আহীর আলমের বাম পা

তুমি আবিদ রাজা! ঠিক বলিনি আমি?

মোবাইলের ওপাশে কাঠফাটা চিৎকার। সেই হাসির তরঙ্গের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে হাসে সিলভিয়া আখতার,

হাসছো কেন? বলো আমি তোমাকে চিনেছি কি না!

চিনতে হবে কেন? আমার নম্বর সেভ নেই তোমার সেটে?

না, তোমার নম্বর আমার মোবাইল সেটে নেই। কণ্ঠস্বরে চিনেছি। একটু থেমে সিলভিয়া প্রশ্ন করে, রাজা এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল?

তোমাকে আমার সব সময়ে মনে পড়ে।

হাসে সিলভিয়া। হাসতে হাসতে একটু বিরতি নেয়, কণ্ঠে এক ধরনের মাদকতা। সুখের শিস বাজে, তুমি আমার মোবাইল নম্বর পেলে কোথায়? কার কাছ থেকে?

সিলভি?

বলো।

তোমার নাম্বার আমার মোবাইলেই ছিল। মনে আছে, বছর আটেক আগে নিউমার্কেটে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।

রাইট, আমার মনে পড়ছে। তো সেই আট বছর পর আজ আমাকে ফোন দিলে রাজা? গলায় ভেজা অভিমান সিলভিয়া আখতারের।

শোনো সিলভি, একসময়ে তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম, তুমি জানো। আহা কী উন্মাতাল সময় কেটেছে তোমার আমার। কিন্তু আমরা এখন সংসারের ট্রেনে। তোমার  স্বামী-সংসার আছে, আমারও আছে।

তাই বলে তুমি আমাকে একটা ফোন করবে না?

আবিদ রাজা গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে, এই যে এখন করলাম।

আট বছর পর! এই আমাকে ভালোবাসো?

ওপাশের উত্তর শুনতে পারে না আহীর আলম, কেবল দেখতে পায় সিলভিয়া আখতারের রিনিক-ঝিনিক হাসি। হাসতে হাসতে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দেয় সিলভিয়া। দেয়ালে তেরছা হেলান দিয়ে কথা বলা সিলভিয়ার একটি প্রিয় তরঙ্গ। যখন মুডে থাকে, খুশিতে ডগবগ করে, তখন দেয়ালে শরীর ঠেস দিয়ে বঙ্কিম-গ্রীবায় দাঁড়ায় ও। অনেক অনেক দিন পর দেখল সিলভিয়ার এই বঙ্কিম-শরীর, তাও আড়াল থেকে, লুকিয়ে।

প্রতিদিনের মতো সকালের দিকে বের হয়েছিল আহীর আলম। বাঁ পা প্রায় অবশ। নিজেরই বাঁ পা, যে-পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে চলাফেরা করে, সেই পায়ের কা- দেখে অবাক। লবণ এবং বাটা লাল
মরিচ-মাখানো থেঁতলানো কষ্ট বাঁ পায়ের ভেতরের কোষে কোষে সিদ্ধ করছে। কেবল নিজেই টের পায়। ধীরে ধীরে পায়ের পাতা অবশ হয়ে হয়ে ওপরের দিকে উঠছে। নিজেরই পা আহীর আলমের, টের পাচ্ছে নিঃশব্দ সর্বনাশ; কিন্তু কারো কাছে বলা যাচ্ছে না। কেউ গুরুত্বও দিচ্ছে না। ডাক্তারের কাছে গেলে চিরাচরিত নিয়ম মেনে বলে, ‘আপনার বাঁ পায়ের রগ এলোমেলো হয়ে গেছে।’

‘কিন্তু যখন অপারেশন করলেন আমার কোমরে, তখন তো বলেননি আমার বাম পায়ের রগ এলোমেলো হয়ে যাবে?’ পরিচিত ডাক্তার আহীর আলমের দিকে কড়া চোখে তাকায়, ‘ডাক্তারের কাজ রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসা করা। আমি সেটা করেছি। চিকিৎসার পর শরীরের কাঠামো অনুসারে অনেক প্রকারের চেঞ্চ আসে। আপনার সেই চেঞ্চ হয়েছে …’

আহীর আলমের ইচ্ছে হয় ডাক্তারের মাথাটা এক কোপে শরীর থেকে নামিয়ে দিতে। ডাক্তার নিজের পজিশন বুঝে মুহূর্তে কথা পরিবর্তন করে। অবশ্য ডাক্তার অনেকগুলো নিয়ম বলেছিল অপারেশনের পর, ‘আপনি ছয় মাস পর্যন্ত কোমরে বেল্ট পরে হাঁটবেন। পারলে এক বছর। সব সময়ে সোজা হয়ে বসবেন। নুয়ে কোনো কিছু তুলবেন না। কোনো ওজন বহন করবেন না।’

বাসায় এসে কোমরে বেল্ট পরার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু বেল্ট পরে প্যান্ট পরলে কোমরটা বেঢপ মোটা হয়ে যায়। পথের লোকজন অবাক চোখে তাকায়। ওপর-নিচ ঠিক মাঝখানে হঠাৎ মোটা, এটা মানুষ না নতুন জন্তু, অবাক প্রশ্ন নিয়ে তাকায় রাস্তার লোকজন। অফিসের লোকজনও বিশ্রী মন্তব্য করে। এবং সকলের চোখ থাকে আহীর আলমের মুখ নয়, বেঢপ কোমরের ওপর। আবার যায় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার মোটা বেল্ট বাদ দিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করা দামি কিন্তু পাতলা একটা বেল্ট দেয়। নতুন বেল্ট শার্ট-প্যান্টের নিচে পরলে কেউ বুঝতে পারে না। আনন্দের সঙ্গেই বেল্ট পরে আহীর আলম; কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয় দুপুরের দিকে। দুপুরের দিকে ঘামে বেল্ট ভিজে গেলে শুরু হয় চুলকানি। কোমরের ওপর প্রবল চুলকাচ্ছে, বেল্টের ওপর দিয়ে হাত দিয়ে চুলকালে মুহূর্তের জন্য চুলকানি থামে; কিন্তু হাতের চুলকানি বন্ধ হলে আবার শুরু হয়। ইচ্ছে হয় প্যান্ট শার্ট জাঙ্গিয়া খুলে চুলকায় …। বাধ্য হয়ে অস্ট্রেলিয়ার পাতলা বেল্ট রেখে দেয়। মোটা বেল্টও …। সব সময়ে সোজা হয়ে বসবেন। সব সময়ে সোজা হয়ে বসা যায়? জীবনে কখনো কি সোজা হয়ে বসেছিল? কেবল স্কুলে পিটি করার সময়ে সেই যে সোজা হয়ে দাঁড়াতে হতো কয়েক মিনিট …। কিন্তু পিটি স্যার কখনো সোজা হয়ে বসতে বলেননি। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বসেছে আজীবন। কিন্তু যখন সচেতন হয়ে বসতে যায়, মেরুদণ্ড সোজা করে, কয়েক মিনিট পর গোটা শরীরে অস্বস্তি দেখা দেয়, ব্যথা বাড়ে মেরুদণ্ড। এক ব্যথা রিমুভ করতে গিয়ে আরেক ব্যথা ডেকে আনবে? নিজেরই ওপর ভয়ানক বিরক্ত আহীর আলম, কেন এই বিষণ্ণ বিপন্ন জীবন আমার? নুয়ে কোনো কিছু তুলবেন না। বললেই হলো, সংসারে কে আছে সবসময়ে মাটিতে রাখা জুতো পরিয়ে দেবে? বাথরুমের বদনা এগিয়ে দেবে? পকেট থেকে টাকা পড়ে গেলে কে তুলবে? কেউ তখন পাশে থাকে না। বাধ্য হয়ে নিজেকেই তুলতে হয় … এসব ডাক্তার বুঝবে? অন্ত নিপীড়নের এই খেলা থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। ফলে, বাঁ পা আহীর আলমের সর্বনাশের প্রতীক হয়ে দেখা দিচ্ছে।

বাসায় নিজেই একটা যন্ত্রণার যন্ত্র! সব সময়ে মেজাজ থাকে তিরিক্ষে। ছোট ছোট ঘটনাও বড় করে দেখার একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। মেয়েটা গতকাল বাইরে থেকে এসে ব্যাগটা রেখেছিল টেবিলের ওপর। আধা ঘণ্টা হয়ে যায় মেয়েটা ব্যাগ নেয় না। আহীর আলমের মনে হলো, এটা আমাকে অপমান করার জন্য করা হয়েছে। রেগেমেগে চিৎকার করে বাসার মধ্যে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ফেলল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। মেয়েটা মাফ চেয়ে ব্যাগটা নিয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী সিলভিয়া আখতারের মুখোশ প্রকট আকারে প্রকাশ হয়ে যায়।

তুমি কী পেয়েছ? ঘর ছেড়ে চলে যাবো? সারাদিন অপদার্থের মতো বাসার মধ্যে বসে থাকো। কোনো কাজ করো না, অফিসে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছ, বসে বসে সংসারের মানুষের হাগামুতা দেখলে চলবে? তুমি আর বাসায় থাকবে না। বের হও বাসা থেকে … কান্না জুড়ে দেয় সিলভিয়া।

হতভম্ব আহীর আলম, আমি এই সংসারের জঞ্জাল? আমি এই সংসারের কেউ না? আমি অপ্রয়োজনীয় বোঝা?

সত্যি সত্যি বের হয়ে যায় আহীর আলম। রাগে ক্ষোভে দুঃখে বের হওয়ার সময় খেয়ালও থাকে না, পরনে লুঙ্গি আর গায়ে পুরনো রংচটা ফতুয়া। বাসা থেকে বের হয়ে অলিগলি শেষে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। হাজার হাজার গাড়ি বাস রিকশা এবং মানুষ ছুটে চলেছে। এই ছুটে চলার পথে আমি আহীর আলম কতটুকু? একটি বিন্দু? বিন্দুরও বিন্দু? বিশাল সংসারজগতে আমার কি কোনো অবস্থান আছে? আমি হাঁটতে পারি না, আমারই শরীরের বাঁ পা আমার বিরুদ্ধে খেলছে। আমাকে কাঁদাচ্ছে, আমাকে ভোগাচ্ছে …। রাস্তা ধরে, ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে আহীর আলম। হাঁটার সময় বাঁ পাটাকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ডান পায়ের ওপর দিয়ে হাঁটে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা বাড়ির কার্নিশের নিচে ছায়া দেখে দাঁড়ায়। হাঁপাচ্ছে। শরীর নুয়ে আসছে, শরীর ভেঙে যাচ্ছে। বাঁ পা কাঁপছে থরথর …। বসে পড়ে আহীর আলম, বাঁ পা জুড়ে বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে, হায় মানুষ, হায় জীবন, তুমি আমাকে কোন তীর্থবাসনায় নিয়ে যাচছ? দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে আহীর আলম।

বন্ধ চোখের ওপর ছায়া পড়ে আহীর আলমের। বুকের সঙ্গে বাঁ পা চেপে ধরেই দৃষ্টি মেলে, সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক। অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে আহীর আলমকে। বোঝার চেষ্টা করছে লোকটা এখানে কী করছে! অথবা জ্ঞান হারিয়েছে কি না! চোখ মেলে তাকালে যুবকের চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যায়। পকেটে হাত দিয়ে খুচরো টাকা বের করে দুহাতের তালুতে আঙুলে টাকা বেছে একটা বিশ টাকার নোট আহীর আলমের পায়ের কাছে রেখে দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়।

ঘটনাটা প্রথম কয়েক মুহূর্ত বুঝতেই পারে না আহীর আলম। অবাক চোখে যুবকের চলে যাওয়া দেখে। যুবক চোখের আড়ালে গেলে ফিরে আসে দৃষ্টি পায়ের কাছে। চকচক করছে নতুন বিশ টাকার নোট। বাতাসে একটু একটু নড়ছে সবুজ নতুন নোটটা লকলকে জিহবা তুলে। নোটটা মিটিমিটি হাসছে, এই বাঁ পা লুলা আহীর আলম হারামজাদা, শিগগির আমারে পকেটে রাখ। কেউ দ্যাখলে ছোঁ মাইরা লইয়া যাইবে।

আর তখনই মনে পড়ে আহীর আলমের, আরে ওই যুবক তো বিশ টাকার নোট আমাকে ভিক্ষুক মনে করে দিয়েছে। চট করে দাঁড়ায় কিন্তু বাঁ পা যথারীতি বিট্রে করে। দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠে এসে কোমরের মাঝখানে চুমু খাচ্ছে, চুমুতে ভয়ানক বিষ।

মা গো! আহীর আলম আবার বসে বাড়ির ছায়ায়। বাঁ পা টেনে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে, আর ডান পাটা সামনের দিকে ছড়িয়ে রাখে। বুঝতে পারে, মানুষ এভাবে ভিক্ষুক হয়। অনেকক্ষণ বাড়ির ছায়ায় থাকতে থাকতে আহীর আলমের চোখে ঘুম নেমে আসে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুমানোর পর ঘুম ভাঙে আহীর আলমের। মাথার ওপরের রোদের ছায়া কাত হয়ে ঝুলে পড়েছে। এবং পেটে প্রচণ্ড খিদে অনুভব করে। কিন্তু কোথায় যাবে? বাসায় আর ফিরতে ইচ্ছে করছে না। অবাক কাণ্ড, সেই সবুজ বিশ টাকার নোট এখনো পড়ে আছে। কেমন একটা মায়া জন্মে টাকাটার প্রতি। এতো লোক আসা-যাওয়া করলো কেউ টাকাটা নিল না? ভালো করে তাকিয়ে দেখে বিশ টাকার সঙ্গে আরো কয়েকটি এক টাকা, দুই টাকা পাঁচ টাকার নোট ঝিমাচ্ছে পায়ের আশপাশে। সঙ্গে সঙ্গে বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে আহীর আলম। রিকশা চালিয়ে যেতে যেতে রিকশাঅলা বলল, হালায় পাগল অইয়া গেছে গা।

কানে তোলে না রিকশাঅলাকে আহীর আলম। টাকাগুলো হাতে নিয়ে গুনতে শুরু করে, আটত্রিশ টাকা। টাকাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, ব্যথাটা অনেকটা কমে এসেছে। বাঁ পায়ের হাঁটুর ওপর বাঁ হাতের ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে। পেটের ভেতরে খিদেটা বুভুক্ষু কুকুরের মতো হামলে হামলে উঠছে …। ছোট রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তায় ওঠে …। বড় রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান। বসে দোকানের বেঞ্চে।

আমাকে একটা চা আর টোস্ট দিন।

দোকানদার চা আর দুটি টোস্ট দিলে গরম চায়ে ডুবিয়ে টোস্ট খেতে শুরু করে আহীর আলম। চায়ে চুবানো নরম টোস্ট মুখে দিলে অমৃতের স্বাদ লাগে। জীবনে কতবারই তো চায়ে ডুবিয়ে টোস্ট খেয়েছে; কিন্তু এমন স্বাদ তো লাগেনি। ভিক্ষার টাকায় খাচ্ছে … সঙ্গে সঙ্গে আহীর আলমের বুকের গভীর থেকে একধরনের মৃত মানুষের গলিত লাভা এসে মুখ ভরে যায়। খক-খক খ-ক-ক-খ বমি করতে থাকে। দোকানদার আর পাশের মানুষেরা বিরক্ত। বমি করে আহীর আলম দাঁড়ায়। হাঁ করে শবাস নেয়। ভিক্ষার টাকা থেকে হিসাব করে ষোলো টাকা দিয়ে এক গস্নাস পানি খেয়ে আবার বাঁ পায়ের ওপর বাঁ হাতের ভর রেখে ধীর ধীরে হাঁটতে থাকে। কোথায় যাবে আহীর আলম? বাসায়? যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু যাওয়ারও কোনো জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে পরাজিত কুকুরের বাসনায় বাসার দিকে হাঁটে। বাসার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। যাবে? নিজের সঙ্গে লড়তে শুরু করে।

না, যাবো না বাসায়।

গাধা নাকি! নিজের বাসা। নিজের কামাইয়ের টাকায় বাসার ভাড়া দাও, যাবে না কেন?

সংসারের কেউ আমাকে চায় না।