কালো ভোর

ভোরে এই বাসায় কেউ ঘুম থেকে ওঠে না আমি ছাড়া। আমি উঠি, উঠে বারান্দায় বসে থাকি একা একা, তারপর অঙ্ক কষি আর ভোর দেখি। আজকে ভোরে উঠেছে আম্মা, ভোর মানে অন্ধকার থাকতে। আব্বার কড়া নাড়ার শব্দে জেগে উঠেছি আমি আর আম্মা। আব্বা হাত-মুখ ধুয়ে এলে কিছু খাবেন কি না জিজ্ঞাসা করল আম্মা। আব্বা মাথা হেলিয়ে অসম্মতি জানালেন। ডাইনিংয়ে গিয়ে নিজেই কল থেকে এক গ্লাস পানি পান করলেন তারপর আম্মার বিছানা থেকে বালিশ দুটো নিয়ে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন রাতজাগা ক্লান্তিতে। আম্মা বলল, কাজ শেষ করে আসতে পারছেন নাকি সকালে আবার যাবেন! আব্বা বললেন, হইছে কোনো রকম, যাওয়া লাগবে না।

 কয়লায় দাঁত মাজতে মাজতে বাঁ-হাতে ভরা জগ নিয়ে আম্মা এসে দাঁড়াল দক্ষিণের বারান্দায়। দুটো বারান্দা আমাদের, একটা দক্ষিণে আর একটা উত্তরে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদারহস্তে জমি খরচ করে ষাটের দশকে এই দালানগুলো বানিয়েছে। বারান্দায় আমরা রীতিমতো ব্যাডমিন্টন খেলতে পারি, হা-ডু-ডুও। তো আম্মা বারান্দায় গিয়ে গাছে পানি দিচ্ছে, পাশেই আমি কাঠের বেঞ্চির ওপর বসে পলাশীর দিকে মুখ করে আছি। সামনে খুব সুন্দর বাগান ছিল বহু বছর, উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছুদিন আগে। এখানে ছোট একটা পার্ক হবে, সামনে আর দুটো বিল্ডিং। কিছুদিন পর শতবর্ষী তেঁতুলগাছ দুটোও কেটে ফেলা হবে, যেখানে করিমের দুগ্ধ খামার ছিল। কোয়ার্টার হবে আরো, আব্বা বলেছেন। কত দ্রুত সব পালটে যাচ্ছে! চোখের সামনে রেললাইন উঠে গেল, এশিয়ান হাইওয়ের কাজ চলছে, রাস্তার দুপাশে কাঁঠালগাছ লাগানো হয়েছে। গরিবের ফল কাঁঠাল, এটাই লাগানো উচিত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর নির্দেশেই কাঁঠালগাছ। এটাও আব্বা বলেছেন, আমার আব্বা সব জানেন। আম্মা-আব্বা দুজনেরই প্রিয় ফল কাঁঠাল, তাই তাঁরা বেশ খুশি।

শেষরাতে ফেরা আব্বা মোটামুটি চারটা বালিশ নিয়ে ঘুমাচ্ছেন বেঘোরে। জীবনে এই সামান্য একটা বিলাসিতা তাঁর, দুটোর জায়গায় চার-পাঁচটা বালিশ শরীরের নানা জায়গায় গুঁজে বিলকুল দুশ্চিন্তাহীন একটা ঘুম। আব্বার এই ঘুম দেখলে পৃথিবী তো পৃথিবী ভূ-ভারতের কেউ বলবে না, মানুষটার পাঁচ-পাঁচটি কন্যা লাউডগার মতো দ্রুত বেড়ে উঠছে, তিনটি পুত্রসন্তান তো আছেই, যাদের মানুষ করা একটা চ্যালেঞ্জ! আমার বসে-থাকা বারান্দা থেকে ঘাড় ঘোরালে কাচের জানালার ওপারে উনি, ক্লান্ত এক প্রকৌশলী, যিনি সারারাত্রি জেগে কাজ করে আলো ফোটার অল্প আগে ফিরেছেন। দিনরাত এক করে কাজ করেছেন গত পনেরো দিন, প্রেসিডেন্টের আগমন বলে কথা!

আহা, ঘুমাচ্ছেন ঘুমান!

বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাব্য যেসব রাস্তায় আচার্য ঘুরতে পারেন তা মসৃণ না হোক অন্তত চলনসই করতে হবে, এটা একটা চ্যালেঞ্জ বটে। তিনি আচার্য হওয়ার পর এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন, মানে পুরো ক্যাম্পাসই ঘুরবেন। রাস্তাঘাট চলনসই না হলে ভর্ৎসনার শিকার হবে প্রকৌশল বিভাগ। যে-বিভাগের প্রধান আবার তাঁর বড়ো পুত্রবধূর বাবা, মানসম্মানের ব্যাপার!

 তো আম্মা গাছে পানি দিচ্ছেন, দাঁতে হাতে কয়লা। বাইরে হালকা আলো, সলিমুল্লাহ হলের গম্বুজের মাথায় আভা ছড়াচ্ছে। আম্মার ব্লাউজের গলার অনেকটাই সামনে চলে গিয়েছে। পিঠের দিকে ব্লাউজের নিচের সাদা ধবধবে পিঠ অনেকটাই উন্মুক্ত। আমি হাই তুলে মাকে দেখি আর ভোর দেখি। চাপা একটা উত্তেজনা কাজ করছে আমার, আম্মারও কি তাই!

বানেজার মা খটখটালো। মা চাইছেন আমিই দরজা খুলি, অন্যদিনও আমিই খুলি। মায়ের জগের পানি অর্ধেক রয়ে গেছে, এটা শেষ হলে আরো এক জগ লাগবে। আমি রাজ্যের আলস্য নিয়ে উঠলাম, দরজা খুলে আবার বারান্দায় গিয়ে বসে আছি। মায়ের গন্ধরাজে ফুল এসেছে, এই প্রথম। গাছটায় আমার কিছু অবদান আছে। ইকবাল হলের মানে জহুরুল হক হলের বাগান থেকে ডালসহ ফুল চুরি করে এনেছিলাম দুই বছর আগে মানে ফাইভে পড়তে। সেটা পানিতে থেকে শিকড় গজালে টবে বপন করেছে আপা। টবের মাটিও অবশ্য আমারই আনা, তেঁতুলগাছের নিচ থেকে, করিমের দুগ্ধখামার ছিল একদা যেখানে! দীর্ঘদিনের গরুর গোবর আর চোনার কারণে মাটি যেমন কালো, তেমনি উর্বর। গাছ বপনের কয়েকদিনের মধ্যে এমন অপূর্ব এক সৌন্দর্য ধারণ করে! আম্মা বুঝি গন্ধরাজ ফুলটার সঙ্গে কথা বলছেন! অনেকক্ষণ ফুলটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঝোপালো অনেকখানি সবুজের মধ্যে সাদা ফুলটা, কুঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বেশ সময় নিয়েছে কিন্তু।

আমি ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত, শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করি, তিনি কি আমাদের এদিকটায় আসবেন আম্মা!

– কোন দিকে?

– ওই যে ইকবাল হলের টিনশেডের সামনের রাস্তা দিয়ে মেইন হলের দিকে! কালকে দেখলাম রাস্তার ভাঙা জায়গাগুলো সারা হইছে!

– কী জানি, একসময় তো তিনি ইকবাল হলে আসতেন মিটিং করতে, পুরনো জায়গা, আসতেও পারেন!

আব্বা ঘুম থেকে উঠলে জিজ্ঞাসা করব, আব্বা নিশ্চয় বলতে পারবেন।

রান্নাঘরে আম্মা রুটি সেঁকছে আমি গোটা পাঁচেক পিঁড়ির স্তূপের ওপর বসে আম্মার রুটি সেঁকা দেখছি। রুটি সেঁকা হলে আম্মা সুজি রান্না করবে রেশনের তেল-চিনি দিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাল-গম-তেল-চিনি উন্নত জিনিস। রুটি-সুজি খেতে পারি না আমি। আমি ডালরুটি খাব, সঙ্গে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ আর এক ফালি সুগন্ধ এলাচি লেবু থাকবে।

লেবু এ-বাসার নিত্য আহার্য বস্তু, বিলাসিতার পরাকাষ্ঠা। রুটি বানিয়ে বানেজার মা মসলা নিয়ে বসেছে। হলুদ মরিচ ধনে। যেদিন মাংস হয় সেদিন আদা- রসুনও বাটে।

জিরা কখনো বাটা হয় না। রান্না করতে করতে মা জিরা টেলে গুঁড়ো করে তরকারির ওপর ছড়িয়ে দেন, জিরার টাটকা ম-ম ঘ্রাণ।

কাই করা আটায় এক স্তূপ রুটি আম্মা সেঁকেই চলেছে। পুকুরের পুব দিক থেকে সূর্য এসে রান্নাঘরের জানালায় পড়েছে। মসলা করা শেষ হলে বানেজার মা রাতের একরাজ্যের বাসন-হাঁড়িকুড়ি মাজতে বসবে ছাই দিয়ে।

– আম্মা শেখ মুজিবকে মেরে ফেলছে!

– কী!

– শেখ মুজিবকে মেরে ফেলছে আম্মা!

ঝন্ করে আম্মার হাত থেকে খুন্তি পড়ে গেল। আমি পিঁড়ির স্তূপ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম তড়াক করে। পুবদিকের জানালাটার কাছে গিয়ে বাইরে কী দেখছি। সূর্যের আলোটা হলুদ, পাগলা কটকটা হলুদ। বলা চলে গা ঘিনঘিনে গুয়ের হলুদ। আমি শুনছি কে যেন বলছে, মেজর ডালিম রেডিওতে কী বলে শোনো আম্মা …। আম্মা ঘরে চলে গেল বোধহয়। আম্মা কি এখন আব্বাকে ডেকে তুলবে, বলবে, শোনেন তিনি আসবেন না, তিনি আর কোনোদিন আপনাদের এতদিনের চেষ্টার চলনসই রাস্তা দিয়ে ঘুরতে আসবেন না। ওঠেন, শোনেন রেডিওতে কী বলে!

জানালা ছেড়ে আমি কিন্তু নড়লাম না। লোহার মোটামোটা শিক, আমাদের বহুল স্পর্শে কালো কুচকুচে হয়েছে, এক যুগ হতে চলেছে যে! দুটো শিক দুহাত দিয়ে ধরে পুকুরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি। এখন সেভেনে পড়ি, তখন তো থ্রিতে পড়ি, জানালার শিক তত শক্ত করে ধরতেও পারতাম না। কিন্তু ধরে চুপিচুপি দেখেছি মিলিটারিরা ঘাড়ে বন্দুক নিয়ে বাসার সামনে দিয়ে দুজন দুজন চলে যাচ্ছে মার্চপাস্ট করে। তাদের পায়ের শব্দ আমাদের নিস্তব্ধ হতভম্ব জনপদকে প্রকম্পিত করে ঔদ্ধত্যকে জানান দিচ্ছে। মাটি চাই মাটি, মানুষ দরকার নাই, এটাকে বলে অপারেশন সার্চলাইট!

তাহলে এটাকে তারা কী নাম দেবে! আমি হাতের তালুটা দেখি, তিনি আমার হাতে সাড়ে তিন বছর আগে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার প্রাইজের বদলে সার্টিফিকেট, আজিমপুর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। বিধ্বস্তদের জন্য আমাদের প্রাইজের টাকা ব্যবহার করা হবে। আমরাও দেশ গঠনে অংশীদার, তিনি বারবার এ-কথা বলছিলেন আর আমাদের বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছিল, আমরাও! তিনি আমাদের সার্টিফিকেট দিলেন। অলৌকিক সাহস ছড়িয়ে দিলেন হাত ছুঁয়ে আর হাসি দিয়ে!

একটু পর বাবার ঘরে গিয়ে দেখি আম্মা একটুখানি জায়গা দখল করে বসে আছেন আব্বার পায়ের কাছে। কাছাকাছি কয়েকটা ভাইবোন, আম্মা কী বলেন, কীভাবে বলেন সেটা দেখার জন্য। আমিও আছি। আম্মা সময় নিচ্ছে, আমরা ধৈর্য ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু আম্মা কিছুই না বলে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ পর উনি পাশ ফিরতে গেলেন আমরা সমস্বরে ডেকে উঠলাম, আব্বা! উনি চোখ না খুলে বললেন, উউ …। আব্বা তিনি আসবেন না! আব্বা তিনি আসবেন না! আব্বা আব্বা!

আব্বা চোখ খুললেন। আম্মা গায়ে হাত রাখল, কাঁচা ঘুম চটে গেল আব্বার। মোটা মানুষ উঠে না বসেই বললেন, কে আসবেন না! –    তিনি আসবেন না আব্বা, তাঁকে মেরে ফেলেছে আর্মিরা! আব্বা এবার উঠে বসলেন, কপালে হাত দিয়ে উপুর হয়ে বসে থাকলেন। ভাইয়া তিন ব্যান্ডের ফিলিপস রেডিওটা এনে আব্বাকে কিছু একটা বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করছে। আব্বা তখনো বিহ্বল দৃষ্টি শূন্যে মেলে বসে রইলেন।

এই ঘরে মাত্র সাড়ে চার বছর আগে আমরা পাকিস্তানি মিলিটারিদের হত্যার কবলে পড়েছিলাম, পঁচিশ মার্চ সারারাত আব্বা আমাদের নিয়ে এই ঘর ওই ঘর করছিলেন নিরাপত্তার জন্য। পুকুরের পুব দিক থেকে কামানের সেলগুলো এলে কয়টা দেয়াল ভেদ করতে হবে আমাদের মারতে! আব্বা এখন নিশ্চিত জেনে গেছেন এখন আর কোনো দেয়াল নেই কামান আর মানুষের মাঝখানে, অভিভাবক না থাকলে যা হয়!