সুরজিৎ দাশগুপ্ত

  • স্মৃতির দর্পণে

    স্মৃতির দর্পণে

    ১৯৩৭ সালে আমার মা অশ্রুবালা দাশগুপ্তকে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে লেডি ডাক্তার হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়। কোয়ার্টারও দেওয়া হয় হাসপাতাল-লাগোয়া। হাসপাতাল আর কোয়ার্টার্সের মধ্যে হাতদুয়েক দূরত্ব। হাসপাতালের দোতলায় ছিল লেবার ওয়ার্ক। ডেলিভারি কেসের সময় হলে ওয়ার্ডের জানালা খুলে নার্সরা চিৎকার করে বলতেন, ‘মেমসায়েব, মেমসায়েব, এবার আসুন, টাইম হয়ে গেছে।’ একদিকে হাসপাতাল, অন্যদিকে একটা মক্তব, মুসলমান বস্তি। সামনে…

  • বেঁচে থাক ১৯৭১

    বেঁচে থাক ১৯৭১

    আমি তখন জলপাইগুড়ি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের পরীক্ষার ফাইনাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। সেটা ১৯৫২ সাল। সেবার এপ্রিল মাসে গরমের সময় অন্নদাশঙ্কর এলেন দার্জিলিংয়ে। জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিং মাত্র তিন-চার ঘণ্টার পথ। আমরা গেলাম দু-তিনজন বন্ধু। যে-অন্নদাশঙ্করকে দেখেছিলাম শান্তিনিকেতনে ধুতি-পাঞ্জাবিতে, তিনি দার্জিলিংয়ে স্যুটবুটের সাহেব। নানা কথা প্রসঙ্গে, বোধহয় বাংলা সাহিত্য ও ভাষা প্রসঙ্গে, উঠল একুশে ফেব্রুয়ারির কথা।…

  • এক পরিক্রমা কথা

    এক পরিক্রমা কথা

    ১৯৫০-এর জুন মাসে দার্জিলিংয়ে ‘বনলতা সেনে’র সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ এটুকু পড়ে পাঠক অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই। তাহলে খুলে বলি। ১৯৫০-এ গরমের সময় মা ও দাদার সঙ্গে আমরা জলপাইগুড়ি থেকে দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলাম। তখন দারুণ ধস হয়। ধসে সব পথঘাট বন্ধ হয়ে যায়। কিছু করার নেই। আমি কাছের একটা বইয়ের দোকান…

  • দৃশ্যাবলি : অন্নদাশঙ্কর

    দৃশ্যাবলি : অন্নদাশঙ্কর

    জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ১৯৪৮ সালে পড়ার সময় ক্লাসে একটি ছেলে আসে, আমার সহপাঠী হয়, সেন্ট্রাল ব্যাংকের ম্যানেজারের ছেলে। তার জন্মদিনে আমাকে নেমন্তন্ন করে। সেদিন তার বোনের সঙ্গেও আলাপ হয়। ভাইবোনে মিলে আমার মাথা খারাপ করে দেয় ছেলেমেয়ের শরীর নিয়ে নানা কথা বলে। তারা আমার বয়ঃসন্ধির অভিশাপ। কোনোমতে নবম শ্রেণিতে উঠি। নবম শ্রেণিতে সহপাঠী…

  • কালের বিচার

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত কয়েক বছর হায়দ্রাবাদে কাটিয়ে সুরজিৎ ফিরল কলকাতায় নিজের বাড়িতে, বিষণ্ণ, ভগ্নস্বাস্থ্য। এই সেই বাড়ি যেখান থেকে প্রিয়তমা গিয়েছিল হাসপাতালে, আশা করেছিল শীঘ্রি ফিরে আসবে, ফিরে এলো শীতল নিথর দেহ। আজ এসে দেখল, বাড়ির সামনে জটলা। কীসের ভিড়? একজন বলল, ‘ওই দাড়িওয়ালা সুরজিৎ গতরাত্রে মারা গেছে।’ ‘কোন সুরজিৎ?’ ‘ওই যে লিখত-টিখত – বইটই আছে।’…

  • আবার সঞ্চয়িতা পড়তে পড়তে

    আবার সঞ্চয়িতা পড়তে পড়তে

    এক তরুণ কবি ১২৮৯ বঙ্গাব্দের ভোরের সূর্যোদয় দেখতে দেখতে অনুভব করলেন তাঁর চারদিকে যেন কঠিন কারাগার, লিখলেন, ‘ওরে, চারি দিকে মোর/ এ কী কারাগার ঘোর -/ ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত র্ক।/ ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি,/ এসেছে রবির কর ॥’ সেদিন কবি ওই সূর্যোদয় দেখেছিলেন কলকাতা মহানগরীর সদর স্ট্রিটের বারান্দা থেকে। আবার…

  • অশোক মিত্র স্মরণে

    প্রবাসে ঘনায় শোক চলে গেছে আপনার লোক। পড়ে আছে স্বপ্নগুলো কিছু তাজা কিছু বা হয়েছে ধুলো। তাজাগুলো ফুটবে কি ফুলে নাকি লোকে ক্রমে ক্রমে যাবে ভুলে? বৈশাখী ঝড়ে কিছু গেছে ঝরে কিছু আছে কারো কারো হৃদয়ের ঘরে, কিছু আছে আমার প্রবাসে।

  • ঈশ্বরী স্মরণে

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত   বাঁচাটাকে যারা গড়ে তুলেছিল মহৎ শিল্পকার্য তারাও যখন চলে যায় সব দেখা-শোনা-ছোঁয়া ছাড়িয়ে সত্যি কি তারা পৃথিবীর কাছে একেবারে যায় হারিয়ে? এটাই তা হলে সত্যের শেষ ভাগ্যের দ্বারা ধার্য?   দিন পরে দিন বাঁচার লড়াই কষ্টের বড়ো নেহাতই। এর চাকা থেকে মুক্তি কোথায় মস্ত একটা ভাবনা উত্তর বহু মহাজন করেছেন কত সাধনা…

  • সাতাশ জুলাই

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত সূর্যদেব যখন আকাশ জুড়ে সেই এক জুলাই-দুপুরে মৃত্যু বের হলো তার নিষ্ঠুর শিকারে – কখন ঝাঁপাবে কার ঘাড়ে, কার টুঁটি টিপে ধরে টুঁ শব্দটি না করে বিদ্যুৎ ঝলকে চতুর চিতার মতো পালাবে পলকে। সেই মৃত্যু খুঁজে খুঁজে এসে পেল কি না মনুয়াকে শেষে!

  • আমার প্রিয় সাহিত্যকৃতি

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত স্কুলবেলাতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। আগুন নিয়ে খেলা। যেটা অবাক করেছিল সেটা লেখার কায়দা। একদিন গল্প শুরু হয়েছে। তারপর গল্প পেছিয়ে গেছে একদিন একদিন করে। এইভাবে ছদিনের কাহিনি। আধুনিক প্রজন্ম, মানে যারা বর্তমানের ভালোলাগাতেই বিশ্বাস করে, সম্পর্কের স্থায়িত্বে বিশ্বাস করে না, তেমন দুটি তরুণ-তরুণীর যৌবনোচ্ছল জীবনের একখ–র কাহিনি। কী ঝরঝরে লেখা! লেখার…

  • কাছের মানুষ সুনীতিকুমার

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত সাল ১৯৪৮, স্থান জলপাইগুড়ি জেলা স্কুল, জানালা দিয়ে দেখা যায় সবুজ ধানক্ষেতের ওপারে তিস্তার সাদা বালির চর, তার পরে রোদ্দুরে চিকচিক জলস্রোত। একদিন আমাদের ক্লাসে বাংলার শিক্ষকের বদলে ইংরেজির শিক্ষক রমেশ গুপ্ত ভায়া, রাগী বলে তাঁর নাম ছিল, থাকতেন স্কুল চৌহদ্দির লাগোয়া বাড়িতে। রমেশ-স্যার এসেই একটা বড়মাপের বই থেকে ডিকটেশন দিলেন। ক্লাস শেষ…

  • কাছের মানুষ অন্নদাশঙ্কর

    সুরজিৎ দাশগুপ্ত আমার তখন সেই বয়স যখন নরনারীর রহস্যময় সম্পর্ক নিয়ে কৌতূহল জাগতে শুরু করে। পড়ি জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে। হাতে আসে অন্নদাশঙ্কর রায়ের আগুন নিয়ে খেলা। পড়ে তাঁর আরো বই পড়ার জন্য উৎসুক হই। সহপাঠী গোপাল চক্রবর্তীর বাড়িতেই ছিল তেলিপাড়া লাইব্রেরি। গোপাল এনে দিলো অন্নদাশঙ্করের দুখানি বই, জীবনশিল্পী ও পথে প্রবাসে। উপন্যাস নয়, একটি প্রবন্ধের…