কিনু পুরুষ

পু কুরে ঘাট হয়, ঘর হয় – এই কথা বোধহয় নতুন। বাপের ভিটায় জায়গা হয়নি কিনুর। তাই শাহজাহানদের পুকুরপাড়ে ঘর বেঁধেছে। রাস্তার পাশ দিয়ে লোকজন যাওয়ার সময় তাদের আর ঘাটের কথা মনে হয় না। কারণ ওই ঘর। চাঁচের বেড়া, কুটোর ছাউনি।

পুকুরের চওড়া পাড় সবুজ ঘাসে এতটা মজবুত, কেউ কোনোদিন মাটি ভেঙে পড়তে দেখেনি। পুকুরটা নতুন নয়। বেশ পুরনো। তবে সব সময় নতুনই মনে হয়। লালচে এঁটেল মাটি অল্প-মেঘ আকাশের লালিমার মতো লেপ্টে থাকে। সেই ভিজে কাদাটে মাটির ওপর দুটো খেজুরগাছ বিছিয়ে ঘাট বানিয়েছে কিনু। খেজুর গাছদুটো শুকিয়ে গিয়েছিল বাগানে। কেমন লম্বা হয়ে আকাশ ছুঁতে চাইতো। ছেলেবেলায় বাপ যখন গাছ কাটতে যেতেন, তখন কিনু তলায় দাঁড়িয়ে দেখতো সিঁড়ি হয়ে ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে গাছগুলো। সারাজীবন যারা রস দিয়েছে, আজ পুকুরের পানির রসে ডুবে আছে তারা।

পুরুষের বুক এত সরু হয় ওকে না দেখলে বোঝা যায় না। সেই সরু বুকে কালো কালো মিহি লোম। বৃষ্টির পর খড়ের চালের কুটোর মতো লেপ্টে থাকে বুকে। গোসল করে উঠলে চেয়ে চেয়ে দেখে ওর বউ। চাঁচের বেড়ার জানালায় কপাল ঠৈকিয়ে রাখে। কিনু গোসল করছে। পিছল কাদায় পা পিছলে গেল হঠাৎ। দুই হাতে উঁচু ডাল ধরার ভঙ্গি করতে করতে ঝপ করে পড়লো পানিতে। বউয়ের হাসি ছড়ালো ছোট্ট ঘরটায়। হাসির দমক থামলে বউ ভাবে, এই তার পুরুষ। এখন কেমন বাতাসের ঘায়ে লুটিয়ে পড়ে, আর রাতের বেলা বাতাসের মতো গতিমান। চৈত্র মাসের গরমে কতবার যে গোসল করেছে ওরা। চালের জোড়া চড়ুই পাখি যেন। কতবার ওঠে-নামে। ফড়ফড় করে পাখনায় পানির ঝাপটা দেয়। বছরখানেক বিয়ে হলেও এখনো পুরনো হতে চায় না দিন। নতুন করে মনে পড়ে পেছনের কথাগুলো।

বাজার থেকে রাহেলাদের বাড়ি বেশিদূরে নয়। তরিতরকারি বিক্রি করে ওর বাপ। বেলা ডোবার আগে মাছ, তেল, লবণ ছোট চটের থলেয় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন ওকে। পেছনে ঝুলিয়ে নিয়ে আসে। বড় রাস্তা থেকে তিন-চারটে জমির আল পার হলে পথ আড়াআড়ি হয়। তখন বৈশাখ মাস। ফসলশূন্য মাঠ। ছোট ছোট নাড়া শুকিয়ে আছে। জমিও ফেটে কাঠ। মাটির চারকোণা ফাটল বিছিয়ে আছে জমিতে। আল ছেড়ে কোনাকুনি পায়ে চলার পথ সাদাটে সুতার মতো লম্বা। মাঝে মাঝে শিয়ালকাঁটা গজিয়েছে। সবুজ তীক্ষ্ন পাতার দু-পাশে বিষময় কাঁটা। তার মধ্য থেকে ফুটে বেরিয়েছে গাঢ় হলুদ ফুল। রাহেলা পথ চলতে চলতে কাঁটা-ফুল দেখছে। সন্ধ্যা প্রায়। মাঠের শেষের আমবাগানটা পেরোলেই ওদের বাড়ি। অসাবধানে হোঁচট খেয়ে চপ্পল খুলে গিয়ে খালি পা পড়লো কাঁটার ওপর। উহ্ শব্দ করে বসে পড়লো শুকনো মাটিতে। থলের ভারে পেছন দিকে হেলান দেওয়ার মতো কাত হলো। পা দুটো বিছিয়ে গেল। আহত পা’টা কাঁপছে। রক্ত ঝরছে। জ্বালায় মুখটা বাঁকা হয়ে আছে। এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে সহ্য করে নিতে চাইলো। পায়ের তলায় স্পর্শে হঠাৎ ব্যথাদীর্ণ চোখ খুললো রাহেলা। নখ দিয়ে খুঁচিয়ে কাঁটা তুলছে কিনু। একবার শুধু ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো আর বাঁ হাত উঠিয়ে বসে থাকতে বললো। কাঁটা তুলে নিজের গামছা দিয়ে রক্ত ও ধুলো মুছে বললো, বাড়ি যাতি পারবি, না আমি থলে বয়ে দোবো?

না না, আমি যাতি পারবানে। তুমি যাও কিনু ভাই।

দেইকে-শুইনে পত চলিস। হন্ হন্ কইরে হাটিস ক্যান?

এর ছয় মাস পরে বিয়ে হয়েছে ওদের। একই পাড়ায় বাড়ি। গায়েপড়া ভাব থাকলেও কোনোদিন খারাপ নজরে তাকায়নি কিনু। মনে আছে, সেদিন পায়ের ব্যথায় শুকনো জমির ওপরে বসে থাকলে হঠাৎ হাওয়ার মতো এলো। ঠিক যেখানটায় ব্যথা সেখানে ধরে কাঁটা তুললো। সুযোগে অন্য কোথাও ছুঁয়ে দেওয়া বা হেলান দেওয়া ভঙ্গির উর্বশী বুকের দিকে আলাদা করে তাকালো না। রাহেলার মনে এই অতিকৃশ কালো মিচমিচে মানুষটার হৃদয় সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা হয়েছিল। স্কুলে দুই-তিন ক্লাসের বেশি না পড়তে পারলেও মেয়ে হিসেবে পুরুষের দৃষ্টি পড়তে কষ্ট হয়নি। তাই বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে, না বলতে পারেনি। যদিও জানত – ও পূর্ণিমার চাঁদ, কিনু অমাবস্যার অন্ধকার।

ঘরের ছোট্ট বারান্দাটা রাস্তার বদলে ফসলের মাঠ ও বনের দিকে। বারান্দার একপাশে মাটির ঝিকের চুলো। দুজনের রান্না অল্পতেই হয়ে যায়। রান্না সেরে পাটির ওপর বসে আছে রাহেলা। হারিকেন জ্বলছে নিবু শিখায়। কিনু গিয়েছে ও-পাড়ায়। ছোট বোনটার বনিবনা হচ্ছে না স্বামীর সঙ্গে। আলাপ করতে হবে। তাছাড়া মায়ের শরীরও ভালো নয়। সেজন্য একটু বেশি সময় নিচ্ছে আজ বাড়ি ফিরতে। বালিশে হেলান দিয়ে বসল রাহেলা। জ্যৈষ্ঠ মাসের এই সন্ধ্যায় পাশের আমবাগান থেকে পাকা আমের ঘ্রাণ নিয়ে আসে বাতাস। মাঝে মাঝে ঝড় হয়। কিনু ঝড়-মাথায় অন্ধকারে নেমে পড়ে আম কুড়োতে। এনে খুশিতে ডগমগ হয়ে তুলে দেয় ওর হাতে। আজ অন্ধকার নেই। পূর্ণিমা। পরিপূর্ণ চাঁদ। বড় আমগাছটার ঠিক মাথার ওপর। দূরে রশিদ নায়েবের উঠোনে কারেন্টের আলো জ্বলছে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে ওরা। হারিকেনের সলতে ওঠানামা করার সময় মনে পড়ে সুইচের কথা। চাঁদটার দিকে তাকায় আবার। অবাক হয়। ‘চানডা কী সুয্যের বুইন’, ভাবে মনে মনে। ‘এত সুন্দুর আলো কনে পায় চান? ওর তো সুইচ দেকিনে, গোল হইয়ে ওটে, কী ফকফকা আলো দিয়ে চইলে যায়।’ মাঝে মাঝে ধোঁয়ার মতো আলো দেখেও এইরকম ভাবে।

ঝিমুনি এসেছিল একটু। তারপর চোখের পাতা বুজে এসেছিল কখন টের পায়নি। জোরালো বাতাস মাঠের মধ্য থেকে ছুটে যাচ্ছে বনের দিকে। কুটোর চালে উড়ে উড়ে আসছে পাতা। নিঝুমতার ভেতরও হাওয়ার ডাকে চোখ খুলে গেল রাহেলার। আধখোলা চোখে সামনের মাঠ মনে হচ্ছে দুধের নদী। চাঁদ চুইয়ে চুইয়ে দুধময় আলোর বহতা নেমেছে এই মাঠে। দৃষ্টি একটু ফর্সা হলে বাগানের কোনা থেকে সরুপথে এক ছায়া নামতে দেখলো। বেশ দূরে হলেও বুঝতে পারলো এ-ছায়া কার। অতি ছোট, অতি চিকন কাঠির মতো ছায়াটা কেমন হেঁটে আসছে তন্ময় আলোর নেশায়। বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালে রাহেলা বললো, এত রাত হইলো যে? মা’র শরীল ভালো আছে তো? হাজেরা বু’গের ঝগড়া মিটেছে?

ভাত বাড়ো, খাতি খাতি সব কচ্চি।

আইচ্চা।

বু আর ভাই সায়েপের সঙ্গে কতা বললাম। ছোটখাট সমস্যা। ও মিটে যাবে।

কতা বন্দ। তা কি কতা হচ্চে একন?

হচ্চে, কিন্তুক উড়ো উড়ো।

আর মা’র অবস্তা কী?

খুপ বেশি ভালো না, বু’র বললাম, মা’র কাছ থেইকে নড়িস নে। সাতে আনতি তো চাইলাম অনেক আগে। মা-ই তো মাইয়ের সাতে ছাড়া থাকপে না।

কিনুর বাবা মারা গেছে বছর তিনেক আগে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে জামাইকে নিজের ভিটেয় ঘর করে দিয়েছিলেন। জবেদ তখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। অনাথ। ছোটবেলায় নাকি গাঙের ওপার থেকে এসে শাহজানদের বাড়িতে উঠেছিল। বিয়ের পর ও অন্যদের জমিতে জন দেয়, থাকে শাশুড়ির কাছেই। নিজের মা-বাবা কেমন, মনে পড়ে না।

শ্বশুর-শাশুড়িকেই বাবা-মা মেনেছে। বেঁচে থাকতে শ্বশুর, জামাইয়ের বদলে ছেলেই মনে করেছেন।

একমাত্র ছেলের বিয়ে নিজ হাতে দিয়েছেন কিনুর বাবা। মায়ের মত ছিল না। মনে মনে অন্য কাউকে ভেবেছিলেন। কিন্তু কিনুর মতের বাইরে ওর বাপ যাননি কোনোদিন। শাশুড়ি তাই বউকে মেনে নেননি। কিনু ও রাহেলা অনেক চেষ্টা করেও মায়ের মন গলাতে পারেনি। তাই বাপের ভিটে থেকে উঠে আসা। এরপর থেকে ছেলের মুখ প্রায় দেখেনই না ওর মা। কিনুর সান্ত্বনা, মা তবু বেঁচে আছেন। বাবার কথা মনে হলে চোখ ভিজে আসে সঙ্গে সঙ্গে। কী শক্ত-সমর্থ মানুষ। তখন শীতের সময়। বিকেলে খেজুর গাছের মাথা চেছে কেবল ভাড় পেতেছেন। ছোটবেলার মতো সেদিনও সঙ্গে গিয়েছিল কিনু। হঠাৎ দেখলো বাপ খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসছেন। অর্ধেক-গাছ পর্যন্ত নেমে হিড়হিড় করে পড়ে যাচ্ছেন নিচে। পেছনের ঠোঙা থেকে দা ছিটকে পড়লো মাটিতে। কিনু সরে না দাঁড়ালে ওর গায়েই পড়তো দাটা। তাড়াতাড়ি এসে বাপের হেলে থাকা মাথা তুলে নিল নিজের কোলে। একহাতে বুক চেপে, ফিসফিসিয়ে হা করে পানি খেতে চাইলেন। দৌড়ে কাছের কোনো বাড়ি থেকে কাঁসার গ্লাসে পানি এনে দেখে বাপের মাথাটা বড় এক ঢেলার ওপর এলানো। অল্প হা-মুখে পানি ঢাললো কিনু। নড়াচড়া দেখলো না। এর মধ্যে পাড়া ভেঙে চলে এসেছে লোকজন। সবাই মিলে ধরে বাড়িতে নেওয়া হলো। মাজহার ডাক্তার এসে নাড়ি দেখে মুখ অন্ধকার করে কিনুকে বললেন, তোমার বাপ আর নেই। হার্ট ফেল করেছেন। এই কথা শুনে মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। চোখ মেলে দেখে বারান্দায় শুয়ে আছে। পাশে রাহেলা। দূরে মায়ের কান্নার আওয়াজ। শোরগোল।

বাপের সামান্য জমি ও কিছু খেজুরগাছ আছে। বাড়ির পাশে তরিতরকারি লাগানো যায়। উঠোনের পাশে পেয়ারা, জাম ও নারকেল গাছও আছে বেশকিছু। তবু সংসার চালানোর জন্য এ যথেষ্ট নয়। পরের জমিতে কাজ করাও কিনুর ধাতে সয় না। সারাজীবন বাপের পেছনে পেছনে ঘুরেছে। স্কুলে তিন-চার ক্লাস পড়ে স্যারের হাতে মার খেয়ে আর কোনোদিন ও-মুখো হয়নি। ওর বাপ জোর করেননি পড়ার জন্য। মুচকি হেসে শুধু বলেছিলেন, শুদু বই পইড়ে লোক মানুষ হয় না রে। চারিদিক তাকায় দ্যাক, শিখার কত কিচু আচে। মনে যা চায়, তাই করবি। বদকাজ না করলিই হইলো। বাপের কথাগুলো খুব পছন্দ হয়েছিল ওর। সেই থেকে একরকম ভবঘুরে। সকালে উঠে গামছা কাঁধে ফেলে চলে গিয়েছে কপোতাক্ষর পাড়ে। মন করলে বড়শি পেতে বসেছে গাছের ছায়ায়। ঘাসে। মাঝে মাঝে বড় বড় মাছ নিয়ে এসেছে বাড়িতে। বাপ হুঁকোয় লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে হেসেছেন ঋষির মতো।

দুজনের পেট ভরানোর জন্য নিয়মিত কিছু আয় জরুরি। তাই প্রায় প্রতিদিন বিকেলে বাজারে কেরোসিনের স্টোভে পাপড় ভেজে দু-পয়সা রোজগার করে। সকালে মাছ ধরতে যায়। পেলে কিছু বিক্রি করে, কিছু মা-বোনকে দেয়, বাকিটা বাড়ি আনে। বাপের ভিটায় গেলে মায়ের কাছে গিয়ে বসে। হাতে গুঁজে দেয় টাকা। মা যন্ত্রের মতো মুঠো আটকে রাখেন।

আগে প্রতিদিন বিকেলে ফুটবল খেলতো। আলাদা জায়গায় ঘর করার পর আগের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। তবু

মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সেদিন পাপড় ভাজা বন্ধ। খেলার মাঠে, ওর জায়গায় দাঁড়িয়ে যায়। ফরোয়ার্ডে। ও খেলতে চাইলে দলনেতা আর কাউকে ওখানে নেয় না। নিয়মিত দর্শক খুশি হয়। বল পায়ে এলে সবাই বলে ওঠে, ‘ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা।’ মিনি ম্যারাডোনা বলেও ডাকে কেউ কেউ। নাম ভুলে একপ্রকার পেলে-ম্যারাডোনা নামেই পরিচিত এখন ও। পেলের মতো কালো আর ম্যারাডোনার মতো সংক্ষিপ্ত উচ্চতা এই খেতাবের কারণ।

ভোর হয়েছে। রাহেলার ঘুম ভেঙে যায় আজানের শব্দে। ও-পাড়ার মসজিদটা বেশি দূরে নয়। মাইকের চোঙ মনে হয় এদিকে দেওয়া। তাছাড়া সকালবেলা চারদিক নিঝুম থাকার জন্য শব্দটা একেবারে কানে এসে বাজে। খারাপ লাগে না ওর। ঘুমন্ত পৃথিবীকে জাগিয়ে দেওয়ার জন্য এই আহ্বান মন্দ নয়। কিনু একটু বেলা করে ওঠে। চাঁচের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্য চোখ না ছুঁলে চোখ খোলে না। রাহেলা পুকুর থেকে বাসি থালাবাটি মেজে, গোসল সেরে রুটি বানাতে বসে। রুটি, ভাজি হয়ে গেলে হালকা স্বরে ডাকে, আর কত ঘুমোবা, উইটে পড়ো দিনি। নুটি ছেকিচি।

আজো তেমন হলো। রাহেলা ডাকলো। কোনো সাড়া নেই। ঘরে গিয়ে দেখে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কিনু। পাশে বসে খালি পিঠে হাত রাখলো। কাত হয়ে নিজের চোয়াল ঠেকালো কিনুর অর্ধ-উদ্ভাসিত চোয়ালে। চুলার তাপে উষ্ণ হয়ে আছে রাহেলার লাবণ্যময় লাল গাল। একগোছা ভেজাচুল এসে পড়লো কিনুর চোখের ওপর। আড়মোড়া ভেঙে সোজা হয়ে শুয়ে তাকালো বউয়ের দিকে। এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে প্রতিদিন। সকালে গোসল করে রাহেলা। তারপর চুলার পাশে বসে। আগুন যেন ওর বোন। সকালবেলার সূর্যের আলোর পুতুল কিনুর ঘরে। ওর পাশে ওকে কী যে বেমানান লাগে। সাহসে ভর করে প্রস্তাব দিয়েছিল। ভাবেনি এই মেয়ে ‘হ্যাঁ’ বলবে। আজ ঘরের বউ। অফুরন্ত প্রেম এই মেয়ের অন্তরে। কিনুও যত্নের কমতি করে না কখনো। দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বুকের ওপর তুলে নিল। রাহেলা বললো, যাও, তুমি একনো নাপাক। আমি গোসল করিচি। আগে ডুব দে আইসো। খাইয়ে ন্যাও। আরেকটা কতা। আইজ তোমাগের বল খেলার বন্দু আইলো। তুমার কাচে দরকার। বলছিলো, আইজগের ফাইনাল খেলা আচে মাটে। তুমার খেলতি হবে। কিনু লাফ মেরে উঠে বসলো। বললো, তাই নাকি। আমি তো কদিন খেলতিই পারিনি। কত ঝামেলা গেল। আইজ খেলবো।

একটা প্রীতি ম্যাচ হবে পাশের গ্রামের সঙ্গে। হঠাৎ করেই এই আয়োজন। গ্রামের মাঠের চারদিকে পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ দাঁড়ানো। বাজারের দিকেও মানবদেয়াল দুলে উঠছে বল সেদিকে গেলে। আগে গ্রামে ফুটবল ম্যাচে বুট ও জার্সি থাকতো না। কেউ কেউ হ্যাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরতো। কাচামারা লুঙ্গির খেলোয়াড়ও চোখে পড়তো। এখন সবার পায়ে বুট, গায়ে জার্সি। মাঠময় লাল-নীল জার্সি দৌড়ে বেড়ায়। মুগ্ধ হয়ে দেখে সবাই। কিনুর পরনে লাল জার্সি, সাদা হাফপ্যান্ট, পায়ে বুট ও লালমোজা। অন্যদলের গায়ে নীল জার্সি। প্রথমার্ধের খেলা শেষ। গোল হয়নি। মাঠে বসে যে যার এলাকায় জটলা করছে। শলামরামর্শ করছে দলনেতা, কোচ। অন্যান্য দিন কিনুর পায়ে দু-একটা গোল এসে যায়। আজ পেরে উঠছে না তেমন। অপরপক্ষ বেশ শক্ত।

খানিকটা বেশি বেলা থাকতে খেলা শুরু হয়েছে। যাতে পুরস্কারপর্বটা দিন থাকতে শেষ হয়। মেহমান খেলোয়াড়রাও ফিরে যেতে পারে বেলায় বেলায়। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা তুমুল উত্তেজনাময় হয়ে উঠলো। লালদল যেন দুর্দম অবাধ্য তেজী অশ^। নিজের মাঠ বলে মুহুর্মুহু আক্রমণ করছে অন্যপক্ষের ওপর। নিখুঁত পাসিং, শাণিত আক্রমণ, নির্ভুল ফিনিশিং। ১০ নম্বর জার্সির কিনু বল ধরলে আকাশ-দীর্ণ আওয়াজ উঠলো, ‘পেলে-ম্যারাডোনা, পেলে-ম্যারাডোনা, গোল দে, গোল দে …।’ লম্বা লম্বা খেলোয়াড়ের ভিড়ে কিনু যেন বল কুড়ানো বালক। কিন্তু বল ধরে যখন তিনজনকে কাটিয়ে, শেষ দুজনের সামনে বল এ-পা ও-পা করে, শূন্যে তুলে মুহূর্তে ঘুরে এক নিমেষে গোলকিপারের সামনে এসে দাঁড়ালো, মনে হলো, থইথই নীলের ভেতরে সন্ধ্যার লাল সূর্যটা অসীম সমুদ্রের জল ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু পরেই ডুব দেবে। গোলের সীমানা দেখে নিয়ে, গোলকিপারের চোখের দিকে একটু তাকিয়ে বল মারলো কিনু। ডানদিকের সাইডবারের কোনা দিয়ে বল আটকে গেল জালে। মাঠভরা উল্লাস দেখলো ঝাপসা চোখে। ভেসে যাচ্ছে কিনু। লাল লাল জার্সির দোলায় শূন্যে ভাসছে। সবাই এসে কখন ওকে কোলে তুলে নিয়েছে বোঝেইনি।

খেলা শেষে স্টেজ সাজানো হলো। পুরস্কার প্রদান পর্ব। কিনু বসে আছে ঘাসে। কে যেন ওর কানে কানে বললো, তুমার মা কানতি কানতি বাড়ি থেইকে বের হইয়ে গেচে। তুমারে খুঁইজদেচে।

কিনুর বাপের ভিটা থেকে একটা রাস্তা পুকুরপাড় হয়ে ইটের রাস্তায় মিশেছে। এই পথে কখনো রোদ পড়ে না। দুপাশে ঘন সবুজ গাছপালা। পথের ওই প্রান্তে একটি বিরাট বটগাছ। জোরে বাতাস হলে ঝুমঝুমির বাজনার মতো আওয়াজ আসে। ছায়াভরা এই পথটা বালুময়। ঠান্ডা। ছেলেরা মার্বেল খেলে এখানে। এই অতিমসৃণ ছায়াবিছানো পথ কোনোদিন অন্যরকম দেখেনি কেউ। কিনু এক দৌড়ে ওই পথের প্রায় মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়ালো। ওর মা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আসছেন। পেছনে হাজেরা বু। তুমুল বকাবকি করছে মাকে। মা অসহায় চোখে সামনে তাকিয়ে এগোতে চাইছেন। হাজেরা বলছে, ছেইলের কাছে না গেলি হয় না? যে ছেইলো বাপের ভিটে ছাইড়ে গেল, তার জন্যি এত মায়া?

কিনু দু-হাতে মাকে জড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। কিছু বলতে চাইছেন। স্বর বেরুচ্ছে না। হাত উঠিয়ে দেখালেন সামনে। রাহেলাও এসেছে। অন্যপাশে ধরে ওঠাতে চাইছে শাশুড়িকে। ছেলে ও বউয়ের কাঁধে ভর দিয়ে ঝুলে আছেন মা। হাঁটার শক্তি নেই। দুজনে কোলে করে আনলো ঘর পর্যন্ত। বারান্দায় শোয়ালো। উঠে বসতে চাইলেন। আধশোয়া হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ওই মাঠের যে-গাছ থেকে কিনুর বাপ পড়ে গিয়েছিলেন সেটার দিকে। রাহেলা পানি এনে মুখে ধরলে খেলেন এক চুমুক। সাদা ঝাপসা চোখে তাকালেন বউয়ের দিকে। হাত ওঠাতে গেলেন। সামান্য শূন্যে উঠে ধপ করে পড়ে গেল হাতটা। চোখ বুজে এলো। ঘাড় কাত করে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকলেন কিনুর মুখে। ছোট্ট ছেলের মতো মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে উঠলো কিনু।