কলকাতা শহরে এমন মানুষ আছে, যারা একসময়ে পূর্ববঙ্গবাসী বা কোনো পূর্ববঙ্গবাসীর উত্তরপুরুষ হলেও কলকাতায় এসেছে, এবং থেকেছে নানা কারণে – অনেক আগে থেকে আজ পর্যন্ত – কখনো পড়াশোনার জন্য, কখনো চাকরিবাকরির সন্ধানে, কিংবা পরবর্তীকালে দেশভাগে বিপর্যস্ত হয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তো দেশত্যাগের আরেক পালা। এরাই বস্ত্তত কলকাতার বাঙাল। কলকাতায় থাকলেও পূর্ববঙ্গের অনেক অভ্যাস ও স্বভাব তাদের রক্তে। আজীবন পশ্চিমবঙ্গবাসী হয়েও আমিও তো তাই। এখানে বাল্য, কৈশোর, যৌবনের দিনগুলি পার হয়ে পৌঁছেছি বার্ধক্যে। – দুই বাংলারই অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে সম্বল করে। তা-ই লিখে রাখতে চেয়েছি আত্মস্মৃতির বিভিন্ন পর্বে। গ্রন্থাকারে তাদেরই একসঙ্গে প্রকাশ করার সফল পরিকল্পনা, কলকাতার রাবণ-প্রকাশনা থেকে। প্রথম পর্বের অন্তর্গত উত্তর-মধ্য কলকাতার ‘বৃন্দাবন মল্লিক লেনে’র অংশটি বন্ধু সুশীল সাহার অনুরোধে প্রকাশ পাক কালি ও কলমের বার্ষিক সংখ্যায়।
উত্তরবঙ্গের মালদায় জন্ম হলেও ব্যক্তিগত পরিচয়ে আপাদমস্তক আমি কলকাত্তাই। পূর্বপুরুষের দেশ বলতে পূর্ববঙ্গ, বাড়িতে ছোটবেলায় ঠাকুরমা বা বাবা-মার গলায় দীর্ঘকাল বাঙাল ভাষাতেই কথাবার্তা শুনতাম। নিজেরা অবশ্য তার ব্যবহারে মোটেই অভ্যস্ত ছিলাম না, খাস কলকাতার কথ্য বুলিই আমাদের মুখে, বড়জোর একটা হালকা মিশ্রণ ছিল তলে-তলে। যেমন, ক্রিয়াশব্দে অপিনিহিতি নয়, অভিশ্রম্নতিও নয়, শিষ্ট বাংলার একটা স্বতন্ত্র রূপ। ‘খাইতাম’ বা ‘খেতুম’ নয়, বলতাম ‘খেতাম’। তবে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের বাঙাল উচ্চারণ ও কথনের প্রতি আমাদের মমত্বের বোধ থাকত। এতেই হয়তো নিজেদের নিজেরা মনে করতে পারতাম কলকাতার বাঙাল।
কলকাতার যে-পাড়ায় থাকতাম, সেখানকার পুরোনো বাসিন্দা ‘ঘটি’রা আমাদের ‘বাঙাল চিংড়ি মাছের কাঙাল’ বলে খ্যাপাত। বাবা পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক কর্মী, অনুশীলন পার্টি থেকে গান্ধীবাদী কংগ্রেস পর্যন্ত ছিল বিচরণ, সেই সুবাদে অনেকবার জেলও খেটেছেন। কোনো-একবার জেল থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুটা সময় তাঁকে অন্তরীণ থাকতে হয়েছিল, এবং তখন বাবা জায়গা বেছে নিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি মালদায় পৃথক এক ভাড়াবাড়িতে। আর সেখানেই আমার জন্ম ১৯৩৬-এর নভেম্বরে।
বোধহয় কুড়ির দশকের একেবারে গোড়ায় ফরিদপুরের অন্তর্গত কুঁয়ারপুর – এখন যা শরীয়তপুরে – সেখানকার গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসেন ঠাকুরদা। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর বাবা সপরিবার মধ্য-কলকাতায় এসে বাসা বদল করেন অনেকবার। মাঝে অবশ্য ঠাকুরদা কিছুকাল উড়িষ্যার কেন্দ্রাপাড়ায় ওকালতির সূত্রে ছিলেন বলে শুনেছি। শেষবার বাবা যে-বাড়িতে ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছিলেন, সেটা ছিল বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও তখনকার আমহার্স্ট স্ট্রিট-পরিবৃত সরু আঁকাবাঁকা বৃন্দাবন মল্লিক লেনে। আমার শৈশবের সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি তাকে ঘিরেই। আশ্চর্য, মনে আছে, আমরা যৌথ পরিবারের কয়েক শিশু সেকালের অভ্যস্ততায় ফ্রক পরে নতুন ভাড়াবাড়ি দেখতে এসে মাঝের ঘরের কুলুঙ্গিতে পুরোনো ভাড়াটেদের পরিত্যক্ত রঙিন পুতুলের পাড়ছেঁড়া শাড়ির সত্মূপ দেখে আনন্দে কীরকম ডগমগ হয়েছিলাম। মাঝে মাঝে রাস্তাঘাটে মা-র হাত ধরে কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে
যেতে- যেতে বাদুড়বাগান বা সংলগ্ন এলাকার কোনো একটি বাড়ির দিকে চোখ রেখে মা বলতেন, দ্যাখ, ওই বাড়িতেই আমরা ভাড়া থাকতাম!
৫/এ বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িটা ছিল আমাদের খুব পছন্দ। বেশ পুরোনো দোতলা বাড়ি, বাড়িতে অনেকটা ফাঁকা জায়গা, ঢুকেই নাতিবৃহৎ উঠোন, একপাশে ছোট্ট চৌবাচ্চা ও তার সঙ্গে জোড়া একচিলতে স্নানের ঘর। উঠোন ঘিরে আমাদের একতলার তিনটি ঘর, ঢুকে বাঁদিকে ঠাকুরমার ঘর, আর রাস্তার সামনে বাবা-মার ঘর। আরেক পাশে বাবার বন্ধু বৈদ্যনাথবাবু পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন। বাবার ও ঠাকুরমার ঘরের মাঝখানে ছিল একটা সরু ছোটো ভাঁড়ার ঘর, তাতে খাবারদাবার ঠাসা থাকত। সেটা ছিল বাড়ির বাচ্চাদের দুপুরবেলায় কৌটো থেকে চুরি করে খাওয়ার জায়গা। একবার আমি অনেকটা জমানো কিসমিস রোজ একটু-একটু করে খেয়ে কয়েকদিনের মধ্যে শেষ করে দিয়েছিলাম। তারপর অভাবনীয় কা-, বাবার কাছেও প্রচ- ধমক! একবারে পেছনে বিশাল চৌবাচ্চাসহ অদ্ভুত লম্বা শৌচাগার। দোতলায় থাকতেন মেজোকাকু ও তার পরিবার। বড়োকাকু ছিলেন উত্তরবঙ্গে। আমার বছর চারেক বয়সের সময়েই ঢাকার হোমিওপ্যাথিক কলেজে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন বলে চলে যান রংপুরের লালমনিরহাটে। সাম্যবাদী রাজনীতির টানে অনেক বছর জেল খেটে সেখানে গিয়েছিলেন ডাক্তারি করার সঙ্গে সঙ্গে পার্টির নির্দেশে কৃষক ফ্রন্টে কাজ করবেন বলে। দীর্ঘকাল আমাদের সঙ্গে তাই তাঁর যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। মণিকাকু থাকতেন উত্তর-কলকাতাতেই বা উত্তরের শহরতলি নাগেরবাজারের বিভিন্ন ভাড়াবাড়িতে। তবে তাঁর বিয়ে হয় বৃন্দাবন মল্লিক লেনে। বিয়ের দিন অনেক রাত্রে শোভাবাজারে
কিশোর-বরযাত্রী হয়ে বরের পাশে বসেছিলাম মনে আছে। বরকর্তা ছিলেন আমাদের এক দূরসম্পর্কের জ্যাঠামশাই। রীতি মেনেই যেন আমরা পৌঁছোনো মাত্র শঙ্খ বাজেনি কেন তা নিয়ে তিনি কন্যাপক্ষের সঙ্গে হুজ্জুত বাধালেন। অত অল্প বয়সেও এটা যে গর্হিত কাজ হলো, আমাদের প্রগতিশীল বাড়ির যোগ্য হয়নি, তা মর্মে-মর্মে বুঝতে পেরেছিলাম। বিয়ের পর কিছুদিন মণিকাকু ও মণিকাকিমা আমাদের বাড়িতেই ছিলেন। বাড়ির দোতলার দুপাশে দুটো চিলতে ছাদ। গরমকালের রাত্রে জলে ছাদ ভিজিয়ে মাদুরে শোয়া হতো – মাঝরাতে বৃষ্টি পড়লে মাদুর বগলে নিয়ে ছুটতাম ঘরে। একটা অসমাপ্ত খোপ-কাটা-কাটা দেয়ালের টালির ঘরও ছিল – ছোটোকাকু সেখানেই থাকতেন। তখনো তার বিয়ে হয়নি। দমদমের ক্লাইভ-কুঠির কাছের একটি বাড়ি থেকে এলেন দিল্লিবাসী ছোটোকাকিমা। বিয়ের পর ছোটোকাকু অন্যত্র গেলে সেই ঘরে ঠাঁই পেল আমাদের দাদা, যাকে আমরা ভাইয়েরা ‘দাদামণি’ বলে ডাকি।
নিম্নমধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারের অস্থির ও জনবহুল দৈনন্দিনে এইসব পুরোনো বাড়ি আর সরু অলিগলি নিয়েই উত্তর কলকাতার স্থাপত্য। আঁকাবাঁকা গলিটি উত্তরদিকে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে পড়েছে, আবার সেটাই পূর্বদিকে সার্কুলার রোডে। দক্ষিণে পঞ্চাননতলা। পশ্চিমে উঁকি মারলেই হৃষীকেশ পার্ক, আমাদের জীবনের সঙ্গে যা খুবই জড়িয়ে ছিল পরবর্তীকালে। হৃষীকেশ পার্কের ওপারে বৃন্দাবন মল্লিক লেনের সমান্তরাল আমহার্স্ট স্ট্রিট – দুদিক ছড়িয়ে – একদিকে বিবেকানন্দ রোডে পড়েছে, অন্যদিকে কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট/ হ্যারিসন রোড/ শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ছাপিয়ে বৌবাজার স্ট্রিটে। মাঝামাঝি কৈলাস বসু স্ট্রিট ধরে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের সীমানা একদিকে বিবেকানন্দ রোড, হাতিবাগান, শ্যামবাজারে – অন্যদিকে হ্যারিসন রোড ছাপিয়ে ওয়েলিংটন স্কয়ারে। এই হলো আমার শৈশবস্মৃতিতে উত্তর ও মধ্য কলকাতার ভূগোল।
সকালবেলায় ধাঙড়েরা রাস্তা পরিষ্কার করত, চাপাকল থেকে গঙ্গার জলে রাস্তা ধোয়া হতো। রাত্রে বৃন্দাবন লেন তো অন্ধকার গলি। গ্যাসবাতি টিমটিম করে জ্বলত – গোধূলিতে কাঁধে মই নিয়ে ছুটে-ছুটে কর্পোরেশনের কর্মীরা দেশলাই দিয়ে সেইসব বাতি জ্বালিয়ে দিত। দুই ল্যাম্পপোস্টের মাঝখানে জমাট অন্ধকার – ওই অংশটুকু ভূতের ভয়ে দৌড় দিয়ে পার হয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে বড়ো রাস্তায় পৌঁছোতাম। কোনো-কোনো বাড়ির ভেতর থেকে মাতালের চিৎকার শোনা যেত।
বৃন্দাবন মল্লিক লেনে গা ঘেঁষাঘেষি করে অনেক বাড়ি ছিল, সবই প্রায় দোতলা, প্রত্যেক প্রতিবেশীর সঙ্গেই আমাদের যোগ ছিল, আমার সঙ্গে তো বটেই। বেশ কিছু আগে থেকেই রেডিওতে পুজোর সময় সকালে মহালয়ার গান ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কথন শোনার জন্য সকলে মুখিয়ে থাকত। কিন্তু আমাদের বাড়িতে কোনো রেডিও ছিল না তখন। আমরা পাড়ায় ঘুরতাম যেসব বাড়ি থেকে বাইরে আওয়াজ আসে তার সামনে। পাশের বাড়িতে থাকতেন মায়েদের এক বন্ধু, আমরা তাঁকে ‘মাসিমা’ বলে ডাকতাম। তাঁর স্বামী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য-বিভাগের ডিরেক্টর। তখন উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলোর মাঝখানে কোনো সীমানা বা বেড়া থাকত না সবসময় – পেছনের বা পাশের একই দেয়াল দুই বাড়ির। ‘কমন’ জানালা দিয়ে মায়েদের কথা হতো। আমরা এভাবে কান পেতে মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনি টের পেয়ে ‘মাসি’ আমাদের খুব ভোরে চলে আসতে বললেন ওঁদের ঘরে। বলা বাহুল্য, আমরা আহ্লাদে আটখানা।
তারপরেই তো পুজো। বৃন্দাবন মল্লিক লেনের আশেপাশে অনেকগুলো বারোয়ারি পুজো হতো। আমরা বাদুড়বাগান লেনের ক্লাব শ্রীসঙ্ঘ এবং বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের হৃষীকেশ পার্ক – কাছাকাছি এই দুই পুজোকেই আঁকড়ে থাকতাম, সকাল থেকে রাত্রি অবধি। বাড়িতে খাওয়াদাওয়া তো হতোই জোরদার – সেইসঙ্গে মুড়ি-চিঁড়ে আর খইয়ের মোয়া, এবং নারকেলের নাড়ু পকেটে ভরে বেরিয়ে পড়তাম। মাঝে-মাঝে আমরা ছোটোরা দল করে হাঁটতে-হাঁটতে যেতাম শহরের পুজো দেখতে। তারপর নিজেদের মধ্যে তর্ক তুলতাম, কে এবার ফার্স্ট, সিমলা না কুমোরটুলি! এখনকার মতোই বাগবাজারের সাবেকিয়ানার পুজোর আকর্ষণই ছিল আলাদা। সেখানে হয়তো বড়োরাই চলনদার হতো। আজকালকার আলোকোজ্জ্বল তথাকথিত থিম-পুজোর হিড়িকে এসবকে মনে হয় ইতিহাস।
ছোটোবেলায় সমবয়সী প্রতিবেশী বন্ধু ছিল অনেক। তাদের নিয়ে ক্লাব তৈরি করা হলো, নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বালক সমিতি’ – যেমন ‘ভাব’ ছিল, তেমন ঝগড়াঝাঁটিও হতো। তখন নামও হলো দুটি, ‘পুরাতন’ বালক সমিতি ও ‘নতুন’ বালক সমিতি। আমরা অনেকেই ছিলাম ‘পুরাতন বালক সমিতি’র সভ্য। মালদহে মামাবাড়িতে ছিল প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসা। মামাদের ধরে বালক সমিতির একটা রাইটিং-প্যাড ছাপিয়ে এনে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম বন্ধুদের। দু-দলের ‘ফুটবল’ খেলা হতো রবার বা ক্যাম্বিসের বলে। কিংবা, বাঁশ কেটে ও ছুলে হকির ‘স্টিকে’। ঠোকাঠুকিতে পায়ের কোণে প্রায় স্থায়ী ক্ষত হয়ে থাকত। ঘা একটু সারলেই, আবার তা ফিরে আসত। মাঝে-মাঝে, সাধারণত আমাদের দোতলাবাড়ির মেজোকাকুর ঘরে, মায়েদের শাড়ি খাটিয়ে স্টেজ বানিয়ে, পাড়ার সব বন্ধু মিলে ‘থিয়েটার’ করতাম (চন্দ্রগুপ্ত, সিরাজদ্দৌলা, কিংবা শিবরাম চক্রবর্তীর প–ত বিদায়)। দর্শক বলতে আমাদের বাবা-মা ও অন্য অভিভাবকেরা এবং পাড়ার ছোটোরা। অভিনয় চলাকালে বড়োরা অভিনেতাদের মুহুর্মুহু পুরস্কারের প্রতিশ্রম্নতি দিতেন। বলা বাহুল্য, সেটা ঘটত না প্রায় কখনো। কিংবা,
মাঝে-মাঝে ছাদের পিকনিক। পেছনের বাড়ির সঙ্গে পাঁচিল আর আলসে বেয়ে-বেয়ে গতায়াত ছিল আমার। তার গেটটা ছিল বাদুড়বাগান স্ট্রিটে। ওই রাস্তায় আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়
বড়দা-ছোড়দা-শ্যামলদের বাড়ি। অনেক সময় যেতাম ওই পথেই। ছাদে-ছাদেই যোগাযোগ ঘটত বাড়ি-বাড়ি। ছাদের পিকনিকে বাড়ি থেকে ময়দা আর ঘি চুরি করে আনত পেছনের বাড়ির অত্যুৎসাহী ‘ঘটি’ বন্ধু, যার ডাকনাম ছিল বুড়ো। সামনের ঈষৎ জ্যেষ্ঠ বাঙালবন্ধু নন্দর বাড়ি থেকে আসত ডিম আর আলু।
আমরা তো একেবারেই ছোটো। পাড়ার বড়োদের মধ্যেও নানা ব্যাপারে দল গড়ার সক্রিয়তা লক্ষ করা যেত কখনো-কখনো। আমার বাবা ও মেজোকাকু প্রায়শই তার নেতৃত্ব দিতেন। তবে একবার করপোরেশনের ধাঙড়-স্ট্রাইকের সময় পাড়ার লোকেরা রাস্তার জমে-ওঠা জঞ্জাল সমবেতভাবে পরিষ্কার করেছিলেন কদিন ধরে – স্ট্রাইক উঠে গেলে পাড়ার বিখ্যাত মাতাল পানুবাবুর বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হলো। কেননা তিনিই ছিলেন স্ট্রাইক-ভাঙার অধিনায়ক। সেদিনই আবার আমার পেট খারাপ – মনমতো খেতে পারিনি বলে দুঃখের সীমা ছিল না। সেই তথাকথিত ‘সংহতি’র দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্ত পরে দেখা গিয়েছিল ছেচল্লিশের দাঙ্গার সময়।
১৯৪২-এ যখন আমার বয়স ছয়, তখনই আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো পাড়ার করপোরেশন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলের শিশুশ্রেণিতে। বাবা নানাভাবেই কলকাতা করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমনকি তৎকালীন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসুর ডান হাত ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাবশিষ্য এডুকেশন অফিসার অরবিন্দ বড়ুয়া ছিলেন তাঁর অতি নিকটজন। বাবা নিজেও শ্যামবাজার-সংলগ্ন শ্যামস্কয়ার ইস্টের অন্য একটি কর্পোরেশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। হয়তো সেটাই কারণ ছিল বিনা প্রশ্নে আমাকে বা আমার ভাইবোনদের ওই নামের অনভিজাত স্কুলে ভর্তি করানোর। আমাদের স্কুলটি ছিল সুকিয়া স্ট্রিট, আজকে যার নাম মহেন্দ্র শ্রীমানী স্ট্রিট, তার সঙ্গে আমহার্স্ট স্ট্রিট, এখন যার নাম রামমোহন সরণি, তার সংযোগস্থলে। সে-সময়ে আজকের মতো উপেক্ষিত বা মুমূর্ষু নয়, কলকাতায় ছড়ানো করপোরেশন স্কুলগুলির সামান্য হলেও খাতির ছিল। সুকিয়া স্ট্রিটের স্কুলটি বসত বেশ বড়ো বাড়িতে। একতলায় সামনে সারি দিয়ে দোকানঘর, দোতলায় স্কুল, পেছনে পাঁচিলঘেরা মাঠ। কত সুখস্মৃতি ওই মাঠটাকে ঘিরে! দুপুরেই আমাদের ক্লাস বসত। তবে গরমের ছুটির কিছু আগে থেকে মর্নিংস্কুল হতো মাসখানেক। মা দুধছাতু মেখে দিতেন, আমরা সকালের ফুরফুরে হাওয়ায় বেরিয়ে পড়তাম। স্কুলবাড়ির পাশেই ছিল আমাদের এমএ পড়ার যুগের সহপাঠিনী শ্যামলীদের গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ি, তার নিচে সমেন্তাষ বিস্কুট কোম্পানির দোকান, এবং উলটোদিকে তাদের বিস্কুট-পাউরুটি তৈরির কারখানা – পাশ দিয়ে গেলে গরম পাউরুটির চমৎকার গন্ধ বেরোত। দোকানে থাকত নানা জাতের ভাঙা বিস্কুটের একটা বড়ো টিন। আমরা সেখান থেকে দু-পয়সায় বা এক-আনায় ঠোঙা-ভর্তি ভাঙা বিস্কুট কিনে কুটুস-কুটুস করে খেতে-খেতে রাস্তায় হাঁটতাম। আর বৃন্দাবন মল্লিক লেনেই ছিল একটি লজেন্সের কারখানা – সেখান থেকে কিনতাম
লজেন্স-চুর। মিষ্টি গন্ধে ম-ম করতো চারপাশ। স্যার সুখরামবাবু বিস্কুট আর চা খেতেন স্কুলে বসেই। তবে দুপুরের ক্লাসই ছিল নিয়মিত। অনেকটা সময় ধরে আমরা টিফিন পিরিয়ডে খেলতাম। পুজো বা গরমের লম্বা ছুটিতে ঘাস হয়ে যেত বড়ো, প্রায় মাথা ছাড়িয়ে। স্কুল খুললে অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে ছাত্রদের হুটোপুটিতে তা সাফ হয়ে যেত। একবার মনে আছে, ভারতের বিভিন্ন শহরের করপোরেশনের মেয়ররা দেখতে এসেছিলেন কলকাতা করপোরেশনের স্কুলগুলি। যে কয়েকটি মাত্র স্কুল বাছাই করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিল আমাদের স্কুলও। শুনেছি প্রধান শিক্ষক প্রভাস ঘোষের খ্যাতির জন্যই। আমরা ওই ছোটো বয়সেও খুব গর্বিত হয়েছিলাম। তিনি একরকম সাংস্কৃতিক মানসের অধিকারী ছিলেন, লেখালিখিও করতেন, ছোটোদের জন্য একলব্য নামে একটি নাটিকা লিখেছিলেন যা বহু জায়গায় অভিনীত হতো। একটু ব্রাহ্মভাবাপন্ন ছিলেন বলেই বোধহয় তাঁরই ইচ্ছায় সরস্বতী পুজোর সময় প্রতিবছর নতুন মূর্তি না কিনে তিনি তাঁর ঘরের আলমারি থেকে সরস্বতীর একটি ছোটো শ্বেতমূর্তি নামিয়ে ঝেড়েপুছে পূজাস্থানে বসিয়ে দিতেন। পুজো শেষ হলে আবার তা তুলে রাখতেন পরের বছরের জন্য। ছাত্রদের চাঁদা দিতে হয় – কেউ দিত চার আনা, কেউ আট আনা। ফলে ব্যবস্থা হতো সেইরকম। ছাত্ররা দুই সারিতে বসত। চার আনার দল পেত চারটি লুচি, আট আনার দল আটটি। আমাদের কাছে প্রভাস ঘোষের স্কুলে এরকম হতো শুনে বাবা-কাকারা তো হতভম্ব। এ তো একেবারেই তাঁকে মানায় না। তিনি ছিলেন খাঁটি ঔচিত্যবোধের মানুষ।
করপোরেশন স্কুলে থাকতে জীবনে একবারই স্কুল-পালিয়েছিলাম। টিফিনে কয়েকজনের সঙ্গে দলে মিশে বইখাতা ক্লাসরুমে রেখেই আমহার্স্ট স্ট্রিট বা কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট ধরে চলে গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায়। প্রথম অভিজ্ঞতায় ফুটপাথে ও রেলিংয়ে বই ঘুরে-ঘুরে দেখি আর অবাক হই। বইপাড়ার এই পরিবেশ এর আগে কখনো দেখিনি। তাই সময়জ্ঞান ছিল না। স্কুলে ফিরে দেখি ছুটির ঘণ্টা বেজে গেছে, আমাদের বইখাতা জমা পড়ে গেছে হেডমাস্টার মশাইয়ের ঘরে। বাবাকে প্রভাস ঘোষ চিনতেন করপোরেশন স্কুলের সঙ্গে সংস্পর্শের কারণেই। তাছাড়া আমার পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে জড়ানো ছিল পাড়ার ক্লাবে আবৃত্তির কৃতিত্বে পাওয়া পুরস্কৃত একটি বই – যতদূর মনে পড়ে, পরিমল গোস্বামীর ছেলে শতদল গোস্বামীর কবিতার বই রূপকথা। সেটার পাতা খুলে-খুলে তিনি নাকি দেখছিলেন। পরের দিন ছাত্রদের সামনে আমাকে রেহাই দিয়ে, আমি যে অন্য ছেলেদের পালস্নায় পড়ে এই কুকর্ম করেছি এই ফতোয়া দিলেন। ব্যাপারটা অবশ্য একেবারেই সত্য নয়। আমারও অংশগ্রহণ কম ছিল না।
যখন আমি বৃন্দাবন মল্লিক লেনে থাকি এবং করপোরেশন স্কুলে পড়ি, তখনকার কিছু দৃশ্য স্মৃতিতে আছে। স্কুলের পাশেই ‘সমেন্তাষ বিস্কুটে’র দোকান থেকে ভাঙা বিস্কুট, পাড়ার লজেন্সের কারখানা থেকে লজেন্স-চুর, গলিতে হেঁকে যাওয়া ফেরিওয়ালার ডাক, যার অর্থ ও উচ্চারণ আমাদের কাছে সবসময় স্পষ্ট ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর মালদার দাদু একবার এসেছিলেন বৃন্দাবন মল্লিক লেনে। মনে নেই, বোধহয় বড়োমামা বা আর কেউ-কেউ এসেছিলেন সঙ্গে। মহাআনন্দে কেটেছিল দরাজদিল দাদুর সঙ্গে। প্রত্যেকদিন খাবারের ফেরিওয়ালাদের ডেকে তাদের প্রায় সব মাল কিনে নিতেন – তা সে ঘুগনি, শোনপাপড়ি, ফুচকা, কুলফিমালাই, তিলের খাজা, মুড়িমশলা যা-ই হোক। বাড়ির সবাই মিলে হইহই করে খেয়ে ফতুর করে দিত। দাদু ফিরে গেলেও অনেক দিন ধরে তারা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। তিনি চলে গেছেন বললেও মানত না।
খুব ছোটোবেলায় আমার একটা কাজ ছিল, রোজ সকালে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একটি দোকান থেকে পাঁচ আনার মুড়ি কিনে আনা। আমি কিছু পরে অভ্যাস করলাম, চার আনার মুড়ি কিনে বাকি এক আনায় শোনপাপড়ির গুঁড়ো বা মিহিদানা কিনে খেতে-খেতে বাড়ি ফেরা। এতে গভীর একটা ‘পাপবোধ’ হতো আমার। মনে-মনে ভাবতাম, বড়ো হয়ে একটু বেশি ‘পুণ্য’ করে সেই পাপ আমি স্খলন করবো।
এ তো হালকা কথা। পরপর কয়েকটি অভিজ্ঞতা স্বভাবতই আমাকে স্পর্শ করে যায় – ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত বাংলাদেশে পড়ল, বড়োদের গলায় সবসময় শুনি তার কথা। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। বিশেষ করে জাপান যখন জড়িয়ে পড়ল এই বিশ্বযুদ্ধে, তার প্রতিক্রিয়ায় বাংলা বা ভারতের ঘটনাবলি কিশোরেরও কানে আসে। হাতিবাগানে বোমাপড়ার গল্প তখন লোকের মুখে-মুখে। বৃন্দাবন মল্লিক লেনের মোড়ের চৌধুরীবাড়ির চওড়া দেউড়িতে বড়োরা আড্ডায় মুখর হতো হিটলারের প্রশসিত্মতে। আকাশে মাঝে-মাঝেই যুদ্ধবিমানের অস্পষ্ট শব্দ ও ধোঁয়া। আমরা দৌড়ে গিয়ে ঘরে লুকোই। বাড়ির সামনের দুটি ঘরের জানালার সামনে ইট দিয়ে গাঁথা পাঁচিল। জাপানি বিমানের সম্ভাব্য আক্রমণের দুশ্চিমন্তায় সাইরেন বাজলেই ঘরে ঢুকে মার তৈরি খুদে বালিশ মুখে দিয়ে দিই, যাতে ভয়ে জিব না কামড়ে ফেলি। ‘অল ক্লিয়ার’ হলে বাইরে বেরিয়ে উঁকি মারি আকাশে জাপানি বোমারু দেখার আশায়। হৃষীকেশ পার্কে মাটি খুঁড়ে আঁকাবাঁকা ট্রেঞ্চ কিংবা ইটের তৈরি লম্বা আর্চ গড়নের শেলটার। আমাদের এক বন্ধু লাফ দিয়ে ট্রেঞ্চ পার হতে গিয়ে পা ভেঙে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিল। ট্রেঞ্চ ও শেলটার দুটোই অসম্ভব নোংরা হয়ে থাকত। বস্ত্তত সেগুলো পরিণত হয়েছিল ভবঘুরে ও ভিখিরিদের মলমূত্র ত্যাগের জায়গায়। শেলটারের অভ্যন্তরে ঢোকাই যেত না। এরই মধ্যে যুদ্ধশেষে আজাদ হিন্দ ফৌজ আর নেতাজির জয়গান চারদিকে। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ডি-রতনের ফটোর দোকানের ছাদ থেকে আই-এন-এর বন্দিদের মুক্তির দাবিতে যে-মিছিল তাতে দেখি সুভাষচন্দ্র বসুর বিশাল কাট-আউট।
১৯৪৩-এ প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রায় কৈশোরে, যুদ্ধের ভয়ের মধ্যে থাকতে-থাকতেই, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ। রোজ বাড়ির সামনে হাড্ডিসার বাচ্চা নিয়ে গ্রামের মৃতপ্রায় পুরুষ ও নারীর ‘ফ্যান দাও’ চিৎকার। সেই তীক্ষন চিৎকারে পাড়া প্রকম্পিত হতো। চোখ বুজলেই দেখতাম, ত্যানা-পরা শরীর নিয়ে ধুঁকতে-ধুঁকতে চলেছে। দুহাত বাড়িয়ে ভাত-কাপড় কিছু-একটা চাইছে। আশেপাশের রাস্তার মোড়গুলিতে ডাস্টবিনে ও তা থেকে উপচে পড়ে পরিত্যক্ত পচা খাবারের সত্মূপ। তা নিয়ে ভিখিরি ও কুকুরের মারামারি ও কাড়াকাড়ি। কংকালসার মৃতদেহও পড়ে থাকতে দেখা যেত। পরে বড়ো হয়ে জয়নুল আবেদিনের স্কেচ যখন দেখি, রামকিঙ্কর, চিত্তপ্রসাদ ও সোমনাথ হোড়ের, কিংবা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নব জীবনের গান’ শুনি, তখন মনে হয় এ তো আমার চোখে দেখার ও কানে শোনার অতিশয় চেনা অভিজ্ঞতা।
বাড়ির কাছেই মুসলিমপ্রধান রাজাবাজার-অঞ্চলে মহররমের সময় জমায়েত হতো – হজরতের দৌহিত্র হাসান ও হোসেনের স্মরণে শোকপালন। আমরা পার্শিবাগান লেন ঘুরে দেখতে যেতাম। বড়ো-বড়ো নিশান নিয়ে মুসলমানেরা ‘হায় হাসান হায় হোসেন’ বলে বুক চাপড়াতে-চাপড়াতে, মহররমের গান গাইতে-গাইতে মিছিল করত। সঙ্গে থাকত ছোটো-বড়ো তাজ। কখনো-কখনো হাতে খোলা তরবারি, প্রতীকী যে তা খুবই বোঝা যেত। সবই তাদের ঐতিহাসিক যুদ্ধদৃশ্য।
সকালে-দুপুরে মেলাও বসত ফুটপাথে – কিন্তু সেটা বোধহয় সুন্নিদের প্রভাব। কলকাতার মুসলমানেরা অবশ্য শিয়াপন্থীই ছিল। একটু বড়ো হয়ে কলাবাগান বসিত্মর ধারে মেডিক্যাল কলেজের সামনেও সেই শোকমিছিল দেখেছি। একটি পতাকা উঁচু করে ধরে ঘুঙুর পায়ে ছুটতো কয়েকজনের দল, মুসলিম বালক ও তরুণেরা। রক্তাক্ত হয়ে যেত যুবকদের বুক। এসবই
১৯৪৬-এর দাঙ্গার আগের কথা। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ওই মিছিলদৃশ্য দেখতে যেতে পারত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে।
১৯৪৬-এ প্রাইমারির সর্বোচ্চ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই শুরু হলো হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা। আগেই যা সবসময় ধিকিধিকি জ্বলত, তা-ই এবার ভয়ংকর হয়ে উঠল। ওই ক্লাসেই একজন মুসলমান কিশোরের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তার নাম এখনো মনে আছে – শামসুল হক। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি মুসলমান-অধ্যুষিত রাজাবাজার থেকে আসত। ভারী মিষ্টি চেহারা, হাতে প্রায়শই মেহেদি লাগানো থাকত। ১৬ আগস্টের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের পর সেই যে বেপাত্তা হয়ে গেল, তারপর তাকে আর কখনো দেখিনি। দাঙ্গার ব্যাপারে বৃন্দাবন মল্লিক লেনে সে-সময়ে একটা আতঙ্ক বিরাজ করত। তাকে সামাল দেওয়ার জন্য যথারীতি একটা ‘নকল সেনা’র সংগঠনও তৈরি হলো। বাড়িতে-বাড়িতে ইট-পাথর জমা করা হলো ছাদে। মোড়ের কোনো বাড়ি থেকে বিউগল বাজানোর ব্যবস্থাও ছিল। হাতের কাছে রইল দা-কাটারি। অনেক অনেক পরে বিষ্ণু দে-র সন্দ্বীপের চর বইয়ে যখন পড়লাম ‘কঙ্কালীতলা’ কবিতাটি, তার ভেতরের সেই লাইনগুলো – ‘মরিয়া শহরে জাগে মুমূর্ষু বাতাসে/ মরা বাড়ি, মরা পথ,/ কোন নরকের ত্রাসে জেগে থাকে ছাদে ছাদে/ বারাণ্ডায়, জানালায় বিনিদ্র প্রহরে টহলায় পাড়ায় পাড়ায়/ মহলস্নায় ইশারায় ইটে বাঁশে চোরাডাকে নকল সেনার ফিসফাসে/ ভয় আর সন্দেহের জিঘাংসু হৃদয়’ – তখন চোখের সামনে অবিকল ভেসে ওঠে সেই দিনগুলি। দূরাগত ‘আলস্না হো আকবর’ চিৎকার কিংবা নিজেদের পাড়ায় ‘বন্দেমাতরম’-এর মহড়া আমাদের কানে পৌঁছোত। আগেই তো বলেছি, রাজাবাজার এলাকা কাছেই। সার্কুলার রোড পেরিয়ে সায়েন্স কলেজের পাশের পার্শিবাগান লেন ধরে বাদুড়বাগানে পৌঁছোনো যায় সহজে, আর তারই কাছে সমান্তরাল বৃন্দাবন মল্লিক লেন। যে-কোনো সময়ে রাজাবাজার থেকে মুসলমানেরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আক্রমণ শুরু করতে পারে। কাছের রাজাবাজার, একটু দূরের কলাবাগান, মাঝখানের ফেজ বা নূর বা লুঙ্গি চিহ্নিত মানুষের অনেক অচেনা এলাকা, আরো দূরের পার্কসার্কাস – বস্ত্তত সারা কলকাতা জুড়ে মুসলমানদের ছোটো-বড়ো অসংখ্য মহলস্না। অল্প বয়সে বাড়ি থেকে নিষেধ ছিল সেসব জায়গায় যাওয়া। চোরাগোপ্তা ছুরিকাঘাতের সম্ভাবনা প্রবল। একবার পার্শিবাগান লেন থেকে এক যুবককে পেট চেপে ছুটে আসতে দেখেছিলাম রক্তাক্ত দেহে, শরীরের মাংস বেরিয়ে পড়েছে। আমরা সায়েন্স কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে রাজাবাজারের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকতাম। এমনকি দাঙ্গার রেশ যখন কমেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও, সর্বত্র ইচ্ছেমতো হাঁটাহাঁটি করা যেত না। তবে, সেই পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা যে পুরোটা মানতাম তা হয়তো নয়, রাজাবাজার-কলাবাগান প্রভৃতি অঞ্চলের সীমান্ত থেকে কৌতূহলবশত উঁকিঝুঁকি মারতাম। কলকাতার দাঙ্গার অনেক স্মৃতিই মনে ফিরে আসে ঢাকার প্রয়াত গুণী বন্ধু মীজানুর রহমানের কৃষ্ণ ষোলোই বইটি পড়তে-পড়তে।
বড়োকাকুরা তখন পূর্ববঙ্গের লালমনিরহাটে মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকায় প্রবল দারিদ্রে্য দিন কাটাচ্ছেন, মাঝে-মাঝে ওখানেই ছোটো পিসিমার বাড়িতেও গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া পাকিস্তানি হুংকার শোনা যাচ্ছে চারদিকে অবিরল। শুনেছি, আমার বাবা, বাবার মৃত্যুর পর ঠাকুমা ও মেজোকাকু বারবার তাঁদের চলে আসতে বলেছেন, কিন্তু বড়োকাকু কিছুতেই রাজি হননি, কলকাতার সংসারও তো কম সমস্যাসংকুল নয়, হয়তো এই ভেবে।
করপোরেশন স্কুল থেকে ১৯৪৬-এ প্রাথমিক পরীক্ষা পাশ করলাম। পরীক্ষা হলো রানী ভবানী স্কুলে দুদিন ধরে। তখন থেকেই ‘ছাত্রবন্ধু’ নোটবইটির খুব চল হয়েছিল। এরপর আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো সামান্য দূরে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজের গা ঘেঁষে, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে এগিয়ে, বাঁদিকে ঝামাপুকুর লেনের সরু গলিতে অবস্থিত ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে।
বোধহয় সে-স্কুলে পড়ার গোড়ার দিকে, কিংবা করপোরেশন স্কুলে পড়ার শেষের দিকে, আমি যুগান্তরের ‘ছোটোদের পাততাড়ি’র সংগঠন ‘সব পেয়েছির আসরে’র ‘সভ্য’ হয়েছি। সারা পশ্চিমবঙ্গে তার শাখা ছিল। কেন্দ্রীয় বার্ষিক অনুষ্ঠান হতো বড়োদিনে, সাতদিন ধরে, উত্তর কলকাতার শোভাবাজারের রাজবাড়িতে। আমি রোজ যেতাম হেঁটে-হেঁটে – টুকটুক করে বৃন্দাবন মল্লিক লেন থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট, গ্রে স্ট্রিট পার হয়ে রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্ট্রিটে। সেই সরু রাস্তাতেই ছিল শোভাবাজারের রাজবাড়ি দুপাশে। মূল বাড়ির ডানদিকেই গেট, সেখানে পরপর কয়েকটি ছোট সেকেলে কামান এবং ভেতরে বিশাল উঠোন, দোতলায় সারি সারি কুঠুরি। তার পাশেই রাজবাড়ির বড়ো-বড়ো থামওয়ালা নাটমন্দির। এই দুটো জায়গাতেই একসঙ্গে চলত সব পেয়েছির আসর। সারাদিন ধরে কত যে-অনুষ্ঠান হতো তা বলার নয়। আমরা একবার এ-চাতালে আরেকবার ও-মন্দিরে চরকি দিতাম। সবেরই কেন্দ্রে ছিলেন স্বপনবুড়ো, অর্থাৎ অখিল নিয়োগী। হরবোলা এসে নানা জন্তুর ডাক শোনাতেন, পিসি সরকার এসে ম্যাজিক দেখাতেন, স্বপনবুড়ো গল্প বলে মাতিয়ে রাখতেন। দেখতে-দেখতে সময় কেটে যেত। সব শেষ হতে বেশ রাত। আবার সেই আগের পথেই অন্ধকারে দ্রম্নত পায়ে হেঁটে বা কখনো দৌড়ে বাড়ি ফেরা। তবে আমাদের বাড়িতে তা নিয়ে কোনো উদ্বেগ বা নিষেধ ছিল না।
আরো কিছু ছিল। বাড়ির কাছেই রামমোহন লাইব্রেরির ছোটোদের বিভাগে গতায়াত ছিল তখনই। দোতলার অলিন্দ থেকে চেয়ার পেতে ফাংশন হচ্ছে দেখতাম। আর ওখানে ডিটেকটিভ ও রোমাঞ্চ সিরিজের বই পড়তাম বেঞ্চে বসে। পাড়ার কিছু-কিছু বদ ছেলে দেখতাম আলমারির নিচের কাচ-ভাঙা তাকের মধ্যে হাত গলিয়ে বই চুরি করছে।
রামমোহন লাইব্রেরির উলটো দিকে একতলায় ছিল একটি ছোট্ট ঘরের লাইব্রেরি – সনাতন হিন্দু ধর্ম প্রচারের জন্য। কী জানি কেন, ব্রহ্মাচর্য শিক্ষার বই পড়তে আমি একবার কয়েক মাস পরপর গিয়েছিলাম, কোনো পয়সা লাগত না। বাড়িতে এসে সকালে ল্যাঙট পরে ও চিরতার জল পান করে কিছু নির্দেশ পালনও করেছিলাম। পাশেই ছিল প্রখ্যাত ব্যায়ামবিদ বিষ্ণুচরণ ঘোষের আখড়া – সেখানেও উঁকি মারতাম যখন-তখন। কিংবা চলে যেতাম বিষ্টু ঘোষের
শো-এ। সত্যিই রেবা রক্ষিত গায়ের ওপর হাতি চড়ান কিনা দেখতে। আর গড়পারে তেলকলের মাঠে দাদামণির সঙ্গে গিয়ে আরএসএসের কুচকাওয়াজেও যোগ দিয়েছিলাম খাকি হাফপ্যান্ট পরে। তবে সে-সবই বোধহয় দু-চারদিনের ব্যাপার। বাবা-মা দুজনেই দেখে বা শুনে মজা পেতেন।
বাবারও নানারকম অদ্ভুত শখ ছিল। পরিবারের ছেলেদের নামে বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় রহস্য-রোমাঞ্চ বা গোয়েন্দা গল্পের বই ছড়িয়ে রাখতেন, আমাদের চিরকুটের ধারাবাহিক নির্দেশ মেনে আবিষ্কার করতে হতো। যুদ্ধের পরে সেনাবাহিনীর বাড়তি ডিস্পোজালের মাল বেচা হতো খুব সস্তায় – আকর্ষণীয় ছিল বড়ো-বড়ো কৌটো থেকে ডিমের গুঁড়ো নিয়ে বিশাল সাইজের ওমলেট বানানো। বাবার বন্ধুরা বাড়িতে আসতে ভয় পেতেন একই জিনিস এতখানি খেতে হবে বলে। ওগুলো তো বটেই, তাছাড়া যুদ্ধের সময় সৈনিকদের জন্য যেসব প্যাকেট দেওয়া হতো ট্রেঞ্চে, যুদ্ধের পরে তার বেচে-দেওয়া পাহাড়প্রমাণ মাল ঠেলা করে নিয়ে এসেছিলেন বাবা। মা প্রায় রোজ সকালে আমাদের হাতে-হাতে একটা করে প্যাকেট তুলে দিতেন। তাতে থাকত জারিত সামুদ্রিক মাছের কৌটো, কেটে বের করে ভেজে রুটি দিয়ে খাওয়া হতো। খালি কৌটোগুলো সত্মূপ হয়ে জমতো বাড়ির কোণে। আঁশটে মাছের গন্ধে বাড়ি ম-ম করত। আমি অবশ্য ততো খেতে পারতাম না। এছাড়া ছিল চকোলেট, বাদামতক্তি ও আরো নানারকমের খাবার। অন্য প্যাকেটে থাকত নানা মাপ ও ধরনের
সুচ-সুতো-দড়ি-কাঁচি। তামাক ও সিগারেটের কাগজ। সৈনিকদের ট্রেঞ্চে শুয়ে পড়ার জন্য চ্যাপটা সাইজের পকেটবই। আমি স্টেইনবেকের গল্প ওই সাইজের বইতেই বড়ো হয়ে প্রথম পড়েছিলাম। বাবা ওগুলো তখন কিন্তু তুলেই রাখতেন।
এছাড়াও বাবার আরো নানারকমের বাতিক ছিল। মাঝে-মাঝেই শিয়ালদার কোলে মার্কেটে বাজার করতে যেতেন। অনেক সময়েই সঙ্গে থাকতাম আমি। পাইকারি ওজনে ও দরে সবজি কেনা হতো, যেমন বস্তা হিসেবে আলু, গণ্ডা হিসেবে কুমড়ো, ইত্যাদি, তারপর ঠেলায় মালের সঙ্গে আমাকেও চাপিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো। একবার ঠেলাচালক রাস্তায় জলের কলের পাশে গাড়ি থামিয়ে, বস্তা থেকে আম বের করে, অনেকক্ষণ ধরে চেটেপুটে খাচ্ছিল, আমি ঠায় বসেছিলাম ঠেলায়। বলা বাহুল্য, বেজায় রেগে গেছিলাম। বাবাকে এসে নালিশও করেছিলাম। চোরাবাজার থেকে বাবা কত যে বিচিত্র জিনিস কিনতেন, তা দেখে আমরা হাঁ হয়ে যেতাম। নানা সাইজের কাঁটাচামচ, কাঁচি, মোটা-সরু দড়ি ও সুতো, কৌটো ইত্যাদি। চোরাবাজারে এরকম অদ্ভুত জিনিস কেনাকাটা করার শখ আমাতেও বর্তায় বড়ো হয়ে। অনেক সময় বাড়ি ফিরে দেখতাম, দুজন বিহারি যুবক ভেতরের বারান্দায় হাত ছড়িয়ে উবু হয়ে বসে ঢুলছে, তাদের পাশে দুটো বড়ো টিনের ড্রামে ভর্তি ভয়সা ঘি। বাবার কাছে বিক্রি করার জন্য দেশ থেকে এসেছে। বাবা কোথা থেকে এদের জোগাড় করতেন কে জানে!
বাবার কোনো কোনো বন্ধুর কথাও ছাড়া-ছাড়া মনে পড়ে। মহেন্দ্রকাকু আমাদের জন্য বড়ো-বড়ো চকোলেট নিয়ে আসতেন, আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। দিগিন পাঠককে বাবার মৃত্যুর অনেক পরেও দেখতাম। তিনি ছিলেন জ্যোতিষী, ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’র গণক, গ্রে স্ট্রিটে তাঁর চেম্বার ছিল। পরিণত বয়সে কলেজে যাওয়ার পথে দেখা হতো, ওঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ওঁর ভাঙা গলায় দু-একটা বাক্যের পুরোনো গল্প শুনতে ভালো লাগত – কারণ তাতে ‘হিমু’র নাম থাকত। হিমু আমার বাবা হিমাংশুর চলতি নাম।
১৯৪৬-এর বছরব্যাপী দাঙ্গার পর ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের স্বাধীনতা-দিবসের ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজাবাজার এলাকায় একা-একা গিয়ে দেখি আলোকিত উৎসবমুখর আবহে হিন্দু-মুসলমানের অসামান্য মিলনদৃশ্য। হিন্দু মুসলমানকে এবং মুসলমান হিন্দুকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করছে, আর উভয় সম্প্রদায়ই যে একই মায়ের সমন্তান তা আবেগ ভরে জানাচ্ছে সকলকে। আমি কখনো কাঁদি না, কিন্তু দেখতে-দেখতে আমার চোখেও জল এসে যাচ্ছিল। রুদ্ধশ্বাস দৌড়ে বাড়ির দিকে ছুটলাম, বাড়িতে ফিরে পরিবারের সকলকে এই অভিজ্ঞতা জানিয়ে তবে শান্তি। বাবা-কাকারা তখনো বাইরে, ফিরে তাঁরাও বলছিলেন সারা কলকাতার কথা। পরদিন স্বাধীনতা-দিবস। মাছের জমানো খালি কৌটোগুলো মাটি দিয়ে ভরে কঞ্চি দিয়ে কাগজের ছোটো জাতীয় পতাকা কোনাকুনি জুড়ে বাড়ির কার্নিশে সারি দিয়ে সাজানো হলো, মেজোকাকার উদ্যোগে। কাপড়ের পতাকা ওড়ানো হলো ছাদে। রাস্তায়, মোড়ে-মোড়ে, বাসে-ট্রেনে-ট্রামে উপচোনো ভিড়। বাড়িতে অবশ্য দাদামণির গলায় কালো-পতাকাবাহীদের সমর্থনে সেস্নাগান ‘এ আজাদি ঝুঁটা হ্যায়!’ – তা-ও চলতো আড়ালে। আমরা ছোটোরা কিন্তু বাবা-কাকাকে ঘিরে উৎসাহে চঞ্চল। স্বদেশি চেতনায় প্রাণবন্ত। সকাল থেকেই পাড়ায়-পাড়ায় প্রভাতফেরি। আমরাও কদিন ধরে রিহার্সাল দিয়েছি বড়োদের নির্দেশে। তারপর ১৫ আগস্টে প্রায় রাত থাকতে সাদা জামাজুতো আর কেডস পরে কলকল করে জমা হয়েছি হৃষীকেশ পার্কে। মিছিলের পথে দেশাত্মবোধক গান,
রবীন্দ্র-নজরুলের গান, নতুন স্বাধীনতার গান আমাদের মুখে একের পর এক। ‘স্বাধীন ভারতে জাগে নবীন’। আর শহরের রাস্তায় মানুষ কখনো হেঁটে কিংবা
ট্রামে-বাসে-লরিতে চড়ে উচ্ছ্বসিত ও উলস্নসিত।
ওই বছরই, অর্থাৎ ১৯৪৭-এ ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণিতে। ভর্তি হওয়ার দিনটিতেই একটি ব্যাপার আমাকে খুব আহত করেছিল। ঝামাপুকুর লেনের ওই জীর্ণ বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে যে-টিনের বোর্ডটি ঝোলানো ছিল, যাতে স্কুলের নাম থাকার কথা, সেটা একেবারে মাজাঘষা, একটি অক্ষরও পড়া যায় না, রোদেজলে ধুয়েমুছে গেছে। এ নিয়ে দীর্ঘকাল সমবয়সী অন্য স্কুলের ছেলেরা আমাদের ঠাট্টাতামাশা করত, আমাদের কিছু বলার থাকত না। শুধু তা-ই নয়, বড়োদের মধ্যেও দেখতাম আমাদের স্কুলের অসিত্মত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা। কেউ-কেউ অর্ধসমাপ্ত বাক্যে জানতে চাইতেন, এটা কি ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলের …। বলতে চাইতেন ওই বিখ্যাত স্কুলটিরই ছেলেদের বিভাগ কিনা। মাথা নিচু করে মৃদু ভঙ্গিতে সায় দিতাম, হয়তো বলেও ফেলতাম, ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলই তো আমাদের স্কুলের মেয়েদের বিভাগ। যদিও পরে জেনেছি, কোনো সম্পর্কই নেই এই দুই স্কুলের মধ্যে। কিন্তু তখনো
উক্তি-প্রত্যুক্তিতে সেটা ফাঁস করার কথা ভাবিনি। ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল সায়েন্স কলেজের ঠিক উলটো দিকে, আপার সার্কুলার রোডের সুদৃশ্য বাড়িতে, নানা দিক থেকেই নামী স্কুল – আমরা তার গৌরবে আলোকিত হওয়ার আশাই করেছি। তবে গৌরাবান্বিত হওয়ার অন্য একটি প্রসঙ্গ আমাদের কিন্তু বানাতে হতো না। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ তখনই শিক্ষিত মানুষের মধ্যে সম্মানিত নাম। আমরা আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসু প্রবীণকে জানিয়ে দিতাম, তিনি আমাদের স্কুলের প্রথম বছরের ছাত্র, এবং এখন পরিচালন-সমিতির সভাপতি। তা শুনিয়ে খানিকটা খাতির পাওয়ার চেষ্টাই ছিল বোধহয়। এছাড়া অন্তত সে-সময়ে, স্কুল নিয়ে জাঁক করার মতো প্রায় কিছুই ছিল না। চুন-খসা দেয়াল, সরু করিডর, ঘেঁষাঘেঁষি অন্ধকার ক্লাসঘর, রেজাল্টও তেমন কিছু ভালো হতো না। তখন ম্যাট্রিকুলেশন বা স্কুলফাইনালে প্রথম বিভাগে পাশ করাটা এতো মুড়িমুড়কির মতো ছিল না। আমাদের স্কুলে সেরকম কিছু ঘটলে কৃতী জ্যেষ্ঠদের আমরা ভিড় করে দেখতে যেতাম হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে। স্কুল ছুটিও হয়ে যেত সেদিন।
উঁচু ক্লাসে উঠে, এবং পরেও, আমি অনেক সময়ই চিমন্তা করতাম, বাবা কেন এই অজ্ঞাতপরিচয় ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলেই বিনাদ্বিধায় ভর্তি করিয়েছিলেন আমাকে। আমাদের তখনকার বাড়ির আশেপাশে আরো অনেক স্কুল ছিল, কোনো-কোনোটা ভৌগোলিক দূরত্বে আরো কাছে, এবং সে-যুগে সে-সব স্কুলে ভর্তি করানোটা ততো সমস্যারও ছিল না। কোনোদিন তাঁকে বা কাউকেই জিজ্ঞাসা করিনি, কিন্তু মনে মনে পুষে রেখেছি প্রশ্নটা, বোধহয় জবাব পেয়েছি পরে – যত দিন গেছে আমাদের হেডমাস্টারমশাইয়ের ব্যক্তিত্ব বা ইমেজ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছি ততই। তিনি আমাদের কোনো ক্লাস নিতেন না, কিন্তু মাঝে-মাঝেই স্কুল বসার আগে প্রার্থনা-সংগীতের পর ছাত্রদের উদ্দেশে কিছু বলতেন। সবসময়ই জানা থাকত, স্কুলে ঢুকতেই বাঁদিকের ঘরে সম্ভ্রান্ত নীরবতায় তিনি বিরাজ করছেন। কখনো ছাত্রদের কোনো গোলমাল হলে তীব্র বেদনায় ধিক্কার দিতেন। তাঁর জীবনের বা জীবনাচরণের সংবাদও কীভাবে যেন পৌঁছে যেত আমাদের মধ্যে। তখনই বুঝতাম, তখনকার অসম্পূর্ণ বোধেই বুঝতাম, এই স্কুলের সঙ্গে এই মানুষটির জীবন-নিহিত আদর্শবাদ কীভাবে মিশে আছে। আর তার ফলেই বোধহয় আবিষ্কার ঘটেছিল, যে-আদর্শবাদে আমার বাবা-কাকারা সেই পরাধীন দেশে নানা রাজনৈতিক বা সামাজিক সচেতনতায় ও সক্রিয়তায় লিপ্ত ছিলেন, তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিল এই স্কুলটির নির্বাচন। অথচ বাবারা ব্রাহ্ম ছিলেন না, বরং অনুশীলন পার্টি থেকে শুরু করে সে-যুগের গান্ধীবাদেই বিচরণ করেছেন – তখনো দেখেছি ব্রাহ্মসমাজ বা ব্রাহ্ম-আন্দোলনের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে এক ধরনের শ্রদ্ধা পারিবারিক আলোচনায় প্রায়শই প্রকাশ পাচ্ছে। হেডমাস্টারমশাই যে আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন তা আমি পরে জেনেছি। কিংবা তিনি যে সিটি কলেজের পদার্থবিদ্যার পঠনপাঠনের সঙ্গেও যুক্ত, সেই তথ্য আমাদের অহংকারী করেছে উঁচু ক্লাসে উঠে।
স্কুলে ভর্তি হয়ে আরো একটি ব্যাপার আমাকে হকচকিত করেছিল, এবং তা হচ্ছে রুটিনে আমাদের কোনো টিফিনের সময় নেই। স্কুলের কোনো মাঠ ছিল না, এমনকি উঠোনও নয়, কিন্তু তাই বলে টিফিনের ফাঁক থাকবে না? মনমরা হয়ে থাকতাম। সব বন্ধুর স্কুলেই টিফিনের ছুটি আছে, ফুর্তি আছে, আমাদের নেই। কেন নেই তা নিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করেছি বলেও মনে হয় না।
অনেককাল পরে এই সমস্যার নিসরন হয়। আমাদের পাড়ায় সে-সময়ে একজন পক্বকেশ বৃদ্ধ থাকতেন – রিপন কলেজের (এখন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের) ইংরেজির অধ্যাপক বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনোদবাবুর দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে – তিনি একা-একা বসে থাকতেন তাঁর বৈঠকখানায়, আমাদের ছোটোদের খুব প্রশ্রয় ছিল তাঁর কাছে। নানা গল্প করতেন। বিনোদবাবু অবসর-সময়ে আত্মস্মৃতি লিখেছেন কয়েক খ– – তাঁর জীবনের অতিতুচ্ছ ঘটনা ও বিষয় নিয়ে – ছাপিয়েছেন নিজের খরচে। বইয়ের শেষে জানিয়েও দিয়েছেন, এসব যে প্রকাশযোগ্য নয় তা তিনি বিলক্ষণ জানেন, কিন্তু তাঁর বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন পড়বে বলে নিজের পয়সায় ছাপিয়েছেন, কার কী বলার আছে?
বিনোদবাবুর বইটা বন্ধুত্বের খাতিরে কম পয়সায় ছাপিয়ে দিয়েছিলেন বৃন্দাবন মল্লিক লেনেরই পড়শি কালীকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাড়ির নিচে তাঁরই নিজস্ব ছাপাখানায়। কে কে ব্যানার্জির প্রোব্যাব্ল্ এসেজ তখনই বহুখ্যাত ও বহুবিক্রীত নোটবই ছিল। কালীবাবু রোজ সকালে জানালার ধারে বসতেন। কোনো ভিখিরিকে ফেরাতেন না। দেশলাইয়ের খালি বাক্সে তখনকার এক পয়সা, অর্থাৎ ফুটো পয়সা জমানো থাকত। কোনো ভিখিরি এসে দাঁড়ালেই উনি কথা না বলে একটি মুদ্রা বের করে দিতেন। মনে রাখতে হবে, তখন ঘোর দুর্ভিক্ষের সময়।
বিনোদবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের কথা অবশ্য সে-সময়ে জানতাম না। অনেক অনেক পরে প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিংয়ে ওই বইয়ের একটা খ- আবিষ্কার করি (পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ গ্রন্থাগার থেকে নিয়ে বাকিগুলোও পড়েছিলাম)। তাতে চোখে পড়ল, বিনোদবাবু লিখেছেন, কলকাতার দাঙ্গার দিনগুলোতে ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলের দুটি ছাত্র টিফিনের সময় বাড়িতে খেতে যেতে গিয়ে কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে ছুরিকাহত হয়ে মারা যায়। সঙ্গে-সঙ্গে যেন উন্মোচিত হলো এতদিনকার রহস্য। আরো পরে স্কুলের একসময়ের শিক্ষক স্বনামধন্য মণীন্দ্রকুমার ঘোষের কাছ থেকে সমর্থনও পেয়েছিলাম – হ্যাঁ, সেই ঘটনার পরিণামেই আমাদের স্কুলের টিফিনের ছুটি বন্ধ হয়ে যায় – কেউ যাতে ওই সময়ে স্কুলের বাইরে, বিশেষত কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিট বা মির্জাপুর স্ট্রিট ধরে দাঙ্গা-অধ্যুষিত রাজাবাজার বা কলাবাগানের দিকে না যেতে পারে। আমি যতদিন স্কুলে পড়েছি, সেই ১৯৫২-৫৩ পর্যন্ত, টিফিন-বন্ধ অব্যাহত ছিল। কবে আবার তা চালু হলো জানি না। এর ফলে একটা ঘটনা ঘটত, আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে যেত অন্যদের থেকে একটু আগে। বিকেল নামলেই আমরা যখন বাড়ি ফিরতাম, তখনো বেশ রোদ, আমরা গরমের দিনে সেই পিচ-গলা রাস্তায় জুতো থেকে পিচ ছাড়িয়ে-ছাড়িয়ে বাড়ি ফিরতাম, আশেপাশের আর কোনো স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখতে পেতাম না। তখনো অবশ্য ইউনিফর্ম চালু হয়নি। চোখে দেখে স্কুলের ছাত্র বলে টের পাওয়া যেত না সবসময়।
এই ‘টিফিন’ না-থাকাটা যে খুব ভালো হয়েছে স্কুলের পক্ষে তা মোটেই নয়। এতক্ষণ ধরে ক্লাসঘরে আটকে থাকার ফলে মাঝে-মাঝে ছাত্ররা কোনো ছুতো পেলেই অস্থির হয়ে পড়ত, ফেটে পড়তে চাইতো। এমনিতে ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলের ডিসিপ্লিনের খুব নাম ছিল, হেডমাস্টারমশাই সে-ব্যাপারে খুব সতর্ক ছিলেন। কিন্তু প্রায়ই দেখা যেত, কোনো কারণে একটি ক্লাসে হলস্না হলে তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অন্য ক্লাসে। একবার, মনে আছে, কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় দুধ দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল ক্লাসে-ক্লাসে। অনেক সময় তখন শিক্ষকেরা ছাত্র-মনিটরের ওপর বণ্টনের ভার দিয়ে টিচার্স-রুমে ঘুরে আসতেন। একদিন কোনো ক্লাসে শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে মুহূর্তের মধ্যে সেই দুধ মেঝেতে ঢেলে দক্ষযজ্ঞ বাধিয়েছিল ছাত্ররা – তার জন্য শাসিত্মও পেতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড়ো মুক্তি, দোতলায় যে-নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ভাঙা ছাদে ওঠা ছিল একান্তভাবে নিষিদ্ধ, তা লঙ্ঘন করা। হেডমাস্টারমশাইয়ের কানে পৌঁছোলে দোষীদের ডাকা হতো তাঁর ঘরে। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তারা যেত। তিনি মাঝে-মাঝেই বেতটা হাতে নিয়ে আস্ফালন করতেন, কিন্তু কারো ওপর ব্যবহার করতেন কদাচিৎ। তাঁর সবচেয়ে মোক্ষম শাসিত্ম ছিল – ডান-কানটা ধরে বাঁ-গালে এবং বাঁ-কানটা ধরে ডান-গালে আলতো করে চড় মারা, এবং সে-সময়ে তাঁর জিভটা সরু হয়ে ঈষৎ বেরিয়ে আসত। এতে কারোরই কষ্ট পাওয়ার কথা নয় – কিন্তু হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে অপরাধী হিসেবে যাওয়াটাই ছিল আতঙ্কের।
এমনিতে হেডমাস্টারমশাই যতীশচন্দ্র সেন ছিলেন গম্ভীর রাশভারী মানুষ – কিন্তু দূরত্বের এই ভাবমূর্তিটাই ছিল – তাঁকে শেষপর্যন্ত কঠোর হতে দেখিনি কখনো। বুঝতে দিতেন না, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ছাত্রদের প্রতি যে চাপা বাৎসল্য আছে তা টের পাওয়া যেত, যখন আমরা অনেক সাহস সঞ্চয় করে হাজির হতাম কোনো আর্জি নিয়ে। কোনো ছাত্র হয়ত পাড়ার ক্লাবের স্পোর্টসে অনেকগুলো পদক পেয়েছে, সহপাঠীরা তাকে নিয়ে, পদকগুলি ট্রেতে সাজিয়ে, ইতস্তত করতে-করতে ঢুকল তাঁর ঘরে। সব শুনে ঈষৎ মুচকি হেসে তিনি ছুটি দিয়ে দিতেন সেই ক্লাসকে।
যতীশচন্দ্র সেন যে একজন আদর্শনিষ্ঠ মানুষ তা আমরা কারো কথায় নয়, কী করে যেন অনুভব করতাম নিজেরাই। তবে এখন তাঁর ছেলেমেয়ের লেখা ছোট্ট জীবনী বইতে যে-বিবরণ পেয়েছি তার অনেক কিছুই, বলা বাহুল্য, জানতাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র, ব্রাহ্ম যুব সমিতির সংগঠক, সাংবাদিক ও প্রকাশনা-সম্পাদক যতীশচন্দ্রের নানামুখী পরিচয় – বিশেষ করে তাঁর সবচেয়ে বড়ো আত্মত্যাগ, স্কুলের ঘোর দারিদ্রে্যর সময় বিনা বেতনে যেভাবে হোক তাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া – এসব অনেক তথ্যই আমাদের অজ্ঞাত ছিল। আমরা খুবই জানতাম, আমাদের স্কুল বড়োই অসচ্ছল, শিক্ষকেরা কম বেতনে পড়ান, বাড়িঘর মেরামত করার বা রং করার পয়সা থাকে না – তাই তো এই অনুজ্জ্বল নিরানন্দ পরিবেশ। যে ছেলেরা পড়তে আসত তারা অনেকেই বেশ হীনম্মন্যতায় জর্জর ও নিষ্প্রভ। অনেকেরই মাইনে বাকি পড়ত। স্কুলের প্রথম পিরিয়ডে বেয়ারা একটা মোটা খাতা নিয়ে আসতো, তা থেকে যাদের মাইনে বেশি বাকি পড়েছে, ক্লাস-টিচার তাদের নাম ডাকতেন। যাদের খুবই বেশি বাকি তাদের শাসিত্ম দেওয়াও হতো – স্যারের পাশে বা বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে। স্কুলের কোনো অনুষ্ঠান বলতে যা বোঝায় তা প্রায় কিছুই ছিল না। বোধহয় সামর্থ্যই ছিল না। এমনকি বার্ষিক পরীক্ষার ফল অনুসারে প্রথমে কোনো প্রাইজের ব্যবস্থাও দেখিনি। ভর্তি হওয়ার দু-এক বছর পরে অবশ্য তা চালু হলো। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান নয় – পুরস্কৃত হবে যে-ছাত্র তাকে আগেই জানাতে বলা হতো, এই তার বরাদ্দ এবং কী বই তার চাই। নির্দিষ্ট দিনে হেডমাস্টারমশাই এক-একটা ক্লাসে আসতেন, সঙ্গে বেয়ারা বই বয়ে নিয়ে আসত। তিনি সংক্ষেপে ছাত্রদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে চলে যেতেন, আবার ক্লাস চলতে থাকতো। এর সঙ্গে আরেকটা নিয়ম ছিল : কোনো ছাত্র যদি স্কুল ছেড়ে চলে যায়, তবে আর তাকে প্রাইজ দেওয়া হবে না – প্রাইজ পাবে পরের জন। উঁচু ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করে যারা উঠত, তাদের মধ্যে অন্য নামী স্কুলে চলে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যেত প্রতিবছর – কেউ সরকারি হিন্দু স্কুলে বা হেয়ারে, কেউ বেসরকারি মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর বা মেইন ব্রাঞ্চে। আমাদের কোনো এক বছরে ফার্স্ট ও সেকেন্ড বয় অন্য স্কুলে চলে যাওয়ায় থার্ড বয় পেয়েছিল প্রথম হওয়ার পুরস্কার, এবং তা নিয়ে হেডমাস্টারমশাই ঘর ছাড়ার পরই ক্লাস-টিচার প্রকাশ্যে তাকে গঞ্জনা দিতেও ছাড়েননি। এই সুবাদেই একবার আমি নিয়েছিলাম নেহেরুর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া ও গিস্নম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্টরির বঙ্গানুবাদ। ওই সন্দিগ্ধ শিক্ষকই আবার জানতে চেয়েছিলেন কাকু পড়বেন বলেই এটা বাছা হয়েছে কিনা। মেজোকাকু অবশ্য সত্যিই নেহেরু-ভক্ত ছিলেন।
শেষের দিকে ছিলেন অবশ্য আমাদের পরিচিত কেষ্টিদা, এতদিনে জানলাম তাঁর আসল নাম কৃষ্ণপদ সেনগুপ্ত, গেমস-টিচার হয়ে আসার পর স্কুলে খেলাধুলোর দিকেও নজর পড়েছিল। স্কুলের বিখ্যাত ছাত্র আন্দ্রে বেতেইয়ের দাদা নীলু বেতেই খেলোয়াড় হিসেবে নাম করেছিলেন, সেই সঙ্গে চোখ পড়েছিল স্কুলের ক্রীড়া বিভাগের দিকেও।
এতক্ষণ স্কুল নিয়ে যে-কথাবার্তা হলো তাতে কারো মনে হতেই পারে, আমাদের স্কুল নিয়ে ভালোলাগার কি কিছুই ছিল না? ভালোর চেয়ে মন্দেরই প্রাধান্য? তাই কি? স্কুল সম্পর্কে আজো যে-অনুভব তাতে তো কই সেই টানটা একটুও কমেছে বলে মনে হয় না। অনেক কিছুই আমাদের ছিল না, দারিদ্র্য ও মালিন্য আমাদের ও স্কুলের গায়ে জড়ানো। তবু তো আমাদেরই স্কুল! ছ-বছরের সহবাস কি সেই অনুরক্তি দেয়নি? দরিদ্রেরও তো অহমিকা থাকে, নিজের চেনা সংসারের জন্য আসক্তি থাকে, আমাদেরও ছিল। এখনো মনে হয়, স্কুলের সর্বজনপ্রিয় দারোয়ান রামদেও লোকান্তর থেকে উঠে এসে নির্ভুল বলে দেবে প্রায় প্রতিটি ছাত্রের ঠিকানা, তার অতীত ও বর্তমান। তবে শুধু অগতির গতি নয়, ভেবে দেখেছি ওই ছ-বছরের সহপাঠী বন্ধুদের ও প্রণম্য শিক্ষকদের স্মৃতি তাদের নিজস্বতাতেই সুখের। বন্ধুরা আজ সকলেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, দু-একজন ছাড়া কারোর সঙ্গেই দেখা হয় না, তবু খবর অনেকেরই রাখি – তারা কেউ-কেউ কৃতী, প্রতিষ্ঠিত ও অবসরপ্রাপ্ত। আর শিক্ষকেরা প্রায় সবাই প্রয়াত। তবু তাঁদের অনুধ্যান এখনো আলোড়িত করে, এখনো তাঁরা অবিস্মরণীয় হয়েই থাকেন।
যেসব শিক্ষকের কাছে আমরা পড়েছি, তাঁরা সবাই যে খুব ‘আদর্শ শিক্ষক’ ছিলেন তা হয়তো নয়। কিন্তু বয়সের সবচেয়ে উন্মুখ সময়টিতে তাঁদের আচার-আচরণ, তাঁদের অভ্যাস, তাঁদের পড়ানোর ভঙ্গি এবং সবচেয়ে বেশি, তাঁদের কারো-কারো ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্পর্শ এমন একটা অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছিল, যা স্থায়ী দাগ রেখে গেছে। আমরা কিছুটা বুঝতে পারতাম হয়ত, আমি আমার শিক্ষক-পিতার অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতাম, সে-সময়ে শিক্ষকতাবৃত্তি অর্থোপার্জনের দিক থেকে মোটেই ঈর্ষণীয় ছিল না – তবু কারো-কারো ক্ষেত্রে অন্তত এই পেশা নিরুপায় সংস্থান মাত্র নয়, স্বেচ্ছানুবর্তী আদর্শের ছোঁয়াও থাকতো তাতে। আর্থিক ক্লেশ ও অসহায়তা যে শিক্ষকদের অনেককেই গ্রাস করে থাকত তার হদিস ছিল তাঁদের পোশাক-আশাকে, এমনকি উড়ো কথাবার্তাতেও। অনেকেই আর্থিক দায়িত্ব সামাল দিতে টিউশনি করতেন বা কোচিং-ক্লাস নিতেন, কখনো স্কুলবাড়ির মধ্যেই ছুটির পরে। এবং আজকের উন্নত বেতন-কাঠামোর যুগে টিউশনি বা কোচিং-সংক্রান্ত সাম্প্রতিক বিধিনিষেধ যে কোনোভাবেই বাস্তব হতে পারত না সে-যুগে, তা বুঝতে কঠোর নিয়মতান্ত্রিকেরও অসুবিধা হবে না।
সংস্কৃতের প–তমশাই স্কুলফাইনাল পরীক্ষার কয়েক মাস আগে থেকে যে কোচিং-ক্লাস নিতেন, তার জন্য মাসে দেয় ছিল মাত্র পাঁচ টাকা এবং আমরা ক্লাসের সবাই প্রায় তাঁর ছাত্র ছিলাম। মাসকাবারির পর একদিন স্কুল থেকে বেরিয়েই দেখি শীর্ণকায় প–তমশাই স্কুলবাড়ির পাশেই যে ছোট্ট মিষ্টির দোকানটি ছিল তার ভেতরের অন্ধকার কোণে বসে গোগ্রাসে রসগোলস্না খাচ্ছেন – সেই করুণ দৃশ্যটি আজো ভুলিনি।
মণিবাবু ইতিহাস পড়াতেন। খুব চড়া মেজাজের মানুষ। তাঁর পড়ানোর পদ্ধতি ছিল এরকম : প্রতিদিনকার পড়া বই থেকেই খাতায় লিখে আনতে হবে। কী লেখা হচ্ছে সেটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়, লিখে আনতে হবে সেটাই আসল কথা। মনিটর খাতাগুলো টেবিলে সত্মূপ করে রাখত। মণিবাবু এরপর একেকজনকে পড়া বলতে বলে চোখ বুজে থাকতেন, সে গড়গড় করে কিছু-একটা বলে যেত, মণিবাবু মাঝে-মাঝে হাঁকতেন – ‘নেক্সট’। এরপর বেয়ারা ডাব ও পান নিয়ে আসত। মণিবাবু ধীরেসুস্থে ডাবের জল খেয়ে পান মুখে দিয়ে দ্রম্নততম বেগে জমা খাতাগুলোতে সামান্যও না তাকিয়ে সই করে দিতেন।
প্রত্যেক স্কুলেই একেকজন মাস্টারমশাই থাকেন, যাঁর সঙ্গে ছাত্রদের হুটোপাটির সম্পর্ক। আমাদের স্কুলে সেরকম ছিলেন ভূগোলের বারীনবাবু। বারীনবাবু গোটানো ম্যাপ নিয়ে তাড়া করছেন, আর কোনো ছাত্র বেঞ্চ টপকে-টপকে পালাচ্ছে – এ তো আমাদের স্কুলজীবনের রিলিফ। বারীনবাবু কিন্তু ছাত্রদের ভালোবেসেই পড়াতেন।
কমলাকান্ত ঘোষ কিছুদিনের জন্য বাংলা পড়াতে এসেছিলেন, একটু নাকউঁচু মানুষ। একদিন তাঁর হাতে দেখি তাঁরই লেখা উপন্যাস জনক জননী জননী। গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠেছিল। দিগিনবাবু, পরে যিনি স্কুলের হেডমাস্টার হন, তিনিও বাংলা পড়িয়েছেন আমাদের। একটু অন্যমনস্ক, পড়াতেন ভারী গলায়, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে।
অংকের মাস্টারমশাই জিতেন চক্রবর্তী ছিলেন স্কুলের শেষ পর্যায়ের ক্লাস-টিচার। খুব উদ্দীপ্ত হয়ে পড়াতেন। প্রায়ই কয়েকজনকে টেনে নিয়ে যেতেন তাঁর পার্কসার্কাসের ভাড়াবাড়িতে। কোচিং-ক্লাস নয়, তিনি চাইতেন ভালো ছেলেরা আরো ভালো রেজাল্ট করুক। পড়া থামিয়ে বারবার বলতেন, অবাঙালিরা কলকাতা দখল করে নিচ্ছে – আমরা যেন ভালো রেজাল্ট করে, কেউকেটা হয়ে কলকাতার মুখ উজ্জ্বল করি, বাড়িগুলো আবার উদ্ধার করি। জিতেনবাবু ক্লাস টেনে টেস্টের পর আমার প্রোগ্রেস-রিপোর্টে মন্তব্যের জায়গায় লিখে দিয়েছিলেন ইংরেজিতে : ‘মে ট্রাই ফর এ স্কলারশিপ’। আমি কথা রাখায় তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
ইংরেজি পড়ার তখন খুব দাপট, স্কুলফাইনালে পরীক্ষা দিতে হতো আড়াইশো নম্বরে। দীনতারণবাবু – দীনতারণ চক্রবর্তীর ছিল ইংরেজি পড়ানোতে প্রধান ভূমিকা। তিনিও স্কুলেই কোচিং-ক্লাস নিতেন, এবং সেটা ছিল সবচেয়ে জমজমাট। উঁচু ক্লাসে যখন পড়ি, পিতৃবিয়োগের পর সাংসারিক দারিদ্রে্যর কথা স্কুলের প্রায় সকলেরই জানা, কোনো মাস্টারমশাইয়ের কাছে গিয়ে সবেতন পড়ার চিমন্তা তো অকল্পনীয়। দীনতারণবাবু একদিন আলাদা ডেকে নিয়ে বললেন, তুই ইচ্ছে হলে আমার কোচিংয়ে পড়তে আসিস। অর্থাৎ বিনাবেতনে। দীনতারণবাবু খুব ভালোবেসে ইংরেজি পড়াতেন। আমাদের সে-বয়সেও বোঝাতেন ইংরেজি ব্যাকরণের কূটকচালি। কোনো একটি বাক্য ‘অ্যানালিসিস’ করতে গেলে বৈয়াকরণিক বেইনের কী মত এবং আধুনিক বৈয়াকরণিকদেরই বা কী মত! আমরা সেই ‘জ্ঞান’ নিয়ে অন্য স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে চালিয়াতি করতাম। দেশভাগের কিছু পরে আমার এক খুড়তুতো ভাই উদ্বাস্ত্ত হয়ে কলকাতায় আমাদের বাড়িতে উঠেছে, ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলেই ভর্তি হয়েছে। একদিন দীনতারণবাবুর কাছে মিনমিন করে আর্জি জানালাম সে-ও যদি বিনাবেতনে পড়তে পায় তাঁর কোচিংয়ে। তখন কোচিংয়ে বেশ ভিড়। তবু তিনি প্রায় গর্জন করে বললেন, নিশ্চয়ই, আসতে বলবি তোর ভাইকে। শুনে বড়োকাকিমা কেঁদে ফেলেছিলেন বাড়িতে। ফাইনাল পরীক্ষার দিনকয়েক আগে দেখা করতে গেছি তাঁর সঙ্গে। এটাও তাঁর মনে পড়লো, আমার কোনো ঘড়ির জোগাড় আছে কিনা পরীক্ষার দিনগুলির জন্য। নেতিবাচক উত্তর শুনে নিজের হাতের আমপাড়া ভারী বড়ো হাতঘড়িটা দিয়ে বললেন, পরীক্ষা শেষ হলে দিয়ে যাবি।
ক্লাস টেনে পড়তে-পড়তেই খবর এলো, বরিশালে বিখ্যাত ব্রজমোহন স্কুলের শিক্ষক সুরেন কর দেশ ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন, আমাদের স্কুলে ইংরেজি পড়াবেন। বিএম স্কুলের নাম শুনেছি, আমরা সাগ্রহে অপেক্ষা করছি তাঁর জন্য। দেখেশুনে অবশ্য একটু হতাশই হলাম গোড়ায়। সুরেনবাবু খুব শান্ত, নিশ্চিন্ত, প্রায় নির্বাক। বোধহয় একটু বিষণ্ণও। তাঁর সবচেয়ে উৎসাহ ছিল ছাত্রদের লেখা সংশোধন করে দেওয়া। যারা প্রশ্নোত্তর লিখে স্বেচ্ছায় তাঁর কাছে জমা দিত, তাদের তা ফেরত পেতে একটুও দেরি হতো না। সেই সংশোধন-জর্জর লেখায়, দেখা যেত, বহু অংশ তিনি কেটেছেন আর বহু অংশ জুড়েছেন। মার্জিনে অতি যত্নে তা লিখে দিয়েছেন ছোটো অক্ষরে সুন্দর হাতের লেখায়। দীনতারণবাবু ও সুরেনবাবুর প্রণোদনাতেই কোনো-কোনো ছাত্র ইংরেজি পড়ায় উৎসাহী হয়ে উঠত। এমনকি নেসফিল্ডের গ্রামারের খুদে অক্ষরওয়ালা মোটা বইটিও হতে পারত আনন্দপাঠের উৎস। তখনো ইংরেজি পড়া বা লেখার সঙ্গে ইংরেজিকে শিক্ষার মাধ্যম ভাবার ব্যাপারটা গুলিয়ে যায়নি।
এসব এখন অতীত কাহিনি। সারা কলকাতা জুড়ে বেসরকারি এবং আপাদমস্তক বাংলা স্কুলগুলির আজ বড়োই দুর্দশা। ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলগুলির প্রলোভন ও পরাক্রমে কলুষিত আমাদের শিক্ষার আবহাওয়া – যে-শিক্ষায়, রবীন্দ্রনাথ কত আগে টের পেয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের ইতিহাস, আমাদের স্বজাতির হৃদয় অস্পষ্ট।’ চেয়েছিলেন তিনি, আমাদের বিদ্যালয় হোক ‘এদেশি প্রতিরূপ’ – ‘বাঙালি জাতির প্রাণের সঙ্গে বিদ্যালয়ের প্রাণের যোগ।’ আমার কেন যেন মনে হয়, শত দুর্বলতা ও দৈন্য সত্ত্বেও, দেশের প্রতিরূপ হিসেবে সেই যোগটা একেবারে অদৃশ্য ছিল না ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলের মতোই সে-সময়ের আরো অনেক আপাতভাবে মস্নান ও বিবর্ণ স্কুলগুলিতে।
বৃন্দাবন মল্লিক লেনে থাকার সময়কার কিছু বিচ্ছিন্ন স্মৃতি এখন ভেসে ওঠে এক-এক সময়ে। পাড়াতেই এক স্নেহপ্রবণ ডাক্তারবাবু ছিলেন – নাম মনে নেই – আমাদের খুব ভালোবাসতেন। খুব ভোরে, প্রায় অন্ধকার থাকতেই, তাঁর একটি ছোটো পুরোনো গাড়ি করে আমাদের প্রায়ই নিয়ে যেতেন গড়ের মাঠে বা ময়দানে। ঘাসে আমরা দৌড়াদৌড়ি করতাম। দেখতাম, প্রথম রোদের আলো পড়েছে, আর তার ভেতরে ভেড়ার পাল নিয়ে পালকেরা হেঁটে চলেছে। তারা যে কসাই তা বুঝতাম না। দৃশ্যটাই ‘স্বর্গীয়’ বলে মনে হতো।
বাড়ি ফিরে পড়ার সময় হতো। অন্য বেলাতেও তা-ই। সন্ধে নামার আগেই, ঠাকুমার নির্দেশ ছিল, হাত-পা ধুয়ে মাদুর পেতে বসে জোরে-জোরে চিৎকার করে পড়া। তখন এটাই প্রথা ছিল। কোনো গলির ভেতর হাঁটলেই দুপাশের বাড়ি থেকে পড়ার মৃদু বা সরব কিন্তু দ্রম্নত আওয়াজ যেন শোনা যেত।
ছোটোকাকু একসময় সম্ভবত স্থানাভাবেই আলাদা বাড়িতে ভাড়া নিয়েছিলেন – কাছেই, বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ও সার্কুলার রোডের ওপারে। তবে প্রতি রবিবার সকালে বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িতে আসতেন ‘ডুস’ নিতে। আমাদের খুব ভালোবাসতেন – সবসময় কিছু-না-কিছু নিয়ে আসতেন। ছোটোদের প্রত্যেকের জন্য নিয়মিত আমহার্স্ট স্ট্রিটের মিষ্টির দোকান থেকে একটা করে দানাদার, আমরা অনেকক্ষণ ধরে চুষে-চুষে খেতাম। তাছাড়া কোনোবার মেকানো-সেট, কোনোবার ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট, কোনোবার ক্যারম বোর্ড ইত্যাদি। একবার একটা জোড়াতালি দেওয়া লোকাল রেডিওসেট কিনে এনেছিলেন। প্রথমদিন সবাই সেটাকে ঘিরে বসে ছিলাম, ছাড়তে আর চাইছিলাম না। নিজের বাড়িতে বসে সেই প্রথম মহালয়ার অনুষ্ঠান শুনলাম। পরেই একদিন সন্ধ্যায় আমরা পড়ছি আবাসিক গৃহশিক্ষক শিববাবুর কাছে, হঠাৎ অন্ধকার গলিতে কে যেন চিৎকার করে উঠল, গান্ধী শট ডেড! আমরা হুড়মুড় করে পড়া ছেড়ে ছাদের পাঁচিলে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। ওই রেডিওতেই ব্যারাকপুরের গঙ্গায় গান্ধীর চিতাভস্ম বিসর্জনের ধারাবিবরণ দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বিসর্জনের মুহূর্তে বাবা, মা, কাকাদের আকুল কাঁদতে দেখেছি।
আর ছিল ছোটোবেলা থেকেই বাড়ির দৈনন্দিন বাজার করার অভ্যাস। প্রথমে শ্রীমানী মার্কেট, তারপরে মানিকতলা বাজার – ছোটো-ছোটো পায়ে সরু গলি দিয়ে চলে যেতাম – কখনো দিনে কখনো রাত্রে। মানিকতলা বাজারের বিভিন্ন অংশের বিন্যাস ও স্থাপত্য আমাকে মুগ্ধ করতো। সস্তায় ঘুরে-ঘুরে কেনাকাটার কুশলতা অর্জন করেছি বাবাদের কাছ থেকে – কারণ তাতেই মিটত আমাদের সংসারের আর্থিক প্রয়োজন। তাই গভীর মনোযোগে আমরা বাজার করতাম, দরদাম করতাম। যেসব আনাজপত্র হয়তো আর তত টাটকা নেই, কিন্তু দামের দিক থেকে সুবিধাজনক, আমরা বেছে-বেছে তা-ই কিনতাম বেশি করে। মামারা আমাদের বাড়িতে এলে তাঁদের বাজার করার সুখী বেপরোয়া উদাস ভঙ্গি আমাদের বিস্মিত করত।
পেছন-পেছন একটা ঝাঁকা মাথায় কুলি ঘুরত – আর মামারা দাম না জেনেই সুন্দর করে সাজানো সবচেয়ে টাটকা মাছ বা সবজি ইচ্ছেমতো তুলে নিতেন। আমি সঙ্গে যেতাম, জুলুজুলু করে তাকিয়ে দেখতাম।
অল্প সময়ের জন্য বিদ্যাসাগর স্ট্রিটে বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির মাঠে লাঠিখেলার শিক্ষানবিশি ও অনুশীলনেও মেতেছিলাম। অনুলোম-বিলোম-আরাম ইত্যাদি শেখাতেন বড়োরা। আমাদের মেজোকাকু সেই সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রোজ শেষ রাতে সমিতির কোনো তরুণ সদস্য আমাদের বাড়ি থেকেই গেটের চাবি নিয়ে যেত। বিখ্যাত পুলিন দাস তখনো বেঁচে।
বাবার বন্ধু বৈদ্যনাথবাবু, খাস বর্ধমানের মানুষ, করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করতে এসে যিনি আমাদের বাড়িতে পেইয়িং-গেস্ট হয়ে থাকতেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত খুব ভালো থাকল না, মূলত তাঁর নির্জলা মিথ্যে কথা বলার স্বভাবের জন্য। বড়োকাকুর জন্য জমি, আমার জন্য মোহনবাগান ক্লাবের সভ্যপদের কার্ড, এরকম কতকিছুর প্রতিশ্রম্নতি ছড়াতেন। অবশেষে এরকম অনেক কা- ঘটিয়ে তিনি চলে গেলেন, এবং নিচের ঘরটা সাবলেটে ভাড়া দেওয়া হলো বড়োপিসিমাদের বরিশালের এক আত্মীয়োপম দম্পতিকে। সেই শম্ভুবাবু বাবার মৃত্যুর পরেও পাতিপুকুরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ছিলেন বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িতে।
বৃন্দাবন মল্লিক লেনে থাকি, নিয়মিত স্কুলে যাই, লাগোয়া হৃষীকেশ পার্কে খেলাধুলো করি, যৌথ পরিবারের কোলাহলে দিন কাটাই। তখনই খুব অল্প বয়সে ১৯৪৮-এ বাবার অকস্মাৎ মৃত্যু। বাড়িতে বরাবরই চালু ছিল হাইড্রোপ্যাথি বা জল-চিকিৎসা (আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারে খুবই পরিচিত শব্দ ছিল ‘হিপবাথ’, ‘স্টিমবাথ’, ‘পেটে মাটির প্যাক’ ইত্যাদি)। যে-কোনো রোগেই আমাদের জল-চিকিৎসা, এবং তার ওপর অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু সে-বিশ্বাস টিকল না। সকলেরই যে আমাদের ওই জল-চিকিৎসায় আস্থা রাখতেন এমন নয়, বরং হাসিঠাট্টাই করতেন। অনেককাল পরে বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষকতার প্রার্থী হয়ে পরিচালন-সমিতির প্রধান ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বংশানুক্রমিক আত্মীয়তায় বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ উভয়ের সঙ্গে ছিল যাঁর সম্পর্ক – তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম মেজোকাকুর সঙ্গে। কাকা ছিল একদা ওঁর ছেলে গৌতম ও গৌরাঙ্গের গৃহশিক্ষক। বাবার প্রসঙ্গে কথার সূত্রে ক্ষিতীশবাবু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলেছিলেন, হিমাংশু তো আবার হাইড্রোপ্যাথি করে সুইসাইড করলো। বাবার মৃত্যুর পর এসেছিলেন অরবিন্দ বড়ুয়া বা তাঁর বোন অরু সেন (কর্পোরেশনের শিক্ষা-বিভাগের তখনকার কর্তারা)। তাঁদেরই উদ্যোগে ১৯৫০-এ মাকে করপোরেশন স্কুলেই শিল্প-শিক্ষকের পদ তৈরি করে চাকরি দেওয়া হলো। সপ্তাহের একেক দিন
ভিন্ন-ভিন্ন স্কুলে তাকে যেতে হতো। অবশ্য ইতিমধ্যেই মা সেলাইয়ের ট্রেনিং নিয়ে নিয়েছিলেন কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের শ্রীমানী মার্কেটের দোতলায় অবস্থিত নিতান্তই ঘরোয়া ইউনাটেড টেলারিং কলেজে, যার অধ্যক্ষ ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ দে। মা তাঁকে ‘মাস্টারমশাই’ বলে ডাকতেন। চাকরিতে মা মাইনে পেতেন সামান্য। তবে প্রয়াত রাজনৈতিক বন্দির স্ত্রী হিসেবে যে-পেনশন বরাদ্দ হয়েছিল, তা অবশ্য আরো সামান্য। তবু, তাতেই অনেকটা আত্মনির্ভরশীল হলাম আমরা, মেজোকাকুর সঙ্গে যৌথ পরিবারে।
বাবা বেঁচে থাকতে মা ছিলেন একান্তই গৃহবধূ – একসময় শুধু দেখেছিলাম মুক্তি মিত্রের নেতৃত্বে ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র হয়ে পাড়ারই বাড়িতে-বাড়িতে যাচ্ছেন, এবং দেশকাল নিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু তার বাইরে কিছু নয়, অনেকদিনও নয়। সুতরাং, সেলাইয়ের ট্রেনিং নিতে বা চাকরি করতে তাঁকে এই যে বাড়ির বাইরে যেতে হচ্ছে, তা একেবারেই রীতিভঙ্গ, কিন্তু পরিবারে প্রয়োজনবোধে স্পষ্টতই অনুমোদিত।
বাবা জীবনের শেষ পর্যায়ে স্কুলের চাকরি ছাড়াও আরো কিছু কাজ করতেন – ময়মনসিংহ ইলেকট্রিক কোম্পানির সুপারিনটেনডেন্ট, বন্ধু মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে যশোরের চিরুনি তৈরির ব্যবসা, ইত্যাদি। ব্যবসার সেই উপার্জিত টাকা দিয়েই কলকাতার উপকণ্ঠে পাতিপুকুরে, প্রায় জলের দামে, দু-বিঘা জমি কিনেছিলেন বাবা। যেদিন রাত্রে জমি কিনে বাড়ি ফিরলেন, আমরা ছোটো দু-ভাই দোতলায় হামজ্বরে বিছানায় শুয়ে। ঘুমের মধ্যেই শুনলাম বাবা-মায়ের উত্তেজিত কথাবার্তা। কী করা হবে ওই জমি নিয়ে। এরপর মাঝে-মাঝেই তা নিয়ে স্বপ্ন দেখা চলতো – নিজেদের বাড়ি আর বাগান বানানোর পরিকল্পনা। বাবা বলতেন, আমাদের ভাইদের নাকি ছোটো-ছোটো করে জমি ভাগ করে দেওয়া হবে, আর আমরা তাতেই শস্য ফলানোর প্রতিযোগিতায় নামবো। সত্যিই তা হয়নি, কিন্তু আমরা তখন খুশিতে উৎফুলস্ন। বাবা, মেজোকাকু ও তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে চিৎপুরের রেললাইন ধরে জমি দেখতে যেতাম কখনো-কখনো – পথে খেজুরের রস আর তালশাঁস পাওয়া যেত। সেটা ১৯৪৭-৪৮ নাগাদই হবে। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বরে বাবার মৃত্যুর পর সব ভেসেত্ম গেল।
বাবার মৃত্যুর সময়টার কথা খুব মনে পড়ে। ঘাড়ে ফোঁড়া নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই ফোঁড়া কার্বাংকল হয়ে যায়। পারিবারিক ঐতিহ্য মেনে
জল-চিকিৎসা হতে লাগল। তখনো পেনিসিলিন চালু হয়েছে কিনা কিংবা কতটা হয়েছে তা মনে নেই। হিপবাথের টাবে বসে আছেন বাবা, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন, জিভ কামড়ে ডিলিরিয়ম শুরু হলো। রক্ত পড়ছিল জিভ থেকে। পাশেই কাকিমা রক্ত সরিয়ে দু-হাতে জোর দিয়ে মুখটা ফাঁক করে কামড়ানো ঠেকালেন। এরকম কাকিমার পক্ষেই সম্ভব। মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হলো বাবাকে। বোধহয় দুদিন সম্পূর্ণ অচৈতন্য। নাকে নল, মুখে গোঙানি। বিকেলে নির্দিষ্ট সময়ে দেখতে যেতাম। একদিন, প্রায় শেষরাতে কাকারা, বাবার বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজন কেউ-কেউ বা হয়তো অনেকেই হাসপাতাল থেকে একসঙ্গে এসে খবর দিলেন, বাবা নেই।
অচিরে দাঙ্গা ও দেশভাগের পরিণামের ছাপ প্রত্যক্ষভাবে আমাদের ওই বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িতেও পড়ল। বাবার মৃত্যুর পরে-পরেই পূর্ববঙ্গের লালমনিরহাট থেকে বড়োকাকু এসেছিলেন কয়েকদিনের জন্য। সবাইকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসার জন্যই সকলের অনুরোধ ছিল, কিন্তু তিনি তা সত্ত্বেও আত্মনির্ভরশীল থাকার জন্যই ফিরে গেলেন। কিন্তু সেখানকার সাম্প্রদায়িক অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছোল যে, দেশত্যাগ সত্যিই ঠেকানো গেল না। ১৯৫০-এর সেপ্টেম্বরে তাঁরা চলে আসতে বাধ্যই হলেন। বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িতেই গিজগিজ করে থাকতে হতো। এক বছর পরে আমাদের সঙ্গে স্বভাবতই বড়োকাকুরা সবাই চলে এলেন পাতিপুকুরে। বৃন্দাবন মল্লিক লেন ও পাতিপুকুর দু-জায়গা থেকেই গিয়ে রাজাবাজারের কাছে বৈঠকখানা রোডে ডিসপেনসারি খুলে আবারো মরিয়া চেষ্টা হলো। কিন্তু সাফল্য তখনো এলো না।
বাল্যকালেই কলকাতার ইট-কাঠ সিমেন্ট-সুড়কি বালি-পাথর আর পিচঢালা রাস্তার এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে তখনকার অনুভবেই মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম দু-একবার। একবার বরিশালে, আর একাধিকবার মামাবাড়ি মালদায়।
ভিন্নচর বরিশালের কথাই আগে হোক। বাবা থাকতেই আমাদের বড়ো পিসতুতো দিদি মঞ্জু আমাদের বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়িতে থেকে উইমেনস্ কলেজে আইএ পড়তো। আমাদের খুবই স্নেহার্দ্র সম্পর্ক ছিল তার সঙ্গে। সেই দিদি আর তার ছোটো বোন মনদির বিয়ে হয় বলিশাল শহরে, ১৯৪৭ সালে, একই সঙ্গে একই লগ্নে। বিরাট উঠোনের দুপাশে, মাঝখানে চাদর ঝুলিয়ে। বরিশাল প্রথম দেখার আবছা স্মৃতি এখনো আছে। নদীর পাড়, স্টিমারঘাট, চকবাজার, নারকেলগাছে ছাওয়া কালীবাড়ি লেনে পিসেমশাইয়ের ‘গুরুনাথ সেন’ নামাঙ্কিত দোতলা বাড়ি ও পরিবেশ-প্রতিবেশী। তখন থেকেই পিসতুতো দাদা রাঙাদা বা নূপুর, ভাই শিবাজি, ফুলদি বা অন্নপূর্ণা ও আরো অনেক ছোটো ভাইবোনের সঙ্গেই প্রীতিনির্ভর অন্তরঙ্গতা। প্রায় চল্লিশ বছর পরেও গিয়ে দেখেছিলাম বরিশাল ও বরিশালের সেই বাড়ির স্মৃতিলগ্ন অসিত্মত্ব অমস্নান। এবার অবশ্য উপরি পাওনা হলো মাধবপাশা, বাটাজোড়, জয়শিরকাঠির বিসত্মীর্ণ গ্রামাঞ্চল ঘুরে বেড়ানোর।
দাঙ্গা ও দেশভাগের পরে, বাবা তখন সদ্যপ্রয়াত, পিসেমশাই ও পিসিমা ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় চলে এলেন। পিসেমশাই ছিলেন বরিশালের নামী কবিরাজ। পৈতৃক অনুক্রমে। থাকতেন শহরে। মাঝে-মাঝে কলকাতায় আসতেন বটে, কিন্তু ১৯৫০-এও ভাবেননি বরিশাল ছেড়ে আসবেন। কিন্তু সে-বছরই বিহারের দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মুসলমানেরা যখন উদ্বাস্ত্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে ঠাঁই নিল, তখনই ঘটলো পর্বান্তর। বরিশালেও আশ্রয় নিয়েছিল মুসলমান উদ্বাস্ত্তরা। নদীঘাটে আহত এই উদ্বাস্ত্তদের দেখে বরিশালের স্থানীয় মুসলমানেরাও উত্তেজিত। এতোকাল তো বরিশালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মোটামুটি বজায় ছিল। কিন্তু এবারে, শহরের ও গ্রামের মুসলমান, সকলের মধ্যেই হিংস্রতা উঠে এলো। তারই লক্ষণ দেখা গেল ঘনঘন ‘আলস্নাহু আকবর’ ধ্বনিতে, মুসলমানদের আস্ফালন ও নানারকম গুজবে। ভীতসন্ত্রস্ত হিন্দুরা একসঙ্গে আত্মরক্ষার ভাবনায় মিটিংয়ে বসলেন, এবং সেখানে বরিশাল ছাড়ার ভাবনাটা ক্রমশই প্রবল হতে থাকল।
পিসতুতো দিদি অন্নপূর্ণাকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর এলেন বড়ো পিসিমা। বাড়ি বা সম্পত্তি রক্ষার জন্য বরিশালে রয়ে গেলেন পিসেমশাই ও কর্মচারীরা। পিসেমশাই-ই অবশ্য পিসিমা এবং পিসতুতো দাদা ও ভাইবোনদের পৌঁছে দিলেন আমাদের কলকাতার বাড়িতে। ওদের আসবার কথা যখন থেকে জানা গিয়েছিল, তখন থেকেই রোজই প্রায় আমরা (মেজোকাকু, দাদামণি ও নাবালক হওয়া সত্ত্বেও আমি) শিয়ালদহে চলে যেতাম খুলনা এক্সপ্রেসের পৌঁছোনোর সময়টায়। অনেক আগে থেকে দু-ধারে লাইন দিয়ে লোকের ভিড়, মাঝখানে সরু পথ। সেই পথ দিয়ে ট্রেন ও পস্ন্যাটফর্ম থেকে বিহবলভাবে নেমে আসছে বিভিন্ন বয়সের স্ত্রী-পুরুষ, সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চা, হাতে এলোমেলো বাক্স বা বোঁচকা। যাদের কেউ নেই অপেক্ষায়, তারা থেকে যাচ্ছে পস্ন্যাটফর্মে। যাদের কেউ আছে, মুখ তুলে চেয়ে দেখছে এই অপেক্ষমাণ ভিড়কে। চেনা মুখ দেখলেই কেঁদে উঠছে এবং জড়িয়ে ধরছে। এ সবই ১৯৫০-এর মে-জুন।
আমি যে সবদিনই যেতাম তা নয়। যাইনি এরকম একটা দিন হঠাৎ ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে। ঠাকুমার ও মার সঙ্গে দেখা হতেই কেঁদে ভাসালেন পিসিমারা। বিভিন্ন ঘরে পার্টিশন, আর ছাদের ওপর অ্যাসবেস্টাস পেপার দিয়ে চাল বানিয়ে, ঘর করে, থাকার ব্যবস্থা হলো।
ইতিমধ্যে পিসেমশাই ফিরে গেছেন। কবিরাজি চিকিৎসাও তো চালাতে হচ্ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকা যে যাবে না তা-ও বুঝতে পারছিলেন। ফলে
যাওয়া-আসা চলছিল এরই মধ্যে। বরিশাল থেকে অনেকে মিলে বন্দোবস্ত করলেন, বাড়িঘর যথাসম্ভব ভেঙে কলকাতায় নিয়ে আসবেন নৌকোয়। সেরকমই একটি বড়ো নৌকো যাকে বলা হতো গহনা-নৌকো, তাতে পিসেমশাইদের দক্ষিণের কাঁচা ঘরটি আস্ত (প্রধানত টিন ও কাঠ) নিয়ে আসা হলো, নদী সমুদ্র আর খাল বেয়ে। কলকাতার দক্ষিণে নাকতলার কাছাকাছি মহলানবীশদের জমিতে তা দিয়েই বানানো হলো ঘর। বৃন্দাবন মল্লিক লেন থেকে চলে গেলেন পিসেমশাইরা সেখানেই। ততদিনে আমাদের পাতিপুকুরের মাটির বাড়ি গড়ার কাজও শেষ হয়েছে।
ছোটোবেলায় কলকাতা থেকে মামাবাড়ি হালদায় যাওয়াটা ছিল আমাদের কাছে স্বর্গভ্রমণ। তাই একটু আলাদা করেই বলতে চাই। মালদা মার বাপের বাড়ি তো বটেই, আমাদেরও কলকাতার একঘেয়েমি থেকে পরিত্রাণ। যাওয়ার দিন স্থির হতেই, কয়েক দিন আগে থেকেই বিনিদ্র রাত্রিযাপন। তোড়জোড় শুরু হলো, ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হলো, শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়া হবে। সে-সময়ের ওই ঘোড়ার গাড়িই যেন সানাই বাজিয়ে দিত – যেন তা রেলগাড়িরই প্রতিনিধি। একবার ঘোড়ার গাড়ি ছাড়ার ঠিক আগে আমাদের এক মেসোমশাই খবর নিয়ে এলেন, ঝড়জলে মালদা বিপর্যস্ত, যাওয়া যাবে না। মা এবং আমরা জামাকাপড় ছেড়ে আকুল কাঁদতে বসলাম। কিন্তু এ তো আর সবসময় হয় না। ট্রেনের থার্ড ক্লাস ভিড় কামরাতে ঠিকই জায়গা করে নিতাম। কলকাতা ছাড়ালেই পুকুর বা এমনকি ডোবা, ছোটো-বড়ো গাছ, চাষের জমিতে গোরু আর লাঙল হাতে চাষি ইত্যাদি দেখা শুরু হলেই আমাদের সে কী পুলক! রেললাইনের ধারের জলাশয় দেখলেই আমরা ছোটোরা চিৎকার করে উঠতাম, ‘গঙ্গা গঙ্গা’ এই বলে। অভিভাবকেরা লজ্জা পেয়ে আমাদের থামাতে চাইতেন।
জুবিলি রোডে মামাবাড়ি তখনো এতো জমকালো নয়। তবে খোলামেলা, একতলাতেই কাদার মশলা ও পোক্ত ইট দিয়ে তৈরি অনেক ঘর, চারপাশে বাগান। দাদু, দিদা, চার মামা আর অবিবাহিত ও বাপের বাড়ি আসা বেশ কজন মাসি – বাড়িটা গমগম করতো। মামাতো ভাইয়েরাও চমৎকার সঙ্গী। তবে সবচেয়ে টান দাদু-দিদিমার। দাদু হাত ধরে মালদা শহরের পথঘাটে বেড়াতে নিয়ে যেতেন, এবং মালদার নিজস্ব খাবার খাওয়াতেন। ক্ষীরের চুড় দেওয়া রসকদম্ব, কানসাটের চমচম, তিলের খাজা কিছুই বাদ যেত না। স্নেহভরপুর ছিলেন দাদু ও মাসিরা আমাদের প্রতি। বিশেষ করে সেই মাসি, যাকে দাদামণি বোঝার ভুলে ‘শুধু মাসি’ বলে ডাকত এবং আমরাও তার অনুসরণ করতাম। দাদু ছিলেন কবিরাজ, মালদার সাপ্তাহিক পত্রিকা গৌড়দূত-এর
প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, স্থানীয় রাজনীতিতে সুবক্তা, বার্ধক্যে বিছানায় শুয়ে পরপর ইচ্ছেমতো গড়গড়ার তামাক, জর্দা-দেওয়া পান আর সিগারেট সেবন করতেন, এবং ভিন্ন-ভিন্ন স্পন্দনে কলিংবেল বাজিয়ে তিন পুত্রবধূকে ডেকে তাঁদের রান্না পরখ করতেন। তাঁরা হাঁপাতে-হাঁপাতে বাটি নিয়ে দোতলায় উঠতেন। দাদু বলতেন, জীবনে অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছি, এবার সবাইকে নিয়ে তা উপভোগ করতে চাই। স্নেহ-সিঞ্চনে মামা-মামিরাও বাদ যেতেন না। মনে আছে আমরা থাকলে বালতি-ভর্তি চমচম নিয়ে আসতেন মেজোমামা, কিংবা পদ্মপাতায় মোড়া ঘি-চপচপে আটার হালুয়া। পরে বাড়ির অনেক অদলবদল হয়। ছাদে ওঠার বাঁশের সিঁড়ি ফেলে পাকা দোতলা হয়। মামাবাড়ির মাঝখানের মস্ত উঠোনে দুই লাফে চলে যেতাম উলটোদিকের কাঁচা ছোটো রান্নাঘরে। সেখানে কাঠের উনোনে ভাত-আলু-কুমড়ো সেদ্ধ করে, পটোল পুড়িয়ে, পদ্মপাতায় প্রভাতি খাওয়া চলতো বাড়ির বিপুল জনতার, খেপে-খেপে। দুপুরের খাওয়ায় নদীর মাছের স্বাদই অন্যরকম। বিশেষ করে বাঁচা-মাছের কথা আমরা ফিরে এসেও খুব বলতাম। পরে সেই নদীতেই তো সাঁতার কেটেছি একসময়। এভাবে আদরে-গোবরে সারাদিন কাটিয়ে বিকেলে বেরোতাম মহানন্দা নদীর ধারে বাঁধের পাড়ের নির্জন রাস্তায় হাঁটতে – যার একপাশে চর ও খেলার জমি, অন্যপাশে টাউন হল ও লাইব্রেরি-বিল্ডিং। সেই রাস্তা একদিকে চলে গেছে মুকদমপুরে, কিংবা আমাদের কাছেরই পুরোনো শহরে, যেখানে গৌড়ের সরু ইট, চুরি করে তৈরি হাড়-জিরজিরে বাড়িতে এখনো প্রকাশ্য। অন্যদিকে রাজমহল রোড ধরে মালদা কলেজ, এবং আরো বেশ দূরে বাঁদিকে গৌড় ও ডান-দিকে মহানন্দা নদী পার হয়ে পাণ্ডুয়া, অর্থাৎ আদিনা মসজিদ। মালদা গেলে গৌড় ও আদিনাতে যাওয়া ছিল আমাদের অবশ্যকর্তব্য। মা বলত, আমরা নাকি খুব ছোটোবেলায় গোরুর গাড়িতেই গেছি। তখন সেটাই ছিল রেওয়াজ। মনে নেই। এখন বাস বা গাড়িতেই যাওয়া।
যেভাবেই যাই, গৌড় যেতে প্রথমে পড়বে রামকেলি, যেখানে কিংবদন্তি অনুসারে চৈতন্য মিলেছিলেন রূপ-সনাতনের সঙ্গে। সেখান থেকে একটু উঁচু জমিতে উঠেই ইতিহাস-জড়ানো মুসলিম স্থাপত্যের একের পর এক আশ্চর্য নিদর্শন। ইতস্তত ছড়ানো। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখব। বড়ো সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, চিকা মসজিদ, পোড়ামাটির কাজে ভর্তি তাঁতিপাড়া মসজিদ, লুকোচুরি দরওয়াজা, লোটন মসজিদ – না গেলে বোঝানো যাবে না কী তার বৈচিত্র্য। সবচেয়ে মনে ধরে অনতিউচ্চ ফিরোজ মিনার আর ফতে খানের সমাধি। সমাধিটিতে তো বাংলা জোড়মন্দিরেরই অনুষঙ্গ, তবে বলাই বাহুল্য প্রাচীনতর। বাংলার মন্দিরে গৌড়ের মসজিদের স্থাপত্যের যে-প্রভাব, উৎস-বিচারের যাথার্থ্য, আমরা অনেক পরে অনুধাবন করলাম মন্দির-বিশেষজ্ঞ ডেভিড ম্যাককাচ্চনের প্রবন্ধে বা বইতে। আমরা এখন এখানে এলোমেলো ঘুরে তা-ই দেখতে লাগলাম। পরেও কতবার মার সঙ্গে, শামন্তাকে নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রণেন বসুকে সঙ্গী করে মালদায় গেছি, এবং ভারত-পাকিস্তান সীমামেত্মর কাঁটাতারের কাছে এসে থেমে গেছি। বাংলাদেশের গৌড়ে কখনো যাওয়া হয়নি, অথচ জানি অনবদ্য ছোটো সোনা মসজিদ ওখানেই।
পাণ্ডুয়ায় গেলে অতি বৃহৎ আদিনা মসজিদ দেখা হয়। প্রশস্ত প্রাঙ্গণে ঘুরে-ঘুরে প্রতিবারই দেখা হয়। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখা হয়। দেখতেই হয়, কেননা এতসব ঐতিহাসিক কাহিনি মিশে আছে প্রতিটি বস্ত্তর সঙ্গে, এতোসব স্থাপত্য-কল্পনা যে তাদের উপেক্ষা করা সম্ভবই নয়। শেষবার যখন গিয়েছিলাম, তখন মামাতো এক ভাইয়ের নির্ভরতায় বিজনকে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়া-আসাটাও কম রোমাঞ্চকর ছিল না।
মালদায় আসতে যেমন পাগল হতাম, তেমনি চটজলদি ফিরতেও চাইতাম কলকাতায়। তাই আবার ছটফট করতে থাকতাম। মা বিরক্ত হতেন। কিন্তু সত্যিই তো ফিরতেও হবে একদিন। এসে বৃন্দাবন মল্লিক লেনের ভাড়াবাড়িটা কেমন যেন বেজায় ছোটো লাগতো। চারপাশের ঘরবাড়ি বা রাস্তাও। তবে বন্ধুদের পেয়ে সব পূরণ হয়ে যেত। আবার আমাদের ক্রিকেট ফুটবল ব্যাডমিন্টন, কিংবা কেষ্টিদার নির্দেশে কুচকাওয়াজ বা গাদি, না হলে সারাদিন মাঠে বা পথে-পথে ঘোরাফেরা।
ক্ষীণভাবে মনে পড়ে, বৃন্দাবন মল্লিক লেনেরই দোতলা ঘরে, বাবা বেঁচে থাকতেই, একটি সাহিত্যবাসরের আয়োজন করেছিলেন বাবা ও মেজোকাকা। পরে শুনেছি, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন। এবং আরো অনেকে। এ ধরনের যে-কোনো উপলক্ষেই আমাদের বাড়িতে অতিথি-আপ্যায়নের পেটেন্ট মেন্যু ছিল মুড়ি-সম্বরা – আমরা
মুখে-মুখে বলতাম ‘মুড়ি সোম্বার’। আমাদের বাড়িতে সেটা ছিল বিখ্যাত। তা-ই খাওয়ানো হয়েছিল অভ্যাগতদের বাটিতে-বাটিতে, এবং চা। বাড়ির সকলের, বিশেষত মায়েদের কী উৎসাহ, আবছা মনে আছে।
ছেড়ে যাওয়ার আগে বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়ি সম্পর্কে গভীর একটা মমতাও যে ছিল, তা হয়ত বলতে ভালো লাগবে। সেই ছোট্ট গলির নির্জনতা, বাড়ির একতলার বাঁধানো উঠোন, চৌবাচ্চা-ভর্তি জল, উঠোনের ওপারে ঠাকুমার টিনের চালের হেঁশেলঘর, যেখানে তাঁর হাতে
দুধ-কলা আর আলোচাল মাখা নিরামিষ খাওয়া সন্ধেবেলা। দোতলার দুটো টুকরো ছাদে খেলাধুলো, তার ছোটোটির ফুটো দেয়ালে আতশকাচ ও কাটা-ফিল্ম দিয়ে সিনেমা দেখার ছিল। মেজোকাকুর ঘরের মেঝে লাল ও মসৃণ, সেখানেই আমরা স্টেজ বানাতাম, আগেই বলেছি। সে-ঘরের একপাশের একটি খোলা আলমারিতে ঢাঁই করা থাকত রমেশচন্দ্র সেনের উপন্যাস কুরপালা বইয়ের অবিক্রীত কপি। বাড়ির বড়োদের দেখতাম বিয়ে জাতীয় কোনো উপলক্ষ থাকলেই এক কপি করে নিয়ে যেতে। শুনেছি, ওই প্রকাশনার সঙ্গে বাবা কীভাবে যেন জড়িত ছিলেন – টাকা শোধ না হওয়ায় বই আর প্রকাশকের ঘরে যায়নি। দোতলারও ওপরে ছিল ন্যাড়া ছাদ – আমরা লুকিয়ে-চুরিয়ে উঠতাম, যেমন আগেই বলেছি পাঁচিল বেয়ে পাশের বাড়িতে ছোটোবেলার বন্ধু বুড়োর বাড়ির ছাদে যাওয়া-আসার কথা। বেশ পুরোনো, হয়তো একটু জীর্ণই, তবু এসব নিয়েই বৃন্দাবন মল্লিক লেনের বাড়ির একটা মজা ছিল আমার মনের মধ্যে।
ফুলগাছও ছিল বাড়িতে ও পাড়াতে, মূলত পাড়াতেই, তার সৌরভেই আমোদিত ছিলাম। বাড়িতে ছিল টগরফুলের একটি বড়ো টব আর সিমেন্টের বেদিতে হাস্নুহানা। পাড়াতে হলুদ করবী ফুল, বোগেনভেলিয়া, কৃষ্ণচূড়া, মাধবীলতা, টগর ইত্যাদি। আমরা দলবল ভোরে উঠে পাঁচিল বেয়ে সেই ফুল ডাল-সমেত পাড়তাম। হৃষীকেশ পার্কের তখনকার ন্যাড়া মাঠে বিরাট বটগাছ। কাঠের তৈরি বিশ্রামাগারের পাশে প্রসারিত, ঝুরি নামানো, পাখিতে খাওয়া বটফলে ছড়ানো বৃক্ষমূলে এসে বসতো অনেকেই। বিশ্রামাগারের বেঞ্চে ভবঘুরে ভিখিরিরা জায়গা দখল করে শুয়ে থাকতো। পরীক্ষার সময় সিটি কলেজের
কোনো-কোনো ছাত্রের, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সহায়তায় চুরি করে মেঝেতে খাতা ফেলে টুকলি করাও চোখে পড়েছে। আমহার্স্ট স্ট্রিটে বকুলগাছের সারি, হাতের মুঠোয় বকুলফুল কুড়িয়ে গন্ধ শোঁকা। হৃষীকেশ পার্কে তো বটেই, আশেপাশের অন্য পার্কেও গুলমোহর, রাধাচূড়া, জামরুলের সমারোহ – লাল বা হলুদ বা বেগুনি রঙে উজ্জ্বল।
বিদ্যাসাগর স্ট্রিট যেখানে সার্কুলার রোডে পড়েছে, তারই ওপারে মূক-বধির বিদ্যালয়ের লালবাড়ির পাশ দিয়ে, সুকুমার রায়ের পৈতৃক বাড়ি পেরিয়ে, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটের কাছাকাছি খালপারে গড়পার ছিল আমাদের নিত্য গন্তব্যস্থল। পরের দিকে আমারই। বাবার মাসি, যাকে আমরা দিদিমণি বলতাম তাঁর ছোটো ছেলেমেয়েরা, সম্পর্কে কাকা-পিসি হলেও, যারা বয়সে কাছাকাছি – সেই কালো-কাজল-নোটনই ছিল আমার দীর্ঘদিনের বিশেষ বন্ধু। নোটন বা পদ্মনাভ দাশগুপ্ত ছিল প্রাত্যহিক আড্ডা-সঙ্গী, আমার সাহিত্যসংস্কৃতির কর্ম ও সংগঠনে প্রেরণা। তার মেধা ও লেখা নিয়ে আমাদের গর্বের অন্ত ছিল না। কাজল বা চন্দনাভ শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিকেলে চলে আসতো নিছক গল্প করতে। আর কালো বা মৈত্রেয়ীর বন্ধুত্বে আমি তখনই প্রাণিত।
পরবর্তীকালে যে-ব্যক্তিগত নিজস্ব লাইব্রেরি তৈরি করেছিলাম, সেই অপ্রতিরোধ্য বাসনার শুরু পাতিপুকুরের ছাত্রজীবন থেকেই। তখন ছিল মাত্র পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুটি পালস্নাহীন বার্মাটিক-কাঠের লম্বা আলমারি – তার দশটি তাকই ভর্তি করে ফেলেছিলাম অন্যের কাছ থেকে পাওয়া বা নতুন ও পুরোনো কেনা বইতে। এমনই তীব্র ছিল বই-জমানোর নেশা। হ্যাঁ, শুধু পড়া নয়, জমানোও। বলতে কী, পাঠ্যবই বাড়তি হয়ে গেছে মনে করলে তা কলেজ স্ট্রিটের রেলিংয়ে গোপনে বেচে দিয়ে পছন্দের বই কেনা পর্যন্ত যেন সেই উদগ্র শখ। এভাবেই কিনেছিলাম এমসি সরকারের দোকান থেকে বুদ্ধদেব বসু-সম্পাদিত আধুনিক বাংলা কবিতার সংগ্রহ। কালো আমাদের পাতিপুকুরের বাড়িতে এলেই সব ফেলে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে বই ঘাঁটত অনেকক্ষণ ধরে। বস্ত্তত তার পাতিপুকুরে আসার একটা বড়ো আকর্ষণ ছিল সেটাই।
হয়ত একটু এগিয়েই গেলাম। তবে, তখনো তো আমরা বৃন্দাবন লেনেই থাকি। একেবারে ছেলেবেলা থেকে যত বড়ো হই, ততই আমহার্স্ট স্ট্রিটের লাহাবাড়ির উলটো দিকের হৃষীকেশ পার্কের সঙ্গে আমাদের সংযোগ বাড়ে। ওই হৃষীকেশ লাহার নামেই পার্কের নাম। পার্কের দুধারে দুটি অংশ, মাঝখান দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা। একদিকে সাবেক ও সম্পন্ন মিলন সমিতি – অন্যদিকে নবীন ও ঘরোয়া কিশোর সংঘ। কিশোর সংঘের প্রাণ ছিল কৃষ্ণপদ সেনগুপ্ত, আমাদের ‘কেষ্টিদা’। মাঠের ধারের আড্ডায় মেতে থাকতেন মিলন সমিতির বুবিদা, আর কিশোর সংঘের প্রবীরদা ওরফে ডাকাতদা। রবিবার দুপুরে সবাই মিলেমিশে মাঠের দুই অংশ জুড়ে ক্রিকেট খেলা হতো। আমরা ছোটোরাও ছিলাম উৎসুক দর্শক। পার্কের যে-পাশে লাহাবাড়ি, তার ঠিক উলটো দিকে বিশাল সাদা বাড়ি – বোধহয় নিতু, সেই বাড়ির ছেলে নিতুই ছিল আমার বন্ধু। সেই বাড়িরই নিচে সরু একচিলতে ঘরে কিশোর সংঘের নতুন লাইব্রেরি তৈরি হলো। আমিই ভার নিয়েছিলাম সেই লাইব্রেরির। তারই পাশে একটি পুরোনো বাড়িতে সংঘের অফিস, অন্তত কিছুকাল। সেখানে সরস্বতী পুজো হতো। বিকেলের
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে একবার আমি আবৃত্তি করে পুরস্কার পেয়েছিলাম – পূর্বোক্ত শতদল গোস্বামীর কবিতার বইটি – যেটা সঙ্গে ছিল বলেই করপোরেশন স্কুলে
ক্লাস-পালানোর শাসিত্ম থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। কেষ্টিদার নেতৃত্বে নানা খেলাধুলোর পরিকল্পনা করা হতো কিশোর সংঘে। যেমন ছেলেদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে ফুটবল প্রতিযোগিতা, নির্দিষ্ট ফিক্সচারে। প্রত্যেক গ্রম্নপে সাতজন করে খেলোয়াড় – তাই তাদের নাম ছিল ‘সেভেন বুলেটস’, ‘সেভেন টরপেডো’ ইত্যাদি। আমাদের দলের নাম ছিল ‘সাত ভাই চম্পা’ – আমিই এই খেলার জগতে অনুপযোগী কোমল নামটি দিয়েছিলাম, এবং সে-দলের অধিনায়ক ছিলাম। শীর্ণকায় কেষ্টিদা প্রত্যেক খেলায় হাঁটু অবধি ধুতি পরে হুইসেল বাজিয়ে পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন আমাদের ‘হিরো’। বড়ো হয়েও বাড়িতে বা পাড়ায় তাঁর গল্প করতাম অবিরল – এমনকি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। তা নিয়ে সবাই খ্যাপাতও আমাকে। ‘মিলন সমিতি’র পাশে কেষ্টিদার ‘কিশোর সংঘ’ ছিল দুর্বল ছোটো ক্লাব – তাদের ব্যান্ড পার্টি ছিল না, ময়দানে তাঁবু ছিল না। কিন্তু আমরা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসতাম কেষ্টিদাকে ও আমাদের ছোটো ক্লাবকে। কিশোর সংঘের বার্ষিক স্পোর্টসেও পরম উৎসাহে যোগ দিতাম – নানা বিভাগে প্রাইজও পেতাম – বিশেষত দৌড়ে। সে-সব চকচকে কাপ-মেডেল দিয়ে আলমারির একটি ছোটো তাক ভরে গিয়েছিল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মা দেখাতেন আত্মীয়স্বজন বা পাড়াপড়শিকে। ক্রমশ কালচে হয়ে তা দেখারও অযোগ্য হলো। অনেক পরে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়-প্রাপ্ত নেপালি কিশোর অযোধ্যা গোপনে পুরোনো লোহার দরে বিক্রি করে দেয়। আরেকটি বলবার কথা, কিশোর সংঘে দেশি খেলার খুব চর্চা ছিল। নিতান্তই গ্রামীণ খেলা, যেমন ‘গাদি’র সফল অনুশীলন ও প্রতিযোগিতা কলকাতায় একমাত্র কিশোর সংঘই দীর্ঘকাল টিকিয়ে রেখেছিল। ‘গাদি’ বা ‘দাইড়াবাঁধা’ এই নামে একসময় গ্রামদেশে একটা খেলা হতো, যদিও তার লিখিত উলেস্নখ এখন কোথাও দেখি না। কলকাতা বা তার মফস্বলে যে-সব অঞ্চলে তখনো বিস্ময়করভাবে সেই গাদি খেলার চর্চা ও প্রতিযোগিতার চল ছিল, সেখানে প্রায়শ কিশোর সংঘই ‘চ্যাম্পিয়ন’। ওই খেলাতে আমিও বেশি পটু ছিলাম, অধিনায়কও হয়েছি ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করতে। ‘হা-ডু-ডু’ বা ‘কপাটি’ দক্ষিণ ভারতের থেকে আমরা নিয়েছি, কিন্তু এখন বাংলার মাঠেঘাটে বেশ জনপ্রিয়। তাছাড়া ব্রতচারী সংঘের অনুপ্রেরণায় রায়বেঁশে নাচও হতো মাঝে-মাঝে। এভাবেই ফুটবল-ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টনের মতো অভিজাত খেলার পাশাপাশি, একটু আড়ালে হলেও কিশোর সংঘের চৌহদ্দিতে চালু থাকে নিতান্ত ‘গেঁয়ো’ খেলাও বেশ সমাদরে। পরে অবশ্য ক্ষক্ষত্র প্রসারিত হলে কিশোর সংঘের নতুন নামকরণ হয় ‘হৃষীকেশ পার্ক ইনস্টিটিউট’। আরো পরে লাহাবাড়ির মালিকদের সঙ্গে নিয়মিত সামান্য অনুদানের বিনিময়ে কেষ্টিদারই উদ্যোগে শুধুই ‘হৃষীকেশ ইনস্টিটিউট’। বৃন্দাবন মল্লিক লেন ছেড়ে যাওয়ার পর সক্রিয়ভাবে খেলাধুলো থেকে একেবারেই সরে গেছি, কিন্তু জাতীয় বা আন্তর্জাতিক যে-কোনো স্তরে ক্রিকেট ফুটবল টেনিস বা ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি সর্বস্বীকৃত বা সর্বগ্রাহ্য খেলার ব্যাপারে উদগ্র ঔৎসুক্য কমেনি সারাজীবনেও। একসময়ে রেডিওতে বা পরে টিভিতে ধারাবিবরণী শোনায় বা দেখায়, কিংবা নবীন প্রজন্মের সঙ্গে আসক্ত আলোচনায় বা তীক্ষন মন্তব্য-বিনিময়ে কখনো কোনো অনাগ্রহ নেই। এমনকি বুড়ো বয়স পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া ভুলে টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখি।
দাদামণি অবশ্য তখন মেট্রোপলিটান স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ছে, এবং বাবার বিরোধিতা সত্ত্বেও বামপন্থী ছাত্র-রাজনীতি করা শুরু করেছে। ১৯৪৬-এ হো চি মিনের সমর্থনে ‘ভিয়েতনাম দিবসে’র মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের লাঠির ঘায়ে খোঁড়া হওয়ার উপক্রম ঘটেছিল। আমাদের পারিবারিক জল-চিকিৎসায় দীর্ঘ ভোগের পর অবশেষে সেরে ওঠে। আমাদের আত্মীয় টংসাকাকু কবিরাজ – তিনি প্রায় রোজ এসে ক্ষততে ‘গজ’ বদলে দিতেন, দাদামণির চিৎকারে আমরা শিহরিত হতাম। এটা আমরা কখনো ভুলিনি। অনেক পরে যখন ভিয়েতনাম সরকারের পক্ষ থেকে স্মরণ করা হয়েছিল ওই ভিয়েতনাম দিবসের ঘটনা, তখন পরিবারের অনুজেরাও গর্বিত বোধ করেছিল। দাদামণিকে জড়িয়ে ধরা হো চি মিনের একটা ফটো আমাদের কারো-কারো ঘরে টাঙানো থাকত। তবে, বাবার অনুমতি না নিয়েই দাদামণি যে তখন আইএতে স্কটিশ চার্চ কলেজের সহশিক্ষা ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল, তাতে বাবা রাগ করেছিলেন।
বাবার মৃত্যুর কিছুকাল পরেই পাতিপুকুরের জমিতে আমাদের যৌথ পরিবারের কর্তা হিসেবে মেজোকাকুই বাড়ি তৈরি শুরু করে দিলেন। কাঁচা মাটির ঘর, দেয়াল-মেঝে সবই মাটির, কিন্তু বেশ উঁচু ও মজবুত, মাপমতো কাঠের জানালা ও দরজা এবং মাথায় টালির চালে বহুকৌণিক বিন্যাস – এভাবেই বাড়ি অনেকটাই বিস্তারিত। ধীরে-ধীরে চোখের সামনে এক বছর ধরে কাজ করে বাড়িটি খাড়া হলো। ডোবায় আরো গর্ত করে, মাটি কেটে, বাঁশের কঞ্চিতে সেই মাটি লেপে, বঙ্গীয় ব্যায়াম সমিতির সূত্রে মেজোকাকুর চেনা রাখাল মিসিত্মরির মৃৎকৌশলে। আমরা মাঝে মাঝে দেখতে যেতাম সেই নির্মাণ – বড়োকাকু, মেজোকাকু, দাদামণি, এমনকি মাঝে-মাঝে আমিও। ১৯৫১ সালে যখন আমি নবম শ্রেণিতে পড়ি, তখনই আমরা যৌথ পরিবার উঠে এলাম পাতিপুকুরের নতুন বাড়িতে, নিজেদের বানানো বাড়িতে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.