কষ্ট ও অহংকারের একাত্তর

১৯৭১ সালে আমি ঢাকার বাইরে গিয়েছি মাত্র দুবার । গিয়েছি আমার জন্মজেলা পাবনায় । জন্ম শহরতলিতেই; ফলে গ্রাম-গ্রামান্তরে গিয়ে গ্রামবাসীদের নির্যাতিত অত্যাচারিত হওয়ার কোনো ঘটনাই আমি প্রত্যক্ষ করিনি-একথা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি ।

কিন্তু স্বাধীনতালাভের ১৭ বছর পর বাংলা একাডেমীতে চাকরি করার সুবাদে আমি যখন কিছু কাজ করার দায়িত্ব পাই এবং একটার পর একটা কাজ করতেই হয়, তখন মনে হয়েছে ১৯৭১ সালে আমি সারা বাংলাদেশে ছিলাম – প্রত্যন্ত গ্রামে ছিলাম, জেলা শহরে ছিলাম, অজস্র পরিবারের দুঃখ-কষ্ট, শূন্যতা, হাহাকার আমি অনুভব করেছি, দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর আমি বাংলা একাডেমীতে যোগদান করে যথারীতি চাকরিই করেছি শুধু, মুক্তিযুদ্ধের কোনো কাজ আমাকে করতে হয়নি । যেন বাংলা একাডেমীর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুই করার ছিল না। ২৬ মার্চ আর ১৬ ডিসেম্বরে শুধু আলোচনা-সভা, একটু- আধটু গান, ওই পর্যন্তই ।

এই স্থবির অবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত করলেন মহাপরিচালক মনজুরে মওলা, পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল। দুজনই, আমি বলবো, স্বাধীনতার স্পর্শ প্রশ্নে মানুষের মর্মমূলে কাজ করেছিলেন; এই কাজটি করার সামান্য দায়িত্ব আমার উপরেও এসেছিল বলে দেখতে পাই আমারই পিতা-মাতা, ভাই-বোন, নিকটজন সারাদেশে জীবন উৎসর্গ করেছেন, ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, আমি অনেকের কথা জানি, অনেক ঘটনা আমার জানা, এমন বহু অভিজ্ঞতার কথা জেনেছি যা অবিশ্বাসকেও হার মানায়। কোনো সন্দেহ নেই, তাঁদেরই কথা বলতে হবে যুগের পর যুগ, যারা জীবন না দিলে বা আহত কিংবা পঙ্গু না হলে অথবা সম্মান না হারালে এই স্বাধীনতা আমি ভোগ করতে পারতাম না। তারা তো আসলে আমার স্মৃতিরই অংশ, আমার অস্তিত্বেরই ভিন্নরূপ। নইলে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সূচিত জগন্নাথ হলের হত্যাকা-ে বন্ধু প্রয়াত কালীরঞ্জন শীল যখন বলেন, অজস্র লাশ তাঁকে টানতে হয়েছে, টেনে টেনে এক জায়গায় স্তূপ করতে হয়েছে, তখনই মনে হয়েছিলো ওই বহনে আমিও ছিলাম, কারণ জগন্নাথ হলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রাবস্থায় অজস্র বন্ধু ছিলেন, আমি বহুবার গিয়েছি ওই হলে। আমার স্মৃতি দিয়েই দেখতে পাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কীভাবে সেই দেবতুল্য ড. গোবিন্দ দেবকে তাঁর বাংলো থেকে টেনে বের করে এনে জগন্নাথ হলের মাঠে গুলি করে হত্যা করছে। শিশুর মতো সহজ-সরল-নিষ্পাপ মানুষটিকে হত্যা করে জগন্নাথ হলের মাঠেই যখন মাটিচাপা দেয়, তখন অনুভব করি আমাকেই চাপা দিলো, আরো বহুজনকে চাপা দিলো। আমার স্মৃতি থেকে কী করে মুছি বিশ্ববিদ্যালয়-আবাসের পাশটিতে ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাকিস্তানিরা গুলি করলো । তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু হলো না, চারদিন পর মেডিক্যাল কলেজে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যে কয়টি বুলেট ড. ঠাকুরতার শরীর ভেদ করেছিল, সেগুলো পড়ে ছিল মেঝেতেই, পরে বাসন্তী গুহঠাকুরতা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিলেন, সেই স্মৃতি আমারও স্মৃতি হয়ে যায়। কারণ স্যারের সান্নিধ্যে আমার আসার সুযোগ হয়েছিলো। এভাবেই স্মৃতি প্রসারিত হতে হতে চলে যায় সেন্ট্রাল রোডে আমার শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর বাড়িতে; স্যার সকালে স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন, ঠিক সে-সময়ে আলবদর ঘাতকদের প্রবেশ । চলে গেলেন স্যার। তেমনি চলে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আরেক শিক্ষক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে মোফাজ্জল স্যার মালিবাগে ছোটভাই লুৎফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায় আশ্রয়ের জন্যে গিয়েছিলেন, আমি স্মৃতি দিয়েই দেখতে পাই ঘাতকরা সেখানেই গিয়ে তাঁকে চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির লাল গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল।

অসম্ভব স্নেহ পেয়েছি ইতিহাসের গিয়াস স্যারের কাছ থেকে। মুহসীন হলে হাউস টিউটর ছিলেন, যুদ্ধের কারণে হলে আর কেউ ছিল না, বরং নৃ তাদেরই পানির কষ্ট দূর করার জন্যে গিয়াস স্যার নিজে গিয়েছিলেন পানির পাম্প চালু করতে । সেখান থেকেই ঘাতকরা, দারোয়ানের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গেল। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের আমার দুই শিক্ষক রাশীদুল হাসান ও আনোয়ার পাশা চলে যেতে বাধ্য হন, আমার স্মৃতি তাঁদের অনুসরণ করে ফেরে। কী করে ভুলি মোর্তজা ভাইকে? বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার মোহাম্মদ মোর্তজার ঘাতকরা চোখ বাঁধে তাঁরই মেয়ে মিতির কাপড় দিয়ে, আমি চোখ বাঁধার দৃশ্য দেখতে পাই। দেখতে পাই আলবদরের ঘাতকরা শহীদুল্লা কায়সারকে চশমাটাও চোখে দিতে দিলো না। দেখি ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল খায়েরকে বাড়ির সামনে থেকে, সন্তোষ ভট্টাচার্যকে খাবার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে গেল, আমি দেখলাম, কিছুই করতে পারলাম না ।

স্বাধীনতা-লাভের আগে, তৎকালীন ন্যাশনাল বুক সেন্টার অফ পাকিস্তানে চাকরি করার সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবর রহমান সাহেবকে দেখেছি, র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজমে বিশ্বাসী অতি আধুনিক মানুষটিকে ঘাতকদের হাতে তুলে দিলেন ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। সে-সময়ে ড. হোসায়েন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ওই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরো দুই শিক্ষক মীর আবদুল কাইয়ুম ও সুখরঞ্জন সমাদ্দারকে ড. হোসায়েন বাঁচাননি; রাজশাহীরই অজস্র মানুষের স্মৃতির সঙ্গে আমার স্মৃতিও অমলিন হয়ে আছে রাজশাহীর পদ্মার তীরে, যেখানে মীর কাইয়ুমকে জীবন্ত পুঁতে ফেলেছিলো। খুলনা জেলার রংপুর গ্রামে আমি যাইনি, কিন্তু যখনই জানি ওই গ্রামের প্রফুল্লকুমার বিশ্বাসকেও জীবন্ত অবস্থায় মাটিচাপা দিয়েছিলো, তখনই বুঝি খুলনা আমার জন্মজেলা পাবনা হয়ে যায়, গ্রাম দোহারপাড়া গ্রাম রংপুর হয়ে যায়, প্রফুল্ল বিশ্বাস আমার স্কুলশিক্ষক হয়ে যান। হ্যাঁ, আমার স্কুল শিক্ষক শিবাজীমোহন চৌধুরীকে নিয়ে সর্বশেষ প্রত্যক্ষ স্মৃতি পাবনা শহরের রায়বাহাদুরের বাড়ির সামনে স্যার দাঁড়িয়ে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, স্যার ধুতি পরনে নয়; পাজামা-পাঞ্জাবিতে । ম্লান হেসে বললেন, হায়দার, আমি মুসলমান হয়েছি । শিবাজী স্যার হয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম, কিন্তু ধর্মান্ধ ঘাতকরা ইসলামের জ্যোতিকেও বাঁচতে দিলো না। আমার স্মৃতিতে স্যার চির উজ্জ্বল, এইটুকুই বলতে পারি ।

বাংলা একাডেমীতে চাকরিকালে স্মৃতি : ১৯৭১ সম্পাদনা করার সময়ে যখনই কোনো সূত্র পেয়েছি, জানতে চেয়েছি, শহীদ বুদ্ধিজীবী আর কারো কথা জানা আছে কিনা; আর এভাবেই জেনে যাই মাগুরার স্কুলশিক্ষয়িত্রী লুৎফুননাহার হেলেনকে কী নিষ্ঠুরভাবে জিপের পেছনে বেঁধে টানতে টানতে সারা শহর ঘুরিয়েছিল, জেনে যাই শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীনকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে নিয়ে গেল, তার লাশ পাওয়া গেল রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। আসলে ১৯৭১ সালে সমগ্র বাংলাদেশই ছিল বধ্যভূমি। সে-সময়ে আমার স্মৃতি ঘটনার সঙ্গে যুক্ত না হলেও পরে ঠিকই যুক্ত হয়ে একাকার হয়ে যায়, আমিও ঘটনার শিকার হয়ে যাই।

নইলে চট্টগ্রামে কু-েশ্বরী ঔষধালয়ের নূতনচন্দ্র সিংহ রাউজানের এক প্রভাবশালী পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক নেতার পুত্রের প্রতিহিংসাপূরণের শিকার হবেন কেন; চট্টগ্রামেরই ডাক্তার শফি একবার ছাড়া পেয়েও আবার কেন যেতে বাধ্য হন, এবং আর ফিরে আসেন না! আমি কি করে ভুলি পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুর কথা, কারণ ক্ষৌরকার রমণী শীল তাঁর মৃত্যুর যে-বিবরণ দেন তাতে স্পষ্টই বুঝি, আমি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেই ছিলাম এবং দেখতে পাচ্ছি, অত্যাচারে অত্যাচারে জর্জরিত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সোজা হয়ে হাঁটতে পারছেন না বলে হামাগুড়ি দিয়ে পায়খানা-প্রস্রাব করতে যাচ্ছেন। বুঝতে পারি তাঁর খুব বড় অপরাধের অধিবেশনে তিনি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বিরোধিতা করে বাংলা একটি হচ্ছে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের ভাষার পক্ষে কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানে মূলত সেদিন থেকেই ভাষা আন্দোলন শুরু। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আমার বাংলাকে বাঁচানোর মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন বলে আমি এখনো ধীরেন দত্তকে দেখি, তাঁর কথা শুনি, তাঁর প্রতিবাদে অংশী হই এবং তাঁর মৃত্যু অসহায়ের মতো শুধু দেখি আর দেখি । এবং এই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেই দেখি, কুমিল্লার ডি সি ও এস পিকে কী নৃশংসভাবে ওরা হত্যা করলো; দেখলাম, চোখের সামনে ক্যান্টনমেন্টের মাটি লাল হয়ে গেল ।

রাজশাহীতে শামসুননাহার মাহমুদের পুত্র মামুন মাহমুদ ২৬ মার্চ শহীদ হন, ওইদিন ছিলো মোশফেকা মাহমুদ ও তাঁর বিয়ের তারিখ। যশোরে আইনজীবী মশিউর রহমান পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারে বিকৃত মুখম-ল

মানুষের প্রতি যার সামান্য ভালোবাসা আছে, সে কি কখনো ভাবতে পারে ঠান্ডা মাথায় ওভাবে গণহত্যা করা যায়? ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ও ২৬ মার্চ দিনে জগন্নাথ হলের মাঠে যে-গণহত্যা চলে তার সামান্য কিছু অংশ ভিডিও করেছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর নূরুল উলা । সেই ভিডিও চিত্রেই আমরা দেখেছি পাকিস্তানি সেনারা ছাত্রদের কিভাবে গুলি করে মারছে।

নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন, ঢাকায় লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে এলিফ্যান্ট রোডের বাসার সামনেই গুলি করে মারে, পাবনায় আইনজীবী আমিনউদ্দিনকে মেরে গর্তে নিক্ষেপ করে, রাজশাহীর আইনজীবী বীরেন সরকার বুঝতেই পারেন না, শুধু হিন্দু হওয়ার জন্যে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। আমার স্মৃতিতে এঁরা সবাই আছেন, ওইদিন যেখানে-যেখানে যাদের হত্যা করা হচ্ছে, ঠিক সেখানে-সেখানেই আমি উপস্থিত থেকে দেখলাম, আমার আপনজনদের কিভাবে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। অমন হত্যাযজ্ঞ বাঙালি এর আগে কখনো দেখেনি। প্রথমে হতভম্ব হয়, প্রতিরোধ করতে পারে না, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে এই ভেতো বাঙালিই কেমনভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, সে- ইতিহাস আপনি জানেন, আমিও জানি।

মানুষের প্রতি যার সামান্য ভালোবাসা আছে, সে কি কখনো ভাবতে পারে ঠান্ডা মাথায় ওভাবে গণহত্যা করা যায়? ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাত ও ২৬ মার্চ দিনে জগন্নাথ হলের মাঠে যে-গণহত্যা চলে তার সামান্য কিছু অংশ ভিডিও করেছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর নূরুল উলা। সেই ভিডিও চিত্রেই আমরা দেখেছি পাকিস্তানি সেনারা ছাত্রদের কিভাবে গুলি করে মারছে। স্বাধীনতার পরে এই গণহত্যার দৃশ্য আমেরিকার একটি টেলিভিশনে দেখানোর আগে ঘোষণা দেয়া হয় কোনো বৃদ্ধ বা শিশু কিংবা অসুস্থ মানুষ যেন এই দৃশ্য না দেখেন। সেই টিভিতে দেখানোর পরদিন খবরের কাগজের খবর থেকে জানা যায়, অমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে বহু সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।

এই গণহত্যা নিয়ে পাকিস্তান সরকার একরকম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিল । টেলিভিশনে ওই মর্মান্তিক হত্যাকা- দেখে ওয়াশিংটনে তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতকে মার্কিন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন – এর পরেও কি বলতে চাও, পাকিস্তান কোনো গণহত্যা করেনি? রাষ্ট্রদূতের জবাব ছিলো, ওরা সবাই ছিলো ভারতীয় সৈনিক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চে, খোদ ঢাকা শহরে ভারতীয় সৈনিক – এই অবিশ্বাস্য কথা বলতে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের বাধেনি, যেমন বাধেনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে গণহত্যা করতে । নেত্রকোনার অধ্যাপক আরজ আলীকে হত্যা করেছিলো ওরা, তার জন্যে গায়েবানা জানাজা হলে পাকিস্তানি হানাদাররা জানাজায় অংশগ্রহণকারী ২০ জনকে ধরে নিয়ে এলো, লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারলো, আমি জোর গলায় বলছি সোমেশ্বরী নদীর তীরে দুর্গাপুরে সেই গণহত্যা ঘটলো আমার চোখের সামনে, আমি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থেকে সেই মর্মান্তিক মৃত্যুযজ্ঞ দেখলাম। ১৩ জুন ১৯৭১ তারিখে সৈয়দপুর থেকে যে-ট্রেনটি চিলাহাটির দিকে রওনা দেয় তার অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান। যাত্রীদের কথা দেয়া হয়েছিলো ভারতে পৌঁছে দেবে। কিন্তু এ তারা কোথায় পৌঁছলো? ৩৩৮ জনকে ট্রেনের মধ্যেই হত্যা করে ওরা, হত্যা করার আগে টাকা-পয়সা, সোনাদানা সব কেড়ে নেয়। যাত্রী ছিলেন ৪০০ জন, ৬২ জন ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়ে বেঁচে যান। আমি একবার শহীদদের দেখি, একবার আহতদের দেখি, প্রতিবারই আমার মনে হয়, এঁরা আমার এই ভাই, ওঁরা আমার ওই বোন!

কোথায় আমার ভাইবোন নেই? চট্টগ্রামের পাহাড়তলির আবদুল গোফরান অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়ে ফয়স লেকের ওপার থেকে দেখতে পান অবাঙালিরা কিছুক্ষণ পরপর ৫/৬ জন বাঙালির একটি দল নিয়ে আসে, তাদের হাত কাটে, পা কাটে, মাথা কাটে এবং লেকের জলে ফেলে দেয় । ওই দৃশ্য আবদুল গোফরান দেখেন, আমি দেখি, আপনিও দেখেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাসেই পাহাড়তলিতে এই গণহত্যা হয়েছে। স্মৃতির আর কতো বিবরণ দেবো? বগুড়ার রামশহর গ্রামের পীরবাড়ি অন্যসব পীরের মতো নয়, তারা উনসত্তরের গণআন্দোলনের সমর্থক, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। এই অপরাধ। পীরবাড়ির মোঃ তবিবুর রহমান ও আবদুল হান্নান এবং ওই এলাকার চাল-ব্যবসায়ী রহিমুদ্দিন ফকির আমাকে সাথে নিয়েই দেখতে পান ১৯৭১-এর ১৩ নভেম্বর পীরবাড়ির পুকুরপাড়ে প্রথমে ১১ জনকে, পরে আরো ১১ জনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারে, মারতে কোনো দ্বিধা করে না। ওরা যে মেরেছে সেই কথা সবাই বলে, কিন্তু আমারই যে বাবা-মা, ভাই-বোন, পুত্র-কন্যা মারা গেছে সে-কথা বলতে যেন আমারই যতো দ্বিধা, যেন এর চাইতে বড় লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে! তাই আমি বলতে পারিনে রাজশাহীর গোপালপুর চিনির মিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শতাধিক বাঙালিকে হত্যা করলো, বলতে পারিনে ঘোড়াশালে ন্যাশনাল জুট মিলে ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ এক সাথে ৯৫ জনকে গুলি করে মারে। এইসব দৃশ্য আমার আজীবন স্মৃতি হয়ে থাকে, গোপালপুর ও ঘোড়াশালের মধ্যে কোনো পার্থক্য আমার চোখে পড়ে না। স্মৃতিতে গেঁথে আছে চট্টগ্রামের ফয়স লেকের কাছাকাছি, পাহাড়তলির রাস্ত ায় শত শত বাঙালির লাশ পড়ে আছে; তাদের শনাক্ত করার কেউ নেই, তাদের সমাহিত করার কেউ থাকে না ।

১৯৭১-এ আমি মা-বোন, স্ত্রী-কন্যার সামনে দাঁড়াতে পারিনে। দাঁড়াতে গেলেই স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে অন্ধ হয়ে যায়, কারণ ১৪ নভেম্বর ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আখতারুজ্জামান ম-ল ভুরুঙ্গামারীতে ঢুকে যা দেখলেন, আমিও যা দেখলাম, তা তাঁর জবানিতেই শুনি : ‘ওয়ারলেসে পেছন থেকে সংবাদ দেয়া হলো আমাকে সিও অফিসের কাছে যেতে । সিও-র বাসভবনের দোতলায় জানালার ফাঁক দিয়ে কয়েকজন যুবতী মেয়েকে দেখা গেল । আমরা কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখলাম বাহির থেকে তালা আটকানো । রাইফেলের বাঁট দিয়ে তালা ভেঙে কক্ষের ভেতর ঢুকে চোখ বন্ধ করে বের হয়ে এসে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটলো। কক্ষের ভেতর চারজন মেয়ে, দুইজন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, দুইজন শুধু জাঙ্গিয়া পরে রয়েছে।’ আমাদের সবার স্মৃতিতেই এই ভয়ংকর দৃশ্য আছে; এখানে আছে নির্যাতনে অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত মা-বোনের জীবন্ত লাশ; কাছাকাছিই ঝোপে-জঙ্গলে দেখলাম অনেকগুলো কঙ্কাল। কঙ্কালগুলো মেয়েদের।

এই দৃশ্য সারা বাংলাদেশে; গণহত্যা আর ধর্ষণ আর অগ্নিসংযোগ আর লুটপাট যত্রতত্র। চ্যানলে আই-তে সাইদুর রহমান নামে যে-ছেলেটি খবর পড়ে, তার বাবা-মা ও ভাইদের অনেকটা চোখের সামনেই অবাঙালিরা কেটে কেটে হত্যা করলো, অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় সাইদুর। এ-রকম প্রত্যক্ষ সাক্ষী সারা বাংলাদেশে রয়েছে অজস্র । বাঙালিকে হত্যা করার কতো পন্থাই না ওদের জানা ছিলো । ঠাকুরগাঁওয়ে মোঃ সফিকুল আলম চৌধুরীকে বাঘের খাঁচায় ছয়বার ফেলে দেবার পরও বাঘ খায়নি, এমন অবিশ্বাস্য ঘটনার পাশাপাশি হত্যাকা-ের আরেক চিত্র দেখি সৈয়দপুরে; অবাঙালিরা ডাক্তার শামশাদ আলীকে জীবন্ত অবস্থায় ট্রেনের বয়লার ইঞ্জিনের মধ্যে ফেলে দিয়ে হত্যা করলো। দেশের যেসব জায়গায় – পার্বতীপুর, ঈশ্বরদী, চট্টগ্রাম, পাকশীতে – জ্বলন্ত বয়লারে ফেলে হত্যা করেছে তা যেমন আমি দেখেছি, তেমনি আপনিও ।

আমার শিক্ষক ড. নীলিমা ইব্রাহিম দেখেছেন ‘সন্তোষ ভট্টাচার্যের দন্ত বিহীন মুখম-ল, পুতুলের কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা ডা. মর্তুজা, একই রকম শাল গায়ে আনোয়ার পাশা আর সাইদুল হাসান।’ আমিও দেখি তাঁদের, প্রত্যেকেই আমার চেনা। ছোট্ট দেশ বাংলাদেশে চেনা-জানা মানুষের অভাব নেই বলে মনে করি সবাই আমার আপনজন, সবার সঙ্গে আমার আজন্ম পরিচয়। পরে নীলিমা আপার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখেছি, এই হত্যা বিষয়ে কথা উঠলে তিনি ভয়ানক বিচলিত হয়ে যেতেন, আমিও বিচলিত হই, না হলে আমার থাকে কি?

দুই

অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মানুষের জীবন আক্ষরিক অর্থেই ঝুলছিলো ধারালো তরবারির উপর । আমরা কেউই নিশ্চিত ছিলাম না যে, কাল বাঁচবো, সকালে সূর্যোদয় দেখবো। শুধু সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা কেন- দিনের যে-কোনো সময়ে, লোকালয় থেকে কিংবা বাড়ি থেকে অথবা রাস্তা থেকে ঘাতকরা মানুষ তুলে নিয়ে যায়, কারো সাধ্য থাকে না বাধা দেবার, প্রতিবাদ করবার । তা করতে যাওয়া মানেই মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো। মৃত্যুর এমনি হোলিখেলা বাঙালি জাতি আগে কখনো দেখেনি; যুদ্ধকালীন নৃশংসতার কাহিনী পড়েছে, চলচ্চিত্রে দেখেছে, কিন্তু তাদের জীবনেই যে তা সত্য হয়ে দেখা দেবে, তা ছিল অকল্পনীয়।

,

আসলে ১৯৭১ বাঙালির জীবনে এমন কিছু অভিজ্ঞতা দান করে গেছে, যা চর্চা করে, লিখে, জানিয়ে, বর্ণনা করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দেয়া যায় । কেউ কেউ বলে, অতীত ঘাঁটাঘাটি করা অর্থহীন। এমন কথা যারা বলে তাদের কাছে যুদ্ধ গ-গোল, তাদের বিবেচনায় ‘৭১ ভুল-বোঝাবুঝির ফসল। সেই ধারণা নিয়েই তারা ইতিহাস বিচার করতে চায় বলে যে মুক্তিযুদ্ধ এই বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় গর্ব ও অহংকারের বিষয়, সেই মুক্তিযুদ্ধ হয়ে যায় বিভ্রান্তির বিষয়; স্বাধীনতাবিরোধীরা এই পরিণতিতে হাততালি দেয়, স্বাধীনতাপ্রিয়রা হতাশায় ম্রিয়মাণ হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা প্রচ- ক্ষোভে শুধু বাতাসেই মুষ্ট্যাঘাত করে, লাঞ্ছিতা মা-বোন-কন্যারা দ্বিতীয়বার মৃত্যুবরণ করে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মৃত্যুবরণে একপ্রকার গৌরব ছিলো, কিন্তু স্বাধীনতালাভের পর? প্রশ্ন এখানেই। ১৯৭১-কে তুচ্ছজ্ঞান করার কারণেই জাতি আজ প্রতিটি মুহূর্তে গ্লানিকর মৃত্যুবরণ

করছে।

অপরদিকে অহংকারের কী অযুত উদাহরণই না আমাদের রয়েছে। এদেশে যুদ্ধ করেছে কারা, এই প্রশ্নে প্রথমেই যারা সামনে আসে তারা হচ্ছে জনগণ। তারা আপনার আমারই কোনো ভাই, প্রতিবেশী, কৃষক, মজুর, মুটে, গোয়ালা, দোকানদার, ছাত্র, ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, আনসার, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালারাই। তারা যুদ্ধ করেছে আধুনিক যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষিত সৈনিকদের বিরুদ্ধে, তারা যুদ্ধ করেছে সে-সময়কার সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭১ সালে সমগ্র বিশ্ব এমন অসম যুদ্ধ দেখেনি। স্বীকার্য, চূড়ান্ত বিজয়লাভের জন্যে আমাদের জনযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাদের একত্র হয়েই আক্রমণ চালাতে হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এই ‘ভেতো’ বাঙালিই প্রথম পর্যায়ে, গেরিলা কায়দায় আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছে, মনোবল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, নির্দিষ্ট জায়গায় সুসংগঠিতই হতে দেয়নি। বাঙালির এই অভূতপূর্ব সাফল্যের উদাহরণ রয়েছে অজস্র। প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ যে হয়েছে, তার তিনটে উদাহরণ দেখা যাক ।

বলছেন বন্ধু বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা কমল সিদ্দিকী: রংপুর এলাকায় রোজার ঈদের দিনে আমরা ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছি; আমরা জানি কিছুক্ষণের মধ্যেই এই রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মি আসবে, আমরা আক্রমণ করবো, হঠাৎ দেখি ধামা-মাথায় এক লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা তাকে বলি শিগগির পালাও, এখনই পাকিস্তানি আর্মি আসবে । কিন্তু সে-লোকের এক কথা, বাবারা, তোমরা দেশের জন্যে লড়াই করছো, আজ ঈদের দিন, তোমাদের খাওয়ার জন্য আমি কিছু ফিরনি রান্না করে এনেছি, তোমরা আগে খাও। তাকে যতই বলা হয় পালাও, পাকিস্তানিরা এসে পড়লো বলে, কিন্তু তার ওই এক কথা, ঈদের দিন, দেশের জন্যে লড়াই করছো!

এমন সময়ে গুলি। লোকটি ছিটকে পড়লো, ধামা রাস্তায় পড়ে গেলে দেখা গেল হাঁড়ির ফিরনি রাস্তার ধুলো-কাদায় একাকার, সে লোকের রক্তে মাটি লাল হচ্ছে, রক্তাক্ত হচ্ছে।

স্নেহভাজন আবু সাঈদ জুবেরীর ঘটনাটি আরো চমকপ্রদ । সেটাও রোজার ঈদের দিনেই। ঘটনাটি সুনামগঞ্জে। ঈদের আগের রাতে জুবেরীরা একটা জায়গায় অপারেশন করে ভোরবেলায় একটা বাড়ির গোয়ালে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ততক্ষণে বাড়ির রাখাল গরু বের করে নিয়ে গেছে। রাতে অপারেশনের ধকল, সারাদিন না-খাওয়া, শরীর স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত । সন্ধ্যার দিকে ওরা চিন্তা করছিল গোয়ালে গরু তোলার আগেই পালাবে। ঠিক সেসময়ে শোনে গোয়ালঘরের দরজা খোলার শব্দ; ওরা রাইফেল বাগিয়ে তৈরি হয়ে যায়। দরজা খোলার পর দেখা যায় এক মহিলা ঢুকলো, তার আঁচলের তলায় কিছু একটা ঢাকা । মহিলা ঢুকেই বললো, বাবারা, আমি টের পেয়েছি, তোমরা এখানে আশ্রয় নিয়েছো । আজ ঈদের দিন, তোমরা সারাটা দিন কিছু খাওনি, এই থালায় কিছু খাবার এনেছি, খাবারগুলো নিয়ে শিগগির পালাও, কারণ আমার স্বামী শান্তি-কমিটির মেম্বার, তোমাদের ধরতে পারলে আর ছাড়বে না।

তৃতীয় ঘটনাটি বলছিলেন বন্ধুপ্রতিম অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী। ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ের। আহাদ চৌধুরী ও সহযোদ্ধারা সিলেটের শমশেরনগরের বিমানবন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করবেন শেষ রাতে । মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে অভুক্ত, অনেকে অর্ধভুক্ত। দুই- তিনজনকে গ্রামে পাঠানো হয়েছে কিছু খাবার সংগ্রহ করতে। বলছেন আহাদ চৌধুরী : মাঝরাত, বেশ ঠান্ডা, একটু একটু কুয়াশাও পড়ছে, হঠাৎ দেখি তিনপাশ থেকে বহুলোক আমাদের ঘিরে ধরছে। ভয় পেয়েছিলাম আমরা । কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয় ভেঙে যায় আমাদের। দেখি প্রায় প্রত্যেকের হাতে ও মাথায় বয়ে আনা কিছু না কিছু খাবার। তার মধ্যে গরম ভাত, মাছ ও মাংসও রয়েছে।

বলা বাহুল্য, জনগণের এই সাহায্য-সহযোগিতা, প্রয়োজনে নির্দিষ্ট রাস্তা দেখিয়ে দেয়া, সঠিক খবরটি জানিয়ে শত্রুকে আক্রমণ, শত্রুর অবস্থান জানিয়ে সাবধান করা, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জেনেও তা গোপন রাখা, ভয়াবহ বিপদ হতে পারে জেনেও শত্রুকে ভুল পথ দেখানো, সামান্য এক মুঠো মুড়ি দিয়ে পানি খাওয়ানো, দুটো টাকা দেয়া, আপনজনের মতো মমতা ছড়ানোর কাজগুলো সাধারণ মানুষ করেছে বলেই শত্রুরা বিভ্রান্ত হয়েছে, বিপাকে পড়েছে, আমাদের বিজয়ও ত্বরান্বিত হয়েছে। এ যেন এক অসম্ভব জাদু । মাত্র নয় মাসে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করতে ভারতীয় সাহায্যের পাশাপাশি বিশ্বের অন্য বহু দেশের সমর্থন ও সহযোগিতা নিতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু খোদ জনগণ যদি সমর্থন প্রত্যাহার করে তাহলে মহাশক্তিধর শত্রুর পক্ষেও জয়লাভ সম্ভব নয়। প্রমাণ- আমেরিকা পারেনি ভিয়েতনামে, পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশে।

আমাদের গর্ব ও অহংকার এখানেই। সরল সত্য এই যে, স্বাধীনতা কেউ কাউকে হাতে তুলে দেয় না। আমাদেরও তিরিশ লক্ষ জীবন দিতে হয়েছে, আড়াই লক্ষ মা-বোন-কন্যার সম্মান বিসর্জিত হয়েছে। এতে কষ্ট ও বেদনা আছে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য মাটি রক্ত চায় বলে যে জীবনদান, তাতে গৌরবটুকুই সর্বাগ্রে মান্য । এবারে শেষ স্মৃতিটার কথা বলি। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে কি করবে না, না করলে ঢাকা শহর নিশ্চিতভাবেই গুঁড়ো হয়ে যাবে, এইরকম একটি মিহি সুতোর উপর জীবন নিয়ে দাঁড়িয়ে সকাল এগারোটার দিকে ধানমন্ডির রাস্তায় প্রথম যখন দেখলাম একটি শিশু তার বাবার কাঁধে বসে বাংলাদেশের পতাকা দোলাচ্ছে, তখন আমি ছুটে গিয়ে সেই অচেনা শিশুকেই পাগলের মতো চুমু খেতে থাকি । আসলে সেই শিশু তখন তো আমারও শিশু! সে বেঁচে আছে!