কালি ও কলম-এর প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক, কবি, চিত্র-সমালোচক, প্রগতিশীল চিন্তার ধারক-বাহক আবুল হাসনাত স্মরণে গত ১১ই জুলাই ২০২৩-এ অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘আবুল হাসনাত স্মারক বক্তৃতা’।
বেঙ্গল শিল্পালয়ের লেভেল ১-এ সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হওয়া এই বক্তৃতার এবারের বিষয় ছিল ‘সংস্কৃতির বিপন্নতা, সংস্কৃতির শক্তি’। অনুষ্ঠানে মূল বক্তা ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কালি ও কলমের সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। আরো বক্তব্য রাখেন আবুল হাসনাতের সহধর্মিণী নাসিমুন আরা হক। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।
কৈশোর-উত্তীর্ণ কাল থেকে আবুল হাসনাতের সামাজিক দায় ও অঙ্গীকার গড়ে উঠেছিল। এই দায়ই তাঁকে সবসময় চালিত করেছে বহুমুখিন সাংস্কৃতিক, সাহিত্যিক ও সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে এতাত্ম হতে এবং সে-আন্দোলনকে গতিসচল করার কাজে তৎপর হতে। এই দায় আমৃত্যু তিনি বহন করেছেন আপন জীবনজিজ্ঞাসা ও অন্তরের তাগিদে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ছাত্রাবস্থায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নে এবং পরবর্তীকালে যোগ দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রায় পুরোটা সময় পার্টির নির্দেশে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অবিচল লক্ষ্যে কলকাতায় থেকে কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।
তিনি বিশ^াস করতেন, একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার পেছনে ক্রিয়াশীল থাকে সে-দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও গতিশীলতা। সেই বিশ্বাস থেকেই হোক বা আন্তর-তাগিদের জন্যই হোক, আবুল হাসনাত সাহিত্যচর্চা ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন আজীবন। যুক্ত ছিলেন ছায়ানটসহ বহু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। এছাড়া অসাম্প্রদায়িকতাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরকার বন্ধন মজবুত করার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে। তাঁর কথায়-লেখায়-কর্মে সেই ভাবনা বারবার প্রতিভাত হয়েছে।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সংস্কৃতির অনেক সংজ্ঞাগত পরিবর্তন ঘটেছে। এ পরিবর্তন আমাদের দেশেও লক্ষণীয় মুক্তিযুদ্ধ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন হয়ে ঊনিশ শতকের মিশ্রণে এবং মনের উপনিবেশমুক্তি না ঘটার কারণে আমাদের সংস্কৃতি গত তিন থেকে চার দশকে অনেকটাই বদলে গেছে। সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতার একটা সম্পর্ক আছে। আছে শ্রেণি ও পুঁজিরও।
তিনি বলেন, একুশ শতকের এ-সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ কতটা বিধ্বংসী হয়ে দাঁড়িয়েছে তা আমাদের এ-উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার নানা অঞ্চল, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। পশ্চিমের উদারপন্থীরা এখন সংস্কৃতির সম্ভাব্য বিপন্নতা নিয়ে কথা বলছেন। অথচ যে পুঁজি ও ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদ এসব সৃষ্টি করেছে, সেসব নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন না।
অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হাসনাত ও আমি একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। পরে লেখালেখির সময় তাকে পেয়েছি সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে, কালি ও কলমে। হাসনাত নেই, আমারও লেখালেখি শেষ। কারণ তাঁর আহ্বানেই আমার অধিকাংশ লেখাগুলো তৈরি করেছিলাম।’
তিনি উল্লেখ করেন, সংস্কৃতি বলতে বোঝায় গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের ভাষা-কর্ম-আচার-আচরণকে। কিন্তু কালক্রমে সংস্কৃতির সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। আগে গ্রামীণ ও শহুরে সংস্কৃতিতে পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও এখন সেটা উচ্চ ও নিম্ন মার্গে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এছাড়া সংস্কৃতির ওপর চেপে বসেছে পুঁজিবাদ। এগুলো কোনোটাই নিজ সংস্কৃতির বিকাশ ও ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য অনুকূল নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কালি ও কলমের সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া বলেন, আবুল হাসনাতের স্মরণ উপলক্ষে এ-আয়োজনে নানা বিষয়ে বিবেচনা করার, ব্যাখ্যা করার সুযোগ পেয়েছি। এর মধ্য দিয়ে নানা ধরনের জিজ্ঞাসা তৈরি হবে, এটি আমাদের বড় প্রাপ্তি।
তিনি আরো বলেন, আমরা চেষ্টা করব কালি ও কলম এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এ-ধরনের প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান আরো আয়োজনের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি সোহরাব হাসান, সাহিত্যিক ডা. মোহিত কামাল এবং আরো অনেক সুধীজন।
– কালি ও কলম প্রতিবেদন
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.