাউদ্দিন ভাই (ইতিহাসবিদ সালাউদ্দিন আহমেদ) খবর দিলেন লন্ডনে সলোকভ আসবেন বক্তৃতা করতে। এটা ১৯৬০ সালে। আমি অক্সফোর্ড থেকে গেলাম। জহুর হুসেন চৌধুরী, সংবাদ-এর এডিটর, তিনিও ছিলেন। সালাউদ্দিন ভাই তাঁর, জহুর ভাইয়ের ও আমার জন্য টিকেট কেটে রাখলেন। গেলাম। ও মা! সলোকভ না এসে আরেকজন সাহিত্যিক এলেন ও বক্তৃতা করলেন! তবে তাঁর বক্তৃতার চেয়ে
যে-মেয়েটা অনুবাদ করেছিল তার কথাই ভালো লাগলো। সে সুন্দর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিল। দেখতেও সুন্দর ছিল আর একেবারে সাবলীল অনুবাদ করেছিল।
– টলস্টয়ের কী পড়েছেন স্যার?
– টলস্টয়ের পড়ার মধ্যে ওয়ার অ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, রিজারেকশন। টলস্টয়ের আর কী? ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়েছিলাম ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামে। আমি তখন সেখানে মাস্টারি করি। ইয়া মোটা বই – একুশশো-পৃষ্ঠার-বই।
– টলস্টয়ের ছোটগল্প আছে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ ছোটগল্প। টলস্টয়ের প্রথম পড়েছি ছোটগল্প। অনেক ছোটগল্প। দারুণ সব ছোটগল্প – একজন বড় ঔপন্যাসিক যে ছোটগল্প লিখতে পারে এরকম! রবীন্দ্রনাথ ওইরকম বড় ঔপন্যাসিক না হলেও খুব ভালো ছোটগল্প লিখেছিলেন। টলস্টয়ের ছোটগল্প দারুণ-সব-ছোটগল্প। তুর্গেনেভের একটি ছোট বই আছে। বইটার নাম হচ্ছে অন দ্য ইভ। এটা ১৮৬০-এর পটভূমিতে লেখা। টেরোরিজমের ওপর। লারমনটফের বই হলো হিরো অফ আওয়ার টাইম।
– গোর্কিকে কীভাবে দেখেন?
– গোর্কিকে দেখতে হলে তাঁর আত্মজীবনী পড়া দরকার। কত রকম দুষ্টুমি থেকে আরম্ভ। তারপর কত রকম স্ট্রাগল তাঁর জীবনে। তিন খণ্ড যা আছে। পার্টির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, মেম্বারও ছিলেন বোধহয় একসময়। যাই হোক আর্টিস্ট হিসেবে তিনি এদিক-ওদিক কিছু লিখতেন। এর জন্য লেনিন বকাবকি করতেন। একদিন একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কী একটা বিষয় নিয়ে লেনিন তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। তখন গোর্কি বললেন, ‘You know, we artists are irresponsible people.’
গোর্কি টলস্টয়ের ওখানে মাঝে মাঝে যেতেন, হাঁটতেন একসঙ্গে। গোর্কি বলেছেন, টলস্টয় দুটো বিষয়ে কথা বলতেন, একটা ম্যুজিক অর্থাৎ রাশান কৃষক। আরেকটা হলো মেয়েমানুষ। অতিরিক্ত মেয়েমানুষের কথা বলতেন।
তিন
টলস্টয় ১৯১০ সালের ২০শে নভেম্বর ৮২ বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রা হয়ে রাশিয়ার একটি রেলস্টেশনে মারা যান। এ সময় তাঁর ওভারকোটের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল আবদুল্লাহ সোরওয়ার্দির The Sayings of Muhammad। একদিন এই আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দির প্রসঙ্গ উঠলো :
– আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দি খুব পণ্ডিত লোক ছিলেন। তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। তিনি ছিলেন আমার মায়ের মামু। তাঁর বাবা অর্থাৎ আমার মায়ের নানা ছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল ওবাইদী। তিনি যখন হুগলি কলেজে অ্যাংলো-আরবির অধ্যাপক, সৈয়দ আমীর আলী তাঁর ছাত্র ছিলেন। ১৮৭০-এর দিকে ঠিক হলো মহসিন ফান্ডের টাকায় মাদরাসা হবে। তো তিনটি মাদরাসা হলো – একটি ঢাকায়, একটি চিটাগাংয়ে, একটি রাজশাহীতে।* (* ১৮৭৩ সালে মোহসীন ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা মাদরাসা (বর্তমান সরকারি কবি নজরুল কলেজ), চট্টগ্রাম দারুল উলুম মোহসিনীয়া মাদরাসা (বর্তমানে সরকারি মোহসীন কলেজ) ও রাজশাহী মাদরাসা (বর্তমানে রাজশাহী সরকারি মাদরাসা) প্রতিষ্ঠিত হয়।) ওবায়েদ উল্লাহ আল ওবাইদী ঢাকার মাদরাসার প্রিন্সিপাল হলেন। ঢাকার মাদরাসাটা ছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে। এখনকার কবি নজরুল কলেজ যে আছে সেই বিল্ডিংটাই। তিনি প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থাতেই মারা গেলেন। তাঁর আরেক ছেলে ছিলেন হাসান সোহরাওয়ার্দি। ওবায়দুল্লাহ আল ওবাইদী বড় ছেলে আমিন সোহরাওয়ার্দি ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। পিসি সরকার তাঁর ছাত্র ছিলেন। আমিন সোহরাওয়ার্দিরও কবর আছে ঢাকার লালবাগে। বাপ-বেটা দুজনেরই কবর আছে। একসময় একটা নামফলক ছিল।
* ওবাদুল্লাহ আল ওবাইদী নিজ চেষ্টায় ইংরেজি শিখেছিলেন। তিনি রামমোহন রায়ের ফার্সি গ্রন্থ তুহফাত-উল-মুওয়াহিদ্দীন ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। অতিসম্প্রতি জানতে পারলাম, তাঁর দসত্মান-ই-ইবরাতবার নামে ফারসি ভাষায় লেখা একটি আত্মজীবনী আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগে সংরক্ষিত রয়েছে। একজন বাঙালি মুসলমানের আনুমানিক দেড়শো বছর আগের লেখা আত্মজীবনী হিসেবে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে মনে করি। এর ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত।)
চার
বদরুদ্দীন উমর তাঁর নানা লেখায়, বক্তৃতায় ইতিহাস পাঠের গুরুত্বের ওপর নিরলসভাবে বলে গেছেন। বাংলাদেশে ও ভারতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন।
– এখন হিস্ট্রি পড়ে না তো লোকে। লিটারেচার আর হিস্ট্রি না পড়লে কীভাবে হবে?
– এখানে ইউনিভার্সিটিতে বা অক্সফোর্ডে আপনি কি হিস্ট্রি পড়েছেন?
– না। ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস আমার সাবজেক্ট ছিল না কখনো। তবে ইতিহাসে আমার বরাবরই আগ্রহ, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই। যদিও ইউনিভার্সিটিতে আমি ফিলোসফি নিয়েছি, ইতিহাস নিইনি। আমি ইতিহাস নিজে নিজে পড়েছি। আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি তখন পেলিকান সিরিজের বিস্তর বই আসত ঢাকায়। তখন একটাই ভালো বইয়ের দোকান ছিল। দোকানটার নাম ছিল ‘ওয়াসি ব্রাদার্স’। এই ‘ওয়াসি ব্রাদার্স’-এ যেতাম নিয়মিত আর কখনো কাজে লাগবে কি-না না ভেবে বই দেখলেই কিনে নিতাম। তখনই কিনেছিলাম গ্রিক ইতিহাসের বই হেরোডোটাসের হিসট্রিস, থুসিডিইডিসের পেলোপনেসিয়ায়ান ওয়ার, জেনোফনের মার্চ অফ দ্য টেন থাউসেন্ড-এর মতো বই। হোমারের ইলিয়াড, ভার্জিলের এনিড-ও কিনেছিলাম। হোমারের ইলিয়াড ওরাল ট্র্যাডিশন হিসেবে ছিল, মুখে মুখে ফিরত। রিটেন ভার্সন তৈরি হয়েছিল হাজার বছর পরে। রামায়ণ, মহাভারত-ও তাই। অনেক পরে লিখিত আকারে এসেছে। এর জন্য ইন্টারপলেশনের বা নানা কিছু ঢুকিয়ে দেওয়ার সুযোগ ছিল। তা গ্রিক মিথলজি মিথলজিই থাকল, কিন্তু ভারতে মিথলজি ইতিহাসে পরিণত হলো! কারণ ভারতীয়দের কোনো হিস্ট্রি নাই। মিথলজিই তাদের হিস্ট্রি। গ্রিসে মিথলজি ও ইতিহাস আলাদা ছিল। সেখানে মিথলজির চর্চা যেমন হয়েছে, তেমনি ইতিহাসের চর্চাও হয়েছে। তাদের সেন্স অফ হিস্ট্রি প্রথম থেকেই ছিল। ভারতে তেমন কিছুই ছিল না। ভারতে ইতিহাসের যেটুকু চর্চা হয়েছে সেটা আরবরা এসে করেছে। আধুনিক ভারতে যে ইতিহাস চর্চা হিন্দুরা শুরু করে, সেটি ইংরেজের অধীনস্থ হয়ে। ইংরেজরা যেভাবে বলেছে তারা সেইভাবে লিখেছে। সেটি একেবারেই ব্রিটিশের অনুগত ইতিহাস। এখন যে ভারতে ইতিহাস চর্চা হচ্ছে সেটা অন্যরকম। সেটা নিজের পায়ে দাঁড়ানো।
ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসও পছন্দ করতেন। দিল্লির ওপর লেখা উইলিয়াম ডালরিম্পলের দ্য সিটি অফ জিনস-এর খুব প্রশংসা করলেন একদিন। বললেন, ডালরিম্পলের দ্য হোয়াইট মোগল এবং দ্য লাস্ট মোগলও পড়েছেন। ডালরিম্পলের বইয়ের প্রসঙ্গ থেকে মোগল প্রসঙ্গ এলো। বললেন, – আমার কাছে ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি খুব ফ্যাসিনেটিং মনে হয়। তার মধ্যে মোগল হিস্ট্রির তুলনা নাই। মোগলদের ওপর বিস্তর কাজ হয়েছে, প্রথম ছয় মোগলের ওপর। পরবর্তী অন্য মোগলদের ওপর বিশেষ কাজ হয়নি। শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর একটা ক্রিমিনাল কাজ ছিল – ময়ূর সিংহাসন তৈরি করা। পুরো তাজমহল তৈরিতে যে ব্যয় হয়, তার তিন ভাগের এক ভাগের মতো অর্থ ব্যয় হয় এই ময়ূর সিংহাসন তৈরি করতে। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় এই অপচয়! শেষে তো নাদির শাহ লুট করে নিল।
তখন একটা বই পড়ছিলেন, নাম দাসত্মান-এ-গদর। বাংলা অনুবাদ পড়ছিলেন। বললেন, সিপাহি বিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আছে। বইয়ের লেখক জহির দেহলভী বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারের লোক ছিলেন।
– বাহাদুর শাহ তো সবসময় ইংরেজদের পক্ষে ছিলেন। বিদ্রোহের বিরুদ্ধে ছিলেন। এই বইয়ে বিদ্রোহের সময় লুটতরাজের বর্ণনা আছে। ইংরেজরা লুটতরাজ করেছে, সিপাহীদের লুটতরাজ করেছে। এই কথা বলে উর্দুতে বললেন, দিল্লি জো এক শহর থা আলম মে ইন্তিখাব
রহতে থে মুনতাখাব হি জহাঁ রোজগার কে
উসকো ফালক নে লুট কে ভিরান কর দিয়া
হম রহনে ওয়ালে হ্যাঁ উসি উজড়ে দিয়ার কে
দিলিস্ন তো ছিল এক শহর, জগতে অনন্য নির্বাচন,
যেখানে শুধু নির্বাচিতরাই জীবিকার জন্য বাস করত।
যে শহরকে আকাশ লুট করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে,
আমরাই তো সেই উজাড় ভূমির বাসিন্দা।
তাঁর ধারণা ছিল এই বিখ্যাত লাইনগুলো সিপাহি বিদ্রোহের ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষাপটে মির্জা গালিবের লেখা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই পঙ্ক্তিগুলো কবি মীর তকী মীরের, যিনি ১৮১০ সালে মারা যান। তিনি আঠারো শতকের শেষদিকে বারবার দিল্লি আক্রান্ত হওয়ার ও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হওয়া দেখে এই কথাগুলো লেখেন। এই মীরকে তাঁরই মতো একজন ওস্তাদ কবি বলে
স্বীকৃতি দিয়ে গালিব লিখেছেন :
রেখতে কে তুমহি উস্তাদ নেহিঁ হে গালিব
ক্যায়তে হায় আগলে যামানা মেঁ কোয়ি মীর ভি থা।
রেখতার (উর্দুর) কেবল তুমিই ওস্তাদ নও গালিব
লোকে বলে আগের যুগে মীর বলেও একজন ছিলেন।
সোহেলের মেয়ে ইনশা [নাতনি] আরেকটি বই পড়িয়েছিল The Last Queen। চিত্রা ব্যানার্জি দিভাকারুনির লেখা। এই বইটা রঞ্জিত সিংহের শেষ স্ত্রী জিনদানের ওপর। জিনদানের বাবা ছিলেন রঞ্জিত সিংহের ‘Kennel Keeper’। রঞ্জিত সিংহের কুকুরের দেখাশোনা করা তাঁর কাজ ছিল। তাঁর মেয়ে জিনদান ছিল অপূর্ব সুন্দরী। রঞ্জিত সিংহ বুড়ো বয়সে সেই মেয়েকে বিয়ে করেন। এই জিনদান চেষ্টা করেছিলেন তাঁর ছেলে দুলীপ সিংকে সিংহাসনে বসাতে, কিন্তু পারেননি। জিনদানের ওপর শাবানা আজমীর খুব উচ্ছ্বসিত কথাবার্তা আছে।
(রঞ্জিত সিং) (১৭৮০-১৮৩৮) ছিলেন শিখ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৮০১ থেকে ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত শিখ রাজ্য শাসন করেন। তাঁর কয়েক ডজন স্ত্রীর অন্যতম ছিলেন জিন্দ কাউর বা জিনদান। রঞ্জিত সিং ও জিনদানের পুত্র দুলীপ সিংয়ের ওপর ২০১৭ সালে দ্য ব্ল্যাক প্রিন্স নামে একটি সিনেমায় শাবানা আজমী ‘মহারানী জিনদান’-এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। শাবানা আজমী জিনদানকে ‘তেজস্বী’ ও ‘শক্তিশালী’ বলে বর্ণনা করেছেন, যিনি প্রতিকূল অবস্থায় থেকে এবং নিজের রাজ্য ও স্বামীকে হারিয়েও তাঁর ছেলে দুলীপ সিংকে তাঁর শিখ ঐতিহ্য এবং ব্রিটিশদের কাছ থেকে শিখ সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।)
– আফগান রাইটার খালেদ হুসেইনির দ্য কাইট রানার পড়েছো? খুব হার্ট-ওয়ার্মিং গল্প একটা।
বইটা আমার কাছে ছিল। তখনো পড়া হয়নি। বইটা দ্রুত পড়ে নিলাম। তার কিছুদিন পর একদিন তাঁর সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শুনি এর মধ্যেই খালেদ হুসেইনির আরো দুটো বই পড়ে ফেলেছেন – থাউজেন্ড সে্প্লনডিড সান এবং দ্য মাউন্টেইন ইকোস। সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য যে-কোনো বই হাতে পড়তেই পড়ে ফেলতেন। একদিন হাতে দেখলাম ঢাউস একটা বই, নাম Tawaifnama। আমি হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে বললেন,
– দেখো, কিন্তু তোমাকে দেবো না। এটা খোকন [আব্দুল কাইয়ুম খোকন, চিত্রনির্মাতা] ধার দিয়েছে। তুমি পরে ওর থেকে নিয়ো।
পাঁচ
রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর কেবল ব্যাপক পড়াশোনাই ছিল না, তিনি ছিলেন রবীন্দ্র-সাহিত্যের এক ভক্ত পাঠক। তবে কিছু বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সমালোচনাও যে করতেন না, তা নয়। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র-সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে। নানা কবিতা মুখস্থ শুনিয়েছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমরা বিসত্মারিত কোনো আলোচনায় যাচ্ছি না। এই আলোচনা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক।
ফারসি সাহিত্যের মধ্যে হাফিজ, রুমি, ওমর খৈয়ামের কবিতার কথা উঠতো কখনো।
– ওমর খৈয়ামের অনুবাদ বাংলায় প্রথম করেছিলেন কান্তিচন্দ্র ঘোষ। নজরুলও করেছেন। আর করেছেন নরেন্দ্র দেব। নরেন্দ্র দেবকে দেখেছিলাম একবার – চুয়াত্তর সালে – সাহিত্য সম্মেলন হয়েছিল সেই সময়। নরেন্দ্র দেব আর তাঁর স্ত্রী রাধারানী। তাঁরা আবার ছিলেন অমর্ত্য সেনের প্রথম স্ত্রীর পিতা-মাতা। অমর্ত্য সেনের প্রথম স্ত্রীর নামটা যেন কী ছিল? কিছুদিন আগে মারা গেলেন …
– নবনীতা দেবসেন।
– হ্যাঁ! হ্যাঁ! নবনীতা দেবসেন। নরেন্দ্র দেব ও রাধারানী ছিলেন তাঁর বাবা-মা।
হাফিজ খুব পছন্দ করতেন। বলা বাহুল্য তুর্কি রমণীর গালের তিল নিয়ে লেখা হাফিজের সেই বিখ্যাত শেরটি অনেকবার আওড়াতে শুনেছি :
আগর আন তুর্কে শিরাজি বে দাস্ত আরাদ দেলে মারা
বে খালে হেন্দুইয়াস বাখশাম সমরখন্দ ও বোখারা-রা
সেই শিরাজি তুর্কি নারী যদি আমার হৃদয় তার হাতে নেয়
তাঁর গালের একটি তিলের জন্য সমরখন্দ ও বোখারা বিলিয়ে দেবো।
আমি আমার অতি সীমিত জ্ঞান নিয়ে হয়তো বলতাম,
শবি আগর লবে ইয়ার বোসমে তলবম্
জোয়ান শওম –
এর বাকিটা তিনিই বলতেন,
জসেরো জিন্দেগি দুবারা কুনম
আজি এ নিশীথে প্রিয়া অধরেতে চুম্বন যদি পাই
জোয়ান হবো –
গোড়া হতে তবে এ-জীবন দোহরাই।
(সুশীল পাঠক দেশে বিদেশে দেখুন)
– ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবি হওয়ার খুব শখ ছিল। তিনি হাফিজের অনুবাদ করেছিলেন। জানো তো?
– জি স্যার। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ওমর খৈয়ামও অনুবাদ করেছেন।
– শহীদুল্লাহর হাফিজের অনুবাদ পড়ে ফররুখ আহমেদ লিখেছিলেন, ‘হাফিজে মারিয়া শহীদুল্লাহ হইল কবি?’
– ফররুখ আহমদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল?
– হ্যাঁ। ফররুখ আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। আমি যখন ইসলামি লাইন পরিত্যাগ করলাম তখন ফররুখ ভাই আমার উপর ভীষণ চটেছিলেন। কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পাওয়ারফুল কবি ছিলেন। তাঁর কোনো স্থান হলো না এদেশে। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর মূর্খতার কারণে তাঁর কোনো স্থান হলো না।
ছয়
বদরুদ্দীন উমর পাঁচ খণ্ড আমার জীবন নামে আত্মজীবনী লিখেছেন। তিনি দেশি-বিদেশি, পুরনো ও সমসাময়িকদের আত্মজীবনী পড়তেন অনেক আগ্রহ নিয়ে।
– কত আত্মজীবনী আছে! আমি আত্মজীবনীতে খুবই ইন্টারেস্ট পাই।
– দুয়েকটা উদাহরণ দিন।
– যেমন নাইন্টিন সেঞ্চুরিতে, ধরো দেওয়ান কার্তিক চন্দ্র রায়ের আত্মজীবনী আছে।
– ডি এল রায়ের বাবা। এটিই বোধহয় বাংলায় প্রথম আত্মজীবনী।
– হ্যাঁ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা। এরপর আছে শিবনাথ শাস্ত্রীর, মীর মশাররফ হোসেনের খানিকটা। দেবেন ঠাকুরের আছে।
– বিপিন পালেরও আছে।
– বিপিন পালেরটা পড়েছি। বিদ্যাসাগর তো আরম্ভ করে ছেড়ে দিয়েছেন। কয়েক পাতা লিখেছেন।
– রাজনারায়ণ বসুর আত্মজীবনী আছে।
– হ্যাঁ। রাজনারায়ণ বসুর আমার জীবন-চরিত। রাজনারায়ণ বসু খুবই ট্যালেন্টেড লোক ছিলেন। কিন্তু নিজে ব্রাহ্ম হলেও হিন্দু জাতীয়তাবাদী ছিলেন। আত্মজীবনীতে বলেছেন, হিন্দুরা আলাদা জাতি! সমাজের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজের কোনো শিখর ছিল না। এরকম ক্লাস-রিলিজিয়ন আর কিছু নেই। সৈয়দ শাহেদুল্লাহ এজন্য লিখেছেন যে, ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা ফিটনে করে যেতে যেতে ধর্ম আলোচনা করতেন, কিন্তু ফিটনের যে গাড়োয়ান তাকে ব্রাহ্ম করার চিন্তা তাদের কখনো ছিল না। কোনো গরিব ব্রাহ্ম ছিল না। এটি ছিল এক মিডল্-ক্লাস রিলিজিয়ন। এজন্য তাঁরা হিন্দু ধর্মের কাঠামো থেকে বেরোতেই পারেননি। হিন্দু ধর্মের যত সংস্কার, যেমন গরু না খাওয়া ইত্যাদি মেনে চলতেন। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ অবশ্য গরু খেতেন। তাঁর ছেলের লেখা বই On the Edges of Time-এ আছে যে, একবার লন্ডনে এক হোটেলে থাকার সময় তিনবেলা গরুর গোস্তের রোস্ট-টোস্ট এগুলো খেতেন। আমার বাবা রবীন্দ্রনাথ [অনুবাদক কবির চান্দ] বইটা পড়ে রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা হলো। আমার ধারণা ছিল একটা অগামার্কা লোক। কিন্তু সে অগামার্কা লোক ছিল না। সে লেখাপড়া জানা লোক ছিল। সমর সেনের আত্মজীবনী আছে বাবু বৃত্তান্ত। আমাকে সমর সেন দিয়েছিলেন। খুব ছোট। তবে এর সঙ্গে আগের কিছু লেখা যোগ করে পুলক চন্দ একটা এডিশন বের করেছেন। ভালো এডিশন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের পাঁচ খণ্ড আত্মজীবনী। ইয়া মোটা মোটা পাঁচ খণ্ড পড়েছি। এর যে ক্যানভাস তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমার আত্মজীবনীর চেয়ে অনেক ভালো আত্মজীবনী লেখা হয়েছে বাংলা ভাষায়। কিন্তু আমার আত্মজীবনীর মতো ক্যানভাস আর নাই। লিখলাম তো কিন্তু কোনো খবর নাই। ভারতে বের করেছে তিন খণ্ড। সেটা কিছু বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এখানে খবর নাই।
সাত
জীবনের শেষ দিকেও বদরুদ্দীন উমর প্রচুর বাংলা উপন্যাস পড়তেন। বলতেন যে, একটা সমাজকে জানার জন্য ফিকশন, উপন্যাস পড়া জরুরি।
– বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম ঔপন্যাসিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। একজন পাওয়ারফুল ঔপন্যাসিক। আমার মতে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কপালকুণ্ডলা। কিন্তু ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁকে যত বড় বলা হয় তিনি তত বড় ঔপন্যাসিক নন। বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছেন তারাশঙ্কর। তাঁর গণদেবতা, ধাত্রী দেবতা পঞ্চগ্রাম, হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, আরোগ্য নিকেতন। আরো আছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ। তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন দারুণ সুন্দর একটা বই। তাঁর ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে ছায়াপথ। ছায়াপথ-এ তারাশঙ্কর মোগলদের ভেতরের ব্যাপার, তাদের মেয়েদের ব্যাপার ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন। এসব বিষয়ে দারুণ আরেকটি বই পড়েছি – ডটার অফ দ্য সান – ইরা মুখতির। দারুণ বই একটা। তাঁর আরেকটা বই আছে, আকবর দ্য গ্রেট মুঘল।
– আপনি অনেকদিন আগে আমাকে বলেছিলেন আপনি খুব স্লো রিডার।
– হ্যাঁ। আমি খুব সেস্না রিডার, যাচ্ছেতাই রকম স্লো। আমি একটা বই পড়ার পরে ঘুরে আবার পড়ি। যেমন এই ডটার অফ দ্য সান আগে একবার পড়েছি, আবার পড়ছি। সিটি অফ দ্য জিনস একবার পড়ার পর উল্টেপাল্টে আবার পড়ছি।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আলোচিত ও সেরা লেখাগুলোর অনেকগুলোই পড়তেন, তরুণদের লেখা পড়ে ভালো লাগলে বলতেন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জানাশোনা ছিল তাঁর। হাসান আজিজুল হক তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলেন। শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রাজনৈতিক চিন্তার দিক দিয়েও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বহুদিন আগে একবার শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন সম্পর্কে বলেছিলেন যে, বইটি পাঠককে অতীতের সময়ে transport করতে পারে। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পের প্রশংসা করতেন। উপন্যাসের মধ্যে আগুনপাখি পছন্দ করলেও সাবিত্রী উপাখ্যান-এর সাহিত্যমূল্য সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্পের চেয়ে উপন্যাসকে বেশি গুরুত্ব দিতেন – বিশেষত চিলেকোঠার সেপাই-কে। এজন্যই মনে করতেন, ফল অফ প্যারীর মতো উপন্যাস একমাত্র ইলিয়াসই লিখতে পারবেন। মঞ্জু সরকারকে একজন শক্তিমান কথাসাহিত্যিক বিবেচনা করতেন। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে একদিন বলেন,
– হুমায়ূন আহমেদ আমানতের খেয়ানত করেছে। কথক হিসেবে তার যে ক্ষমতা, সে যদি ভালোভাবে সাহিত্যচর্চা করতো তবে অনেক বড় লেখক হতো। সেটা না করে, সে নিজে পরিষ্কারই বলেছে সে টাকার জন্য লেখে। সে তার প্রতিভাটা টাকার পায়ে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি যা বলেছি তার ভালোর জন্যই বলেছি, তার দুর্নাম করিনি। কিন্তু সে ভালোভাবে নেয়নি। হুমায়ূন আহমেদ আমার সম্পর্কে বলেছিল, ‘উনি আমার সম্পর্কে বলেন; আমার বই তো লাখ লাখ বিক্রি হয়, উনার বই তো পোকায় কাটে।’ আমি বলি, এটা তো এদেশের দুর্ভাগ্য যে হুমায়ূন আহমেদের বই লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়, আর বদরুদ্দীন উমরের বই পোকায় কাটে। আবার তসলিমা নাসরিন এক জায়গায় লিখেছে, ‘সকলেই আমার লেখার প্রশংসা করেন, ব্র্যাকেটে লিখেছে – এক বদরুদ্দীন উমর ছাড়া।’
আট
১৮৬৯ সালে বর্ধমানে ম্যালেরিয়ার প্রচণ্ড প্রাদুর্ভাব দেখা গেল। বিদ্যাসাগর ছোটলাটকে চিঠি লিখলেন ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু নিজে হাত গুটিয়ে বসে রইলেন না। তিনি বর্ধমানে একটি দাতব্য ঔষধালয় খুললেন। এখান থেকে রোগীদের ওষুধ দেওয়া হতো। যারা ওষুধ নিতে আসতে পারতো না, বিদ্যাসাগর জাত-ধর্ম নির্বিশেষে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ পৌঁছে দিতেন।
– বর্ধমানে কিছু মাড়োয়ারি জমিদার ছিল। বংশগোপাল ক্ষেত্রী নামে একজন বড় জমিদার ছিলেন। বর্ধমানে ম্যালেরিয়ার সময় বিদ্যাসাগর তাঁর কাছ থেকে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন দাতব্য ঔষধালয় করার জন্য। পরে আমার আববার নানা নবাব আব্দুল জববার বংশগোপাল ক্ষেত্রীর কাছ থেকে সেই বাড়ি কিনে নেন। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম হয়েছিল।
বিদ্যাসাগরের স্মৃতিধন্য বাড়িতে জন্ম নেওয়া বদরুদ্দীন উমর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ নামে বই লিখে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চার পথিকৃৎ হয়েছিলেন।
– কলকাতার বিদ্যাসাগর চর্চা কেন্দ্রের সমন্বয়ক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, বিদ্যাসাগর শেষ বয়সে কর্মাটারে যে একটা বাড়ি কিনেছিলেন সেটি নাকি খুঁজে দিয়েছিলেন নবাব আব্দুল জববার, যিনি সাঁওতাল পরগনায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।
– সেটা আমার জানা নেই। তবে তাদের মধ্যে জানাশোনা অবশ্যই ছিল।
নয়
একদিন নিজে থেকেই বললেন :
– এখন আবার কোরান পড়ছি। আল-বাকারা থেকে আরম্ভ করে সব প্রথম থেকে পড়লাম। এর বিরাট অংশ জুড়ে আল্লাহর সৃষ্টি আর ক্ষমতার কথা। অনেকদিন আগে কোরান পড়েছিলাম। অনেক মুখস্থও ছিল। যেমন সুরা লোকমান, সুরা বাকারা, বাকারার শেষদিকটা। রায়টের সময় মুসলমানরা খুব পড়ত এটা –
মা-লা-তা-কাতা লানা-বিহি ওয়াফু আন্না-ওয়াগফিরলানা-ওয়ারহামনা-আনতা মাওলা-না-ফানসুরনা-আলাল কাওমিল কা-ফিরিন।
অনুবাদে কোরান সুখপাঠ্য না হলেও মূল কোরানের কাব্যগুণ খুব বেশি।
এই বলে সুরা আর-রাহমান থেকে বলে গেলেন বেশ কয়েক লাইন :
আর রাহমান-আল্লামাল কোরআন-খালাকাল
ইনসান-আল্লামাহুল বায়ান – … ফাবি আইয়ে আলা-ই রাবিব কুমা তুকাজ্জিবান। এর যে একটা rhythm ও ভাষা তা অপূর্ব। আকবর মূর্খ ছিল। একেবারে যাকে বলে নিরক্ষর। হুমায়ুন তাঁকে লেখাপড়া শেখানোর বহু চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। হজরত মুহাম্মদ (সা.) তো সেরকম নন। তিনি ছিলেন কুরাইশ বংশের একজন ছেলে। তাঁকে তাঁর চাচা, দাদো লেখাপড়া শেখাবেন না – এ কী করে হতে পারে? তাছাড়া তিনি হজরত খাদিজার ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। একজন সম্পূর্ণ নিরক্ষর লোক কীভাবে এই দেখাশোনা করতে পারেন?
বাইবেলও পড়লাম। ওল্ড টেস্টামেন্ট, নিউ টেস্টামেন্ট। পুরো না। জেনেসিস, এক্সোডাস, নিউ টেস্টামেন্টে ক্রাইস্টের গল্প, নানারকম আজগুবি কথাবার্তা। তবে বাইবেলটা সুখপাঠ্য। বাইবেলের কিং’স জেমস ভার্সনটাই সবচেয়ে ভালো। গান্ধী ইংরেজি শেখার জন্য বাইবেল পড়তে বলতেন।
দশ
পেইন্টিং সম্পর্কে মাঝে মাঝে কথা বলতেন। একদিন এ-বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলেন,
– আমি পেইন্টিং দেখেছি অনেক, কিন্তু পেইন্টিং সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। পেইন্টিং আমার ভালো লাগে কিন্তু পেইন্টিং নিয়ে আলোচনার করার মতো জানাশোনা আমার নাই। এই সামান্য জানাশোনা। এটা খুব অবাক লাগে, মোগলদের সময় এখানে পেইন্টিংয়ের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। আকবর থেকে আরম্ভ করে তারপর জাহাঙ্গীর, শাহজাহানের সময়। তাঁদের মিনিয়েচার পেইন্টিং ছিল। পারসিক পেইন্টিংয়ের ট্র্যাডিশনই এখানে মোগলদের মধ্যে এসেছিল। মিনিয়েচার পেইন্টিংয়ের রাজপুত স্কুল, ডেকান স্কুল এসব ছিল। তাদের sense of perspective ছিল আলাদা। ইউরোপিয়ান perspective-এর চেয়ে পারসিক বা মোগল perspective ছিল একদম আলাদা। দূরত্ব বোঝানোর জন্য ওদের যে কায়দা সেটা পশ্চিমের টেকনিকের মতো নয়। মোগলদের হলো, যত ওপর দিকে উঠবে, তত দূরত্ব বাড়বে। এটা তো অন্য পেইন্টিংয়ে নেই। ওয়েস্টার্ন পেইন্টিংয়ে ডেপথ্টা অন্য রকম বোঝা যায়। আমি ইউরোপের যত জায়গায় গেছি – লন্ডন, প্যারিস, হামবুর্গ, বার্লিন, হাইডেনবার্গ, আমেরিকায়, সমস্ত জায়গায় আমি মিউজিয়াম দেখেছি। আমি দুনিয়ার অনেক বিখ্যাত পেইন্টিং দেখেছি। পিকাসোর গোয়ের্নিকাটা দেখিনি। এটা স্পেনে আছে। কিন্তু যাকে connisseur (সমঝদার) বলে আমি তা নই। ভালো লাগে কিন্তু বুঝি না। আমি গানও বুঝি না। গান আমার ভালো লাগে খুব। গান শুনি অনেক। গানের ভক্ত হিসেবে এক ধরনের সমঝদার। কিন্তু গানের গ্রামার জানি না। ছবিরও গ্রামার জানি না। কিন্তু ভালো লাগে। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ হয়তো বুঝতে পারি। কিন্তু মান যাচাই করতে পারি না।
– সিনেমা?
– অনেক ভালো সিনেমা দেখেছি। হলিউডের। তারপর জার্মান ছবি। ইতালিয়ান ছবি, গ্রিক ছবি, রাশান ছবি। আগেকার দিনে হলিউডে এত ভালো ছবি হতো সব! হলিউডের যত নায়ক নায়িকা এখন পর্যন্ত তাদের সবার
নাম-চেহারা মনে আছে। গ্রেটা গার্বো ও চার্লস বোয়ারের একটা দারুণ ছবি ছিল কনকুয়েস্ট। এটার গল্পটা হলো – এক পোলিশ প্রিন্সেস ছিল, ভালেভস্কা। নেপোলিয়ন তার প্রেমে পড়েছিল। তারই গল্প। চার্লস বোয়ার নেপোলিয়নের চরিত্রে অভিনয় করেছিল। দারুণ অভিনয়! আরো কত ছবি যেমন, স্যামসন অ্যান্ড ডেলাইলা, রেবেকা, গন উইথ দ্য উইন্ড, সিজার অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা, গ্রেটা গার্বোর আনা কারেনিনা, রাশান ছবি ওয়ার অ্যান্ড পিস, ক্রেইনস আর ফ্লাইং, আইভান হো, ফল অফ বার্লিন। বলে শেষ করা যাবে না। রাশান বিখ্যাত পরিচালক কি নাম যেন?
– আইজেনস্টাইন?
– হ্যাঁ। আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন, অক্টোবর দেখেছি। অনেক ছবি দেখেছি। নাম মনে পড়ছে না। আগে ঢাকাতে সকল সিনেমা আসতো। এসব ছবির বেশিরভাগই ঢাকার হলে দেখা। এখন তো ভালো ছবি আসে না; লোকে যা-তা ছবি দেখে। এসব ছবি পঞ্চাশের, ষাটের দশকে দেখা। বেশিরভাগ ছবি পঞ্চাশের দশকে দেখা, যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম। তখন সিনেমা দেখতাম খুব।
– বাংলাদেশের ছবি?
– দেখেছি কিছু। সূর্য দীঘল বাড়ি দেখেছি, আলমগীর কবিরের ছবি দেখেছি এক-আধটা, ধীরে বহে মেঘনা। আলমগীর কবিরের সঙ্গে আমার ভালো জানাশোনা ছিল। জীবন থেকে নেয়া দেখেছি। মোটামুটি ভালো ছবি। এখন নাটক তো উঠেই গেল। নাটক শেষ হয়ে গেছে। সব নাটকের লোকেরা শেষ হয়ে গেছে।
– ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে তো আপনার পরিচয় ছিল?
– হ্যাঁ ! ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ঋত্বিক ঘটক আমার বিদ্যাসাগরের বইটা পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমাকে বলেন, ‘কী মুনশিয়ানা মশাই আপনার।’
– মৃণাল সেনের সঙ্গে পরিচয় ছিল?
– না। মৃণাল সেন বা সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তবে তাদের ছবি দেখেছি। উৎপল দত্ত অভিনীত মৃণাল সেনের ছবি ভুবন সোম দেখেছিলাম। ছবিটা খুব ভালো লেগেছিল। খুব সুন্দর ছবি।
উৎপল দত্ত অভিনীত সত্যজিৎ রায়ের শেষ ছবি আগন্তুক-এর প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘ছবিটার শেষ দিকে দারুণ সুন্দর একটা সাঁওতালি নাচ আছে।’
– সিনেমার লোকের মধ্যে আমার পরিচয় ঋত্বিক ঘটক আর উৎপল দত্তের সঙ্গে। উৎপল দত্ত সেই বাহাত্তর সালে আমাকে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিলেন। তারপর দেখা-টেখা হয়েছিল। আর আমাদের বন্ধুমহলের মধ্যে ছিল পূর্ণেন্দু পত্রী। একটা ফিল্ম করেছিল স্ত্রীর পত্র। সে ছিল আমাদের বর্ধমানের উমার স্বামী। সুরাইয়া (সুরাইয়া উমর) আর উমা পড়তো একসঙ্গে। শিল্পী ছিল, পেইন্টার।
– কবিও। তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই কথোপকথন।
– হ্যাঁ। ওর বইও আছে। বাংলা সিনেমায় আমার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে ছবি বিশ্বাস। ছবি বিশ্বাসকে দেখতেই ভালো লাগে। ছবি বিশ^াসের তুলনা নাই কোনো।
এগারো
একজন পিএইচ.ডি শিক্ষার্থী উমর স্যারের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছেন। তিনি উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমানের মূল্যবোধের উপর কাজ করছিলেন। বদরুদ্দীন উমর তাঁকে বললেন,
– এখানে বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় চিন্তার ব্যাপারে হিন্দু ধর্মীয় চিন্তাটা খেয়াল রাখতে হবে। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা করা যাবে না। এখানে বাঙালি মুসলমানরা গভীরভাবে হিন্দু কালচার ও রিলিজিয়ন দ্বারা প্রভাবিত। এরকম বিশেষ দেখা যায় না। ইন্ডিয়ার অন্য কোনো জায়গায়ও এটা নাই, পাঞ্জাবে ইউপিতে এসব জায়গায়।
ধর্ম বলতে কেবল কোরান, হাদিস বোঝায় না। তার সামগ্রিক একটা সাংস্কৃতিক চরিত্র আছে। রিলিজিয়নের ব্যাপারে দুটো জিনিস দেখতে হবে, একটা হলো texual religion আরেকটা হচ্ছে সামাজিক ধর্ম। দেখা যাবে এখানে সামাজিক আচার-বিচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ফারাক খুব কম। যেমন বিবাহ ইত্যাদি উৎসবের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়, সেই মাছ পাঠানো থেকে সবই এসেছে হিন্দু কালচার থেকে।
বখতিয়ার খিলজি আসার পর এখানে যারা মুসলমান হয়েছিল তাদের অনেকেই মুসলমান হয়েছিল বৌদ্ধ থেকে। আগে বাংলাদেশে বৌদ্ধ বেশি ছিল হিন্দুদের চেয়ে। ব্যাপকভাবে বৌদ্ধরা মুসলমান হয়েছিল। বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হওয়ার জন্যেই মুসলমানদের হিন্দুরা ‘নেড়ে’ বলতো। ‘নেড়ে’ মানে মাথা ন্যাড়া। বৌদ্ধরা মাথা ন্যাড়া করতো। সেই থেকে ‘নেড়ে’। এদের বেশিরভাগই ছিল নিম্ন শ্রেণির হিন্দু এবং বৌদ্ধ। কিন্তু মুসলমান হয়েছে বলে তারা তো তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি বদলে ফেলতে পারে না। সেসব তো রয়ে গেল। একটা গল্প আছে বলি, যখন খ্রিষ্টান পাদরিরা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করতে থাকলো, তারা বিহারের সাঁওতাল পরগনায়ও প্রচার করতে লাগলো। সেখানে এক পাদরি সাহেব এক এলাকায় সাঁওতালদেরকে খ্রিষ্টান করলেন। সাঁওতালরা ক্রিশ্চিয়ান হয়ে গেল। পাদরি সাহেব খুব খুশি হয়ে চলে এলেন। কিছুদিন পরে তিনি আবার দেখতে গেলেন কী অবস্থা। গিয়ে দেখলেন তারা বোংগা পূজা করছে। সাঁওতালরা দেবতাকে বলে বোংগা। এ দেখে পাদরি সাহেব বললেন, ‘এ কী ব্যাপার! আমি তোমাদের খ্রিষ্টান করে গেলাম আর তোমরা এখন আবার বোংগা পূজা করছো?’ তখন সাঁওতালরা আশ্চর্য হয়ে তাঁকে বলে, ‘কি বলছিস তুই! খিরিস্টান হয়েছি বলে কি ধম্মো-কম্মো ছেড়ে দেবো?’
একদিন খুব আক্ষেপ করে বললেন, ‘একটা ভালো সমাজ হলে খারাপ লোককে সেই ভালো সমাজ ভালো করে। যেমন রাশিয়ায় হয়েছিল। আরেকটা খারাপ সমাজ হলে ভালো লোককে সেই সমাজ খারাপ করে দেয়। বাংলাদেশ হচ্ছে এরকম একটা সমাজ। এই সমাজে মানুষের পক্ষে ভালো থাকা খুব মুশকিল। মানুষকে চারিদিক থেকে প্ররোচিত করা হয় খারাপ হওয়ার জন্য। বাংলাদেশে যারা ভালো লোক ছিল, ধরো সেই ষাটের দশকে, বাংলাদেশ তাদের সবার চরিত্র হরণ করে শেষ করে দিলো। সব খারাপ হয়ে গেল।’
১২
সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে ইংরেজিতে In a Land Far From Home নামে অনূদিত হয়েছে। অনুবাদ করেছেন নাজেশ আফরোজ। বদরুদ্দীন উমর দেশে বিদেশে খুব পছন্দ করতেন। ইংরেজি অনুবাদটারও তিনি প্রশংসা করেছেন। অনুবাদক নাজেশ আফরোজ সম্পর্কে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হন। একদিন বললেন, দেশে বিদেশে তিনি চারবার পড়েছেন। তিনবার বাংলায় আর একবার ইংরেজি অনুবাদটি। সেদিন তাঁর কাছ থেকেই আমি জানলাম যে, নাজেশ শবনম-এরও অনুবাদ করেছেন। বললেন, শবনম তিনি পড়েননি। জিজ্ঞেস করে জানলাম হিটলার-ও পড়েননি। তাঁর ৯৩তম জন্মদিনে আমি তাঁকে শবনম ও হিটলার উপহার দিয়েছিলাম। বাদশাহ আমানুল্লাহ যখন আফগানিসত্মানের শাসক তখন সৈয়দ মুজতবা আলী কাবুলে ছিলেন। এসময় বাচ্চায়ে সাকাও নামের এক উগ্রপন্থী উপজাতি সর্দার বাদশাহ আমানুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে কয়েক মাসের জন্য আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। দেশে বিদেশে-তে সেই সময়ের আফগানিস্তানের অনবদ্য বর্ণনা আছে। বদরুদ্দীন উমর অসুস্থ হওয়ার পর যে দুদিন ইউনাইটেড হাসপাতালে তাঁকে দেখতে যাই তখন কথাবার্তা ভালোই বলছিলেন। দ্বিতীয় দিন হাসপাতালের কেবিনে দেখা করতে গেলে তিনি সেদিনের দৈনিক যুগান্তর পত্রিকাটা তাঁর হাতে দিতে বললেন। পত্রিকা দিলে ভেতরের পাতায় এক তরুণ নেতার ছবি দেখিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘মনে হচ্ছে সে বাচ্চায়ে সাকাও হতে চায়।’ এটিই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ আলাপ।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.