কোরিয়ান কবি হান ক্যাংয়ের কবিতা

ভাবানুবাদ : মঈনুস সুলতান

কবি-পরিচিতি : দক্ষিণ কোরিয়ার কবি হান ক্যাংয়ের জন্ম ২৭ নভেম্বর, ১৯৭০ সালে। ২০১৬ সালে দ্য ভেজিটারিয়ান শিরোনামে একটি উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারে ভূষিত হলে শিল্প-সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর পরিচিতি ঘটে। উল্লেখ্য, তাঁর পিতা ছিলেন যশস্বী ঔপন্যাসিক হান সোয়ে-ওন। তাঁর ভ্রাতা হান ডং রিমও লেখক হিসেবে খ্যাতিমান।

তারুণ্যে কবি ইয়োনসেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোরিয়ান সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করেন। কবি হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৩ সালে লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি নামে একটি জার্নালে ‘সিউলে শীত ঋতু’ শিরোনামে পাঁচটি কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। পরের বছর লোহিত নোঙর নামে উপন্যাস রচনা করে তিনি জয়ী হন সিউলের শিনমুন স্প্রিং লিটারেরি কনটেস্টে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কবিতায় – ফ্রুটস অব মাই উইম্যান (২০০০) ও ফায়ার সালাম্যানডার (২০১২); উপন্যাসে – দ্য বস্ন্যাক ইভেনিং ইন দ্য ড্রয়ার (২০১৩) এবং প্রবন্ধে লাভ অ্যান্ড দ্য থিংগস্ অ্যারাউন্ড দ্য লাভ (২০০৩) প্রভৃতি।

২০১৩ সাল থেকে কবি হান ক্যাং সিউল ইনস্টিটিউট অব আর্টসে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর পড়ানোর বিষয় হচ্ছে ক্রিয়েটিভ রাইটিং। লেখালেখির সঙ্গে সঙ্গে কবি সংগীতচর্চায়ও বিশেষভাবে আগ্রহী। তাঁর রচিত ও স্বকণ্ঠে গাওয়া দশটি গানের একটি সিডি প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে।

সাহিত্যে ম্যান বুকার পুরস্কার ছাড়াও তিনি হেনকক ইবো এক্সেলেন্ট রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৫), কোরিয়ান ফিকশন অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৯) এবং ই সাং লিটারেরি অ্যাওয়ার্ড (২০০৫) প্রভৃতি পুরস্কার অর্জন করেন।

উপস্থাপিত কবিতাগুলো কোরিয়ান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন সোফি বোম্যান। কবি-পরিচিতি ও কবিতার সূত্র হলো ওয়েবসাইট।

 

গাঢ় অন্ধকারে ছাওয়া আলোর ঘর

 

তুষারের ভেজা কুঁচি উই ডং-এ ঝরেছিল যেদিন

নেমে আসা অশ্রুতে কাঁপছিল আমার শরীর

আত্মার দোসর হয়েছিল দোলাচলে সঙ্গিন।

 

যাও তুমি, চলো পথ স্বাভাবিকতালে

সামনে সরণি প্রশস্ত

তুমি কী দ্বিধাগ্রস্ত

খামোকা দাঁড়িয়ে থেকে বেখেয়ালে

কোন স্বপ্নে হয়েছ তুমি বিভোর

আঁধারের সমাপ্তিতে ফুটবে যে ভোর।

 

দ্যাখো – ফুটে-ওঠা ফুলের মতো আলোকিত

দোতলা বাড়িগুলো

তাকাও – চোখ তোলো

তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোগান্তির সাথে হচ্ছে পরিচয়

সড়ক চলে গেছে আনন্দলোকে – যেখানে পৌঁছতে পারেনি কেউ

চলতে চলতে দেহ-মনে জাগছে ভয়

দ্যাখো – দূরে কাঁপছে আলোকের সম্পাত

যদিও বাড়িয়েছ বোকার মতো হাত।

 

আগে বাড়ো, চলো নিজস্ব পথে

স্বপ্নে হয়েছ বিভোর, পা ফেলো যাত্রার শপথে।

 

ল্যাম্পপোস্টের ওপর জড়ো হচ্ছে স্মৃতি

হেঁটে যাই আমি ওইদিকে

তাকাই – চোখে পড়ে

বাতির ঢাকনাতলে আলোহীনতা জ্বলে অনিমিখে

দেখি ওখানে গৃহ এক গাঢ় অন্ধকারে হয়ে আছে নিবিড়

আলোর আলয়ে কালো অশরীরীরা করে আছে ভিড়।

 

ওইদিন আকাশ ছিল গাঢ় অন্ধকার

আর আলোরিক্ততায় আবাসিক পাখিগুলো

উড়ছিল নির্ভার।

 

কতবার আমি মৃত্যুকে করে নেব বরণ

ওইভাবে ওড়ার জন্য

কেউ আমার হাত করবে না স্পর্শ

বুঝবে না কেন আবেগ হয় বন্য

কতবার ম্রিয়মাণ হবে আমার পণ।

 

কোন স্বপ্ন এতো মধুচন্দ্রিম

কোন স্মৃতি জ্বলে উজ্জ্বলতায় আকাশে নিঃসীম।

 

তুষার-কুঁচি যেন আমার জননীর আঙুলের অগ্রভাগ

ছুঁয়ে যায় আমার ভুরু ও গ-দেশ

বিলি কাটে চুলে – ছড়ায় দিব্য অনুরাগ।

জলদি করো – দীপ্ত হও অন্তর্গত শপথে

পা ফেল – চলো নিজস্ব পথে।

 

আরশিতে দেখা শীত

 

\ এক \

 

খুঁটিয়ে তাকাই অগ্নিশিখার অক্ষিগোলকে

নীলাভ – হৃৎপিণ্ড-র আকৃতি এ চোখ

তাকে ঘিরে আছে যে অত্যন্ত উত্তপ্ত ও দারুণ উজ্জ্বল বস্ত্তটি

তাকে দেখায় প্রাণবন্ত ও উৎসুক।

 

তার কমলালেবু রঙের অন্তর্গত শিখা

সেখানে যে জিনিস কাঁপছে সবচেয়ে বেশি

কখনো লম্ব রেখায় কখনোবা বক্র

যা ফের ঘিরে ধরে আধেক-স্বচ্ছ

বহির্ভাগের শিখা-চক্র।

 

আগামীকাল সকালে

যে ভোরে আমি যাত্রা করবো

সুদূরের এক নগরী দিকচক্রবালে;

 

ভাবছি সে শীতের প্রভাত

নীলাভ শিখার অক্ষিগোলক বিদ্ধ হয়ে

অতিক্রম করে যাবে আমার দৃষ্টিপাত।

 

 

\ দুই \

 

আমার নগরীতে এখন বসন্ত-প্রভাত। যদি তুমি পৃথিবীর অভ্যন্তর ভেদ করে চলে যাও, নিষ্কম্প্র হাতে খনন করে সোজাসুজি ঢুকে পড়ো পৃথিবীর মাঝবরাবর, উদিত হবে সে-নগরী – যার কথা আমি বলছি। সময়ের ব্যবধান ওখানে – কাঁটায় কাঁটায় পুরো বারো ঘণ্টা। ঋতুও পিছিয়ে আছে পুরো আধ-বছর। তাই নগরীতে এখন শরতের সন্ধ্যা। কাউকে নীরবে অনুসরণ করার মতো – ওই নগরী যেন অনুসরণ করে চলছে আমাকে। রাত্রিকে অতিক্রম করার জন্য, শীতকে অতিক্রম করার জন্য আমি অপেক্ষা করি নীরবে। আর আমার নগরী কাউকে নিঃশব্দে পেরিয়ে যাওয়ার মতো অতিক্রম করে যায় সমস্ত কিছু।

 

 

 

\ তিন \

 

একটি ঠান্ডা জায়গা

আরশির অভ্যন্তরে প্রতীক্ষা করছে শীত

মারাত্মক রকমের একটি ঠান্ডা জায়গা

জায়গাটি সত্যি এমনই হিমশীতল – যা ভাবনার অতীত।

একবার জমে গেলে কোনো কিছুই আর পারে না নড়তে

তোমার মুখছবিতেও হয় না ভাংচুর

আমি নড়েচড়ে আমার হাতটাও স্পর্শ করি না

আমাদের মাঝে বাজে না কোনো সুর।

তুমিও হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চাও না তোমার হাত

একটি ঠান্ডা জায়গা

যে-জায়গাটি হিমশীতল থেকে যায়

এ ঠান্ডা এমনই মারাত্মক রকমের যে

রক্ত জমাট বাঁধে পায়।

চোখের পুতলি নাড়াতে পারে না পাতা

জানি না কীভাবে বন্ধ করবো দুচোখ

আরশির অভ্যন্তরে প্রতীক্ষা করছে শীত

তাবৎ কিছু যেন জমে যেতে হয়েছে উৎসুক;

আর আয়নাটির ভেতরে আমি এড়াতে পারি না

তোমার নির্নিমেষ দৃষ্টিপাত

তুমিও চাও না ছুঁতে তোমার দুহাত।

 

 

\ চার \

 

তারা বলেছিল উড়বে তুমি সারাদিন ধরে।

 

চবিবশ ঘণ্টাকে ভাঁজে ভাঁজে ছোট্ট পুঁটলি করে তোমার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে তারা বলেছিল, যাও – আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও।

ওই নগরীর কামরাটিতে ঢুকে স্যুটকেস খুলে কাপড়-চোপড় বদলে একটু সময় নিয়ে মুখ ধোয়া উচিত ছিল আমার।

 

যদি এ-নগরীর দুর্ভোগ নীরবে আমাকে অতিক্রম করে যায়, তাহলে আমিও নিঃশব্দে পড়ে যাব পেছনে। আর যখন তুমি নিমিষের জন্য চোখ ফেরাবে অন্যদিকে … আমি হিমশীতল ভাঁপে কুয়াশাচ্ছন্ন আয়নায় হেলান দিয়ে ভাঁজবো দেহাতি সুর, যতক্ষণ না ভাঁজ করা চবিবশ ঘণ্টার ছোট্ট পুঁটলি ফেলে দিতে পারি থুথুর সাথে।

 

তারপর আয়নায় ফিরে তুমি তাকাবে আমার দিকে ফের।

 

 

\ পাঁচ \

 

আমার চোখের বাতি দুটি সলতে পুড়িয়ে ঝরায় তপ্ত তরল মোমের ফোঁটা ফোঁটা বিন্দু; এতে ব্যথাবোধ করি না আমি – পুড়েও যায় না তেমন কিছু। বলা হয় যে, কম্পমান নীল শিখা হচ্ছে আত্মার উদ্ভাস – যে-আত্মার অবস্থান আমার যুগল চোখে; যা কাঁপে, সুর ভাঁজে মৃদুস্বরে, শিখার বহির্ভাগ দুলতে দুলতে কেবলই চলে যেতে থাকে দূর থেকে বহুদূরে। আগামীকাল তুমি রওনা হচ্ছো সুদূরের সে-নগরীটির দিকে। এখানে আমি পুড়ছি তীব্র উত্তাপে। এখন তুমি শূন্য কবরটিতে হাত রেখে প্রতীক্ষা করছো। স্মৃতি দংশন করছে তোমাকে সরীসৃপের মতো। ব্যথাবোধ করছ না তুমি, তীব্র জ্বালাপোড়াও অনুভূত হচ্ছে না তোমার। কাঁপছে না তোমার চোখমুখ, পুড়ছে না বা ভেঙেচুরেও হচ্ছে না চুরমার।