ব্রেনে ব্রাউনের লেখা পড়ছিলাম এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জালে, বিশেষ করে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত সীমারেখা (boundary) – শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক – এসবের সঙ্গে মানুষের ও সমাজের স্বাস্থ্যের নিবিড় সম্পর্ক বুঝতে গিয়ে যে-গভীর অনুসন্ধান করছিলাম সেখানেও দেখলাম ব্রেনে ব্রাউনের বইয়ের কথা উঠে আসছে। তাঁর হালের গবেষণা ব্যবহার হচ্ছে নানামুখী চর্চার জগতে। মনোস্তত্বে, সমাজতত্ত্বে, সংগঠনের পরিবেশ রক্ষায়, স্বাস্থ্যসেবায়, ভালো থাকার সমসত্ম অনুশীলনে। উদ্বুদ্ধ হয়েছি বারবার। এই মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক। কয়েক বছর আগে তাঁর টেড টক সাম্প্রতিককালে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রায় সাড়ে তিন কোটি দর্শক সেই টেড টক দেখেছেন আজ পর্যন্ত। তাই সে-সংবাদ জানার পর, ‘পাওয়ার অব ভালনারেবিলিটি’ (নাজুক হওয়ার শক্তি) শিরোনামে আন্তর্জালে পাওয়া তাঁর টেড টক শুনে ফেলেছিলাম। এবং শুনে তাঁর কথা আরো জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। তাঁর সব সাক্ষাৎকার মন দিয়ে শুনে ফেললাম। তাঁর বইয়ের খোঁজ করতে লাগলাম। টিভি হোস্ট বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ওপরাহ্ উইনফ্রের করা ব্রেনে ব্রাউনের সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা দেখেছিলাম এর আগে। জেনেছিলাম বিখ্যাত কবি, লেখক, শিল্পী, অ্যাক্টিভিস্ট মায়া অ্যাঞ্জেলু-অনুপ্রাণিত এই ব্যক্তি মায়া অ্যাঞ্জেলুর সাক্ষাতেও এসেছিলেন। অ্যাঞ্জেলু তাঁকে তাঁর জরুরি কাজের জন্য অভিবাদন জানিয়েছিলেন। যত শুনেছি, ততই তাঁর কাজকে জানতে আগ্রহী হয়েছি। জানতে ইচ্ছা করছিল, অধ্যাপক ব্রেনে ব্রাউন এমন কী সামাজিক গবেষণা করলেন যে, টেড টকের বক্তৃতার মঞ্চে তাঁকে আহবান করা হলো আর আজ পর্যন্ত সেই টেড টক শুনতে তেত্রিশ মিলিয়নের বেশি দর্শক ইউটিউবে ভিড় করলেন? এমন কী বললেন যে, দেশ-বিদেশের টিভি ডাকতে লাগল তাঁকে? এমন কী কাজ তাঁকে করতে হয়, লেখালেখি আর গবেষণা ছাড়াও, যে, তিনি এখন এক সমাজকল্যাণমূলক কোম্পানির সিইও হয়ে ওঠেন অবধারিতভাবে? সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পেশাদারি সংস্থার ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য, উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর ডাক আসে – কেন? হাসি হাসি মুখে সহজ ভাষায় কী পরিবেশন করেন তিনি? কেন তাঁর বই রাইজিং স্ট্রং আর ব্রেইভিং দ্য ওয়াইল্ডারনেস নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় উঠে যায়? কেন তিনি সমাজ, সংসার, ব্যক্তি আর বিশ্বের সীমানায়, রাজনীতি আর পেশাদারি জগতে এক অপরিহার্যতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন বারবার? অথচ এই বাংলায় এখন পর্যন্ত আমরা তাঁর কাজের কথা তেমন শুনতে পাইনি। নিজের মতো পাঠ আর অনুসন্ধানের দিকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা পাই। একটু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাকি এমন এক সমাজ-গবেষক তিনি, যিনি ‘শেইম’ (লজ্জা), ‘হেইট’ (ঘৃণা), ‘কারেজ’ (সাহসিকতা), ‘ভালনারেবিলিটি’ (নাজুক হওয়া),
‘ডি-হিউম্যানাইজেশন’ (মানুষকে মানবেতরভাবে তুলে ধরা), ‘এম্প্যাথি’ (সমবেদনা), ‘ক্রিয়েটিভিটি’ (সৃজনশীলতা) ইত্যাদি ব্যক্তিগত আর সম্মিলিত মানুষের নানা রকম গহিন জায়গা নিয়ে বছরের পর বছর অপ্রচলিত ‘অদ্ভুত’ সমসত্ম অনুসন্ধানের কাজ করে তা সহজ-সাদাসিধে ভাষায় আর অনেক রসবোধের সঙ্গে তুলে ধরেন জনতার সামনে – লেখেনও বটে। ইউটিউবে তাঁর বিবিধ সাক্ষাৎকার এবং টেড টকে বক্তব্য শুনে আর হাসিখুশি অমায়িক মানুষটাকে দেখে বুঝতে পারি, তিনি অত্যন্ত ভদ্রলোক হলেও বেজায় ডানপিটে; সাহসীও বটে। ব্রেনে ব্রাউন ডটকম বলে একটা ওয়েবসাইট আছে, সেখানে কিছু কথা লেখা। আমি একটু সচেষ্ট ছিলাম সংশয় নিয়ে পড়ার। তবু সংশয় বৃষ্টির জলে ধুয়ে যেতে থাকে একটু যখন পড়ি, ‘Courage is contagious. Every time we choose courage, we make everyone around us a little better and the world a little braver’। এ-কথাগুলো একজন সমাজবিজ্ঞানীর বলেই বিস্মিত হতে হলো। এ-লেখার নাতিদীর্ঘ পরিসরে আমি তাঁর ব্রেভিং দ্য ওয়াইল্ডারনেস – দ্য কোয়েস্ট ফর ট্রু বিলঙ্গিং অ্যান্ড দ্য কারেজ টু স্ট্যান্ড অ্যালোন (আমিই সেই অরণ্য : আপন ভুবনের তালাশ আর একলা দাঁড়ানোর হিম্মত) নামে ২০১৭ সালে প্রকাশিত, বিপুলখ্যাত বই থেকে বাছাই করা ভাব-নির্যাস তুলে দিচ্ছি। এই পর্বে লেখকের প্রথম অধ্যায়টুকুর তর্জমা তুলে দেওয়া হলো।
আমি লিখতে শুরু করেছি; কিন্তু ভয় আমাকে অজগরের মতো গিলছে। তার কারণ বিশেষ করে এই যে, আমি আমার গবেষণা থেকে যা পেলাম আর যা বলতে যাচ্ছি তা বহুদিনের বিশ্বাস আর ধারণাকে অসমর্থন করবে। এমন যখন হয় আমি তখন ভাবতে থাকি – এসব বলার আমি কে? অথবা আমার কথা শুনে কি মানুষ খুব ক্ষেপে যাবে? বিরক্ত হবে?
এই নাজুক এক অবস্থানে, আমি সেসব অগ্রগামী সাহসী মানুষের কাছে প্রেরণা খুঁজি যারা সমাজকে গুরুতর নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। যাদের হিম্মত ছোঁয়াচে। আমি তাদের সম্পর্কে যা হাতের কাছে পাই তা-ই দেখি বা পড়ি – বই, সাক্ষাৎকার, প্রবন্ধ। এমনটা করি কারণ আমি যখন ভয়ের মধ্যে বসবাস করি তখন ওরাই তো এসে আমাকে উৎসাহ দেয়, এগিয়ে যেতে বলে। আর তার চেয়েও বড় কথা, আমার ঘাড়ের ওপর নজর রাখতে গিয়ে ওরা আমার লেখায় এক আখর ফালতু কথা সহ্য করে না।
এমন হয়ে উঠতে সময় লাগে। আমার জীবনের প্রথম দিকে, আমি উলটো পথে ছিলাম। আমার মন সমালোচক আর নেতিবাচকদের কথায় বোঝাই ছিল। আমি লিখতে বসে আমার সবচেয়ে অপছন্দের অধ্যাপক, সবচেয়ে নাক-সিটকানো কলিগ, সবচেয়ে নির্দয় সমালোচকের মুখ কল্পনা করে নিতাম। যদি এদের খুশি করতে পারি বা চুপ রাখতে পারি, আমি ভাবি, তাহলেই চলবে। এর পরিণতি একজন গবেষক বা সমাজবিজ্ঞানীর জন্য ভয়াবহ: এমন কিছুই তাকে আবিষ্কার করতে হবে যা বর্তমান ধারণার সঙ্গে ভাঁজে ভাঁজে মিলে আছে, কাউকে যা আলোড়িত করে না; যা নিরাপদ, পরিশ্রম্নত, স্বসিত্মকর। তবে এগুলো সত্যি কথা নয়। খুশি করার ভেট মাত্র।
সুতরাং আমি ঠিক করি এই নেতিবাচক লোকদের, এই ভয়- দেখানো জুজুদের আমার দরকার নেই। তাদের বদলে আমি ডাকতে শুরু করি সেসব পুরুষ আর নারীকে, যারা হিম্মত দিয়ে দুনিয়া গড়েছে। আর কখনো কখনো তা করতে গিয়ে লোকজনকে খেপিয়ে তুলেছে। তারা এক বিচিত্র দল। জে কে রাওলিং, আমার অত্যন্ত প্রিয় হ্যারি পটার বইয়ের লেখককে আমার বারবার দরকার হয় – যখন আমার গবেষণায় নতুন, অদ্ভুত ধারণার ভুবনকে তুলে ধরতে হবে। আমি কল্পনা করি তিনি বলছেন : নতুন ভুবন খুব জরুরি, কিন্তু বর্ণনা করলেই হলো না। সেই ভুবনে যে-গল্প আছে, তাই দাও আমাদের। সেই ভুবন যতই উদ্ভট আর আশ্চর্য হোক না কেন, সেই সব গল্পে আমরা নিজেদের দেখতে পাব।
যখনই জাত, লিঙ্গ বা শ্রেণি নিয়ে কোনো বেদনাদায়ক আলোচনা এসে যায়, তখন লেখক এবং অ্যাক্টিভিস্ট বেল হুক্সকে আমার দরকার হয়। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন শিক্ষকতা এক পবিত্র কাজ এবং শিক্ষাগ্রহণের সময় যে অস্বসিত্ম, সেটা জরুরি। এছাড়া এড ক্যাটমুল, কেন বার্নস আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি গল্প বলার সময় কানে ফিসফিস করেন। আমি যখন ধৈর্য হারিয়ে সংলাপ থেকে ডিটেইল বাদ দিতে থাকি তাঁরা আমাকে একটু ঠেলা দেন। ‘আমাদের তোমার গল্পের ভেতর নিয়ে যাও’, বলেন তাঁরা। অনেক সংগীত-ওস্তাদ আর শিল্পী এসে যান, আসেন ওপরাহ্ উইনফ্রে। তাঁর কথা আমি আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে সেঁটে রেখেছি। ‘ভেবো না
তোমার কাজ, তোমার জীবন সাহসী হবে এবং কাউকে তা হতাশ করবে না। এমন হয় না কখনো।’
কিন্তু আমার সবচেয়ে একনিষ্ঠ মন্ত্রণাদাত্রী হলেন মায়া অ্যাঞ্জেলু। কলেজে কবিতা পড়তে গিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। তাঁর কবিতা ‘স্টিল আই রাইজ’ (‘তবু আমি জাগি’) আমার জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছিল। এর মধ্যে এমন এক শক্তি আর সৌন্দর্য ছিল যে আমাকে তাঁর প্রতিটি বই সংগ্রহ করতে হয়। তাঁর সব কাব্য, সব সাক্ষাৎকার আমি পড়েছি। তাঁর লেখা আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দেয়, নিরাময় আনে। তাঁর কাজ আনন্দে ভরা; কিন্তু এক তিল রেহাই দেয় না।
কিন্তু তাঁর একটি উদ্ধৃতির সঙ্গে আমি গভীরভাবে ভিন্নমত ছিলাম। হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ণ এবং শ্রেণি নিয়ে একটি কোর্স পড়ানোর সময় উদ্ধৃতিটি আমার সামনে আসে। ১৯৭৩ সালে বিল ময়ারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে টেলিভিশনে মায়া বলেন :
আমরা তখন মুক্ত যখন আমরা বুঝতে পারি, কোনো স্থান আমাদের আপন নয় – সব স্থান আমাদের আপন – সেটা কোথাও নয়। এর জন্য চড়া দাম দিতে হয়। পুরস্কারও অনবদ্য।
লেখাটা পড়ে আমার কী মনে হয়েছিল হুবহু মনে আছে : ‘দারুণ একটা ভুল হচ্ছে এখানে। আপন স্থান, আপন ভুবন যদি না থাকে – সে দুনিয়া কেমন হবে? কতগুলো নিঃসঙ্গ মানুষের জটলা শুধু! আমার মনে হয় মায়া ভুবনে আপন হওয়ার শক্তিকে বুঝতে পারছেন না।’
পরবর্তী বিশ বছর ধরে সেই উদ্ধৃতি যখনই উঠে এসেছে আমার জীবনে, আমি একরাশ রাগ অনুভব করেছি। ‘কেন এমন কথা বললেন তিনি? এটা ঠিক হতেই পারে না। আপন হওয়া, একাত্ম হওয়া খুব জরুরি। কিছুর সঙ্গে, কারো না কারো সঙ্গে, কোথাও না কোথাও আপন হতেই হবে।’ বুঝতে পারি দুই কারণে আমার এমন রাগ হচ্ছে। প্রথমত, ডক্টর মায়া অ্যাঞ্জেলু আমার কাছে এমন এক কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন যে, তাঁর সঙ্গে এমন এক মৌলিক জায়গায় আমাদের দ্বিমত থাকবে, এ আমি মেনে নিতে পারছি না। দুই, আমরা কোনো জায়গায় খাপ খাইয়ে এঁটে যাব না, আপন হব না, এই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনার অন্যতম। আমার ব্যক্তিগত পরিণত জীবনের বড় কষ্টের জায়গা।
তাই মায়ার এই উদ্ধৃতি কখনো আমাকে শামিত্ম দিতে পারে না।
কোথাও আপন হতে না পারা আমার জীবনে ছাপ এঁকে গেছে। আমি নিউ অরলিন্সে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে যাই। সালটা ১৯৬৯। শহর যত সুন্দর হোক (এখনো খুব সুন্দর) বর্ণবাদ এখানে বাতাসকে ভারি করে তুলেছে। বর্ণভিত্তিক স্কুলগুলো মিলিয়ে-মিশিয়ে এক করে ফেলা হয়েছে সে-বছর। ঠিক কী যে হচ্ছে আমার পক্ষে তা আদৌ বোঝা সম্ভব নয় – আমি বড্ড ছোট। কিন্তু আমি জানি আমার মা খুব সোচ্চার আর বলিষ্ঠ। তাঁর আশেপাশে দাঁড়িয়ে সেই তেজ আমি অনুভব করতে পারি। কিন্তু আমার কাছে আমার মা আমাদের পাড়ায় নামের-তালিকা-তৈরি-করা একজন স্বেচ্ছাসেবক। তিনি আমার আর আমার পুতুলের জন্য হলুদ ফ্রক সেলাই করেন।
আমরা আদি বাড়ি টেক্সাস ছেড়ে যাই, এবং এই দেশ ছাড়া আমার জন্য খুব কঠিন ছিল। আমার দিদিমার জন্য আমার মন কেমন করে। কিন্তু একই সঙ্গে আমি আমার বাড়ির চারপাশে বন্ধুত্ব পাতানোর জন্য ব্যসত্ম। আমাদের পাড়ায় আবার নামের তালিকা দেখেই আদ্যোপান্ত ঠিক করা হতো। কোন অনুষ্ঠানে কে কে হাজির থেকে শুরু করে কোন জন্মদিনে কাকে কাকে ডাকা হবে অবধি। একদিন আমার মায়ের এক বন্ধু তাঁর চোখের সামনে তালিকাটা হাওয়ায় নাড়িয়ে বলেন, ‘এই পাড়ার কালো মেয়েদের নাম দেখেছ? সবার নাম ক্যাসান্দ্রা দিয়ে শুরু!’
বেশ! আমার মা ভাবেন। এই কারণেই হয়তো আমি আমার সব সাদা বন্ধুর জন্মদিনের নেমন্তন্নে বাদ পড়ে যাচ্ছি! আমার মায়ের প্রথম নাম ক্যাসান্দ্রা। আমারও প্রথম নাম ক্যাসান্দ্রা। পাড়ার তালিকায় আমার নাম? ক্যাসান্দ্রা ব্রেনে ব্রাউন। যদি কোনো আফ্রিকান আমেরিকান এই লেখা পড়েন, তিনি জানবেন ঠিক কেন আমাকে শ্বেতাঙ্গ বন্ধুদের জন্মদিনে ডাকা হয়নি। একই কারণে আফ্রিকান আমেরিকান একটি দল আমাকে অধ্যাপকবেলায়, বছরশেষে একটা কার্ড দেয়। তাতে লেখা : ‘বুঝলাম। তুমি আসলে ব্রেনে ব্রাউন।’ নারী ইস্যুর ওপর আমার একটা কোর্সে তারা নাম লিখিয়েছিল। আমি যখন ক্লাসে পড়াতে ঢুকি তারা আশ্চর্য হয়ে প্রায় চেয়ার থেকে পড়ে যায় আর কি! ‘আপনি ক্যাসান্দ্রা ব্রেনে ব্রাউন নন?’ হ্যাঁ, বটেই তো। একই কারণে আমি যখন ছোট একটা আধবেলার কাজের ইন্টারভিউতে যাই, আমাকে দেখে সেখানে এক মহিলা বলে ওঠেন, ‘তুমিই ব্রেনে ব্রাউন! কী অবাক কা-! খুশি হলাম!’ বসার আগেই সেই সাক্ষাৎকারঘর থেকে আমি বেরিয়ে আসি।
কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারগুলো আমাকে অভ্যর্থনা জানায়, কিন্তু তাদের বাড়িতে ঢোকার সময় তাদের চোখ যে কপালে উঠছে তা টের পাওয়া যায়। আমার এক বন্ধু জানায়, আমি তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা প্রথম সাদা মানুষ। চার বছর বয়সে এই কথার মর্ম বোঝা কঠিন, বিশেষ করে বন্ধুর বাড়িতে জন্মদিনের কেক খেতে এসে। কিন্ডারগার্টেনে সবার সঙ্গে একাত্ম হওয়া খুব সহজ হওয়ার কথা, অথচ আমার সবসময় মনে হতো, আমি বাইরের লোক।
পরের বছর বাবার চাকরিসূত্রে আমরা অন্য শহরে চলে যাই। আমাকে হোলি নেম অব জিসাস নামে এক ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করা হয়। দেখা যায় সেই স্কুলে একমাত্র আমিই ক্যাথলিক নই। আরো দেখা যায়, সেই স্কুলের পক্ষে আমার ধর্মটা ঠিক হয়নি। আবার আপন হওয়ার স্বপ্নে বাদ সাধে। এক-দুই বছর বাইরে বসে কাটানো, আলাদা করে ডেকে নেওয়া, এবং মাঝেমধ্যে একা পড়ে যাওয়ার পর একদিন দেখি ঈশ্বর আমাকে অফিসে ডেকে পাঠাচ্ছেন। অন্তত তাঁকে দেখে আমার তেমনটাই মনে হয়েছিল। আসলে তিনি বিশপ। তিনি এক ধর্মগ্রন্থ আমার হাতে তুলে দিয়ে প্রতিটি লাইন পড়ে আমাকে শোনান। পরে তিনি আমাকে একটি চিরকুট দেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেই চিরকুটে লেখা, ‘ব্রেনে এখন থেকে ক্যাথলিক।’
সে যাই হোক, পরের দুটো বছর মোটেও মন্দ কাটে না, কারণ আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী এলেনোর যেমন তেমন মেয়ে। কিন্তু এরপর শুরু হয় বাসস্থান পরিবর্তন। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে। হিউস্টন থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যখন যাওয়া হয় তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে। আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে তখন আমরা আবার হিউস্টন ফিরে আসি। বয়ঃসন্ধির জবুথবু ভাবের সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন-মেয়ে হিসেবে নতুন জায়গায় মেলার চেষ্টা। এসবের মধ্যে বাঁচোয়া – আমার বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো ছিল। আমার আশপাশের নানা ঝড়ঝঞ্ঝা, স্কুল-পালটানো, নতুন বন্ধু, নতুন মানুষের ভিড়ে আমার বাড়ি এক নিরাপদ আশ্রয়। কোথাও আপন না হওয়ার ফলে সেটাই ছিল আমার ভরসার জায়গা। সব যখন ব্যর্থ, তখন আমি মা-বাবার আপন।
কিন্তু সে-শামিত্ম টেকে না। হিউস্টনে ফিরে আসার পর আমার মা-বাবার ভেতর এক বেদনাদায়ক দ্বন্দ্ব শুরু হলো – শেষ পর্যন্ত যা তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সেই চরম বিশৃঙ্খলার সন্ধিক্ষণে ছিল আমার স্কুলে ড্রিলের দলে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন।
অষ্টম শ্রেণিশেষে ফিরে হিউস্টনে এসে যেটুকু সময়, তার মধ্যে আমি হাইস্কুলের ড্রিল টিমে যোগ দেওয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিলাম। সেই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। বাড়িতে আমার ঘরের দেয়ালের ওপার থেকে যখন আমার মা-বাবার তর্কের চাপা শব্দ শুনি, তখন এই ড্রিল টিমের স্বপ্ন আমার প্রতিরোধ হয়ে উঠছে। তার আগে আট বছর ধরে আমি নাচ শিখেছি – সে শিক্ষা বৃথা গেল না। এই ড্রিল টিমে ঢুকতে চেয়ে আমাকে তরল খাদ্য খেতে হলো – বাঁধাকপির সুরুয়া আর জল। নাহলে নাকি ওজন বাগে আসবে না। বারো বছর বয়সে কাউকে ওজন ঠিক করতে এই আহার খেতে হয়েছে, শুনতে অদ্ভুত লাগে। কিন্তু আমার কাছে একে স্বাভাবিক মনে হলো।
আমার এখনো মনে হয়, এই ড্রিল টিমে ভর্তি হতে চাওয়াই আমার জীবনের সেরা স্বপ্ন ছিল। এতটাই চেয়েছিলাম। এই ড্রিল নাচ আমার কাছে যেন নিখুঁত, নির্ভুল, সুন্দর কিছু। আমার পরিবারের ডামাডোল থেকে যোজন দূর। এখানে থাকা যেন আপন হওয়ার পবিত্র সোপান। এখানে একজন ‘বড় বোন’ আমার লকার সাজিয়ে রাখত। আমরা একে অপরের বাসায় সখির মতো রাত কাটিয়েছি। ফুটবল খেলোয়াড়দের সঙ্গে প্রেম করেছি।
এবং আক্ষরিকভাবে, এই ড্রিলের মধ্য দিয়ে আমরা একমন একপ্রাণ হয়ে একটা কাজে অংশ নিতাম – সেটা নাচ। তাই এই জীবন আমার আপন ভুবনের নিটোল ছবি বলে মনে হতো।
আমার তখনো কোনো বন্ধু হয়নি। রুটিন শেখা সহজ ছিল। আমি এতটাই চর্চা করেছি যে, ঘুমের মধ্যেও নাচতে পারি।
পরীক্ষার দিন আমার ভয়ে কাঁপুনি এলো। জানি না সেটা কি দুর্ভিক্ষের খাদ্য, না স্নায়ুর গড়বড়। আমার মাথা হালকা লাগছিল। মা আমাকে স্কুলে দিয়ে এলেন। এখন নিজে মায়ের ভূমিকায় এসে পড়েছি; তাই বুঝতে অসুবিধা হয় আমার সেদিন কেমন লাগছিল, যখন সবাই হাত ধরাধরি করে দৌড়ে ঢুকছিল, আর আমাকে কেমন একা একা ঢুকতে হয়। তবে আমি চটজলদি বুঝতে পারি একা ঢোকার চেয়ে ঢের কঠিন সমস্যা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
সব মেয়ে – সত্যি বলছি প্রত্যেকেই – পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সেজেগুজে এসেছে। মাথায় নীল সোনালি ফুল-কাঁটা ফিতের ছড়াছড়ি। তাদের মুখে রং, পাউডার, কাজল ইত্যাদি। আমার মুখে কোনো প্রসাধন নেই। আমার জামার রং ছাই। ওদের গায়ে নীল আর সোনালি জামা। কেউ আমাকে বলেনি আজ স্কুলের রঙে সেজে আসতে হবে। সবাই কেমন উজ্জ্বল আর চকচকে। তার মধ্যে আমি যেন সেই দুঃখী মেয়ে, যার বাবা-মা কেবল ঝগড়া করে।
নির্ধারিত ওজনের চেয়ে আমার ওজন ছয় পাউন্ড কম দেখা যায়। তারপরও অনেক মেয়ের ওজন মাপার যন্ত্রে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে লকার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ার দৃশ্য আমাকে আতঙ্কে ফেলছিল।
আমাদের জামায় সেফটি পিন দিয়ে নম্বর আঁটা আছে। পাঁচ অথবা ছয়ের দল হয়ে আমরা নাচ করলাম। মাথা হালকা লাগছিল তো কী, রুটিনে আমার কোনো ভুল হলো না। মা যখন তুলে নিতে এলেন, আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে গেলাম। অপেক্ষার সময়টা অহেতুক কাটতে চাইল না।
শেষে, বিকেল ছয়টা বেজে পাঁচে, আমরা সবাই মিলে আসি। মা, বাবা, ভাই, বোন। আমি নম্বর দেখে নেব। তারপর আমরা সবাই আমার দিদিমার কাছে বেড়াতে যাব। পোস্টার বোর্ডে টাঙানো পাশ করা মেয়েদের নম্বরের তালিকা ঝুলছে। আমার দলের একজন আছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল আর চকচকেদের মধ্যে একজন। নাম ক্রিস। এমন নাম আমাদের সকলেরই অভীষ্ট। ছেলে না মেয়ে বোঝা যায় না।
নম্বরগুলো ছোট থেকে বড় করে সাজানো। আমার নম্বর ৬২। ষাটের ঘরে আমার নজর দৌড়ায়। ৫৯, ৬১, ৬৪, ৬৫। আমি আবার তাকাই। কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না। যেন ওইদিকে আরো ভালোভাবে তাকিয়ে থাকলে ৬২ নম্বরটা দেখা যাবে। এমন সময় ক্রিসের চিৎকারে আমার ঘোর কেটে গেল। সে ওপর-নিচ লাফাচ্ছে। আমি কিছু বোঝার আগে তার বাবা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে এসে তাকে উঁচুতে তুলে এক ঘুর দিয়ে দিলো, ছবিতে যেমন হয়। আমি পরে শুনতে পেলাম ভেতরকার খবর; আমার নাচ ঠিক হলে কী হবে। আমার মাথায় ফিতে নেই। চকচকে সুন্দর জামা-কাপড় নেই, প্রসাধন নেই। দল নেই। আপন বলতে কেউ নেই আমার। আমি তাই অযোগ্য।
একা! ভেতরে ভেতরে আমি ধ্বসত্ম হতে থাকি।
আমি গাড়িতে গিয়ে উঠি আর বাবা চালাতে শুরু করেন। আমার মা-বাবা একটা কথাও বললেন না। সেই নৈঃশব্দ্য আমার বুকে ছুরির মতো বিঁধল। তাঁরা আমাকে নিয়ে লজ্জা পাচ্ছেন। আমি তাঁদের মুখ রাখতে পারিনি। তাই লজ্জা পেয়েছেন। আমার বাবা ফুটবলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। আমার মা তাঁর ড্রিল টিমের নেত্রী ছিলেন। আমি কিছুই নই। আমার বাবা বিশেষ করে চাইতেন সকলে দেখুক, চাইতেন সামাজিক অবস্থানে আমরা খাপ খাইয়ে নেব, নেতৃত্ব দেবো। আমার দেখানোর মতো কিছু নেই। আমি খাপ খাওয়াতে পারছি না।
প্রথমবারের মতো আমি আমার পরিবারের কাছে আপন হতে পারলাম না।
আমার ড্রিল টিমের গল্প পৃথিবীজোড়া অনেক বড় বড় সমস্যার মধ্যে উন্নত বিশ্বের এক ছোট সমস্যা হিসেবে খারিজ করা যায় নিশ্চয়ই। কিন্তু এই সমস্যা আমার কাছে কেমনতর ছিল একটু বলি। জানি না গল্পটা সত্যি কি না, নাকি আমি বানিয়ে তুলেছিলামসে-গল্প, কিন্তু সেই নৈঃশব্দ্যের মধ্যে আমি নিজেকে বলছিলাম, আমি আর আমার পরিবারের কেউ নই, আমাদের সামাজিক সবচেয়ে মৌলিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমি অন্তরে বহিরাগত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা যদি আমাকে সেই মুহূর্তে জানাতেন, আমি চেষ্টা করে যথেষ্ট সাহসিকতা দেখিয়েছি, অথবা সত্যি তখন আমি যেমনটা চাইছিলাম, পাশে ডেকে যদি বলতেন – আমার এই অভিজ্ঞতা কত বেদনাদায়ক; বলতেন, সত্যি ওই দলে থাকার যোগ্যতা আমার আছে – তবে আমার জীবনের গতিপথ এমনটা হতো না। কিন্তু তাই তো হলো।
এই গল্প সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এতটা কঠিন হবে ভাবিনি। আমাকে আইটিউনসে গিয়ে নাচের দলের সেই গানটা আবার শুনতে হয়েছে। শুনতে গিয়ে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। ড্রিল টিমে জায়গা পাইনি বলে নয়, আমি কাঁদছিলাম সেই মেয়েটির জন্য যে কেন, কী হচ্ছে তার কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। আমার নাজুক অবস্থায় আমাকে সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে খুব অদক্ষ যে বাবা-মা, তাদের জন্য কাঁদছিলাম আমি। যাঁদের জানা ছিল না কীভাবে ওই নৈঃশব্দ্য ভেঙে কথা বলতে হয়, সান্তবনা দিতে হয়, অথবা নিদেনপক্ষে আমার বহিরাগত হয়ে যাওয়ার গল্পে বাধা দিতে হয়। এই কারণে আমরা পরিণত জীবনে এসেও নিজের আপন আস্তানা খুঁজে বেড়াই, খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করতে থাকি। সৌভাগ্যের কথা, আমার বাবা-মা কখনো মনে করেননি সমত্মান বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর তাঁদের বাবা-মা হওয়ার দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়। হিম্মত কী, নাজুক হওয়া কাকে বলে, আপন ভুবন মানে কী, এসব আমরা পরে একসঙ্গে শিখেছি। সেসব ছোটখাটো অলৌকিক ঘটনাও বলা যায়।
এমনকি, কষ্টের চালচিত্রে – দারিদ্র্য, সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার মধ্যেও – পরিবারের কাছে আপন হতে না পারার ব্যথা সবচেয়ে বেশি। তার কারণ এই একাত্মতার অভাব আমাদের বুক ভেঙে দেয়, আমাদের আত্মাকে চুরমার করে দেয়, আমাদের আত্মমর্যাদাকে ধ্বংস করে। আমার ক্ষেত্রে এর সবকিছুই হয়েছিল। এই রকম হলে কেবল তিনটি ফলাফল আছে, আমি আমার জীবনে আর কাজে এর সাক্ষ্য দিতে পারি :
১) ব্যথা হয় চিরন্তন। সেই ব্যথাকে অবশ করে অথবা অন্য মানুষের মধ্যে সঞ্চালিত করে আপনি নিরাময় খোঁজেন।
২) ব্যথা আছে এ-কথা আপনি অস্বীকার করেন। এই অস্বীকৃতির কারণে সেই ব্যথা আপনার শিশুর মধ্যে সঞ্চালিত হয়।
৩) আপনি এই ব্যথাকে স্বীকার করে নেন, একে আপন করে নেন হিম্মতের ভেতর দিয়ে। নিজের জন্য সমবেদনা আর করুণা অনুভব করেন নিজের ভেতরে, অন্যের ভেতরে। এর ফলে দুনিয়ায় ব্যথাকে চিনে নেওয়ার এক অসামান্য ক্ষমতা তৈরি হয় আপনার মধ্যে।
আমি এ-তালিকার প্রথম আর দ্বিতীয়কে নিশ্চয়ই বেছে নিয়েছি। এবং পরম এক কৃপায় আমি তৃতীয় নম্বরে এসে পৌঁছি।
এ-ঘটনার পরে আমাদের বাড়িতে বাকবিত-া আরো তীব্র হয়ে ওঠে। সেই সব ঝগড়ায় কোনো কিছুই উহ্য থাকত না। আমার বাবা-মায়ের অন্যভাবে ঝগড়া করার দক্ষতা জানা ছিল না। আমি নিজেকে বোঝালাম, দুনিয়ায় শুধু আমার মা-বাবাই তাঁদের বিবাহিত সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করছেন। আমার খুব লজ্জা হলো। আমার ভাই আর বোনের বন্ধুরা আমার বাবা-মাকে বলতেন, ‘মিস্টার এবং মিসেস বি।’ শুনতে বেশ লাগত – মনে হতো কত দারুণ মানুষ তাঁরা। কিন্তু আমি তো জানি তাঁরা ঝগড়া করেন, আর এও জানি এসব বন্ধুর বাবা-মা টিভিতে দেখা বাবা-মায়ের মতো অসম্ভব সুখী মানুষ। সুতরাং গোপন লজ্জা আমার মধ্যে জমা হতে শুরু করল।
দৃষ্টিকোণ আসলেই অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি। আমার আশপাশে যা হচ্ছে তাকে স্বাভাবিক বাসত্মবতার প্রেক্ষাপটে রেখে দেখার মতো অভিজ্ঞতা আমার তখন নেই। আমার মা-বাবা তখন কোনোরকম বিধ্বংসী কিছু না ঘটিয়ে কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করছেন, তাই আমাদের কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে – এমন কথা তাঁদের মাথায় আসেনি। আমার হাইস্কুল তখন বিশ্বরেকর্ড করে খবরের কাগজে এসেছে। ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার রেকর্ড নিয়ে। কিন্তু সে-খবর ছাপিয়ে আমার ধারণা, সেই শহরে, এমনকি সারা পৃথিবীতে আমার মতো গাড্ডায় কেউ পড়েনি। অনেক পরে, দুনিয়ার মানুষ যখন নিজ নিজ সংগ্রামের কথা বলতে শুরু করে, তখন আমি যেসব বাবা-মাকে খুব সুখী বলে জানতাম, তাঁদের অনেকে বিবাহবিচ্ছেদে আলাদা হয়ে গেছেন, কেউ কেউ মানসিক চাপে অসুস্থ, আর কেউ কেউ সৌভাগ্যক্রমে সেরে উঠছেন।
কখনো কখনো মৌনতা নিজের মতো ফিসফিস করে গল্প বলতে থাকে শিশুর কানে। শিশুমনে তৈরি সে-গল্প। সেটা সব থেকে বিপদের কথা। সে-গল্পে তারা নিজেদের ভালোবাসার অযোগ্য বলে ভাবে। নিজেদের মূল্যহীন হিসেবে তুলে ধরে। আমার কাছে আমার নিজের কথকতা এমনটাই ছিল। তাই ছুটির সময় আমি হাই কিক অনুশীলন না করে আমার চেয়ারের তলায় নেশার বস্ত্ত লুকিয়ে রাখি, বুনো প্রকৃতির ছেলেমেয়ের সঙ্গে দৌড়াই। আমার ধরনের মানুষ খুঁজি। আমি আর কখনো কোনো দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করিনি। বরং খাপ খাওয়ানোর অনুশীলনে আমি চোসত্ম হয়ে উঠি। এমন কিছু করতে থাকি যেন কিছুর অংশ বলে আমি নিজেকে চিহ্নিত করতে পারি।
আমার বাবা-মায়ের চলমান ক্রমশ আরো বিষণ্ণ-হতে-থাকা বিবাদের মধ্যে আমার দুই বোন আর এক ভাই ত্রাণের জন্য আমার ঘরে এসে জুটলে আমি তাদের জন্য সবকিছু কীভাবে ‘আরেকটু ভালো’ হতে পারে, সে-চেষ্টা চালাতে থাকি। বীরবিক্রমে আমি বিবাদ কেন হয়েছে বোঝার চেষ্টা করি। আমার পরিবার আর আমার ভাইবোনের জন্য আমি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। যখন তা কাজে দিত আমার নিজেকে হিরো বলে মনে হতো। এখন লিখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এ-অবস্থায় আমি গবেষণা আর উপাত্তকে নাজুক হওয়ার চেয়ে বেশি মূল্য দিতে শিখছিলাম।
পেছনে ফিরে বুঝতে পারি, আপন হতে না পারাই আমাকে মূলত এই জীবিকা দিয়েছে। প্রথম শিশু হিসেবে, তারপর উঠতি জোয়ান হিসেবে, আপন হতে না পারাকে সামাল দিতে আমি মানুষ পর্যবেক্ষণ করতাম, শিখতাম তাদের কাছ থেকে। মিলের নকশা খুঁজতাম। খুঁজতাম সংযোগ। আমি জানতাম, মানুষের আচরণের ধরন চিনে সেসব তাদের কাজ আর অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত করতে পারলে পথ খুঁজে পাব। নকশা অনুধাবনের দক্ষতাকে ব্যবহার করে বুঝতে চাইতাম, মানুষ কী চায়, কী চিমত্মা করে, অথবা তারা কী করছে। আমি সঠিক কথাটা বলতে, সঠিকভাবে নিজেকে হাজির করতে শিখলাম। একজন বর্ণচোরার মতো নিজেকে মিলিয়ে নিতে শিখলাম পরিবেশের সঙ্গে। ফলে নিজের কাছে অজ্ঞাত আর নিঃসঙ্গ থেকে গেলাম আমি।
সময়ের সঙ্গে আমি অন্য মানুষকে যতটা ভালো চিনতে শিখলাম, ততটা ভালো তারা নিজেরাই নিজেদের চেনে না। সেই প্রক্রিয়ায় আমি নিজেকে হারালাম। আমার বয়স যখন একুশ, আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি, বেরিয়েও এসেছি, আমার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, হিচহাইক করে ছয় মাস ইউরোপে ঘুরে এসেছি আমি। হালকা ধরনের সব নেশা করা থেকে শুরু করে আত্মবিধ্বংসী সব ধরনের বোকা বোকা কাজ করেছি। কিন্তু ক্লামিত্ম আসছিল। আমি ধোঁয়ার ওপর বেঁচে ছিলাম। এই ধরনের পলায়নকে একজন খুব মোক্ষমভাবে ধরেছেন : ‘জীবনের মানের চেয়ে দ্রুত শরীরের ক্ষয়।’
১৯৮৭ সালে স্টিভের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। কেন জানি তাকে খুব আপনজন বলে মনে হলো। এমনটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী এলেনোরের সঙ্গে কেবল হয়েছে। স্টিভ আমাকে সত্যি সত্যি দেখতে পেত। আমার আত্মবিধ্বংসী দিনগুলোর শেষদিকটায় সে এসেছিল। তারপরও সে আমাকে দেখতে পেত। আমাকে পছন্দ করত। তার পরিবারেও এমন এক বেদনার কাহিনি ছিল। তাই সে আমার ব্যথা চিনতে পেরেছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বললাম। কুঁড়ির মতো যেন ফেটে পড়লাম আমরা। কখনো দশ ঘণ্টা ধরে ফোনে কথা বলতাম। আমরা আমাদের দেখা প্রতিটি বিবাদ, কলহ নিয়ে কথা বলেছি। যে নিঃসঙ্গতার সঙ্গে আমাদের নিয়ত লড়াই, সেই নিঃসঙ্গতা নিয়ে, এবং কোথাও আপন হতে না পারার অসহনীয় বেদনা নিয়ে।
যা বন্ধুতা হিসেবে দেখা দেয়, তা-ই উত্তাল প্রেম এবং ক্রমশ পূর্ণ ভালোবাসায় রূপ পেল। দেখতে পাওয়ার ঘটনা যে কত শক্তিশালী – কেউ যেন তা ছোট না করে। কেউ যখন সত্যি আমাদের দেখে আর ভালোবাসে তখন নিজের বিরুদ্ধে পথচলা ক্লামিত্মকর। কখনো তার ভালোবাসা উপহার বলে মনে হতো। কখনো তার এই সাহসিকতাই ক্ষুব্ধ করত আমাকে। কিন্তু যখন আমি আসল ‘আমি’র টুকরো টুকরো ছবি দেখতে শুরু করলাম, আমার মন বিষাদ আর গভীর আকাঙক্ষায় ভরে উঠল। যে-মেয়েটি কোথাও আপন হতে পারেনি, তার জন্য শোক, তাকে জানার গভীর আকাঙক্ষা আমাকে ব্যাকুল করে তোলে। তার কী ভালো লাগে, কী সে বিশ্বাস করে, কোথায় সে যেতে চায়, সেসব জানার ব্যাকুলতা। স্টিভ আমার এই আত্মজিজ্ঞাসা ভয় পায়নি। ভালোবেসেছিল। সমর্থন করেছিল।
সুতরাং ডক্টর মায়া অ্যাঞ্জেলু, কোথাও আপন না হতে পারা কোনোভাবেই ভালো কিছু হতে পারে না। তখনো আমি বুঝতে পারছি না, তাঁর সেই উদ্ধৃতির মর্ম।
পরিচয়ের সাত বছর পরে স্টিভ আর আমি বিয়ে করি। সে মেডিক্যাল স্কুল থেকে রেসিডেন্সি করতে যায়। আমি স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তরে উত্তীর্ণ হই। ১৯৯৬ সালে মাস্টার্স শেষ করে আমি ঠিক করি সিগারেট আর মদ জন্মের মতো ছেড়ে দেবো।
আমাদের বিয়ের প্রথম বছরগুলো সংগ্রামের ছিল। রেসিডেন্সি আর গ্র্যাজুয়েট স্কুলের চাপ, নুন আনতে পামত্মা ফুরানো অবস্থা। আমার মনে আছে, একজন কলেজ থেরাপিস্টকে বলেছিলাম, এই বিয়ে হয়তো টিকবে না। তিনি কী উত্তর দিলেন জানেন? ‘মনে হয় না। তুমি নিজেকে যতটা পছন্দ করো তার চেয়ে বেশি পছন্দ করে সে।’
আমার নিপুণভাবে খাপ খাইয়ে নেওয়া একজন মানুষ থেকে নিজের আপন হয়ে ওঠা শুরু হয় বিশের কোঠায় আর শেষ হয় চলিস্নশের কোঠায়। ত্রিশের কোঠায় আমি এক আত্মবিধ্বংসী কাজ আরেক বিধ্বংসী কাজের বিনিময়ে পালটাপালটি করে নিই। নেশা গেল, এলো নিখুঁত হওয়ার শুচিবাই। আমি তখনো একজন বহিরাগত, কিন্তু তালিকায় নিজের নম্বর না দেখলে আমি আর আগের মতো নিশ্চয়ই লজ্জায় ছোট হয়ে যাই না। বরং নিজের ভয় আর বেদনা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলি। আমার কাছে কী, কেন গুরুত্বপূর্ণ সেসব প্রশ্ন করি নিজেকে। তালাবদ্ধ ধারণায় বন্দি থাকা কী আমার পোষাবে মনে হয়? না। আমাকে যখন বলা হলো কোয়ালিটেটিভ গবেষণা করা হবে না, তখনো আমি সেটাই করি। আমাকে বলা হয়, ‘লজ্জা’ আমার গবেষণার বিষয় হতে পারে না, আমি তা-ই বেছে নিই। যখন লোকে জানায়, আমি একজন অধ্যাপক হয়ে জনগণের কাছে পৌঁছার মতো বই লিখতে পারব না, আমি সে-বই লেখাতেই হাত দিই।
এমন যেন মনে করা না হয় যে, আমি খাপ খাওয়ানোর এক চরম প্রান্ত থেকে অন্য চরম প্রামেত্ম – স্বতন্ত্র, প্রতিবাদী, অবাধ্য হওয়ার পথে চলে গেছি। ওই রকম বিপরীতগামিতা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আমি তখনো গভীরভাবে আপন হতে চাই এবং জীবিকার দিক থেকে মূলস্রোতের বাইরে থাকা আমাকে চিরন্তন দুশ্চিমত্মা আর অভাববোধে পীড়িত করে। একে আদর্শ অবস্থা বলা যাবে না; কিন্তু আমি তখন অনেকটা পথ হেঁটে জেনে গেছি যে, স্রোতের টানে হুবহু মিলে গেলে, আমার কাছে ঠিক যা চাওয়া হয়, সেটুকুর বাইরে কিছু না করতে পারলে, আমার অনেক ক্ষতি হবে – হয়তো আমার স্বাস্থ্য, বিয়ে, অথবা আমার নেশা-থেকে-দূরে-থাকার-প্রতিজ্ঞা টিকবে না। এই তিনটে জিনিস না টিকলে আমার চলবে না বলে আমি মূলস্রোতের বাইরেই থেকে যাই। অথচ সহযাত্রী চাইছি আমি।
তারপর, ২০১৩ সালে, কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে। ওপরাহ্ উইনফ্রে তাঁর ‘সুপার সোউল সানডে’ বলে অতিপ্রিয় এবং বিপুলখ্যাত টিভি অনুষ্ঠানে আমাকে সাক্ষাৎকার নিতে ডাকেন।
শোয়ের আগে এর একজন প্রযোজক এবং আমার ম্যানেজার মারডকের সঙ্গে আমি বাইরে খেতে গেছি। খাবার পর মারডক শুধায়, ‘ব্রেনে, তুমি এখন কোথায়?’
আমি তাকে বেশ চোসত্ম এবং চালাক শুনতে একটা উত্তর দিই, ‘মিশিগান আর শিকাগোর কোনা কেটে অবস্থান করছি।’ কিন্তু বলতে গিয়ে মনে হয়, আমি কিছু একটা ভুল করছি। নিজেকে নাজুক লাগছে আমার। মারডক আমাকে বোঝায় কীভাবে আমি খাওয়ার সময় ‘হাজির’ ছিলাম না। ভদ্র ছিলাম যদিও। আমি মারডকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি ভয় পেলে যা করি, তাই করছি। আমি আমার জীবনের ওপরে হাওয়ায় ভেসে উঠছি, নিজেকে বাইরে থেকে দেখছি পর্যবেক্ষকের ভূমিকায়, অবিকল বাঁচতে পারছি না।’
মারডক মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। জানি। কিন্তু তোমার সেটা বন্ধ করে জীবনেই ফের ফিরে আসতে হবে। যা ঘটতে চলেছে তা বারবার হওয়ার নয়। একে হেলায় হারানো যাবে না যে। পর্যবেক্ষণ নয়। বর্তমানে উপস্থিত থাকো, ব্রেনে।
পরদিন সকালে আমি যখন শোতে যাওয়ার জন্য প্রস্ত্তত হই, আমার কন্যা আমাকে এসএমএস করে। ওর স্কুলের এক ভ্রমণের ব্যাপারে অনুমোদন জানিয়ে একটা সিস্নপে আমার সই দেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চায়। তার বার্তার জবাব দিয়ে আমি বিছানার এক কোনায় বসে বহু কষ্টে কান্না চাপার চেষ্টা করতে থাকি। আমার নিজের একটা অনুমোদনের সিস্নপ লাগবে – যেন এতটা গম্ভীর আর আর্ত না হই। সে-মুহূর্তে মাথায় এক খেয়াল চাপে। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিই কেউ আমাকে লক্ষ করছে কি না। করছে না জেনে একটা সিস্নপে লিখি, ‘তোমাকে উলস্নাস করার, মজা করার আর অদ্ভুত হওয়ার অনুমোদন দেওয়া হলো।’
এমন একশটি সিস্নপ এরপর আমি নিজের জন্য লিখেছি। এখনো লিখি। আমাকে যে তার পাঁচটা মিনিট দিতে রাজি, তাকে আমি এই অভিপ্রায় ঠিক করার পদ্ধতি শেখাই। খাসা কাজ করে। শিশুদের চিড়িয়াখানায় যাওয়ার অনুমোদন দিলে তাদের অবশ্য ঠিকই বাসে উঠতে হয়। সেদিন, আমিও বাসে উঠেছিলাম।
তখন আমি বুঝতে না পারলেও এখন জানি ওই অনুমোদন-সিস্নপগুলোর ভেতর দিয়ে আমি আর কারো নয়, নিজের আপন হওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
ওপরাহ্ এবং আমার ক্যামেরার সামনে প্রথম আবেগঘন সাক্ষাতের কিছু মিনিটের মধ্যেই আমরা হাসছি, ঠাট্টা করছি। তাঁকে যেমনটা ভেবেছিলাম দেখা গেল তিনি ঠিক তেমনটাই। তীব্র, সহৃদয়। অমায়িক, সহিষ্ণু। এক ঘণ্টা চোখের পলকে কেটে গেল। আমাদের সময় যখন শেষ, ওপরাহ্ আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমাদের আরেক ঘণ্টা করা দরকার – আরেকটি টিভি পর্ব।’ আমি চারদিকে তাকাই অস্বসিত্ম নিয়ে।
সত্যি?
ওপরাহ্ মিটমিট করে হাসছেন। ‘সত্যি। অনেক কথা বলা বাকি থেকে গেল যে।’
আমি অন্ধকারে কন্ট্রোল রুম বলে যা মনে হচ্ছিল সেদিক দেখিয়ে বললাম, ‘ওদের কি জিজ্ঞেস করে নিতে হবে?’
ওপরাহ্ আবার মিটমিট হাসছেন। ‘কাকে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে বলে মনে হয়?’
তাঁর কথায় অহংকার ছিল না, আমার প্রশ্ন তাঁর অদ্ভুত শোনাল।
‘ওহ্, তাই তো বটে। দুঃখিত। তাহলে, হ্যাঁ! অবশ্যই! আমার ভীষণ ভালো লাগবে। কিন্তু পোশাক যে পালটাতে হবে! ইস্! আমি মোটে একপ্রস্থ জামা নিয়ে এসেছি।’
‘বুট আর জিন্স ঠিক আছে। তোমাকে একটা জামা দিচ্ছি, দাঁড়াও।’
তিনি ভেতরে পোশাক পালটাতে যাওয়ার সময় দুই কদম হেঁটে আবার ফিরে তাকিয়ে বলেন, ‘মায়া অ্যাঞ্জেলু এসেছেন। কথা বলবে?’
হঠাৎ যেন সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি যেন এক সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়ানো। সময় গড়িয়ে মন্থর হচ্ছে। এতকিছু একদিনে! আমি নিশ্চয়ই মরে গেছি।
‘ব্রেনে? আছো? ডক্টর মায়ার সঙ্গে দেখা করতে চাও কি?’ আমি ভাবছি যেন খাড়া পাহাড় দিয়ে এবার আমাকে ঠেলে ফেলা হচ্ছে, এমন সময় ওপরাহ্ আবার বলেন, ‘চাও দেখা করতে?’
আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বলি, ‘হ্যাঁ! নিশ্চয়ই চাই!’
ওপরাহ্ আমার হাত ধরে আরেকটা গ্রিনরুমে আমাকে নিয়ে গেলেন যেখানে আমি পরের পর্বের শুটিংয়ের জন্য তৈরি হই। আমরা ভেতরে যাই; দেখি এক টিভি স্ক্রিনের সামনে মায়া বসে আছেন। সেই স্ক্রিনে দুটো শূন্য চেয়ার দেখা যাচ্ছে। ওই চেয়ারে আমি আর ওপরাহ্ এতক্ষণ বসে কথা বলেছি।
মায়া অ্যাঞ্জেলু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন ডক্টর ব্রাউন? আমি এতক্ষণ আপনাদের কথা শুনছিলাম।’
আমি তাঁর দিকে এগিয়ে তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে বলি, ‘আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া কী যে সৌভাগ্যের ঘটনা! আপনি আমার কাছে অনেক কিছু। আমার জীবনের একটা বড় অংশ আপনি।’
তিনি আমার হাত ধরে ছিলেন; এবার আরেক হাত আমার সেই হাতের ওপর রাখলেন। ‘আপনি খুব জরুরি কাজ করছেন। থামবেন না। কাউকে থামাতে দেবেন না।’
আমি তখন তাঁকে বলি, কখনো কখনো পড়ানোর সময় ক্লাসে সব আলো বন্ধ করে দিয়ে আমি তাঁর রেকর্ড করা ‘আমাদের মাতামহ’ কবিতাটা ছাত্রদের শোনাই। কখনো সেই লাইন দুবার করে বাজাই, ‘… আমাকে কিছু টলাতে পারবে না।’
তিনি আমার হাত আরো শক্ত করে ধরেন, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর, ধীরকণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘নদীর ধারে বেড়ে ওঠা এক গাছের মতো, আমাকে কিছু টলাতে পারবে না।’ তারপর আমার হাতে উষ্ণ চাপ দিয়ে বলেন, ‘টলাতে দেবেন না, ব্রেনে।’
যেন তিনি সে-মুহূর্তে আমার জীবনে যত সাহস লাগবে সবটুকুকে সঁপে দিচ্ছিলেন। এক বিশেষ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে কদাচিৎ জানা যায়, সে-মুহূর্ত আমাদের নির্ধারণ করে দেবে। কিন্তু আমি জানতে পেরেছিলাম তখন। সারাজীবন যে খাপ খাওয়াতে চেয়েছে হঠাৎ মায়া অ্যাঞ্জেলু তাকেই গান শোনালেন, ‘টলাতে দেবেন না’, বলল সে কী করে? কী আর করবে, তার পা দুটো শিকড় হয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে যায়। সে নুয়ে পড়ে, প্রসারিত হয়, বাড়ে, কিন্তু সত্তা থেকে একচুল না সরার অঙ্গীকার নেয়। অথবা পারতপক্ষে চেষ্টা করে।
সেই অবিশ্বাস্য দিনটির ছয় মাস পর দেখি আমি শিকাগোর আরেকটি গ্রিনরুমে বসে আছি। এবার আমি নেতৃত্বের ওপর পৃথিবীর একটি বৃহত্তম সম্মেলনে এসেছি। যাঁরা অনুষ্ঠানের সংগঠক, তাঁরা পইপই করে বলে দিয়েছেন ধোপদুরসত্ম কালো পোশাকে হাজির হতে হবে। আমি আমার কালো সস্ন¨vং আর পাম্প শুর দিকে তাকাই। নিজেকে ছদ্মবেশী বলে মনে হতে থাকে।
আমি আরেকজন বক্তার পাশে বসে আছি (তিনি আমার বন্ধু হয়ে যান), জিজ্ঞেস করেন আমার কেমন ঠেকছে। আমি স্বীকার করি আমার বেশ খাপছাড়া লাগছে, মনে হচ্ছে আমি অভিনয় করতে এসেছি। তিনি বলেন যে, আমায় দেখতে ‘বেশ ভালো’ লাগছে; কিন্তু তাঁর মুখে লেখা ছিল এক না-শোনা-বার্তা ‘কিন্তু উপায় কী, বলুন?’
আমি হঠাৎ উঠে দাঁড়াই; যে দেয়ালে আমাদের সুটকেসগুলো পরিপাটি সাজানো, সেখান থেকে আমার সুটকেস ওঠাই, এবং ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক পালটে আসি। আমার পরনে নেভি শার্ট, কালো জিন্স, ক্লগ জুতো – আমার সহজাত পোশাক। মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘অসাধারণ। সাহস আছে বটে আপনার!’
জানি না কথাটা তিনি সত্যি ভেবে বলেন কি না, কিন্তু আমি হেসে জানাই, ‘আসলে তা নয়। এটার প্রয়োজন ছিল। ওই মঞ্চে আমি ‘সত্য হওয়ার সাহস’ নিয়ে কিছুতেই কথা বলতে পারব না, যদি না নিজে চর্চা করি। শারীরিকভাবেই পারব না। এখানে আমি তাদের ব্যবসায়ী সত্তার সঙ্গে আলাপ করতে আসিনি। এসেছি আমার হৃদয় ওদের হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলুক এই আশায়।’ এ-ঘটনা ছিল নিজের কাছে আপন হওয়ার আরেক ধাপ।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতের সঙ্গে টক্কর খাই। একটা নোট পড়তে পড়তে দেখি এক সংগঠক লিখেছেন, ‘আমরা শুনলাম আপনি গত বছর এক সম্মেলনে কথা বলেছেন। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি আপনি আমাদের পরিচালকদের সঙ্গেও কথা বলবেন! আমরা আপনাকে বলতে শুনেছি, মানুষের গভীর মূল্যবোধগুলো জানা দরকার – সে-কথা আমাদের ভালো লেগেছে। আপনি অবশ্য বলছিলেন আপনার চালিকা-মূল্যবোধের দুটোর একটা নাকি আধ্যাত্মিক বিশ্বাস। কিন্তু যেহেতু আমরা এই মুহূর্তে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলছি, সুতরাং আপনাকে অনুরোধ করি বিশ্বাস-টিশ্বাস নিয়ে কিছু না বলতে। আপনার প্রধান মূল্যবোধের আরেকটি, আপনি জানিয়েছেন – হিম্মত। আপনি হিম্মতের ওপর আপনার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখুন, দয়া করে।’
আমি বুঝতে পারছি আমার বুকের খাঁচায় টান পড়ছে, আমার চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। গত বছর ঠিক এমন এক ঘটনা ঘটে। যদিও ঠিক এর উলটো মেরুর ঘটনা বলা চলে তাকে। একটি অনুষ্ঠানের সংগঠক আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার সোজাসাপটা ঘরোয়া কথা বলার ধরন’ তাঁর পছন্দ হয়; কিন্তু আমি যেন কথা বলার সময় মুখ খারাপ না করি, কারণ তা করলে ‘ধর্মভীরু শ্রোতা’দের আমি হারাব; তারা হয়তো আমাকে ক্ষমা করে দেবে – তবে চোট পাবে ঠিকই।
বাজে কথা। আমি এ পারব না। তার চেয়ে কিছু না বলাই ভালো। দৌড়ঝাঁপের এখানেই ইতি।
সারাজীবন আমার মানুষের অভিজ্ঞতা শুনে কেটেছে। তাদের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তের কথা। সবচেয়ে বেদনাময় সময়ের কথা। পনেরো বছর ধরে এই কঠিন কাজ করার পর আমি আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলতে পারি, বেদনা আর হিম্মতের প্রতিটি গল্পেই দুটি সর্বজনীন বিষয় আছে – প্রার্থনা আর মুখ খারাপ করা। কখনো দুটো একসঙ্গে ঘটে।
আমি আমার স্নিকারস পরি আর ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাই। বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যেতেই আমি এই চিঠি এবং এই ধরনের সব চিঠির জবাব কী দেবো, বুঝে উঠতে পারি : আপনি যদি ভেবে থাকেন মানুষের সত্যিকার অভিজ্ঞতার পুঁজ আর পাঁক আমি পরিষ্কার করে উপস্থাপন করব, অথবা ঘষে মেজে নেব, আপনি ভুল করছেন। আমি খুব একটা মুখ খারাপ নিশ্চয়ই করব না, কিন্তু দু-একটা আটপৌরে খিসিত্ম যদি আপনারা সহ্য করতে না পারেন, এমন ভাব দেখান যে মুখ খারাপ করার অর্থ আমার বিশ্বাস-টিশ্বাস নেই, তাহলে এটা আমার জায়গা নয়। বক্তার যখন অভাব নেই, আপনারা তাদের নিয়ে আসুন যারা ধোপদুরসত্ম, পরিপাটি, অথবা যারা স্রেফ মুখে কুলুপ এঁটে রাখে। আমি সে-বান্দা নই। ব্যস।
আমাকে টলানো যাবে না!
স্টিভ বাড়ি ফিরলে আমার এই সর্বশেষ সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম। ‘বড্ড কঠিন মনে হয়’, আমি বলি, ‘আমি কোথাও খাপ খাওয়াতে পারি না। কোথাও আপন হতে পারি না। যেখানে যাই, আমি একজন বহিরাগত যে নিয়ম ভাঙে, যে এমন কথা বলে যা আর কেউ বলে না। আমার কোনো সহযাত্রী নেই। এমনভাবেই সারাটা জীবন কেটে গেল।’
স্টিভ আমাকে সান্তবনা দেওয়ার চেষ্টা করে না। বরং মাথা নাড়িয়ে জানায়, আসলেই আমি কোনো বিশেষ দলে পড়ি না। এও বলে, আমি স্টিভ, এলেন আর চার্লির আপনজন, এবং ওদের সামনে আমি যত খুশি প্রার্থনা আর মুখ খারাপ করতে পারি।
আমি একটু মস্নান হাসি, কিন্তু চোখ ভিজে উঠতে থাকে। ‘সারাজীবন আমি বাইরেই থেকে গেলাম’, বলি তাঁকে, ‘ব্যাপারটা এমন কঠিন। কখনো কখনো আমাদের বাড়ি সেই একমাত্র জায়গা যেখানে আমার অসম্ভব একা লাগে না। আমি হয়তো যে-পথে আছি সে-পথটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারিনি – এখানে তো আর কেউ নেই। কেউ বলছে না, ‘তোমার আগে এরকম একজন আছে – যিনি একাধারে অধ্যাপক, গবেষক, কথক, নেতৃত্বের সংগঠক, ঈশ্বর বিশ্বাসী, মুখ খারাপ করা লোক।’
স্টিভ আমার হাত ধরে বলে, ‘বুঝতে পারি এটা কত কঠিন। তোমার নিশ্চয়ই একা লাগে। তুমি কিছুটা অদ্ভুতও বটে – অনেক দিক থেকে খুব আলাদা। কিন্তু ব্যাপার হলো, ওই বিশাল নেতৃত্বের সম্মেলনে বিশজন বক্তার মধ্যে তুমি ছিলে শ্রোতাদের বিচারে সেরা বক্তা। সাদামাটা ঘরোয়া পোশাকেই এমন হয়েছিল। যদি তা-ই হয়, ওই মঞ্চ তো তোমারই। তুমি যেখানেই নিজের সত্তাকে মেলে ধরবে, নিজের কাজ নিয়ে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারবে, সেটাই তোমার নিজের জায়গা।’
ঠিক সে-মুহূর্তে ব্যাপারটা ঘটে।
আমি মায়া অ্যাঞ্জেলুর কথাটার গভীর ও ব্যবহারিক তাৎপর্য বুঝতে পারি। আমি স্টিভকে চুমু খেয়ে, দৌড়ে আমার পড়ার ঘরে ঢুকি, ল্যাপটপে বসি আর গুগলে মায়ার সেই বিখ্যাত উদ্ধৃতি খুঁজি। ল্যাপটপটা স্টিভের কাছে নিয়ে গিয়ে ওকে পড়ে শোনাই :
আমরা কেবল তখন মুক্ত যখন আমরা অনুধাবন করি, কোনো স্থান আমাদের আপন নয় – সব স্থান আমাদের আপন – সেটা কোথাও নয়। এর জন্য চড়া দাম দিতে হয়। পুরস্কারও অনবদ্য।
আরে ঠিক সে-মুহূর্তে আমি নিজেকে আগাগোড়া যেভাবে দেখে এসেছি – একটা মস্নvন, নিঃসঙ্গ মেয়ে, যে আপন স্থান খুঁজে নিতে গিয়ে স্কুলের তালিকায় নিজের নাম তালাশ করে, সেই ছবি আমার কাছে আমূল পালটে যায়। আমার কাজে আমি সফল হয়েছি। আমার একজন অসাধারণ জীবনসঙ্গী আছে, চমৎকার দুটো ছেলেমেয়ে আছে। কিন্তু সে-মুহূর্তের আগে আমি আমার নিজের ভুবনের কাছে, আমার জন্মসূত্রে পাওয়া পরিবারের সঙ্গে যেন আপন হতে পারিনি।
স্টিভ টের পায় কিছু একটা পরিবর্তন ঘটছে। ‘এর জন্য চড়া দাম দিতে হয় ঠিকই। কিন্তু পুরস্কার হলো – তোমার কাজ দুনিয়ার কাছে খোলামেলা পৌঁছতে পারছে। যারা তোমাকে তাদের কাহিনি খুলে বলেছে, তাদের সঙ্গে সৎ থেকে।’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, একা একা দাঁড়িয়েও সত্যিকার অর্থে সব স্থানকে আপন করে পাওয়ার এই অদ্ভুত দ্বৈততা সে বুঝতে পারছে কি না। সে বলে, ‘হ্যাঁ। কখনো কখনো আমারও এমন হয়। এর মধ্যে একটা আপাতবিরোধী ব্যাপার আছে। নিজেকে একা লাগে, আবার একই সঙ্গে শক্তি পাওয়া যায়। অনেক সময় শিশুডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও আমি ছোটদের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দিতে বারণ করি। এতে শিশুদের মা-বাবারা বিরূপ হন। আমাকে বলেন, ‘শিশুডাক্তার সকলেই তো কথায় কথায় অ্যান্টিবায়োটিক সুপারিশ করেন। এ আবার কেমনতর চিকিৎসা! আমরা বরং অন্য কারো কাছে যাই।’ ডাক্তার হয়ে এ-কথা শোনা সহজ নয়; কিন্তু আমি সবসময় মনে করি : ‘আমি শিশুর জন্য যা ভালো বলে বিশ্বাস করি সেটাই বলেছি। ব্যস।’
আমার চিমত্মায় যেন আরো একজোড়া চাকা যোগ হয়। আমি বলি, আমি যদিও একা দাঁড়ানোকে এক নাজুক এবং সাহসী অবস্থান হিসেবে চিনতে পারছি, তারপরও আমি জানি – একটা যোগসূত্র একটা একাত্মতাবোধের জন্য আমাদের মধ্যে হাহাকার থেকে যায়। আসলে আমি নিজস্ব এক ‘বাহিনী’ চাই। ‘সেই বাহিনী তো তোমার আছে’, স্টিভ বলে, ‘যদিও সে এক ছোট বাহিনী। আর তোমার বাহিনীতে সবাই একভাবে চিমত্মা করবে, কাজ করবে – এমন তো নয়। সত্যি বলতে কী, সেরকম বাহিনী আমাদের সবার আছে।’ আমি টের পাই, ওর কথা ঠিক; কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
অবশেষে আমি উঠে দাঁড়াই। স্টিভকে জানাই আমাকে এই সবকিছুর মানে বের করতে হলে মায়া অ্যাঞ্জেলুর উদ্ধৃতি আর আমার সংগ্রহে থাকা সমসত্ম উপাত্তের কাছে ফিরে যেতে হবে। এর উত্তরে স্টিভ যা বলে তা মনে করলে এখনো হাসি পায়। ‘ও, হ্যাঁ। এবার কী হবে আমার জানতে বাকি নেই। তোমার গবেষণার ওই খরগোশের গর্তের মধ্যে খাবার পৌঁছে দিতে হবে তো? দেবো। গতবার সেই গর্ত থেকে বেরোতে তোমার দুই বছর লেগেছিল।’
আমি বিল ময়ার আর মায়া অ্যাঞ্জেলুর সেই সাক্ষাৎকার খুঁজে বের করে ফের খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। শেষের অংশ এতদিনে খেয়াল করে পড়লাম :
ময়ারস : আপনি কোথাও আপন বোধ করেন?
মায়া : এখনো করিনি।
ময়ারস : এমন কেউ আছে আপনি যার আপন?
মায়া : তা আছে বইকি। রোজ একটু একটু করে সেই মানুষের সঙ্গে আমার আপন হওয়া কেবল বেড়েই চলেছে। সত্যি বলতে কী, আমি নিজেরই পরম আপন। এতে এক ধরনের গর্ব আছে, বুঝলেন? আমি মায়ার দিকে কেমন করে তাকাই সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট নজর দিতে হয়। ওর সাহস আর রসবোধ আমার দিব্যি লাগে। আমি যখন এমন কিছু করি যা আমাকে অখুশি করে, তখন, … তখন সে-ব্যাপারে আমাকে সচেতন হতে হয়।
আমি এই আলোচনা পড়া শেষ করে ভাবি, মায়া মায়ার আপন। আমি আমার আপন। এবার বুঝলাম। এখনো পুরোটা বুঝিনি, কিন্তু বুঝতে শুরু করেছি।
এবার গবেষণার গর্ত থেকে বেরোতে লাগে চার বছর। আমি পুরনো উপাত্তে ফিরে যাই। নতুন উপাত্ত জমাই। আর ক্রমশ ‘আপন হওয়ার তত্ত্ব’ জমাট বাঁধতে শুরু করে।
টের পাই আপন হওয়া কাকে বলে বুঝতে অনেক বাকি থেকে গেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.