সুধীন দত্তের পিতৃস্মৃতি ও কবিতা ‘১৯৪৫’

কবিরা কবিতা লেখেন। আমরা পাঠকেরা তার ব্যাখ্যা করি। এবং তা বহুমুখী। কবিতার এটাই সবচেয়ে বড়ো ফাঁদ, ফন্দি কিংবা মজা। আসলে কবিতা একবার কবির কলম থেকে বেরিয়ে পড়লে এর ওপর কবির অধিকার কতটা থাকে, বলা শক্ত; এমনকি তিনি যদি জীবিত থেকেও তার ব্যাখ্যা দেন, তাও সর্বগ্রাহ্য হয় কি না সন্দেহ। আর যদি তিনি থাকেন লোকান্তরে, তবে গবেষণা, ব্যাখ্যা আর অর্থকরণ হতে পারে সীমাহীন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের করা তাঁর ঘোষিত গুরু ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মের ‘লাপ্রে মিদি দু আঁ ফন’ কবিতার অসাধারণ অনুবাদ প্রতিধ্বনি কাব্যের অন্তর্গত ‘ফনের দিবাস্বপ্ন’ একটি অতুলনীয় ভাষ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক লিখেছেন, না মূল অনুবাদ, না ভাষ্য – কোনোটিই তাঁকে বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি। আবার দু-একজন কৌতুক করে বলেছেন, সুধীন দত্তের বাংলা গদ্যের ‘বঙ্গানুবাদ’ হওয়া দরকার। এর বিপরীতে অবশ্য ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ই বলেছেন, সুধীন দত্ত আসলে গদ্যে সনেট লিখতেই চেয়েছেন। এসব হিসাব থেকে অবশ্যই বাদ যাবে তাঁর ‘কাব্যের মুক্তি’ নামের প্রবন্ধ।

তবে গদ্য সম্পর্কে যে-বক্তব্যই থাকুক, সুধীন দত্তের পদ্য রচনা ‘দুর্বোধ্য বলে নিন্দিত’ হয়নি। আর তাঁর সংবর্ত কাব্য এসেছিল কবিজীবনের এক পরম ঋদ্ধি ও পরিপূর্ণতার মুহূর্তে। বিশেষ করে, ওই কাব্যের নামকবিতা, যা লেখা হয় ১৯৪০ সালে, তার সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘জগতে ভগবান যদি না থাকেন, প্রেম ও ক্ষমা যদি অলীক হয়, তাহলেও মানুষ তাঁর অমর আকাক্সক্ষার উচ্চারণ ক’রেই জগৎকে অর্থ দিতে পারে। এই আবেগের পরম ঘোষণা ১৯৪০-এ লেখা ‘সংবর্ত’ কবিতা : ঐ কবিতাটি রচনা করার পর তিনি যেন মুক্তিলাভ করলেন, কবিতার দ্বারা পীড়িত অবস্থা তাঁর কেটে গেলো।  মুক্তি? না। মায়াবিনী কবিতার দেখা একবার যে পেয়েছে, সে কি আর মুক্ত হতে পারে? রচনার পরিমাণ হ্রাস পেলেও আরাধ্যা সেই দেবীই থাকেন।’১

সুধীন দত্ত যে ওই ‘মায়াবিনী’র প্রভাব থেকে মুক্ত হননি, তাঁর এর পরের লেখাগুলো তাই প্রমাণ করে। সংবর্তের পাঁচ বছর পরে লেখেন ‘১৯৪৫’, প্রেমের চিহ্নমুক্ত, নতুন বৈশিষ্ট্যে ভরা, আর আমাদের বর্তমান নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। অবশ্য সংখ্যায় হ্রাসপ্রাপ্তির ওই কথাটি যথাযথ। সংখ্যা বলছে, পরবর্তী তেরো বছরে, সাতটি কবিতা তিনি লিখেছেন। যে-কোনো বরিষ্ঠ কবির জন্য এ-সংখ্যা যথেষ্ট নয়। অনেক বড়ো সাহিত্যিক এই কমে-আসা সংখ্যা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তবে মনে রাখা উচিত, এ-সময়ে তিনি তিনটি পূর্ণকালীন চাকরি করেছেন, আর বেশ কিছু স্বরচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদেও সময় দিয়েছেন। ‘সংবর্ত’ কবিতা একই নামের কাব্যগ্রন্থভুক্ত আর তা ১৩৬০ বঙ্গাব্দের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থরূপে নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক নির্বাচিত হয়। নামকবিতা বাদেও এতে আছে ‘নান্দীমুখ’, ‘জেসন’, ‘প্রত্যাবর্তন’ প্রভৃতি বহুপঠিত-বহুনন্দিত সব কবিতা, আছে তাঁর অমর সৃষ্টি ‘যযাতি’, যা লিখতে কবি চার মাস সময় নিয়েছিলেন, যার ‘ঈশিত্ব’ বুদ্ধদেব বসুকে মুগ্ধ করেছে, আর বিশিষ্ট লেখক ও তুলনামূলক সাহিত্যের অগ্রগণ্য পথিক অমিয় দেব জানিয়েছেন২, কীভাবে এতে গদ্য-পদ্যের বিভাজনরোধে সুধীন দত্ত নিজ পথে এগিয়েছেন তথা ফরাসি, ইংরেজি বিভিন্ন কবিতা থেকে দু-হাতে নিয়ে বা অনুবাদে এখানে ঢুকিয়েছেন অথবা কঠোপনিষদের পঙ্ক্তি ভেঙেচুরে ব্যবহার করেছেন। পাঠক ভাবতেই পারেন, কবি ‘যযাতি’র মতোন অন্য কোথাও কি নিজ জীবনদর্শন এতোখানি পরিষ্কার করেছেন। সুধীন দত্তের কাব্যদর্শন নিয়ে লিখতে গিয়ে কেকা ঘটক৩ যদিও সংবর্ত কাব্যের দার্শনিকতাকে যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর নিরাশার মধ্যে খুঁজেছেন, কিন্তু আসলেই কি সুধীন্দ্রনাথের কোনো দর্শনচিন্তা ছিল – এ-প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই শব্দপ্রেমিক প্রথম কাব্যচর্চা থেকে শেষাবধি শব্দ নিয়েই মাথা ঘামিয়েছেন, তা তাঁর গদ্য হোক বা পদ্য। প্রচলিত অর্থে যে-দার্শনিকতাকে আমরা খুঁজি, তা সুধীন দত্তে ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাবে। কিছুদিন আগে সুব্রত সিন্হা জানিয়েছেন : ‘প্রকৃতপক্ষে সুধীন্দ্রনাথের কাব্যতত্ত্বও তাই নিছকই শুদ্ধ কবিতার কথা নয়, বরং যুগপৎ ‘শৃঙ্খলা আর সম্ভাব্যতা’র দ্বন্দ্বের বৃহত্তর এক বোধের মধ্যেই কবিতার সংস্থাপন।’৪

তবে আমরা ফিরে যাব ‘১৯৪৫’ নামের কবিতায়, যার উদ্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো মাঝে-মধ্যে জমাট বাঁধে এবং একই সঙ্গে যা সুধীন দত্তের কাব্যসাধনার এক নতুন দিকনির্দেশক, বিশেষত দেশি পুরাণ-বিদেশি শহর-নদী-রাজনীতি-ব্যক্তিত্ব প্রভৃতির অঢেল ব্যবহারে। ‘সংবর্ত’ কবিতা, যা এক ক্ষুদ্রকায় মহাকাব্য, তথা মূলত বৃষ্টির পটভূমিতে এক প্রেমগাথা, এক হারিয়ে যাওয়া নারীর জন্য হাহাকার, প্রথম বাক্য থেকে শেষ বাক্য পর্যন্ত, তাও কিন্তু বহু রাজনীতি ও কূটনীতির কথায় ভরা, যেমন ভরা মনীষীশ্রেষ্ঠদের সৃষ্টির উল্লেখে, আছে অবৈধ প্রেমের কথা, (‘তাহলে কি অসময়ে ফিরেছে প্রমথ নিন্দুকের প্রেরণায়?’); তথা হিটলারের সঙ্গে স্ট্যালিনের সৌহার্দ্য নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য, অবশ্যই মলোটভ-রিবেনট্রপ অনাক্রমণ চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে; কিন্তু প্রেমই এখানে মুখ্য। এর বিপরীতে পাঁচ বছর পরে লেখা ‘১৯৪৫’ কিন্তু প্রেমের চিহ্নহীন এক নতুন ধরনের দ্যোতনা আনে, যার আরো প্রমাণ পাই আরো আট বছর পরের ‘প্রত্যাবর্তন’-এ। জিজ্ঞাস্য : সুধীন দত্ত কি ‘সংবর্ত’ কবিতার পরে আর প্রেমের কবিতা লিখেছেন?

‘১৯৪৫’ বিবেচনার জন্য তাঁর পরের লেখাগুলো দেখে আসা জরুরি বলে মনে করি। ব্রিটিশ শাসন অবসানের এক সপ্তাহের মধ্যেই লিখেছিলেন তাঁর একমাত্র সরাসরি ইংরেজি কবিতা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’। এই নাতিদীর্ঘ কবিতার দ্বিতীয় ভাগের শেষাংশ যে গান্ধীকে নিয়েই, এ-ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ কম। গান্ধী তখনো কিন্তু জীবিত, তাঁর ওপর আততায়ীর উন্মত্ততা সে-সময় থেকে আরো পাঁচ মাস পরের ঘটনা; কিন্তু গান্ধী সম্পর্কে সুধীন দত্তের ধারণা তথা শ্রদ্ধাবোধ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের শেষ বর্ষে এবং অব্যবহিত পরেই জাগ্রত হতে থাকে বেশি করে – তখন আর বন্ধুদের আড্ডা নেই; এবং তিনি সবার থেকে মানসিক দূরত্বে থেকে চোখের সামনের ইতিহাস থেকে নিজ ধারণা গড়ছেন।

কিন্তু ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ বাদে, তখন পর্যন্ত গান্ধীস্তুতির খুব বেশি দৃষ্টান্ত সুধীন দত্তে মেলে না। বরঞ্চ, ‘১৯৪৫’-এর বারো বছর পরে ১৯৫৭ সালে সুধীন দত্তের লেখা ইংরেজি প্রবন্ধ ‘ক্যালকাটা’য় গান্ধী সম্পর্কে অনেক বেশি ইতিবাচক কথা আছে, সম্রাট আকবরের পরে  তাঁর স্বদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরূপে উল্লেখ পাই সেখানে, আছে বাংলার তৎকালের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর প্রসঙ্গ।৫ অন্যদিকে ‘১৯৪৫’ কবিতায় যে-দুটি চরণ মেলে : ‘স্থগিত ভারতে আপ্ত কালান্তর,/ জিন্না যেহেতু বিমুখ গান্ধিবাদে’, তারা কি অপ্রত্যক্ষে হলেও বুঝিয়ে দিচ্ছে না ‘১৯৪৫’-এর শুরু ও শেষের উদ্দিষ্ট ‘তুমি’ আর গান্ধী ভিন্ন ব্যক্তি?

আরো পেছনে যাওয়া যেতে পারে। সুধীন দত্ত-প্রতিষ্ঠিত পরিচয় পত্রিকা ঘিরে যে-আড্ডা৬ বসতো, তাতে কিন্তু গান্ধীর প্রতি তেমন একটা অতিভক্তি অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী বা অন্তত সুধীন দত্তের মুখ থেকে পাওয়া যায় না। ১৯৩৯-এর ১৭ ফেব্রুয়ারির আড্ডায় অরুণ সেন জানালেন, তিনি জানেন সুভাষ বসু কেন গান্ধীর কাছে যায়, চাঁদা তুলে তার অংশ দিতে : তিনি বঙ্কিম মুখুজ্জের বরাতে বললেন, ‘চেষ্টা করে যখন সমর্থ হয়েছে তখন মহাত্মাকে তাঁর অংশ পঞ্চাস হাজার টাকা দিতে গেছে।’ সুধীন্দ্র উচ্চ হেসে বললেন, ‘মহাত্মা নিশ্চয়ই দরাদরি করে পঁচাত্তর হাজারে তুলবেন।’

(পৃ ১২৫-২৬)। এসব কথা খুব ভক্তি বা মোহের কথা নয়। পরিচয়ের আরেক আড্ডায় এ-কথা যে, ‘গান্ধী সম্বন্ধে মোহ ও তাঁর কর্মপন্থার প্রতি আস্থা বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে’ (২৫ আগস্ট ১৯৩৯ : পৃ ১৬৪); অথবা হিটলারকে লেখা গান্ধীর চিঠি নিয়ে কথা ওঠে আর হীরেনবাবুর মন্তব্য যে, ‘বৃদ্ধের মাথা খারাপের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে’ (৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ : পৃ ১৬৭), কিংবা গান্ধীর ইংরেজি লেখার ‘ঠাস বুনানি আলগা’ হয়ে যাওয়া (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ : পৃ ১৭০), অথবা আরেক জায়গায় তাঁকে ‘ফ্রড’ বলা (‘কানে এল নীরেন বেশ উত্তেজিত হয়ে হেমেন্দ্রকে বলছেন তিনি গান্ধীকে ‘ফ্রড’ বলছেন যুক্তিসঙ্গতভাবে’ : পৃ ১৪৮, ২ জুন, ১৯৩৯) – এসবের মধ্যে একটি কথাই সুধীন দত্তের; কিন্তু বিতর্কপ্রিয় সুধীন দত্ত বাকি  কোনোটি নিয়েই বাদানুবাদ করেননি। সুতরাং, পরিচয়ের আড্ডাকে যদি সুধীন দত্তের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব মনে করা হয়, তবে এমন নমুনা তা থেকে পাওয়া যায় না যে তিনি গান্ধীকে সন্ত পর্যায়ের মানুষ মনে করতেন।

সুধীন দত্তের অসমাপ্ত আত্মজীবনী দি ওয়ার্ল্ড অফ টোয়াইলাইট পড়লে বোঝা যায় তাঁর পিতৃভক্তির অসাধারণ নমুনা।

১৯৫৭-৫৮ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সংযুক্তিকালে তিনি যখন এই আত্মজীবনী লেখার কাজে হাত দেন, পিতৃপ্রসঙ্গ বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে। পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৬০-১৯৪২) জীবনযাপন, ন্যায়পরায়ণতা, অহিংসা, ক্ষমাসুন্দরতা, অতি উঁচু মানের বৌদ্ধিক অর্জন, বিশেষ করে, যেমন লেখাপড়ার ফলাফলে তেমনি পরবর্তীকালে সাহিত্য-দর্শন বিষয়ে লেখালেখি তাঁকে সুধীন দত্তের মানসলোকে এক অসাধারণ অবস্থানে রেখে দেয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর তিন, চার ও পাঁচ নং অধ্যায় পড়লে মনে হবে, এক যুগ আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে লেখা আমাদের আলোচ্য কবিতা পিতৃদেবকে নিয়েই।

এমন নয় যে, দুজনের সব ব্যাপারে অবস্থান একই ছিল। আত্মজীবনীতেই আছে পিতা-পুত্রের মাঝে-মধ্যে কথাবার্তাও বন্ধ থাকতো। পিতার অদ্বৈত-সাধনায় পুত্র অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। সুধীন দত্তের অর্কেস্ট্রা কাব্যের সংশোধিত সংস্করণের ভূমিকার প্রথম বাক্যটি স্মরণ করা যেতে পারে : ‘পিতৃদেব ছিলেন নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক; এবং আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হয়ে আমি যদিও অল্প বয়সেই অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়েছিলুম, তবু বিচারবুদ্ধির স্বাতন্ত্র্য আজও আমার অধিকারে এসেছে কিনা সন্দেহ।’ তবু এই পিতার ‘আকৈশোর’ প্রভাব অবশ্য জীবনব্যাপী নানামাত্রায় বিস্তৃত ও কার্যকর ছিল : তাঁর পড়াশোনায়, তাঁর প্রথম বিয়েতে, এমএ ও অ্যাটর্নিশিপ সমাপ্ত না করাতে দুজনের মধ্যে স্বল্পকালের বিরোধ তথা কথা বন্ধ থাকা; কিন্তু একই সঙ্গে পিতার পছন্দের মেয়েকেই প্রথম স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা আবার অন্যদিকে দ্বিতীয় দ্বার পরিগ্রহণের কিছুদিন আগে পিতার এটা মেনে নেওয়া যে, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দুজনের আর একত্রে ঘর করা সম্ভব নয় – এসব নানান বিষয় আসে তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করতে। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন : ‘সুধীন্দ্র আচারে সাহেব, কিন্তু অন্তরে একেবারে হিন্দু; তার ওপর তার পিতার প্রভাব খুবই আন্তরিক।’৭ এমনকি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম বিদেশযাত্রা সেটাও তো পিতার নির্বন্ধেই এবং ভ্রমণের পুরো খরচ পিতা কর্তৃক বহন করার কারণেই সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল।

এসব জাগতিক বিষয় বাদেও পিতার প্রভাব ও পিতার প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা বোধ, যা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সংশ্লিষ্ট অংশে পিতার যেসব গুণের সন্ধান আমরা পাই, তারই এক সারসংক্ষেপে ‘১৯৪৫’ ভারাক্রান্ত; আর ধরে নিতে উদ্বুদ্ধ হই এই কবিতার ‘তুমি’ সম্ভবত তাঁর পিতা। এ-প্রসঙ্গে পূর্ববর্ণিত অমিয় দেবের কথাগুলো স্মর্তব্য : ‘(পিতা) হীরেন্দ্রনাথ (দত্ত) ছিলেন দত্তকুলে ব্যতিক্রম। দত্তরা তখন মনে করতেন না তাঁদের মতো উচ্চবংশে লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজন আছে। হীরেন্দ্রনাথ লেখাপড়া করেছিলেন এবং শুধু যে করেছিলেন তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রও ছিলেন, যদিও তিনি বৃত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন আইন। … তিনি এটর্নি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্বধর্মে স্থিত থেকে অর্থোপার্জন তাঁর কাছে ছিল আদর্শেরই শামিল। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রের কাছেও তিনি তাই প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু সুধীন্দ্রনাথ যেমন এমএ শেষ করেননি তেমনি আইন বা এটর্নিশিপ পরীক্ষাও দেননি। পিতাপুত্রে এতে পরে মনোমালিন্য ঘটে থাকলেও সুধীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত তাঁর পিতার মূল্যবোধকে অস্বীকার করেননি। এবং যেহেতু তাঁর বিত্ত ছিলো মূলত পিতৃদত্ত তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে তাই তা পিতৃস্মৃতি রক্ষার্থে দান করে যান। আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েকে যে গ্রহীতা রূপে বেছে নিয়েছিলেন তা কেবল এই কারণে নয় যে ওখানে তিনি পড়িয়েছিলেন, এই কারণেও যে তাঁর মামা ‘রাজা’ সুবোধ মল্লিকের দানে প্রতিষ্ঠিত যে-বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অন্যতম স্থপতি ছিলেন তাঁর পিতা তারই উত্তরাধিকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়। … তাঁর কাছ থেকেই সুধীন্দ্রনাথ যুক্তিধর্মে প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন। … আকৈশোর অদ্বৈতের অনির্বচনীয় আতিশয্যে উত্ত্যক্ত হ’য়ে অনেকান্ত জড়বাদের আশ্রয় নিয়ে থাকলেও তাঁর দর্শনমনস্কতা সম্ভবত পিতৃসংসর্গেই উৎপন্ন। পিতার দৈনন্দিন শৃঙ্খলা ও সরলতায় জীবনযাপন এবং সতত শ্রমশীলতা তাঁকে মুগ্ধ করতো, তাঁর জাতীয়তাবাদী এষণা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে তাঁর ছিলো সমীহ, পাণ্ডিত্য ও মনীষায় শ্রদ্ধা, কিন্তু তাঁর থিয়সফি-চর্চায়, বিশেষত তার বাহুল্যে তথা তজ্জাত ঐন্দ্রিজালকতার প্রতি তাঁর আকর্ষণে পুত্রের সমর্থন ছিলো না। তবে আনি বেসান্ট প্রতিষ্ঠিত থিয়সফিকাল স্কুল, যেখানে তাঁর পিতা তাঁকে বিদ্যাশিক্ষার জন্য সভ্রাতা পাঠিয়েছিলেন, তাঁর ভালো লেগেছিলো। যেমন বইপড়ায় তেমনি খেলাধুলায়ও তাঁর আগ্রহ জন্মায় সেখানে। হয়তো যে-যুগপৎ অন্তর ও বহির্মুখী সুধীন্দ্রনাথকে আমরা পরে দেখি, তত্ত্বদর্শী ও আড্ডাধারী, তার সূত্রপাত সেখানেই। পিতার কাছে পুত্রের ছিলো একটা বড়ো ঋণ, যদিও কোনো প্রত্যক্ষ ভারতগৌরব ও অতীতচারিতা পুত্রের মনে উপ্ত করে দিতে পারেননি পিতা। পক্ষান্তরে, ১৯২৯-এ তাঁর রবীন্দ্রনাথের সহযোগে গান্ধীর পাশ্চাত্য শিক্ষাবিরোধী প্রকাশ্য প্রতিবাদ পুত্রকে আনন্দ দিয়েছিলো।’৮

আত্মজীবনীর প্রথম অনুচ্ছেদেই পিতৃপ্রসঙ্গ এসে গেছে বড়ো আকারে। তাঁকে যে ‘সিগনিফিক্যান্ট ফিগার’ বলে তিনি অভিহিত করলেন, তা শুধুই শব্দপ্রয়োগের কষ্টকল্পনা নয়, তার পেছনে আজীবন পিতৃঋণ ও পিতৃপ্রভাব সক্রিয়। ওই গাণিতিক শব্দবন্ধ নিছক তাঁর গণিতমনস্কতা বাদেও অত্যন্ত সুবিবেচনা ও সুচিন্তার প্রকাশ।

আত্মজীবনীর প্রথম অনুচ্ছেদ আমার অনুবাদে অনেকটা এরকম : ‘আমি যখন নিজ অতীতের দিকে পিছন-ফিরে তাকাই, ঝাপসা সবুজে ঘেরা শুকনো গিরিমাটির ডোরা-আঁকা রক্তজবার৯ মতো লাল বেখাপ্পা জোড়াতালি পর্যন্তই শুধু দেখতে পাই; এবং তবু স্মৃতি ও  জনশ্রুতির মধ্যে পার্থক্য এমনই  সূক্ষ্ম যে এই রঙের ছোপের মিশ্রণকে আমার সবচেয়ে পুরানো অতীত-রোমন্থন বলতে আমার বাঁধে। কেননা আমার মা-ই আমাকে বলেছিলেন যে তাঁদের সাথে দার্জিলিং যাওয়ার আগে আমাকে বাবার দেয়া রোমশ আচকানই এই রঙের ঘোরের প্রাণবন্ত কেন্দ্রের সঙ্গে তুলনীয় : হিমালয়কোলের ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাতা-ভরা গাছ আর ঘাসে-ঢাকা চড়াই-উৎরাই, টিনের ছাদওয়ালা বাড়ী আর আড়ম্বরি আদিবাসী, জ্বলজ্বলে ফুল আর সুপুরু কুয়াশা, আর পরিশেষে এসব কিছুরই মোক্ষলাভ যেন নির্বিকার কাঞ্চনজংঘার আকাশছোঁয়া নৈকট্যে; এবং এ ধারণা ওই বিশোধক পর্বতমালায় আমার দ্বিতীয় ও পরের সব ভ্রমণের সাথে সুনিশ্চিতভাবেই সুস্পষ্ট জড়ানো। প্রথম ভ্রমণের রঙ ছাড়া আমার আর কিছুই মনে নেই; এবং এমনকী এখনও সে-আনাড়ি ছবি আমার কাছে দুর্বোধ্য। কিন্তু যদিও মায়ের বার বার চেষ্টার পরেও আমি নিজেকে সে-দৃশ্যপটের কেন্দ্রবিন্দু ভাবতে পারি না, যা বাবার মহত্ত্বপূর্ণ আকৃতি ছাড়া অসম্পূর্ণ, আমি এর আবেগময় অন্তর্নিহিত গুণ সম্পর্কে সদা সচেতন; এবং তার ফলে আমি মানি যে এই দ্ব্যর্থক গৌরচন্দ্রিকা আমার বিভ্রান্ত জীবনের বিশুদ্ধ প্রতীক।’

এই অনুচ্ছেদেই পিতৃপ্রসঙ্গ দুবার এসেছে; এবং দুটিই উঁচুমানের ইতিবাচক। আত্মজীবনীতে মা-ও আছেন তাঁর প্রথম অনুচ্ছেদসহ অন্যত্র; একটি পুরো অধ্যায় তাঁর জন্য নিবেদিত; এবং পরেও একজন বিদ্রোহী পিতৃব্যকে (অমরেন্দ্রনাথ দত্ত) ঘরে ফিরিয়ে আনতে মায়ের ভূমিকা বা সুধীন দত্তের প্রথম নাটক-দেখার পেছনে তাঁর নির্বন্ধ জোরালো ভাষায় বর্ণিত। কিন্তু পিতৃস্মৃতি, পিতৃপ্রভাব ও পিতঋণ খুব বড়ো আকারে স্থান পেয়েছে। ওপরে অমিয় দেবের কথা পড়লেই বোঝা যাবে, তিনি সে-ঋণ পরিশোধেরও চেষ্টা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে ও পিতার নামে ফাউন্ডেশন তৈরির মাধ্যমে।

ভিন্ন আঙ্গিকের কবিতা ‘১৯৪৫’ তিনি শেষ করেন ১৯৪৫ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে। তিনি কবিতাশেষে যে-তারিখ দিতেন, তা তার সমাপ্তিরই দিন। পূর্ব ও পশ্চিম দুদিক থেকেই মিত্র বাহিনী ঘিরে আসছে জার্মানিকে, এ-অবস্থায় লেখা এই কবিতা; ইউরোপে ঠিক আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ শেষ হয়নি, তা হবে ৮ মে ১৯৪৫ তারিখে; এরই মাসখানেক আগে এই কবিতার জন্ম। প্রথম অনুচ্ছেদের পঙ্ক্তিগুলো এমন :

তুমি বলেছিলে জয় হবে, জয় হবে :

নাট্সী পিশাচও অবিনশ্বর নয়।

জার্মানি আজ ম্রিয়মাণ পরাভবে;

পশ্চিমে নাকি আগত অরুণোদয়।

অন্তত রুষ বাহিনী বন্যাবেগে

কবলিত করে শোষিত দেশের মাটি;

বিভীষণদের উচ্ছেদে ওঠে জেগে

স্বাধীন প্যারিস, যথারীতি পরিপাটী;

এ-বারে সমরে, শান্তিতে সহযোগী

মার্কিন্ঢালে সমানে শোণিত, টাকা;

ধনিক যুগের প্রধান ভুক্তভোগী

ইংলণ্ডেই সমাজতন্ত্র১০ পাকা ॥

ছয় অনুচ্ছেদের বাহাত্তর পঙ্ক্তির এই কবিতা শেষ হয়েছে এভাবে :

তবু জানি যবে জয় হবে বলেছিলে,

চাওনি তখন তুমিও এ-পরিণাম:

শূন্যে ঠেকেছে লাভে লোকসানে মিলে,

ক্লান্তির মতো শান্তিও অনিকাম।

এরই আয়োজন অর্ধশতক ধ’রে,

দু-দুটো যুদ্ধে, একাধিক বিপ্লবে;

কোটি কোটি শব পচে অগভীর গোরে,

মেদিনী মুখর একনায়কের স্তবে!

নির্বাণ নভে গৃধ্নু রাহুর গ্রাস;

তুমি অনিকেত নির্বাক নাস্তিতে:

কে জবাব দেবে, নিখিল সর্বনাশ

কোন অবরোহী পাতকের শাস্তিতে?

শুরুর ওই ‘তুমি বলেছিলে’র ‘তুমি’টা কে, এটা নিয়ে একটা বিতর্ক ও ভিন্নমত থেকেই যাচ্ছে। আগে যেমন বলেছি, আসলে কবিতা এমনই এক বস্তু, যা কবির কলম থেকে বের হয়ে গেলে, পাঠকেরা বিভিন্ন অর্থ করেন; এই স্বাধীনতা পাঠকের নিজস্ব ও স্বোপার্জিত; এবং কবি যদি গতায়ু হন, এই বাদানুবাদ বা কূটকচাল আরো বাড়ে। কবি হিসেবে সুধীন দত্ত যদিবা ফরাসি পূজনীয় স্তেফান মালার্মের অনুগামী বলে স্বঘোষিত বা অনেক ব্যাখ্যাদাতার মতে চিহ্নিত, তিনি কিন্তু কখনো তাঁর ফরাসি গুরুর ÔProse pour des EsseintessÕ বা ÔUn coup de dés jamaisn’abolira le hasardÕ-এর মতোন কবিতা লেখেননি, বা ঘোরালো পরীক্ষায় নামেননি। ফরাসি কাব্যের স্বনামধন্য আলোচক ও ইংরেজি অনুবাদক অ্যান্টনি হার্টলি প্রথমটি সম্পর্কে মন্তব্যই করেছেন, এ-কবিতাটি বুঝতে পারার জন্য লেখা হয়নি।১১ অন্যদিকে ব্যাসকূট সৃষ্টি সুধীন দত্তের স্বভাববিরুদ্ধ বলেই ধারণা জন্মে; এবং সংবর্তের পরে যে-অসমাপ্ত কবিতাসংগ্রহ, দশটি কবিতার কাব্য দশমীতে তিনি পৌঁছান এক নতুন জগতে। দুরূহ শব্দ সেখানে মেলা ভার। বক্তব্যে ও দর্শনে তা ভারী। কী হতো সুধীন দত্তের সম্পূর্ণ কাব্য, যদি সময় পেতেন, আমরা শুধু ভাবতেই পারি।

‘১৯৪৫’ অবশ্য সহজবোধ্য কবিতা। শুধু ‘তুমি’ নিয়ে বিতর্কটা চলমান। এতে উদ্দিষ্ট হিসেবে গান্ধী বা এম এন রায় এ-দুজনকেই বিজ্ঞজনেরা ধারণা করেছেন। এ-দুজন, বিশেষ করে, কবিতাটির অনেক বক্তব্যে প্রথমজনকেই উদ্দিষ্ট মনে হবে। বিশেষ করে সুধীন দত্তের একমাত্র ইংরেজি কবিতা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ পাঠে সে-ধারণাই পোক্ত হওয়া স্বাভাবিক। তবে ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ লেখা ১৯৪৭-এর ২১ আগস্ট; তখনো গান্ধী এবং এম এন রায় দুজনই জীবিত। অন্যদিকে ‘১৯৪৫’-এর শেষ অনুচ্ছেদের ‘নির্বাণ নভে গৃধ্নু রাহুর গ্রাস;/ তুমি অনিকেত নির্বাক নাস্তিতে’ এবং তাঁর নিজের করা অনুবাদ১২ : ÔThe heavens are extinct; and darkness has regained its sway,/ You too are lost forever in the emptiness of space.Õ দৃশ্যত স্পষ্টতই এই বক্তব্য একজন লোকান্তরিত ব্যক্তিকে নিয়েই : সুধীন দত্তের গুণী পিতৃদেব বিবেচনায় থাকবেন না কেন এখানে?

মৃতদের মধ্যে আরেকজন হতে পারতেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ, এমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, সর্ববিচারে যিনি ‘অসাধারণ’ আর যাঁর শিষ্যত্বেই সুধীন দত্তের কবিজীবন শুরু। হীরেন মুখার্জীর তরী হতে তীর বইতে১৩ আছে, ‘সোভিয়েট সুহৃৎ সমিতি’র পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী যান শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথকে এই নবগঠিত সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে। ‘কবি রাজী হলেন সোভিয়েট সুহৃৎ সমিতির পৃষ্ঠপোষক হতে, কিন্তু সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ‘ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েটকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কম্যুনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গা-ঢিলা দিয়ো না’। … আর সবাই তো জানি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর, বলতেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ-এর মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে যে সোভিয়েট কখনো হার মানবে না।’

এখানেও পড়া দরকার ‘পরিচয়ের আড্ডা’১৪ : ‘সুধীন্দ্র বললেন, পক্ষান্তরে যা হবে সেটা হচ্ছে নাৎসী শক্তি নিজেদের ক্ষমতা সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হয়ে সোভিয়েট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে তছনছ করে ছাড়বে’ এবং ‘ব্রিটেনের শ্রমিক ও লিবারাল পার্টির চাঁইরা পুঁজিবাদী মহাজন সম্প্রদায়ের সঙ্গে একজোট হয়ে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকে হিটলারকে মাথায় তুলেছে।’ এটা ২৮ জুন ১৯৪০-এর আড্ডা। তখনো ২২ জুন ১৯৪১ আসেনি। এর আগে ২৫ আগস্ট ১৯৩৯-এর আড্ডায় তিনি মলোটফ-রিবেনট্রপ অনাক্রমণ চুক্তি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রাশিয়া জার্মানির সঙ্গে রফা করেছে আত্মরক্ষার তাগিদে।’ অবশ্য তাঁর ‘সংবর্ত’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতা লেখা হয় পরে, ১৯৪০-এর সেপ্টেম্বরে, যার বহুল উচ্চারিত পঙ্ক্তির অংশ : ‘হিটলারের সুহৃদ্ স্ট্যালিন্।’ এটা কবিতার এক ধরনের প্রকাশ বা ঝোঁক, যাকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে কাব্যপ্রকাশ রূপেই; পড়তে হবে ২৫ আগস্ট ১৯৩৯-এর কথার আলোকে; কিন্তু ১৯৪৫ সালে এসে তিনি যখন আমাদের আলোচ্য ‘১৯৪৫’ লেখেন, তখন যুদ্ধ প্রায় শেষ, জার্মানির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণটাই বাকি। এর আগে তিনি ১৯৪২-এ পিতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এসেছেন; রবীন্দ্রনাথ চলে যান আরো এক বছর আগে। মহাকবির প্রয়াণে সুধীন দত্ত সম্পর্কে সুশোভন সরকার লিখেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর নিমতলা ঘাটের কাছে উদ্ভ্রান্ত সুধীন্দ্রনাথ হাবুলকে বলেছিল : it is going to make a difference’।১৫ এতদসত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ এই ‘তুমি’ নন। বিদেশে এবং শান্তিনিকেতনে মহাকবির সঙ্গে তাঁর মাসকে মাস সময় কাটলেও মহাকবির এই বক্তব্য ‘সোভিয়েট কখনো হার মানবে না’ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কাছেই বলা এবং পরে বাইরে প্রচারিত হয়, যা সুধীন দত্তও শুনেছিলেন।

কিন্তু নিজ পিতাই রোগশয্যা থেকে তাঁকে ১৯৪২-এর গহিন কালো দিনগুলোতে বলেছিলেন, ‘ঐশ্বরিক যুক্তিই হিটলারকে যুদ্ধে জিততে দেবে না’, তা আমরা পাই অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। মূল ইংরেজি কথাগুলো এমন : ‘… he felt completely certain even in the blackest days of 1942 that divine logic would not let Hitler win the war.Õ ১৬ ওই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে বহুগুণসম্পন্ন পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরলোকগমন করেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় যেমন কমিউনিস্টদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে সজাগ থাকার পরামর্শ আছে, সুধীন দত্ত কিন্তু উলটো দিকে বিমান হানা প্রতিরক্ষা বাহিনীতে (্এআরপি) যোগ দিয়ে ইংরেজদের যুদ্ধপ্রচেষ্টাতেই অংশ নিয়েছিলেন। সে যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের কথা যে তাঁর মাথায় ছিল না ‘১৯৪৫’ লেখার সময়ে, এটা তার প্রমাণ।  তাঁর দুই বিদেশি বন্ধু এডওয়ার্ড শিলস্ ও ম্যালকম ম্যাগারিজও সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেন। তাঁদের প্রথমজনের জন্যই সুধীন দত্তের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মরণোত্তর প্রকাশ সম্ভব হয়েছিল; তিনি তার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন; আর পরের জন লেখেন মুখবন্ধ। দুজনের সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্ব কলকাতাতেই। সুধীন দত্ত কি তাঁদের প্রভাবেই যুদ্ধপ্রচেষ্টায় যোগ দিয়েছিলেন? নিরঞ্জন হালদার জানিয়েছেন : ‘সুধীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনার ক্রমবিবর্তনের ক্ষেত্রে ম্যালকম ম্যাগারিজেরও কিছুটা অবদান আছে।’১৭

আলোচ্য কবিতার তিন নম্বর অনুচ্ছেদে আবার সেই ‘তুমি’তে প্রত্যাবর্তন : সেই দর্শন ও পুরাণ ভারাক্রান্ত কথাবার্তা, প্রত্যয়, প্রতিপ্রত্যয়। সেই ‘তুমি’ থেকে আগত ‘দুরূহ দৈববাণী’র বরাত এবং এসব অ্যান্টিথেটিক্যাল বা প্রতিপ্রত্যয়ী বক্তব্য : ‘ভূতের অগাধে নিহিত ভবিষ্যৎ,/ অন্যায় আনে আস্থা ন্যায়ের প্রতি,/ শত্রুনিপাত মহামৈত্রীর পথ,/ পরিশ্রমীর স্বধর্মে সদ্গতি॥’ এ-জাতীয় পঙ্ক্তি ও তদন্তর্গত গূঢ়ার্থ তাঁর আরো কবিতায় আছে : বহুল পঠিত ‘উটপাখী’ (যা তিরিশের দশকে লেখা) কিংবা পঞ্চাশের দশকের ‘দশমী’র উত্তরধ্বনি বা পূর্বধ্বনিই কি পাচ্ছি আমরা এখানে? সম্ভবত।

চার নম্বর অনুচ্ছেদটিতে ‘তুমি’র পুরো বৈশিষ্ট্যটাই কবি বলে দিচ্ছেন এভাবে :

কিন্তু জীবন এতই বিকল কি যে

কেবল মরণে প্রমার সম্ভাবনা?

প্রাণধারণের যে-দৃষ্টান্ত নিজে

রেখে গেছ, তা কি অন্ধ প্রবঞ্চনা?

ক্ষমা, অহিংসা, মনীষা, বিবেকী দ্বিধা,

অত্যাচারের সঙ্গে অসহযোগ,

অসম্পৃক্ত ইষ্টের সদভিধা,

বিচারে বিশ্বমানবের বিনিয়োগ –

এ-সকলে আজ তুমি কি নিরুৎসাহ,

বুঝেছ সাধুর শাঠ্যেই মজে শঠ?

তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই অংশগুলোতে তাঁর পিতার জীবনযাপনের ও অর্জনের যেসব কথা ‘১৯৪৫’ নামের কবিতায় আছে, তার অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা মিলবে (আমার আক্ষরিক অনুবাদের চেষ্টায়) :

অধ্যায় তিন থেকে

… ‘অবশ্য এমন ভাবা হাস্যকর যে তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী ধর্মান্ধ ও শিথিল, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর শ্রদ্ধাহীন, অজ্ঞ তথা অকর্মণ্য ছিলেন বলেই বাবা এমন এক উদারপন্থী মানবতাবাদী আর প্রয়োগবাদী নীতিবাগিশ বনেছিলেন, যিনি নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেও ধর্মীয় সহনশীলতার রক্ষক, প্রাতঃস্মরণীয় কোবিদ ও পার্থিবতায় সুপরিচিত; এবং এমনকী তাঁর বাল্যাবস্থায়ও তাঁর বিদ্যানুরাগ সেসব সমকালীনদের সংগে তাঁর দুস্তর ব্যবধান তৈরী করে যাঁরা ভাবতেন আভিজাত্য আর বৈভবের উত্তরাধিকার উচ্চশিক্ষার একান্নবর্তী নয়। কিন্তু সারস্বত স্বাতন্ত্র্য ছিল তাঁর সহজাত; প্রতিটি পরীক্ষায় অভূতপূর্ব নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম হতেন; এবং তিনি যে শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনার জীবন বেছে নেননি, তা সম্ভবত, আমার ধারণায়, এই  প্রমাণ করে যে, সজ্ঞান আপত্তি সত্ত্বেও, চরম মুহূর্তে তিনি বৌদ্ধিক ও নৈতিক অধমর্ণদের কাছে যে-মূল্যবোধ প্রিয়, তা-ই বেছে নিয়েছিলেন। …

‘… কেননা সুখপ্রদ তালুকের উত্তরাধিকারী হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে বড়ো ভাইয়ের অসংযমের মুখে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হয়; আর অন্যদিকে তাঁর ঠিক পরের জন ভদ্রসমাজের প্রতি দায়িত্বহীন অবজ্ঞা দেখানো শুরু করেন; এবং বাবা যদি এর প্রতিক্রিয়ায় অর্থের মূল্য বুঝতে শিখেও থাকেন, এর পিছনে ছোটা  কখনই তাঁর জীবনের একমাত্র চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়নি, কেননা এর চেয়ে মহত্তর মাঠের শস্যই তাঁকে আনন্দ দিত। নিজ জাঁকালো জীবিকা হিসেবে তিনি স্বাধীনচেতাদের জন্য উন্মুক্ত যে-পেশা সেই আইনজ্ঞ হওয়াকেই বেছে নেন; এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি সলিসিটর হতেই মনস্থির করেন, কেননা অ্যাডভোকেটের কাজে যদিবা টাকা-পয়সা বেশি, তাতে আবার বিচারকের পদের দাসত্বের প্রলোভন ছিল। জায়মান জাতীয়তাবাদের প্রতি এই অপ্রত্যক্ষ অবদান রেখেই তিনি ক্ষান্ত হননি; তিনি ছিলেন বেংগলী একাডেমী অফ আর্টসের স্থপতি আর জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সংগঠক; এবং আন্দোলনকারী রাজনীতির দেশদ্রোহী নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর মুক্ত মেলামেশা আনুমানিক ১৯০৫ হতে ১৯২০ পর্যন্ত সারাক্ষণ তাঁর স্বাধীনতা আর আমাদের মানসিক শান্তি বিপদাপন্ন করে তোলে।

‘যাঁরা আগামীকাল মরবেন না, তাঁরা পানাহার বা আনন্দের প্রয়োজন অনুভব করেন না; এবং বাবা যখন এ যুক্তি দিতেন যে এমনকী পশুরাও অনশ্বর আত্মার অধিকারী, তিনি শুধু সকল প্রাণের পবিত্রতাই বুঝাতে চাইতেন, জলচর, ভূচর বা খেচর প্রাণীর শব খাওয়ার প্রস্তাব আনতেন না। তিনি নিজ দেহকেও সর্বব্যাপী পরমাত্মার বাহন মনে করতেন; এবং সেজন্য তিনি যদিবা শারীরিক স্বাস্থ্য চাইতেন, তাঁর দুটি অগুরু আহারের মূল কথা ছিল পরম আত্মসংযম, কখনও তিনি নেশাকর বা মাদক দ্রব্য স্পর্শ করতেন না, কেননা দৈহিক উত্তেজনা বা সম্মোহকে তিনি বিশুদ্ধ সত্তার অবমাননা ভাবতেন। একই কারণে তিনি পোষাকী আড়ম্বরও এড়িয়ে চলতেন; এবং যদিবা সাদা কাপড় ছাড়া অন্য কিছু পরতে তাঁর অসম্মতি ছিল, সকল মধ্যবিত্ত বাঙালীর মতোই তিনি সদা-সর্বদা সাধারণ পরিচ্ছদে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। ছটার আগেই ঘুম থেকে উঠে তিনি আধা ঘণ্টা সংবাদপত্র পড়তেন; তারপরে কাছের চত্বরে – তা বৃষ্টিই হোক বা ফোস্কাপড়া গরমে – পঁয়তাল্লিশ মিনিটের প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন; এবং ফেরার সাথে সাথেই তাঁর তাৎক্ষণিক বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপৃতিতে মন দিতেন; তা বন্ধ হত দশটায় আর এর পরে এগারোটায় যাতে আদালত ধরা যায়, সেজন্য তৈরী হওয়া শুরু করতেন। প্রায়ই  তিনি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত দপ্তরে থাকতেন, আর বাড়ী ফিরে পেশার বাইরের বইপত্র পড়া আরম্ভ করতেন। রাত সাড়ে দশটায় খেয়ে এগারোটার মধ্যে তিনি শয্যাশায়ী হতেন – যত না ঘুমের জন্য, তার চেয়ে বেশী চিন্তা ও ধ্যানের দরকারে। শনি আর রোববারে তাঁর কাজের চাপ বাড়ত : আইনসম্মত রাজনীতি আর আকাশছোঁয়া অধ্যাত্মবাদ সকাল আর বিকেলগুলোকে ভরে রাখত; এবং শিক্ষাগত আর সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের কারণে দর্শনার্থীরা তাঁর প্রতিদিনের কাজকে বিঘ্নিত করতে সারাক্ষণই আসতেন ।

‘তাঁর পোষাক-পরিচ্ছদের স্বতঃস্ফূর্ত সারল্য, আচরণের অনাড়ম্বর মিতব্যয়িতা, অলক্ষ্য অমায়িকতা আর সবার সংসর্গে স্বাচ্ছন্দ তাঁর  অপার আত্মসম্মানবোধ হতেই উৎসারিত; এবং আমার মনে আসতে চায় তাঁর ভরা ত্রিশ আর আদ্য চল্লিশের সেই চেহারা – দীর্ঘকায়, সোজা, স্থূল নয়, ক্ষীণও নয়, সেগুন-পিঙ্গল বর্ণ, বেশী চুলের পরেও অন্তরায়হীন চওড়া কপাল, পুরানো ধাঁচের সোনার ফ্রেমের চশমায় আরও বড়ো-হওয়া তাঁর গভীর ও ঢাকা* ও কালো সরু* চোখ, মৃদু হাসির সন্দেহদ্যোতক তাঁর সুন্দর করে কাটা গোঁফ, চলাফেরায় ধীর তথা সামান্য জবুথবু, আর সেই লঘু কণ্ঠ যা মোহনীয় প্রাঞ্জল্যের আধিক্যের পরেও আস্থাজ্ঞাপক। কেননা তিনি যদিও প্রকৃত অর্থে বক্তা ছিলেন না, ভাষার অকাট্যতা ও উৎকর্ষে তাঁর আনন্দদায়ক কথন ছিল প্রথিতযশা; এবং সবিস্তার বর্ণনা ও যথাযথ উদ্ধৃতির প্রাচুর্যসহ ওই বৈশিষ্ট্য দুটি তাঁকে একজন উল্লেখ্য লেখক ও সূক্ষ্ম চিন্তাবিদের প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। আমি বিশ্বাস করি, পঁয়ত্রিশ বছর পরেও তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁর বৈশিষ্ট্যাবলী অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন; এবং যদি ইতিমধ্যে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতিতে প্রবেশ তাঁকে সেখান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেও থাকে, তাঁর বিস্ময়কর পাণ্ডিত্য একেবারে শেষ পর্যন্তই বৃদ্ধি পায় আর তাঁর সাহিত্যপ্রেমও কোনোদিন তাঁকে ছাড়েনি।’

অধ্যায় চার থেকে

‘যেদিনগুলোতে শিক্ষিত ভারতীয়েরা ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখার বাসনা পোষণ করতেন, এমনকী সেই সময়ের বিবেচনায়ও ওই ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর; এবং যদিবা তাঁর সমকালে একাধিক ব্যক্তি কথন ও লিখনে সমান উৎকৃষ্ট হয়েও থাকেন, শুধু শ্রেষ্ঠ পেশাদার শিক্ষকেরাই বৃটিশ লেখকদের সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের সাথে তুলনীয় হতে পারতেন, আর তাঁর অন্তদর্শিতা পৌঁছাত আত্মনিবিষ্টতার পর্যায়ে। উপরন্তু, তিনি শুধু ইংরেজি ভাষাই জানতেন না, সংস্কৃতেও ব্যুৎপত্তিলাভ করেছিলেন; এবং তাই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার অল্প কাল পরে প্রকাশিত কালিদাস ও শেক্সপিয়র সম্পর্কে তাঁর দীর্ঘ নিবন্ধ বাঙলা ভাষায় তুলনামূলক সমালোচনার প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সত্য বটে, তিনি আর কখনও বিশুদ্ধ সাহিত্য বিষয়ে নিজেকে ব্যাপৃত করেননি; এবং তাঁর যৌবনে গোপনে লেখা ছাপার মুখ দেখেনি যে-পদ্যাবলী, তা তাঁর পরিণত জীবনে অবিজ্ঞের মতো ছাপানো কালিদাসের মেঘদূতের ছন্দোবদ্ধ অনুবাদের চেয়ে কোনোক্রমেই উৎকৃষ্ট নয়। কিন্তু তাঁর সাহায্যে* শেক্সপিয়র পাঠ আমার কৈশোরের অবিস্ময়ণীয় অভিজ্ঞতা; এবং তাঁর ব্যাখ্যাতেই এনশেন্ট ম্যারিনার বারো বছর বয়সে আমার কাছে কাব্যের যথার্থ সারবত্তার মর্যাদা পায়। স্বাভাবিকভাবেই উত্তর-ভিক্টোরিয়দের প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার চেয়ে ঠাণ্ডা; এবং বার্নার্ড শ’য়ের সঙ্গে নয়, তাঁর উদ্দেশেই তিনি হাসতেন।

‘… তিনি খ্রিষ্টকথার অলৌকিক অংশসমূহ সম্পূর্ণত গ্রহণ করতেন বটে, কিন্তু প্রতীচ্যের জুডিয়া-রোমান নীতিকথার অন্তর্নিহিত হীনমন্যতা সম্পর্কে তিনি এমন নিঃসংশয় ছিলেন যে বৃটিশ শাসনকে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। তাই সহিংসতার প্রতীকী কাজে তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকৃত অংশগ্রহণ না থাকলেও তা ক্ষমার চোখে দেখতো; এবং একই কারণে উত্তরকালে গান্ধীবাদের বিজাতীয় বিনয়ের সাত্তিক অনুতাপ আর প্রকাশ্য আপস, তার মুক্তিদায়ক পাপস্বীকার আর উৎপীড়ক অনশন তথা চূড়ান্ত পর্যায়ে তার নেংটি দেখিয়ে বেড়ানো আর নম্রতাকে স্বর্গরাজ্যের অনন্য প্রবেশপত্র অনুমানে বাবার ছিল নিদারুণ অবজ্ঞা ।

‘… সংশ্লেষ যদিবা তাঁকে অদম্যভাবে টানতো, একই সময়ে বিশ্লেষণে তাঁর বৈদগ্ধ্য ছিল বিরাট; এবং সত্যের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল এমনই সীমাহীন যে তিনি কখনও অস্বীকার করতেন না যে বিগত পঞ্চাস বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়াও ইউরোপীয় সভ্যতার আরো অনেক মহার্ঘ্য ভারতীয় সংস্কৃতির সারাৎসারে চমৎকারিত্বসহ চুয়ে চুয়ে ঢুকেছে। এসবের অন্তর্নিহিত ঋদ্ধি সম্পর্কে তাঁর সম্যক স্বীকৃতি ছিল; এবং ওই অসীম উৎস থেকে আমাদের আরও অগ্রগতির জন্য তিনি এতোটা উদগ্রীব ছিলেন যে ১৯২১ সনে গান্ধীর বোধিহীন ‘প্রতীচ্য’ শিক্ষাবিরোধী নিন্দাবাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দাঁড়াতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে সংগী হিসেবে নেয়া নিশ্চিত করেছিলেন।’

পাঁচ নং অধ্যায় থেকে

… ‘পশ্চিমা পণ্ডিতেরা বুদ্ধ সম্পর্কে শূন্যবাদের যে-রঙ চড়িয়েছেন, উত্তরকালে তাকে মিথ্যা-প্রমাণে তাঁর পাণ্ডিত্য ও তীক্ষèতা সমভাবে দৃষ্টান্তমূলক; এবং এ লেখা দুটি ১৯৩২ সনে আমার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এক সাময়িকীতে১৮ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়াতে আমি স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছি যে, ওই পত্রিকার জন্য তাঁর লিখিত কিছু পর্যালোচনা সমকালীন সাংবাদিকতার মানে দুর্লভ। … হায়! বয়স বাড়ার ফলে তাঁর বাইরের ব্যাপৃতি কমে আসাতে তিনি আরও বেশী করে সময় লেখার পিছনে ব্যয় করা শুরু করেন; এবং তখন পরিমাণের স্বার্থে মানকে জলাঞ্জলী দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, গান্ধীর যুগ এসে তাঁর সকল বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে, সম্ভবত অবচেতনে এমন ধারণা থেকেই তিনি সমকালীন ঘটনা বা পুঞ্জীভূত অনিশ্চিয়তার উপর  প্রতিক্রিয়ার

বাছ-বিচার* না করেই স্ববিশ্বাসকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরেন।…

‘কিন্তু তিনিও দেখিয়েছেন যে অযুক্তি ঈশ্বরের অনিবার্য পরিণতি নয়; এবং তিনি যদিবা অদৃষ্টে ন্যায়ারোপ অপ্রাসংগিক তথা অকার্যকর বিবেচনা করতেন, তবু ১৯৪২ সনের গহীন কালো দিনগুলোতেও তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে ঐশ্বরিক যুক্তিই হিটলারকে যুদ্ধে জিততে দেবে না। কেননা মূলত তিনি ছিলেন বৈদান্তিক; তাঁর অকাট্য বিশŸাস ছিল যে বিশ্ব নিজ সত্তার অন্তর্নিহিত বিধিবলে অন্ধকার থেকে আলোতে এগোয়।’১৯

আরো পরে একই অধ্যায়ে আছে : ‘… তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর পেশার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন; তাঁর ব্যাপৃতি ও প্রভাব তখনও বেড়েই চলেছে; এবং ভারতবর্ষের সব জায়গাতেই সবাই তাঁর সততা স্বীকার করতেন, তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করতেন, তাঁর সামর্থ্যরে শ্রদ্ধা করতেন ও তাঁর দেশপ্রেমের মর্যাদা দিতেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও গোখেল, মোতিলাল নেহরু ও সাপরু, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী ও সিনহার মতো মধ্যপন্থী নেতারা তাঁকে সম্ভবত ভয়ংকর চরমপন্থী ভেবে আদর্শগত বিবেচনা থেকে বাদ দিতেন; এবং তথাপি তাঁরা জানতেন যে, তাঁর সাহসী সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে লালায়িত নয়, আর তাঁদের উলটো দিকে ছোট-বড়ো এমন অনেকেই ছিলেন যাঁরা তাঁকে ভালোবাসতেন ও মনে করতেন, তিনি শুধু প্রজ্ঞার কথাই বলেন। এসবের পরেও তাঁর মাথা বিগড়ে যায়নি; তাঁর দরোজা আরো বেশী করে সবার জন্য খুলতে থাকে।’

‘প্রাণধারণের যে-দৃষ্টান্ত নিজে রেখে গেছ’ তা নিজ পিতারই কথা – এটা ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে। গান্ধী, যাঁর প্রতি তাঁর সহমর্মিতা সাতচল্লিশের ঠিক আগে বা পরে জন্মে, তা ‘১৯৪৫’ লেখার সময় তেমন একটা ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরঞ্চ যুদ্ধের সময়ে হিটলারকে গান্ধী চিঠি লিখেছিলেন, পরিচয় পত্রিকার আড্ডায় তা নিয়ে সুধীন দত্ত মন্তব্য করেননি বটে, কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ায়নি। বরঞ্চ তাঁর আত্মজীবনীর একাধিক স্থানে তাঁর পিতার গান্ধীবিমুখতা স্বতঃপ্রমাণ; তথা সুধীন দত্ত তা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন। অমিয় দেব উল্লেখ করেছেন, যামিনী রায়-সম্পর্কিত লেখায় সুধীন দত্তের গান্ধীবিমুখতা আরো স্পষ্ট।

১৯৪৬-৪৭-এর সময়টা ১৯৪৫-এর প্রথমার্ধ থেকে অনেক বিচারেই ভিন্ন।‘দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ এরই মধ্যে ঘটে গেছে।

 গান্ধী অনেক চেষ্টা করেও ভারতবর্ষকে এক রাখতে পারেননি; তার পরে আসে ১৯৪৭-এর আগস্ট মাসের ১৪-১৫ তারিখের মধ্যরাত, যে-সময়টাতে তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার প্রচেষ্টার সাফল্য-ব্যর্থতা দুটিই ধ্বনিত হয়; এবং সবকিছু মিলে ওই ঋদ্ধ ঋষির প্রতি সুধীন দত্তের মনোজগতে এক ধরনের অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটে। এর ফলশ্রুতিই সম্ভবত ২১ আগস্টে সমাপ্ত ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’ কবিতা। এসব তো পরের কথা। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসের ‘১৯৪৫’ তিন বছর আগে লোকান্তরিত পিতার প্রতি তাঁর একমাত্র কাব্য-শ্রদ্ধার্ঘ্য, যার ইংরেজি গদ্যে তিনি পুনর্বয়ান করেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনীর তিন, চার ও পাঁচ নং অধ্যায়ে। গান্ধী তখনো তাঁর মানসপটে আসন নিতে সেভাবে যুদ্ধের শেষ বছরে আসেননি। বরঞ্চ তাঁর পিতা যে গান্ধীর প্রতি বিমুখ ছিলেন, তা তাঁর আত্মজীবনীর একাধিক জায়গায় দেখতে পাই। গান্ধীর জন্যই হীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাজনীতি ছেড়েছিলেন, একথাও আছে সেখানে। অবশ্য গান্ধীর প্রতি সুধীন দত্তের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা সম্ভবত আরো এক যুগ পরে ১৯৫৭ সালে লেখা ইংরেজি প্রবন্ধ ‘ক্যালকাটা’তে, যেখানে তাঁকে তিনি অভিহিত করেছেন সম্রাট আকবরের পরে তাঁর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে। ইতিমধ্যে গান্ধী আততায়ীর শিকার হয়েছেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রোধের চেষ্টা ও নবগঠিত পাকিস্তানের পাওনা টাকা শোধ করার দাবি নিয়ে অনশনের কারণে। তখন স্বভাবতই সবকিছু ‘মৃত্যু মহৎ সমতাসাধক’ – এই সূত্রে গিয়ে পড়েছে।

এম এন রায় কোনো বিবেচনাতেই এই ‘তুমি’ নন। জীবনের একটা সময়ে নিকট বন্ধুত্ব থাকার পরেও সুধীন দত্ত কিন্তু কোনো সময়েই এম এন রায়ের ‘রচিত’ সব ‘সূত্র’ সম্পর্কে সংশয়ের ঊর্ধ্বে ছিলেন না।২০ আর বর্ণিত কবিতা-লেখার সময় পর্যন্ত গান্ধীও তাঁর মনে একনিষ্ঠ ভক্তির স্থানে আসন নেননি। উপরন্তু, রায় এবং গান্ধী, দুজনের কেউই তখনো মহাশূন্যের মৌনে হারিয়ে যাননি; জীবিত। হতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ, কেননা তিনিও তখন হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতোই ‘অনিকেত নির্বাক নাস্তিতে’, এবং ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন সোভিয়েটরা হারবে না। কিন্তু সুধীন দত্ত রবীন্দ্রনাথ থেকে ‘প্রাণধারণের যে-দৃষ্টান্ত নিজে রেখে গেছ’, এমন বিশেষ কিছু প্রত্যক্ষ করেননি। অনেকটা রাবীন্দ্রিক ইচ্ছার বিপরীতেই সুধীন দত্ত ইংরেজদের যুদ্ধচেষ্টায় যোগ দিয়েছেন ফ্যাসিবাদবিরোধী হিসেবে; নিজ পিতাকেই কাছ থেকে বুঝেছেন; এবং তাঁর মৃত্যু অবধি। তাঁর ‘বিবেকী দ্বিধা’, অহিংসা, ক্ষমা – এসব জীবন-প্রত্যয় ও বৈশিষ্ট্য দিনের পর দিন স্বচক্ষে দেখেছেন; এবং সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পরে বিনম্র শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন ‘১৯৪৫’ লিখে। কারণ জানার মধ্যে তিনিই নিজ পিতার কাছ থেকে শুনেছেন, ঐশ্বরিক যুক্তিই হিটলারকে যুদ্ধে জিততে দেবে না। সুতরাং আমরা যদি কবির পিতাকেই নির্ধারণ করি এই ‘তুমি’ হিসেবে, তা হয়তো প্রকৃত উদ্দিষ্টকেই সামনে আনবে; অথবা অন্তত সম্ভাব্যদের অগ্রগণ্য একজন হিসেবে দাঁড় করাবে।

কবিরা কবিতা লিখেই যাবেন। এবং অব্যাহতভাবে। পাঠকেরা তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতেই থাকবেন। এজরা পাউন্ডের কিছু ক্যান্টো বা ওপরে বর্ণিত স্তেফান মালার্মের ওই কবিতা দুটির সঙ্গে তুলনীয় ব্যাসকূট তৈরিতে বিভ্রান্তি আসবেই। কিন্তু দুনিয়া থেমে থাকবে না; না থামবে কবিতার কারখানা।

উৎসপঞ্জি

          ১।       সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ, বুদ্ধদেব বসুর ভূমিকা, দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ১৯৯৭-এর পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা।

          ২।       অমিয় দেব, দুই তিরিশে অক্টোবর-নভেম্বর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু, এবং মুশায়রা, কলকাতা, এপ্রিল ২০১২,

পৃ ৫৫-৬৬।

          ৩।       কেকা ঘটক, ‘সুধীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা’ শীর্ষক প্রবন্ধ; পুস্তক বিপণি০প্রকাশিত ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়-সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : জীবন ও সাহিত্য পুস্তকের পরিবর্ধিত সংস্করণ, ২০০২, কলকাতা, পৃ ১৩৯।

          ৪।       সুব্রত সিন্হা, আধুনিকতার কাব্যতত্ত্ব ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (অমিয় দেবের ভূমিকাসংবলিত), যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ২০১৯, কলকাতা, পৃ ২৫৮।

          ৫।      সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, দি ওয়ার্ল্ড অফ টোয়াইলাইট গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধ ‘ক্যালকাটা’; অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কলকাতা, ১৯৭০; পৃ ৭।

          ৬।      শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, পরিচয়ের আড্ডা, কে পি বাগচী এ্যাণ্ড কোম্পানী, কলকাতা, জুন ১৯৯০।

          ৭।       ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, পৃ ১৪০, হিরণকুমার সান্যালের পরিচয়ের কুড়ি বছর ও অন্যান্য স্মৃতিচিত্র, প্যাপিরাস, কলকাতা ১৯৭৮, পৃ ১৪০।

          ৮।      অমিয় দেব, ‘সুধীন্দ্রনাথের ব্যক্তিসত্তা’, পরিচয় পত্রিকার সুধীন্দ্রনাথ শতবর্ষ সংখ্যা, নভেম্বর ২০০০-জানুয়ারি ২০০১, কলকাতা, পৃ ১৫৩-১৬৫।

          ৯।       মূলে আছে ‘পিলার-বক্স রেড’; আমি রক্তজবার মতো লাল বেছে নিয়েছি।

১০।  ‘ইংলণ্ডেই সমাজতন্ত্র পাকা’ কথাটির অর্থে তিনি কল্যাণ রাষ্ট্র বোঝাতে চেয়েছেন। অমিয় দেবের ইংরেজি বই সুধীন্দ্রনাথ দত্ততে কবিতাটির কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদের চরণটি আছে এভাবে, ঠিক সমাজতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তা নয় : ÔAnd even England, which monopolized the Golden Fleece,/ Prepares to found the welfare state ÑÕ

  – ’, সাহিত্য আকাদেমি, নয়া দিল্লি, প্রথম প্রকাশ ১৯৮২, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ১৯৯১, পৃ ৮৬।

          ১১।     অ্যান্টনি হার্টলি, দি পেঙ্গুইন বুক অফ ফ্রেঞ্চ ভার্স, প্রথম প্রকাশ ১৯৫৭, পঞ্চম পুনর্মুদ্রণ ১৯৬৮, ভূমিকা, পৃ ৩৪-৩৫।

          ১২।     আবু সয়ীদ আইয়ুব, পথের শেষ কোথায়, দে’জ পাবলিশিং, জুলাই ১৯৭৭, পৃ ১৯৪।

          ১৩।     হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, তরী হতে তীর, মনীষা, কলকাতা, ১৯৮৬, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ ৩২৮।

          ১৪।     শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, কেপি বাগচী এ্যান্ড কোম্পানী, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জুন ১৯৯০, পৃ ২০৮।

          ১৫।     হিরণকুমার সান্যাল পরিচয়ের কুড়ি বছর ও অন্যান্য স্মৃতিচিত্র’, প্যাপিরাস, কলকাতা ১৯৭৮, সুশোভন সরকার-লিখিত ভূমিকার বদলে, পৃ ১৬।

          ১৬।     সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, দি ওয়ার্ল্ড অফ টোয়াইলাইট, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কলকাতা, ১৯৭০; পৃ ১৭।

          ১৭।     নিরঞ্জন হালদার, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বন্ধুত্ব’, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সুধীন্দ্রনাথ পাঠের ভূমিকা শীর্ষক বই থেকে, ভারত বুক এজেন্সি, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ জুন ২০০২, পৃ ১১৪।

          ১৮।     সুধীন দত্ত-প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকায় তাঁর পিতা হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন নিয়মিত লেখক। তাঁর জীবদ্দশায় শুধু একটি-দুটি সংখ্যা বাদে, যখন তিনি ছিলেন অসুস্থ, প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখে গেছেন।

          ১৯।     সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কাব্যসংগ্রহ অর্কেস্ট্রার ভূমিকা, দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ১৯৯৭-এ পুনর্মুদ্রণ, কলকাতা।

পিতৃ-কথা অনুসরণ করেই সুধীন দত্ত এখানে এভাবে নিজের বর্ণনা দেন : ‘আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি।’

          ২০।     শিবনারায়ণ রায় প্রবন্ধসংগ্রহভুক্ত ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা,  প্রথম সংস্করণ, জানুয়ারি, ২০০১ (চতুর্থ মুদ্রণ আগস্ট ২০১৩), পৃ ১৫৯।

ছবি : আনন্দবাজার পত্রিকা