পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বাঙালির চারিত্রমাধুর্য এই যে, সর্বদা তার চরিত্রে বৈপরীত্য বিকশিত। যখন দুর্লভ তখন তার চাহিদা বাড়ে। যখন সহজলভ্য তখন চাহিদা কমে। জ্ঞান যখন রুদ্ধ ছিল, তখন তা জানার প্রয়াস ছিল অদ্রি-অতিক্রম্য। জ্ঞান যখন মুক্ত হলো অবারিত তথ্যজালে তখন জ্ঞাত হওয়ার স্পৃহা মনের প্রাচীরেই নিহত হয় কুঁড়িতে। অর্থাৎ বাঙালির চরিত্রে হুজুগের আধিক্য লক্ষণীয়। যখন যে হুজুগ ওঠে, তখন সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা বাঙালির চরিত্র। সেই হুজুগের জোয়ারে কেউ কেউ পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন কম প্রতিভাবান হয়েও। আর অধিক প্রতিভাবানরা অনেক সময় হুজুগের কলেস্নাল তৈরিতে অপারগ বিধায় পড়ে যান বিস্মৃতির অতলে। বাংলা সাহিত্যে এ-রকম চরিত্র নিতান্ত কম নয়। আমজনতার কাছে যিনি সহজবোধ্য তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাতারাতি আর যিনি জনপ্রিয় সাহিত্যিকের কাছেই জনপ্রিয়, আমজনতার কাছে তিনি পড়ে থাকেন বিস্মৃতির অন্তরালে। কবি ও ছান্দসিক আবদুল কাদির এমনি একজন সাহিত্যিক, যিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি পেয়েও রয়ে গেছেন ধুলোমলিন স্মৃতি হয়ে অনালোকিত, অপ্রদর্শিতরূপে।
অপ্রদর্শিত, অনালোকিত আবদুল কাদিরকে ধুলোমুক্ত করে আলোকসম্পাতে যুগের কাছে তুলে ধরার এক নান্দনিক প্রয়াস ‘কম চেনা বড় মানুষ আবদুল কাদির’। স্বকালের ধ্বনিকে উচ্চকিত করে সমকালীন উপযোগিতাকে তুলে ধরাই কালের ধ্বনির কাজ। কবি ও ছান্দসিক আবদুল কাদির স্মারকগ্রন্থখানি যুগের সেই মহান ডাকের প্রতি উপযুক্ত সাড়া বলেই প্রতীয়মান।
উনিশশো ছয় সালের পয়লা জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আড়াইসিধা গ্রামে জন্ম নেওয়া আবদুল কাদির জন্ম থেকেই এক ইঁদুরকপালে সত্তা, যিনি অতি শৈশবেই মাতৃহারা হয়ে বঞ্চিত হন অপত্যস্নেহ থেকে। সেই ধারা বহমান থাকে তাঁর শিক্ষাজীবনেও, যিনি পাঁচটি বিষয়ে লেটার পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশনের বৈতরণি পার হলেও শুধু গণিত নেওয়ার কারণে স্নাতকের গ– অতিক্রম করতে পারেননি। অথচ তাঁর মেধা ছিল প্রখর এবং ছাত্র হিসেবে তিনি তুখোড়ই ছিলেন বলা যায়। শুধু যে গণিতই তাঁর উচ্চশিক্ষায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা-ই নয়, তাঁর সাহিত্য ও সম্পাদনার বিষয়ে অতিআসক্তি তাঁকে পাঠ্যবিমুখ করে তোলে। ফলে পর্যাপ্ত সময় ব্যয়িত না হওয়ায় সনদধারী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মানদ– তিনি উচ্চশিক্ষিতরূপে চিহ্নিত হতে পারেননি। ইঁদুর তার কপাল এতটুকুই কেটেছে যে, বড়মাপের সাহিত্যজন হয়েও তিনি আজ সাহিত্যের আড্ডায় অনাঘ্রাত, অনুচ্চারিত।
আজ যাঁরা কবি-যশোপ্রার্থী, ছন্দ তাঁদের দূর প্রতিবেশীর মতো। আধুনিক গদ্য কবিতার তুমুল প্রভাবের কারণে আজকের কবির কাছে ছন্দ অস্পৃশ্য এবং সেকেলে হয়ে উঠেছে। অথচ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন, ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্যই কবিত্বের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞান। ছন্দের শুদ্ধ পাঠ আজকাল বিরল। এমনই এক ছন্দোক্রান্তির লগ্নে ছান্দসিক আবদুল কাদিরকে স্মরণ ও তাঁর সাহিত্যিক জীবনের ওপর উপযুক্ত আলোকসম্পাত কালের ধ্বনির এক মহৎ উদ্যোগ এ-কথা অকুণ্ঠচিত্তে বলতেই হয়। কবির কালজয়ী প্রবন্ধ ভাণ্ডার থেকে ছন্দবিষয়ক ‘বাঙলা ছন্দের বিশেস্নষণ’ এবং ‘বাঙলা ছন্দ ও নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক অমর দুটি প্রবন্ধকে পুনঃপাঠহেতু সচল করার যে-সমকালশোভন প্রয়াস, তাতে আজকের নবীন লিখিয়েদের জন্য তা মহাপ্রসাদ বলেই বিবেচিত হবে। ছান্দসিক আবদুল কাদিরের বাইরে কবি, সংগঠক ও সম্পাদক আবদুল কাদিরকে পূর্ণাঙ্গ পরিস্ফুটনে কালের ধ্বনির ‘কম চেনা বড় মানুষ’ শিরোনামটি জুতসই ও দূরদর্শী হয়েছে বলেই প্রমিত। কবি আবদুল কাদির একজন অলস কিংবা প্রচার-অন্তরালের মানুষ হিসেবেই পরিগণিত। না হলে উনিশশো তেত্রিশে দিলরুবাকে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দিয়ে যিনি বাংলার কবিদের আসরে নিজের অধিকার ও আসন অসংশয়িত করে নিয়েছেন তিনি কেনই-বা উনিশশো সাতষট্টিতে উত্তর বসন্ত নিয়ে সমেত্মাষে আবিষ্ট হবেন? কবি আবদুল কাদির একজন প্রচারে নির্লোভ নিজ প্রতিভার অবিচারকারী অপরাধী এক উদাসীন বই আর কিছুই নন।
সাংবাদিক আবদুল কাদির একজন বালুচরে ঘরবাঁধা যাযাবরের মতো। কোনো পত্রিকাতেই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেননি। কখনো পরিস্থিতির কারণে, কখনো-বা আপন বিচরণশীলতার কারণে। নিজের জয়তীকে সাত সংখ্যার বেশি টেনে নিতে না পারাটা আদৌ কি আর্থিক অনটন নাকি তাঁর অস্থিরতার প্রভাব তাও বিবেচ্য। সংগঠক আবদুল কাদির ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের অগ্রপুরুষ। কিন্তু খুব বেশি পরিমাণে মুসলিম কবি-সাহিত্যিক ও সংগঠন নিয়ে সংশিস্নষ্ট থাকার কারণে তাঁর মধ্যে অতিমাত্রায় বাঙালি মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবধারার কালচার গড়ে উঠেছিল। এরই সুবাদে নজরুল প্রতিভার বিচারে কিঞ্চিৎ আবেগ তাঁকে যুক্তিনিষ্ঠতা থেকে বিচ্যুত করেছিল বলে মনে হয়। এ-কারণে তিনি নজরুলকে ‘জাতীয় মহাকবি’ আখ্যা দিতেও পিছপা হননি, যেখানে বাংলা মায়ের আরেক সন্তান মাইকেল মধুসূদন দত্ত-স্বীকৃত মহাকবি হিসেবে জ্বলজ্বল করছিলেন তাঁর সামনেই। গবেষক আবদুল কাদির অত্যন্ত মেধাবী এবং শ্রমনিষ্ঠ ও তথ্যনিষ্ঠ। আবদুল কাদিরের সর্বাপেক্ষা সবল ও দুর্বল দিক হচ্ছে সংকলন-সম্পাদনা। একজন সম্পাদক হিসেবে নিজেকে নিজেই তিনি তিলে তিলে নষ্ট করেছেন মূল্যবান সময় ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে। কখনো কখনো তাঁর সম্পাদনাকর্মটি কাক ও পরভৃতের কাহিনিটাকেই মনে করিয়ে দেয়। নিজের সৃজনশীলতাকে পরিচর্যা না করে মননশীল রচনায় মেতে তিনি এমন অনেক কিছুই সংকলন করেছেন, যা তাঁর জন্য আবশ্যক ছিল না। তাঁর সব সংকলনের মধ্যে নজরুলকে নিয়ে যত কর্মসম্পাদনা হয়েছে তা-ই তাঁকে আজো অবিস্মরণীয় করে রেখেছে। নজরুল-জীবনীকার এবং নজরুল-রচনাবলি সম্পাদনা তাঁর সম্পাদিত কর্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ-কারণেই কবি আবদুল কাদির আজো নজরুল প্রসঙ্গে সমীহভরে উচ্চারিত ও অনুসৃত।
আবদুল কাদিরের ছন্দবিষয়ক প্রবন্ধ ছাড়াও ‘কম চেনা বড় মানুষ আব্দুল কাদির’ স্মারকগ্রন্থটিতে উলেস্নখযোগ্য প্রাপ্তি হলো শামসুজ্জামান খান কর্তৃক গৃহীত আবদুল কাদির-লিখিত সাক্ষাৎকার ও কবিকন্যা সুলতানা কাদিরের ‘আমার বাবা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণা। পাশাপাশি বাবার সঙ্গে আবদুল কাদিরের পত্র-যোগাযোগও মূল্যবান সংযোজন। বিভিন্ন বিভাজনে ও বিশেস্নষণে আবদুল কাদিরকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে সংযোজিত রচনাগুলোর প্রায় বহুলাংশেরই পুনরাবৃত্তি হয়েছে – এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায়। প্রায় প্রতিটি রচনাতেই রবীন্দ্রনাথের দিলরুবা পাঠে মন্তব্য সংশিস্নষ্ট থেকেছে। নজরুল, প্রবোধ চন্দ্র সেনের উক্তি, মোহিতলাল মজুমদার, আবুল ফজলের লেখনীর অংশবিশেষ ঘুরেফিরে বিভিন্ন লেখায় পুনরাবৃত্ত হয়েছে। স্মারকগ্রন্থখানা পাঠে এ-কথা বলা যায়, কলেবর স্ফীতির ব্যাপারে সম্পাদকের আবেগমাখা প্রশ্রয় ছিল বটে। ‘একজন আবদুল কাদির’ শিরোনামে খন্দকার সিরাজুল হকের রচনাটিকে আবদুল কাদিরের মূল্যায়নে যথাবর্ণিত রচনা বলে সাধুবাদ দেওয়া যায়। পাশাপাশি ‘আনুষঙ্গিক একটি পত্রিকা : জয়তী’ শীর্ষক আবদুল মান্নান সৈয়দ লিখিত রচনাটিও পাঠকের পিপাসা মেটাতে সমর্থ বলে আমার বিশ্বাস।
অধিকাংশ রচনাতেই আবদুল কাদিরকে পরিচিত করতে গিয়ে নজরুলকে ব্যাপক পরিসর দেওয়া হয়েছে এবং তাঁর শ্বশুর মুজাফ্ফর আহমদও কম মঞ্চ দখল করেননি। যে-কারণে স্মারকগ্রন্থ পাঠে এটাই মনে হয়, নজরুল সম্পর্কে আলোচনায় আবদুল কাদির যতটুকু আসতে পারেন, ততটুকুই বুঝি তাকে ফুটিয়ে তোলা হলো। একই কারণে কম চেনা বড় মানুষ গ্রন্থটি নিজেও তার আঙ্গিকে ধারণ করেছে বলে প্রতীয়মান হয়।
একটি কথা বারবার গ্রন্থপাঠে সামনে এসেছে – কবি আবদুল কাদির রবীন্দ্র-বলয়ভুক্ত। অথচ এমন বড়মাপের একজন কবির সঙ্গে আবদুল কাদির বিষয়ে আলাদা কোনো আলোচনাই হলো না। রবীন্দ্রনাথ যেখানে দিলরুবায় দিলখোলা হয়েছেন খুশ দিলে, সেখানে ‘রবীন্দ্রনাথ ও আবদুল কাদির’ শিরোনামে আলাদা কোনো পাঠ কীভাবে বাদ পড়ে যায় ভাববার বিষয়।
পারিবারিক জীবনে আবদুল কাদির কেমন মানুষ ছিলেন তা আরো ব্যাপক পরিসরে আলোচিত হলে মানুষ আবদুল কাদিরকে জানা সম্ভব হতো। স্মারকগ্রন্থটিতে যারাই আলোচনা করেছেন, তাদের অনেকেই আবদুল কাদির উচ্চশিক্ষিত না হতে পারার বিষয়টি অবতারণা করেছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষিত না হওয়ার কারণে তাঁর সাফল্যে ও সার্থকতায় কোনদিকে ঘাটতি ছিল তা ইঙ্গিত করেননি। বরং বিষয়টি বারবার আলোচিত হওয়ায় ক্ষুদ্র ক্ষতকে বারবার খুঁচিয়ে অহেতুক বড় করে তোলার প্রবণতা লক্ষণীয়।
চারশো ছেষট্টি পৃষ্ঠার ঝকমকে ছাপা বইটির শেষে কবি আবদুল কাদিরের বেশ কয়েকটি দুর্লভ ছবি ছাপানো হয়েছে, যাতে গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গতার পথে এগিয়ে গেছে। আবদুল কাদিরের বইগুলির কয়েকটির প্রচ্ছদছবি প্রকাশ করে আজকের পাঠকদের তীর্থ ভ্রমণের মতো সুখলাভে সুযোগ করে দিয়েছেন সম্পাদক মহোদয়। মনন মোর্শেদের মনকাড়া প্রচ্ছদে কবি আবদুল কাদিরের প্রতিকৃতি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। প্রধান সম্পাদক আশিক রেজা ও সম্পাদক তরুণ কবি ইমরান মাহফুজের সম্পাদনায় ফেব্রম্নয়ারি দুই হাজার সতেরোতে আলোর মুখ দেখা গ্রন্থখানি কবি আবদুল কাদির সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য দলিল – এ-কথা জোর দিয়ে বলা যায়। উপেক্ষণীয় মুদ্রণপ্রমাদ সত্ত্বেও আবদুল কাদিরের ‘জোড়’ বানানশৈলীতে চোখ আটকে যায়।
আপন আলোকবিহীন চাঁদ দিনের বেলা সূর্যের প্রতাপে নজরে পড়ে না। তাই মনে হয় দিনের আকাশে বুঝি চন্দ্রোদয় ঘটেনি। কবি আবদুল কাদিরের ক্ষেত্রেও এ-উপমা প্রযোজ্য তিনি নিজে একজন অসংশয়িত কবি, কিংবদন্তি ছান্দসিক এবং কালজয়ী সম্পাদক। তবু এ-মানুষটিকে চেনা হলো কম সে কি নজরুল নামক সূর্যের প্রতাপে, নাকি তাঁর আপন উদাসীনতায়? কবি আবদুল কাদির তাই যথার্থ অর্থেই কম চেনা বড় মানুষ যাঁর নিজের আলো থাকলেও তিনি দিবাশশী। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.