পাঁচ

তখন রতনপুর বাজারটা ছিল পদ্মার কোলঘেঁষে। রিশিপাড়া ছাড়িয়ে দক্ষিণে দশ-পনেরো কানি আবাদি জমি। তার পশ্চিমে বাজার। নদীতীর থেকে একটা রাস্তা বেরিয়ে সোজা চলে গেছে উত্তরে। রিশিপাড়ার মুখে এসে দুদিকে দু-হাত ছড়িয়েছে। ওদিক থেকে হেঁটে এলে বাঁ-হাতের রাস্তা চলে গেছে কুসুমপুরের দিকে, ডান হাত গেছে রতনপুর পোস্ট অফিসের দিকে। পদ্মাপারে গিয়ে শেষ হয়েছে এই রাস্তা। পোস্ট অফিসের ইট রঙের ঘরের পাশে বিশাল বটগাছ। জায়গাটা দিনমান ছায়াময়। পোস্ট অফিসের পিছন দিয়ে পদ্মা থেকে ঢুকেছে খাল। রিশিপাড়াটা পড়েছে খালের পূর্ব ধারে। পাড়ায় ঢোকার মুখে পূজামণ্ডপ। বছরভর কোনো না কোনো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে মণ্ডপে। মণ্ডপের পাশে রাস্তা। রাস্তার ওপারে একটা বুড়ো তেঁতুলগাছ আর পুরনো বাঁশঝাড়ে জমে থাকে পুরনো কালের অন্ধকার। কালী সন্ধ্যায় রিশিবাড়ির বউ-ঝি বা যুবতী মেয়েরা কেউ ওদিকটায় যায় না।

নবীন রিশির মেয়ে বাসন্তী খুবই ডাকাবুকা। সতেরো-আঠারো বছর বয়সের মেয়েটি স্বাস্থ্যবতী ও কালো। মুখভর্তি গোটাগাটি, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট। তবে তার চোখ দুটি আর হাসি খুবই সুন্দর। চোখের পাপড়ি ঘন কালো। সাদা দাঁতের সারি পরিপাটি। হাত-পা পুরুষালি। চলাফেরায় বোঝা যায় শরীরে বেদম শক্তি। তবে বাসন্তীকে কেউ মোটা বলবে না। ভরাট স্বাস্থ্যের মেয়ে। একটু খাই খাই স্বভাবও আছে। মাঝারি মাপের লম্বা মেয়েটি পুরো পাড়ার অন্য ছেলেমেয়েদের শাসন করে। বেশ একটা মাতাব্বরি ভাব আছে, মুখরাও। ভয়ডর বলতে তার কিছু আছে বলে মনে হয় না।

ভরসন্ধ্যায় বাসন্তী গিয়েছিল তেঁতুলতলা আর বাঁশঝাড় গলাগলি করে

থাকা জায়গাটায়। ফিরে এসেই তার চেহারা-আচরণ বদলে গেল। বড় চোখ আরো বড় করে উচ্চস্বরে খিলখিল করে হাসতে লাগল। এলোচুল নিয়েই ওদিকটায় গিয়েছিল। পঞ্চাশ-ষাট ঘর রিশিপাড়ার বিশাল উঠোনে দাঁড়িয়ে অচেনা গলায় আবোলতাবোল কথা বলল কিছুক্ষণ। তারপর উš§াদিনীর মতো নাচতে লাগল। বাড়ির বউ-ঝি, ছেলেপেলে আর

জোয়ান-মর্দ-বুড়োবুড়ি সবাই যে যার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। ঘরে ঘরে কুপিবাতি জ্বলছে। সেই আলোতে বাসন্তীর এই মূর্তি দেখে রিশিগোষ্ঠী স্তম্ভিত।

এ কী করছে বাসন্তী? কী হয়েছে মেয়েটির?

নবীন রিশির রোগা-পাতলা বউ কমলা এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। একঝটকায় মাকে উঠোনের মাটিতে ছুড়ে ফেলল বাসন্তী। গমগমে পুরুষালি গলায় বলল, ‘আমি তেঁতুইল গাছে থাকি। আমার সামনে কেউ আইলে জানে মাইরা হালামু। অনেক দিন ধইরা তালে আছিলাম কবে বাসন্তীরে ধরুম। আইজ ভাও মতন পাইয়া ধরছি। দুনিয়ার কেউর খ্যামতা নাই আমারে ছাড়ানোর।’ তারপর ঠা-ঠা হাসি আর উদ্দামনৃত্য বাসন্তীর।

রিশিপাড়ার লোকজন শুকনা মরিচ পুড়িয়ে নিয়ে এলো বাসন্তীর নাকের কাছে ধরার জন্য। কাউকে ধারেকাছে ঘেঁষতেই দিলো না সে। শেষ পর্যন্ত পাড়ার জোয়ান-মর্দ লোকেরা একত্র হয়ে জাপটে ধরল মেয়েটিকে। উঠোনের কোনার বকুলগাছটির সঙ্গে মোটা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল। বাসন্তী তখনো ঠা-ঠা করে হাসছে।

গাছে বাঁধা অবস্থায়ই রাত কেটে গেলে বাসন্তীর। ওদিকে সারারাত মেয়ের জন্য ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদল কমলা। নবীন খুবই হম্বিতম্বি করল বউয়ের সঙ্গে। ‘মাইয়ার দিকে খেয়াল রাখস নাই ক্যা, মাগি? কালীসন্ধ্যায় তেঁতুলতলায় ও গেল ক্যা?’

কমলা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তোমার মাইয়ায় কেউর কথা হোনে? দুই-তিন বচ্ছর ধইরা তোমারে কইতাছি মাইয়ার বিয়া দেও। তুমি বলে পোলাই পাও না। বড় মাইয়া দুইডারে

বারো-তেরো বচ্ছর বয়সে বিয়া দিয়া দিছি। তারা সুখে আছে। বাসন্তীর অহন সতরো-আঠরো বচ্ছর বয়স। এই রকম মাইয়া একলা পাইলে ভূতে তো ধরবই! মাইয়ার যা চালচলন, দেশ-গেরামের যুবক পোলাপানে যে দল বাইন্দা তোমার মাইয়ারে ধরে নাই, দিনদুপুরে পাটক্ষেতে লইয়া যায় নাই, এইডাই তো বেশি।’

কমলার এসব কথা শুনে বিরাট একটা লাফ দিলো নবীন। ‘চুপ কর মাগি। বেশি প্যাঁচাইল পাড়লে গরু-বরকির খাল ছাড়ানোর

 চাক্কু দিয়া তর শইল্লের খাল ছাড়াইয়া দিমু।’

কমলা আর কথা বলেনি। সারারাত কেঁদেছে। ওদিকে বকুলতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খানিক ঘুমিয়েছে বাসন্তী। যখনই জেগেছে তখনই নানা রকম স্বরে হেসেছে।

দেবু ঠাকুর গিয়েছিলেন হালিম পিয়নের বাড়িতে রোগী দেখতে। সঙ্গে বদরু ছিল। ফিরতে ফিরতে দুপুর বসে গেছে। ফেরার পথে বদরুকে ঠাকুর বললেন, ‘রিশিপাড়ায় কিছু একটা ঘটছে রে, বদরু। ল ওদিকটায় একটু ঘুইরা যাই।’

ঠাকুরের কথায় দ্বিমত করার উপায় থাকে না বদরুর। সে সঙ্গে সঙ্গে বিপুল উৎসাহের গলায় বলল, ‘লন যাই। আপনি যেইডা কন হেইডাই তো সত্য হয়! গিয়া দেহি রিশিপাড়ায় কী হইছে।’

রিশিপাড়ার উঠোনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বকুলগাছে বাঁধা বাসন্তী হি হি করে হাসতে লাগল। গলার আওয়াজ এখন আর পুরুষালি না। খুনখুনে বুড়ির মতো।

ঠাকুর আর বদরু দুজনেই স্তম্ভিত। বদরু অতি বিস্ময়ভরা চোখে ঠাকুরের দিকে তাকাল। ‘আপনের কথাই তো ঠিক, দাদা! এইডা কেমতে কইলেন?’

ঠাকুর কথা বললেন না। নিঃশব্দে হাসলেন।

বাসন্তী তখন চিৎকার করে বলছে, ‘আইছ ঠাকুর? যতই ক্যারামতি দেহাও, আমারে তুমি ছাড়াইতে পারবা না। বাসন্তীরে আমি ধরছি তো ধরছিই, কিছুতেই ছাইড়া যামু না।’

তারপর খোনা গলায় হাসতে লাগল বাসন্তী।

রিশিপাড়ার লোকজন সবাই তখন ঠাকুরকে ঘিরে। নবীন ছুটে এসে ঠাকুরের পা জড়িয়ে ধরল। কমলা দূরে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে কাঁদতে লাগল।

ঠাকুর গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কালীসন্ধ্যায় তেঁতুলতলায় গেছিল তর মাইয়ায়। ওখান থিকাই ধরছে।’

বাসন্তী পুরুষালি গলায় বলল, ‘তুই তো বেবাকই জানস, ঠাকুর। খ্যামতা থাকলে আমারে ছাড়া। দেহি তুই কত বড় ঠাকুর।’

ঠাকুরের পা জড়িয়ে নবীন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার মাইয়াডারে বাঁচান কর্তা। আমার বাসন্তীরে বাঁচান।’

বাসন্তী চিৎকার করে বলল, ‘আরে ও আমারে কী বাঁচাইব রে? ওরে আমি খাইয়া ফালামু। ও কত বড় ঠাকুর হইছে দেইখ্যা লমু! ওই ঠাকুরের পো ঠাকুর, সাহস থাকলে আয়, আয় আমার কাছে আয়।’

ঠাকুর কোনো কথা বললেন না। স্থির চোখে বাসন্তীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দু-এক পলক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাসন্তী কেমন স্থির হয়ে গেল। সেও ঠাকুরের মতো করে তাকিয়ে রইল ঠাকুরের চোখের দিকে। গত সন্ধ্যা থেকে এ পর্যন্ত যত পাগলামি সে করেছে তার কিছুই যেন মেয়েটির মধ্যে এখন আর নেই। ধীর-শান্ত ভঙ্গিতে অপলক চোখে সে ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠাকুরের অবস্থাও আগের মতোই। সেও তাকিয়ে আছে। চারদিকে ভিড় করা লোকজন কারো মুখে কোনো কথা নেই।

ঠাকুর বদরুর দিকে তাকালেন, ‘বদরু, ব্যাগ থেইকা চাক্কুটা দে তো।’

ঠাকুরের ব্যাগে ওষুধপত্র, ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ইত্যাদির সঙ্গে একটা ধারালো চাকু আর নতুন ব্লে­ডও থাকে। বদরু সঙ্গে সঙ্গে চাকুটা বের করে দিলো। সেই চাকু হাতে ঠাকুর গিয়ে দাঁড়ালেন বাসন্তীর সামনে। বাঁধন কেটে মুক্ত করলেন মেয়েটিকে। লোকজন স্তব্ধ হয়ে আছে। বাসন্তী সুবোধ মেয়েটির মতো দাঁড়িয়ে আছে। পলকহীন চোখে দেখছে ঠাকুরকে।

প্রথমে রিশিপাড়ার লোকদের দিকে তাকালেন ঠাকুর। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘যে যার কামে যাও। আমি বাসন্তীর চিকিৎসা করুম।’ বাসন্তীকে বললেন, ‘ঘরে যা বাসন্তী। আমি আসতেছি।’ নবীন আর কমলাকে বললেন, ‘তোমগো ঘরের আশপাশে এখন আর কেউ থাকবো না। আমি বাসন্তীর ভূত ছাড়ামু।’ বদরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সব দিকে খেয়াল রাখবি, বদরু। নবীনের ঘরের ধারেকাছে যেন কেউ না আসে।’

ঠাকুরের কথায় মন্ত্রের মতো কাজ হলো। রিশিপাড়ার লোকজন যে যার ঘরের দিকে চলে গেল। ক্ষেতখোলায় কাজ আছে যাদের, তারা চলে গেল ক্ষেতখোলায়। মহিলারা সংসারের কাজে ব্যস্ত হলো। স্নান করতে খালে গেল কেউ কেউ। দুষ্ট পোলাপান কয়েকজন নড়তে চাইল না। তারা ভূত ছাড়ানো দেখবে। নবীন তাদের তাড়া করল। বদরুও করল।

বাসন্তী ততক্ষণে সুবোধ বালিকার মতো ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। ঘরটা টিনের দোচালা। বেড়াগুলোও টিনের। লেপাপোছা পরিচ্ছন্ন ঘর। শক্তপোক্ত একটা চৌকি আছে ঘরে। টানানো দড়িতে তিনজন মানুষের কাপড়চোপড়। এক পাশে হাঁড়িকুড়ি,

থালা-বাসন। মাটির একটা গণেশের মূর্তি আছে। ঘরের দরজাটা শক্ত কাঠের।

সেই ঘরে ঢুকেই দরজার খিল লাগিয়ে দিলেন ঠাকুর। সঙ্গে সঙ্গে উন্মাদের মতো তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাসন্তী। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাকুর দেখলেন বাসন্তী তাঁকে চৌকির ওপরে ফেলে দিয়েছে। ফেলে তাঁর ওপর চড়ে বসেছে। ফিসফিসে গলায় মেয়েটি বলল, ‘তোমার লেইগা আমি পাগল হইছি, ঠাকুর।

ভূত-পেত্নি কিচ্ছুতে আমারে ধরে নাই। আমারে ধরছো তুমি। তুমি রিশিপাড়ায় রোগী দেখতে আহো, তুমি দেহো রোগী আর আমি দেহি তোমারে। আমি তোমার লেইগা পাগল হইয়া গেছি। আইজ তোমারে আমি খামু।’

ঠাকুর কথা বলার সুযোগই পেলেন না। এক হাতে অসুরের মতো শক্তি নিয়ে বাসন্তী তাঁর মুখ চেপে ধরেছে। চৌকিতে ঠাকুরকে ফেলে তাঁর ওপর চড়ে বসেছে। শক্তিশালী পুরুষ যেভাবে অবলা নারীকে ধর্ষণ করে, ধর্ষণের আগে যে ধস্তাধস্তি ইত্যাদি চলে, অবস্থাটা সেই পর্যায়ে গেল। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি ঠাকুর। বুঝে গেলেন মিনিটখানেকের মধ্যেই, যখন তাঁর ধুতি খুলে ফেলেছে বাসন্তী। নিজের শাড়িও একটানে খুলে অবতীর্ণ হয়ে গেছে পুরুষের ভূমিকায়। ঠাকুরের ওপর চড়ে দুর্ধর্ষ জন্তু-জানোয়ারের কায়দায় কাজটা সে করতে লাগল। সে যে একটা কুমারী মেয়ে, পুরুষ সঙ্গ এর আগে যার ঘটেনি, সেই মেয়ে অবলীলাক্রমে ঠাকুরকে গ্রহণ করল তার শরীরের ভিতর। দিকপাশ কোনো কিছুই দেখল না। ভবিষ্যৎ ভাবল না। কাণ্ডটা ঘটিয়ে চলল। ঠাকুর হতভম্ব হয়ে আছেন। শুরুতে কথা বলতে গিয়েছিলেন, বাধা দিতে গিয়েছিলেন, কোনোটাই কাজে লাগেনি। বাসন্তীর শরীরে যেন দৈত্যের শক্তি। সেই শক্তির কাছে ঠাকুর টিকতেই পারলেন না।

দীর্ঘক্ষণ কাণ্ডটা চালাল বাসন্তী। রক্তারক্তি হয়ে গেল। একটা সময়ে ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে ঠাকুরের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাঁপাতে লাগল। ঠাকুর কোনো রকমে তাকে শরীরের ওপর থেকে সরালেন। উঠে ধুতি পরতে পরতে বিপর্যস্ত গলায় বললেন, ‘তুই তো মানুষ না রে ছেমড়ি! তুই তো পিশাচিনী। আমার হইব না কিছুই। সর্বনাশ হইব তোর।’

বাসন্তীও তখন উঠে বসেছে। কোনো রকমে শাড়িটা পরল। অতিরিক্ত কামুক মেয়েটি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তির ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি যা চাইছি কইরা ফালাইছি, ঠাকুর। আমার ভূত ছাইড়া গেছে। অহন তুমি বেবাকতেরে কইতে পারো, আমার ভূত তুমি ছাড়াইয়া দিছো। অহন যুদি আমি মইরাও যাই, আমার কোনো দুঃখু থাকব না। আমি তোমারে চাইছি, তোমারে পাইছি। তোমারে পাওনের আশায় ভূতে ধরনের তামসা করছি।’

ঘরের আবছা আলো-আঁধারিতে ঠাকুর দেখতে পেলেন, হতকুৎসিত মেয়েটির মুখখানা গভীর আনন্দে ঝলমল করছে। চোখের দৃষ্টি শান্ত আর স্নিগ্ধ। তার কোথাও কোনো অসংলগ্নতার চিহ্ন নেই।

দুয়ার খুলে বাইরে এলেন ঠাকুর। নবীন আর কমলাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার মাইয়ার ভূত ছাড়াইয়া দিছি। ওরে অহন খালে গিয়া চান কইরা আসতে কও। তারপর ভাত-পানি খাওয়াও। আরেকখান কাজ করতে পারলে ভালো। যত তাড়াতাড়ি পারো মাইয়াডার বিয়া দিয়া দেও।’

ফেরার পথে ঠাকুর খুব গম্ভীর। থমথমে মুখে হাঁটছেন। ভালো রকম ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাঁকে। বদরু বোধহয় কিছু অনুমান করল। কারণ ঠাকুরের স্বভাবটা সে জানে। তবে বাসন্তীর ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, এটা বদরু অনুমানও করতে পারল না। এই ঘটনা বদরুকে একদিন বলবেন ঠাকুর। ফিরে আসার পর একান্তে বলবেন। বদরু সে-কথা কোনোদিন কাউকে বলবে না।

ছয়

ঠাকুর ফিরে এলেন

দক্ষিণপাড়ার কাদের গিয়েছিল গরুর জন্য কচুরি কাটতে। পদ্মা থেকে যে খালটা ঢুকেছে গ্রামে, সেই খালের ধারে হিন্দুদের ছেড়ে যাওয়া একটা বাড়ি আর বিশাল একখানা পুকুর। বাড়িভর্তি ঝোপজঙ্গল আর পুকুরভর্তি ঠাসা কচুরি। পুরো বর্ষাকাল ধরে সেই কচুরি কেটে শেষ করা যাবে না। নধর কচুরি ডগাগুলো কাদেরদের বাড়ির গরুরা খুব পছন্দ করে। অন্যান্য ঘাসের সঙ্গে ধুমসে কচুরিটা খেতেই থাকে। এতে অবশ্য কাদের খুব খুশি। বিলের দিকে গিয়ে অন্য ঘাস কেটে আনার চেয়ে কচুরি ডগা কেটে আনা অনেক সহজ। জায়গাটাও বাড়ির কাছেই। পরিশ্রম তেমন হয় না।

আজ খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তার পরই উঠেছে আষাঢ় মাসের দুপুরবেলার রোদ। নৌকা ভরা কচুরি যেমন বৃষ্টিতে ভিজেছে, লুঙ্গি কাছা মারা খালি গায়ের কাদেরও ভিজেছে তেমন। এখন আবার রোদে ভাজা ভাজা হচ্ছে। ঠাকুর চদরিবাড়ির গা-ঘেঁষে বাড়ির দিকে এগোনো জায়গাটা ছায়াময় পাওয়া যায়। হিজল বরুণ গাছ, কদম আম জামের গাছ, তেঁতুল আর গাব গাছ বর্ষাজলের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে আছে। ছায়া ফেলে রেখেছে দীর্ঘ। কাদের সেই পথটা ধরেছিল।

বড় বড় গাছের তলায় আছে টোসখোলা ঝোপ, ছিটকি আর বেত ঝোপ। একটা ডাহুক পাখি অনেকগুলো বাচ্চা নিয়ে এক বেতঝোপ থেকে বেরিয়ে ওপারের অন্য বেতঝোপের দিকে যাচ্ছিল। কাদেরের বৈঠার আওয়াজ পেয়ে চোখের পলকে যে ঝোপ থেকে বেরিয়েছিল, সেই ঝোপে উধাও হয়ে গেল।

গত বছর এই মাসে ঠাকুর খুন হওয়ার পর গ্রামটাও যেন খুন হয়ে গিয়েছিল। প্রাণের স্পন্দন বলতে যা বোঝায় তার কিছুই প্রায় ছিল না। মানুষ চলাফেরা, কাজকর্ম করেছে মরার ভঙ্গিতে। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে থেকেছে। পাখপাখালির ডাকও তেমন শোনা যায়নি, দেখাও যায়নি। আজ এক বছর পর যেন ছানাসহ একটা ডাহুক পাখি দেখল কাদের। মনটা একটু ভালোও হলো। তারপর যে-দৃশ্য দেখল কাদের, ওই দেখে তার দম প্রথমে বন্ধ হয়ে এলো। চোখে পলক ফেলতে ভুলে গেল। ভাবনা-চিন্তা লোপ পেয়ে মাথাটা গেল শূন্য হয়ে।

এ কী দেখছে সে? এ কাকে দেখছে? ওই তো বাড়ির ঘাটে গোসল করছেন মানুষটি। পিতলের লোটা ভরে মাথায় ও শরীরে পানি ঢালছেন। পৈতাটা এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। পরনের ধুতি লেপ্টালেপ্টি হয়ে আছে নিম্নাঙ্গে।

এ তো সেই মানুষ! কোনো ভুল নেই। ঠাকুর। দেবু ঠাকুর। এ কী করে সম্ভব? গত বছর ঠাকুর-চদরি এক রাতে খুন হলেন। ঠাকুরের লাশ পড়ে ছিল তাঁর ঘরের দরজায়, চদরিরটা পড়ে ছিল উঠোনে। গ্রামের মানুষ সবাই এসে দেখেছে। কাদেরও ছিল সেই দলে। চোখের সামনে অনেকক্ষণ ধরে দুটো গলা কাটা লাশ পড়ে থাকতে দেখেছে। দারোগা পুলিশ এসে চটে পেঁচিয়ে সেই লাশ নিয়ে গেল। লাশ হওয়া মানুষকে আজ চোখের সামনে তাঁর ঘাটপারে গোসল করতে কেমন করে দেখছে কাদের? এও কি সম্ভব! খুন হওয়া মানুষ এক বছর পর নিজের ঘাটে বসে গোসল সারে কেমন করে? এ ঠাকুর তো, নাকি ঠাকুরের প্রেতাত্মা! নাকি ভূত! দিনে-দুপুরে এরকম দৃশ্য কি দেখা যায়?

হাতের বৈঠা আগেই থেমে গেছে কাদেরের। একটা ঝুঁকে পড়া হিজলগাছের তলায় সে নৌকা থামিয়েছে। পলক-না-পড়া চোখে তাকিয়ে আছে দৃশ্যটার দিকে। মুখটা একটুখানি হাঁ হয়ে আছে।

ভূত-প্রেত বা অশরীরী আত্মা চোখের পলকে দেখে কোনো কোনো মানুষ। চোখের পলকে তারা উধাও-ও হয়ে যায়। কিন্তু ঠাকুর গোসল করছেন অনেকক্ষণ ধরে। হিজলতলায় নৌকা রেখে কাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তিন-চার-পাঁচ মিনিট ধরে গোসল করলেন ঠাকুর। ঘাটপারে রাখা গামছায় গা মুছলেন। ধোয়া ধুতি পরে ভেজা ধুতি চিপরালেন। তারপর উঠোনের দিকে চলে গেলেন।

তারপর কাদেরের আর হুঁশ নেই। ঠাকুরবাড়ির ওদিকটায় সে আর গেলই না। নৌকা ঘুরিয়ে দ্রুত বৈঠা বেয়ে বাড়ি ফিরল। কাদেরের বাবা বুড়ো অথর্ব নঈমুদ্দিন সারাক্ষণ চৌকিতে শুয়ে থাকে আর খকখক করে কাশে। দলা দলা কফে মাখামাখি হয় তার মুখ। কাদেরের অসীম ধৈর্যশীলা মা ভেজা ন্যাকড়ায় খানিক পরপর এসে স্বামীর কফ পরিষ্কার করে আর মুখ মুছিয়ে দেয়। একটুও বিরক্ত হয় না, একটাও কথা বলে না। বাড়িতে তিন ছেলের তিন বউ। তাদের একঝাঁক বাচ্চাকাচ্চা। কাদেরের একটা নিঃসন্তান বিধবা ফুফু আছে। সেই মহিলা বোকার হদ্দ। সংসারের সব কাজ পারলে একা করে। মুখে রা শব্দটা নেই।

বাড়ি এসেই হুড়মুড় করে কাটা কচুরি আথালে বাঁধা গরুগুলোর মুখের সামনে ফেলল কাদের। তারপর দৌড়ে গেল বাবার ঘরের জানালার সামনে। ঘটনা বলল বাবাকে। শুনে বুড়ো মানুষটা হাছড়পাছড় করে উঠে বসল। খকখক করে কয়েকবার কেশে কফ ফেলে গভীর বিস্ময়ে বলল, ‘কস কী তুই? ঠাকুররে দেখছস?’

কাদের বলল, ‘হ বাবা, নিজের চক্ষে অনেকখুন ধইরা দেখছি। নিজে চক্ষুরে বিশ্বাস করতে পারি নাই।’

ততক্ষণে কাদেরের মায়ের কানেও গিয়েছে কথাটা। বাড়ির বউদের কানে গিয়েছে। কাদের মেজো ছেলে। তার বড়ভাই নুরু আর ছোটভাই তোতা বাড়িতেই ছিল। তাদের কানেও গিয়েছে। উঠোনের বেলগাছটার তলায় জড়ো হয়েছে সবাই। কাদের সবিস্তারে ঘটনা আবার বলল। শুনে বাড়ির লোকজন একটা কথাই বলল, ঠাকুরের ভূত দেখেছে কাদের, প্রেতাত্মা দেখেছে।

কাদেরের বুকে হাত বুলাতে বুলাতে মা বলল, ‘ডরাইছসনি, বাজান?’

কাদের কথা বলার আগেই দোয়া পড়ে ছেলের বুকে ফুঁ দিলো। কাদের বলল, ‘না মা, আমি ডরাই নাই। তয় তোমাগো আমি কিরা-কসম কাইট্টা কইতে পারি, আমি ঠাকুররে দেখছি। ভূত-প্রেত মাইনষের চোখের সামনে দিনে-দুইফরে এইভাবে দেহা দেয় না। আমি জীবিত ঠাকুররেই দেখছি। সে ভূত-প্রেত না।’

নুরু বলল, ‘যেই মানুষ চক্ষের সামনে খুন হইয়া গেল, তারে তুই জীবিত কেমনে দেহস? ওইডা ঠাকুরের ভূত।’

তোতা বলল, ‘আমি দাদার লগে একমত। মাইজ্জা দাদা, তুমি ওই রকম কিছুই দেখছ। খুন হওয়া মানুষ ফিরত আইব কেমনে? ডরাইয়া থাকলে নুন দিয়া গরম পানি খাও।’

কাদেরের বউ বছিরন নুনপানি এনে দিলো। কাদের মুখেও দিলো না। ছোট ছেলেটা এসে কোলে চড়ল। বাবার গলা জড়িয়ে বলল, ‘তুমি ভূত দেখছ, বাজান? ভূতটা দেখতে কেমুন আছিল?’

কাদের অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘না বাজান, আমি ভূত দেখি নাই। ঠাকুররে দেখছি।’

কাদেরের ঘরের বাতার দিকে একটা টিকটিকি তখন টিকটিক করে ডেকে উঠল। কাদের তার বউয়ের দিকে তাকাল, ‘ওই দেহো, টুকটুকিতেও কয় ঠিক ঠিক ঠিক।’

তারপর ঠাকুরকে দেখল হাওলাদারবাড়ির ইন্নত। মঙ্গলবার। সে গিয়েছিল গোয়ালীমান্দ্রার হাটে। একা একাই নৌকা বেয়ে গিয়েছিল তিন মাইল দূরের হাটে। গিয়েছিল ছাগল বিক্রি করতে। বর্ষাকালে একটু অভাব-অনটনে পড়ে ইন্নত। তার চাষবাসের জমি অতি সামান্য। ধান যেটুকু পায় তিন-চার মাস চলে। বাকি সময়টা গরুর দুধ, ছাগল পেলে বড় করা, বিক্রি করে কিছু টাকা রোজগার, হাঁস-মুরগির ডিম, কখনো কখনো দু-চারটা হাঁস-মুরগি বিক্রি করা – এভাবেই চলে সে। বিয়ে করেছে অনেকদিন। বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। চুপচাপ ধরনের মানুষ। গ্রামের বিচার-সালিশ-আড্ডায় যায় ঠিকই, পঞ্চায়েত মজলিশে থাকে ঠিকই, কথাবার্তা তেমন বলে না। একটা স্বভাব খুবই ভালো ইন্নতের। দু-এক দিন না খেয়ে থাকলেও কারো কাছে হাত পাততে যায় না। বুড়িমা আছে সংসারে। সেই মহিলাটি সারাদিনই খ্যাকর খ্যাকর করে। ছেলের ওপর খুবই খাপ্পা সে। একমাত্র ছেলেটি জীবনে কিছু করতে পারল না, এই তার আক্ষেপ। বউটিও মাঝে মাঝে শাশুড়ির সঙ্গে গলা মেলায়। ইন্নত ওসব পাত্তাই দেয় না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে নির্বিকারভাবে বের করে দেয়। মঙ্গলবার হাটে গিয়েছিল তাগড়া খাসি দুটো বিক্রি করে একটা গাভিন বকরি কিনে আনবে। বকরি কেনার পরেও খাসি বিক্রির বাড়তি টাকা থেকে চাল-ডাল কিনে আনবে। ওই দিয়ে এক-দেড় মাস চলার পথ করবে। দিন ইন্নতের এভাবেই কাটে। এক-দেড় মাস পর কী হবে, তা সে ভাবেই না। তার দিন এভাবেই যায়।

হাটে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটার মতো বেজে গিয়েছিল। হাটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দালালরা লেগেছিল পিছনে। মুলামুলি করতে করতে বিকেল হয় হয়। ওদিকে একটা গাভিন বকরিও দেখে রেখেছে ইন্নত। দামদস্তুর ঠিক হয়ে আছে। সাতঘরিয়ার বকরিওয়ালা বারবার তাগিদ দিচ্ছিল। মনমতো দামে খাসি বিক্রি করতে পারছিল না বলে বকরিওয়ালাকে বসিয়ে রেখেছিল ইন্নত। শেষ পর্যন্ত কিছুটা কম দামেই ছাড়তে হলো খাসি দুটো। গাভিন বকরি আর চালের বস্তা, ডাল, নুন, আলু, পেঁয়াজ – এসব নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল। যখন গ্রামে ঢুকেছে ইন্নত, তখন সন্ধ্যা বেশ খানিকটা পেরিয়ে গেছে। ঠাকুরবাড়ির ওদিক দিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে বৈঠা বেয়ে। হঠাৎই চোখ গেছে বাড়িটার দিকে। দূর থেকে পরিষ্কার দেখতে পেল ঠাকুরের ঘরের দরজা খোলা। দরজার সামনে চেয়ারে বসে আছেন ঠাকুর। তাঁর পায়ের কাছে উজ্জ্বল আলোতে জ্বলছে হারিকেন। সবকিছু দিনের মতো ফকফকা। ওই তো ঠাকুর! ধুতি আর গেঞ্জি পরা। মুখটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

ঠাকুরকে দেখে আর তাঁর ঘরে হারিকেন জ্বলতে দেখে কাদেরের মতোই অবস্থা হলো ইন্নতের। প্রথমে দমটা বন্ধ হয়ে আসতে চাইল তার। হাতের বৈঠা থেমে গেল। চোখ দুটো হয়ে গেল পলকহীন। কাদেরের মতো তার মনেও প্রশ্ন হলো, এ কী দেখছে সে? কাকে দেখছে? ময়মুরব্বিদের কাছে শুনেছে, যে বাড়িতে মানুষ খুন হয়, সেই বাড়ি ছেড়ে মৃতের আত্মা সহজে যায় না। নানা রকম চেহারায় দেখা দেয়। ঠাকুর খুন হওয়ার এক বছরের মধ্যে এরকম দৃশ্য কেউ দেখেনি; আর ভূত-প্রেত কখনো আলোর সামনে থাকে না। এ যদি ঠাকুরের প্রেতাত্মাই হয়ে থাকে, তাহলে সে আলোর সামনে বসে আছে কেমন করে? পায়ের কাছেই তো জ্বলছে হারিকেন। অনেকক্ষণ ধরেই তো দৃশ্যটা দেখছে ইন্নত। এক-দুই পলকের জন্য দেখলে না হয় মনে হতো দৃষ্টিবিভ্রম ঘটেছে। এ তো দৃষ্টিবিভ্রম নয়। এ তো বাস্তব, অতিবাস্তব।

ভয়ে-আতঙ্কে দিশাহারা হলো ইন্নত। গাভিন বকরিটা দু-তিনবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেছে। অর্থাৎ অন্ধকার হয়ে গেছে দেখে তারও বাড়ি ফেরার তাড়া। ইন্নত আর দেরি করল না। যত দ্রুত সম্ভব নৌকা বেয়ে বাড়ি ফিরল।

বাড়িটি পাঁচ শরিকের। মুখচোরা ইন্নত বাড়ি ফিরেই নিজের মা-বউকে প্রথমে ঘটনা বলল। তারপর এঘর-ওঘরের জ্ঞাতিদের ডেকে সবিস্তারে বলতে লাগল। শুনে নানাজনের নানা মত। ওই ভূত-প্রেত আর অশরীরীর কথাই বলল সবাই। ইন্নত তাদের কিছুতেই বোঝাতে পারল না এতক্ষণ ধরে অশরীরী আত্মা দেখা যায় না। সে প্রস্তাবও দিলো, ‘আমাগো বাইত্তে পুরুষপোলা আমরা বাইশ-পঁচিশ জন। লন বেবাকতে মিল্লা ঠাকুর বাইত্তে যাই। গিয়া দেহি ঘটনা কী।’

কেউ রাজি হলো না।

ওদিকে কাদের দেখেছে ঠাকুরকে দিনের আলোতে। সে-কথা তাদের পাড়ায় রটে যেতে দেরি হয়নি। এদিকে হারিকেন জ্বালিয়ে ঠাকুরকে বসে থাকতে দেখা ইন্নতের এ-ঘটনাও নাড়ার আগুনের মতো ছড়িয়ে গেল। একে একে রতনপুরের প্রতিটি বাড়িতে তো বটেই, আশপাশের দশগ্রামে রটে গেল ঠাকুরকে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে তাঁর বাড়িতে। খুন হওয়া মানুষ দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাড়িতে। গ্রাম পঞ্চায়েত শুনল ঘটনা।

চেয়ারম্যান-মেম্বাররা শুনলেন। দফাদার ফইজু শুনল। ধীরে ধীরে লৌহজং থানায় গিয়েও পৌঁছাল এই খবর। এলাকার যুবক পোলাপান একদিন একত্র হলো। জনা পঞ্চাশেকের একটা দল সকাল এগারোটার দিকে গিয়ে হাজির হলো ঠাকুরবাড়িতে। কোষা নাও আর ডিঙি নাওয়ে ভরে গেল ঠাকুরবাড়ির চারদিক।

ঠাকুর তখন বড়ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলেন। গ্রামের মানুষজন বাড়ির উঠোনে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। এত মানুষের মধ্যে প্রথমেই তাঁর চোখ গেল বদরুর দিকে। জামতলায় পড়ে থাকা ঠাকুরের নৌকাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। গভীর মমতায় হাত বুলাচ্ছে নৌকার ছইয়ে। এক বছরের অযত্নে আর খরালিকালে ডাঙায় পড়ে থাকার ফলে রোদে-বৃষ্টিতে নৌকাটা আর আগের মতো নেই। বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

ঠাকুরকে তাকাতে দেখে বদরুও তাকিয়েছে তাঁর দিকে। গ্রামের মানুষজনের মতো তার চোখও বিস্ফারিত। কোনো ভুল নেই। মানুষটা ঠাকুরই। দেবু ঠাকুর।

কথা ঠাকুরই প্রথম বললেন। ‘কী খবর তোমাগো? আমি আইলাম আইজ দশ দিন। এত দিন বাদে তোমরা আমারে দেখতে আইলা? খোঁজখবর লইতে আইলা?’

মানুষজনের বিস্ময় তখন কাটতে শুরু করেছে। প্রথমে যে ঘোর লেগেছিল তাদের, তা কাটতে শুরু করার ফলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু করেছে তারা। ফিসফিস করে এ ওকে বলছে, ‘এইডা তো ঠাকুরদাদাই!’ হিন্দুপাড়ার লোকরা বলছে, ‘কর্তারেই তো দেখতাছি চোক্ষের সামনে।’ পুবপাড়ার রমিজ বলল, ‘খুন হওয়া মানুষ দেহি ফিরত আইছে?’

আরফান বলল, ‘কয়দিন ধইরা হুনতাছি দাদারে মাঝে মাঝে দেহা যায় বাড়িতে। আমরা তো মনে করছি ভূত-প্রেত। বদ আত্মা। এহন তো দেহি জেতা দাদায় খাড়াইয়া রইছে চোক্ষের সামনে।’

উত্তরপাড়ার ইব্রাহিমের সাহসী মানুষ হিসেবে বিরাট নামডাক আছে গ্রামে। সে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল ঠাকুরের দিকে। ঠাকুর তার দিকে তাকাতেই বলল, ‘এহন তো আর অবিশ্বাস কইরা লাভ নাই দাদা। আপনে আপনেঐ। ভূত-প্রেত না। তয় ঘটনাটা হইল কী, গত বছর চদরি মশাইয়ের লগে আপনে খুন হইয়া গেলেন। আমরা বেবাকতে দেখলাম, আপনের গলা কাটা লাশ পইড়া রইছে বড়ঘরের দুয়ারে। চদরির লাশ পইড়া রইছে উঠানে। তাইলে আসল ঘটনাটা কী? আপনে খুন হন নাই?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘তর কী মনে হয় রে ইব্রাহিম? আমি খুন হইছি না হই নাই?’

আইয়ুব বলল, ‘এইডাই তো বুঝতে চাইতাছি। আপনের লাশই তো দেখলাম আমরা। পুলিশ-দারোগারাও আপনার লাশই লইয়া গেল। তয় আপনে আবার ফিরত আইলেন কেমনে? এমুন ঘটনা তো কিচ্ছা-কাহিনিতেও হুনা যায় না।’

মতি মাস্টার ঠাকুরের বয়সী। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার। ছোট-বড় সবাই তাঁকে মান্য করে। তিনি বললেন, ‘ঠাকুর, ব্যাপারটা বুঝাইয়া বলো। এটা তো বিরাট ঘটনা। তুমি খুন হইলা, আবার তুমিই ফিরত আইলা? এটা কেমনে হয়?’

ঠাকুর হাসলেন। ‘কথা কইলে তোমরা তো বিশ্বাস করবা না।’

আজিজ বলল, ‘আপনে কন দাদা, আমরা আপনের কতা বিশ্বাস করমু। আপনে আছিলেন না এই এক বছরে আমাগো গেরামডা মইরা গেছিল। আসল ঘটনাটা খুইলা বলেন, আমরা নিচ্চিন্ত মনে বাড়িত যাই। আপনের লাশ আমরা পষ্ট দেখছি। এই বড়ঘরের দুয়ারের সামনে পইড়া রইছে। তয় ওই মানুষটা কে?’

ঠাকুর বললেন, ‘এটা তোমাগো কাছে বিরাট রহস্য মনে হইবো। আমারে দেইখা তোমরা নিশ্চয়ই বুঝছো খুন আমি হই নাই। খুন হওয়া মানুষ ফিরত আহে কেমতে?’

কাশেম বলল, ‘তয় আপনে এই এক বছর আছিলেন কই? আর আপনের মতন দেখতে যেই মানুষটা খুন হইলো সে কে? আপনের তো কোনো জমক ভাইও নাই। আমরা জানি আপনের কেউই নাই। আপনে একলা মানুষ। তয় যে খুন হইলো সেইটা কে?’

‘কে খুন হইছে সেটা আমি না। এই কথা তো আর বলার দরকার নাই। যেদিন খুনাখুনির ঘটনা ঘটল সেদিন বিকালেই আমি বাড়ি থেইকা বাইর হইয়া গেছি। আমার নৌকা লইয়া বদরুরে লইয়া যাই নাই। বেলদারগো নৌকা লইয়াও যাই নাই। কেমতে কেমতে গেছি হেই হগলও তোমাগে কইতে চাই না। তয় গেছি ভাইগ্যকূল ঘাটে। ওহেন থেইকা ইস্টিমারে চড়ছি। গোয়ালন্দ গিয়া রেলগাড়িতে চড়ছি। সোজা চইলা গেছি শিয়ালদাহ, কইলকাত্তা। এক বচ্ছর কইলকাত্তায় থাইকা যেমতে গেছিলাম ওমতে ফিরত আইছি!’ বলেই তিনি আড়চোখে বদরুর দিকে তাকালেন। চোখের খুব সূক্ষ্ম একটা ইশারা করলেন। কেউ তা দেখতে পেল না। তবে বদরু বুঝল ঘটনা দাদায় বানাইয়া বলতাছে। খুন সে-ই হইছে। এখন যেই মানুষটা সামনে খাড়াইয়া রইছে, গেরামের মাইনষের লগে কথা কইতাছে হেয় হইলো আরেকজন ঠাকুর।

বদরু থম ধরে রইল, কোনো কথা বলল না।

কাদের বলল, ‘আমি দাদা আপনেরে দেখছি।’

ইন্নতও বলল একই কথা। এই ফাঁকে বিল থেকে ফিরে আসার পথে বদরুও যে ঠাকুরকে দেখেছিল সে-কথা সে বলে ফেলল।

ঠাকুর বললেন, ‘আমি তো জীবিত মানুষ। এই বাড়িতে আছি আইজ দশ দিন। আমি তো অবাক হইতাছি তোমরা আমারে দেইখাও বিশ্বাস করো নাই কেন? আমারে ভূত-প্রেত ভাবছো কেন?’

তিনি বদরুর দিকে তাকালেন, ‘তর সমস্যা কী রে বদরু? তুই তো তেরো বচ্ছর আমার লগে কাম করছস। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বিশ-বাইশ ঘণ্টা আমার লগে রইছস। আমারে দেখনের পরও একবারও তর মনে হইলো না, যাই একবার দাদার বাড়িতে। ঘটনা বুইঝা আসি।’

বদরু মাথা নিচু করে রইল। কথা বলল না।

গ্রামের লোকদের দিকে তাকালেন ঠাকুর। ‘শোনো। কথাটা খোলসা কইরা কইতাছি তোমগো। চদরি খুন হইছে এইটা বুঝলাম। আমার মতন দেখতে কে খুন হইছে সেইটা আমি জানি না। আমি বাড়িতেই আছিলাম না। জানুম কেমতে? কে কোনহান থেইকা আইসা এক বছর আগে সন্ধ্যাবেলা আমার বাড়িতে উঠছিল, খুনিরা আমি মনে কইরা তারে খুন করছে, এইটা তো আমার বোঝনের কথা না। তয় আরেকটা কথাও তোমাগো কইয়া দেই। আমারে কেউই খুন করতে পারবো না। পার্টিশনের আগে-পরে কম ঘটনা তো আর ঘটে নাই দেশ-গেরামে। দলে দলে হিন্দু দেশ ছাইড়া গেছে। খুনখারাবি লুটতরাজ হইছে। চদরিও তহন কইলকাত্তা চইলা গেছিল। আর আমি করলাম কী? একলা এত বড় বাড়িডায় রইয়া গেলাম। কেউ আমার কিছুই করে নাই।

শত্রু দুই-চাইরটা কইলাম আমারও আছে। আমার কিছুই তারা করতে পারে নাই। তোমরা যে যার বাড়িতে যাও। আমি জানি দুয়েকদিনের মইধ্যে থানার পুলিশ-দারোগারাও আইবো। আমার খোঁজখবর লইবো। আমি তোমাগো যা বললাম দারোগা পুলিশরেও তাই বলমু।’

ঠাকুর তাকালেন ফইজু দফাদারের দিকে। ‘খবর কিরে ফইজু? থানার দারোগা-পুলিশরা জানছে না আমি ফিরত আইছি?’

ফইজুর স্বভাব হচ্ছে গলা উঁচু করে কথা বলা। অনেকের কাছে তা চিৎকার মনে হয়। সেরকম গলায় সে বলল, ‘মনে হয় খবর গেছে দাদা। তারবাদেও আমি আইজ খবর দেওনের চেষ্টা করতেছি।’

হিন্দুপাড়ার নন্দ জেলে বলল, ‘অহন বেবাকের মনে একটাই কথা কর্তা, রহস্যটা কী? আপনার মতো দেখতে খুন হইল তাইলে কেডা?’

ঠাকুর বললেন, ‘দারোগা-পুলিশ আসুক, এই রহস্য তারাই বাইর করব নে।’

তখন ধীরে ধীরে লোকজন কমতে শুরু করেছে। নানা রকম কথা বলতে বলতে যে যার বাড়ির দিকে নৌকা ছাড়ল। রয়ে গেল শুধু বদরু। বাড়ি একদম খালি হওয়ার পর বদরুকে কাছে ডাকলেন ঠাকুর। ‘এই মিহি আয় বদরু, কথা আছে।’

বদরুর অবস্থা সঙ্গে সঙ্গে আগের দিনের মতো হয়ে গেল। ঠাকুরের সবকিছু জানার পরেও ডরভয় বলতে কিছুই রইল না তার। সে প্রায় ছুটে এসে ঠাকুরের দু-পা জড়িয়ে ধরল। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ঠাকুর তার মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন, ‘কান্দিস না বদরু, ওঠ, কথা আছে।’

কান্নার রেশ থামিয়ে উঠে দাঁড়াল বদরু। গামছায় চোখ-মুখ মুছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠাকুর বললেন, ‘তরে আমি কইছিলাম যেদিন আমি মইরা যামু তার এক বচ্ছর বাদে ঠিক ওইদিন ফিরত আমু। তুই আমার অনেক কিছুই জানস। আমি একজন না, আষ্টজন। একজন মরছি, আরেকজন ফিরত আইছি। দেশ-গেরামের মাইনষে তো আর এই হগল জানে না! জানলেও বিশ্বাস করব না। একমাত্র তুই বিশ্বাস করবি। কারণ আষ্টজন ঠাকুররে তুই এক রাইতে দেখছস। দেশ-গেরামের মাইনষের কাছে আমি মিছা কথা কইলাম। খুন আমিই হইছি। কারা আমারে খুন করছে সেইটা আমি তরে কমু না। তয় এই বাড়ি ছাইড়া আমি কোনোখানে যাই নাই। ওই সাতজনের মতন এই বাড়িতেই আছিলাম। হাওয়ায় মিশা আছিলাম। ঠিক এক বচ্ছর বাদে মানুষের রূপ ধরছি। তয় আমিও ঠাকুরই, আগের ঠাকুরই। কোনো পার্থক্য নাই। আমি জানি ডরভয় বইলা তোর এখন আর কিছু নাই। আইজ থিকাই তুই আমার বাড়িতে থাক। আগের লাহান বেবাক কামকাইজ কর। তয় নৌকা তোর বাইতে হইব না। আমি কোনো রোগীবাড়িতে আর কোনো দিন যামু না। বাড়িতে রোগী আসলে তাগো চিকিৎসা করুম। তোর মাহিনা আগের মতন। বেবাক কিছু আগের মতন। তুই থাক। কাইল থেইকা সবকিছু আগের নিয়মে চলব। অহন বাড়িত গিয়া ভাত খাইয়া আয়। বৈকালে দেখবি দেশ-গেরামের বউঝি, পোলাপান বেবাকতে আমারে দেখতে আইব। বাড়ি ভইরা যাইব মাইনষে। তুই তাড়াতাড়ি গিয়া ভাত খাইয়া আয়।’

পুরো গ্রাম ততক্ষণে জেগে উঠেছে। প্রত্যেক বাড়িঘরে একই আলোচনা, ঠাকুর খুন হননি। যে রাতে খুনোখুনির ঘটনা ঘটল সেদিন দুপুরের পর তিনি চলে গিয়েছিলেন ভাগ্যকূল গোয়ালন্দ হয়ে কলিকাতা। এক বছর সেখানে থেকে ফিরে এসেছেন। তবে তাঁর জায়গায় তাঁর মতো দেখতে কে খুন হয়েছে সেই রহস্যের কোনো কূল-কিনারা করতে পারল না কেউ। প্রায় দেড়-দু মাস এই রহস্য নিয়ে আলোচনা চলতে

থাকবে চারপাশের গ্রামগুলোর উৎসাহী মানুষের মধ্যে। বদরু ছাড়া কেউ জানবেই না আসল ঘটনা কী?

দুপুরের পর থেকেই সেদিন ঠাকুরের বাড়ি ভেঙে পড়ল লোকের ভারে। রতনপুর থেকে তো বটেই, চারপাশের গ্রাম থেকেও নৌকা ভরে ভরে আসতে লাগল আবালবৃদ্ধবনিতা। সবাই ঠাকুরকে একপলক দেখতে চায়। মানুষ সামলাতে গিয়ে বড় রকমের হিমশিম খাচ্ছিল বদরু। ঠাকুর তাকে শান্ত থাকতে বললেন। নারী পুরুষ ছেলে বুড়ো সবার সঙ্গে একটা-দুটো কথা বললেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। রিশিপাড়া থেকে এসেছে অনেকে। কামারবাড়ি আর সীতারামপুরের তালুকদারবাড়ি থেকে এসেছে হিন্দু সম্প্রদায়। তারা সকলেই ঠাকুরকে প্রণাম করতে লাগল। রিশিপাড়ার বাসন্তীর বাবা নবীন রিশি, তার বউ কমলা অনেক বুড়ো হয়েছে। তারাও ঠাকুরকে প্রণাম করল। ঠাকুর বাসন্তীর কথা জিজ্ঞেসই করলেন না। মুখেই আনলেন না সেই নাম। কারণ তিনি জানেন কী ঘটেছে মেয়েটির জীবনে। বাসন্তী যেদিন তার সঙ্গে ভূতে ধরার অছিলায় ওই কাজটি করেছিল, সেদিন থেকেই তিনি জানতেন কোনো দুর্ভোগ আছে বাসন্তীর কপালে!

বেশ কয়েক দিন লোকজনের উৎপাত চলতেই থাকবে ঠাকুরের বাড়িতে। দু’চোখে ঠাকুরকে একবার না দেখে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না ঠাকুর আসলেই ঠাকুর। তিনি খুন হননি। ফইজু দফাদার নিজেই গিয়ে হাজির হবে থানায়। নিজ মুখে বর্ণনা করবে ঠাকুরকে স্বচক্ষে দেখার কথা। দারোগা-পুলিশকে আমন্ত্রণ জানাবে ঠাকুরকে এসে দেখে যাবার জন্য। আর চদরির সঙ্গে ঠাকুরের মতো দেখতে যে-মানুষটি খুন হয়েছেন সে আসলে কে এই রহস্য

দারোগা-পুলিশেরা যেন উন্মোচন করেন – এই অনুরোধও রেখে আসবে।

দুদিন পর স্পিডবোট নিয়ে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার আসবেন ঠাকুরবাড়িতে। তিন-চার ঘণ্টা ধরে ঠাকুরকে জেরার পর জেরা করবেন। ঠাকুর কলিকাতায় কোথায় ছিলেন সেই জায়গার কথা অনুপুঙ্খ বলবেন। এমনকি রেল আর স্টিমারের টিকিটের তার নিজের অংশটুকু দেখাবেন। পাসপোর্টও দেখাবেন। পুলিশের কর্তারা নিশ্চিত হবেন, ঠাকুর যা যা বলছেন সবই ঠিক। এক বিন্দু মিথ্যে নেই কোথাও। তবে ঠাকুরের জায়গায় কে খুন হলো এই রহস্য বের না করেই ফিরে যাবেন তারা। আর বদরু অবাক বিস্ময়ে ভাববে, দাদায় কইলেন তিনায় কোনোখানে যান নাই। এই বাড়িতেই আছিলেন। তাইলে

রেল-ইস্টিমারের টিকিট পাইলেন কোথায়? তিনার তো পাসপোর্ট আছিল না। পাসপোর্ট পাইলেন কোথায়?

রহস্য! রহস্য? রহস্য।

ঠাকুর-রহস্য নিয়ে চর্চা চলতেই থাকবে। লৌহজং থানার দারোগা কাজী এবাদুর আর সেকেন্ড অফিসার বজলুর রহমান সঙ্গে যে তিনজন কনস্টেবল এসেছিল, তাদের নিয়ে থানায় ফিরবে দুপুরের পরপর। স্পিডবোটের শব্দে কথাবার্তা তেমন বলা যায় না। বললেও বলতে হয় চিৎকার করে। চিৎকার করে কথা বলাটা এবাদুর তেমন পছন্দ করেন না। তিনি ঠান্ডা মাথার মানুষ। তবে সর্বত্রই পুলিশি মেজাজ বজিয়ে রাখেন। শীতল গম্ভীর গলায় কথা বলেন। তাঁর ওই ভঙ্গিতেই আসামিদের বুকে কাঁপন শুরু হয়। বিকেলবেলা সেকেন্ড অফিসারকে নিয়ে চা পান করতে করতে ঠাকুরের ঘটনা তুলবেন তিনি। বরিশাল অঞ্চলের লোক। দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ফলে তাঁর ভাষাটা শুদ্ধর কাছাকাছি। কখনো কখনো দু-একটি শব্দের ব্যবহারে বা কথা বলার ঢঙে বরিশালের প্রভাব টের পাওয়া যায়।

সেকেন্ড অফিসার বজলুর সঙ্গে এবাদুরের সম্পর্ক ভালো।

সময়-সুযোগ পেলেই দুজন আড্ডা দেন, চা পান করেন। এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন।

আজ তাঁদের আলোচনার বিষয় ঠাকুর। রহস্যটা তাঁদের মাথায়ই ঢুকছে না। ঠাকুর হাতে হাতে প্রমাণ করে দিলেন হত্যাকাণ্ডের দিন দুপুরের পর তিনি চলে গিয়েছিলেন ভাগ্যকূল গোয়ালন্দ হয়ে কলিকাতা। রেলের টিকিটের অংশ দেখালেন, পাসপোর্টের সিল-ছাপ্পর দেখালেন। কলিকাতা যাওয়া-আসা দুটোই বর্ষার পানির মতো পরিষ্কার। তাহলে তাঁর মতো দেখতে খুনটা হলো কে?

বৈকালিক চা পান করতে করতে এই প্রশ্নটা বজলুর রহমানকে করবেন এবাদুর।

বজলু ফুরুক করে চায়ে চুমুক দেবে। ‘ঠাকুরের মতো দেখতে লোকটার মুখ রক্তে মাখামাখি ছিল, এ জন্য হয়তো আসল চেহারা বোঝা যায়নি। এমনও হতে পারে, খুন হওয়া লোকটা ঠাকুর বা চৌধুরীর কোনো আত্মীয়। দেখা করতে এসে খুনের শিকার হলো। ঠাকুরের কোনো আত্মীয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। লোকটা হয়তো চৌধুরীর আত্মীয়।’

এবাদুর বলবেন, ‘সবই বুঝলাম। কিন্তু খুন দুটো করল কারা তার তো কোনো হদিস পাওয়া গেল না। অবশ্য হদিস পাওয়ার কারণও নেই। খুনের ঘটনায় কয়দিন পরেই তো

ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ওয়ার লেগে গেল। এদেশের মালাউনদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা সব বাদ দিলো সরকার। হিন্দুগো জায়গা-সম্পত্তি হয়ে গেল এনিমি প্রপার্টি। মালাউনদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনার দরকার নেই, বজলু। ঠাকুর থাকুক তার মতো। আমরা আমাদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি। দেশে এখন অনেক কাজ। ওদিকে ঢাকা শহরে চলছে আন্দোলন। শেখ সাহেব ছয় দফা দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন চাইছেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিচালনা হলে দেশের মানুষ

খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে। শান্তিতে থাকতে পারবে। ছাত্ররা লেখাপড়া করতে পারবে ভালোভাবে। বেকারত্ব থাকবে না। আইনের লোক হয়েও, পাকিস্তান গভরম্যান্টের লোক হয়েও আমি শেখ সাহেবের পক্ষে।’

সেকেন্ড অফিসার বজলুর রহমান আর কোনো কথা বলবে না। চা শেষ করে সিগারেট পান করবার জন্য থানার বারান্দার দিকে চলে যাবে। ওসি সাহেবের সামনে সে সিগারেট ধরায় না।

রতনপুর গ্রামেও চলবে ঠাকুর-রহস্য উদ্ঘাটনের চর্চা। ইব্রাহিমরা কয়েকজন একত্র হবে প্রাইমারি স্কুলটার মাঠে।

থানায় যে প্রকারের আলাপ-আলোচনা হয়েছে, একই প্রকারের চিন্তা-ভাবনা ইব্রাহিমদের মধ্যেও চলবে। কথোপকথন প্রায় একই রকমের। দশ-বারোজন গ্রাম শাসন করা যুবকের একেকজনের একেক মত জানা যাবে। তবে ঠাকুর সম্পর্কে অশোভন কোনো শব্দ তারা উচ্চারণ করবে না। ভুলেও ঠাকুরকে মালাউন বলবে না। তারা সবাই ঠাকুরের অনুগত। ঠাকুরকে মান্য করে। একটাই কথা তাদের, ঠাকুরের জায়গায় যে-ই খুন হয়ে থাকুক, মানুষটা কে? ঠাকুর যে কলিকাতায় চলে গিয়েছিলেন, তাতে কারো কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। চৌধুরী একটু খ্যাচরম্যাচর করা স্বভাবের লোক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁকে খুন করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে না। জায়গা-সম্পত্তির লোভেও যে তাঁকে কেউ খুন করবে, তেমন আশঙ্কা যদি থাকবে, তাহলে তো সাতচল্লি­শের পরেই করতে পারত। খুনিরা তো ধরাও পড়ল না! ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ সব এলোমেলো করে দিলো।

ইব্রাহিমরা তারপর সিদ্ধান্ত নেবে, ঠাকুরের সঙ্গে তারা আগের মতোই মেলামেশা করবে। দেশ গেরামে উৎসব-আনন্দ আগে যেমন হতো, তেমনই হবে। সব আগের মতোই চলতে থাকবে। তবে ঠাকুর যে বাড়ি থেকে আর বেরোবেন না, রোগী দেখতে গ্রামান্তরে যাবেন না, সেটা তখন পর্যন্ত তাদের কানে যাবে না। ধীরে ধীরে তারা জানবে, রোগীরা ঠাকুরবাড়িতে আসবে তাদের দেখাতে। তিনি চিকিৎসা করবেন আগের মতোই। লৌহজং বা ঢাকা থেকে ওষুধ আনবার জন্য ফর্দ তৈরি করে বদরুকে পাঠাবেন লৌহজং পর্যন্ত আর ঢাকায় পাঠাবেন কুসুমপুরের রতনলালকে। রতন ঠাকুরের খুবই বিশ্বস্ত ও অনুগত। এসব তথ্য ধীরে ধীরে জানবে গ্রামের লোক।

ওদিকে ঠাকুরের আসল রহস্য জানবে শুধু বদরু। শুধু একটি তথ্যই ঠাকুর তাকে জানতে দেবেন না, তা হলো, ঠাকুর ও চৌধুরীকে খুন করল কারা? বদরু এই সম্পর্কে জানতে চাইলে ঠাকুর তাকে পরিষ্কার বলে দেবেন, এই প্রসঙ্গে যেন সে আর কোনো দিন কথা না বলে। ঠাকুরের বাড়িতে আগের মতোই বসবাস শুরু করবে বদরু। ডর-ভয় আর কিছুই থাকবে না তার। আগের সেই শান্তিময় জীবনটা সে ফিরে পাবে। দুঃখ বদরুর একটাই, বাপটা জেনে যেতে পারল না কিছুই। ঠাকুরের ফিরে আসা আর বদরুর এই আনন্দময় জীবন ফিরে পাওয়া যদি জমশেদ হাজাম দেখে যেতে পারত, বদরুর তাহলে কোনো দুঃখ থাকত না।

কথাটা সে ঠাকুরকে বলবে এবং শুনে ঠাকুর মৃদু হাসবেন। ‘তর বাপের মরণের জন্য তুই দায়ী, বদরু।’

‘কেমতে, কর্তা?’

‘তর বাপ যে রাত্রে মরল, সেই রাত্রে উঠানে বইসা আমার সম্পর্কে কিছু কথা তুই তর বাপরে বলছস। সেইসব কথা বলতে আমি তরে নিষেধ করছিলাম। মরতি তুই, তয় তরে আমি বাঁচাইয়া রাখছি। আমি ফিরত আসলে যেন তুই আবার আগের মতো আমার লগে থাকছ, আমার কাম-কাইজ করছ। তারও একটা কারণ আছে। আমার জীবনের অনেক ঘটনা তুই জানস। তরে আমার দরকার আছে। এই ভুল আর করিস না বদরু। তয় তুইও মরবি।’

বদরু সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের পা জড়িয়ে ধরবে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলবে, ‘মইরা গেলেও এই ভুল আর করুম না, দাদা। আপনেরে লইয়া আমার পেট থেকে আর কোনো কথা বাইর হইব না, দাদা। একবার ভুল করছি, ইহজিন্দিগিতে আর করুম না। আমার শাস্তি বাজানের ওপর দিয়া গেছে। তার বাদেও আপনি আমারে মাফ কইরা দিয়েন।’

ঠাকুর স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলবেন, ‘যা মাফ কইরা দিছি তরে। এসব লইয়া আর চিন্তা করিস না। তর কোনো ডর-ভয় নাই। থাক আমার লগে।’

ঠাকুর আর বদরুর কথা হবে বেশ খানিকটা রাত হয়ে যাওয়ার পর। তখন এই বিশাল বাড়িটি ভুতুড়ে অন্ধকারে ভরে আছে। বর্ষারাতের হাওয়া বয়ে যায় শন শন করে। ঝিঁঝিরা ডেকে যায় তাদের স্বভাবমতো। খাবারের সন্ধানে বাদুড়েরা ওড়াউড়ি করে মাথার ওপর। একটা ডাহুক পাখি সাথি হারাবার কষ্টে অবিরাম ডেকে যায় গুহের বাড়ির বেত-ঝোপের দিকে।

[‘কাল’ উপন্যাসের চারটি কিস্তি এ-পর্যন্ত কালি ও কলমে প্রকাশিত হয়েছে। ঔপন্যাসিকের অসমর্থতার কারণে আপাতত উপন্যাসটির প্রকাশ স্থগিত করা হলো।]