আখতার হোসেন খান
আরো লেখা
প্রমথ চৌধুরী
সংকলক : ভূঁইয়া ইকবাল
বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৮
৫৪০ টাকা
প্রমথ চৌধুরীর এই বইটি (আরো লেখা) বাংলা একাডেমির ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমে’র আওতাভুক্ত; প্রথম প্রকাশ জুন ২০১৮, দৃশ্যতই লেখকের জন্মতারিখের হিসাবে সার্ধশত বার্ষিকী পালনের জন্য। বইটির সম্পাদক, লেখক ও গবেষক ভূঁইয়া ইকবাল।
যাঁকে নিয়ে তাঁর এই চেষ্টা, সেই প্রমথ চৌধুরী সার্ধশতবর্ষে নতুনভাবে মূল্যায়িত হবেন, তাই স্বাভাবিক। বাংলা ভাষার ইতিহাসে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে তুলনীয় মনস্বিতা ও চিন্তাগত ঔদার্যের অধিকারী দ্বিতীয় লেখক খুব সুলভ নয়। অতি-অসাম্প্রদায়িক ও সেক্যুলার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী বা আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে; কিন্তু যদি বিবেচনা করা হয় যে বাংলা ভূখ– হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের শুরুর কঠিন দিনগুলোতেই প্রমথ চৌধুরীকে কলম ধরে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয়েছিল, তবে তাঁর কাজটা অন্যদের তুলনায় খুবই অসহজ মনে হবে। এবং এ-ধরনের দৃপ্ত আশাবাদের মধ্য দিয়েই তিনি ভবিষ্যতের দিকে তাকান : ‘আমার আশা, বাংলা সাহিত্যই হিন্দু মুসলমান নির্বিচারে বাংলার লোককে একজাত করে তুলবে।’ ‘একজাত’ কথাটা লক্ষণীয় ।
বইটির পেছনের কভারের কথাগুলোর দ্বিতীয়াংশ দিয়েই শুরু করা যাক : ‘পঞ্চাশটি প্রবন্ধের সংকলন-অতুলচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত প্রবন্ধ সংগ্রহে অন্তর্ভুক্ত হয়নি এমন ৬৫টি রচনা এই গ্রন্থের সম্ভার ও ঐশ্বর্য। প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান এবং শতবর্ষ আগে প্রকাশিত স্টোরি অব বেঙ্গলি লিটারেচার পুস্তিকা দুটি এই বইয়ে পুনর্মুদ্রিত। সংযোজিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের এক অজানা চিঠি। আরো আছে প্রমথ চৌধুরীর একশো আশিটি চিঠি।’ বইটিতে কী আছে, এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত ভালো বর্ণনার আর দরকার নেই। উল্লেখ্য, বিশ্বভারতীর প্রবন্ধসংগ্রহে এই বইয়ের লেখাগুলি নেই।
ওই একই প্রচ্ছদের প্রথম অনুচ্ছেদের কথাগুলোও প্রণিধানযোগ্য : ‘প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) বাংলা গদ্যের শীর্ষ শিল্পী। যৌবন, তারুণ্য, বুদ্ধির দীপ্তি, রুচি, যুক্তি, বৈদগ্ধ ও কেŠতুক তাঁর গদ্যের বৈশিষ্ট্য। বাংলা গদ্যে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন চলতি রীতিকে মানভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের জন্য।’ বিষয় ও লেখক সম্পর্কে এমন একটা নির্যাস পাওয়ার পরে এ-যুগের পাঠকদের এ-বইয়ের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছা উদগ্র হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রসঙ্গত সম্পাদক সম্পর্কেও কিছু জানার আগ্রহ জাগা স্বাভাবিক : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ইকবাল ডজন দেড়েক বইয়ের লেখক ও সম্পাদক। সব ধরনের প্রত্যাশিত ও অপ্রত্যাশিত সূত্র থেকে প্রকাশ্য (এবং হয়তো বা অপ্রকাশ্যও) সব খনি বা খনির টুকরা বের করা তাঁর সাহিত্যচর্চার এক অনিবার্য অভ্যাস। এই লক্ষণ বাংলাভাষীদের (বিশেষত, সাহিত্যসেবক ও অনুরাগীদের) জন্য এক অতুলনীয় সেবা ও দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথের একগুচ্ছ পত্র, বাংলাদেশে রবীন্দ্র-সংবর্ধনা, পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা, রবীন্দ্রনাথ ও মুসলিম সমাজ ইত্যাদির সংকলক/ লেখক/ গবেষক হিসেবে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য। প্রায় সাত পৃষ্ঠাব্যাপী মুখবন্ধে আমরা জানতে পারি, সম্পাদক কী কী ধরনের অপরিচিত বা প্রায়বিস্মৃত সব সূত্রে গিয়েছেন এই লেখাগুলো সংগ্রহের জন্য।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার ভুবনে এক অনিবার্য নাম। তিনি না থাকলে এ-ভাষার অবস্থা কোথায় গিয়ে কী দাঁড়াত, তা অনুমান করা কঠিন। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বলেই বাংলা ভাষার অনুগামীরা লিখে থাকেন; এবং বুদ্ধদেব বসুর ওই বক্তব্যকে প্রমথ চৌধুরীর দিকে ঘুরিয়ে সহজেই বলা সম্ভব তিনি সাহস না দেখালে আমরা সবাই আজো সম্ভবত নীরদ সি. চৌধুরীর সাধু ভাষায় গদ্য লিখে যেতাম। সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, আমার প্রিয় লেখক অমিয় দেব, বা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনিসুজ্জামান প্রমুখের সুপাঠ্য গদ্য এ-ভাষায় হয়তো অন্য রূপেই পড়তে হতো বা আমাদের রুচি রবীন্দ্রনাথের প্রথম পাঁচের দশকের বা নীরদীয় সাধুত্বে আবদ্ধ থাকত।
হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে তাঁর লেখাগুলো (সংখ্যায় প্রায় দশটা) আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক ভিন্ন কারণে। পৃথিবীতে ধর্মীয় কারণে নরহত্যা, নির্যাতন, রাজনীতি, দেশত্যাগ বা দেশত্যাগের ইন্ধন, মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, স্বধর্ম নিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই/ গর্ব; এবং এ থেকে সম্প্রসারিত বর্ণবিদ্বেষ ও তার প্রতিক্রিয়ায় আরো সব অঘটন – এ সবকিছুরই বিপক্ষে ছিলেন প্রমথ চৌধুরী। এমনকি তথাকথিত দেশপ্রেম ও তদুদ্ভূত জাত্যাভিমান তাঁর মোটেই পছনদ হয়নি। ‘জাতিতত্ত্ব’ নামে একটা ছোট লেখায় পৈতাহীনদের দেখাও পাপ মনে করেন যাঁরা তাঁদেরই কণ্ঠে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আবার অস্পৃশ্যতা দূর করার দাবি ওঠা শুনে তাঁর ‘হাসিও পায়, কান্নাও পায়’। আরো লেখার এই প্রবন্ধগুলি তাই আজকের দুনিয়ায় চলার পথে বিশেষ সহযাত্রী হতে পারে। তাঁর মতো সক্রিয় সেক্যুলার আর কে?
ফ্রয়েডের তত্ত্ব সম্পর্কে উৎসাহীরা সংক্ষিপ্ত সারবত্তা পাবেন ‘মনের পথে’ লেখায়। কর্মবীর রাজনীতিবিদেরা বা নিরুদ্ধ সাধু-সন্ন্যাসীরা ‘উদ্ভ্রান্ত প্রেমের বর্ণচোরা বিকাশ’ হিসেবে তথা ‘লিবিডো’ নামের মধুরসের প্রভাবেই মাঠে নামেন বা অরণ্যের নির্জনতায় আশ্রয় নেন, ফ্রয়েডের এ-কথায় অনেকের গাত্রদাহ হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রমথ চৌধুরী একটা সারসংক্ষেপ বানিয়ে সাধারণ পাঠকদের জন্য বিষয়টি সহজবোধ্য করেছেন। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন মনের পথে নামের ফ্রয়েডীয় বিষয়ক একটি বাংলা পুস্তিকার ওপর আলোচনা হিসেবে; আর নিজ লেখাকে তিনি ওই বইয়ের ‘উপসংহার’ মনে করেন।
দিনপঞ্জি হিসেবে রক্ষিত অংশে (‘দিনপঞ্জী ও অন্যান্য কথা’ এবং ‘বাজে কথা’) জানতে পারি, নিঃসন্তান প্রমথ চৌধুরী যে-ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিজ পুত্র হিসেবে ভাবতেন, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৈমানিক হিসেবে জার্মানিতে মৃত্যুবরণ করেন; আর তাঁর নিজ জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ। মহাকবির মৃত্যুর আগের ক’দিনের বিবরণ মিলবে এই দিনপঞ্জিতে।
নন-কো-অপারেশন, গান্ধী তথা রাজনীতি সম্পর্কে ‘আমাদের মত-বিরোধ’ প্রবন্ধটি এই কারণে পাঠ্য যে, রাজনীতিতে ভিন্নমত কীভাবে প্রকাশ করতে হয়, এটা তার একটা শিক্ষ। যে মার-মার-কাট-কাট ভাষা আমরা সচরাচর এখনকার দিনের পত্র-পত্রিকায় দেখি, তার সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর এই ভাষা মিলিয়ে দেখা দরকার।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ছিন্নপত্র’ নিয়ে লেখাটি উদ্দীপক। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ওই মহাকাব্য বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মেলেনি; কিন্তু পরিষ্কারভাবে প্রমাণ রাখে যে, সব ব্যাপারেই তাঁর উৎসাহ ও নিজস্ব অভিমত ছিল। বাংলা সাহিত্য-সংক্রান্ত ইংরেজি লেখা দি স্টোরি অব বেঙ্গলি লিটারেচার এ-বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পাদক পাঠককে কৃতার্থই করেছেন। চ-ীদাস যে চসারের সমকালীন ছিলেন, সে-মতও প্রকাশ করে গেছেন প্রমথ চৌধুরী এ-লেখায়। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠবেই, এই চ-ীদাসই কি মহাকাব্য লেখক বড়ু চ-ীদাস, না পদাবলির চ-ীদাস; আর চৈতন্যদেব কোন কবির গানে, নাকি দুজনেরই, পাগল হতেন, চৈতন্য হারাতেন, সে-সমস্যার সমাধান মেলা দুষ্কর। এমনকি হতে পারে দুজন অভিন্ন? ভাষা বাছলে দুজনকে ভিন্ন মনে হওয়াই তো স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথবিষয়ক সাতটি লেখা আছে এই সংগ্রহে; এগুলো এই সংকলনের একটা বিশেষ দিক; বাংলা ভাষার অচপল ভক্তেরা এসবে পাবেন চেনা অনেক বিষয়ের ভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন। তবে অন্যান্য লেখায়ও রবীন্দ্রনাথ বারবার ঘুরেফিরে এসেছেন, কিন্তু তিনি যে মহাকবির ভাতিজি-জামাই সেজন্য ভিন্নমত প্রকাশে তাঁর দ্বিধা নেই মোটেই।
এই বইয়ের দুর্লভ সম্পদ বিভিন্ন জনকে লেখা একশ আশিটি চিঠি : রবীন্দ্রনাথকে লেখা ডজনেরও বেশি বাদে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখকে লেখা চিঠিগুলো বাংলা ভাষার ইতিহাসের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। একটি চিঠির একই কাগজে রবীন্দ্রনাথের কথা ইন্দিরা দেবী লিখে পাঠিয়েছেন। সুধীন দত্তের উদ্দেশে চিঠিটি পরিচয় পত্রিকার জন্য লেখা পাঠানোর অনুরোধের উত্তরে : চিঠিটি বেশ বড়, প্রায় সাড়ে চার পৃষ্ঠার, আর তা-ই পত্রিকায় ছাপা হয়। সম্পাদক খুবই ঘাম ঝরিয়েছেন চিঠিটি জোগাড় করতে। চিঠিটি যাঁকে লেখা, সেই সুধীন দত্ত যেমন করেন, তেমনি প্রমথ চৌধুরী এতে সংস্কৃত ভাষায় সূর্যস্তব থেকে শুরু করে কালিদাসের ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ বৃষ্টি, রবীন্দ্রনাথ, বের্গসঁ, দিলীপকুমার রায়, বেদ, বেদান্ত, বার্ট্রান্ড রাসেল, হাইনে, পতঞ্জলি, অ্যারিস্টটল, বুদ্ধ সবাইকে টেনে এনেছেন।
যুবক বন্ধুদের, যেমন বুদ্ধদেব বসু, অজিত চক্রবর্তী, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের অনুরোধে তিনি একটু বিলম্বেই আত্মকথা লেখা শুরু করেন। এই বইয়ে আছে তার দুটি অংশ। এর প্রথমটিতে উল্লেখ করেছেন এক বৃদ্ধার কথা, যিনি ‘শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কর্তার ঘোড়া দেখলে ঘোমটা টানতেন’। বিভিন্ন চড়া বেতনের চাকরির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন আর্টিক্লড ক্লার্কের কাজ। এটিই তাঁর প্রথম চাকরি। সে-অফিসে তিনি বিচিত্র ধরনের লোককে দেখেন, ‘যাঁদের প্রায় সকলেই বাঙাল’ এবং ‘নানারকম জুয়োচ্চুরি করতে প্রায় সকলেই প্রস্ত্তত’।
একবারে শেষে পরিশিষ্টে তিনটি লেখা আহমদ কবিরের ‘প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা’ ও ‘প্রমথ চৌধুরীর ভাষাচিন্তা’ এবং সাঈদ-উর রহমানের ‘প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তা’ বইটির গুরুত্ব, গরিমা এবং মাধুর্য দু-ই বাড়িয়েছে। আহমদ কবিরের প্রথমোক্ত লেখাটির উত্তর দিয়েছেন
সাঈদ-উর রহমান। এমনসব কঠিন তত্ত্ব তিনটি লেখায় এসেছে, যার বিচার-বিশেস্নষণ শুধু গুরুভার লেখকদেরই ওপর বর্তায়; এবং লেখাগুলো যে আগত দিনে প্রমথ-চর্চার ক্ষেত্রে অনিবার্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে, তা সন্দেহাতীত। ‘উদ্দেশ্যহীন আর্ট’ বা সাহিত্যকে ‘জাতিগঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়’ হিসেবে বিবেচনার বিতর্কের শেষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সুতরাং, এই মতভিন্নতাকে সাহিত্যচর্চার অবিচ্ছেদ্য মৌল ভাবাই হয়তো অগতির গতি।
বিশেষ করে আহমদ কবিরের ‘প্রমথ চৌধুরীর ভাষাচিন্তা’ প্রবন্ধটি খুবই প্রয়োজনীয় বাংলা ভাষায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান বোঝার জন্য, সরল ভাষায় তিনি কী চেয়েছিলেন, তা পরিষ্কার হয় এ থেকে। তিনি ‘বাংলা ভাষাকে বিশুদ্ধ, নির্মল, নিটোল ও সুমার্জিতভাবে পেতে চান।’ তিনি ভাষার ‘স্বত্বস্বামিত্ব সাব্যস্ত করবার জন্য’ প্রয়োজনবোধে ‘বিবাদ-বিসংবাদ’ করতে প্রস্ত্তত ছিলেন। আর চলতি ভাষা প্রচলনের জন্য তিনি মিশনারির মতো নামলেন; এবং যদিও অনেকেই ওই যুগে চলতি ভাষার পিছনে রবীন্দ্রনাথকেই মূল ‘মোড়ল’ ভেবেছিলেন, কিন্তু তার অগ্রসৈনিক নিশ্চিতভাবেই ছিলেন প্রমথ চৌধুরী : কথ্যভাষার দ্বিধা দুর্বল ধারায় তিনি ‘প্রাণগঙ্গা’ বইয়ে দিয়েছিলেন।
আমার ধারণা, প্রমথ চৌধুরীর কলাকৈবল্যবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটা কারণ হয়তো ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অখ- দখল ও অভিনিবেশ। উনিশ শতকের শেষের দিকে বা বিশ শতকের প্রথম দিকে মালার্মে, ভ্যালেরি প্রমুখ নতুন নতুন বক্তব্য নিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যে। মালার্মের অনুকীর্তন ছিল – কবিতার মূল উপাদান শব্দ, বক্তব্য নয়। সুধীন দত্ত এই মতের অনুসারী ছিলেন বলে দাবি করতেন। এক কদম এগিয়ে ভ্যালেরি ভজালেন, শব্দ না হলেও চলে, শুধু ধ্বনি দিয়েই কবিতা লেখা সম্ভব। ওই একই সময়ে ক্লাইভ বেল, রজার ফ্রাই প্রমুখ নতুন তত্ত্ব ‘সিগনিফিক্যান্ট ফর্মে’র কথা আনলেন চিত্রকলায় : কোনো বক্তব্য প্রয়োজন নেই চিত্রকলায়, তার ‘বিশুদ্ধ রূপ’ই সারাৎসার। এ-ধরনের একটা আবহে প্রমথ চৌধুরীর সাহিত্যচিন্তায় কলাকৈবল্যবাদের দিকে প্রচ্ছন্ন প্রীতি বা স্পষ্ট প্রেম অসংগত নয়। তবে সম্ভবত সাঈদ-উর রহমানের লেখার এ-কথাটাও ঠিক : ‘(সাহিত্য) ধীরে ধীরে অজ্ঞাতসারে জাতীয় জীবন গঠন করে। গঠনের এই প্রক্রিয়া অমোঘ, নিরবচ্ছিন্ন।’ এর সঙ্গে যদি পড়ি প্রমথ চৌধুরীর এই
কথাগুলো, যথা ‘সুতরাং সাহিত্যচর্চা আমাদের পক্ষে একটা শখ নয়, জাতীয় জীবন গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়’, তাহলে তাঁকে আর মালার্মে-ভ্যালেরির মতো ঘরসংসার-বহির্ভূত নিরাসক্ত সন্ত মনে হবে না।
প্রমথ চৌধুরীর জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত এই সংকলন এক মহৎ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ রূপে মর্যাদা পাবে; এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ ও অধ্যাপক ইকবাল এ-কাজটি সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার পাঠকদের চিন্তার জগৎকে তার এক অবিস্মরণীয়-তথাচ-প্রায়শ-বিস্মৃত সাধকের দিকে পুনঃআকর্ষণের মহাপুণ্যবান পদক্ষেপটি নিলেন। সাহিত্যে উৎসাহী প্রত্যেক বাংলাভাষীর জন্য এই বই সংগ্রহ করা অবশ্য কর্তব্য।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.