আমার আনিস স্যার

যদ্দুর মনে পড়ে আনিস স্যার মানে সমসাময়িককালের অসামান্য পণ্ডিত। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে আমি প্রথম দেখি এবং তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই ১৯৮৩ সালে। তিনি ইউনেস্কো ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে হোটেল পূর্বাণীতে আয়োজিত ‘টিচিং অ্যাবাউট ইউএন (Teaching about UN)’ শীর্ষক সম্মেলনে মূল বক্তব্য প্রদান করতে আসেন। স্যার চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকে সেই বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে এসেছিলেন। জাতিসংঘ সমিতির তৎকালীন মহাসচিব ও আনিস স্যারের আত্মীয়-বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন সে-সময় আনিস স্যারের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই পরিচয়ে মঞ্চের মানুষ আনিস স্যারকে আমি মনে রাখলেও স্যারের পক্ষে আমাকে মনে রাখার কোনোই কারণ ছিল না। বলা আবশ্যক, সেই সময় আমি সরকারি জগন্নাথ কলেজে সান্ধ্যকালীন শিফটে শিক্ষকতা করি আর দিনে দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির অফিসে কাজ করি। কাজ বলতে ইংরেজি-বাংলা সব দৈনিক পত্রিকা পড়া, জাতিসংঘ-সংশ্লিষ্ট খবরাদি কাটিং করা, কিছু প্রুফ দেখা আর টেলিফোন ধরা। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় জাতিসংঘের কিছু দলিলপত্র অনুবাদের কাজ। সবমিলিয়ে মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকার বাড়তি আয় আর তার সঙ্গে তখনকার সমিতির অফিসবাসী সার্বক্ষণিক পুরনো পিয়ন মজিদভাইয়ের ভালোবাসা আমার জীবন চলার পথে খুব সহায়ক হয়েছিল। পরে আহমদভাই দেশের বাঘা-বাঘা জ্ঞানী-গুণীজন যেমন – অধ্যাপকবৃন্দ নীলিমা ইব্রাহিম, কবীর চৌধুরী, সালাহ্ উদ্দিন আহমদ,  মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ইন্নাস আলী, দুর্গাদাস ভট্টাচার্য; এবং আবদুল্লাহ আল-মুতী, এ. জেড. এম. আবদুল আলী, অগ্রজপ্রতিম ব্যাংকার খলিলুর রহমান প্রমুখের সঙ্গে আমাকেও সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটিতে যুক্ত করে নেন। অতঃপর জাতিসংঘ সমিতির দ্বিতীয় প্রধান কর্তাব্যক্তি আমাদের সব আবদারের আশ্রয়স্থল শাহেদভাইয়ের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ) অভিভাবকত্বে দিন কাটতে থাকে।

১৯৮৫ সালে আনিস স্যার দীর্ঘদিন পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলেন। তখন থেকে জাতিসংঘ সমিতির ও অন্যান্য নানা কাজের সুবাদে স্যারের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি হয়। স্যারকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে কতভাবেই না বাধা দেওয়া হয়েছে। তবু তাঁর অদম্য ইচ্ছাতেই চট্টগ্রাম থেকে তিনি রাজধানীতে আমাদের মাঝে আসতে পেরেছিলেন। ফলে তাঁর মতো চিন্তা-চেতনায় অগ্রণী ও সর্বজনগ্রাহ্য একজন জ্ঞানী মানুষের সান্নিধ্য লাভ করে আমরা প্রাণিত, শাণিত ও ধন্য হয়েছি। তিনি পৃথিবীর বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। আমাদের জানামতে আনিস স্যারই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে কম বয়সী ছাত্র, যিনি ১৯৬২ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

আনিস স্যার যখন ঢাকায় এলেন, তখন সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সমস্ত ক্যাম্পাস অশান্ত ও উত্তাল। দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সক্রিয়। এই সময়টায় ঢাকাসহ সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি বিনাশের লক্ষ্যে স্বৈরশাসক এরশাদ কর্তৃক গঠিত ‘সংস্কৃতি কমিশনে’র অপতৎপরতার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলেন। আনিস স্যারকে আমরা সব আন্দোলনে সঙ্গে পাই। ১৯৮৭ সালে সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলমুক্তির ডাক দিয়ে শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে যখন জাতীয় কবিতা উৎসবের যাত্রা শুরু হয় তখন আনিস স্যার ছিলেন আমাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস। আমাদের ৩৪টি কবিতা উৎসবে স্যার সক্রিয়ভাবে উপস্থিত থেকেছেন, সেমিনারে প্রবন্ধ লিখেছেন, সভাপতিত্ব করেছেন, অনেক বক্তব্য-বিবৃতি দেখে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবিকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদ স্যারের সহায়তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঋণের বন্ধনে আবদ্ধ। 

১৯৮৮ সালে সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে বাঙালির রক্তে অর্জিত সংবিধানের মূল চরিত্র পাল্টে দিলে আনিস স্যার যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও আহত হন। ১৯৯২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত গণআদালতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মূল হোতা ঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের সময় আনিস স্যার অন্যতম বাদী হয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে দেশ ও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্বজনের দুঃখে ব্যথিত হয়েছেন, আনন্দে খুশি হয়েছেন। স্যারের সংস্পর্শযুক্ত এমন আরো দু-চারটি স্মৃতিচারণমূলক কথা আমি এখানে উল্লেখ করব।

১৯৮৮ সালের পহেলা জানুয়ারি রীমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমি পাড়াগাঁয়ের সাধারণ পরিবারের ছেলে। তখন ঢাকায় আমার স্বজন বলতে কিছু ব্যক্তিগত বন্ধু-বান্ধব আর জাতিসংঘ সমিতির আহমদভাই, শাহেদভাই ও খলিলভাই। অন্যদিকে ছাত্র-রাজনীতির সূত্রে অভিভাবক ছিলেন ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান, অর্থাৎ ফজলুভাই ও মাহমুদা চৌধুরী ভাবির পরিবার। রীমার দাদা পানাউল্লাহ আহমেদ ভারত বিভাগপূর্ব বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। রীমার জন্ম ওর দাদার সরকারি বাসভবন মিন্টো রোডের লালবাড়িতে। বেড়ে ওঠা ধানমণ্ডির সাত নম্বর সড়কের পানাউল্লাহ হাউজে। বলা আবশ্যক, শাহেদ ভাই, রীমা, অনুজপ্রতিম তারিক সুজাত বা আমি জানতাম না যে, আনিস স্যার, ভাষাসংগ্রামী তোফাজ্জল  হোসেন ও  আমার শ্বশুর এটিএম আমান উল্লাহ আহমদ একই সময়ে জগন্নাথ কলেজে পড়তেন এবং তাঁরা পরস্পর পরিচিত ছিলেন। এটাও জানার কোনো কারণ ছিল না যে, পঞ্চাশের দশকে তোফাজ্জল চাচা আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের অধিনায়ক এবং রীমার আব্বা ফুটবল খেলায় খ্যাতিমান ফরোয়ার্ড ছিলেন। আমাদের বিয়ের দিন নতুন পরিচয়ে তাঁদের সম্পর্কের নবায়ন হয়। বিশেষ করে বিয়ের পর থেকে আমার চলার পথে সব বিষয়ে আনিস স্যারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার জীবনে যৎসামান্য যা সফলতা তার পেছনে স্যারের প্রজ্ঞাময় পরামর্শের ভূমিকা অপরিসীম। আমার সব সিদ্ধান্তে স্যারের মতকে আমি প্রাধান্য দিয়েছি। নানান বিষয়ে স্যারের মেধার ধার, জ্ঞানের আলো ও প্রজ্ঞার তীক্ষèতা আমি তিলে-তিলে উপলব্ধি করেছি।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় গিয়ে সারাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাতে থাকে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের হত্যা, তাদের নারীদের নির্বিচারে ধর্ষণ, বাড়িঘর-সম্পদ লুটপাট করে বাংলাদেশকে এক মৃত্যুউপত্যকায় পরিণত করে। চট্টগ্রামে  অধ্যক্ষ গোপাল চন্দ্র মুহুরীকে ঘরে ঢুকে মাথায় আগ্নেয়াস্ত্র ঠেকিয়ে হত্যা, সিরাজগঞ্জে পূর্ণিমা শীলের ওপর গণনির্যাতন, ভোলায় দুধের সন্তানকে জিম্মি করে গৃহবধূকে ধর্ষণ, গৌরনদীর মানুষদের প্রাণটুকু নিয়ে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া-টুঙ্গিপাড়ায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করা প্রভৃতি ঘটনায় আনিস স্যারসহ অনেকেই বিচলিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। যেন আরেক একাত্তর! সংস্কৃতিকর্মীরা কিছু প্রতিবাদ করলেও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হলো না। আমি তখন জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। সেই চরম সন্ত্রস্ত পরিস্থিতিতে একদিন আনিস স্যার তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, ‘আমরা আগামীকাল কালিয়াকৈরে আক্রান্ত হিন্দুপাড়ায় যাচ্ছি – তুমি কি যেতে পারবে?’ যেখানে আনিস স্যার তাঁর জীবনের ওপর প্রতিদিনকার হুমকি উপেক্ষা করে আক্রান্ত মানুষজনের পাশে দাঁড়াতে যাবেন, তখন আমার আর কী বলার ছিল! পরদিন স্যারের গাড়িতে করে কালিয়াকৈরে পৌঁছে দেখি রাস্তার ওপর অধ্যাপক অজয় রায় (২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশের বইমেলা থেকে বেরোবার সময় জঙ্গিদের হাতে নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা) আরো কয়েকজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আনিস স্যার-অজয় স্যারের সঙ্গে বড় রাস্তা থেকে নেমে আমরা গ্রামের ভেতরে যাই। থমথমে পরিবেশ, ঘরের টিনের বেড়া রামদার আঘাতে কাটা, কিছু ঘর লণ্ডভণ্ড। তাঁদের হাটবাজারে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা। ভয়ার্ত লোকজন প্রথমে তাদের ওপর আক্রমণের কথা বলতে চাইছিলেন না। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কয়েকজন গেঞ্জি খুলে শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখালেন। জানালেন – তাঁদের মেয়েদের গায়েও হাত ওঠানো হয়েছে। একজন জানালেন, তাঁর তরুণী কন্যাকে ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বেদনা ভারাক্রান্ত আনিস স্যার যাওয়া-আসার পথে সেদিন একটি কথাও বলেননি। সেই দুঃসময়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারিক আলী পূর্ণিমা শীল ও তাঁর পরিবারকে অভয় দিতে সিরাজগঞ্জে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, ভারত যে সঠিক গন্তব্য নয়, সে-কথা আমি আরো ভালো করে বুঝেছিলাম সেই সময় কলকাতায় পশিচমবঙ্গ রাজ্য সরকারের একটি অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে গিয়ে। অনুষ্ঠানে তখনকার কলকাতার শেরিফ, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানের কণ্ঠশিল্পী ও বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী সুচিত্রা মিত্র উদ্বোধনী গান পরিবেশন করেন। প্রধান অতিথি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মনে আছে, রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে কবি বেলাল চৌধুরী ও কবি রবিউল হুসাইনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু মানুষের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে আমি উত্থাপন করি। সংস্কৃতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকাল থেকে বুদ্ধদেবদা আমাদের পরিচিত ছিলেন। তিনি বললেন – ‘আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, কিন্তু দিল্লি এই বিষয়ে আমাদের কথা কানেই তুলছে না। আমি শিগগির দিল্লি যাচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করব।’ ওই পর্যন্তই।

২০০৩ সালে আমার কণ্ঠস্বরে সমস্যা দেখা দেয়। ঢোক গিলতে ও কথা বলতে গেলে মনে হতো গলায় যেন কিছু আটকে আছে। কথা ফ্যাঁসফেঁসে হয়ে বেরোতে থাকে। ডাক্তাররা কোনো কূল-কিনারা করতে পারছিলেন না। কথা বলতে বারণ করেছিলেন। কথাই যার পেশা ও জীবিকা, সে-মানুষ আমি প্রায় তিন মাস কাগজে লিখে লিখে আমার কথা চালাতে থাকি। সেই সময় আমার পরিবার-পরিজন ও স্বজনেরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এতো ব্যস্ত মানুষ আনিস স্যার প্রায় প্রতিদিন আমাকে দেখতে আসতে থাকেন। স্যার যেদিন আসতে পারেন না, সেদিন বেবী আপা (অধ্যাপক আনিসুজামানের স্ত্রী সিদ্দিকা জামান) আসেন। সেই বিপদের সময় আনিস স্যারের এতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আমার মনে ক্যান্সারের ভয় ঢুকে যায়। এভাবে সারাজীবন ছোট-বড় সব মানুষের বিপদ-আপদে ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন আনিস স্যার।

উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্যে পরে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেনের পরামর্শে সেই দুঃসময়ে ড. রফিকউল্লাহ খান আমাকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ডা. দুলাল বোসকে দেখান। কলকাতার পিয়ারসন হাসপাতালের ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডা. দুলাল বোসের অস্ত্রোপচারে আমি সুস্থ হই। শাহেদভাই পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন স্পিকার সৈয়দ হাশিম আবদুল হালিমকে চিঠি লিখে কিড স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরে স্পিকার সৈয়দ হাশিম আবদুল হালিম ঢাকায় এলে আমি দেখা করে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। প্রসঙ্গত, কিছুদিন পর আমাদের প্রিয় গুণদা (কবি নির্মলেন্দু গুণ)

ড. রফিকউল্লাহ খানের ঘনিষ্ঠ কলকাতার তরুণ সন্দ্বীপন ধর টুটুলের হাত দিয়ে ডা. দুলাল বোসকে তাঁর আত্মজীবনী আমার কণ্ঠস্বর বইটি উপহার দিয়ে লিখেছিলেন – ‘আমার অনুজপ্রতিম কবি মুহাম্মদ সামাদকে তার কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে আমি আপনাকে আমার কণ্ঠস্বর উপহার দিলাম।’

২০০৭ সালে ১/১১-র সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমাদের ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের সময়  আমি নীল দলের ভারপ্রাপ্ত কনভেনার হিসেবে আনিস স্যারের পরামর্শ নিয়েছি। পুরনো ঢাকায় কবি আসলাম সানীর বাসায় রাতে আত্মগোপনে থেকেছি। অনেক রাত আমি মশারির নিচে বসে চিন্তা করতে করতে শীতের মধ্যেও টেনশনে দরদর করে ঘেমেছি। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা আমাকে তিনবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এক পর্যায়ে অপরাজেয় বাংলার সামনে আয়োজিত

ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ থেকে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’ ঘোষণা করলে আমাদের আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে। কবীর স্যার, আনিস স্যার ছাড়াও অনেকে সেদিন বক্তব্য রেখেছিলেন। সারাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজে কারাবন্দি হয়েও আদালতে তাঁর মামলার হাজিরা দিতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের মুক্তি দাবি করেন। এক পর্যায়ে সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাত্র-শিক্ষকদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আমার সব কাজে, সব সিদ্ধান্তে আনিস স্যারের পরামর্শ ছিল অনিবার্য।

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণের পর কবীর স্যারের নয়াপল্টনের ফ্ল্যাটে একাধিক সভা করে ‘শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদ’ গঠন করা হয়। সৈয়দ শামসুল হক, আনিস স্যার, রামেন্দুদা, বেলাল ভাই, রবিউল ভাই, মফিদুল ভাই, রুবী আপা, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুভাই, গোলাম কুদ্দুছ, হাসান আরিফ, তারিক সুজাতসহ রাহমানভাইয়ের অনেক অনুরাগী সভায় উপস্থিত ছিলেন। কবীর স্যারকে সভাপতি আর আমাকে সম্পাদক করে কমিটি করা হয়। ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কবীর স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যান। আনিস স্যারের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতেই আমি স্যারকে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো থেকে বিরত হই; কিন্তু পরিবারসহ সকলে অনুরোধ-উপরোধ করেও স্যারকে বিন্দু পরিমাণ থামানো সম্ভব হয়নি। যাই হোক, উপায়ান্তর না দেখে সবার কথায় স্যারকে ‘শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদে’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানালে স্যার সম্মত হন। গত বছর (২০২০) ১৪ মে স্যার চলে যাওয়ার পর আমরা কাউকে নতুন সভাপতি করিনি। এখনো মনে হয়, আসছে ২৩ অক্টোবর রাহমানভাইয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করতে স্যারকে আমি ফোন করব।

আমরা সবাই জানি আনিস স্যার অনেক বড় জ্ঞানী, স্মৃতিধর ও গুণী মানুষ ছিলেন। আমার ছিল ছোট ছোট চাহিদা। কবিতা বা কিছু লিখতে অথবা পড়তে গিয়ে সাধারণ অভিধানের বাইরে অন্য ভাষার অনেক অপরিচিত শব্দ বা শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা আনিস স্যারের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে আমি প্রতিনিয়ত উপকৃত হয়েছি। যেমন একবার একটি গবেষণার কাজে দিনাজপুরের একটি সংস্থার অর্গানোগ্রাম পর্যালোচনা করতে গিয়ে অজানা ও অপ্রচলিত একটি পদের নাম ‘মশলাচি’ দেখে অবাক হই এবং যথারীতি আনিস স্যারকে ফোন করি। স্যার মুহূর্তের মধ্যে বললেন – ‘বাবুর্চির অ্যাসিস্ট্যান্ট’। আনিস স্যারের দীর্ঘ সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাদের খোকন ভাই (এ জেড এম আবদুল আলী) আমার পিএইচ.ডি থিসিস আদ্যোপান্ত দেখে দিয়েছিলেন। আমার মনের প্রশান্তির জন্যে শেষ অধ্যায়টি আনিস স্যার দেখে দিয়েছেন। এভাবে লেখাপড়ার কাজে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। ১৯৯৫ সালে আমার পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জনের দিন রাতে বেবী আপাসহ স্যার বড় এক বাক্স সন্দেশ নিয়ে গ্রিনরোডে আমার পাঁচতলা বাসায় হেঁটে উঠলে আমরা স্তম্ভিত হই। সেদিন নন্দিতার জন্যে আমেরিকা থেকে এক বাক্স প্লাস্টিকের পুতুলও এনেছিলেন। বিদেশ-বিভুঁইয়ে গিয়ে আমার মেয়েকে মনে রেখে খেলনা আনার কথা আমরা কী করে ভুলি! তাঁর তিন ছেলে-মেয়ে রুচি, শুচি ও আনন্দের বিয়ের সময় নিজে বাসায় এসে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। এমনকি স্যারের নাতনির বিয়ের সময় কলাভবনে তাঁর কক্ষ থেকে নিমন্ত্রণপত্র নেওয়ার শত চেষ্টা করেও পারিনি। স্যার সেই দাওয়াতও বাসায় এসে দিয়েছিলেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর স্যার আর শাহেদভাইকে সস্ত্রীক দাওয়াত দিই। খাওয়া-দাওয়া-গল্প-গুজব শেষে যাওয়ার সময় স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন – ‘সামাদ, তোমার কি নিচে অফিস আছে?’ আমি উত্তর দিলাম – ‘জি স্যার।’ স্যার বলেলন – ‘অফিসের কাজ অফিসে সেরে আসাই ভালো।’ আমি স্যারের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি।

শামসুর রাহমান স্মৃতি পরিষদের কাজে একবার আনিস স্যারের  কলাভবনের অফিসকক্ষে আমার দেখা করার কথা। স্যার চট্টগ্রাম থেকে ফোনে পরের দিন আড়াইটায় সময় দিয়েছিলেন। আমি ভুলে শুনেছিলাম সাড়ে চারটা। আমি যথারীতি দিবানিদ্রা সেরে চারটায় স্যারকে ফোন করি। স্যার ফোন ধরে বললেন – ‘তোমার কয়টায় আসার কথা?’ আমি বললাম – ‘সাড়ে চারটায়, স্যার।’ স্যার বললেন – ‘আমি তোমাকে আড়াইটায় আসতে বলেছি; আমি আড়াইটা থেকে বসে আছি।’ আমি আবার বললাম – ‘স্যার, আমি তো শুনেছি সাড়ে চারটা।’ স্যার বললেন – ‘ধ্যাৎ’! ধ্যাৎ শব্দটি এত ভারী হয়ে আমার কর্ণকূহরে প্রবেশ করেছিল যে, আমি মুহূর্তে ভয়ে নিশ্চল হয়ে পড়ি এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘেমে নেয়ে উঠি। আমি কলাভবনে যাওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলি। অতঃপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্যারের বাসায় ফোন করে বেবী আপাকে ঘটনাটা বলি। স্যার তখন গুলশানে থাকতেন। বেবী আপা জানালেন যে, ‘চিটাগং থেকে এসে তোমার সাথে আড়াইটায় কাজ আছে বলে চলে গেল। দেরি হবে বলে না-খেয়েই চলে গেছে। এখন আর কিছু বলার দরকার নেই। কয়েকদিন যাক।’ তারপর বহুদিন গেছে কিন্তু আনিস স্যার এই বিষয়ে কোনোদিন আমাকে কিছু বলেননি। এমন অনুকরণীয় সময়নিষ্ঠ মানুষ আমরা আর কোথায় পাব!

আনিস স্যারের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় বাংলা একাডেমিতে মুজিব বর্ষের প্রকাশনা কমিটি থেকে স্যারের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রকাশিতব্য একটি গ্রন্থের জন্য লেখা বাছাইয়ের সভায়। সেই সভায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম ও কবি পিয়াস মজিদ ছিলেন। স্যারের চলে যাওয়ার এক বছরের মাথায় এই বছর ২৪ মে (২০২১) সিরাজীভাইও আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। 

আমার কন্যা নন্দিতা হওয়ার পর পাঁচতলার সিঁড়ি ভেঙে স্যার ওকে দেখতে এসেছিলেন। তারপর থেকে যখনই টেলিফোনে কথা হয়েছে অথবা যেখানেই দেখা হয়েছে স্যার প্রথমে নন্দিতা তারপর রীমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। তারপর আমার বা কাজের কথায় এসেছেন। নন্দিতা ছোট থেকেই সেটা জানত এবং বড় হয়ে আরো গর্বিত বোধ করেছে। আনিস স্যারের চলে যাওয়ার খবরে আমাদের শোকে ও কান্নায় নন্দিতা শামিল হয়েছে। চলে যাওয়ার দিন আমাদের বাসায় আগে এক দাওয়াতে স্যারের হাত ধরে কেক কাটার একটি ছবি দিয়ে নন্দিতা ফেসবুকে লিখেছে :

He took the pain to climb up a 5-storey building just to cherish newborn Nandeeta. He never missed asking : Ôbw›`Zv †Kgb Av‡Q?Õ over any random phone conversations with my father. His inspirational words on successful career path, acclamations for my achievements — all these pure affections joined my memory list today.

Words fall short to define his intellectual contribution and physical participation in numerous significant occasions of Bangladesh. This country lost an enlightener today.

National Professor Dr. Anisuzzaman (18 February 1937 – 14 May 2020).

আনিস স্যারের ওপর সামান্য লেখাটি নন্দিতার কথা দিয়েই শেষ করলাম।

রচনাকাল : ৪ঠা জুলাই ২০২১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়