মৃণালের চিঠি

ভূমিকা

রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে ঠিক কতগুলি চিঠি লিখেছেন তা জানা যায় না। তবে একটা আন্দাজ পেতে অসুবিধে নেই। রবীন্দ্রনাথের লেখা ছত্রিশটি চিঠি অত্যন্ত যত্ন করে মৃণালিনী তাঁর ড্রয়ারে প্রায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, যেভাবে কেউ মহামূল্য জিনিস আগলে রাখে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেগুলো খুঁজে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে তাঁর স্মরণ কাব্যের সেই কবিতা – ‘দেখিলাম খানকয় পুরাতন চিঠি/ স্নেহমুগ্ধ জীবনের চিহ্ন দু’চারিটি/ স্মৃতির খেলেনা-ক’টি বহু যত্নভরে/ গোপনে সঞ্চয় করি রেখেছিলে ঘরে …’ ইত্যাদির মতো আশ্চর্য শব্দমালা। কিন্তু স্বামীর চিঠির জবাবে স্ত্রীর লেখা চিঠিগুলি কোথায় গেল – সে-খবর কেউ রাখেনি। অন্যদের কাছে পাঠানো মৃণালিনীর দুয়েকটা চিঠি পাওয়া গেলেও রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠির তোড়াটাই নেই। তাঁর লেখা চিঠির সংখ্যাই বা কত ছিল! কবির ছত্রিশটি চিঠির উত্তরে মৃণালিনী যদি নিদেনপক্ষে খানকুড়ি চিঠিও লিখে থাকেন, সেগুলো কোথায় তার হদিস মেলে না! সে কি হারিয়ে গিয়েছে, নাকি হারিয়ে যেতে দেওয়া হয়েছে? অথবা খুলনার দক্ষিণডিহির ভবতারিণী নামের সেই শ্যামলা সাধারণ মেয়েটির মামুলি চিঠিপত্র জড়ো করে রাখা তেমন জরুরি ছিল না। ধরে নিই, মৃণালিনীর লেখায় ছিল কেবল সাংসারিক খবরাখবর, নেহাত প্রয়োজনের কথাবার্তা। সেটাই তো স্বাভাবিক। সংসারে প্রতিদিনের দেওয়া-নেওয়ার বিষয় ছাপিয়ে রবীন্দ্রনাথের লেখার সেই অসাধারণ দার্শনিক আলাপন মৃণালিনীর কাছে কি প্রত্যাশিত ছিল? তবে সেই চিঠির গোছা কোথায়? রবীন্দ্রনাথের কাছের মানুষদের দেখি কবির চিঠিপত্র রক্ষা করার পরম ব্রত নিয়ে চলতে। তাঁদের অন্যতম ছিলেন বিবি*, ইন্দিরা দেবী। তিনি না থাকলে রবীন্দ্রজীবনে ছিন্নপত্রের মতো এক অসাধারণ অধ্যায় হয়তো বিলীন হয়ে যেত। কখনো ইন্দিরা দেবীকে দেখি সযত্নে ছিন্নপত্রের চিঠি কপি পর্যন্ত করে রেখেছেন। কবির চিঠির অনেক বাতিল পাঠ আমাদের সামনে তিনিই মেলে দিয়েছেন – রবীন্দ্রজীবনকে যথাযথ তুলে ধরার তাগিদে। কিন্তু মৃণালিনী? তবে কি রবীন্দ্রনাথের জীবনে স্ত্রীর চিঠিপত্রের তেমন কোনো মূল্য আছে বলে তাঁরা মনে করেননি! নাকি সে-সব চিঠি কবি নিজেই হারিয়ে ফেলেছেন, খানিকটা সচেতনভাবে! পারিপার্শ্বিক তথ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, মৃণালিনী বুঝি কবির আশেপাশের মানুষজনের কাছে কিছু অপাঙ্ক্তেয় ছিলেন। এমনকি, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর মৃণালিনী দেবীকে লেখা কবির পত্রগুচ্ছ পুত্র রথীন্দ্রনাথ যখন চিঠিপত্রের প্রথম খণ্ড হিসেবে প্রকাশ করতে চাইলেন, তখন তাঁকে খানিকটা বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেই বাধা এসেছিল পারিবারিকভাবেও। তবে কি সে স্ত্রীকে লেখা চিঠি বলেই তা জনতার দরবারে আনতে না-দেওয়ার চেষ্টা? আজ এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে নেই।

আজকের লেখা যদিও সেই বিষয় ঘিরে নয়। এখানে একেবারেই কল্পনা করে নেওয়া হয়েছে – ন-বছরের এক বালিকার কুড়ি বছরের দাম্পত্য-জীবনের আলোছায়ামাখা কিছু অভিজ্ঞতার কোলাজ। যে-মানুষটি মৃত্যুশয্যায় তাঁর স্বামীর কাছে জীবনের শেষ প্রতিবেদন জানাতে চাইছেন। সেই স্বামী আর কেউ নন, বাংলার বিখ্যাত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর যদি সত্যিই এমনটা হতো, তাহলে মৃত্যুর চৌকাঠে পা রেখে কী বলতে চাইতেন মৃণালিনী? কেমন হতে পারত তাঁর সেই অনুযোগভরা চিঠিখানা? রবীন্দ্রজীবনের তথ্য দিয়ে গাঁথা একখানা মালার মতো সেইটে একবার কল্পনা করে দেখার প্রয়াস রয়েছে এখানে।

শ্রীচরণেষু,

আমার শরীর আজ একটু ভালো বোধ হচ্ছে, তাই আপনাকে কিছু বলতে চাই। আপনি কিন্তু বাধা দেবেন না, আপনার অনুমতি নিয়ে রথীকে দিয়ে কাগজ-কলম আনিয়ে রেখেছি। অসুস্থ শরীরে হয়তো বেশি কথা বলতে পারবো না, সব কথা মুখে বলারও নয়। তাই ঠিক করেছি চিঠির আকারে লিখে জানাবো। নিজের হাতে লিখতে না পারলে বেলি বা হেমলতা বৌঠানকে বলেছি আমার হয়ে একটু লিখে নিতে। কিন্তু আমাকে আজ বলতেই হবে। কত কথাই যে বলতে ইচ্ছে করছে, –  এই বেলির কথায় মনে হচ্ছে আমাদের সেই বেলি, আমাদের প্রথম সন্তান। মনে পড়ে, ওর জন্মের সময় আমার বয়স কম বলে আমাকে ভরসাই করতে পারতেন না। বেলির যত্নের প্রায় পুরোটা আপনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ওকে দুধ খাওয়ানো, কাপড় পরানো, বিছানা বদলানো – সবই তো নিজের হাতে করতেন। আর আমি লজ্জায় মরমে মরে যেতাম, আর আপনার বকুনির ভয়ে চুপ করে থাকতে হতো। তবে এও ঠিক, আমি আপনার মতো করে ওকে সামলাতে পারতুম না। একটু বড় হলে বেলি সেই মোটা তাকিয়াগুলোর মধ্যে আটকে থেকেও কি দৌরাত্ম্যি করতো সে আপনার মনে আছে? ওর সমবয়সী কাউকে দেখলে কেমন হুঙ্কার দিয়ে তার ওপরে আছড়ে পড়তো – সেসব ভাবলে আজো হাসি পায়। তবে বরাবর বড় ভালোমানুষ। যখন আমরা পার্কস্ট্রিটের বাড়িতে সেখানেও কতদিন আপনি ওকে স্নান করিয়ে দিয়েছেন। আর দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গিয়ে রাত্রে ওকে উঠিয়ে দুধ গরম করে খাওয়ানোর কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। বরাবর ও একটু আপনার কোলঘেঁষা ছিল। সেই বেলি বড় হয়ে এখন শ্বশুরবাড়ি করছে, শুনি সেখানে মানিয়েও নিয়েছে। মজঃফরপুরের বাড়িতে গিয়ে আপনি নিজের চোখে দেখেশুনে এসেছেন, তাই আমার আর কোনো চিন্তা নেই। আপনার মুখেই শুনেছি, শরৎ কত ভালো ছেলে, ওর বাইরে কোনো আড়ম্বর নেই – যা কিছু সমস্ত ওর মনে মনে। লজ্জায় ও কিছু প্রকাশ করতে পারে না, কিন্তু বড় গভীর হৃদয়ের মানুষ। ওর মনে কোনোরকম সন্দিগ্ধতার অবকাশ নেই। সে একদিকে উপার্জনশীল উদ্যমশীল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ নিরলস, অন্যদিকে এলোমেলো, অসতর্ক, অসন্দিগ্ধ, টাকাকড়ি সম্বন্ধে অসাবধান – যেখানে-সেখানে যা তা ফেলে ফেলে রেখে দেয়, হারায়, কাউকে কিছুমাত্র সন্দেহ করে না – এসব তো আপনার কাছেই শোনা। আপনি বলেন, শরৎ পুরুষমানুষের মতো কাজের আর পুরুষমানুষের মতোই অগোছালো। মজঃফরপুরে নাকি সকলে একবাক্যে স্বীকার করে যে, ‘শরৎবাবুর মতো পপুলার লোক সেখানে আর দুটি নেই।’ এসব গল্প যখন শুনি মনটা ভরে ওঠে। এমনকি আপনি একথাও বলেন, এমন সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য জামাই আমি হাজার খুঁজলেও পেতুম না। সেদিক থেকে বরং বেলিকে নিয়ে যেন আপনারই একটু চিন্তা হয়েছিল, বলতেন, বেলিকেই ওর স্বামীর যোগ্য হয়ে উঠতে হবে।

সেবারে বেলির শ্বশুরবাড়ি মজঃফরপুরে আপনার সাজগোজের যে-গল্প বলেছিলেন, আমি তো হেসে অস্থির। হ্যাঁ বলেছিলুম বটে, ওদের ওখানে হেলাফেলা করে থাকবেন না। বেলির শ্বশুরবাড়িতে তার বাবাকে নিয়ে আমাদের মেয়ের যেন অসম্মান না ঘটে। তাই বলে একটু ঢাকাই ধুতি চাদর পরেছেন বলে অমন কাণ্ড হবে তা কে জানতো! আপনার বেশভুষায় মজঃফরপুরের বাঙালিদের এমন চক্ষুস্থির হবে, আপনাকে দেখতে এমন জনসমাগম ঘটবে, সেটা আন্দাজ করলেও এতটা বুঝতে পারিনি। আপনি তার সমস্ত দায় দিয়েছিলেন আমার মাথায়। বলেছিলেন, আমার কথা শুনেই নাকি আপনার এমন দুর্গতি। এমনকি ভিড়ের চাপে বেলির একখানা গয়না পর্যন্ত খোয়া গিয়েছিল। তবে দোষ কি কেবল আমার আর ঢাকাই ধুতি-চাদরের, যে পরেছে তার নয়? জানি না, এইসব নানান কথা কেন আজকাল মনের মধ্যে ভিড় করে আসছে। মাঝে মাঝে চিন্তা হয়, আর যদি সময় না পাই, আর যে বলা হবে না। বোলপুরে আপনার ইস্কুলের কাজে যোগ দিয়ে আমার ভারি ভালো লেগেছিল। একা হাতে ছেলেদের ইস্কুলের সব কাজ করেছি। কাজের কষ্টকে কষ্ট বলে মনে হয়নি। কিন্তু একটা বছর কাটল না, আমি কি এক অসুখে পড়লুম! আপনি তখন কলকাতায় ছিলেন, বাড়াবাড়ি হতে কলকাতায় আসতে হলো। তবে দ্বিপেন্দ্র আপনার কথায় খুব যত্ন করে আমাকে এনেছে। ট্রেনে আসবার সময় সারাটা পথ আমি শুয়েই ছিলুম, রথী জানালায় বসে বাইরের দৃশ্য দেখছিল। আমাকে ডেকে ডেকে সে কত কী দেখাতে লাগলে। আপনার মতো সে-ও বড় অবাক হয়ে চেয়ে দেখে, পথের পাশে তালগাছের সারি, বুনো খেজুরের ঝোপ, বাঁশঝাড়ে ঘেরা গ্রাম, যা দেখে তাই দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। একবার তো একটা বাচ্চা ছেলেকে

 মস্ত এক মোষের পিঠে নির্ভয়ে বসে থাকতে দেখে ওর কি আনন্দ, সেই সঙ্গে চিন্তা – ‘মা, ও পড়ে যাবে না তো!’ রথী তো আমার মতো ডানপিটে নয়, ওর বড় নরম মন। আমি ছোটবেলায় যে কত দস্যি ছিলুম সে তো আর জানে না। এবারে আমি প্রায় শুয়েই আসছিলুম, ওর ডাকে মাঝেমাঝে উঠে দেখি আবার শুয়ে পড়ি। ঠিক যেন সিনেমার মতো চোখের সামনে দিয়ে দৃশ্যগুলো চলে যাচ্ছে। একবার তো সে জোরে চেচিঁয়ে উঠল, তাকিয়ে দেখি নির্জন মাঠের মধ্যে পাড়ভাঙা অর্ধেক বোজা পুকুরে যেটুকু জল, তার পুরোটা ঢেকে গিয়েছে সাদা পদ্মফুলে। কী যে সুন্দর লাগছিল, ভাদ্রের শেষে ওই পদ্মপুকুরের ছবি আজো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এবারে বোলপুর থেকে যখন আসছিলুম চারদিক দেখতে মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা জমে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, আবার এই পথে ফিরে যেতে পারবো তো! আপনার বিদ্যালয়ের কাজে আবার লাগতে পারবো তো? কেবল আপনার বলি কেন, সে তো আমার বলুর* বিদ্যালয়ও বটে! চলে আসবার আগে ইশকুুলের ছেলেদের মুখগুলো দেখে ভারি কষ্ট হচ্ছিল, বড় মায়া করছিল, মনে হচ্ছিল, আমি চলে গেলে এই বালকদের কী হবে! ওরা এখন কেমন আছে কে জানে! বোলপুরের বিদ্যালয়ের কথা বলতে গেলে একটা কথা বারবার আমার মনে উঁকি দেয়, সে ভয়ানক কেমন পীড়া দেয় আমাকে। আপনি বাবামশায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে বোলপুরে ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের সূচনা করলেন; কিন্তু তার আগে বলুও তো সে-কাজে অনেকটা এগিয়েছিল। সে-ই তো প্রথমে বাবামশায়ের সম্মতি নিয়ে বিদ্যালয়ের কাজ শুরু করে। এমনকি বিদ্যালয়ের নিয়মাবলির একটা কাঠামোও তৈরি করেছিল। বিদ্যালয়ের জন্য পাকাবাড়ি তৈরির কাজও শুরু হয়। সেই আদিকুটিরে পৌষ উৎসবের সময় বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হবার কথা ছিল। কিন্তু বরাবরের রুগ্ণ বেচারী বলু সেবারে হঠাৎ ওর কাজ আর মানসিক চাপে অসুস্থ হয়ে চিরকালের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেল, বিদ্যালয় উদ্বোধনের মাত্র চার মাস আগে। অথচ তারপর যখন বিদ্যালয়ের উদ্বোধন হলো আপনারা কেউ একবার তার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করলেন না! মেজদামশায় তাঁর ভাষণে কেবল বাবামশায়ের নাম করলেন, বলুর নাম একবারও উচ্চারিত হলো না! কিন্তু এ তো বলুরই পরিকল্পনা, সদ্য চলে যাওয়া বলুর প্রতি আপনাদের এই আচরণ কি যথার্থ? তখন আমি কিছু বলতে চাইনি, কিন্তু আপনি জানেন না এই ঘটনা আমার অন্তরে কতখানি গভীর আঘাত করেছিল! কাউকে বলতে পারিনি, কিন্তু মন থেকে এই ঘটনা কি আমি মেনে নিতে পেরেছিলাম? বাবামশায় কি তা জানতেন? তাঁর মতো ঋষিতুল্য মানুষ কি করে এমন কাজ মেনে নিলেন? ঘটা করে উদ্বোধনের পরেও তো বিদ্যালয় শুরু হতে পারল না। অবশেষে আরো বছর দুয়েক পরে আপনি এসে পুনরায় বিদ্যালয়ের কাজ নতুন করে শুরু করলেন। বলু আপনার এত স্নেহের, কিন্তু তার মৃত্যু আপনাদের মন থেকে সবটুকু মুছে দিয়ে গেল? আমি তো নিজের চোখে দেখেছি, অসুখের ঠিক আগে বাধ্য হয়ে সে কি ভয়ানক পরিশ্রমের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। বাবামশায়ের নির্দেশে সেবারে ব্রাহ্মসমাজের কাজে অমন সারা দেশময় ঘুরে বেড়িয়েছে। লাহোর থেকে ফিরে আসার সময় মথুরা, বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ছাড়া কাছাকাছি তীর্থস্থান দেখে ফেরার পথে সীতাকুণ্ডতে স্নান করতে গিয়ে ওর কানে যে জল ঢুকলো সেই হলো কাল। বাড়ি আসার পরে ওর মা ন’দির সেবাযত্নে ব্যথা একটু কমলেও কার টেগোর কোম্পানির হিসেবপত্তরের জন্যে ওকে শিলাইদহে আসতেই হলো। সাহানা তখন ওখানে আমার কাছে, সে সাহেব মাস্টার লরেন্সের কাছে ইংরেজি শেখে। চোখের সামনে দেখেছি, দিনরাত হিসেবপত্র নিয়ে বলুর স্নানাহার বিশ্রামের কিছু ঠিকঠিকানা ছিল না। দুপুরের খাওয়া কোনোদিন বেলা তিনটায় তো কোনোদিন বিকেল পাঁচটায়। কতদিন আমিও ওর জন্যে অপেক্ষা করে বসে থেকেছি। এরপরে বিশ্রামের অভাবে তার কানের যন্ত্রণা গেল আরো বেড়ে। এদিকে রথীর শরীরটাও ঠিক যাচ্ছিল না, ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে বলু আর রথীকে নিয়ে আপনি কলকাতায় চলে গেলেন। আমি পড়ে রইলুম শিলাইদহে। বলু আর সুস্থ হলো না, ওর মৃত্যু যে আমাকে কি আঘাত দিয়ে গেছে সে কেবল আমিই জানি। রাত্রে ঘুম আসতো না, একা একা ছাদে গিয়ে বসে থাকতুম, এভাবে রাত কেটে গিয়েছে! হয়তো আপনিও জানেন সেই ছাদের সঙ্গে আমার কত দুঃখের সন্ধ্যা ও রাত্রি কেটেছে। আপনি কখনো অবাক হয়েছেন, এমনকি বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু সে-আঘাত আমাকে বড় কঠিন করে বেজেছিল।

কিন্তু শিলাইদহে আমার আনন্দের স্মৃতিও কি কম! আপনার মনে আছে, সেবারে শিলাইদায় বলুর সঙ্গে সন্ধ্যায় পদ্মার পাড়ে বালিহাঁস দেখতে গিয়ে কি বিপদেই না পড়েছিলুম? আপনি তো আমাদের সঙ্গে যাননি, গিয়েছিলুম আমি আর সেই দিদি। কী করবো, আগের রাতে খাবার আগে বলু খুব একটা অ্যাডভেঞ্চার করে আসার গল্প শুনিয়ে ভারি লোভ দেখালে। পরদিন আমরা আপনাকে খোলসা করে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়েছি। আপনি রাজি হবেন না ভেবেই বলিনি, কিন্তু বলু বারবার বলেছিল, ‘কাকিমা, রবিকাকাকে বলে যাই।’ আমিই আমল দিইনি, ভেবেছি এ আর এমন কি, যে-পথে যাবো, আবার সেই পথেই তো ফিরে আসব। সন্ধের পর হালকা চাঁদের আলোয় যাবার সময় কিছু হয়নি, কিন্তু বিপদ হলো ফেরার পথে। তখন চারিদিক সব একাকার লাগছে, এদিকে রাত হয়ে আসছে, মুখ ফুটে না বললেও ফেরা নিয়ে আমারও বেশ চিন্তা হচ্ছিল, আর সেই দিদি তো প্রায় কেঁদেকেটে একশা। আসলে আমরা যে পথ ভুলে পদ্মার চর পেরিয়ে একেবারে ওপারে চলে গিয়েছিলুম তা বুঝতেই পারিনি। আর আপনি ক্রমে রাত বাড়ছে দেখে কী কাণ্ড করেছিলেন মনে আছে? আপনার মুখেই শুনেছি ‘বলু বলু’ করে চিৎকার করতে করতে চারদিক খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আপনার চিৎকারে একে একে গফুর, প্রসন্ন আর মাঝিরা সবাই বেরিয়ে পড়েছে। তাদের কেউ ডাকছে ‘বাবু বাবু’, প্রসন্ন আবার প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে ‘ছোট মা’ ‘ছোট মা’ বলে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। নিঃশব্দ রাত্রিতে নির্জন নিস্তব্ধ বালির চরে আবছা চাঁদের আলো, একমাত্র গফুরের হাতের লণ্ঠনের আলোয় আপনার উদ্বিগ্ন সেই মুখের চেহারাখানা আমি আজো কল্পনায় দেখতে পাই। সেই বিপদের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না। আপনি তো ভেবেছিলেন, আমরা বুঝি চোরাবালির মধ্যে পড়েছি, কিংবা নির্ঘাৎ বলুর কিছু একটা হয়েছে বা সাপ-খোপে কামড়ালো কি না – এইসব কত কী ভাবতে বসেছিলেন! গফুর মাঝে মাঝে ‘ওই দেখতে পেয়েছি’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে, আবার পরক্ষণেই ‘না না’ বলে হতাশ। শেষে ঘণ্টাখানেক এমন খোঁজাখুঁজির পর বোঝা গেল আমরা চড়া বেয়ে ওপারে চলে গেছি, আর ফিরতে পারছি না। তারপর আপনি বোট পাঠালেন, সেই বোটে করে ফিরতেও সেদিন আমাদের কম ভোগান্তি আর দেরি হয়নি।

সেই বলু, আপনার প্রাণাধিক বলু, আপনাদের লেখা আপনার ভাবনা আপনার পত্রপত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে ছড়িয়ে থাকা বলু – তাকে আপনি কি সহজেই ভুলে গেলেন? নাকি সেই ভয়ানক দুঃখকে চাপা দেওয়ার জন্য বলুকে আপনার জীবন থেকে একপ্রকার সরিয়ে রাখলেন? আমার বড় আফসোস, বলুর শেষবেলার দিনগুলোয় আমি ওর কাছে থাকতে পারিনি, এমনকি তার শেষকাজেও যেতে পারলুম না, আজো মনে বড় অনুশোচনা হয়। বেলাকে নিয়ে আমি তখন শিলাইদায়, যেটুকু খবর পেতাম সে আপনার চিঠিতে। আপনিও বেশি লিখতেন না পাছে আমি কষ্ট পাই – ওই বেলিকে আপনি যতটুকু জানাতেন সেখান থেকেই একটা আবছা খবর পেতুম। আমার দশা দেখে বেচারী বেলিও ভয় পেয়ে যেত। শেষে একবার বেলিই আপনাকে চিঠিতে লিখেছিল – ‘বলুদাদা কেমন আছেন? মা দিন চার-পাঁচ থেকে কেঁদেকেটে অস্থির। নাওয়া-খাওয়া একরকম বন্ধ করেছেন। মামা বোঝাচ্ছেন যে শুধু দুর্বল থাকলে ভয়ের কারণ নেই। আজ তোমার চিঠি পেয়ে চুপ করেছেন।’ সেদিন আমার চুপ না-করে থেকে আর উপায় ছিল না, মনে মনে স্পষ্ট বুঝেছিলাম, বলু চলে যাচ্ছে, তাকে ধরে রাখার আর কোনো উপায় নেই। পরে জেনেছি, বেলি ও-চিঠি লেখার দুদিন আগেই সে চলে গিয়েছে। আমার কষ্টের মাঝে আমি ভাবছিলাম সুশীর কথা, ওইটুকু মেয়ে কী নিয়ে বাঁচবে সে, আর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ন’বৌঠানের মুখখানা। পরে শুনেছি, বলুর রোগশয্যায় আপনি তার অক্লান্ত সেবা করেছিলেন। বলুর কষ্ট দেখে ন’বৌঠান শেষবেলায় ওর কাছে থাকতেই পারছিলেন না, আর সেই সমস্ত রাত জেগে আপনি সেবা করে গেছেন। ভোরের দিকে আপনি বুঝতে পেরে ন’বৌঠানকে পাশের ঘর থেকে ডেকে এনেছিলেন। শুনেছি, ন’বৌঠান যখন ওর মাথার কাছে গিয়ে বসলেন, তখন বুঝি সব শেষ হয়ে এসেছে। তবে চলে যাওয়ার আগে বলু তার মাকে হয়তো চিনতে পেরেছিল। বৌঠানের মুখে শুনেছি, তিনি বলুর কাছে গিয়ে বসতে সে যেন কিছু বলতে চেয়েছিল; কিন্তু বলতে পারেনি। তারপর একবার বমি করেই সব শেষ। এদিকে আকাশ তখন ভোর হয়ে এসেছে।

বলুর মৃত্যুর পর আপনি আমাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছেন, জীবনের সুখ-দুঃখকে বাইরের জিনিস বলে ভাবতে আপনি কতবার শিখিয়েছেন। বলেছেন, এই ‘ক্ষণিক সংসারের দ্বারা অমর আত্মার শান্তিকে কোনমতেই নষ্ট হতে দিলে চলবে না – কারণ, এমন লোকসান আর কিছুই নেই – এ যেন দু’পয়সার জন্যে লাখ টাকা খোয়ানো।’ ভগবত গীতার তুলনা টেনে বলেছেন, ‘গীতায় আছে – লোকে যাকে উদ্বেজিত করতে পারে না এবং যে উদ্বেজিত করে না – যে হর্ষ বিষাদ ভয় এবং ক্রোধ থেকে মুক্ত সেই আমার প্রিয়।’ কিন্তু এসব গভীর কথা আপনার মতো অমন করে আমি কি অন্তরের মধ্যে গ্রহণ করতে পারি? এইসব কথায় আমি সাময়িক সান্ত্বনা পাই ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ের গভীরে সেই ক্ষত থেকে ক্রমাগত যে রক্তক্ষরণ চলতে থাকে, সে-কথা আপনারা পুরুষমানুষ – হয়তো বুঝতে পারবেন না। আপনি কত সহজেই আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি করছ কী? যদি নিজের দুর্ভাবনার কাছে তুমি এমন করে আত্মসমর্পণ কর তাহলে এ সংসারে তোমার কি গতি হবে বল দেখি? বেঁচে থাকতে গেলেই মৃত্যু কতবার আমাদের দ্বারে এসে কত জায়গায় আঘাত করবে – মৃত্যুর চেয়ে নিশ্চিত ঘটনা ত নেই – শোকের বিপদের মুখে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ বন্ধু জেনে যদি নির্ভর করতে না শেখ তাহলে তোমার শোকের অন্ত নেই।’ আপনার কথার সবটুকু আমি মানি, কিন্তু এত কঠিন এমন নিরাসক্ত হতে আমি কখনো পারি? তবু চেষ্টা করেছি নিজেকে সামলে নিতে, অন্তত বাইরে যেন কোনো তার প্রকাশ না-থাকে। আজো ন’বৌঠানের ভাগ্যের দিকে তাকালে আমি যেন নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। একে ন’দাদামশায় মাথার ব্যামোর তীব্র দশায় পাগল হয়ে পড়ে আছেন, তার ওপর এই ভয়ানক পুত্রশোক উনি নিলেন কী করে? তবু আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, বলুর শোক, তারপর ন’দাদাও মারা গেলেন; কিন্তু ন’বৌঠান শুধুমাত্র পুত্রবধূ সুশীর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন। আপনাদের তখন অনেকের মনে হয়েছিল, ন’বৌঠানের সংসারের বন্ধন নষ্ট হয়ে গেলেও তিনি টাকাকড়ি কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত ভেবে চলেছেন। কিন্তু ওঁর দিকটা আপনারা একবার ভেবে দেখলেন না? আপনাদের নিয়ম অনুসারে তো ন’দাদা আর বলু মারা যাওয়ার পরে বাবামশায়ের সম্পত্তির কিছুই তো ওঁরা আর পাবেন না। একটু মাসোহারাই তখন ভরসা, সেই সময়ে ওই ছেলেমানুষ পুত্রবধূর জন্য ওঁর চিন্তা হওয়া কি খুবই অন্যায় বলে মনে হয়েছিল আপনাদেরও?

জানি, এই চিঠি পড়তে গিয়ে আপনার মুখে হয়তো আঁধার ঘনিয়ে আসছে। ভাবছেন, আপনার সেই সহজ সরল ‘ছুটি’ আজ এতদিন পরে এসব কী বলছে? সত্যিই তাই, আজ আমি কী বলছি তা নিজেও ভালো করে জানি না। এগুলো আমার বুকের তলায় চাপা পড়ে ছিল, আজ অসুখের ঘোরে আমাকে দিয়ে যেন বলিয়ে নিচ্ছে। কথাগুলো আপনাকে জানিয়ে আমি একটু হালকা হতে চাই, হয়তো একই কথা বারবার বলে বসছি। সে আপনিও জানেন না, বলুর শেষের খবরে আমার মনের অবস্থা কী হয়েছিল! বেলিকে রাত্রে ঘুম পাড়িয়ে একা একা ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকতুম, চোখের জলে রাতের আকাশ পদ্মার চর সমস্ত ঝাপসা একাকার হয়ে উঠত। কত রাত যে এভাবে জেগে থাকতুম সে নিজেও জানি না। হৃদয়ের ধন, পরম বন্ধু, একান্ত প্রিয়, স্নেহের জন যখন চলে যায় তখন মনের অবস্থা যে কী হয়, সে-কথা আপনার চেয়ে ভালো আর কে বুঝবে!

বলুর চলে যাওয়ায় যেমন নিদারুণ কষ্ট পেয়েছি, আজ এতদিন পরে বলতে বাধা নেই, নতুন বৌঠানের মৃত্যু আমাকে কি এক ভয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সে যে কি অসহায় অনুভূতি তা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। আর ভয়ের কেন্দ্রের অন্যতম কারণ তো ছিলেন আপনি। সদ্য বিয়ে হয়ে এসেছি, খুলনার গ্রাম থেকে কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকোর এই বিশাল বাড়ি – এমনিতেই ভয় পেয়েছিলাম। ভয় আর লজ্জা-সংকোচের কারণ এ-বাড়ির মেয়ে বউ সবাই সুন্দরী শিক্ষিতা, যেখানে আমার কোনো যোগ্যতাই নেই। এই কারণে বিবি প্রায় কোনোদিন আমাকে খুশি মনে গ্রহণ করতে পারেনি। আর হবে না-ই বা কেন? তাকে তো দোষ দেওয়া যায় না, আমি না-সুন্দরী, না-শিক্ষিতা! তার প্রিয় রবিকার যে এমন একজন অতিসাধারণ গ্রাম্য স্ত্রী জুটবে, সে ছিল তার কল্পনার অতীত। আপনাকেও তো প্রায় জোর করে বিয়েতে মত দিতে হয়েছিল এমনটা শুনেছি। এ-ও শুনেছি, বাবামশায় বিয়ের ব্যাপারে আপনার ওপর চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু কেন, আপনার কি বয়স বেড়ে যাচ্ছিল, না অন্য কোনো কারণে? আপনারা যখন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন তখন যশোরে বিবাহযোগ্য সুন্দরী মেয়ের নাকি আকাল পড়েছিল। আর দেখুন তো কি কপাল আপনার! পাত্রী হিসেবে সেখান থেকেই গ্রামের লেখাপড়া না-জানা কালো কুশ্রী মুখ্যুমেয়েকে বিয়ের জন্যে সবাই নির্বাচন করে বসলেন। এর আগে আপনি দুবার বিলেত ঘুরে এসেছেন, সেখানে কি কোনো সুন্দরী আপনার মনোহরণের চেষ্টা করেনি? আর সেই মেয়েটি, যে আপনার প্রথমবার বিলেত যাওয়ার আগে নানারকম সহবত শিখিয়েছিল, তার তো আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছিল, সে আমি বুঝতেই পারি। আপনি না মানলেও দেখুন এ আপনার বিধিলিপি, আমার সঙ্গেই আপনার বিবাহ স্থির হয়ে আছে। তার ওপর বাবামশায়ের নির্দেশ অমান্য করার কোনো উপায়ও ছিল না। তবে আমাকে আমৃত্যু এইটে স্বীকার করতে হবে যে, মনের মধ্যে অপছন্দের রেশ থাকলেও আপনি তা আমাকে কখনো বুঝতে দেননি, বরং গড়েপিঠে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পড়াশুনোয় কত উৎসাহ দিয়েছেন, আর বাবামশায় আমাকে লরেটোতে ভর্তিই করে দিয়েছিলেন।

আজ অনেকদিন পর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে কেন জানি না, আমার এখানে আসার সেই প্রথম স্মৃতি ভেসে উঠছে। বাবামশায়ের নির্দেশে আপনি আমাদের বাড়িতে বিয়ে করতেও গেলেন না, বরং আমাকেই মহর্ষি ভবনে আসতে হলো। অবশ্য তার দুদিন আগে জোড়াসাঁকোর বাড়ির কাছে আমাদের জন্য একটা ভাড়াবাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে এসে আমার বিয়ে হচ্ছে – এই খবরে আমার বাপের বাড়িতে দক্ষিণডিহি গ্রামের খেলার সাথিরা আমার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করতে ছাড়েনি। দুয়েকজন তো আমাকে কানে কানে বলেছিল, এমন ঘটনা নাকি তারা বাপের জন্মেও শোনেনি। আমার কিছুই করার ছিল না, আমাকে তখন ওদের ঠাট্টার সবটা মুখ বুজে শুনতে হয়েছে। বোধহয় সেদিন থেকে আমার জীবনের সবকিছু উল্টোমুখো চলতে শুরু করেছে। যেমন আপনার সেই বিয়ের নেমন্তন্ন চিঠিখানা? আমাদের কালে কখনো শুনিনি যে পাত্র তার বিবাহের চিঠি নিজেই লিখেছে। কিন্তু আপনি তো তাই করলেন। আবার চিঠির ওপরে ‘আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়’ এই ছাপানো লাইনটার পাশে কলম দিয়ে আপনি লিখে দিলেন ‘আমার মোটো নহে’। সেইটিই কি না হয়ে গেল বন্ধুদের কাছে পাঠানো আপনার বিবাহের পত্র! যেখানে কি না আপনি নিজেই আপনার পরমাত্মীয় শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহের নিমন্ত্রণ করছেন! এমনসব আজগুবি কাণ্ড আপনি ঘটিয়েছিলেন যা এর আগে কেউ ভাবতে পেরেছিল বলে মনে হয় না। বিয়ের চিঠিখানা সেই সময় আমার চোখে না পড়লেও পরে দেখে তার অর্থটা জেনে মনে মনে বেশ উপভোগ করেছিলাম। ওর একখানা চিঠি আমি যত্ন করে সরিয়ে রেখেছিলাম, আমার ড্রয়ারে লুকোনো রয়েছে।

তারপর বিয়ের সময়েও তো এক কাণ্ড বাধিয়েছিলেন! আপনার নিজের বাড়িতেই বিয়ে হচ্ছে, তাই লজ্জাটজ্জারও কোনো বালাই নেই। শুনেছি, এ-বাড়ির পশ্চিমের বারান্দায় এক পাক ঘুরে আপনি অন্দরমহলে হাজির হয়েছিলেন বিয়ের স্ত্রী আচারের জন্যে। গায়ে নাকি বরসজ্জার একখানি শাল জড়ানো ছিল। অবনের মুখে শুনেছি, আপনাকে নাকি দেখতে লাগছিল একেবারে দিল্লির বাদশা। আর সেখানে আমার কথা একবার ভাবুন, গাঁয়ের এক কালো-কুচ্ছিত মেয়ে, মুখ তুলে কোনোদিকে তাকাতে পারছি না। বিয়েতে খুব আড়ম্বর না হলেও এই বিরাট প্রাসাদে এসে পড়েছি, সামনে দাঁড়িয়ে এক রাজপুত্তুর – ভয়ে আমি একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিলুম। সাতপাক ঘুরিয়ে আমাদের দালানে নিয়ে আসা হলো, সেখানে সম্প্রদান, তারপরে বাসরে এনে বসানো হলো আমাদের, সেই ঘরখানাই নাকি আমার জন্যে নির্ধারিত। এ পর্যন্ত পুরো ঘটনা যেন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে ঘটে গেল। কিন্তু এখানেই কি শেষ আছে? বাসরের স্ত্রী-আচারের খেলায় আপনার ভয়ানক দুষ্টুমি শুরু হলো। সবাই আমাদের ঘরে বসে আছে, ভাঁড়খেলা কুলোখেলা এইসব আরম্ভ হতেই আপনার উল্টোপাল্টা কাণ্ড শুরু হলো। চাল দিয়ে ভাঁড়গুলো ভর্তি আর কালি করার বদলে আপনি ভাঁড়গুলো সব উপুড় করে দিতে লাগলেন। আমি ভয়ে জবুথবু, কী জানি এজন্যে পরে না কিছু অঘটন হয়! এসব দেখে ছোট কাকিমা বলে উঠলেন – ‘ও কি করিস রবি, এই বুঝি তোর ভাঁড়খেলা? ভাঁড়গুলো সব উল্টেপাল্টে দিচ্ছিস কেন?’ আপনার সটান জবাব – ‘জানো না কাকিমা, সব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে – কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উল্টে দিচ্ছি।’

অবশেষে আপনার কাণ্ড দেখে কাকিমা বলে উঠলেন, ‘তবে তুই একটা গান কর। তোর বাসরে আর কে গাইবে – তুই এমন গাইয়ে থাকতে?’ আর আপনিও সঙ্গে সঙ্গে বাসরে গান জুড়ে দিলেন, ওই যে ন’দিদির লেখা গান বসন্ত উৎসব নাটকে আছে –

আ মরি লাবণ্যময়ী

কে ও স্থির সৌদামিনী,

পূর্ণিমা-জোছনা দিয়ে

মার্জিত বদনখানি!

নেহারিয়া রূপ হায়,

আঁখি না ফিরিতে চায়,

অপ্সরা কি বিদ্যাধরী

কে রূপসী নাহি জানি।

সেই গানখানা আবার গাইতে লাগলেন আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। আমি একেবারে জড়োসড়ো হয়ে ওড়নায় মুখ ঢেকে মাথা হেঁট করে বসে আছি। আপনার গানের প্রতিটি শব্দ যেন আমাকে বিঁধতে লাগল, চোখ ফেটে জল আসছিল আমার। একে আমি তখন খুব রোগা, দেখতে ভালো নই, শহুরে হাবভাবের কিছুই জানি না। তার ওপর বাসরঘরে আপনার মতো এমন সুদর্শন বর গান গাইছে। সেই গানের সবটুকু মানে না বুঝলেও পূর্ণিমা জোছনার মতো বদন, অপ্সরা, বিদ্যেধরী, এগুলো তো বেশ বুঝতে পারছি – আর লজ্জায় মরমে একেবারে মরে যাচ্ছিলুম। এমনিতেই বিয়ের দিনে মেয়েরা, বিশেষ করে আমাদের মতো গ্রামের মেয়েরা, একটু ভয় পেয়ে থাকে, তার ওপর আপনি সেদিন আমাকে এমন একরাশ লজ্জা আর অপ্রস্তুতের মধ্যে ফেলেছিলেন তা বলার নয়। সবার সামনে এভাবে গান গেয়ে আরেকবার আপনি আমায় মহাবিপদে ফেলেছিলেন। ন’দিদির বড় মেয়ে হিরণ¥য়ীর বিয়ের সময় কলকাতার মিউজিয়মে কি একটা প্রদর্শনী খুলেছিল যেন, সেখানে মেজদির সঙ্গে আমারও যাবার কথা ঠিক হয়েছে। মেজদি আমাকে নতুন একটা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। বাসন্তী রঙের জমিতে লাল ফিতের মতো সরু জরির পাড় শাড়ি পরে তৈরি, হঠাৎ বেরোবার মুখে আপনি কোথা থেকে হাতে এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে খেতে খেতে সেখানে এসে হাজির। ব্যস, অমনি আমাকে দেখেই গান জুড়ে দিলেন – ‘হৃদয়কাননে ফুল ফোটাও, আধো নয়নে, সখী, চাও চাও!’ – শুধু কি গান, এমন চড়া সুরে উঁচু গলায় ধরেছেন যাতে সারাবাড়ির সবাই শুনতে পায়। আমার তখন লজ্জার একশেষ, কিন্তু আপনি তো গেয়েই চলেছেন –

‘ধীরি ধীরি প্রাণে আমার এসো হে,

মধুর হাসিয়ে ভালোবেসো হে।

হৃদয়কাননে ফুল ফোটাও,

আধো নয়নে সখী, চাও চাও –

পরান কাঁদিয়ে দিয়ে হাসিখানি হেসো হে।

আমার বেশ মনে আছে, বিয়ের বাসরে আপনার সেই ওলটপালট খেলায় আমার মনের মধ্যে যে একটা অজানা আশঙ্কা আর ভয় ঢুকেছিল, তা নিমেষের মধ্যে সত্যি হয়ে উঠবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি গ্রামের মেয়ে, অতশত বুঝতাম না, বিয়ের সমস্ত আচার-আচরণই আমার কাছে পুজোআর্চার মতো ঠেকত। আর সেখানে আপনার সেই ওলটপালটের খেলা আমার মনে ভয় পাইয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ঠিক তাই, আমার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে আমাদের বিয়ের পরের দিনই খবর এলো শিলাইদায় আমার বড় নন্দাই মারা গিয়েছেন। খবরটা জেনে আমার মনের যে কী অবস্থা হয়েছিল তা বলতে পারিনে। মনে মনে আমি তো নিজেকেই দোষ দিতে লাগলুম, কি ভীষণ অপয়া আমি, শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতে-না-রাখতে সেখানে এমন এক মৃত্যু ঘটে গেল। সারাবাড়িতে তখন শোকের ছায়া, বিয়ের আনন্দ-অনুষ্ঠান মুহূর্তে পরিণত হলো শোকের আবহে। বড়দিদি তখন জোড়াসাঁকোয় ছিলেন না। মেজদাদা, মেজবৌঠান আর বিবিদের সঙ্গে কারোয়ারে ছিলেন, নতুনদাদার তার পেয়ে সবাই ফিরে এলেন কলকাতায়। সেই চিঠিতে অবশ্য মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি, বলা হয়েছিল তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। পরে দিদিদের কাছে শুনেছি, জোড়াসাঁকোর দেউড়িতে নেমে বড়দিদি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিমেষে সবটা বুঝতে পেরে সোজা তেতলার ঘরে গিয়ে বিছানায় মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। বাবামশায় জোড়াসাঁকোতে নেই, তিনি তখন বাঁকিপুর থেকে তুসৌরী যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। বড় জামাতার এই খবরে তিনিও কিছু পরে জোড়াসাঁকোতে ফিরে এলেন। তারপর শোকের আবহ একটু কমে এলে একদিন তিনি আমাদের ডেকে পাঠালেন, ওঁর ঘরে গিয়ে প্রণাম করতে তিনি আমাদের আশীর্বাদ করে চারটি কোম্পানির মোহর দিলেন বিবাহের যৌতুক হিসেবে। তাঁর এই আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে আবার ফিরে এলাম বটে কিন্তু আমার মন তখন খুবই বিষণ্ন, কিছুই ভালো লাগছিল না। একে দেশের বাড়ির সবাইকে ছেড়ে আসা, নতুন জায়গা, তারপর হঠাৎ এই মৃত্যু – সব মিলিয়ে আমার তখন দুচোখ যেন ফেটে জল আসছিল। তখনই আমার জীবনের আরেকটা ঘটনাও ঘটে গেল। আমার বাপের বাড়ির নাম পরিবর্তন করে এই বাড়ির উপযোগী একটা নামকরণ হলো। আমি ছিলুম ভবতারিণী, এবারে আপনার রবি নামের সঙ্গে মিলিয়ে আমার নতুন নাম হলো মৃণালিনী। নতুন নামটি বেশ, আমার পছন্দ হলো খুবই; কিন্তু এও তো ঠিক, এ-বাড়িতে এসে দক্ষিণডিহি গ্রামের সেই ডানপিটে দস্যি মেয়েটি কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল, এবারে সে একেবারেই হারিয়ে গেল। তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।

বিয়ের পর পৌষমাসের পুরোটা জোড়াসাঁকো বাড়িতে কাটিয়ে মাঘের শুরুতেই আমি মেজবৌঠানের সঙ্গে লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার নানারকমের শিক্ষাদীক্ষা চলেছে। এমন কি আমার স্বাস্থ্যের দিকে তীক্ষè নজর দেওয়া হয়েছিল, ফলমূল-দুধ-দই-ক্ষীর-মাখনে আমার ক্ষীণ চেহারাকে সারিয়ে তোলার ব্যাপারে মেজদিদির আপ্রাণ চেষ্টায় আমি মনে মনে বেশ কৌতুক অনুভব করতাম। তাছাড়া বিয়ের পরে বাবামশায় ও মেজবৌঠানের বিশেষ আগ্রহে আমাকে যে কেবল লরেটো হাউসে ভর্তি করানো হয়েছিল তাই নয়, হাউসের বাইরে আমার জন্য আলাদা টিউশনির ব্যবস্থা আর সংগীতচর্চার ক্লাসেও ভর্তি করানো হয়েছিল। আপনি তো আমাকে খুবই উৎসাহ দিতেন; কিন্তু আমি কি আর এতসব পারি? পরে বাড়িতে পণ্ডিত হেমচন্দ্রের কাছে

সংস্কৃতের পাঠ শিখেছি। স্বীকার করতেই হবে, আমাকে এ-বাড়ির যোগ্য করে তোলার জন্যে আপনাদের চেষ্টার কোনোরকম ত্রুটি ছিল না। এর মাঝে আপনার সঙ্গে গিয়ে একবার যশোর থেকেও ঘুরে এলুম। সে যেন আমার কাছে বিলম্বিত দ্বিরাগমনের মতো। সেবার যখন ফিরলুম আমার চোখে সবকিছুই যেন অন্যরকম ঠেকছিল। আমি ফিরেছি শুনে বন্ধুদের অনেকেই দেখা করতে এলো। ওরা বললে, কলকাতায় থেকে আমি নাকি বেশ চকচকে হয়ে উঠেছি। শুনে মনে মনে ভারি খুশি হলুম। এইভাবে মহানন্দে দিনগুলো যেন কেটে যাচ্ছিল আমার। তবে এই আনন্দের মধ্যেও একটা অন্ধকারের কালোছায়া যে ওঁৎ পেতে বসে ছিল তা কি সেদিন ঘুণাক্ষরে টের পেয়েছিলুম?

সেই ভয়ঙ্কর কালো ছায়াটি নতুন বৌঠানের আত্মহত্যা। সেই ছায়া আমাকে কিভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে তা বলার নয়। আজ পেছন ফিরে তাকিয়ে ভাবি, বিয়ের দিনে শ্বশুরবাড়িতে আমি বউ হয়ে আসার প্রথম দিনে একটা মৃত্যু ঘটেছিল। আবার এবারে চারটে মাস পেরোতে-না-পেরোতে নতুন বৌঠান, ঠাকুরবাড়ির অন্যতম সেরা বধূটি আত্মঘাতী হলেন! এতদিন পরে মনে হয়, এই দ্বিতীয় মৃত্যুর সঙ্গেও কি আমার ভাগ্য কোনোভাবে জড়িয়ে গেছিল? আমি তখন সদ্য বউ হয়ে এসেছি, নতুনদির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার তেমন সুযোগ হয়তো ছিল না। উনি যে খুব গুণী মানুষ ছিলেন এইটে আপনার কাছে শুনে মনে মনে একটু ভয় পেতাম। তা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছে, ওঁর মতো সূক্ষ্ম অনুভব খুব কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। আজো ভাবলে অবাক হয়ে যাই, ওইরকম মানুষ, যিনি লোকলজ্জা ও সংকোচকে উপেক্ষা করে চিৎপুরের রাস্তায় গড়ের মাঠে স্বামীর পাশে

ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেড়িয়েছেন, বাড়ির তেতলায় যাঁর স্বপ্নের নন্দনকানন সর্বদা সাহিত্য ও সংগীতে মুখরিত হয়ে থাকত, যিনি ভারতী পত্রিকা গোষ্ঠীর প্রাণভ্রমরা – সেই আধুনিক মানুষটি কি না শেষে আত্মহত্যা করে বসলেন? তাঁর মনের সেই গভীর রহস্য আমি আজো সমাধান করতে পারিনি। বুঝতে পারিনি এই মর্মান্তিক ঘটনার আড়ালে প্রকৃত কারণটা ঠিক কী ছিল? আপনার সঙ্গে ওঁর স্নেহপ্রীতির সম্পর্কের কথা আমি শুনেছি। কেউ কেউ আমাকে আরো গভীর কোনো ইঙ্গিতের কথাও জানিয়েছেন। তাই বলে আত্মঘাতী? আমার জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, জীবনের শেষ আশাটুকু নিভে গেলেও কোনো মানুষ সহসা আত্মহত্যা করতে পারে না। নিজের প্রাণকে শেষ করে দিতে অনেক বড় সাহস লাগে। তবে নতুনদিদির এমন কী হয়েছিল? আমি তখন এ-বাড়িতে সদ্য এসেছি, বউ হিসেবে জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই বা ক’দিন থাকা হয়েছে আমার? থাকলেও লরেটো হাউসের পড়াশুনো, টিউশনি, সংস্কৃত পাঠের অনুশীলন – এইসবের মধ্যে সমস্ত সময় চলে যেত। এর বাইরে কোথায় কী ঘটছে সেটুকু ভালো করে বুঝে ওঠার আর সময় পেলুম কই?

অথচ আমার বুকের ভেতরটা তখন ভেঙে চুরমার, একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল – সে কেবল আপনার দিকে তাকিয়ে! কী চেহারা হয়েছিল আপনার, সে এক ভয়ানক উদ্ভ্রান্তের মতো দিশেহারা অবস্থা! না বলে হঠাৎ হঠাৎ কোথায় চলে যান, আবার কখনো বা সারাক্ষণ বিমর্ষ হয়ে চুপ করে থাকেন, ভালো করে কথা বলেন না। আপনার সে তো পাগলের দশা, অন্যদিকে আমার অবস্থাটা একবার ভাবুন দেখি। ভয়ে আমি আপনার কাছে ঘেঁষতেই পারি না, সাধারণ গ্রামের এক সাদামাটা মেয়ে আমি, যার সঙ্গে বিয়ে হলো, সারাজীবনের মতো যার হাত ধরে বাপের বাড়ি ছেড়েছি – তখনো শ্বশুরবাড়ির মানুষজনের সঙ্গে ভালো করে চেনাজানা পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি – সেই সবচেয়ে কাছের মানুষটা তার নতুন বৌঠানের শোকে এমন কাতর এতখানি বিহ্বল যে, তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর দিকে একবার চেয়ে পর্যন্ত দেখে না! দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি লুকিয়ে চোখের জল ফেলেছি, কাউকে বুঝতে দিইনি। কিন্তু পুরোটাই কি লুকোতে পেরেছিলুম, মাঝে মাঝে ধরাও পড়েছি। কেউ প্রশ্ন করলে বলেছি বাপের বাড়ির কথা মনে পড়ছে, তাই মন খারাপ। সবাই সে-কথা বিশ্বাস করেও নিয়েছে। বিয়ের পরে দেশ গাঁ ছেড়ে আসা ন-দশ বছরের মেয়ের মনে বাপের বাড়ির জন্যে দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক। ওঁরা ভেবেছেন – সত্যিই তো, বাপ-মায়ের কথা, ভাইবোনের কথা, গ্রামের কথা, ছোটবেলার খেলার সাথিদের কথা মনে পড়ে ছোট বউয়ের বুঝি সত্যিই মন খারাপ করছে, তখন বড়রা কত সান্ত্বনা দিয়েছেন আমাকে। কিন্তু আমি তো জানি, আমার সেই কষ্ট বুকের কোন গভীরে গিয়ে বেজে উঠেছিল।

বেশ বুঝতে পারি নতুনদির মৃত্যুই আপনার সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা নির্মম মৃত্যু। শুনেছি, ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যুর সময় আপনি রাত্রে ঘুমিয়ে ছিলেন। ছেলেবেলার সেই মৃত্যু আপনাকে হয়তো সেভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। আর আপনারা তো মাকে তেমন করে ঘনিষ্ঠভাবে পাননি। বাড়ির চাকরবাকরের কাছে বড় হয়ে উঠেছেন, তাই মায়ের মৃত্যু আপনার মনে সেই শূন্যতা জাগাতে পারেনি। তাছাড়া তখন থেকেই নতুন বৌঠান সর্বদা আপনাকে আগলে রেখেছিলেন। তাঁর সেই স্নেহ-আদর মায়ের চলে যাওয়াকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সহজেই। এরপরে বড় বউঠাকুরানী সর্বসুন্দরীর মৃত্যুর সময়ে আপনি জোড়াসাঁকোয় ছিলেন না, ছিলেন আমেদাবাদে। আর আমাদের বিয়ের রাত্রে বড় ভগ্নিপতি সারদাবাবুর মৃত্যু ঘটেছিল শিলাইদহে, সেও আপনার চোখের আড়ালে। তাই মৃত্যুর তীব্র হাহাকার আপনার কল্পনায় থাকলেও এ পর্যন্ত আপনাকে তার মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু এবারে আপনার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ নতুন বৌঠানের আত্মহনন ঘটল আপনার একেবারে চোখের সামনে। সেই ভয়ানক মৃত্যুশোক যে আপনাকে পাগলের মতো করে দেবে এ তো জানা কথা। হলোও তাই, তখন আপনার জগৎসংসার থেকে সমস্ত মন সরে গেল যেন, সারাক্ষণ কী একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে রয়েছেন। যে আপনি সবসময় নিজেকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর করে রাখতে ভালোবাসতেন, সেই সময় আপনার পোশাক-আশাকের দিকেও কোনো নজর নেই। খালি গায়ে একটা চাদর গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ছেন, চলে যাচ্ছেন থ্যাকার্সের বইয়ের দোকানে। আবার কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে রয়েছেন লেখার মধ্যে। তবে আপনার সেইসব লেখা তখন পড়বার সাহস বা বোধ কোনোটাই আমার ছিল না; কিন্তু পরে তার কিছু কিছু পড়েছি বইকি। পড়তে গিয়ে আমার গলার কাছেও যেন একটা বোবাকান্না দলা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে এসেছে। সে একদিকে যেমন আপনার কথা ভেবে আবার অন্যদিকে নতুনদিদির কথা মনে করেও। সেই পর্বের প্রায় সব লেখাই আপনি নতুনদিকে উদ্দেশ করে লিখেছেন, একটু মন দিয়ে পড়লেই তা বোঝা যায়। কখনো লিখেছেন – ‘হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত, আগে তোমাকে যেমন গান শুনাইতাম, এখন তোমাকে তেমন শুনাইতে পারি না কেন? এসব লেখা যে আমি তোমার জন্য লিখিতেছি। পাছে তুমি আমার কণ্ঠস্বর ভুলিয়া যাও, অনন্তের পথে চলিতে চলিতে যখন দৈবাৎ তোমাতে আমাতে দেখা হইবে তখন পাছে তুমি আমাকে চিনিতে না পারো, তাই প্রতিদিন তোমাকে স্মরণ করিয়া আমার এই কথাগুলি তোমাকে বলিতেছি, তুমি কি শুনিতেছ না!’ নতুন বৌঠানের সঙ্গে আপনার এই নীরব কথোপকথন পড়তে গিয়ে চোখ ফেটে জল আসে।

এমন কি সেই সময়ে আপনার যেসব নতুন বই বেরিয়েছিল প্রায় তার সবগুলো আপনি উৎসর্গ করেছেন নতুন দিদিকে।

প্রকৃতির প্রতিশোধ বইতে কারো নাম না জানিয়ে আপনি শুধু লিখলেন,  ‘তোমাকে দিলাম’। এই তুমি যে আপনার নতুন বৌঠান সে কি বুঝতে কারো বাকি থাকে! আর এ-প্রসঙ্গে আপনার আড়াল করার কোনো চেষ্টাও ছিল না। যেমন শৈশব সঙ্গীতের উৎসর্গের পাতায় সরাসরি আপনি লিখেছেন – ‘উপহার/ এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম। বহুকাল হইল তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম। সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতির ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে। তাই, মনে হইতেছে তুমি যেখানেই থাক না কেন, এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই।’ আর ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর উৎসর্গপত্রে একেবারে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন – ‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই।

আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি দেখিতে পাইলে না।’

কিন্তু আশ্চর্য, ওই একই সময়ে আপনার নলিনী নামের যে-নাটকটি প্রকাশিত হলো, যেখানে দক্ষিণডিহির ফুলতলা গ্রামের ফুলি ডাকনামের সেই মেয়েটি হঠাৎ একটি চরিত্র হয়ে উঠেছিল, সচেতনভাবে সে-নাটিকার মূল চরিত্র নলিনী অবলম্বনে সেই নাটকের নামটাও আপনি রেখেছিলেন নলিনী – যার সঙ্গে স্পষ্টই আমার এ-বাড়িতে দেওয়া নতুন নামের একটা সাদৃশ্য জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু নাটকখানি যখন বই হিসেবে ছাপা হলো, তখন আর সে-বইতে উৎসর্গের কোনো পাতা রইল না। কারুর নামে বই উৎসর্গ করলে তার মনে গোপনে যে আনন্দের অহঙ্কার হয়, সেটুকু থেকেও আমাকে বঞ্চিত হতে হলো। কোনোরকম ইশারা-ইঙ্গিতেও আমার নামাঙ্কিত বইয়ের উৎসর্গ পাতায় ঠাঁই হলো না আমার। বিয়ের পরে আপনার জীবনে আমার মতো সাধারণ মেয়ের উপস্থিতির যে-শুভসূচনার সূত্রপাত হলো – শুরুতেই তা আপনার কলমের নির্মম আঁচড়ে মুহূর্তে মুছে গেল। কারণ ততোক্ষণে আপনার নতুন বৌঠান আত্মঘাতী হয়েছেন। আপনার সমস্ত মন, হয়তো-বা সমস্ত অপরাধবোধ আছড়ে গিয়ে পড়েছে নতুনদিদির মৃত্যুর আবহে। ঠিক সেই সময়ে আমি এসবের অতটা না-বুঝলেও অত্যন্ত সচেতনভাবে ছাপার অক্ষরে আপনি এই ঘটনার সাক্ষী রেখে দিলেন। অথচ আপনি নিজেই একবার ভেবে দেখুন, আপনার তখনকার কত লেখার মধ্যে আমার আভাস ফুটে আছে। শৈশব সঙ্গীতের ‘লাজময়ী’ কবিতাটিকেই একবার খেয়াল করুন না, সেই লজ্জাবনত মেয়েটি কি আমি নই? অথচ আমার ভাগ্যের দিকে একবার চেয়ে দেখুন, তার উপস্থিতি যেন কোনোভাবে স্বীকার করাই হচ্ছে না। সমস্ত পটভূমি জুড়ে কেবল রয়েছেন আপনার নতুন বৌঠান। এখানে সেই হতভাগ্য গ্রামের মেয়েটির সত্যি কোনো দোষ ছিল? নতুন বৌঠানের উপস্থিতি কি শুধুই আপনার বইয়ের উৎসর্গপত্রেই ছেয়ে আছে? সেই পর্বে আপনার অধিকাংশ লেখায় বারংবার ফিরে এসেছে – মৃত্যুশোকের চাপা যন্ত্রণা, নতুনদির মর্মান্তিক স্মৃতি। প্রতিনিয়ত নিজের মনকে যেন ওলটপালট করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। নিজের সঙ্গে নিজেরই সারাক্ষণ লড়াই চলেছে, অবিরাম আপনমনে কথোপকথন।

‘পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতে স্বাস্থ্যরক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়। জীবন যেমনি আসে জীবন তেমনি যায়, মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহলে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন। হৃদয়টাকে পাষাণ করিয়া সেই পাষাণের মধ্যে তাহাকে সমাহিত করিয়া রাখ কেন। তাহা কেবল অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও; জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না। হৃদয়ের দুই দ্বারই সমান খুলিয়া রাখো, প্রবেশের দ্বার দিয়া সকলে প্রবেশ করুক, প্রস্থানের দ্বার দিয়া সকলে প্রস্থান করিবে।’ আবার পরক্ষণে বলেছেন – ‘আমি বৈরাগ্য শিখাইতেছি। অনুরাগ বন্ধ না রাখিলে তাহাকেই বৈরাগ্য বলে, অর্থাৎ অনুরাগকেই বৈরাগ্য বলে। প্রকৃতির বৈরাগ্য দেখো। সে সকলকেই ভালোবাসে বলিয়া কাহারও জন্য শোক করে না। তাহার দুই-চারিটি চন্দ্র সূর্য গুঁড়া হইয়া গেলেও তাহার মুখ অন্ধকার হয় না, … অথচ সামান্য তৃণের অগ্রভাগেও তাহার অসীম হৃদয়ের সমস্ত আদর স্থিতি করিতেছে, … প্রেম জাহ্নবীর ন্যায় প্রবাহিত হইবার জন্য হইয়াছে। তাহার প্রবহমান স্রোতের উপরে সীলমোহরের ছাপ মারিয়া ‘আমার’ বলিয়া কেহ ধরিয়া রাখিতে পারে না। সে জন্ম হইতে জন্মান্তরে প্রবাহিত হইবে।’ এমন ভারি ভারি দর্শনের কথা আমি আজো ভালো করে বুঝতে পারি না। কিন্তু আপনি কি আশ্চর্যসব কথা লিখেছেন – ‘বিস্মৃতিই যদি আমাদের অনন্তকালের বাসা হয় আর স্মৃতি যদি কেবলমাত্র দুদিনের হয় তবে সেই আমাদের স্বদেশেই যাই না কেন। সেখানে আমার শৈশবের সহচর আছে; সে আমার জীবনের খেলাঘর এখান হইতে ভাঙিয়া লইয়া গেছে – যাবার সময় সে আমার কাছে কাঁদিয়া গেছে – যাবার সময় সে আমাকে শেষ তাহার শেষ ভালোবাসা দিয়া গেছে। এই মৃত্যুর দেশে, এই জগতের মধ্যাহ্নকিরণে কি তাহার সেই ভালোবাসার উপহার প্রতি মুহূর্তেই শুকাইয়া ফেলিব!’ এর অর্থ আমি আজ এতদিন পরেও বুঝতে পারিনি। এর পরেরটুকু আরো মর্মান্তিক – ‘সেদিন বাঁশি বাজাইয়া আসিল, সে আজ গেল কী করিয়া! সে কেন চোখের জল ফেলিল! সে তাহার গভীর হৃদয়ের অতৃপ্তি, তাহার আজন্মকালের দুরাশা, শ্মশানের চিতার মধ্যে বিসর্জন দিয়া গেল কোথায়! সে কেন বালিকাই রহিল না, … সে আপনার সাধের জিনিসসকল ফেলিয়া, আপনার ঘর ছাড়িয়া, আপনার ভালোবাসার লোকদের প্রতি একবার ফিরিয়া না চাহিয়া – যে কোলে ছেলেরা খেলা করিত, যে হাতে সে রোগীর সেবা করিত, সেই স্নেহমাখানো কোল, সেই কোমল হাত, সেই সুন্দর দেহ সত্য সত্যই একেবারে ছাই করিয়া চলিয়া গেল!’ আপনার এই লেখা পড়তে গিয়ে আমি যে কত কেঁদেছি, তা আপনি জানন না।

আবার ‘ভারতীয়’ লেখায় বললেন – ‘এই যে অতি কোমল বাতাস বহিতেছে, এই যে আমার চোখের সুমুখে গঙ্গার ছোট ছোট তরঙ্গগুলি মৃদু মৃদু শব্দ করিতে করিতে তটের উপরে মুহুর্মুহু লুটাইয়া পড়িতেছে ইহারা আমার হৃদয়ের এই অতি তীব্র শোক অহরহ শান্ত করিতেছে। জগতের চতুর্দ্দিক হইতে আমার উপর অবিশ্রাম সান্ত্বনা বর্ষিত হইতেছে, অথচ আমি জানিতে পারিতেছি না, অথচ কেহই একটি সান্ত্বনার বাক্য বলিতেছে না। কেবল অলক্ষ্যে অদৃশ্যে আমার আহত হৃদয়ের উপরে তাহাদের মন্ত্রপূত হাত বুলাইয়া যাইতেছে …।’ সরোজিনী প্রয়াণে একটু অন্যভাবে ‘আবার হৃদয়ের মধ্যে মেঘ করিয়া আসে – লেখার উপরে গম্ভীর ছায়া পড়ে, – মনের কথাগুলি শ্রাবণের বারিধারার মত অশ্রুর আকারে র্ঝর্ঝ করিয়া ঝরিয়া পড়িতে চায়। কিন্তু এ লেখার বাদ্লা কাহারো ত ভাল লাগিবে না। আমার মনের মধ্যে যাহাই হউক, আমি নিজের মেঘে পাঠকের সূর্য্যকিরণ রোধ করিয়া রাখিতে চাই না …।’ সেখানেই কিছু পরে আবার বলে উঠেছেন – ‘এ সব কতদিনকার কত ছবি মনের মধ্যে আঁকা রহিয়াছে। ইহারা বড় সুখের ছবি, আজ ইহাদের চারিদিকে অশ্রুজলের স্ফটিক দিয়া বাঁধাইয়া রাখিয়াছি। … এখন যাহা কিছু দেখিব সেইগুলি মনে করাইয়া দিবে – এখনকার সৌন্দর্য্য সেই সকল স্মৃতির ছায়ায় সুন্দর হইয়া উঠিবে।’ এখানে আপনার মনের ভেতরে যে স্পষ্টভাবে নতুনদা আর বৌঠানের সঙ্গে আপনার চন্দননগরের স্মৃতি মিশে রয়েছে, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। আবার নতুন দিদির আত্মহনের পরে তাঁর সেই বন্ধ ঘরখানার উদ্দেশে আপনার হতাশা – ‘বৃহৎ বাড়ির মধ্যে কেবল একটি ঘর বন্ধ। তাহার তালাতে মরিচা ধরিয়াছে – তাহার চাবি কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সন্ধ্যা বেলা সে ঘরে আলো জ্বলে না, দিনের বেলা সে ঘরে লোক থাকে না – এমন কতদিন হইতে কে জানে!’

আজো সত্যি করে জানি না, নতুন দিদির অমন তীব্র অভিমান কী সূত্রে ঘটেছিল? এ-বাড়িতে অনেক গল্পই আমার কানে এসেছে, দাসদাসীরা কিছু কম কানাঘুষো করেনি। যেসব নিয়ে ভাবি না। কখনো মনে হয়, অন্য সবকিছু ছাপিয়ে কেবল আমাকে ঘিরেই কি তাঁর অভিমান অমন ভীষণ হয়ে উঠেছিল? আমার জন্যেই উনি ক্রমশ আপনাকে হারিয়ে ফেলছিলেন? তাই এই আত্মঘাত?

নতুনদির মৃত্যুর পর আমাকে পাকাপাকিভাবে মেজদিদিদের লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে জোড়াসাঁকোয় নিয়ে আসা হলো। এ-বাড়িতে এসেও আমার যত্নের কোনো ঘাটতি রইল না।  বাড়ির ছোটবউ হিসেবে আমি যেন কিছু বেশি আদরযত্ন পেতে লাগলাম। এই সময়ে দর্শনী নামে এক দাসীকে কেবল আমার কাজেই বহাল করা হলো। বাবামশায়ের নির্দেশে কোনো দিকে আয়োজনের কোনো ত্রুটি নেই, বরং কিছু বেশিই। যেমন ধরা যাক, বাড়ির অন্য বউরা তখন যা মাসোহারা পেতেন তার চেয়ে আমার জন্যে অনেক বেশি বরাদ্দ হলো। এছাড়াও নতুন নতুন রকমের পোশাক তৈরি হতে লাগল আমার ব্যবহারের জন্য, সেসব বিচিত্র কাণ্ড। নয়ানশুক কাপড়ের গাউন, ঘাগরা ওড়নায় সেজে নিজেকেই তখন যেন আর চিনতে পারি না। ছোট ছিলুম ঠিক বুঝিনি, আজ মনে হয়, আমাকে নিয়ে সেদিনের এত আয়োজন কেন? এমন হতে পারে যে, নতুনদির মৃত্যুর পরে আমার ওপর দিয়েও যে প্রবল ঝড় বয়েছে, তার ওপরে হয়তো কিছুটা সান্ত্বনার প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা চলেছিল। যাতে সেই মুহূর্তে আমার প্রতি আপনার যে উদাসীনতা দেখা দিয়েছিল – তাকে একটু হলেও প্রশমিত করার চেষ্টা করা যায়। আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, আপনার অন্তরের সেই অপূরণীয় শোক কি সহজে প্রশমিত হতে পেরেছিল? ওপর থেকে হয়তো বোঝা যেত না, আপনি বাইরের কাউকে বুঝতে দিতেন না, কিন্তু মনের গভীরে? যাকে আপনি বলেছেন আপনার সতেরো বছরের সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা, তাকে কি আপনি অত সহজে ভুলতে পেরেছিলেন? আপনার লেখায় কি নিদারুণ আর্তিই না তখন ঝরে পড়েছে – ‘আমার যে গেছে সে আমাকে কতদিন হইতে জানিত – আমাকে কত প্রভাতে, কত দ্বিপ্রহরে, কত সন্ধ্যাবেলায় সে দেখিয়াছে! কত বসন্তে, কত বর্ষায়, কত শরতে আমি তাহার কাছে ছিলাম! সে আমাকে কত স্নেহ করিয়াছে, আমার সঙ্গে কত খেলা করিয়াছে, আমাকে শতসহস্র বিশেষ ঘটনার মধ্যে খুব কাছে

থাকিয়া দেখিয়াছে! সে আমাকে যখন ডাকিত তখন আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশই, আমার এই সতেরো বৎসর তাহার সমস্ত খেলাধুলা লইয়া তাহাকে সাড়া দিত। ইহাকে সে ছাড়া আর কেহ জানিত না, সে জানে না। সে চলিয়া গেছে, এখন আর ইহাকে কেহ ডাকে না, এ আর-কাহারও ডাকে সাড়া দেয় না! তাঁহার সেই বিশেষ কণ্ঠস্বর, তাঁহার সেই অতি পরিচিত সুমধুর স্নেহের আহ্বান ছাড়া জগতে এ আর কিছুই চেনে না। বহির্জগতের সহিত এই ব্যক্তির আর কোনো সম্বন্ধই রহিল না – সেখান হইতে এ একেবারেই পালাইয়া আসিল – এ জন্মের মতো আমার হৃদয়-কবরের অতি গুপ্ত অন্ধকারের মধ্যে ইহার জীবিত সমাধি হইল।’

কী আশ্চর্য রকমের কথা লিখেছেন আপনি! পড়তে গিয়ে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে! নতুনদির মৃত্যুর পরে বাইরের সংসারের সঙ্গে আপনারা আর কোনো সম্বন্ধ রইল না – কত বড় একটা কথা কি অনায়াসে আপনি বলে দিলেন! তাহলে তখন আপনার কাছে আমার কোনো অস্তিত্বই ছিল না? বুঝতে পারছেন, সদ্য বিয়ে হয়ে আসা সেই ন’দশ বছরের সরল বালিকার প্রতি সেদিন কি নিদারুণ আঘাত আপনি হেনেছিলেন? বাবামশায় আর বাড়ির অন্য গুরুজনেরা আমাকে পরম স্নেহে আগলে না-রাখলে সেদিন আমার কি দশা হতো সে-কথা আপনি একবারও ভেবে দেখেছিলেন? মনে হয় ভাবেননি, আপনি কেবল আপনার নিজের শোকে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। বৌঠানের মৃত্যুর পর আপনার সেই পায়ের নিচ থেকে পৃথিবী সরে যাওয়া, আকাশ থেকে আলো নিভে যাওয়া, প্রিয়হীন শূন্য জগতে জীবনের সমস্ত সাধ চলে যাওয়ার কুহক ঘুচতে আরো কতদিন সময় লেগেছিল সে আমি এখনো বলতে পারব না। নতুনদির যত্নে গড়া বাগান, সেই বাগানের ফুলের সঙ্গেও দেখি নিজেকে মিশিয়ে নিয়েছেন – ‘তুমি যে-ঘরটিতে রোজ সকালে বসিতে তাহারই দ্বারে স্বহস্তে যে-রজনীগন্ধার গাছ রোপণ করিয়েছিলে তাহাকে কি আর তোমার মনে আছে! … আজ সে কত ফুল ফুটাইয়া প্রতিদিন প্রভাতে তোমার সেই শূন্য ঘরের দিকে চাহিয়া থাকে। সে যেন মনে করে, বুঝি তাহারই ’পরে অভিমান করিয়া তুমি কোথায় চলিয়া গিয়াছ! তাই সে আজ বেশি করিয়া ফুল ফুটাইতেছে। তোমাকে বলিতেছে, ‘তুমি এসো, তোমাকে রোজ ফুল দিব!’ হায় হায়, যখন সে দেখিতে চায় তখন সে ভালো করিয়া দেখিতে পায় না – আর যখন সে শূন্যহৃদয়ে চলিয়া যায়, এ-জন্মের মতো দেখা ফুরাইয়া যায়, তখন আর তাহাকে ফিরিয়া ডাকিলে কী হইবে! সমস্ত হৃদয় তাহার সমস্ত ভালোবাসার ডালাটি সাজাইয়া তাহাকে ডাকিতে থাকে। আমিও তোমার গৃহের শূন্য দ্বারে বসিয়া প্রতিদিন সকালে একটি একটি করিয়া রজনীগন্ধা ফুটাইতেছি – কে দেখিবে! ঝরিয়া পড়িবার সময় কাহার সদয় চরণের তলে ঝরিয়া পড়িবে! আর-সকলেই ইচ্ছা করিলে এই ফুল ছিঁড়িয়া লইয়া মালা গাঁথিতে পারে, ফেলিয়া দিতে পারে – কেবল তোমারই স্নেহের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যও ইহাদের উপরে আর পড়িবে না।’

আপনার সেই অবিশ্রান্ত শোকের ধারা এমনি করেই বুঝি বয়ে চলেছিল। তবে এও স্বীকার করি, আপনি পুরুষমানুষ, নিজের জীবনবোধের মধ্যে দিয়ে ক্রমে আপনি যেন এক নতুন মানুষ হয়ে উঠতে চেষ্টা করছিলেন। মৃত্যুশোকের তীব্র বেদনা থেকে এক নিরাসক্ত মুক্তির দিকে এগোতে চাইছিলেন। কিন্তু আমার মনের সেই ভয়, যন্ত্রণা, সেই বেদনার্ত অস্থিরতা দীর্ঘকাল বাসা বেঁধে বসেছিল। এখনো স্বপ্নে সেইসব দিনগুলো যেন হঠাৎ ভেসে ওঠে।

আজ এতদিন পরে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে বড় ইচ্ছে করছে। কিছু মনে করবেন না, সত্য করে বলুন – নতুনদির উদ্দেশে সেই হৃদয় নিঙড়ানো লেখা পুষ্পাঞ্জলির শেষে আপনি এক ছোট মেয়ের কথা লিখেছিলেন। কে সেই মেয়েটি, সে কি আমি? আপনি কি আমার কথা ভেবে সেদিন ওই ছত্র-কখানা লিখেছিলেন? খেয়াল করে দেখেছি, আমি তো সত্যি সেই ভয়ানক দুর্যোগের সন্ধ্যাবেলায় মেজদির সঙ্গে তাঁর পার্কস্ট্রিটের বাড়ি থেকে জোড়াসাঁকোয় ফিরেছিলুম। কি আশ্চর্য, আপনিও সেখানে নতুন বৌঠানের উদ্দেশে লিখেছেন – ‘তোমার ঘরে যে প্রতিদিন অতিথি আসিতেছে – হৃদয়ে সরল প্রীতির সহিত তাহাদিগকে কেহ যে আদর করিয়া বসিতে বলে না। তুমি যাহাকে বড়ো ভালোবাসিতে সেই ছোটো মেয়েটি যে আজ সন্ধ্যাবেলায় আসিয়াছে – তাহাকে আদর করিয়া খেতে দিবে কে। এখন আর কে কাহাকে দেখিবে! যে অযাচিত প্রীতি স্নেহ-সান্ত্বনায় সমস্ত সংসার অভিষিক্ত ছিল সে নির্ঝর শুষ্ক হইয়া গেল – এখন কেবল কতকগুলি স্বতন্ত্র স্বার্থপর কঠিন পাষাণখণ্ড তাহারই পথে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হইয়া রহিল!’ আমি আজো বুঝতে পারিনি, আমার পথে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সেইসব স্বতন্ত্র স্বার্থপর পাষাণখণ্ড বলতে আপনি কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, কাদের কথা বলতে চেয়েছিলেন?  আপনি কি আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন? আপনার লেখাটি পড়তে গিয়ে বারবার মনে হয়, নতুন বৌঠান আপনার গভীরতম বন্ধু, অত্যন্ত প্রিয়জন তো বটেই, সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন আপনার পরম আশ্রয়। আজ ভেতর থেকে অনুভব করি, ওঁর অনুপস্থিতিতে সেদিন আমাকে নিয়েও আপনি কতটা চিন্তিত হয়েছিলেন! হয়তো মনে মনে চেয়েছিলেন, আমিও আপনার নতুন বৌঠানের স্নিগ্ধ আঁচলের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠি; কিন্তু বিধাতার নিষ্ঠুর পরিহাসে সে আর হলো না। নতুনদির স্নেহের স্পর্শ আমার কপালে আর জুটল না।

আমার বেশ মনে আছে, প্রাথমিকভাবে নতুনদির সেই মর্মান্তিক শোক, অন্তত ওপর থেকে কাটিয়ে উঠতে আপনার প্রায় ছ’সাত মাস সময় গিয়েছিল। তারপর একটু একটু করে আপনার কাছে ঘেঁষতে পেরেছিলাম, সেও অতি সন্তর্পণে, দুরুদুরু বুকে। তখন আমি তিল তিল করে আপনার প্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছি, আপনি যা ভালোবাসেন, তাই করতে চেয়েছি। আড়াল থেকে আপনাকে একটু খুশি করার জন্য কত কিই না করেছি – সে কেবল আমি জানি। আপনাকে খুশি করার জন্যে ভেতরে ভেতরে আমি নতুনদির মতো হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ওঁর মতো গুণী মানুষ হওয়া আমার পক্ষে কোনোদিন সম্ভব নয়, সেটা জেনেও চেষ্টার কসুর করিনি। বিয়ের পর যখন এ-বাড়িতে এলুম, তখন অনেকেই আড়ালে বলেছে, ‘রবিকাকার বড় দুর্ভাগ্য যে এমন অযোগ্য স্ত্রী নিয়ে তাঁকে সংসার করতে হবে।’ সে-কথা কি আমার বুকে একটুও বাজেনি? আমি কি আজো তেমনি অযোগ্য হয়ে রইলুম? আপনার জীবনের কোথাও কি আমার কোনো মূল্য নেই? বিদ্যায়, জ্ঞানে, পড়াশুনোয় আমি যে এ-বাড়ির মেয়েদের ধারেকাছেও নই – সে আমার অজানা নয়। এমনকি বিবিকে আপনি এত ভালোবাসেন, সেজন্যে বিবির প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই, বরং ওর গুণের দিকেই আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থেকেছি। বিবি তো রূপে-গুণে-বিদ্যায় অসাধারণ, আমি কখনো তার কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারব না, এইটে বুঝে নিয়ে – আমি যা পারি না আর যা কোনোদিন পারব না – সেই না-পারার ফাঁকটুকু ভরাট করতে চেয়েছি আমার শ্রম দিয়ে, আমার অন্তরের যত্ন দিয়ে। গ্রামের মেয়ে আমি, মনকে শক্ত করে বেঁধে আমার সীমাবদ্ধ বিদ্যেবুদ্ধির ওপরে সর্বদা ঠাঁই দিয়েছি আমার সেবার কাজ, যা আমি পারি। আমার সকল প্রাণ, সমস্ত পরিশ্রম এ-বাড়ির জন্যে নিঃস্বার্থভাবে ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তা হয়তো অনেকেই বুঝেছেন, আবার বিদ্রƒপের ইশারাও কি পাইনি? কখনো মনে হয়েছে আমি বুঝি এ-বাড়ির নিতান্ত এক কাজের লোক ছাড়া আর কিছু নই। পাশাপাশি এও জেনেছি, বাবামশায়ের স্নেহ-আশীর্বাদ সবসময় আমার সঙ্গে আছে। আর সে কেবল সাময়িক নয়, সে আমার সারাজীবনের সংকল্প, আমার ভাবনা, আমার তপস্যা। অবশেষে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে যেদিন আপনি আমায় গ্রহণ করলেন সেদিনও আমি চোখের জলে ভেসে গিয়েছিলুম। বাঁধভাঙা বন্যার মতো আমার সমস্ত কান্না তখন আর কোনো বাধা মানেনি, বেরিয়ে এসেছিল প্রবল ধারায়। সেদিন আপনার স্নেহের সান্ত্বনাও কখনো ভুলব না। আমার সেই চোখের জলে যে কতখানি আনন্দ, কত অপেক্ষার সুখানুভূতি মিশে ছিল তা আপনি বুঝতে পারবেন না। এত কাল পরে নিজের মুখে বলতে বড় সংকোচ হয়, আজো পড়তে গিয়ে আপনার কড়ি ও কোমলের কবিতায় যখন কখনো আমার ছায়া ফুটে উঠতে দেখি তখন লজ্জা আর আনন্দ মিশে, সে কি এক আশ্চর্য অনুভূতি হয় তা বলতে পারিনে। তবে একটা কথা মনে মনে আজো আমি মানতে পারিনি, আপনি অমন অসময়ে আমাদের রানীর বিয়ে দিতে কেন রাজি হলেন? সদ্য আষাঢ় মাসে বেলির বিয়ে হলো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না, হাঙ্গামাও কম হয়নি। শরৎ নিজে না-চাইলেও ওদের পণের টাকা নিয়ে আপনার ভাবনা কি কিছু কম ছিল? আপনি তো আপনার বইয়ের কপিরাইট পর্যন্ত বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। তবুও শেষ রক্ষা হচ্ছিল না। বেলির শাশুড়ি এবং শরতের দাদা মিলে বিয়েতে যেভাবে বিশ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন – সে-কথা ভাবলে আজো আমার বুক কেঁপে ওঠে। এর আগে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এত বিয়ের আয়োজন হয়েছে, সেখানে বেলির বিয়ের মতো টাকা-পয়সা নিয়ে কখনো এমন দরকষাকষি হয়েছে বলে জানা নেই। বেলির বিয়েতে যে এমনটা হবে, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। শেষে এমন তিক্ততায় পরিণত হলো যে, মনে মনে আমি প্রায় স্থির করে ফেলেছিলুম, থাক এ-বিয়েতে আর কাজ নেই। শেষ পর্যন্ত শরতের সঙ্গে যে বেলির বিয়ে হতে পারবে, সে-আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলুম। এত হাঙ্গা করে সে-বিয়ে মিটতে-না-মিটতে আপনি আবার রানীর বিয়ে নিয়ে অমন মেতে উঠলেন কেন?

আমাদের রেণুকা তখন নিতান্ত বালিকা! আর আমি তো নিজের জীবন দিয়ে জানি, ওই অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ের পর কত রকমের সমস্যার সামনে

 তাদের দাঁড়াতে হয়! এমন কত কথা থাকে যা কারুকে বলতে পারা যায় না। সেসব আপনাকে বুঝিয়ে বলেও আমি নিরস্ত করতে পারিনি। তার ওপর রানীর মতো মেয়ে, আমার ভয়ানক চিন্তা ছিল ওকে নিয়ে। ছোট থেকেই সে বড় জেদি, ভাবনাচিন্তাও কেমন যেন সৃষ্টিছাড়া ধরনের – সে তো আপনি জানতেন। আপনার মনে আছে, একবার ওর জন্মদিনে নীতিন্দ্র একটা সিল্কের তৈরি দামি ফ্রক উপহার দিলে সে কি কাণ্ড না করেছিল? লেডল কোম্পানির সেই ফ্রকের বাহার দেখে আমরা সকলেই খুব খুশি, তারপর রানীকে ডেকে জোর করে সেই ফ্রক পরিয়ে দিতে সে কি রেগে উঠেছিল? অমন দামি ফ্রক, আর সে কি না তার লেস ফ্রিলগুলো ছিঁড়ে এক টানে ফ্রকটা গা থেকে খুলে ঘাড় বেঁকিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল! ওর কাণ্ড দেখে সবাই ভয়ে লজ্জায় জড়সড়, শেষকালে ওকে বুঝিয়ে বলতে সে বললে ‘তোমরা তো জানো, আমি এসব ভালোবাসি নে, তাও তোমরা জোর করে আমাকে এসব পরাও কেন?’ ছোট থেকেই ও যেন কেমন! আজ মনে হয়, ওর মধ্যে হয়তো সন্ন্যাসী-বৈরাগীর মন লুকিয়ে ছিল। আপনিও তো দেখেছেন, ও চুল আঁচড়াতে চাইত না, সাজতে একেবারে ভালোবাসত না, মাছ-মাংস পর্যন্ত খেতে চাইত না – এমন জেদি সৃষ্টিছাড়া মেয়েকে অমন সাততাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্যে আমার সায় ছিল না মোটে। আপনি ভেবেছিলেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জায়গার বদলে মানুষজনের পরিবর্তনে ওর জেদ হয়তো কমে যাবে, রানী অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কিন্তু আমি ওকে যতটুকু চিনি তাতে করে আমার সেরকমটা মনে হয়নি। তাছাড়া আমি যে আপনাকে বুঝিয়ে বলব তার সুযোগই পেলাম না। হঠাৎ একদিন বাইরে থেকে ফিরে আমাকে বললেন, ‘ছোটবউ, রানীর বিয়ে ঠিক করে এলুম, মাঝে মাত্র তিনদিন আছে, তার পরদিন বিয়ে।’ আমি তো আকাশ থেকে পড়লুম, ‘সে কি, আপনি কী বলছেন, এই তো সবে বেলির বিয়ে হলো। এর মধ্যেই আবার মেয়ের বিয়ে দেবেন?’ কিন্তু আপনি মনে মনে সব ঠিক করেই ফেলেছেন। হেসে জবাব দিলেন, ‘ছেলেটিকে আমার বড্ড ভালো লেগেছে ছোটবউ, যেমন দেখতে সুন্দর তেমনি মিষ্টি অমায়িক স্বভাব। রানীটা যে জেদি মেয়ে, এর বর একটু ভালোমানুষ-গোছের না হলে চলবে কেন? আর সত্যেন বিয়ের দুদিন পরেই বিলেত চলে যাবে। সে ফিরতে ফিরতে রানী বেশ বড়ো হয়ে উঠবে।’ শুনেছি, আপনি তখন জগদীশবাবুকেও লিখেছিলেন ‘ছেলেটি তাহার অ্যালোপ্যাথি ডিগ্রির ওপর হোমিওপ্যাথিক চূড়া চড়াইবার জন্য আমেরিকা রওনা হইতেছে। বেশি দিন সেখানে থাকিতে হইবে না। ছেলেটি ভাল, বিনয়ী, কৃতী।’ এসবের পরে আমার তো আর কোনো কথা চলে না। কিন্তু এই অল্পসময়ে তিনদিনের মধ্যে সব জোগাড় হবে কী করে তার ঠিক নেই! আপনি শুনে বললেন, কলকাতা শহরে নাকি কিছুই আটকায় না। ‘তুমি একটু প্রসন্ন মনে কাজে লেগে যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ এই বলে আপনি তো চলে গেলেন, কিন্তু আমি মেয়ের মা, আমার কি ভাবনার শেষ আছে?

এদিকে রানী তো সহজে তার বিয়ে মেনে নিতে পারেনি, আপনি নিজেই দেখেছিলেন – বিয়ের কথা শুনেই সে কেমন ভুরু কুঁচকে রইল! শেষকালে অবশ্য সব ঠিকমতোই হলো, বিয়েতে বেশি জাঁকজমক করা হয়নি, সে একদিকে ভালোই হয়েছিল। সেদিন আবার বাড়িতে দুজনের বিয়ে, সেজদার মেয়ে সুনৃতার বিয়ে রাত ন’টায়, তারপর রানীর বিয়ে বসল এগারোটায়। তবে রানীকে বিয়েতে মানানোই দায় হয়েছিল, শেষে আপনার মুখে এইটে শুনে সে কোনোমতে নিমরাজি হলো যে, বিয়ের পরেই তার বর বিলেত চলে যাবে। এটা জেনে রানী আপাতত বিয়ের সব কাজকর্ম লক্ষ্মীমেয়ের মতোই মাথা নিচু করে মেনে নিয়েছিল।

এবারে আপনাকে যে-কথাটি বলব, তা আপনাকে রাখতে হবে। আমার দুই মেয়ের তো বিয়ে ভালোভাবেই সমাধা হলো। আমার ছেলের বিয়ে কিন্তু আমাকে ঠিক করতে দিতে হবে। মনে বড় সাধ ও-বাড়ির গগনদাদাদের বোন বিনয়িনীর মেয়ে প্রতিমার সঙ্গে আমার রথীর বিয়ে হয়। ফুলের মতো ওই মেয়েটিকে আমার ভারি ভালো লাগে, ও দেখতে যেমন সুশ্রী আর স্বভাবটিও তেমনি মিষ্টি। আপনি কিন্তু গগনদাদাদের সঙ্গে আগে থেকেই এই কথাটা পেড়ে রাখবেন। আমার শরীর কবে যে ভালো হবে, কবে আবার বিছানা ছেড়ে উঠতে পারব জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো আর কোনোদিন ভালোই হবো না – এইটে ভাবলে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। চারিদিকে এত কাজের মাঝে আপনাকে কি চিন্তায় ফেলেছি, কাজের কত ক্ষতি করে দিচ্ছি – এসব ভেবে আমার চোখ ফেটে জল আসে। ছোটবেলায় আমার মায়ের কাছে শুনেছিলুম, স্বামীর সেবা পাওয়া নাকি বড় সৌভাগ্যের। কিন্তু আমি আর আপনার সেবা নিতে পারছি না, প্রতিদিন লজ্জায়-সংকোচে মরমে মরে যাচ্ছি। আপনি কিছুতেই বাইরের নার্স রাখতে দেবেন না, নিজের হাতে সেবা করবেন। বলুন তো এতে আমার মনের মধ্যে কী হয়? রাতের পর রাত জেগে হাতপাখার হাওয়া করে আপনি আমাকে ঘুমোতে বলেন। ঘুম যে আমার আসে না। বলুন তো, আমি কি কখনো ঘুমোতে পারি? আপনি জোর করে শমীকে বিদ্যালয়ে রেখে এলেন, ওই একরত্তি কোলের ছেলে শমী, ওকে ছাড়া আমার চোখে ঘুম আসবে কেমন করে? ঝোঁকের মাথায় আপনাকে আজ এত কথা বললুম, এত অভিযোগ জানালুম বলে আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি তো জানেন, আমি কিছু বানিয়ে বলতে পারিনে। কি জানি, আর হয়তো কোনোদিন এসব কথা বলার সুযোগই পাবো না। আপনার কাছে আমি অনেক ভুলত্রুটি করেছি, আমাকে মার্জনা করবেন। আজ একটাই কথা, পরজন্ম আছে কি না জানি না, যদি থাকে তবে যেন স্বামী হিসেবে আপনাকেই পাই – করুণাময় ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা জানিয়ে রাখি। প্রণাম নেবেন। ইতি।

২৪ কার্তিক, ১৩০৯

আপনার ‘ছুটি’

* বিবি – ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী।

* বলু  – বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

গ্রন্থপঞ্জি

          ১.        পুষ্পাঞ্জলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতী, বৈশাখ ১২৯২ (রবীন্দ্র রচনাবলী নবম খণ্ড, সুলভ সং-এর পাঠ), বিশ্বভারতী, ১৩৯৬।

          ২.       আমাদের কথা, প্রফুল্লময়ী দেবী (তথ্যসূত্র : বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংখ্যা), কলকাতা ১৪২০।

          ৩.       পিতৃস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জিজ্ঞাসা পাবলিকেশনস (প্রা.) লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৯৫।

          ৪.       মৃণালিনী দেবী (শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত), বিশ্বভারতী, পুনর্মুদ্রণ, পৌষ ১৩৯৭।

          ৫.       ছিন্নপত্রাবলী, বিশ্বভারতী, পুনর্মুদ্রণ, ভাদ্র ১৪০৯।

          ৬.       চিঠিপত্র, প্রথম খণ্ড, বিশ্বভারতী।

          ৭.       চিঠিপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, বিশ্বভারতী।

          ৮.       চিঠিপত্র, ষষ্ঠ খণ্ড, বিশ্বভারতী।

          ৯.       স্মৃতিসম্পুট, তৃতীয় খণ্ড, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, রবীন্দ্রভবন, বিশ্বভারতী, ২০০১।

          ১০.      রবিজীবনী (দ্বিতীয়-ষষ্ঠ খণ্ড), প্রশান্তকুমার পাল, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

          ১১.      ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ২০০৯।

          ১২.      সম্পর্ক, কবি ও কবিপত্নী, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা, ১৪১০।