আমরা করবো জয় একদিন

আগস্টের শেষ দিকে কমান্ডার সদরুদ্দীনের কাছ থেকে নির্দেশ আসে ।

প্রচুর জলকাদা ভেঙে হাতে-লেখা চিরকুটে সেই নির্দেশ নিয়ে এসেছে লোকটি । পড়ন্ত বিকেল তখন। আকাশে গুমোট মেঘ । কদিন ধরে বরষার মাতামাতি চলছে। থামাথামির নাম নেই। চারদিকের পৃথিবী ভিজে চুবচুবে হয়ে রয়েছে।

আমাদের হাইড আউট গুয়াবাড়ির জোনাব আলীদের বাড়িতে। পিছল আঙিনা ভেঙে ছেলেরা চলাফেরা করে । প্রধান সমস্যা শুকনো কাঠ । যুদ্ধের ভাষায় লাকড়ি । এই লাকড়ির সমস্যা নিয়ে সব সময়েই পীড়িত থাকে লংগর কমান্ডার মিনহাজ। সেকশন কমান্ডার একরামুল এ ব্যাপারে খুবই করিৎকর্মা। জোনাব আলীর দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ছোটভাবি সম্পর্ক পাতিয়ে বসেছে। তার সাহায্যেই লাকড়ির যোগান দেওয়ার চেষ্টা। মহাব্যস্ত আর ত্যক্ত-বিরক্ত মুখের মানুষ মিনহাজ। তার ওপর দায়িত্ব হাইড আউটের শতাধিক ছেলের তিনবেলা খাদ্যের যোগান দেওয়া, কিন্তু এতে তার ফাঁকি- ঝুঁকি নেই। যেভাবেই হোক ক্লান্তিহীন পরিশ্রম দিয়ে সে ভরা-বরষার মধ্যেও সব কিছু যুগিয়ে যাচ্ছে সময়মতো ।

জোনাব আলীরা ধনী নয় আবার গরিবও নয়। কিন্তু যুদ্ধের এই ডামাডোলে পড়তে হয়েছে প্রায় হা-ভাতে অবস্থায় । চাষবাস লাটে উঠেছে। বাজার-গঞ্জে যাওয়ার উপায়ও নেই পাকসেনাদের ভয়ে । গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই চলে গেছে ওপারের শরণার্থী শিবিরে। তারা যায়নি । মানে যেতে পারেনি বাড়িঘর ছেড়ে। সীমান্তের কোলঘেঁষে তালমা নদী পারের এই বসতিটায় আমরা এসেছি দুদিন আগে। হাইড আউট হিসেবে এর অবস্থান চমৎকার । গাইড হিসেবে জোনাব আলীর বিশ্বস্ততাও তুলনাহীন।

ঘরবাড়িগুলো হয়ে পড়েছে জরাজীর্ণ। কখন খানসেনা আসে, কখন পালাতে হয় এই শঙ্কাযুক্ত ভয় সব সময়ে এই অসহায় আর ভেঙেপড়া মানুষগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে গভীরভাবে। এমনি অবস্থায় এক রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আমরা এখানে উঠে এসেছি। এতে এদের ভেঙেপড়া মনোবল চাঙ্গা হয়েছে অনেকটাই। এখন এরা এটা নিশ্চিত হয়েছে, খানসেনারা অন্তত আসবে না। এলেও ঠেকিয়ে দেবে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা ।

এইরকম ভিজে স্যাঁতসেঁতে দিনে কমান্ডারের প্রেরিত বার্তা। আমরা বাইরের দহলিজ ঘরটায় বসে সে রাতের চৈতনপাড়া ব্রিজ আক্রমণ বিষয়টির চূড়ান্ত পরিকল্পনা কাজে ব্যস্ত ছিলাম । পিন্টু, বকর, মুসা এই তিন কমান্ডার আমাদের গাইড। যার ছিল আমার সাথে। আর ছিল জোনাব আলী ভাষায়, ‘এই এলাকায় রাস্তাঘাট তার কাছে ঘষঘষা কাচের নাহান পরিষ্কার।’ কমান্ডারের নির্দেশ প্রতিপালিত হতেই হবে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। গেরিলাযুদ্ধের চোরাগোপ্তা যুদ্ধ থেকে একেবারে সম্মুখযুদ্ধে যাওয়া। সেই এগুলো কিছুই নেই। গেরিলাযুদ্ধে প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি, পোশাক-আশাক শত্রুকে দেখা যায় না। সম্মুখযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে হয়। শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি জেনে নিয়ে স্বাধীনভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা করা যায়। সার্বক্ষণিক শত্রুর কামান-মর্টারের গোলা মাথার ওপর ছুটে আসে না। কিন্তু সম্মুখযুদ্ধের চিত্র ভিন্ন। সেখানে সরাসরি প্রতিদিনের যুদ্ধ । শত্রু ভয়ংকর। জীবন-মৃত্যু সব সময়েই সেখানে বাস্তবতা নিয়ে হানা দেয়। নির্বাচিত ছেলেদের মধ্যে ভীতি। এখানে যারা থাকবে তাদের কেমন একা হয়ে যাওয়া, শক্তি কমে যাওয়া । জোনাব আলীদের শঙ্কা, মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমে গেলে তাদের যুদ্ধশক্তিও কমে যাবে । যদি খানসেনারা আসে তখন কি এনারা সামাল দিতে

পারবেন?

যাচ্ছিতো মাত্র কদিনের জন্যে। সেকেন্ড ইন-কমান্ড পিন্টুকে দায়িত্ব নিতে হয়। অমরখানা থেকে টুনিরহাট বিরাট একটা এলাকা। সবটাই শত্রুকবলিত। এর মধ্যে সামান্য একটা ভুল সিদ্ধান্ত বয়ে আনতে পারে দলের জন্য ভয়াবহ বিপদ। ওকে সব বুঝিয়ে দেই। অন্যদের বলি, মাত্র কটা দিন, হয়তো সপ্তাহ খানেক, তারপরতো ফিরছি । পিন্টু বলে, একা হয়ে যাবো মাহবুব ভাই, তাড়াতাড়ি চলে আসবেন । সবার চোখে জল, তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন, একটাই আকুতি। বনে-জঙ্গলে বিপদ-আপদ, প্রতিকূল পরিস্থিতি আর প্রতিরাতের যুদ্ধ নিয়ে যে গেরিলাজীবন তা ভেঙে বের হয়ে আসা কঠিন। এ এক অদ্ভুত ভ্রাতৃত্ববোধের বন্ধন, যা গড়ে উঠেছে প্রশিক্ষণশিবির থেকে এই যুদ্ধের মাঝে এবং টিকে থাকবে আমৃত্যু ।

সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে রাতের আঁধারে বেরিয়ে পড়তে হয়। পাকা সড়ক সীমান্তের ওপারে। হাঁটা পথে শর্টকাট মেরে পাঁচ মাইলের মতো। জহুরী বাজার। সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য গাড়ি, যা আমাদের নিয়ে যাবে উদ্দিষ্ট গন্তব্যে ।

দুই

বিকেলের শেষ আলোটুকুর মুখে পাকা সড়কের ওপর নামিয়ে দিয়ে ট্রাকটি চলে যায়। ড্রাইভারের নাম রহমান। ছোটখাট হাসিখুশি মানুষ। ট্রাকের গায়ে লেখা টিএসএম। অর্থাৎ ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস। ড্রাইভার রহমান ট্রাকটা নিয়েই সীমান্তপাড়ি দিয়ে ফ্রন্টে যোগ দিয়েছে। মিত্রবাহিনীর সামরিক লরির পাশাপাশি এধরনের বেশ কটি গাড়ি এখন এই ব্যস্ততম ফ্রন্টে সদাব্যস্ত সময় পার করছে। মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব পালন করেছে মূলত বাংলাদেশ থেকে চালিয়ে নিয়ে আসা গাড়িবহর। কটি জিপ পাঁচ-সাতটা ট্রাক, ট্রাক্টর, ট্রলি এগুলো। অধিকাংশই পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের মালিকানায় ছিল যুদ্ধের আগে । এখন নিয়োজিত দেশের এই চরম পরিস্থিতে জয়বাংলা তথা স্বাধীনতার যুদ্ধে ।

বাংলাবান্ধা। তেতুলিয়া থানার শেষ মাথা। বাংলাদেশ সীমানার অংশে ট্রাক থেকে মাল-সামান নামিয়ে ড্রাইভার রহমান চলে যায় ভজনপুর ফ্রন্টের উদ্দেশে। সেখানে অপেক্ষমাণ তার জন্য অন্য দায়িত্ব। আমাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে ফ্রন্ট কমান্ডার সদরুদ্দীনের জন্যে। তার কাছ থেকেই পাওয়া যাবে চূড়ান্ত ডিপ্লোয়মেন্ট অর্ডার ।

সাথে রেশন, অস্ত্র, গোলাবারুদ। সড়কের পাশে তাঁবু খাটানোর ব্যবস্থায় লেগে যায় ছেলেরা। হাবিলদার রওশন জানিয়ে দিয়েছেন, আপনাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হবে । বিওপিতে জায়গা নেই । রেশন কম, খাবার দেওয়াও যাবে না। বাংলাবান্ধার এই বিওপিতেই আমাদের রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। ধারণা ছিল সমাদর-টমাদর ভালোই জুটবে, যেহেতু যুদ্ধের মাঠ থেকে আসছি। কিন্তু পরিবেশ সম্পূর্ণ উলটো । ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার মুকিউদ্দিন ভুরু কুঁচকে আমাদের সংখ্যাটা জানতে চেয়েছেন। আবার কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছেন, এফএফ? স্কুল- কলেজের পোলাপান? তারপর হাবিলদার রওশনের ওপর দায়িত্ব দিয়ে বলেছেন, এনাগো দেখভাল করেন। স্কুল-কলেজের পোলাপানগো ফ্রন্টে পাঠানো হইতেছে। যা হইবার হইবো। প্রাক্তন ইপিআর সুবেদার এরপর সুখী ও আয়েশী মানুষের মতো চলনভঙ্গি নিয়ে বিওপির দিকে এগিয়ে যান । সামনেই চলছে মরণপণ যুদ্ধ। কিন্তু সুবেদার মুকিমউদ্দিনের যেন তাতে কিছুই যায় আসে না। নিরাপদ দূরত্বে বসে তিনি শান্তিপ্রিয় জীবনযাপন করছেন । আমাদের প্রতি তার তাচ্ছিল্যভরা উক্তি মোটেই ভালো লাগে না । পরিবেশটা কেমন বৈরী মনে হয়।

হাবিলদার রওশনের রূঢ় ধরনের ব্যবহার সেটি আরো বাড়িয়ে দেয়। আমাদের তিনি ফল-ইন হতে বলেন। ছেলেরা গাঁইগুঁই করলেও সবাই দাঁড়িয়ে যায়। তিনি ডিসিপ্লিনের ওপর লম্বা বক্তৃতা দেন। তারপর সোজা- সাপটা জানিয়ে দেন থাকার জায়গা দেওয়া যাবে না, খাবার দেওয়া যাবে না, যেটা তিনি আগেও বলেছেন। এরপর বলেন, অস্ত্রপাতি সব বিওপিতে জমা দিতে হবে। তার হুকুম-হাকাম ছাড়া এদিক-ওদিক যাওয়া যাবে না। সেন্ট্রি ডিউটি, পেট্রল ডিউটি এগুলো ভালোভাবে দিতে হবে। চারদিকে শত্রু গিজগিজ করতেছে। বাইরের কারো সাথে কথা বলা যাবে না। কোনো গন্ডগোল, হট্টগোল বরদাশৎ করা হইতো ন। রাইতের বেলা আলো জ্বালানো নিষেধ বুঝচোননি? শেষের উচ্চারণ দ্বারা বোঝা যায় লোকটির বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলে। কিন্তু এর মাতবরী অসহনীয় মাত্রায় যাওয়ার আগেই থামিয়ে দিতে হবে। নইলে ছেলেরা বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। এজন্যে অবশ্যই সময় আসবে। মনের মধ্যে এই ভাবনা রেখে ছেলেদের বিরতি দিয়ে দেই। নিজেদের কাজে চলে যায় সবাই। নতুন জায়গায় অস্থায়ী আস্তানা পাততে হচ্ছে। রান্নাবান্নার ব্যবস্থাও করতে হবে। সামনে অনেক কাজ । দূর থেকে একটানা গুড়ুম-গুড়ম কামানের গর্জন ভেসে আসে। জানান দিয়ে যায় যুদ্ধ আছে, চলছে সামনে কোথাও। সেখানেই যেতে হবে। আমাদের। বুকের গভীরে হিম-ধরানো ভয় কেমন একটা অস্থিরতার মধ্যে ডুবিয়ে রাখে ।

শেষ রাতে আমাদের এ জায়গাটায় নামিয়ে দিয়ে গেছে ড্রাইভার রহমান। তখন পরিবেশটা বোঝা যায়নি। পেটে ক্ষুধার আগুন। প্রচ- শারীরিক ধকল । পাথরের নুড়িবিছানো রাস্তা। তার ঢালে শরীর এলিয়ে দিয়ে বাকি রাতটা পার হয়েছে। সকালের আলো ফুটতেই আবু বকর কাজে নেমে পড়েছে। প্রথমেই রান্নার ব্যবস্থা। সেটাই এখন জরুরি কাজ । তাতেই হাত দিয়েছে কজনকে সাথে নিয়ে গোছানো ছেলে বকর।

সকাল দশটার দিকে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া যায়। দাঁড়িয়ে যায় তাঁবুগুলো। সুবেদার মুকিমউদ্দীন কাজকর্ম দেখে গেছেন সেই একই ভঙ্গি নিয়ে। হাবিলদার রওশন মাঝে মাঝেই আসছেন আর ‘এটা করেন, ওটা করেন’ আদেশ-নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। লোকটার ব্যবহার যাচ্ছেতাইভাবে অশালীন— ‘কেন যে এরা খ্যাপে আছে বুঝতে পারি না। লড়াই চলতাছে ভজনপুরের দখল লইয়া। ক্যাপ্টেন সাব রইছেন সেইখানে। তিনি আইলে আপনাগো পাঠানো হইবো । খানেগো লগে যুদ্ধ, বুঝচোননি?’ তার মুখে রূঢ় হাসি । লোকটার উপস্থিতি এবং কথাবার্তা ভালো লাগে না । কিন্তু উপায়ই বা কী! স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন যে কবে আসবেন?

ফ্রন্ট এখান থেকে ২৫-৩০ মাইল দূরত্বের মধ্যে। কিন্তু যুদ্ধ এখান থেকে স্পষ্টভাবে অনুভূত হয়। রাতের বেলা তা যেন বিভীষিকা ছড়িয়ে দিয়ে কাছাকাছি চলে আসে। বাদলদিনে আবহাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই । যখন-তখন গড়গড়িয়ে বৃষ্টি নামে। কিছুক্ষণ পর আবার শুকনো খটখটে রোদভরা দিন । ভ্যাপসা চিটচিটে গরম। তাঁবুর ভেতর সেদ্ধ হতে হয়। এর মধ্যেই ছেলেরা কাজ করে। আর সেই সাথে অপেক্ষা, কখন সেই ঈপ্সিত ডাক আসবে ফ্রন্টে যাওয়ার। এখন শুধু তিনবেলা খাবার তৈরি, সকাল বিকেল ফল-ইন। সন্ধের পর সেন্ট্রি আর পেট্রল ডিউটি। আবু বকরের কর্তৃত্বে এ কাজগুলো মোটামুটি সুষ্ঠুভাবেই চলে। যদিও লংগর কমান্ডার মমতাজের সমস্যার অন্ত নেই। বর্ষাবাদলের দিনে ভিজে মাটিতে চুলো বানিয়ে এতোগুলো ছেলের তিনবেলা আহার যোগানোর বিষয়টি সত্যিকারভাবেই কষ্টকর কাজ। নিজেদের খেতে হবে এই ভাবনা থেকেই ছেলেরা তাকে ভলানটিয়ার করে সাধ্যমতো ।

তিন

দুটো দিন হলো আমরা এখানে এসেছি। ঝমঝম বৃষ্টি এলেই তাঁবুর আশ্রয়ে শুয়ে-বসে থাকা। অলস সময় মনের ওপর কেমন অনিশ্চয়তার প্রভাব বিস্তার করে। এর মধ্যে হাবিলদার রওশন উড়োকথা শুনিয়ে যায়। ‘শুনচোননি ফ্যাডম ভাইরা, আপনাগো তো অমরখানা ফ্রন্টে পাঠাইতেছে। তৈরি থাকেন।’

এই কথায় ঝিম মেরে যায় সবাই। অগ্নিগর্ভা যুদ্ধের ফ্রন্ট অমরখানা। দেশের উত্তরাঞ্চলে শেষ পাকিস্তানি ঘাঁটি । পাকা কংক্রিটের বাংকার, ট্রেঞ্চ – এগুলো দিয়ে দুর্ভেধ্য করে তৈরি করেছে তাদের শক্তিশালী ডিফেন্স লাইন। সেই সাথে বাছাই করে সমাবেশ ঘটিয়েছে ব্যাটালিয়ন সমান পাঞ্জাব, বেলুচ রেজিমেন্টের নিয়মিত সৈনিক । সাথে আছে ইপিক্যাফ, রাজাকার । আর্টিলারি মর্টারের পাশাপাশি অনেকগুলো মেশিনগানপোস্ট। প্রচ-তর তাদের ফায়ার পাওয়ার । সেখানে পাঠানো মানে সরাসরি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া। সেতো ভয়াবহ ব্যাপার!

আবু বকর বলে, আমাদের নাকি অমরখানা পাঠাচ্ছে?

– পাঠাতে পারে । জানি না ঠিক ।

– হাবিলদার বলে গেল, মিছা কথা নাকি?

-সত্যিও হতে পারে।

-তাহলে?

তাহলে কি?

আমাদের দেওয়া হয়েছে গেরিলা ট্রেনিং। করছিলামও গেরিলা যুদ্ধ। হালকা অস্ত্রশস্ত্র আমাদের। খানদের তুলনায় সেগুলোতো বাঁশের লাঠির মতো। আমাদের সম্মুখযুদ্ধে পাঠাবে কেন?

বুঝতে পারছি নারে বকর। আমাদের লোকক্ষয় হয়েছে প্রচুর। ফ্রন্টে শক্তি বাড়ানো দরকার। এজন্যে যাচ্ছি আমরা রি-ইনফোর্সমেন্ট মানে শক্তিবৃদ্ধির জন্যে । সামনে না গেলে কিছুই বোঝা যাবে না।

যদি ফ্রন্ট ফাইটে লাগিয়ে দেয়?

– কি করবি, দলবল নিয়ে পালাবি?

না, সে কথা নয়। এ্যাটে ইপিআররা বসি বসি বাতাস খাওছে, আর হামাক মাইরবার জন্যে ফ্রন্টে পাঠাওছে। খানের সাথে ফ্রন্ট ফাইট, এটা কি খেলা কথা?

রংপুর নাগেশ্বরীর ছেলে বকরের কথায় হতাশা। এখানে আসার উদ্দেশ্য কমান্ডারের নির্দেশেই উল্লেখ ছিল। কিন্তু বাস্তবতার সামনা-সামনি হতে গিয়ে বারবার এই কথাটা ঘুরেফিরে আসে, গেরিলাযুদ্ধের জন্যে ট্রেনিং নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে পাঠানোর মধ্যে কোনো যুক্তি নেই। মানসিকভাবে ছেলেরাও ভেঙে পড়েছে। দূর থেকে ভেসে আসে অবিরাম গুড় গুড় গুম-গুম ধ্বনি। উচ্চকিত হয়ে তা শোনে সকলে। ভয় একটা সংক্রামক ব্যাধির মতো। দ্রুতই তা ছড়িয়ে পড়ে সকলের মধ্যে।

এ থেকে পরিত্রাণের রাস্তা একটাই। ছেলেদের ব্যস্ত রাখা কাজ দিয়ে। খলীলের নেতৃত্বে দল গঠন করে দিয়ে তাদের নির্দেশ দেই আশেপাশের লোকালয়গুলো হতে শুকনো লাকড়ি যোগাড় করে আনার জন্যে । এ কাজে তাদের উৎসাহের শেষ নেই। তাঁবুর বাইরে যাওয়া যাবে। সিভিল মানুষদের সাথে মেশা যাবে। তাঁবুর বন্দিজীবন আর সার্বক্ষণিক শৃঙ্খলার বাঁধন হতে মুক্ত হতে চায় সবাই ।

ঘণ্টা দুয়েক পর মহা হৈ-চৈ তুলে ফিরে আসে দলটি। কাঁধে-পিঠে লাকড়ির বোঝা। লংগর কমান্ডার মমতাজের মুখে উদ্ভাসিত হাসি। যেন কঠিন কাজে বিজয়ী হয়ে ফিরে এসেছে লাকড়িবাহী দলের সদস্যরা। হাসি- মুখের উচ্ছলতা তাদের চেহারায়, মুখভঙ্গিতে। শুধু খলীলকে কেমন উদাস আর মনমরা দেখায়। কিরে, কি হয়েছে তোর – জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যায়। উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ছেলে খলীলের হলো কি? উদাস আর বর্ষা আকাশের মতো কালো মেঘ করে বসে থাকে ।

রাতে সেটা পরিষ্কার হয় । বকর এ ব্যাপারে ওস্তাদ । অন্যদের মনের খবর বের করার কায়দা-কানুন সে ভালোই জানে। অনেকটা লাফাতে লাফাতে এসে সোৎসাহে সে বলে, শুনেছেন মাহবুব ভাই, খলীল তার মীরানার খোঁজ পেয়েছে ।

– মীরানা কে? খলীলের ‘এ-ও’।

মানে?

মানে প্রতিবেশী । সম্পর্কের মামাতো বোন । ঠাকুরগাঁও শিবগঞ্জ গার্লস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার প্রেমিকা ।

– তারাও এখানে শরণার্থী হয়ে এসেছে? – তাইতো খলীল বললো ।

– ভালোইতো, এতে মন খারাপের কি আছে?

 -খুবই নাকি কষ্টের মধ্যে আছে। তার জন্য কিছু করতে পারছে না। তাকে এখানে রেখে এখন ফ্রন্টে যেতে হবে। যদি ফিরতে না পারে, আর

দেখা না হয়?

ফ্রন্টে তো যেতেই হবে, আর তার মীরানাও থাকবে। এটাই এখনকার বাস্তবতা। সামনের দিনগুলোতে যে আমাদের কত মীরানার সাথে দেখা হবে।

বকরের উদ্দেশে এই কথাগুলো বলে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকি । গাঢ় কালো অন্ধকার চারিধারে। শুধু জোনাকিরা তাদের আলো জ্বেলে আলো নিভিয়ে নিজেদের উৎসবে মেতে থাকে। সামনে থেকে ভেসে আসে যুদ্ধের । বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ। ভীষণভাবে জাগিয়ে রাখে সমস্ত

পরিবেশ ।

চার

আকাশ দিয়ে ফট ফট শব্দ তুলে উড়ে যায় হেলিকপ্টার। ফ্রন্টলাইন বরাবর। বেশ কিছুটা সময় পার করে দিয়ে ফিরে যায়। আবার যায় উড়ে উড়ে। হেলিকপ্টার একটা না দুটা বোঝা যায় না। বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট কাছেই। গর্জন তুলে মাঝে মাঝেই ভারতীয় ফাইটার প্লেন আকাশে উড়ে জোড় বেঁধে। উঁচুতে উঠে হারিয়ে যায় মেঘের আড়ালে। মিলিয়ে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে আবার সেই প্লেনের গর্জন ।

সীমান্ত খোলা। জনমানবের ঢল। মুক্ত ও স্বাধীন তেতুলিয়া থানা। অমরখানা পর্যন্ত এসে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা থেমে গেছে। মুক্তিবাহিনীর মরিয়া ডিফেন্সের সামনে। এখনো তারা হাল ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই গোঁয়াড়ের মতো এগিয়ে আসতে চায়। মুক্তিবাহিনী ঠেকিয়ে যায় প্রাণপণে । এজন্য লোকক্ষয় হয়। প্রয়োজন হয় রি-ইনফোর্সমেন্টের। অমরখানার বিপরীতে গড়ে তোলা হয়েছে ভজনপুর-মাগুরমারী-দেবনগড় ডিফেন্স লাইন । বাংকার-ট্রেঞ্চের সারি। সার্বক্ষণিক সেগুলো মুখোমুখি অবস্থানে বসে থাকা দলের মধ্যে গোলাগুলিবিনিময় । একটা অগ্নিঝরা ফ্রন্ট । তাকে ঘিরেই মানুষের আশাজাগানিয়া ভাবনা। মুক্তিবাহিনী ঠেকিয়ে রাখবে। স্বাধীন থাকবে তেতুলিয়া । অন্ততপক্ষে ভাবা যাবে একটা হলেও রয়েছে আমাদের মুক্তাঞ্চল আর সেটা এই তেতুলিয়া ।

তো, মুক্তাঞ্চল তেতুলিয়া যেন একটা দেখার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাংবাদিক, রেডিও-টিভির রিপোর্টার, বিদেশী ডেলিগেট, মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি। সবাই আগ্রহ নিয়ে আসে মুক্তাঞ্চল দেখতে। যুদ্ধের পরিস্থিতি জানতে। শরণার্থী মানুষদের খবর নিতে। সীমান্তলাগোয়া আমাদের অবস্থান। উৎসুকদৃষ্টি নিয়ে কেউ ফিরে ফিরে দেখে আমাদের তাঁবুগুলোকে । মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের। দ্রুত ধাবমান সামরিক লরি, ভ্যান, জিপের কনভয়। তেতুলিয়ামুখী। নির্লিপ্তমুখে সেগুলোতে বসে থাকে ভারতীয় সৈনিক । বিওপির সামনে কোনো গাড়ি থামে । কিছু জিজ্ঞেস করে। আবার ছুটে যায় গন্তব্যপানে। বিএসএফ-এর লোকজন আসে। খবর-টবর নেয়। আবার ফিরে যায়। রাজনৈতিক নেতা তাদের কর্মীবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ছুটে যান গাড়ি হাঁকিয়ে । সবার মধ্যে ব্যস্ততা। বাংলাদেশের প্রায় সবকটি প্রশাসনিক ইউনিট দখলে নিতে পেরেছে পাকবাহিনী । পৌঁছে গেছে সব খানে । শুধু মুক্ত ও স্বাধীন রয়ে গেছে এই থানা । তাই এর মর্যাদা ছাড়িয়ে গেছে অন্যরূপে। যেন স্বাধীন বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছে এই তেতুলিয়া । সবার লক্ষ্য তাই সেদিকপানে । একেবারে সরগরম অবস্থা এখন মুক্তাঞ্চল এই ভূখ-টির ।

কিন্তু একশ্রেণির মানুষের স্রোত ঠিক বিপরীতমুখী । তেতুলিয়াকে পেছনে রেখে এরা এগিয়ে আসে বাংলাবান্ধার দিকে। এরা আসে পায়ে হেঁটে, রিকশায়, সাইকেলে, গরুগাড়িতে। আসে বাস-ট্রাক বোঝাই হয়ে । নানা শ্রেণির মানুষ । সবাই নিজের বাসভূমি থেকে উম্মুল হয়ে পালিয়ে আসছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক-আবালবনিতা বলতে যা বোঝায় । এখানে এসে তারা থামে । সাথে বয়ে-আনা শেষ সম্বল, লটবহর পোঁটলা-পুঁটলি । গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পর্যন্ত বয়ে এনেছে তাদের কেউ কেউ। কেমন দিশেহারা ভাবভঙ্গি চোখেমুখে। সামনে কোথায় যাবে, জানা নেই। কোথায় ঠাঁই মিলবে, তাও অজানা। সীমান্ত পেরুলেই তারা নিরাপত্তা পাবে। পিছু তাড়া করে আসা মৃত্যুভয় আর থাকবে না। শুধু এটুকুই ভাবনা তাদের মধ্যে কাজ করে। সীমান্ত পেরুবার আগে শেষবারের মতো থামে। বারবার পিছু ফিরে চায় । নিজ দেশ, জন্মভূমি সেটা ছেড়ে যেতে মন চায় না । বুকের মধ্যে গভীর কষ্টবোধ । অজানা ভবিষ্যৎ তাদের বিমর্ষ আর ম্রিয়মাণ করে রাখে । কিছুক্ষণ জিরিয়ে-টিরিয়ে নিয়ে সীমান্তরেখা পার হয়ে পরদেশে। অনাগত দিনগুলোতে সেখানে থাকবে পরবাসী হয়ে। হয়ে যাবে শরণার্থী। হীনম্মন্যতায় ভরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার জীবনযাপন সেখানে ।

আমাদের ক্যাম্পের পাশ দিয়েই সবার এভাবে যাতায়াত । কর্মহীন দিনে- রাতে আমাদের শুধু দেখে যাওয়া। কেউ কেউ তাঁবুগুলোর কাছে আসে। মুক্তিফৌজ (মানেই তো মুক্তিদাতা। জ্বল জ্বল করে তাদের চোখমুখ। আশাজাগানিয়া প্রশ্ন নিয়ে জানতে চায়, কবে হবে জয়বাংলা? আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ!

যুদ্ধ চলছে । চূড়ান্ত রূপ নিতে আরো সময় নেবে। সৰ্বাক যুদ্ধ শুরু হলে এবং তাতে জয়ী হতে পারলেই আসবে আমাদের স্বাধীনতা। কী উত্তর দেবো আমরা এই বাস্তুচ্যুত উদ্ধান্ত মানুষগুলোর? আমাদেরই তো জানা নেই। তবুও দিতে হয়, অনেকটা যেন নিজেদেরকেই সান্ত¡নাবাণী শোনানোর মতো করে, যুদ্ধ চলছে, আর বেশিদিন লাগবে না। সেই বেশিদিনটা কতদিন – এর উত্তরে কিছু বলা যায় না।

কি দেশ কি হয়ে গেল! সবুজ শ্যামলিমাঘেরা জনপদের পর জনপদ । শান্তিময় মানুষের জীবনযাপন। হঠাৎ করেই দুর্দিন নেমে এলো, কবে যে এর শেষ হবে? হবে কি আদৌ? এর উত্তর আমরা জানি না। কিন্তু চোখের সামনে মানুষের এই দুর্দশা মনকে বিষাদে ভরে রাখে। সেই সাথে শঙ্কাময় ভাবনা এসে ভিড় করে, তাহলে কি দেশের সব মানুষকেই ওরা মেরে ফেলবে কিংবা এভাবে বিতাড়িত করবে? দেশটা বাঙালিশূন্য করে ফেলবে? এইসব ভাবনার মুখে মনে হয়, আর দেরি নয়, আমাদের দ্রুত ফ্রন্টে যাওয়া প্রয়োজন । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আবু বকরকে সাথে নিয়ে বিওপির উদ্দেশে রওনা দেই । ওয়ারলেসে কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগের উদ্দেশ্য নিয়ে।

পাঁচ

খোলা জিপটি হাঁকিয়ে আসছিল ভারতীয় দিক থেকে। তাতে বসা বিদেশী কজন মানুষ। অবশ্যই সাংবাদিক। সাথে ক্যামেরা-ট্যামেরা রয়েছে। যুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য ছুটে চলেছেন তেতুলিয়াপানে। মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁবুগুলোর পাশঘেঁষে ছুটে যায় তাদের ধাবমান গাড়ি। দিনভর এমনিতর অনেককেই যেতে আসতে দেখা যায়। কেউ থামে না । যেন অবকাশ নেই একটুও। তবে তাদের কারো কারো চোখে থাকে উৎসুক দৃষ্টি, রাস্তার পাশে আমাদের তাঁবুর তৈরি অস্থায়ী ক্যাম্পের প্রতি। যুদ্ধ থেকে দূরে আমরা। তাদের চাই টাটকা খবর। সর্বশেষ যুদ্ধ পরিস্থিতি, ফ্রন্টের অবস্থা।

তাঁবুতে যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে অপেক্ষমাণ যোদ্ধাদের প্রতি তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাই চকিত দৃষ্টি দিয়ে, নিস্পৃহভাব নিয়ে ধাবমান গাড়ি যায়, গাড়ি আসে। তাতে বসে থাকা দেশী-বিদেশী নামী-দামি মানুষ। আমাদের কাছে আসার জন্য তাদের কোনো তাগিদ নেই। এমনকি তাদের মধ্যে আমাদের নিজেদের দেশীয় মানুষরাও কোনো খোঁজ-খবর নিতে আসে না। নিজেদের কাজ নিয়ে আমরা ব্যস্ত থাকি আর হরদম ওইসব গাড়ির যাওয়া-আসা দেখি। অবশ্য তেমন কিছু মনে না হলেও কিছুটা আশাভঙ্গ হয়। কেউ থামছে না, কাছে আসছে না, খোঁজ-খবর নিচ্ছে না। অন্তত আমাদের নেতৃস্থানীয় মানুষজন – এই ধরনের ভাবনা অভিমানাহত বালকের মতো আমাদের মনের গভীরে হানা দেয়। কিন্তু সেগুলো স্থায়ী হওয়ার অবকাশ পায় না । আমাদের চলছে এখন চরম উৎকণ্ঠিত সময় । ফ্রন্টে যেতে হবে, সে ডাক এলো বলে । কিন্তু তৃতীয় দিনে দুটো ঘটনা ঘটে ।

প্রথমটা বেলা দশটার দিকে। একটা ধাবমান গাড়ি আমাদের ক্যাম্প পেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে থেমে যায়। তারপর ব্যাক-গিয়ার চালিয়ে এসে দাঁড়ায় তাঁবুগুলোর পাশে। নেমে আসেন একজন লম্বা গড়নের বিদেশী মানুষ। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা। সাংবাদিক। সেন্ট্রি ডিউটিতে তখন সামসুল হক। তাকে কী-সব জিজ্ঞেস করেন। দুর্বোধ্য ভাষা । ইংরেজিজ্ঞান শামসুলের সামান্যই। নবম শ্রেণিতে উঠে আর পড়া হয়নি। তার পক্ষে বিদেশী লম্বা-চওড়া লালমুখো মানুষটির কথার জবাব দেওয়া সম্ভব হয় না । শুধু বলে, আই কল কমান্ডার।

বিওপি থেকে ফিরে লংগর কমান্ডারকে নিয়ে হিসাব-নিকাশে ব্যস্ত ছিলাম । প্রতিদিনই রেশন আর অস্ত্র-গোলাবারুদের হিসাব মেলাতে হয়। রুটিনকাজ এটা। সেই ব্যস্ততার মাঝে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে আসে শামসুল । কেমন হতবিহ্বল চেহারা। যেন বড় কিছু ঘটেছে। তার মুখের দিকে তাকাতেই সে বলে, একজন বিদেশী মানুষ আপনাকে খুঁজছে।

– বিদেশী মানুষ? কোথাকার?

– জানি না । কি কয়, কিছুই বুঝি না, তার গলাৎ ঝুলানো আছে ক্যামেরা দেখিনু ।

– সাংবাদিক?

হবার পারে ।

আমাকে চায়?

ওইভাবে কিছু কয় নাই। মুইতো কিছুই বোঝো না, এই জন্য কইছি, আই কল কমান্ডার।

ঠিক আছে, চলতো বকর ব্যাপারটা দেখি!

মুখে স্মিত হাসি নিয়ে যুবা-বয়সী বিদেশী এগিয়ে এসে হাত মেলায় ।

নিজের পরিচয় দেয় এই বলে, মাই নেম ইজ সিডনি শানবার্গ । আই অ্যাম ফ্রম জার্মানি। ফ্রি ল্যান্স জার্নালিস্ট । আর ইউ কমান্ডার ইয়েস।

– ক্যান আই টক টু ইউ ফর সাম টাইমস?

আমাদের কঠোরভাবে বলে দেওয়া হয়েছে নিজেদের পরিচয় আড়াল রাখতে। যুদ্ধ-বিষয়ক কোনো আলোচনা অজানা-অচেনা লোকদের সাথে না = করতে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা মানা যায় না। বলি, ইউ ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট আসা

ইয়েস।বাট ইয়েট উই আর টু জয়েন দা ফ্রন্ট ।

 আই নো ইট। লেটস্ গো টু ইয়োর টেন্ট ।

ইউ লাইক টু সি হাউ ডু উই লিভ?

ইয়েস অ্যান্ড আই উইল টক টু ইউ ফর ফিউ মিনিটস ।

তাকে তাঁবুতে এনে বসানো হয়। বাবলু মতিয়ার তার সমাদরে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। সতরঞ্চির বিছানা । ইতস্তত ছড়ানো মাল-সামান, রসদসামগ্রী। দড়িতে ঝোলানো কাপড়-চোপড়। এর মধ্যেই মমতাজ চায়ের মগ এগিয়ে দেয়। মোতালেব চারমিনার সিগারেট। শানবার্গের কোনোটাতেই আপত্তি নেই। নিজেকে এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয় । পরিবেশটা আপন আর সহজ হয়ে ওঠে। তার ইংরেজি উচ্চারণ অনেকটা দুর্বোধ্য, আমরাও তেমন চৌকস ইংরেজি বলিয়ে নই। কিন্তু তার সাথে কথা চালিয়ে নিতে অসুবিধে হয় না।

তার জানার অনেক কৌতূহল। বলে, হোয়াই ইউ লেফট ইয়োর কান্ট্রি? ফর জয় বাংলা, বলে ওঠে বকর।

জয়-বাংলা মিনস, ইনডেপেনডেন্স?

– ইয়েস। বলি আমি ।

ক্যান ইট বি পসিবল?

হোয়াই নট?

– দে আর ভেরি পাওয়ারফুল আমি। উইথ দিজ বয়েজ হাউ কুড ইউ মিট দেম? ইউ আর নট প্রোপারলি ট্রেন্ড ইভেন অ্যান্ড হ্যাভিং স্মল আর্মস?

– লুক শানবার্গ, উই আর নট অ্যাফ্রেশ। উই হ্যাড বিন ইন দ্য গেরিলা ওয়ারফেয়ার ফর লং টু মানথস। উই হ্যাড সেভারেল এনগেজমেন্ট উইথ দেম ইন দিজ পিরিওডস। নাউ উই আর গোয়িং, ফর জয়েনিং ফ্রন্ট ফাইট । দেয়ার উই উইল গেট হ্যাভি আরমস অ্যান্ড উইপনস । ইট ইজ গোয়িং টু বি এ প্রোলংগ ওয়ার। নাউ দে আর ইন ডিফেন্সিভ পজিশন অ্যান্ড উই উইল গো ফর অফেন্সিভ। উই আর অন ইয়াং, ইয়েস, বাট আর কমিটেড অ্যান্ড ডেডিকেটেড। ইট ইজ আওয়ার কান্ট্রি। হাউ লং দে কুড বি অ্যাবল টু অকুপাই আওয়ার হোমল্যান্ড?

-হোয়াট ইজ ইয়োর স্ট্র্যাটেজি?

-বোথ। গেরিলা ওয়ারফেয়ার অ্যান্ড ফ্রন্ট ফাইট ।

-ডু ইউ বিলিভ ইউ কুড ডিফিট দেম?

-ইয়েস, ইফ নট টুডে, দেন সাম ডে। ডু ইউ নো দ্যাট সং?

 -হোয়াট?

-আমরা করবো জয়,

উই শ্যাল উইন সাম ডে।

– ইয়েস, উই শ্যাল উইন সাম ডে।

তখন বাবলু গেয়ে ওঠে সেই গান,

আমরা করবো জয়,

আমরা করবো জয় একদিন… ।

তাঁবুর অন্যরা ছেলেরাও তার সাথে গলা মেলায়। শানবার্গও। তাঁবুর এই নিরানন্দ পরিবেশটাই পালটে যায় । দীপ্ত শপথের মতো সকলে গেয়ে চলে,

আমরা করবো জয়

উই শ্যাল উইন সাম ডে…। শানবার্গ ওঠে। যাবার সময় বলে, ইয়েস আই উইল কিপ দিস ডে ইন মাই মেমরি ফর লং। উইশ ইওর সাকসেস। মিট ইউ অ্যাগেইন ইন ইওর লিবারেটেড কান্ট্রি । ফটাফট কটা ছবি তুলে নিয়ে শানবার্গ চলে যায় । আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, আই উইল রাইট এভরিথিং ইন মাই পেপার টু নো হোল ওয়ার্ল্ড। তারপর ধোঁয়া উড়িয়ে তাকে নিয়ে চলে যায় তার জিপ গাড়ি। সেদিকপানে তাকিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। মনের মধ্যে অনুরণন চলতে থাকে, উই শ্যাল উইন সাম ডে।