দৃশ্যাবলি : অন্নদাশঙ্কর

জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ১৯৪৮ সালে পড়ার সময় ক্লাসে একটি ছেলে আসে, আমার সহপাঠী হয়, সেন্ট্রাল ব্যাংকের ম্যানেজারের ছেলে। তার জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করে। সেদিন তার বোনের সঙ্গেও আলাপ হয়। ভাইবোনে মিলে আমার মাথা খারাপ করে দেয় ছেলেমেয়ের শরীর নিয়ে নানা কথা বলে। তারা আমার বয়ঃসন্ধির অভিশাপ। কোনোমতে নবম শ্রেণিতে উঠি। নবম শ্রেণিতে সহপাঠী পাই নির্মল সান্যালকে। তার দশম শ্রেণিতে পড়ার কথা, পরীক্ষায় ফেল করে নবম শ্রেণিতে আটকে গেছে। অদ্ভুত ছেলে – গল্প-উপন্যাসে দারুণ নেশা। সে-ই ওই ভাইবোনের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করে। আমাকে অন্নদাশঙ্করের আগুন নিয়ে খেলা পড়ায়। অসমাপিকা পড়ায়। কদমতলার আজাদ হিন্দ পাঠাগার থেকে সে এইসব বই এনে পড়াত। একদিন নিয়ে এলো অন্নদাশঙ্করের পথে প্রবাসে। আমি অন্নদাশঙ্করের নেশায় পড়লাম। যার যেথা দেশ-এর যেন সে সুধী।  যার যেথা দেশের প্রকাশক ডি.এম. লাইব্রেরির প্রযত্নে চিঠি দিলাম অন্নদাশঙ্করকে।

এর আগে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে চিঠি দিয়েছিলাম দেব সাহিত্য কুটীরের ঠিকানায়। যখন সেই চিঠির কথা ভুলে গিয়েছিলাম, মাস তিন-চার পরে প্রেমেন্দ্র মিত্রের পোস্টকার্ড পাই। মাত্র তিন-চার ছত্রের চিঠি। এবার অচিরে অন্নদাশঙ্করের উত্তর। ভালো করে পড়াশোনা করো যাতে তুমিও একদিন ইউরোপে যেতে পারবে। একখানা ‘পথে পথে’ লিখবে।

ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে নির্মল কলকাতায় চলে গেল দাদার কাছে, ভর্তি হলো স্কটিশ চার্চ কলেজে। আমি কলকাতায় বেড়াতে এসে উঠলাম মামাবাড়ি ভবানীপুর পদ্মপুকুর রোডে। একদিন হেঁটে রওনা হলাম আয়রন সাইড রোডে অন্নদাশঙ্করের বাড়ির খোঁজে।

 

প্রথম দৃশ্য

গিয়ে দেখি বাড়ির বাগানে মালী ঝারি করে গাছে জল দিচ্ছে। বললাম, ‘অন্নদাশঙ্কর আছেন? আমি এসেছি জলপাইগুড়ি থেকে।’ মালী বলল, ‘এসো, ঘরে বসবে। যা গরম। ফ্যান চালিয়ে দেবো।’

আমি ফ্যানের নিচে বসে হাওয়া খাচ্ছি। মালী ভেতরে খবর দিতে গেল। একটু পরে ফুটফুটে সাদা ধুতি, একটু খাটো, গায়ে হাফ হাতা ফুটফুটে সাদা পাঞ্জাবি পরে আমার সামনের সোফায় বসে সেই মালী শুধাল, ‘বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি তো।’ বুঝলাম তিনিই অন্নদাশঙ্কর। বেশ ধারালো মুখের কাটুনি। চোখদুটো দুর্গাপুজোর কার্তিকের মতো, বড় এবং গভীর। জিজ্ঞাসায় উজ্জ্বল।

দু-এক মিনিট মামুলি কথাবার্তা। একজন মেমসাহেব, গোলপানা মুখ হাসিহাসি, এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চা খাবে টো সরজিট।’

বুঝলাম অন্নদাশঙ্করের স্ত্রী। তাড়াতাড়ি তাঁকে প্রণাম করলাম। মালীর রূপান্তরে ঘাবড়ে অন্নদাশঙ্করকে প্রণাম করিনি। এবার করলাম।

 

দৃশ্যান্তর

১৯৫১-র জুন মাস। জলপাইগুড়ি কলেজে গরমের ছুটিতে গেছি শান্তিনিকেতনে। পথেপ্রবাসেতে পড়েছিলাম বিলেতে ছেলেমেয়েরা ছুটি পেলে বেড়াতে বেরোয়। আমি বেড়াতে এলাম শান্তিনিকেতনে। প্রথমেই টের পেলাম শান্তিনিকেতনের গরম। বাববা, এতো গরম! গেস্ট হাউসে (তখন গেস্ট হাউস ছিল শান্তিনিকেতন গৃহটি) গিয়ে চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে স্নান সেরেই পেটে দুটি ভাত দিয়ে ঘুম। ট্রেনে ঘুম হয়নি একঝাঁক বিহারির বকবকানিতে। গেস্ট হাউসে ঘুমিয়ে। কে যেন ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘চা দেবো?’ চায়ের সঙ্গে একবাটি মুড়ি-ডালমুট। ম্যানেজারের কাছ থেকে হদিস নিয়ে এলাম শ্রীনিকেতনের পথে লালবাঁধের ধারে অন্নদাশঙ্করের বাসায়। অকাল অবসর নিয়ে তিনি তখন বাসা ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে। খুব বড় ফাঁকা জমির মাঝখানে একতলা ছোটমাপের বাড়ি।

আমি এগিয়ে গেছি, অমনি হলুদ পর্দা সরিয়ে বের হলেন অন্নদাশঙ্কর। ট্রাউজার্স, সাদা কেডস জুতো, গায়ে সাদা হাফহাতা শার্ট, হাতে টেনিস র‌্যাকেট। আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। ‘ও, তুমি এসেছ? ওই মোড়াতে একটু বসো।’ বলে পর্দা সরিয়ে ঘরে চলে গেলেন। কিছু পরে বেরিয়ে এলেন – পরনে সাদা খাটো ধুতি, গায়ে গেরি পাঞ্জাবি, হাতে টর্চ। ধুতি ও পাঞ্জাবি খদ্দরের। বললেন, ‘চলো, একটু হাঁটা যাক।’ আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। বেশি কথাই হলো গান্ধীজির অর্থনীতি নিয়ে, অল্প কথা হলো সাহিত্য ও স্টাইল নিয়ে। বললেন, ‘আধুনিক কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত তাঁর পছন্দ, সুর আছে, বিষ্ণু দে-র আছে নাগরিকতা, আরবান কালচার।’

‘আর জীবনানন্দ দাশ?’ জিজ্ঞেস করি। বললেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের শুদ্ধতম কবি।’

প্রকৃতিতে আসন্ন সন্ধ্যার আভাস। গাছের ডালে পাখিদের কিচিরমিচির। অন্নদাশঙ্কর বললেন, ‘চলো, ফেরা যাক।’ মস্নান অন্ধকার নেমেছে পথে, আকাশে সূর্যাসেত্মর আলো। পথের ওপর মধ্যে মধ্যে টর্চের আলো ফেলে প্রত্যাবর্তন।

মেমসাহেব মাসিমা বারান্দায় টেবিল ও কয়েকটা মোড়া পেতে রেখেছেন। বারান্দার দেয়ালে ইলেকট্রিক বাতি। ঘরে তৈরি কেক ও চা খাওয়ার পরে গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘এবার চলো আমার সঙ্গে।’

তিনি গেস্ট হাউসের দিকে কিছুটা এগিয়ে একটা জায়গায় থামলেন। সেখানে অন্ধকারে ঝুপসি ঝুপসি কয়েকটা গাছ দেখিয়ে বললেন, ‘এই হচ্ছে ছাটিমটলা – এক টির্ঠ – শান্তিনিকেতনে এলে পরঠমে এখানে আসবে।’

তিনি ফিরে গেলেন, আমি ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। পরের দুদিন ঘুরে ঘুরে দেখলাম শান্তিনিকেতন। তারপরে এলাম কলকাতায়। উঠলাম প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে। আগেই দেখে গেছি, এই বাড়িটা ধর্মশালার মতো – সারাক্ষণ লোক আসছে, যাচ্ছে, চা হচ্ছে, কেউ ভাত খাচ্ছে। তার মধ্যেই প্রেমেন্দ্র মিত্র গল্প করছেন। শুধু রাত দশটা নাগাদ বাড়ি ঠান্ডা হলে লিখতে পড়ত বসেন। কখন শুতে যান জানিনে। তাঁর বড় ছেলে মৃন্ময়, ডাকনাম মনা, স্কটিশে পড়ে, আইএসসি, আমার চেয়ে এক বছরের বড়, সমবয়সীও হতে পারে। সে-ও শান্তিনিকেতনের ছাত্র। তার ভাই হিরণ্ময়, সুনু ডাকনাম। সে-ও শান্তিনিকেতনের।

 

দৃশ্যান্তর

১৯৫২-র মে মাস। আমার আইএ পরীক্ষা হয়ে গেছে। অন্নদাশঙ্কর এসেছেন দার্জিলিংয়ে। দিনেশ রায় আমার সিনিয়র – বাংলা অনার্স পড়ছেন। বললেন, ‘চলো – দার্জিলিংয়ে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে দেখা করে আসি।’

দার্জিলিংয়ে রিংক সিনেমা হলের কাছে একটা বাঙালি হোটেলে উঠলাম। ম্যানেজার বললেন, ‘অন্নদাশঙ্কর রায়? আইসিএস সাহিত্যিক? নর্থ পয়েন্টে উঠেছেন? চলুন, আমিও যাব। একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে দেখা হবে।’

একটা ট্যাক্সি করে তিনজনে এলাম নর্থ পয়েন্টে। সহজেই পেয়ে গেলাম লগ কেবিন। সুপরিচিত বাড়ি। গাছের চেরা কাঠের তক্তা দিয়ে নয়, গুঁড়ি কেটে গুঁড়ির বাইরের ছালসুদ্ধ গুঁড়ি থাক থাক সাজিয়ে লগ কেবিনের বহির্দেওয়াল, তাই নাম লগ কেবিন। অঞ্চলে সুপরিচিত বাড়ি।

ভেতরে শীতের দেশের উপযুক্ত আসবাব, তক্তার দেওয়াল ও মেঝে। একেবারে সুটবুটে অন্নদাশঙ্কর, মেম সাহেবান কালো কার্ডিগান – খুব ফর্সা চামড়ার ওপর কুচকুচে কালো পশম।

কফি ও গেস্ননারিজের জিঞ্জার-নাট বিস্কিটে আপ্যায়ন। শান্তিনিকেতনের পেস্নন লিভিং, এখানে হাইলিভিং। পেস্নন থিংকিংয়ের মাঝখানে এসে গেল হঠাৎ ১৯৫২-র একুশে ফেব্রম্নয়ারি – ঢাকার রাজপথে তরুণদের রক্তস্রোত বাংলা ভাষার জন্যে। অমনই দপ করে জ্বলে উঠলেন অন্নদাশঙ্কর। বললেন, ‘এ রক্ত বৃথা যাবে না, ইতিহাসে আগুন জ্বালাবে। রক্ত গোলাপ হয়ে ফুটবে।’

 

দৃশ্যান্তর

আইএ পাশ করে এলাম কলকাতায় ১৯৫২-র জুন মাসে। ভর্তি হলাম স্কটিশ চার্চ কলেজে, কিন্তু টমোরি কি অগিল ভি কি স্কটিশের কোনো হস্টেলে জায়গা নেই। অগত্যা জায়গা পেলাম হাতিবাগানের হরি ঘোষ স্ট্রিটের দ্য রেসিডেন্স মেসে, আবাসিকরাই বলে ‘হরি ঘোষের গোয়াল’।

স্কটিশে ভাব হলো নবীন কবি দীপক মজুমদারের সঙ্গে। সে-বছরের পুজো সংখ্যার দেশে তার কবিতা বেরিয়েছে। আমারও দেশে কবিতা বেরিয়েছে – তবে সাধারণ সংখ্যায়।

একদিন স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ছুটির পরে বের হচ্ছি, তখনই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। বিডন স্ট্রিট কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের মোড়ে বসন্ত কেবিনের ভেতর থেকে দীপক বলল, ‘পাতায় বর্ষার গান শুনতে হলে শান্তিনিকেতনে যেতে হবে। চলো, কাল শান্তিনিকেতনে যাই।’ বলে গান ধরল, ‘চিত্ত আমার হারালো মেঘের মাঝখানে।’

পরদিন সকালে হরি ঘোষের গোয়ালে দীপকের আবির্ভাব। বলল, ‘আজ কলেজ যেতে হবে না, চলো শান্তিনিকেতনে।’ দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখছি দিগমেত্ম মেঘের সম্ভার। বোলপুর স্টেশনে নামতেই শুরু হলো বৃষ্টি। দুজনে ভিজতে ভিজতে শালবীথির দিক দিয়ে আশ্রমে ঢুকলাম। সত্যিই শালের পাতায় পাতায় বর্ষার গান। দীপক চলে গেল তার মামাবাড়ি শান্তিদেব ঘোষের বাড়ি। আমি ভিজতে ভিজতে হাজির হলাম অন্নদাশঙ্করের বাড়িতে। প্রথমে বকুনিবৃষ্টি। মেমসাহেব মাসিমা একটা তোয়ালে ও কতকগুলো শুকনো পাজামা-পাঞ্জাবি হাতে দিয়ে আমাকে ঠেলে দিলেন বাথরুমে।

বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি ধরেছে। গরম চা এগিয়ে দিলেন মাসিমা। মেসোমশায় এসে পাশের মোড়ায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কটিশের হস্টেলে জায়গা পেলে?’ বললাম, ‘পাইনি।’

‘তাহলে এখানে চলে এসো। কলেজ হস্টেলে অনেক জায়গা।’ দ্বিধা করছি দেখে বললেন, ‘বিশ্বভারতী সারা বিশ্বকে কোলে ধরে আছে।’

পরদিন মেসোমশায়ের চিঠি নিয়ে গেলাম রেজিস্ট্রার নিশিকান্ত সেনের কাছে। চিঠিটা পড়ে বললেন, ‘অনেকদিন সেশন শুরু হয়ে গেছে। অনেক ক্যাচ-আপ করতে হবে তোমাকে – আজই ভর্তি হয়ে যাও।’

নিজেকে সামলে বললাম, ‘আমি তো টাকা-পয়সা কিছু আনিনি।’

তিনি মেসোমশায়ের চিঠিটা আমার চোখের সামনে নেড়ে বললেন, ‘এটা তো এনেছ।’

বললাম, ‘কলকাতায় গিয়ে মেস থেকে আমার জিনিসপত্র আনব, মাকে এক্সপ্রেস চিঠি দেবো – টি.এম.ও করে টাকা পাঠিয়ে দেবেন।’

‘কোনো দরকার নেই টাকা-পয়সা; আসা-যাওয়ার পথে অনেক বিঘ্ন ঘটে। এটা তুমি জানো না। বয়স কম তো। দুমাস বাদে পুজোর ছুটি। বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে এসো সঙ্গে করে।’

এভাবেই আমার বিশ্বভারতীর জীবন শুরু।

 

দৃশ্যান্তর

১৯৫২-র ডিসেম্বর। আম্রকুঞ্জে আলপনা আঁকা হয়েছে, আসন সাজানো হয়েছে। সমাবর্তনে আচার্য প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এলেন। সিংহাসনের পাশে ডাঁই করা ছাতিমপাতা আর অনেক উত্তরীয়। এই ছাতিমপাতাগুলোই দেওয়া হবে শংসাপত্র হিসেবে। পরে দেওয়া হবে  বিশ্বভারতী ছাপমারা সার্টিফিকেট।

রথীদার সঙ্গে জওহরলাল নেহরু এলেন! রথীদা ইঙ্গিতে সিংহাসনে নেহরুকে বসতে বললেন। নেহরু আসনটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ, অবশেষে বসলেন, রথীদা, নিশিকান্তদা বসলেন। নিজ নিজ আসনে।

ছাতিমপাতা দেওয়ার আগে নেহরু বললেন, ‘মাই হার্ট ওয়াজ ট্রেম্বিস্নং উইথ ফিয়ার। দিস দি সিংহাসন মেন্ট ফর গুরুদেব। নাও আই হ্যাভ বিন আস্কড টু অকুপাই ইট। হ্যাভ আই দি রাইট টু অকুপাই ইট? হাউএভার -’

সন্ধেবেলা মেলা প্রাঙ্গণে পাঠভবনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে হইহই করতে করতে নেহরু এলেন। গিয়ে উঠলেন নাগরদোলায়। নাগরদোলা যত জোরে ঘোরে, তত বাড়ে নাগরদোলায় চড়া ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর নেহরুর হাসি। কিছুক্ষণ পরে নাগরদোলা থামল। নেহরু নামলেন। অমনি একটা ভিড় যেন আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল নেহরুর দিকে। নেহরু হাত নাড়ছেন সবার দিকে। অনেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তাঁর দিকে। আমিও হাত বাড়ালাম – নেহরু আমার হাত টেনে ধরে একটা নরম ঝাঁকুনি দিলেন। মনে পড়লে আজো গায়ে কাঁটা দেয়।

 

দৃশ্যান্তর

সমাবর্তন ও মেলা শেষ। আমি গেলাম মার কাছে জলপাইগুড়ি। ১৯৫৩-র জানুয়ারিতে ফিরেছি শান্তিনিকেতনে। ছাতিমতলা হয়ে গেলাম অন্নদাশঙ্করের কাছে। ‘এসেছ?’ কুশলবিনিময়। তারপর বললেন, ‘সামনের বুধবারে একটা মিটিং ডেকেছি বাড়িতে – ক্ষিতীশদা, হীরেনদা, অশোকদা আসবেন, তুমিও এসো – মাসিমাকে সাহায্য করবে আপ্যায়নে।’ গিয়ে দেখি মিটিংয়ে নিমাই চট্টোপাধ্যায় ও গৌরী দত্ত – দুজনেও উপস্থিত।

মিটিংয়ের বিষয় দেশভাগের পাঁচ বছর পরে দুই বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা। প্রস্তাবটা অন্নদাশঙ্কর ও ক্ষিতীশদা গিয়ে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে তুলতেই বললেন, ‘না।’ অন্নদাশঙ্কর কিছু বলতে গেলে বললেন, ‘ওরা তো অনেককে খুন করে ক্ষান্ত হয়নি, জমিজমাও দখল করেছে। আমার জমিদারিও এখন তাদের। ওদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নয়।’

অন্নদাশঙ্কর ফিরে ঠিক করলেন পশ্চিম বাংলার সাহিত্যিকদের নিয়েই মেলা করবেন। ওই একুশে ফেব্রম্নয়ারি স্মরণ-শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও এপার বাংলা সাহিত্যের হালহকিকত।

কিছুদিন পরে রথীদারও সম্মতি মিলল। শঙ্কা ছিল পাকিস্তান সরকার বাঙালি পাকিস্তানিদের আসতে দেবে কিনা। তখন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন জেনেই বোধহয় দু-সপ্তাহের জন্যে অনুমোদন দেয় এই শর্তে যে, শান্তিনিকেতন ছাড়া তারা অন্য কোথাও যাবে না, এই মেলা ছাড়া কোনো সভা করবে না। এই শর্ত প্রবীণরা মানলেও শামসুর  রাহমান ও কায়সুল হক মানেননি – তাঁরা কলকাতায় ইচ্ছেমতো ঘোরেন, দেখা-সাক্ষাৎ করেন, সভাও করেন। ফলে তাঁরা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের কিছু কিছু দেখলেও অনেকটা থেকে বঞ্চিত হন। তবে দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের এমন মিলন উৎসব আর হয়েছে বলে জানি না।

১৯৬৭ সালে আর একবার সাহিত্য মেলা ডাকার কথা ভেবেছিলেন পাকিস্তানের বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার হাসান ইমাম। তিনি  প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন অন্নদাশঙ্করের কাছে। কিন্তু পরে পাকিস্তান সরকারের ধমকে তিনি চুপ করে যান। একা অন্নদাশঙ্কর মুষ্টিমেয় সাহিত্যিকদের, যেমন মনোজ বসু, নীহাররঞ্জন রায়কে নিয়ে একুশে ফেব্রম্নয়ারি পালন করেন যোধপুর পার্কে এবং সেদিন গাওয়ার জন্যে বেছেছিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।

 

দৃশ্যান্তর

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণায় রোমাঞ্চিত হলেন অন্নদাশঙ্কর। সবাইকে ফোন করে বলতে লাগলেন, ‘খবর শুনেছ? বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। রেডিয়ো শুনে দ্যাখো তো যুদ্ধ চলছে কিনা। কারা জিতছে, কারা হারছে জানাও আমাকে।’

এক অদ্ভুত উত্তেজনায় গ্রীষ্ম পেরিয়ে শুরু হলো বর্ষা। অন্নদাশঙ্কর আমাকে বললেন, ‘রাশিয়াতে শীতের চোটে নেপোলিয়নকে পিছু হটতে হয়েছিল, হিটলারকেও হটতে হয়েছিল। বাংলায় বর্ষা মানে রাশিয়ায় শীত। এবার পাকিস্তানিরা জব্দ! দ্যাখো-না এবার কী হয়।’ অধীর আগ্রহে দিন কাটতে লাগল। সেক্টরে সেক্টরে পাকিস্তানিদের পরাজয়ের খবরে বাড়িতে সপ্তাহে সপ্তাহে ভোজের আয়োজন। দীপাবলিতে পরিচারকদের বললেন, ‘আলো দিয়ে বাড়ি সাজাও।’ ডিসেম্বরে নিয়াজির আত্মসমর্পণে অজয়কে টাকা দিয়ে বললেন, ‘যেখান থেকে পারো, বাজি কিনে আনো।’ এসব ব্যাপারে ওস্তাদ ছিল পরিচারক অজয়। অর্ধেন্দু আমাকে বলল ফোনে, ‘দাদু পাগল হয়ে গেছেন – শীঘ্রি আসুন।’ গিয়ে দেখি, হাসিমুখে ফুলঝুড়ি পোড়াচ্ছেন, সারা মুখে খুশির আলো। অর্ধেন্দু-অজয় দেখাল, নতুন সোয়েটার পরেছে তারা। ‘দাদু দিয়েছেন।’

আমার সঙ্গে দেখা হতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন, ‘এটা মঞ্জুর শাড়ি। কিন্তু চিমন্তা যাচ্ছে না – মুজিব তো এখনো পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি।’

ঘটনা এই যে অনেক পাকিস্তানি সেনা, ক্যাপ্টেন, মেজর সেনাবুদ্ধিতে মুজিবকে মেরে ফেলতে চাইলে ভুট্টো বাধা দিয়ে বোঝান, এখানে মুজিবকে মারলে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়াজি ও শত শত সেনাকে  মুক্তিযোদ্ধারা মেরে ফেলবে আর পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা আমাদের মেরে ফেলবে। ফলে মুজিবুর বেঁচে যান। ভারতের ইন্দিরা গান্ধী মুজিবকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন কলকাতায়। তারপর মুজিব ঢাকায় গিয়ে আওয়ামী লীগের সর্বময় কর্তৃত্ব পান।

১৯৭২-এ অন্নদাশঙ্কর প্রথম গেলেন স্বাধীন বাংলার ঢাকায়। মুজিবুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ  – করমর্দন  – আলিঙ্গন। আবার ১৯৭৪-এ ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা হিসেবে অন্নদাশঙ্করের ঢাকা সফর।

পরের বছরেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ক্ষমতালোভী স্বার্থপর হিংস্র ডালিমের চক্রামেত্মর শিকার হলেন মুজিবুর। অন্নদাশঙ্কর হতবাক – স্তম্ভিত – কেঁদে আকুল। ‘কাঁদো প্রিয় দেশ’ লিখে পাঠালেন আনন্দবাজার পত্রিকায়। আনন্দবাজার পাঠাল সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রীকে। সিদ্ধার্থশঙ্কর সেটার ইংরেজি অনুবাদ করে পাঠালেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে। ভারতীয় উপমহাদেশ শঙ্কিত অনিশ্চয়তায়। ইন্দিরা গান্ধী চিঠি দিলেন অন্নদাশঙ্করকে।

 

New Delhi

September 24, 1975

 

Dear Shri Ray

The Chief Minister of West Bengal has sent me a copy of your article on recent events in Bangladesh and I have had it translated. It is deeply mouring and has a hard core of reliable analysis. You are aware of the high regard in which we held Sheikh Mujib and our revulsion at the gruesome assassination of the entire family. However, we must think of the repurcussions of anything that is said or done here. Lest we be misrepresented, we should modulate our public reaction to events in a neighboring country with the utmost care. What a person of your position in the literary world says will have far-reaching impact and I am sure that you would not like to cause us any embrrassment.

Yours sincerely

Indira Gandhi