স্মৃতির দর্পণে

১৯৩৭ সালে আমার মা অশ্রুবালা দাশগুপ্তকে জলপাইগুড়ি হাসপাতালে লেডি ডাক্তার হিসেবে চাকরি দেওয়া হয়। কোয়ার্টারও দেওয়া হয় হাসপাতাল-লাগোয়া। হাসপাতাল আর কোয়ার্টার্সের মধ্যে হাতদুয়েক দূরত্ব।
হাসপাতালের দোতলায় ছিল লেবার ওয়ার্ক। ডেলিভারি কেসের সময় হলে ওয়ার্ডের জানালা খুলে নার্সরা চিৎকার করে বলতেন, ‘মেমসায়েব, মেমসায়েব, এবার আসুন, টাইম হয়ে গেছে।’
একদিকে হাসপাতাল, অন্যদিকে একটা মক্তব, মুসলমান বস্তি। সামনে রোটান্ডা গাছের বেড়া। বেড়ার ওধারে মাটির নালা, সারাক্ষণ তিরতির করে জল বইত। নালার পাশে চওড়া পাকা পিচের রাস্তা। রাস্তার এক প্রান্তে জেলা শাসক, জেলা বিচারক, আদালত, সার্কিট হাউস, তিস্তা নদী, অন্য প্রান্তে রাজবাড়ির মস্ত দিঘি এবং আরো এগিয়ে, মাঠঘাট ছাড়িয়ে চা-বাগান। এসব জেনেছি জেলা স্কুলে পড়ার সময়, মানে ১৩-১৪ বছর বয়সে।
চওড়া পিচের রাস্তার ওধারে জ্যাকসন মেডিক্যাল স্কুল, মড়াকাটা ঘর ইত্যাদি। মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে লাগোয়া মস্ত মাঠ, এই মাঠ ও পিচের রাস্তার মাঝখানে ডিমের আকারে ঝিল। ঝিল ও মাঠের পাশে পিঙ্ক ক্যাশিয়া গাছ ও সারি সারি শিরীষগাছ। এসব সেই ব্রিটিশ আমলের পরিবেশের বর্ণনা। এখন এসব ছবি নিশ্চয়ই একেবারে পালটে গেছে। করলা নদীর পাড়ে ব্রাহ্মসমাজের মন্দির। ১৯৬২ নাগাদ বেহাত। বাবা বলেছিলেন, ওই মেডিক্যাল স্কুলে যাবে না। আমার দৌড় ছিল ওই বস্তি-মক্তব পর্যন্ত। বারণ ছিল সামনের রাস্তার ওদিকে যাওয়া। বাবা প্রতি রোববার আমাদের দু-ভাইকে ব্রাহ্মসমাজে নিয়ে যেতেন।
একদিন খুব বৃষ্টির পর সামনের নালা জলে ভরে উঠে কলকল করে জল বইতে লাগল। বস্তির ছেলেমেয়েরা লাল গামছা পেতে নালার জলে কুচো মাছ ধরতে লাগল। তারপর একটি ছেলে, আমার দাদার বয়সী, একটা বাতা নিয়ে নালার জলে নেমে পড়ল। তার নাম ভুলে গেছি। আবদুল, আবদুর কিছু হবে। আমার কৌতূহল হলো – বাতা নিয়ে সে কী করে। দেখলাম, সে হঠাৎ বাতাটা গুঁজে দিলো নালার জলে। তারপর জলে হাত ডুবিয়ে সে কী-একটা তুলল। ঠাহর করে দেখলাম, তুলেছে একটা ছোট কাঁকড়া।
এভাবে আরো কয়েকটা কাঁকড়া ধরল। ভালো করে দেখে বুঝলাম নালার মধ্যে কুচো মাছ ছাড়াও ছোট কাঁকড়া আছে। কাঁকড়ার গর্তের মুখে যেই ছোট কাঁকড়া মুখ বের করে, অমনি ছেলেটা বাতাটা গর্তে গুঁজে দিচ্ছে, কাঁকড়াটা গর্তে ঢুকতে পারছে না, আটকে যাচ্ছে গর্তের মুখে, আর ছেলেটা ধরে ফেলছে, পুরে ফেলছে একটা কৌটোতে।
এই দেখে ও ব্যাপারটা বুঝে দাদার ফুটস্কেল নিয়ে এসে একই কায়দায় একটা কাঁকড়া ধরে ফেললাম। অমনি বাচ্চা কাঁকড়াটা আমার আঙুলে কামড়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে কাঁকড়াটা ফেলে দিলাম; কিন্তু রক্ত বেরিয়ে পড়ল।
অমনি বস্তির একটি মেয়ে কোথা থেকে এসে আমার রক্তাক্ত আঙুল মুখে পুরে চুষতে লাগল। যখন ছেড়ে দিলো তখন রক্ত বন্ধ। রক্ত বন্ধ হয়েছে দেখে আমার মুখে চুমু দিলো। মেয়েটি আমার চেয়ে কিছু বড়, ছেঁড়া জামা। ফুঁড়ে বুকে দুটি ফোঁড়া। তার নাম রেহানা বা সাবিনা – আজ আর মনে নেই।
আমার ভাব হয়ে গেল বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। ওদের সঙ্গে আমি মক্তবেও জমে গেলাম। জানলাম আলেফ, বে, তে, ছে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। ওদের সঙ্গে একদিন মেডিক্যাল স্কুলে গেলাম। একটা জায়গায় গিয়ে পেলাম একটা বদবু। কিসের এই দুর্গন্ধ? সেই বারান্দায় একটা লোককে দেখে আমরা জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওই বন্ধ ঘরে মড়াকাটা শেখানো হয় মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের (নাবালোগদের)।
লেডি ডক্টরস কোয়ার্টার্স, মেডিক্যাল স্কুল, ঝিল ছাড়িয়ে ডানদিকে তিস্তার দিকে একটু গেলেই ধরধরা নদী, তার ওপর একটা লোহার পুল, হাতবিশেক লম্বা পুল। পুল পেরোলেই হাকিমপাড়া। ধরধরার পুলে দাঁড়ালে ডানদিকে ধরধরার ধোবাপট্টি। ভোরে ধোবারা ধপধপ করে কাপড় কাচে। আমাদের কোয়ার্টার্স থেকে ভোরে ধপধপ আওয়াজ পেতাম বিছানায় শুয়ে। ধোবাপট্টির শেষে আরেকটি নদী – করলা নদী।
হাকিমপাড়ায় ঢুকে বাঁদিকে গেলে বিপুল ব্যানার্জির বাড়ি। বিপুল ব্যানার্জির বাড়ি ছাড়িয়ে আরো কিছুটা গেলে জেলা স্কুল। আমি মক্তবে কিছু শিখেছিলাম, বাবা বললেন, ওই মক্তবের শিক্ষা নাকি কোনো শিক্ষাই নয়। তার ওপর ওই বস্তির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অত মেলামেশা কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না। আমাকে নিয়ে মা ও বাবার অবনিবনা ছিল।
মা একদিন দাদার টিউটরের সঙ্গে আমাকে জেলা স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। কেন বাবার বদলে মণিকাকার সঙ্গে আমাকে পাঠানো হয় জানিনে। মণিকাকা আমাকে নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার মশায়ের কাছে। হেডমাস্টার পাঠিয়ে দিলেন ক্লাস থ্রির টিচারের কাছে। ক্লাস থ্রির টিচার আমাকে পেনসিল-কাগজ দিয়ে বললেন, ‘তোমার নাম লেখো।’ আমি লিখলাম আমার নাম, শ্রীবাস গুডম্যান, কিন্তু আরবি হরফে। দেখে মাস্টার মশায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী?’ আমার উত্তর শুনে মাস্টার মশায় বললেন, ‘এর তো অক্ষরজ্ঞানই হয়নি। পাঠশালায় নিয়ে যান, অক্ষর চিনিয়ে আনুন।’
মণিকাকা হাল ছাড়লেন না। আবার নিয়ে গেলেন হেডমাস্টার মশায়ের কাছে। হেডমাস্টার মশায় পেছনের আলমারি খুলে একটা মোটা বই খুলে বললেন, ‘এর মানে কী বলো তো – বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা।’
আমি কী বলেছিলাম, মনে নেই। তবে করলা নদীর ওপারে বাবা ও দাদার সঙ্গে দু-একবার ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে গানটা শুনেছি। হেডমাস্টার মশায়ের কথা শুনে আমি বললাম, ‘রবিঠাকুর।’ তিনি বললেন, ‘মাই গড।’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম বলো।’ আমি বললাম, ‘শ্রীবাস গুডম্যান দাশগুপ্ত।’ তিনি হা-হা করে হেসে উঠলেন। আসলে গুডফ্রাইডের দিন আমার জন্ম বলে বাবার মামা আমার নাম দিয়েছিলেন শ্রীবাস গুডম্যান।
হাসি থামিয়ে হেডমাস্টার মশায় বললেন, ‘তোমার দাদা রণজিতের সঙ্গে মিলিয়ে নাম দিলাম সুরজিৎ।’
ক্লাসটিচার বলেছিলেন আমাকে পাঠশালায় নিয়ে গিয়ে অক্ষরজ্ঞান করিয়ে নিতে। সেটা শুনে হেডমাস্টার মশায় বলেন, ‘ও যদি বস্তির ছেলেমেয়েদের দেখে আরবি শিখতে পারে তাহলে ক্লাসের ছেলেদের দেখে অ-আ, ক-খ, এ-বি-সি-ডিও শিখতে পারবে।’
১৯৪৩ সালে আমি জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে ভর্তি হলাম সুরজিৎ দাশগুপ্ত নামে। ১৯৪৬ সালে আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলাম। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সেকালে একটা নতুন ভাষা (classical language) শিখতে হতো। মৌলবি সাহেবের কাছে আরবি অথবা পণ্ডিতমশায়ের কাছে সংস্কৃত। পণ্ডিতমশায় রাধারমণবাবু। সেকেন্ড পণ্ডিত ছিলেন গোরক্ষকৃষ্ণ পাল। হেড পণ্ডিত রাধারমণবাবুর চোখের দিকে তাকালেই বুকের রক্ত জল হয়ে যেত। কিছুটা তাঁর চাউনির ভয়ে, আর কিছুটা আমার জানা বলে আমি আরবি পড়া শুরু করি।
এক রোববার বেলা এগারোটা-সাড়ে এগারোটায়, আমি যখন বস্তিতে খেলছি তখন দাদা এসে বললেন, ‘চলো, ডাকছে – বাঘ এসেছেন!’ আমি বাসায় এসে দেখি ‘বাঘ’ রাধারমণবাবু আর মা বাইরের ঘরে বসে জমিয়ে গল্প করছেন আর বাবা এককোণে একটা বই পড়ছেন। বাবার ছিল পড়ার নেশা, যেটা দাদারও ছিল।
আমি জানলাম অনেকগুলো কথা। পণ্ডিতমশায় রোজ সকালে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে জেলখানায় যান কয়েদিদের কাছে, ‘গীতা’ পড়ে শোনাতে। ফেরার সময় আমাকে এসে সংস্কৃত পড়াবেন। যেই তিনি বলেছেন ‘হিন্দুর ছেলে আরবি পড়বে, সংস্কৃত জানবে না!’ অমনি বাবা বই থেকে মুখ তুলে বললেন, ‘হিন্দু নয়, ব্রাহ্ম।’ আমাদের উপনিষদসম্মত ধর্মের জন্যও সংস্কৃত জানা প্রয়োজন – রাধারমণবাবু এসে জানিয়েছেন, আমি আরবি পড়ছি নতুন ক্লাসে। ঠিক হলো যে, আমাকে সংস্কৃত পড়িয়ে তিনি দ্বিপ্রাহরিক আহার আমাদের কাছে খেয়ে নিজের ডেরায় যাবেন।
যথারীতি আমি স্কুলে যাচ্ছি। আরবির ক্লাসও করছি, রোববার বাড়িতে সংস্কৃত পড়ছি। কয়েকদিন চলার পর জানলাম রাধারমণবাবু স্কুলে আসছেন না। – জ্বর হয়েছে। আমার কাছে কথাটা শুনে মা বললেন, ‘সর্বনাশ। একা মানুষ – টংয়ে একটা ঘরে থাকেন। নিজেই রেঁধে খান!’ মা লোক পাঠিয়ে তাঁকে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করে দিলেন। ম্যালেরিয়া হয়েছে। তাঁর আত্মীয়স্বজন থাকেন বগুড়ায়। গোরক্ষবাবুও বগুড়ার। তাঁর উদ্যোগে রাধারমণবাবুর মা ও এক ভাই জলপাইগুড়ি এলেন, মা তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করলেন স্টেশনের কাছে ডাকবাংলোয়।
রাধারমণবাবু সেরে উঠলেন। ভাত খেলেন। পরদিন ছাড়া পাবেন। শেষ কুইনাইন ইনজেকশন দিলেন মেডিক্যাল স্কুলের একজন স্টুডেন্ট। সেদিন রাত্রে মায়ের কাছে একজন ওয়ার্ডবয় এসে জানাল, মায়ের রোগী কাতরাচ্ছেন, কাঁপছেন আর ‘মা’, ‘মা’ করছেন। শুনেই মা ছুটলেন হাসপাতালে। ডেপুটি সুপারও এসে রাধাবাবুর বেড চাদর দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন। মাকে বললেন, ‘মনে হচ্ছে সিরিয়াস কেস, ওঁর রিলেটিভদের খবর দিন।’
মাঝরাতে সব শেষ। এবার শ্মশান। রাধাবাবুর ভাই আমার মাকে বললেন, তিনি শ্মশানে গেলে ভালো হয়।
রাধাবাবুর ভাই, মা, আর আমার মা যাবেন। আমি বায়না ধরলাম, আমিও যাব। আমার বাবা বললেন, ‘না, ছোট ছেলেরা শ্মশানে যায় না।’
কিন্তু মা বললেন, ওর জন্যই পণ্ডিতমশায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। গোরক্ষবাবুও আমার শ্মশানে যাওয়ায় মত দিলেন।
মা ও আমি একটা রিকশায়, রাধাবাবুর মা ও ভাই একটা রিকশায়, আর একটা রিকশায় গোরক্ষবাবু ও হেডমাস্টার তামসবাবু – এভাবে আমাদের শ্মশানযাত্রা।
শ্মশানে সমস্যা হলো, কে মুখে আগুন দেবে! রাধাবাবুর ভাই ও গোরক্ষবাবুর ইচ্ছায় আমি মুখে আগুন দিলাম।
চিতা জ্বলে উঠল দাউদাউ করে। মিনিটখানেক পরে পণ্ডিতমশায়ের শব বুকের ওপরকার কাঠগুলো ফেলে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল। সবাই হতবাক। এ কি ভুতুড়ে ব্যাপার! শ্মশানের ডোমেরা ছুটে এলো বাঁশ হাতে। বাঁশ দিয়ে ঠেলে ঠেলে চিতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শবটাকে আবার শুইয়ে দিলো।
তারা কাজ সেরে জিজ্ঞেস করল, ‘টিটেনাস কেস নাকি – টিটেনাস কেস কভি কভি এয়সা – ?’
বলতে ভুলে গেছি, হেডমাস্টার মশায়ের নাম তামসরঞ্জন রায়। পণ্ডিতমশায়ের শেষকৃত্যের পরে তামসবাবু আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে আর আরবি পড়তে হবে না, তুমি গোরক্ষবাবুর কাছে সংস্কৃতই পড়ো। শুনেছি রাধারমণবাবু তোমাদের বাড়ি গিয়ে তোমাকে সংস্কৃত পড়াতেন।’
ফলে আমার আরবি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। আমি গোরক্ষবাবুর কাছে সংস্কৃত পড়া শুরু করলাম। ক্লাস সিক্সের অ্যানুয়াল এক্জামিনে কোনোমতে পাশ করলাম
সংস্কৃতে, উঠলাম ক্লাস সেভেনে।
সেভেনে আমাদের ক্লাসে এসে ভর্তি হয় প্রণব ঘোষ। তার চেহারা দেখে বোঝা যায় তার বাবা বা মা নেপালি। বেশ ফর্সা। কী ব্যাপারে যেন তার সঙ্গে হরিপদর ঝগড়া থেকে হাতাহাতি। মারামারিতে আমার রুচি না থাকলেও কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল বস্তির বন্ধুদের দৌলতে। হরিপদ এমনিতেই একটু ষ-া ছিল, কিছু না জেনেই আমি প্রণবের পক্ষ নিই। এভাবে ভাব হলো প্রণবের সঙ্গে। প্রণব তার জন্মদিনে আমাকে নিমন্ত্রণ করে। তার বাড়ি গিয়ে দেখলাম তার মা সত্যিই নেপালি, বাবা সেন্ট্রাল ব্যাংকের ম্যানেজার। প্রণবের বোন শকুন্তলা আমার বয়সী, মানে প্রণব আমার চেয়ে একটু বড়। প্রণবের জন্মদিনের ভোজনটা দারুণ হয় – মাংস, পোলাও, চিংড়ির মালাই ইত্যাদি, সঙ্গে একটা নতুন জিনিস যার নাম মোমো – ওটা নাকি টুকলুর (প্রণবের ডাকনাম) খুব প্রিয়।
খাওয়ার পরে টুকলু ও পিয়া (শকুন্তলার ডাকনাম) আর আমি তিনজনে ওদের বাবা-মায়ের ঘরে গিয়ে বড় খাটে শুলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে। কে যেন আমার প্যান্টের ভেতর হাত ঢুকিয়েছে। দেখি – আর কেউ নয়, পিয়া। ‘কী করছ?’ জিজ্ঞেস করাতে বলল, ‘দেখছি কলাটা আছে কিনা।’ টুকলু ঘুম ভেঙে বলল, ‘লজ্জার কিছু নেই। বেটা ছেলের কলা থাকে, মেয়েদের কী থাকে জানো?’ তারপর পিয়াকে বলল, ‘দেখাও তোমার কী আছে?’
পরদিন আমি ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসলাম হরিপদর পাশে। হরিপদ জিজ্ঞেস করল, ‘আজ এখানে যে?’ আমি আগের দিন প্রণবের বাড়িতে কী হয়েছে বলতে পারলাম না। কাউকেই বলতে পারিনি, মাকেও না। কী দারুণ একটা বিচ্ছিরি তেতো অভিজ্ঞতা। প্রণব দুদিন পরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কলাটা ঠিক আছে তো?’ আমি কিছু জবাব দিতে পারলাম না। কিছুদিন পরে প্রণবের বাবা মালদহে বদলি হয়ে গেলেন। প্রণবও মালদহে চলে গেল।
ক্লাস এইটে শুনলাম দেশ স্বাধীন হবে তিন টুকরো হয়ে – দু-টুকরো পাকিস্তান, এক বড় খণ্ডেইন্ডিয়া।
বস্তিতেও গিয়ে শুনলাম সাত্তার বলছে, ‘লড়কে লেগা পাকিস্তান।’ তার মানে কী বুঝলাম না। কিন্তু বুঝলাম আস্তে আস্তে – বস্তির বন্ধুরা একে একে কোথায় চলে গেল। স্কুলের থেকে বাড়িতে এসে সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। একা একা ঘুরে বেড়াই মেডিক্যাল স্কুলে, মড়াকাটার ঘরের বারান্দায়। কোনোদিন তিস্তার কিং সাহেবের ঘাটে কোর্ট-ট্রেজারি নিঝ্ঝুম। ট্রেজারির সামনে বিহারি চৌকিদাররা উনুন জ্বেলে রান্নাবান্না করে। আর একদিন স্টেশনের কাছে দেখা হয়ে গেল নিমুর সঙ্গে। নিমু মানে নির্মল সান্যাল। সে আমার সহপাঠী; কিন্তু আমাদের ক্লাসের নয়, এক ক্লাস ওপরে পড়ত, ফেল করে আমার ক্লাসমেট হলো। নিমুর দিদি অরুণা সান্যাল জলপাইগুড়ির বিখ্যাত নেত্রী। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর পরম ভক্ত।
নিমু বলল, ‘আরে সুরজিৎ, চলো, স্টেশনের ভেতরে যাই, নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস আসার টাইম হয়ে গেছে। কে নামল, কে গেল, গিয়ে দেখি – কত লোক নামে, কত লোক ওঠে। বেশ লাগবে।’
‘এই এক্সপ্রেস কোথায় যাবে?’ জিজ্ঞেস করি।
বলল, ‘পাকিস্তান – থুরি ফাঁকিস্থান হয়ে শেয়ালদা।’
পাকিস্তান বা ফাঁকিস্থান, যা-ই হোক, শুনে আমার মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। বস্তির বন্ধুদের কথা মনে পড়ল। কত বড় জায়গা পাকিস্তান? ওই বস্তির মতো? না, হাকিমপাড়ার মতো? না, জলপাইগুড়ি শহরের মতো? ভাবতে ভাবতে ট্রেনে উঠে পড়লাম। নিমুকে বললাম, ‘তুমি যাও, আমি পাকিস্তান যাচ্ছি।’
উঠে পড়লে নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস বাঁশি বাজিয়ে হুসহুস করে চলতে শুরু করল। প্রথমে বাইরের মাঠ, ক্ষেতের গাছগুলো ফেলে, তারপর দেখি মাঠ, ক্ষেত, বাঁশঝাড় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছে। দিনের আলো নিবে এলো। আবছা অন্ধকার গাড়ির ভেতরে। একটা স্টেশন – হলদিবাড়ি। স্টেশনে টিমটিম আলো জ্বলছে। গাড়ির ভেতরে মিটমিটে আলো জ্বলে উঠল। ট্রেন চলতে লাগল। বাইরের অন্ধকার আমাদের সঙ্গে চলতে লাগল। একটা জায়গায় থামল। বাইরে লোকের আওয়াজে বুঝলাম যে, একটা স্টেশন এসেছে। খাকি পোশাক পরা কয়েকটা লোক উঠে টর্চ জ্বেলে গাড়ির ভেতরের সবকিছু দেখতে লাগল। আমার মুখে টর্চ ফেলে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ‘এই পোলা, কোথায় যাবি?’ বললাম, ‘পাকিস্তান।’ লোকটা হাসল। তারপর কালো কোট গায়ে একজন দাড়িওয়ালা লোক টিকিট দেখা শুরু করল।
কালো কোটের সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দেওয়া সত্ত্বে শুধু আমার টিকিট নেই বলে আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে টেনে নামিয়ে নিয়ে গেল একটা ঘরে। সেখানে বসে ছিল আরেক কালো কোট, তারও গালভরা দাড়ি। চেয়ার-টেবিলে সে কিছু করছিল। টিকিটওয়ালা কালো কোট বলল, ‘মাস্টারসাব, এই পাজি মালাউন বেটাকে আজ গুদামঘরে আটকাইয়া রাখেন। কাল কোনো টেরেইনে জলপাইগুড়ি ফেরত করেন।’
এবার আমি গুদামঘরের ঘুটঘুটে অন্ধকারে বন্দি। শুধু মশার গুনগুনানি। সারা গা জ্বলে যাচ্ছিল। বেশকিছু পরে একটা ট্রেন গেল মাটি কাঁপিয়ে। একটু পরে গুদামঘরের দরজা খুলে এলেন মাস্টারসাব। হাতে লণ্ঠন। বললেন, ‘আসো।’
স্টেশনের পেছনে কচুবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে এসে একটা ঘর। লণ্ঠনের আলোতে যেটুকু আলো, তাতে যেটুকু দেখা যায়। একটা কুয়ো, কুয়োপাড়ে দড়ি, বালতি, বদনা। দুজনে হাত-মুখ ধুয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মোটা চালের ভাত, ডাঁটাশাক, লংকা দিয়ে খেয়ে মশারিতে ঘুম দুজনে। ঘুম ভাঙলে দেখি মাস্টারসাব আমাকে কী-একটা জিনিস, তেতো জল খাওয়াচ্ছেন।
আমি নাকি তিনদিন ধরে জ্বরে বেহুঁশ হয়ে ছিলাম। স্টেশনের ঘণ্টা বাজানোর বা কাউকে বসিয়ে চাকরিতে যেতেন মাস্টারসাব। আরো দুদিন কাটলে তিনি একটা শিলিগুড়িমুখো মালগাড়ির গার্ডের কাছে আমাকে জমা দিলেন। গার্ডসাহেব আমাকে জলপাইগুড়িতে নামিয়ে দিলেন।
মায়ের কোয়ার্টার্সে এসে দেখি, মা আর গণেশমামা (ড. গণেশ রায়) আর ধীরেন মামা (ড. ধীরেন লাহিড়ি) জল্পনা করছেন। শুনলাম, গণেশ মামা থানায় গিয়েছিলেন, থানা বলেছিল দশদিন দেখে যা করণীয় তা করবে।
স্কুলে গিয়ে দেখি, অনেকেই জেনে গেছে, আমি বাড়ি পালিয়েছি। ক্লাসে একটি নতুন ছেলে এসেছে – অলক ব্যানার্জি। শহরে নতুন ডিসির (ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার) ছেলে। ডিসির নাম হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায়।
অলক আমাকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে প্রবাসে পড়তে দেয়। নিমু আমাকে পড়ায় শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত।
হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায় জলপাইগুড়ির ঝিমিয়েপড়া ব্রাহ্মসমাজকে চাগিয়ে তোলেন। নিজে ব্রাহ্ম ছিলেন না, কিন্তু ব্রাহ্মসমাজে রোববার রোববার উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
এই সময় মায়ের নামে একটা রহস্যময় চিঠি আসে – পরাজিত জাপান সরকার জানতে চায় – মা পরাজিত জাপানের এক দম্পতির দায়িত্ব নিতে রাজি কিনা। মা বুঝলেন, বড় মাসিমা হরিপ্রভা তাগেদা ও মেসোমশায়ের কথাই জানতে চেয়েছে ইন্ডিয়ার এক্সটারনাল মিনিস্ট্রি। মা গিয়ে দেখা করলেন ডিসির সঙ্গে। ডিসির সৌজন্যে সব ব্যবস্থা সহজে হলো। কিন্তু তাগেদা দম্পতি আসার আগেই ডিসি বদলি হলেন।
হরিপ্রভা তাগেদা বুড়ি হলেও শক্ত ছিলেন, ওয়েমন তাগেদা নড়বড়ে বুড়ো। ‘তোজো হেরে গেছে’, ‘তোজো হেরে গেছে’ বলে কাঁদেন থেকে থেকে।
বলতে ভুলে গেছি, ১৯৪৭-এ ভারত স্বাধীন হয়, সে-বছরেই দাদা রণজিৎ ম্যাট্রিক দেন, দাদার ম্যাট্রিকের পরই বাবা অন্য নারীকে নিয়ে কোথায় চলে যান, পরে জানতে পারি ধানবাদে কোল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চাকরি করেন। জলপাইগুড়িতে ‘লেডি ডাক্তারের স্বামী’ পরিচয় তাঁর বেশিদিন পছন্দ হয়নি। হয়তো নিজস্ব পরিচয় পেয়েছিলেন ধানবাদে।
বড় মেসোমশায় ওয়েমন তাগেদা তখন মাকে ‘খুকি’ বলে ডাকেন। মায়ের সেবাযতেœ বেশ সুস্থ হন। কিন্তু ঘর থেকে সিঁড়ি দিয়ে একা নামতে গিয়ে পড়ে যান ও তাতেই মৃত্যু।
ওদিকে হেডমাস্টার তামসরঞ্জন রায়ও ১৯৪৮-এ বদলি হন। বদলির মুখে তিনি একটা নতুন পরীক্ষা করেন বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে। পরীক্ষার সময় কোনো শিক্ষক পাহারা দেবেন না, পরীক্ষার্থী ইচ্ছামতো বইপত্র দেখে উত্তর দিতে পারে, মানে নকল করতে পারে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে পারবে না কাউকে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর লিখতে হবে।
তামসবাবু বদলির ঠিক পরেই হিরণ¥য় বন্দ্যোপাধ্যায় ডিসি হয়ে আসেন। হেডমাস্টার হন জগদীশচন্দ্র বসু। তামসবাবুর প্রবল ব্যক্তিত্বের পরে তাঁকে ধূর্ত মনে হতো। তিনি যে অলককে খাতির করছেন এটা বেশ বোঝা যেত।
১৯৪৯ সালে একদিন দার্জিলিং মেল এলো। কামরায় কামরায় লাশ আর রক্ত। হইহই কা- শহরজুড়ে। শোনা গেল রেলকর্মীদের কাছে যে, সান্তাহার ছাড়ার পর ট্রেন থামাতে হয়, লাইনের ওপর তারা যেন দাঁড়িয়ে ট্রেন থামায়, তারপর ট্রেনে উঠে বেছে বেছে হত্যা ও লুট চালায়।
জলপাইগুড়ি স্টেশনের সাইডিংয়ের ওধারে একটা মাঠ ছিল। সেখানে ডোমেরা লাশগুলো নামিয়ে লরি লরি কাঠ এনে জ্বালায়, তার দুর্গন্ধ স্টেশনপাড়া ছাড়িয়ে বাবুপাড়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আমরা হাসপাতালপাড়ায়, হাকিমপাড়ায় টের পাইনি, শুধু লোকমুখে শুনি। আমিও তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। কিন্তু খবরে খুবই বিচলিত হই। স্কুলে বলাবলি করছিল যে, এবার শহরে দাঙ্গা বাধবে। অনেক গরিব মুসলমান পাকিস্তানে চলে গেলেও অবস্থাপন্ন অনেক মুসলমান থেকে গিয়েছিল। তারা শহরের গণ্যমান্য ছিলেন। সবাই বলছিল, এতদিন শহরে কোনো অশান্তি ছিল না। হিন্দু-মুসলমানে যথেষ্ট সম্প্রীতি ছিল। তবে পাকিস্তান থেকে লাশভর্তি ট্রেন আসার পর বাস্তবতার পরিবর্তন হয়। দাঙ্গা বাধবে – কিন্তু কবে? কেউ কেউ বলল, দোলের সময় দাঙ্গা হতে পারে বলে আশঙ্কা। দোলের দেরি আছে। এই তো সবে শীত।
আমার সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা। সংস্কৃতেই আমার ভয়। নিমু বলল, ‘জাহ্নবী শাস্ত্রীর নোটবইটা পড়ো – সব সোজা হয়ে যাবে।’
মা হাসপাতাল থেকে ফিরতে আমি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নোটবই কিনতে চললাম। জলপাইগুড়িতে তখন বিখ্যাত বইয়ের দোকান ছিল নবাববাড়ির কাছে দত্ত ব্রাদার্স। সদাগরপট্টিতে। আমি বইটি কিনে বাড়ি ফিরছি। সদাগরপট্টি ছাড়িয়ে দিনবাজার। দিনবাজারের এককোণে মেওয়াওয়ালাদারের দোকান। দোকানগুলো ছাড়িয়ে ভেতরে মুদি, সবজি, মাছের বাজার।
কেউ বোধহয় মেওয়াওয়ালাদের দোকানের সামনে সাইকেল রেখে বাজারে গেছে, খেয়াল করেনি যে সাইকেলটা মেওয়াওয়ালাদের দোকানের মুখ আটকে দিয়েছে। দু-তিনজন মেওয়াওয়ালা (এরা সব কাবুলের লোক বা কাশ্মিরের লোক) ছিল। তাদের একজন দোকানে দাঁড়িয়ে সাইকেলওয়ালাকে চিৎকার করে ডাকছে। হঠাৎ রাস্তা থেকে কে একজন লাফিয়ে উঠে মেওয়াওয়ালার পেটে ভোজালি চালিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে দিলো। কারা ‘খুন’, ‘খুন’, ‘দাঙ্গা’, ‘দাঙ্গা’ বলে হল্লা জুড়ে দিলো। শুরু হলো ছোটাছুটি, পাশের দোকান, মিষ্টির দোকান – ঝপাঝপ ঝাঁপ বন্ধ করল।
আমি ছুটে বাড়ি এলাম। মা তখন জলপাইগুড়ির আনন্দ চন্দ্র কলেজের প্রিন্সিপালের স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমি গিয়ে শান্তি মাসিমাকে বললাম, ‘শিগগির বাড়ি যান, শহরে দাঙ্গা বেধেছে।’
জলপাইগুড়ির ডিসি তখন একজন আয়ার বা অয়েঙ্গার। বিকেলেই একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে মাইকে ঘোষণা এবং রাতে কারফিউ জারি হলো। চারদিনে দাঙ্গা বন্ধ হলো। মরল এক অন্ধ মুসলমান ভিখিরি, একজন মেওয়াওয়ালা, আমাদের স্কুলের দফতরি সোনামুদ্দিন। তার খুনটা দেখেছিল আমার সহপাঠী প্রসূন সেন। সোনামুদ্দিনকে কয়েকটা লোক ঘিরে ধরে বলে, ‘সোয়েটার খোল।’ সে তার সোয়েটার খুলছিল, সে-অবস্থায় তার পেটে ছোরা মারা হয়।
আশ্চর্যের বিষয়, ডিসি চারদিনে দাঙ্গা থামার পরই বদলি হয়ে যান, একজন বাঙালি ডিসি আসেন। একজন ব্যানার্জি, আইএএস।
আমি ম্যাট্রিক দিয়ে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে আনন্দচন্দ্র কলেজে ভর্তি হলাম। নিমু চলে গেল কলকাতায় দাদার কাছে। আমি জলপাইগুড়ি কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হলাম। কিন্তু কম্বিনেশনে থাকল ম্যাথামেটিকস। ম্যাথামেটিকস নিলে হিস্ট্রি নেওয়া যায় না। বিএতে ও এমএতে হিস্ট্রিই আমার বিষয়।
আনন্দ চন্দ্র কলেজে আমার নতুন বন্ধু-বান্ধবী। কো-এডুকেশন কলেজ প্রথম থেকেই। দুজন বন্ধুর সঙ্গে এখনো যোগ আছে।