আমার বাংলাদেশের ভিসা

আবুল হাসনাত সাহেব ছিলেন আমার বাংলাদেশের ভিসা। ওঁর পাঁচ আঙুলের ছাপ না পড়লে আমার বাংলাদেশে ঢোকা নেই। বাংলাদেশের খুলনায় আমার পিতৃপুরুষের ভিটে, যা দেখা হয়েছে, কখনো থাকা হয়নি। কিন্তু সেই শৈশব থেকে অদম্য টান। সেই টানও এক জাদুটানে দাঁড়াল বছর কয়েক আগে হাসনাত সাহেবের দাক্ষিণ্যে। ব্যাপারটা ঘটল এরকম …

হাসনাত সাহেব এসেছিলেন কলকাতা। আড্ডা হচ্ছিল আমাদের বাড়িতে, যখন দুই বাংলা এবং জীবনানন্দকে নিয়ে আমার একটা চিত্রনাট্য সম্পর্কে ওঁকে বলেছিলাম। এও বলেছিলাম বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্তা লিটুভাইয়ের ইচ্ছা আছে এই ছবি প্রযোজনার। শোনামাত্র হাসনাতভাই বললেন, ‘করুন, করুন, এই ছবি তো হওয়াই চাই। আমি ফিরে গিয়েই দেখছি।’

এই ‘ফিরে গিয়ে দেখা’র প্রথম কাজটা হলো বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে আমার ও স্ত্রী ইন্দ্রানীর নামে দুটো প্লেনের টিকিট পাঠানো। আর ফোনে জানালো যে, আমাদের ট্রিপের বন্দোবস্ত হচ্ছে জীবনানন্দের বরিশাল যাবার এবং ছবির জন্য এক নিখুঁত ‘রেকি’ সেরে আসার। প্রস্তাবে যে কী অভিভূত হয়েছিলাম তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করব না, তবে যেটা না বলে উপায় নেই তা হলো, ঢাকা থেকে বরিশালের জাহাজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার সেই আশৈশব বঙ্গপ্রেম এক নতুন জোয়ারে ফিরে এলো হৃদয়সৈকতে। পদ্মার বুকে ভাসতে ভাসতে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি বাঙালি হয়ে জন্মাতে দিয়েছেন বলে আর আবুল হাসনাতের মতো বন্ধু উপহারের জন্য।

হাসনাত সাহেব শুধু জাহাজে চড়িয়ে ক্ষান্ত দেননি। আগের দিন ঢাকায় জীবনানন্দের দুটি উত্তম জীবনীও ধরিয়ে দিয়েছেন পড়তে পড়তে যাব বলে। যার মধ্যে ক্লিন্টন বি সিলির লেখা ইংরেজিটাও আছে। আমি খানিকটা সময় বই পড়ে পড়ে আর বাকিটা কবির রূপসী বাংলা দেখতে দেখতে যাচ্ছি, আর হঠাৎ হঠাৎ মনে আসছে হাসনাত সাহেবের একটা কথা : ‘বরিশালের ছবি তুললেই তো জীবনানন্দ!’

সত্যি বলতে কী, হাসনাত সাহেব ছিলেন বন্ধু, দাদা, শিক্ষক ও ভালো মানুষের এক রোমান্টিক মিশ্রণ। আমার উপকারে আসতে পারলে যেন ওঁর নিজের উপকার। আর বইয়ের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা জেনে ভেতরে ভেতরে ওঁর কী যে পুলক! ঢাকা সম্পর্কে আমার শতেক প্রশ্নের উত্তর তো জুগিয়েই চলেছেন, হঠাৎ হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে একটা কোনো বই পেড়ে এনে বলছেন, ‘তাহলে তো এই বইটা আপনাকে পড়তেই হচ্ছে।’ আমি ‘করেন কী, করেন কী’ করলেও উনি কেতাব গছিয়েই চলেছেন। আর মুখে বলছেন, ‘ঢাকার সব কথা কি বলে শেষ হয় শঙ্করবাবু। নিন, লজ্জা করবেন না, আর আমারও তো একটা নেবার জিনিস আছে। জানেন কি?’

জিজ্ঞেস করতে ‘কী আছে নেবার?’ বললেন, ‘পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁকে নিয়ে একটা বই।’ একজন প্রকাশক কত সুন্দর করে একজন লেখকের কাছ থেকে বই চাইতে পারেন তার এক অপরূপ নমুনা হয়ে থেকে গেছে হাসনাত সাহেবের সেদিন বলা সেই কথাটা। বই তো নয়, যেন ভালোবাসা চাইছেন। আর সেই ভালোবাসাকে আরো কত, কত, কত ভালোবাসা দিয়ে প্রতিফলন করা যায় তারও এক অবিকল্প নমুনা রাখলেন বিলকুল আন্তর্জাতিক মানে রবিশঙ্কর-বিলায়েৎ : একটি অশ্রুত যুগলবন্দি বইটি প্রকাশ করে। যার সর্বঅঙ্গে হাসনাতভাইয়ের হাতের মধুর স্পর্শ দেখি সর্বক্ষণ। কি কাগজ, কি মলাট, কি ছাপা-বাঁধাই, প্রুফ পড়া, ডিজাইন, কি শিল্পীদের ছবির ঢল। কোত্থেকে যে ভদ্রলোক জোগাড় করলেন এত এত ছবি আমি আজো জানি না; এর অনেক ছবিই আমি নিজেও আগে দেখিনি। সে-কথা বলতে হাসনাত সাহেবের মরমি প্রশ্ন : ‘আপনার ভালো লেগেছে তো?’ যেই বললাম, ‘ভীষণ’ হাসনাতভাইয়ের কথা এলো ফোনে – ‘ব্যস, এটাই চেয়েছি। বাকিটা বাজার বুঝবে।’

আমার জীবনে এই হচ্ছেন হাসনাত সাহেব। আমার পূর্বপুরুষের জন্মভিটের মুখ। আরো আধুনিক করে নিয়ে বললে – চলমান বাংলাদেশ। আর খুব ব্যক্তিগত করে বললে, যা প্রথমেই বলেছি, আমার বাংলাদেশের ভিসা। যখন খুব আসতেন কলকাতা, একরাশ বাংলার হাওয়া বয়ে আনতেন। যেভাবে চশমার ভেতর দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে চাইতেন মনে হতো কিছু খুঁজছেন। পণ্ডিতের খোঁজা, যার কোনো শেষ নেই। কী জানি, হয়তো কোনো রসের খোঁজা।

নানা রস, নবরস ছাড়াও হাসনাতভাই ছিলেন অপূর্ব খাদ্যরসিক। শেষবার ঢাকাতে ওঁর বাড়িতে যে-ডিনার খাওয়ালেন তা ঢাকার আদি পরিবারগুলির লাইফস্টাইল থেকে বয়ে আসা। পদেরও যেমন শেষ নেই, তেমনি তরিবত করে সব রাঁধা। যে-ভোজের শুরু হয়েছিল জনি ওয়াকার ব্ল্যাক লেবেলে। গূঢ় রসিকের মতো জিজ্ঞেসও করেছিলেন, ‘স্কচটা ফ্রেশ লাগছে তো?’ আর মাংসের পদের প্রশংসা করতে ভাবিকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা ওর ডিপার্টমেন্ট।’

এখন দাদার জন্য যখন বুক ফাটছে তখন জানতে ইচ্ছে করছে, এবার থেকে আমার বুকের মধ্যে বাংলাদেশটা তাহলে কার ডিপার্টমেন্ট? কে আমায় ঢাকার তথ্য দেবেন? জীবনানন্দের তাবৎ ডায়েরি সংগ্রহ হাতে তুলে দিয়ে বলবেন, ‘রাখেন। কাজে লাগান!’ দুষ্টু, মিষ্টি হেসে বলবেন, ‘বরিশাল দেখে এলেন তো, এবার রূপসী বাংলাটা নতুন করে কেমন লাগে জানাবেন।’ জীবনানন্দকে নিয়ে আমার সেই ছবিটা নানা কারণে আর তোলা হয়নি। সেই দুঃখটা তো আছে, সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন দুঃখ – আবুল হাসনাত নামের আমার বাংলাদেশের ভিসাও শেষ হয়ে গেল।