অ্যামি জিরালডাইন স্টকের কবিতা

ভাষান্তর : কাজল বন্দ্যোপাধ্যয়

আইরিশ মা-বাবার পরিবারে অ্যামি জিরালডাইন স্টক ১৯০২ সালের ২২শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেন, অক্সফোর্ডে। বন্ধুবান্ধবের কাছে তিনি ডিনা আর আত্মীয়-বান্ধবের কাছে অ্যামি জিরালডাইন নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বাবা পেমবোর্ক কলেজের স্নাতক ছিলেন; কিন্তু অক্সফোর্ডে পড়াতেন। পড়াতেন ক্ল্যাসিকস। বিশেষ আগ্রহ ছিল একটি বিব্লিক্যাল কনকর্ড্যান্স প্রণয়ন করাতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এর প্রকাশনা স্থগিত হয়ে যায়, পরে তা হারিয়ে ফেলে তার মুহূর্তকে। তার বাবা প্রবল স্বাধীনচিত্ত ছিলেন, এবং অক্সফোর্ডে থাকাকালে উচ্চতর অ্যাকাডেমিক পদে যাননি।

কন্যা অ্যামি স্টক অক্সফোর্ডে অধ্যয়নকালেই প্রবলভাবে যুক্ত হন উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলনে। সে-সময়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র ইউরোপীয় যিনি ভারতবর্ষের প্রতি তাঁর তীব্র আগ্রহ নিয়ে অক্সফোর্ডের উপনিবেশবাদবিরোধী ছাত্র সংগঠন ‘অক্সফোর্ড মজলিস’-এ  যোগ  দিতেন,  রোববারের  সন্ধ্যাগুলোতে,  কখনো বক্তৃতাও করেছেন।

ব্রিটিশ এবং ভারতবর্ষীয় – উভয় তরফেই অ্যামির বন্ধু ছিল, যাঁদের তিনি বলেছিলেন যে, স্বাধীনতা পেলে তিনি ভারতে পড়াতে যেতে আগ্রহী। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতনের শিকার অন্য মানবগোষ্ঠীতেও অ্যামির আগ্রহ ছিল।

১৯৪৭-এ টাইম্স লিটারেরি সাপ্লিমেন্টে দুটো নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়। একটি উগান্ডার ম্যাকারেরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির প্রভাষক পদের জন্য। অপরটি পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপক পদের। দুটোর জন্যেই অ্যামি স্টক আবেদন করেন। বাস্তবে শেষ অবধি চলে এসেছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তাঁর আগ্রহ এবং সংযোগ ছড়িয়ে যায় শিক্ষকতাসহ সবকিছুতেই – কর্মচারীদের ধর্মঘট, ছাত্র-কর্মকাণ্ড, সহকর্মীদের চিন্তাভাবনা-সাহিত্যকর্ম ইত্যাদিতে। এরই কোনো পর্যায়ে তাঁর গদ্য-পদ্য লেখা বেরোয় খান সারওয়ার মুরশিদ-সম্পাদিত নিউ ভ্যালুজে। এখানে পত্রস্থ হলো সেই সাময়িকীতেই প্রকাশিত তাঁর কটি কবিতা, যাতে প্রস্ফুট তাঁর গভীর-বাম রাজনৈতিক চেতনা আর সংবেদন। এই কাব্যানুবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে অ্যামি জিরালডাইন স্টকের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। – অনুবাদক 

শিশু

উইলিয়াম সৌটার

জীবনের অজেয় জানুদেশে

অত্যাচারী আদালতের আদেশে

কোনো গর্ভনাশ হয় না,

জয়ী শিশু কেঁদে ওঠে।

দাঙ্গা আর আর্তনাদে,

রাষ্ট্রের রণকৌশলে কেন্দ্রীভূত

আগামীকালকে সে তার বাহুতে ধরে

হেরোডীয় ঘৃণার ঊর্ধ্বে।

পূর্ণ শাখায়

সে উৎসগীত কিশলয়,

এপ্রিল সে,

আমাদের শীতের দুঃখেও অজেয়

নূতন মূল্যবোধ

আত্মঘাতী মানুষের জন্যে, ভাতের জন্যে বিক্রীত শিশুর জন্যে

আমরা কি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেব, যিনি বরফে বেঁধে দিয়েছিলেন

                                                মানবহৃদয়?

দেয়ার মতো কোনো যুক্তিতর্ক আমার নেই, তবে জানি

স্বর্গেও বর্জ্যরে জন্যে মেঘের সারিতে উন্নসিত সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে

                                                               পড়ে,

ঝড়ো বাতাস বয়।

নক্ষত্র আর আত্মারা তাদের বাসস্থান রাখে

সেই প্রচণ্ড গভীরে অলঙ্ঘনীয়,

যেখানে ন্যায়-অন্যায়ের বাদ-প্রতিবাদের ওপারে,

দ্রোহী আনন্দে গাত্রের ঝরনা জাগে।

কোনো উপসংহার এখানে নেই, তবে দিন গত।

বিরতিতে : জমকের মিছিলে সূর্য

ঘোমটা গুটিয়ে নেয়, আর বিশ^

শূন্যতার সাম্রাজ্যে এসে মেশে; ব্যাঙেরা ডাকে

যান্ত্রিক ঐকতানে; আর সবকিছু ঢেকে দিয়ে রাত

অশরীরী দানবিক বিলাপে বলে

বিলয়ের জন্যে ঘরকাতর শেয়ালের কথা

বৃষ্টির কথারেখ : নীলক্ষেত, রমনা

আজ আগস্ট তার তাপের জন্যে অনুতপ্ত। প্রত্যুষ থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, হচ্ছে আর হচ্ছে। তুমুল নয় একেবারেই, তবে উদাস ধরনে। গরুর পা পিষ্ট ঘাসে প্যাঁচপ্যাঁচ করে চলছে; সূর্য অস্ত গেল চার্চ অব ইংল্যান্ডের কোমলতা নিয়ে। আমি একা, কারণ আবদুল শুভ সন্ধ্যা জানিয়েছে, আর গ্রিমালকিন আমার মতো করেই, রাতের খাবার ভালো করে খেয়ে নৈশভ্রমণে গিয়েছে।

আমি নম্বরপত্রীকে একটি সংকীর্ণ গ্রাফে নিয়ে আসতে পারতাম, সন্ধ্যাবেলা যেহেতু আমারই, কিংবা চীনা ভাষা শিখতে পারতাম, কিংবা সেই ফাঁকি-দেওয়া  অনুচ্ছেদটি আবার খুঁজতে পারতাম। কিন্তু আরাম করে বসার আগে ভোলা যাচ্ছে না (আজীজকে প্রতিশ্রুত প্রশংসাপত্র) যেখানে তার অভ্যস্ত প্রকৃতিস্থতা নিয়ে ড্রাইডেন যুক্তি দিচ্ছেন যে, মহাকাব্যকে খ্রিষ্টধর্মের সঙ্গে একাকার করে ফেলা যাবে না।

দিনের কাজে মনে হয় বেছে নিতে হয়। কিছুই, চিরকালের পরিপ্রেক্ষিতে, অনেক অর্থ ধরে না, ঈশ্বরের ঘরে বুঝি আমি বরং দ্বাররক্ষক হবো নিজের ঘরে আরামে চা খাওয়ার পরিবর্তে, তবে স্বীকার করতেই হবে উনিশশো ঊনচল্লিশে আমি ঠিকানাটি হারিয়ে ফেলেছিলাম।

আর সময় বদলে গিয়েছে – না, ওটা বলার একটা রীতি। আমরা বদলাই, আমাদের সঙ্গে সময় বদলায় : উল্টোটা।

বৃষ্টির চিহ্ন

তারা অবশ্যই নির্ভুল, কোনো কবিকে তার নিজের শুদ্ধ স্বপ্নে

বাঁচতে হয়, অপরের নয়,

আর ঢাকার লেখকেরা লাঙলের সঙ্গে

কলম বিনিময় করবে না। গ্রামের প্রবাহ

তাদের কাব্যদেবের শ্বাসরোধ করে; নিরক্ষর জন

তাদের ভাইয়ের পক্ষে হট্টগোল।

সকল পণ্ডিতমন্যতার মধ্যে সর্বাধিক মিথ্যে হচ্ছে

বসন্তের যে হাবভাবকে তুমি পেছনে ফেলে এসেছো।

জীবন্ত বিতর্ক হচ্ছে সোভিয়েতের সমাজচেতনার

সঙ্গে প্যানইসলামিক অবস্থানের –

যে-পক্ষকে তুমি বেছে নাও,

কিংবা পশ্চিমা-এলিয়টিক এবং উচ্চমার্গের শিল্প

সময়-স্রোতের ওপরে কঠোর, যা আমাদের ক্ষণিকের ব্যবস্থাকে

ক্লিষ্ট করে, লক্ষ্যহীন শিল্প,

শুধু নিজের নিয়মে বাঁধা।

ঠিক এই মুহূর্তে আমার আপন একগুঁয়ে কাব্যদেবী

কর্মঘণ্টা বাজিয়েছেন। তিনি এক প্রত্যয়ী ট্রেড ইউনিয়নিস্ট,

বলেছেন তিনি, এবং অন্যজনের লক্ষ্য সম্পর্কে

আমার মতপ্রকাশের সাহায্য করবেন না, তবে বললেন

সনদপ্রাপ্ত তালিকার মধ্যেই থাকতে হবে আমার বিষয়।

কাব্যিক ভবিষ্যৎসমূহ এক জল্পনা,

প্রেরণার কোনো লভ্যাংশ যা দেয় না

যুক্তি আনো। আমার আপন ভুবন রয়েছে,

চেতনার সত্য এক স্বপ্ন, আত্মীয়তার সূত্রে রহস্যময় জ্ঞানের হাওয়া

আর নক্ষত্রের ভাষা : সেই ভুবন থেকে বয়ে আসা বল

ধরার পক্ষে চল্লিশ জীবন অতি দীর্ঘকাল নয়,

শুধু যদি লজ্জাজনক সব অন্যায়ের চিন্তা বাদ দিতে পারতাম

তারা আমাকে স্পর্শ করে না বলেই

কারণ, এখানে ঈশ্বরের সেই অনৈসলামিক কাহিনি ছড়ায়

যিনি সকল প্রাণীতে নিজেকে ঢেলেছিলেন, হাড়-জিরজিরে

                                  ভিখিরিদের কান্না আমরা যারা

শুনেছি, পাগল হয়ে যাইনি,

দুর্ভিক্ষের জঞ্জাল

শুকনো-রুক্ষ রাস্তায় ছড়ানো, আমরা যারা ছুড়ে দিয়েছি

বখশিশ, এবং চলে গেছি ডিনারে, যারা জেনেছি

যার সবুজ চুল গৌরবে সঞ্চরমান হাওয়ায়,

যার মৃত্যুগীত জীবনে ঝংকৃত; মঞ্জরিতে গোলাজাত,

প্রতিশ্রুত আর পুনর্বিক্রীত, আর চোরদের দলে শামিল

গুদামে মজুদ, তার সম্পদ সম্পূর্ণ বিস্মৃত

আর যখন তারা দরাদরি করছিল, সেসব পচলো

হাড়-জিরজিরে ভিখিরিদের কান্না আমরা যারা

শুনেছি, পাগল হয়ে যাইনি,

দুর্ভিক্ষের জঞ্জাল

শুকনো-রুক্ষ রাস্তায় ছড়ানো, আমরা যারা ছুড়ে দিয়েছি

বখশিশ, এবং চলে গেছি ডিনারে, যারা জেনেছি

১৮ বৃষ্টির চিহ্ন

সত্য ঝিকিয়ে ওঠে, যা কিছু মানুষ নির্মাণ করে বলে

মার্কস শেখান, যা কিছু আপন বলপ্রয়োগ যে সয়ে নেয়।

কিন্তু অধিবিদ্যার পথে শয়তান উস্কে দিয়েছিল

কোন শিক্ষাসফর? সেই মহান তর্কের উচ্চতায়

পৌঁছুনোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

কোথায় ছিলাম আমি? ভেবেছি আরো ভালো কী আমি করবো?

প্রশ্নটির উত্তর এখন। দ্রুত লেখনের

কৌশল আমি হারিয়ে ফেলেছি। নিয়মিত চর্চার

দু-এক সপ্তাহে পুলিশের মেশিনগানের মতো

দ্রুত এসে যেতে পারে অন্ত্যমিল, ঝরঝরে, বাকপটু

অথচ ভ্রান্ত চিন্তাকে মুছে দিতে; কিন্তু এখন তিন ঘণ্টায়

এমন কিছু আসেনি, অতএব শয্যায় যাই।

বৃষ্টিধৌত মাস, নবোদ্গত জুঁই থেকে আসা

সৌগন্ধের স্রোত; নৈরাজ্যিক ভেড়া আর

সরকারি ঢাকা মিশ্রিত; আর বর্ষার গোটা আকাশে

সদাই মিছিল, মিছিল তার সুউচ্চ

         লক্ষ্যে তাই পাকিস্তানে

প্রভাতের ঘুম ভাঙে, আর এখানে নীলক্ষেতে

মানুষ ঘুমের ভিড় থেকে জাগে নামাজে

আর চায়ের দোকানের গল্পে আর দিনের

ফিরে আসা বিরক্তিতে, স্ফূর্তিতে, শ্রমে কিংবা হতাশায়,

যখন দূরের বিষণ্ন বিউগল কামনা করে

সেই শুদ্ধতা যা দেখা অসম্ভব,

তার নাম আনুগত্য কোনো বেহেশতি

কিংবা মনুষ্য-দৃষ্টিতে সে প্রশ্ন করে না।

দূরে-দূরে কম্পমান আলো ঝুলে থাকে

সবুজের অশেষ মাঠে

সারসতাড়িত নদীতে রূপেতে জড়িত

আর দোদুল্যমান তালগাছে ছাওয়া

তাতে ঢাকা মাটির দেয়ালের সব ঘর।

ভেতরে অদৃশ্য নারীরা শান্ত পায়ে গভীর নুয়ে রয়

রান্নার হাঁড়ির বুকে, সেখানে পৃথিবীর শেষ তাহাদের।

পৃথিবীর নিচের পৃথিবী। এখানে নয়, অ্যাপোলো,

তোমার জন্যে সর্বাধিক মানানসই স্থানে তোমার ঊষাকাল থেকে

                                                            প্রেরণা নেয়,

তবে অন্য পথে খোঁজে

অন্য সন্ধান, কলেজের কক্ষে, সরকারি অফিসে,

তারা জন্ম দেয় এক নূতন ঐতিহ্য, মতাদর্শে জাত

আর বেতারে প্রচারিত