আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল র্যাচেল কার্সন নামে এক গবেষকের গবেষণালব্ধ একটি প্রতিবেদন। এটি বই আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর তা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যার মাধ্যমে মানুষ প্রথমবারের মতো আমাদের নাজুক জৈবমণ্ডলের ক্ষতির কথা জানতে পারেন। লেখিকা এতে দেখিয়েছেন কীভাবে কৃত্রিম রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার খাদ্যোৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে সক্ষম হলেও তা বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ ও পাখিদের মৃত্যুর কারণ হচ্ছে এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায়। ফলে আমাদের পৃথিবীতে এখন বসন্ত আসছে নীরবে – গানের পাখিদের কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই। আধুনিক পরিবেশবাদী আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে মৌন বসন্ত* (১৯৬২) নামে প্রকাশিত এই বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রথমবার এ-বইটি পড়ে বিখ্যাত লেখক আলডুস হাক্সলি বেদনাহত মন্তব্য করেছিলেন – ‘পৃথিবী থেকে কবিতার উপজীব্য বিষয়বস্তুর প্রায় অর্ধেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে।’ আর তাঁর এ-মন্তব্যটি ছিল ছয় দশক আগের বাস্তবতায়, যে-অবস্থার বর্তমানে আরো অবনতি ঘটেছে।
র্যাচেল লুইস কার্সন জন্মেছিলেন ১৯০৭ সালের ২৭শে মে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের স্প্রিংডেলে আলঘেনি নদীর তীরে একটি পারিবারিক খামারে। তাঁর পিতা রবার্ট ওয়ার্ডেন কার্সন ছিলেন একজন বীমা এজেন্ট এবং মা মারিয়া ফ্রেজার একজন গৃহিণী। কার্সন পরিবারের ৬৫ একর আয়তনের খামারটিকে শৈশবকালেই র্যাচেল আপাদমস্তক আবিষ্কার করে ফেলেন। তিনি বাল্যকালেই তাঁর লেখাপড়া শুরু করেন এবং অল্প বয়সেই বইপত্রের বিমূর্ত জগৎকে আবিষ্কার করে ফেলেন। আট বছর বয়সে তিনি তাঁর জীবনের প্রথম গল্পটি লিখে ফেলেন, যা তাঁর ১০ বছর বয়সে ছাপার মুখ দেখে। শৈশবেই তিনি ভক্ত হয়ে ওঠেন হারমান মেলভিল, জোসেফ কনরাড, রবার্ট লুই স্টিভেনসন প্রমুখ বিখ্যাত লেখকের।
প্রকৃতির খোলা জগৎ, বিশেষ করে সাগর-সম্পর্কিত রচনাবলি তাঁর বিশেষ আগ্রহের বিষয়। স্থানীয় স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে তিনি ঢ্যাথাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯২৯ সালে, তাঁর ক্লাসের ৪০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে এবং Magua cum Laude হয়ে।
স্কুল এবং কলেজজীবনে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। প্রথমে তিনি পড়েন ইংরেজি সাহিত্য, কিন্তু পরে বেছে নেন জীববিদ্যা – যদিও তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। জীববিদ্যা ও সৌজাত্যবিদ্যায় (Genetics) তিনি পরে জন হপকিন্সে শিক্ষা লাভ করেন এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। আর্থিক কারণে কার্সন গ্র্যাজুয়েট স্কুলেই রেমন্ড পার্লের গবেষণাগারে সহকারী হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি ইঁদুর ও ফলের মাছি (drosophila) নিয়ে গবেষণা করেন, যা তাঁর লেখাপড়ার খরচ জোগাতে সাহায্য করে। জুন, ১৯৩২ সালে তিনি লাভ করেন মাস্টার্স ডিগ্রি। এই জন হপকিন্সেই তিনি পিএইচ.ডি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিরিশ দশকের মার্কিন মহামন্দা তাঁকে বাধ্য করে পারিবারিক দায়িত্ব নিয়ে চাকরি শুরু করতে। কিছুদিন পর ১৯৩৫ সালে তাঁর পিতার আকস্মিক মৃত্যু হয়। ফলে তিনি তাঁর বৃদ্ধ মাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। তাঁর প্রথম চাকরিটি তিনি শুরু করেন মার্কিন মাৎস্য ব্যুরোতে। চাকরির সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরো একটি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে থাকেন – সেটি হচ্ছে সাগরতলের রোমাঞ্চকর জগৎ নিয়ে একটি শিক্ষামূলক বেতার সম্প্রচারের স্ক্রিপ্ট লেখা। এটি ছিল সামুদ্রিক জীবনের ওপর প্রতিদিন সাত মিনিট করে প্রচারিত মোট ৫২টি এপিসোডের সিরিজ। একই সঙ্গে তিনি স্থানীয় পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীগুলিতেও প্রকৃতি ও পরিবেশ, বিশেষ করে সাগরতলের রহস্য নিয়ে নানা লেখা চালিয়ে যান। বেতার কথিকাটির সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে কার্সনের সুপারভাইজার তাঁকে অনুরোধ করেন, মাৎস্য ব্যুরোর ওপর একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন বা ব্রোশিওর করে দিতে। মাৎস্য বিভাগের চাকরিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে তিনি জুনিয়র সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী হিসেবে পূর্ণকালীন স্থায়ী চাকরিতে যোগ দেন।
মাৎস্য বিভাগের চাকরিতে এবার কার্সনের দায়িত্ব হলো মাৎস্য জনসংখ্যার ফিল্ড রিপোর্ট বিশ্লেষণ এবং জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে মাৎস্য সংক্রান্ত নানা ব্রোশিওর লেখা ও সেগুলি সম্পাদনা করা। একই সঙ্গে তিনি বাল্টিমোর সান এবং আরো কিছু সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে নানা বিষয়ে লেখালেখি চালিয়ে যান। ১৯৩৭ সালে তাঁর বড়বোন হঠাৎ মারা গেলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবে তাঁকে মা এবং দুই ভগ্নিপুত্রীর দায়িত্ব নিতে হয়।
সে-বছরই জুলাই মাসে আটলান্টিক মান্থলি নামে সাময়িকীটি ‘সাগরতলের জগৎ’ নামে তাঁর একটি লেখা ছাপায়। সাগরতলে ভ্রমণ করার এটি একটি মনোগ্রাহী রচনা, যা তিনি তাঁর মাৎস্য ব্যুরোর দাপ্তরিক কাজে আগেই লিখেছিলেন। এ-লেখাটির প্রকাশই কার্সনের লেখকজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেওয়ার সূচনা ঘটায়। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সাইমন অ্যান্ড সুস্টার এটি ছাপতে কার্সনকে প্রস্তাব দেয়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী কয়েক বছর পরিশ্রম করে তিনি প্রস্তুত করেন মহাসাগরের গোপন রহস্য উন্মোচন করা তাঁর ‘সমুদ্র ট্রিলোজি’র প্রথম বই (Under the Sea Wind) ১৯৪১-এর পাণ্ডুলিপি। প্রকাশিত হওয়ার পর বইটি প্রশংসা লাভ করলেও এর বিক্রির পরিমাণ ছিল বেশ কম, যা ছিল তাঁর জন্য হতাশাজনক। তবে এতে দমে না গিয়ে কার্সন তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যান এবং সান ম্যাগাজিন, নেচার, কলিয়ের্স ইত্যাদি সাময়িকীতে সেগুলি প্রকাশ করেন। এগুলির মাধ্যমেই তিনি লেখালেখির জগতে হয়ে ওঠেন একটি পরিচিত মুখ।
র্যাচেল কার্সনের চাকরিস্থল US Fishery Bureau-র নাম ১৯৪৫ সালে পরিবর্তন করে রাখা হয় ইউ এস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস। এতে তাঁর কাজের পরিধিও বেড়ে যায়। ঠিক এ-সময়টিতেই শুরু হয় আর এক মার্কিনি মহাযজ্ঞ – পারমাণবিক বোমা তৈরি করার জন্য লস আলামোসে শুরু হয় ম্যানহাটান প্রজেক্ট। এই বিরাট প্রকল্পে যে-অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়, তাতে বাকি সবার অর্থ বরাদ্দে কাট-ছাঁট করা হয়, যার প্রতিক্রিয়া কার্সনসহ অন্য সবাই অনুভব করেন। এ সময়ই, ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি, তিনি প্রথমবার পরিচিত হন ডিডিটির সঙ্গে, যা সে-সময়ে একটি যুগান্তকারী কীটনাশক হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট হিরোশিমা ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা বর্ষণের পর এই ডিডিটিকে আখ্যা দেওয়া হয় ‘কীটনাশক বোমা’ বলে। যদিও তিনি ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত ডিডিটি নিয়ে কিছুই লেখেননি, তবু এই ডিডিটিই পরবর্তীকালে কার্সনকে পৃথিবীব্যাপী পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ডিডিটি নিয়ে লেখা সাইলেন্ট স্পিংই সারা পৃথিবীতে তাঁকে চিহ্নিত করে কীটনাশকের বিরুদ্ধে একজন ‘সরব প্রতিবাদকারী’ হিসেবে।
কার্সন তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা বিভাগের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পান ১৯৪৯ সালে। যদিও এ-দায়িত্ব তাঁকে ফিল্ডওয়ার্ক এবং লেখালেখির বিষয় নির্বাচনে স্বাধীনতা এনে দেয়, তবে এটি একই সঙ্গে তাঁকে দেয় ক্লান্তিকর অতিরিক্ত প্রশাসনিক দায়িত্বও। এর মাঝেই ১৯৪৮ সালে কার্সন তাঁর ট্রিলোজির দ্বিতীয় বইটি লেখা শুরু করেন, যেটি প্রকাশের পর ব্যবসাসফল হয়ে ওঠে। এর সাফল্য তাঁকে এনে দেয় আর্থিক নিরাপত্তা এবং তিনি সাহস করেন সার্বক্ষণিক চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর লেখক হিসেবে জীবন যাপনের চিন্তা করতে। এ-সময় তিনি মেরি রোডেলকে তাঁর সাহিত্য প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক বজায় রাখেন।
তাঁর দ্বিতীয় বইটি The Sea Around Us নামে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বের হয় ১৯৫১ সালে। বইটি প্রকাশের পর তা নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার লিস্টে ৮৬ সপ্তাহ জুড়ে স্থান ধরে রাখে। পরের বছর ১৯৫২ সালে এটি নন-ফিকশন বিভাগে জাতীয় গ্রন্থ পুরস্কার লাভ করে। এ-বইটির জন্য র্যাচেল কার্সন দুটি অনারারি ডক্টরেটও লাভ করেন। বইটি পরে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্মেও চিত্রায়িত করা হয়। আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর ১৯৫২ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে সার্বক্ষণিক লেখকজীবনে প্রবেশ করেন। কিন্তু এই ডকু ফিল্মটি নিয়ে তাঁর পরিচালক ইরউইন অ্যালোনের সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। এর প্রধান কারণ, পরিচালক এটিকে একটি জনতুষ্টিমূলক ছবি বানিয়ে এর বৈজ্ঞানিক দিকটির প্রতি সুবিচার করেননি। ছবিটি যদিও ১৯৫৩ সালে বেস্ট ফিচার ফিল্ম হিসেবে পুরস্কার লাভ করে, কিন্তু বিরক্ত কার্সন তাঁর আর কোনো বইয়ের চলচ্চিত্রায়ন অনুমোদন করেননি।
র্যাচেল কার্সনের জীবনের আরেক অধ্যায় হলো ডরোথি ফ্রিম্যান নামে আরেক ভদ্রমহিলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। বিবাহিত এই মহিলার সঙ্গে কার্সন পরিচিত হন ১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মে, মেইন অঙ্গরাজ্যের সাউথপোর্ট দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে। পরিচয়ের পর তাঁরা দ্রুতই একে অন্যের কাছে চলে আসেন এবং আদর্শগত একাত্মতা তাঁদের সম্পর্ককে আমৃত্যু ধরে রাখে। প্রকৃতি-প্রেম ও অন্যান্য জাগতিক বিষয়ে তাঁদের দুজনের আগ্রহ ও রুচিবোধ ছিল অভিন্ন। মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ চিঠিতে কার্সন ডরোথিকে লিখেছিলেন – ‘হে প্রিয়, আমাকে কখনো ভুলে যেও না। এ পর্যন্ত আমি তোমাকে কীভাবে ভালোবেসেছি, তা মনে রেখো।’
আটলান্টিক সৈকতের পরিবেশ ও তার জীবজগৎ নিয়ে ১৯৫৩ সালের শুরু থেকেই কার্সন তাঁর ফিল্ডওয়ার্ক শুরু করেন। এর দু-বছর পর তিনি তাঁর সমুদ্র ট্রিলোজির শেষ বইটি লেখেন The Edge of the Sea নামে। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে বইটি প্রকাশ করে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থা। বইটি এর পূর্ববর্তী দুটো বইয়ের মতোই জননন্দিত হয়ে ওঠে এবং এর কাব্যিক গদ্য প্রশংসা লাভ করে। জনপ্রিয় সাময়িকী অমনিবাসে ১৯৫৫ ও ’৫৬ সালে তিনি লেখেন ‘Something about the sky’ নামে ধারাবাহিক কিছু রচনা। এ-সময়ই তিনি বিবর্তন বিষয়ে একটি বই লিখতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন, তবে পরবর্তীকালে তাঁর অসুস্থতা ও অন্যান্য কারণে তাঁর সে-উদ্যোগ পরিত্যক্ত হয়। তখন থেকে তিনি তাঁর বাকি জীবনীশক্তি ব্যয় করেন শুধু পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে। কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন ১৯৫৭ সাল থেকে, যখন তিনি দেখতে পান যে, ডিডিটি, ক্লোরিনেটেড হাইড্রোকার্বন, অর্গানো ফসফরাস কম্পাউন্ড (এনড্রিন জাতীয় কীটনাশক) ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি কীভাবে আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।
র্যাচেল কার্সনের ম্যাগনাম ওপাস অবশ্য সমুদ্র-ট্রিলোজি বা অন্যান্য লেখাগুলি নয়, তা হচ্ছে ১৯৬২ সালে হিউটন
মিফিন-কর্তৃক প্রকাশিত Silent Spring বা মৌন বসন্ত। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কীটনাশকসমূহ, বিশেষত ম্যালেরিয়া দূরীকরণে মশা মারার কাজে ব্যবহৃত ডিডিটি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পরিবেশের যে ক্ষতি করছে, তা এ-বইটির মূল উপজীব্য। ডিডিটির এ-বিপদ সম্পর্কে কার্সন যদিও প্রথম উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না, কিন্তু একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং কাব্যিক লেখনীর ফলে বইটির জনপ্রিয়তা তাঁকে পরিবেশ-আন্দোলনের শীর্ষে নিয়ে আসে। শুধু সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহই নয়, সাইলেন্ট স্পিং-এর বইটি এতদিন পরও পরিবেশ-আন্দোলনের একটি মাইলফলক হিসেবে বিরাজ করছে। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের ভূমিকাসংবলিত সাইলেন্ট স্প্রিংয়ের একটি বিশেষ সংস্করণ ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১২ সালে বইটিকে চিহ্নিত করা হয় ‘National Historic Chemical Landmark’ অভিধায়। মার্কিন রাসায়নিক সমিতি এ-কাজটি করে, পরিবেশ-আন্দোলনে মৌন বসন্ত বইটির ভূমিকা স্মরণ করে।
১৯৫৭ সালে, জিপসি মথ দমন কর্মসূচির অংশ হিসেবে উড়োজাহাজ থেকে ডিডিটি ছড়ানোর মধ্য দিয়ে এ-কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। তবে কিছুদিনের মধ্যেই এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া শনাক্ত করতে পেরে লং আইল্যান্ডের জমি মালিকরা এর বিরুদ্ধে মামলা করেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁরা এতে হেরে যান। ওডুবন ন্যাচারালিস্ট সোসাইটিও এর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া শনাক্ত করে। তারা র্যাচেল কার্সনকে নিয়োগ দেয় এ-সম্পর্কে গবেষণা করে তার সমস্ত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে। তবে কার্সন এ-কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ও সাংবাদিককেও এতে যুক্ত করেন। চার বছরের ফিল্ডওয়ার্ক ও এই গবেষণায় কার্সন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলেন, যাঁরা তাঁকে অনেক গোপন তথ্য সরবরাহ করে। অচিরেই তিনি আবিষ্কার করেন যে, বিজ্ঞানী মহলেও দুটো গ্রুপ রয়েছে – একদল কীটনাশকের বিপদকে গুরুত্ব না দিয়ে খাটো করে দেখছেন, অন্যদল এর ক্ষতিকর দিকগুলি সবাইকে জানিয়ে এর বিকল্প কিছু আবিষ্কার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।
এর কিছুদিন পর ১৯৫৯ সালের বসন্তে ওয়াশিংটন পোস্টে কার্সনের একটি চিঠি ছাপা হয়; এতে কীটনাশককে অভিহিত করা হয় ‘বসন্তের পাখিদের নীরব করে দেওয়া ঘাতক’ হিসেবে। এর কিছুদিন আগে, ১৯৫৭-৫৯ সালে জনপ্রিয় ক্র্যানবেরি ফলে আগাছানাশক রাসায়নিক অ্যামাইনো ট্রায়াজলের বিষাক্ত উপস্থিতি পাওয়া যায়, যার ফলে কিছুদিনের জন্য ক্রানবেরি বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়। এ সময়েই FDA হিয়ারিংয়ে কার্সন দেখতে পান, কীভাবে শক্তিধর কীটনাশক কোম্পানিগুলি এসব অভিযোগ ধামাচাপা দিতে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করে কার্সন দেখতে পান যে, এসব কীটনাশকের একটা বড় অংশই বহন করছে ক্যান্সার তৈরি করার উপাদান।
কার্সন তাঁর মূল দাবিটির সব প্রমাণ পেয়ে যান ১৯৬০ সালেই – মানুষের শরীরে কীটনাশকের বিষাক্ত উপস্থিতি, ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগের সঙ্গে কীটনাশকের সম্পর্ক এবং পরিবেশ-দূষণের মিলিত প্রতিক্রিয়া। এর বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতেই হঠাৎ করে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন – প্রথমে পাকস্থলীর পীড়া, পরে ধরা পড়ে স্তনক্যান্সার। কীটনাশক কোম্পানিগুলির সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি তাঁর রোগের কথা গোপন করেই চিকিৎসা চালিয়ে যান, যাতে কোথাও তাঁর দুর্বলতা ফুটে না ওঠে। তাঁর সাহিত্য-এজেন্ট মেরি রোডেল ১৯৬১ সালে প্রস্তাব দেন যে, এ নিয়ে তাঁর প্রকাশিতব্য বইটির একটি রূপক শিরোনাম দেওয়া হোক – মৌন বসন্ত, যে-বইটির পাণ্ডুলিপি ১৯৬২ সালের মাঝামাঝিই চূড়ান্ত হয়ে যায়। যুক্তি ও তথ্য সহযোগে কার্সন বইটিতে তুলে ধরেন, এই কীটনাশক শুধু কীটপতঙ্গই ধ্বংস করছে না, বরং তা ধ্বংস করছে সমস্ত জৈবজগৎ (biocide)। জৈবজগৎ ধ্বংসের মূল উপাদানটি ডিডিটি হলেও আরো অনেক কীটনাশক ও রাসায়নিক দ্রব্য একই কাজ করছে। মানবশরীরে এর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হওয়া ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগের সঙ্গে এর সম্পর্কটিও তিনি আবিষ্কার করেন। বইটি শেষ হয় কীট ও বালাইনাশক হিসেবে রাসায়নিকের পরিবর্তে বিকল্প উপাদান অন্বেষণের আহ্বান জানিয়ে। তিনি এটিও প্রমাণ করেন যে, ডিডিটি ব্যবহার করে ম্যালেরিয়া দমন করা সম্ভব হলেও কিছুদিনের মধ্যেই মশারা ডিডিটি সহ্য করে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই র্যাচেল কার্সন কোপানলে পতিত হন মহাশক্তিধর কীটনাশক কোম্পানিগুলির ক্রোধের; তারা মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠোকে। অথচ এ-সময়টিতে তিনি তাঁর ক্যান্সার রোগের জন্য কেমো ও রেডিওথেরাপি নিতে ব্যস্ত। তবে সচেতন বিজ্ঞানী মহল তাঁর দাবিটিকে উড়িয়ে না দিয়ে তাঁকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসে। কার্সন তাঁর অসুস্থতা নিয়েও হোয়াইট হাউসে ১৯৬২ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত পরিবেশ সংরক্ষণ সম্মেলনে যোগ দেন। সে-বছরই অক্টোবর মাসে মৌন বসন্ত বইটি ‘বুক অব দ্য মান্থ’ হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রশংসা ও প্রশস্তিতে নন্দিত হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও ডিডিটি ও অন্যান্য কীটনাশক প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষ করে শক্তিশালী দুই কোম্পানি – ডুপন্ট ও ভেলসিকোল – বইটির বিরুদ্ধে প্রচারণা অব্যাহত রাখে এবং আইনি ব্যবস্থা জারি রাখে।
জনসমক্ষে কার্সনের সর্বশেষ উপস্থিতির একটি হচ্ছে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির সায়েন্স অ্যাডভাইজারি কমিটির এবং মার্কিন সিনেট সাব-কমিটির সামনে হাজির হওয়া। দেশে-বিদেশে প্রচুর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি সেগুলি গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। তবে ১৯৬৩ সালের শেষদিকে তিনি কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করেন, যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্স-এর সম্মাননা। পরের বছর, ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসেই তাঁর অবস্থা হয়ে পড়ে সংকটজনক এবং এপ্রিল মাসে ম্যারিল্যান্ডের সিলভার স্প্রিং-এর বাড়িতে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কার্সন। ১৪ই এপ্রিলের এক বসন্তেই নীরব হয়ে যাওয়া মৌন বসন্তের এই লেখিকার অন্ত্যেষ্টিকার্য দাহ করে শেষ করা হয় এবং তাঁর ছাইভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয় মেইন অঙ্গরাজ্যের শিপস্কট উপসাগরের সমুদ্রসৈকতে। সমুদ্র ট্রিলোজির লেখিকার দেহাবশেষও এভাবে মিশে গেল আটলান্টিক মহাসমুদ্রের অতল গর্ভে।
র্যাচেল কার্সনের সারা জীবনের কাজ পরিবেশ-আন্দোলনকে যে অভূতপূর্ব গতিদান করেছে, তা অনস্বীকার্য। কার্সন-বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিসিয়া হায়েন্স বলেছেন – ‘মৌন বসন্ত পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্যকে টলিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে কেউ আর সহজে ও বিনা প্রতিবাদে দূষণ বিক্রি করতে সাহস পাবে না।’ ইকোফেমিনিজম নামে নারীবাদী বিজ্ঞানীদের আন্দোলন গড়ে উঠতেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পুঁজিবাদী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা যদিও কার্সনকে অভিহিত করেছেন আবেগতাড়িত ও শৌখিন বলে, কিন্তু ইকোফেমিনিস্ট বিজ্ঞানীরা তাঁদের এ-দাবি নস্যাৎ করেছেন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, র্যাচেল কার্সন শুধু যে কীটনাশক ব্যবসাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তাই নয়, তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন কৃষি-ব্যবসায় বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির পুঁজিবাদী উৎপাদন-পদ্ধতিকে।
কার্সনের সুপারিশের ভিত্তিতে ডিডিটি নিষিদ্ধ করা ছাড়াও এর ওপর ভিত্তি করেই ১৯৬৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত হয় পরিবেশ প্রতিরক্ষা তহবিল (EDF)। দূষণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণে নাগরিক অধিকার রক্ষায় এটি সরকারগুলিকে আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য করে। তাদের সবার বক্তব্যই কার্সনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। EDF সক্ষম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিডিটি উৎপাদন বন্ধ করার সময়সীমা নির্ধারণ করতে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পরবর্তীকালে সারাবিশ্বে তা নিষিদ্ধ করতে। ১৯৭০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন কর্তৃক পরিবেশ রক্ষা এজেন্সি (EPA) তৈরির পেছনেও কাজ করছে কার্সনেরই ‘সংবেদনশীল প্রসারিত হাত’ – যেমনটি বলেছেন একজন সাংবাদিক। ১৯৭২ সালে প্রণীত আইন ফেডারেল ইনসেকটিসাইড, ফাঙ্গিসাইড অ্যান্ড রডেন্টিসাইড অ্যাক্টও সরাসরি কার্সনের কাজকে ভিত্তি করেই প্রণীত। তবে ১৯৮০ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি পদে রোনাল্ড রিগ্যান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পুঁজিবাদের তল্পিবাহকেরা তাদের শক্তি সংহত করে কার্সনের দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল উল্টে দিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
র্যাচেল কার্সনের মৃত্যুর পরও তাঁর সম্মান লাভ অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে, ১৯৮০ সালের ৯ই জুন মার্কিন রাষ্ট্রপতির স্বাধীনতা পুরস্কার, যা সে-দেশের সবচেয়ে বড় বেসামরিক পুরস্কার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ থেকেও তাঁর স্মরণে ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়। ১৯৭৩ সালে তাঁকে স্থান দেওয়া হয় National Women’s Hall of Fame-এ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তাদের একটি কলেজকে ২০১৬ সালে নামকরণ করে ‘র্যাচেল কার্সন কলেজ’ হিসেবে এবং ২০০৯ সালে মিউনিখে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘র্যাচেল কার্সন সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি’। ম্যারিল্যান্ডে তাঁর ঘরটিকে – যেখানে বসে তিনি তাঁর মৌন বসন্ত লিখেছিলেন – ঘোষণা করা হয় National Historic Landmark নামে। আমেরিকায় পূর্ব ও পশ্চিম সৈকতে দুটো গবেষণা-জাহাজকে সামুদ্রিক প্রাণী সংক্রান্ত গবেষণায় R.
V. Ratchel Carson নাম দিয়ে নিয়োজিত করা হয়। মেইন অঙ্গরাজ্যে ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় র্যাচেল কার্সন বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম, যার আয়তন ৯১২৫ একর। আর ২০০৭ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী আমেরিকা জুড়ে সম্মানের সঙ্গে উদ্যাপন করা হয়।
* মৌন বসন্ত, এ. কে. এম. ফজলুল কবির, বাংলা একাডেমি, ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.