ঘানার কেইপ কোস্ট ক্যাসল

ঘানার রাজধানী আক্রা নগরী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, সমুদ্র-উপকূলবর্তী একটি জনপদে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে আসি কামরা থেকে। গেস্টহাউসের ওপরতলার ওপেন সিটিং এরিয়ায় মানিপ্লান্টের লতানো কুঞ্জের কাছে চুপচাপ বসে আছে ব্রিয়ানা। সে ডিজিটাল ভিডিও ক্যামেরার স্ক্রিনে কিছু একটা খুঁটিয়ে দেখছে। আজ ব্লু-জিন্সের সঙ্গে কেনতে-ক্লথের সিøভলেস টপ পরেছে, মাথায়ও ব্রেইড করা উইগ, এতে এ আফ্রো-আমেরিকান নারীটিকে দেখাচ্ছে ঘানায় জন্ম নেওয়া তরুণীদের মতো। আজ আমরা একত্রে আক্রা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে কেইপ কোস্ট নামে একটি শহরে যাচ্ছি। এ-যাত্রার আয়োজন করেছে ব্রিয়ানা, মিনিট দশেকের মধ্যে ট্যুর কোম্পানির এয়ারকন মাইক্রোবাস আমাদের তুলে নেবে। বাসভাড়া থেকে যাত্রার খরচাদি পুরোটাই বহন করছে সে।
আমি ও ব্রিয়ানা সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউন থেকে দিনচারেক আগে আক্রা নগরীতে এসেছি। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে এ-যাত্রাবিরতিতে আমি ঘানায় খানিক পর্যটন করছি। ফ্রিটাউনে ব্রিয়ানার বসবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। সে এখনই যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যেতে চাচ্ছে না। ব্রিয়ানা চেষ্টা করছে ঘানায় দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পাওয়ার, যা তাকে অত্র এলাকা বিশদভাবে পর্যটন করতে সহায়তা দেবে। ইবোলার দুর্বিপাকের সময় আমরা দুজনে ফ্রিটাউনে কাজ করেছি। ওখানে রোগ সংক্রমণের আতঙ্কে হোটেলাদি বন্ধ হয়ে গেলে কিছুদিন ব্রিয়ানা আমার কটেজে বাস করেছিল। তাই আজ আমাকে সে অ্যা থ্যাংক য়্যু ট্রিপটি উপহার দিতে যাচ্ছে।
আজ আমাদের গন্তব্য আক্রা থেকে আড়াই ঘণ্টার ড্রাইভিং দূরত্বে অবস্থিত জনপদ কেইপ কোস্ট। সেখানকার ঔপনিবেশিক আমলের দুর্গটিও কেইপ কোস্ট ক্যাসল নামে পরিচিত। এ-কেল্লা এক জমানায় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে কিডন্যাপ করে অন্তরীণ করে রাখার কাজে ব্যবহৃত হতো। অত্যাচার ও অনাহারে তারা শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাস ব্যবসায়ীর ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করে নিলে, শিকল প্যাঁচানো শরীরে ব্র্যান্ডিংয়ের দাগ বা তপ্ত লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে সেøভ ট্রেডিং কোম্পানির লোগো উল্কি করে, জাহাজের খোলে পুরে তাদের চালান দেওয়া হতো আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। ক্রীতদাস ব্যবসাসংক্রান্ত বইপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ঔপনিবেশিক শাসনের চারশো বছরে আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ক্রীতদাস হিসেবে চালান দেওয়া হয়েছিল কমবেশি এক কোটি বিশ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে। এ-সংখ্যার এক ব্যাপক অংশ ছিল তৎকালীন ঘানার মানুষজন। তাদের অত্যন্ত হিংস্রভাবে কিডন্যাপ করে, শিকল পরিয়ে, অন্তরীণ করে রাখা হতো উপকূলের চল্লিশটি ভিন্ন ভিন্ন কেল্লায়। এ-কেল্লাগুলোর একটি বা দুটি দেখার আমার আগ্রহ ছিল, কিন্তু আক্রায় জানাশোনা সুহৃদদের সঙ্গে সহবতে এ-কদিন ভারি ব্যস্ত ছিলাম, তাই উদ্যোগ নিতে পারিনি। ব্রিয়ানা এ-আয়োজনটি করে দিয়ে ফের আমার প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছে।
আমি তার কাছে গিয়ে উলটোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলি, ‘হাই, হাউ আর ইউ ডুয়িং টুডে, ব্রিয়ানা?’ সে ক্যামেরার স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে হাসে, তাকে কেমন যেন সেন্টিমেন্টাল দেখায়। হাত তুলে কপালে এসে পড়া চুলের সর্পিল ব্রেইড সরিয়ে সে বলে, ‘লুকিং ফরোয়ার্ড টু দিস ট্রিপ।’ তখন খেয়াল করি, তার নিরাভরণ বাহুতে শিকড়-বাকড় ও লতার কষ দিয়ে আঁকা উল্কি। এ-ধরনের জ্যামিতিক প্যাটার্ন ঘানার গ্রামাঞ্চলে কাদা-মাটি-ছনের কুঁড়েঘরে দেখা যায় বিস্তর। আমি নকশাটির তারিফ করে বলি, ‘দ্য জিওম্যাট্রিক ডিজাইন অব ইয়োর ট্যাটু লুকস ফেবুলাস।’ সে লাজুকভাবে হেসে জবাব দেয়, ‘দিস ইজ নট ট্যাটু, বাট অ্যা কাইন্ড অব বডি পেইন্ট, তিন-চারদিন থাকবে, তারপর গোসলে ধুয়েমুছে যাবে।’ নিচ থেকে ওয়েটার এসে জানায়, ট্যুর কোম্পানি ফোন করেছে, তাদের মাইক্রোবাস হোটেলে পৌঁছতে মিনিট পনেরো দেরি হবে। ব্রিয়ানার কপাল কুঁচকে ওঠে। যাত্রার শুরুতে দেরির সম্ভাবনা আমাকে উদ্বিগ্ন করে না, ট্যুর কোম্পানির মাইক্রোবাস আমাদের পিক করতে সময়মতো এসে পৌঁছলে আমি বরং ‘আচরণটিকে’ অ্যাবনরমাল বিবেচনা করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম। ওয়েটারকে আমি হরলিক্স সার্ভ করার অনুরোধ করি। ব্রিয়ানা আদুরে ভঙ্গিতে গ্রীবা হেলিয়ে বলে, ‘ইয়েসটারডে – সামথিং ওয়ান্ডারফুল হ্যাপেনড টু মি, মিনিস্ট্রিতে ধরনা দিয়ে ভিসা এক্সটেন্ড করিয়েছি। নব্বই দিনের সিল মেরে দিয়েছে। তো আমি আপাতত আর যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাচ্ছি না, সেøভ ক্যাসলগুলো আমার দেখা চাই। হাতে সময় যখন পাওয়া গেছে, আস্তে-ধীরে উপকূলের চল্লিশটি কেল্লা ঘুরেফিরে দেখে তারপর কোথায় যাওয়া যায় – তা ডিসাইড করব।’ আক্রা এয়ারপোর্টে তাকে মাত্র সাতদিনের ভিসা দিয়েছিল, তার ভিসা এক্সটেন্ড হওয়ায় আমি খুশি হই, বলি, ‘কংগ্র্যাচুলেশনস, ব্রিয়ানা’, সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ‘আই ফেল্ট সো হ্যাপি ইয়েসটারডে … তো মিনিস্ট্রি থেকে বেরিয়ে মার্কেটে গিয়ে বডি পেইন্ট দিয়ে বাহুতে নকশা আঁকিয়ে নিলাম।’
করিডোর ধরে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে অত্যন্ত কায়ক্লেশে এদিকে আসছেন প্রৌঢ় একজন আফ্রো-আমেরিকান মানুষ। গালফ যুদ্ধে অংশ নেওয়া এ অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের নাম সার্জেন্ট সুগাররে বার্চউড। তিনদিন আগে তিনি এসে উঠেছেন এই গেস্টহাউসে। আমার সঙ্গে তাঁর বাতচিত হয় ব্রেকফাস্ট লবিতে। যুদ্ধে আহত হওয়া মানুষটি তার জ্যাকেটের ল্যাপেলে সামরিক অর্জনের নিশানাস্বরূপ একটি মেডেল ঝুলিয়ে একা বসেছিলেন। আমি তাঁকে হ্যালো বলে তাঁর টেবিলে বসলে তিনি খুশি হয়েছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল ইমোশনালি ক্ষতবিক্ষত হওয়া অভিব্যক্তি। নাশতা খেতে খেতে টুকটাক কথাবার্তায় আমি তাঁর ফ্র্যাংকনেস অনুভব করতে পেরে ভারি অবাক হয়েছিলাম! ব্রেকফাস্ট ব্যুফেতে দীর্ঘ কাউন্টারে সাজিয়ে রাখা ছিল বিবিধ রকমের খাবার। ফলফলাদি থেকে চিজ, ইয়োগার্ট, বেকন, সসেজ কিংবা অমলেট কোনো কিছুর অভাব ছিল না। সার্জেন্ট সুগাররে ওটমিলের পরিজ খেতে খেতে বারবার আফসোস করছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি নাকি কখনো ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সুযোগ পাননি। শিশুবয়সে পিতা তাঁর মাকে খুন করার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাগারে কাটান। তিনি বেড়ে ওঠেন আলাবামা অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর টাসকুমবিয়ায় তাঁর দিনদরিদ্র চাচির বাড়িতে। গির্জার ধর্মযাজকরা বাইবেল স্কুলে তাঁকে লেখাপড়া শেখান, সেখানে ফ্রি লাঞ্চ খেয়ে দিনযাপন করতেন। যুবক বয়সে তিনি বিত্তবানদের ম্যানসনগুলোর বাগানে ঘাস কাটা ইত্যাদি কাজ করে সামান্য আয়-উপার্জন করতেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের বছর দুয়েক আগে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে সম্মানজনকভাবে ডিসচার্জ দেওয়া হয়। অবসর পেয়ে আহত শরীর নিয়ে ভারি সংকটে পড়েছিলেন সার্জেন্ট সুগাররে। সামান্য যে-পয়সা পেনশন পেতেন তা দিয়ে ঘর ভাড়া করার কোনো উপায় ছিল না, ততদিনে তাঁর চাচিও প্রয়াত হয়েছেন। উপরন্তু দু-পায়ে একাধিকবার অপারেশনের ফলে সাফার করছিলেন ক্রনিক পেইনে। পেনশনের সিংহভাগ চলে যেত পেইনকিলার কিনতে। আলাবামার একটি হোমলেস শেল্টারে সার্জেন্ট তাঁবুতে বাস করছিলেন, হঠাৎ করে আক্রান্ত হন স্ট্রোকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গির্জার এক সহানুভূতিসম্পন্ন উকিলের সহায়তায় সেনাবাহিনীকে মামলার নোটিশ দেন। এ প্রক্রিয়ার ফলে তাঁর হাতে এসে যায় কমপেনসেশন হিসেবে বেশকিছু টাকা। সার্জেন্ট সুগাররে এ-পয়সাটি ব্যয় করছেন তাঁর পূর্বপুরুষ ক্রীতদাস মিস্টার বার্চউডের দেশ ঘানায় ভ্রমণ করে।
অনেক সময় নিয়ে করিডোর অতিক্রম করে ওপেন সিটিং এরিয়ায় এসে সার্জেন্ট সুগাররে আমাদের কাছে একটি সোফায় বসেন। আজ তিনিও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন কেইপ কোস্ট ক্যাসলটি দেখতে। বসেই তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ঘানার রাজপথে গাড়িঘোড়ার চলাচলে অ্যাক্সিডেন্ট হয় হামেশা। জীবনে একাধিকবার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, পূর্বপুরুষ মিস্টার বার্চউডের দেশে এসে তিনি কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে চান না। কথা বলতে বলতে তাঁর মুখের দু-কোণ বেয়ে লালা গড়ায়। এ-সমস্যাটা আমি তাঁর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে আগেও খেয়াল করেছি। ওটমিলের পরিজ গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর জ্যাকেটে। স্ট্রোকে সম্ভবত তাঁর মুখের মাসলগুলো শিথিল হয়ে গেছে। ব্রিয়ানা উঠে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে তাঁর মুখ মুছিয়ে দেয়। সার্জেন্ট সুগাররে খুশি হয়ে ব্যাকপ্যাক থেকে ছোট্ট একটি বাইবেল বের করে বলেন, ‘গাইজ, লুক, হোয়েনএভার ইউ আর অন দ্য রোড, দেয়ার আর অলওয়েজ পসিবিলিটিজ অব অ্যাক্সিডেন্টস, চলার পথে আমাদের মাথার ওপর সবসময় ঝুলছে দুর্ঘটনার খাঁড়া। খুব বেশি এংজাইটি হলে আমি বাইবেলে সমাধান খুঁজি। লর্ড জিসাস ক্রাইস্ট অলঅয়েজ হেল্পস মি।’ তিনি একটু ইতিউতি করেন, অতঃপর জানতে চান, ‘আমি বাইবেল থেকে একটু পড়লে তোমরা মাইন্ড করবে কি?’ ব্রিয়ানা তাঁকে বাইবেল তর্পণ করতে উৎসাহিত করে। সার্জেন্ট সুগাররে একটি পৃষ্ঠা থেকে মৃদু স্বরে পড়ে যান, ‘হি উইল কমান্ড হিজ অ্যাঞ্জেলস কনসারনিং ইউ টু গার্ড ইউ ইন অল ইয়োর ওয়েস।’ পড়তে পড়তে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে অসহায় হাসি। বাইবেলের পবিত্র বচনটির সরল ভাবানুবাদ হতে পারে, ‘ঈশ্বর তোমার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত দেবদূতদের নির্দেশ দেবেন তোমার সকল চলার পথে নিরাপত্তা বিধান করতে।’ তো আজকের ট্রিপে ঐশী সূত্র থেকে আশীর্বাদ পাওয়া গেলে তো মঙ্গল, আখেরে উপকৃত হবো আমরা সকলে; কিন্তু সার্জেন্ট সুগাররেকে ফের উদ্বিগ্ন হতে দেখি। তিনি আসমানি কিতাবটি ব্যাকপ্যাকে রেখে অস্থিরতা ছড়িয়ে যা বলেন তার সারসক্ষেপ হচ্ছে – যাত্রাপথে সর্বত্র তিনি ওয়াকার ব্যবহার করতে পারবেন না। একটি রেঞ্চজাতীয় শলাকা দিয়ে ওয়াকারটি ভেঙে দু-টুকরা করে দুটি লাঠি হিসেবে ব্যবহার করা যায়, লাঠিতে ভর দিয়েও তিনি চলাফেরা করতে পারেন। তবে সমস্যা হচ্ছে – সারা কামরা খুঁজেও তিনি রেঞ্চজাতীয় বস্তুটি পাননি। এখন উপায়? ব্রিয়ানা তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত¡না দিয়ে বলে, ‘কাম অন, গেটআপ সার্জেন্ট, চলো আমার সঙ্গে তোমার রুমে, আমি খুঁজে দিচ্ছি।’
ওয়েটার তপ্ত এক পেয়ালা হরলিক্স নিয়ে আসে। তা পান করতে করতে আমি করিডোরের দিকে তাকাই। ব্রিয়ানার কাঁধে একটি হাত রেখে সার্জেন্ট আস্তে-ধীরে এগোচ্ছেন। ব্রিয়ানা তাঁকে হেল্প করছে, তার চরিত্রের এ-দিকটি আমার খুব ভালো লাগে। আর সার্জেন্ট সুগাররে এমন একজন নির্বান্ধব ও নিঃসঙ্গ মানুষ, তাঁকে সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আমিও স্বীকার করি। মানুষটির চরিত্রের ব্যতিক্রমী রকমের ফ্র্যাংকনেস আমাকেও আকৃষ্ট করেছে। পরিচয় হওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই আমি ব্রেকফাস্টে তাঁর টেবিলে বসেছি। তাঁর সম্পর্কে আমি আরো যেসব তথ্য জানতে পেরেছি – তা হচ্ছে : তাঁর পূর্বপুরুষ মিস্টার বার্চউডের আদি নিবাস ছিল ঘানার পূর্বাঞ্চলে আকিম আডা নামে একটি বনানীর প্রান্তিকে। সুগাররে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছেন যে, আকিম আডা বনানীটি বর্তমানে পর্যটকপ্রিয় ইকোপার্কে পরিণত হয়েছে। সেখানে আছে সাত-আটশো বছরের একটি অতিশয় পুরনো বৃক্ষ। বৃক্ষটিকে দর্শনার্থীরা ‘দ্য বিগ ট্রি’ নামে অভিহিত করে থাকেন। তরুবরটির বেড় এগারো মিটার, উচ্চতায় এটি ১২৮ মিটারের মতো। স্থানীয় মানুষজন শত শত বছর ধরে বৃক্ষটির পূজা করে আসছে। তার তলায় বলি দিয়ে পশুপাখি উৎসর্গ করার বিধান প্রচলিত আছে। আরাধনায় প্রসন্ন হলে নাকি গাছটির কা-ের ছিদ্রপথে বেরিয়ে আসে সুমিষ্ট মধু। তা সেবন করে হামেশা অনুর্বর রমণীরা সমর্থ হয়ে ওঠে সন্তান ধারণে। যৌন-সক্রিয়তা হারানো পুরুষরাও নাকি ফিরে পায় সঙ্গমের স্পৃহা। এ-তথ্যগুলোর মধ্যে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, মিস্টার বার্চউডের পরিবার নাকি বংশানুক্রমে একটি অত্যন্ত সুদীর্ঘ প্রাচীন বৃক্ষের সেবায়েত হিসেবে আকিম আডা বনানীতে বাস করত। এ-কাহিনি তাঁর চাচির মুখে শুনে শুনে সার্জেন্ট সুগাররে বড় হয়েছেন। তাঁর পূর্বপুরুষ মিস্টার বার্চউডের আদি আফ্রিকান নাম কী ছিল, গোত্রভিত্তিক কোনো পদবি ছিল কিনা, এসবের কিছুই সুগাররে জানেন না। তাঁর বংশধরদের লাস্ট নেম বা পদবি কীভাবে বার্চউড হলো – এ-বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি জানান, ক্রীতদাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় তাঁর পূর্বপুরুষের কোনো নাম ছিল না, তিনি পরিচিত হতেন তাঁর শরীরের উল্কি করে আঁকা নম্বর অনুযায়ী। শ্বেতাঙ্গ কটন ফারমারের খামারে শ্রমিক ছিলেন তিনি। খামারের তাবৎ বার্চউড গাছের সেবাযতœ করাও তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তো পরবর্তী প্রজন্মে ক্রীতদাস সন্তানরা নাম গ্রহণ করার অধিকার পেলে তারা পদবি হিসেবে বার্চউড শব্দটি ব্যবহার করতে থাকে।
ওয়াকারটি ভেঙে জোড়া লাঠিতে ভর দিয়ে ব্রিয়ানার সঙ্গে লবিতে ফিরে আসেন সার্জেন্ট সুগাররে। আমাদের ট্যুর বাসটিও এসে পড়েছে। লিফটে আমরা নেমে পড়ি নিচে। আমাদের ট্যুর-গাইডের নাম মি. কাসিয়াডা। তিনি ধর্মযাজকদের মতো যাত্রীদের আশ্বাস দেন। মানুষটি গায়েগতরে বেজায় তাগড়া। পাদ্রিদের মতো হাঁটুজোকা একটি ঢোলা লেবাস পরেছেন। সার্জেন্ট সুগাররেকে রীতিমতো পাঁজাকোলা করে মাইক্রোবাসের সিঁড়ি উত্তীর্ণ করিয়ে দেন। বাসের ভেতরদিককার দেয়ালে আংটা দিয়ে শক্ত করে ঝোলানো হরেক ডিজাইনের অনেকগুলো মুখোশ। আমরা সবাই ওয়াটার বটল বা কফি-মগ নিয়ে রওনা হয়েছি। কাসিয়াডা ভারি সুন্দর করে হেসে যাত্রীদের চলমান বাসে কিছু পান না করার অনুরোধ করেন, কারণ এতে দুর্ঘটনায় নিহত মানুষদের আত্মা কুপিত হতে পারে, হাইওয়েতে চলাচলের সময় এ-ধরনের কোনো ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। তবে পিপাসা দারুণ হলে তাকে ইশারা দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি গাড়ি থামিয়ে নিজ হাতে কুলার থেকে সরবরাহ করবেন মিনারেল ওয়াটার।
নগরীর ট্র্যাফিক ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়তেই হাইওয়ের দুপাশে ল্যান্ডস্কপে বিস্তীর্ণ হয়ে ওঠে। পেছনদিকে দ্রুত সরে যেতে থাকে লালচে-হলুদাভ ঘাসে ছাওয়া মাঠ, মাঝে মাঝে দীঘল ঘাসের ঘন ঝোপ থেকে উড়ছে নাম-না-জানা পাখিদের ঝাঁক। ঝংকারের চিত্রকল্পের মতো তারা উড়ে উড়ে শূন্যতায় তৈরি করছে নানাবিধ নকশা। দিগন্ত ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাড়াগাঁয়ে কাদামাটিতে তৈরি নারকেল পাতার ছানি দেওয়া কুঁড়েঘর।
গাইড কাসিয়াডা সংকীর্ণ আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্যাসেঞ্জারদের সিটগুলোতে খুঁটিয়ে কী যেন দেখেন। চোখাচোখি হলেই ভারি সুন্দর করে হাসেন, যেন ধর্মযাজকের মতো ভরসা দিয়ে বলতে চাচ্ছেন, পাপ তো সকলেই করে কিছু না কিছু, এবার প্রার্থনা করে নাও, ক্ষমা পেয়ে যাবে। তাঁর হাতে বেজায় দীর্ঘ চামচের মতো কাঠে তৈরি একটি ব্যাকক্রেচার। জারকিংয়ে কখনো কখনো মুখোশগুলো বেজে ওঠে জিংজং করে। কাসিয়াডার হাসিটি মলিন হয়, তিনি কপাল কুঁচকে জোব্বার ভেতর দিয়ে ব্যাকক্রেচারের চামচ ঢুকিয়ে খচরমচর করে পিট চুলকান।
ব্রিয়ানা এসে আমার পাশে বসে। এতক্ষণ সে সার্জেন্ট সুগাররের পাশে বসেছিল। জানতে চাই, ‘হোয়াটসআপ?’ সে খোঁজ নেয় – ট্রেইল ক্যামেরার স্ট্যাটাস কী? আমি ক্যামেরাটি ব্যবহার করতে পেরেছি কি না? এ-প্রশ্নের জবাব দিতে আমি দ্বিধাগ্রস্ত হই, বলি, ‘একটু পর খুলে বলছি’, বলে তাকে অ্যাভয়েড করার অছিলায় আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। হঠাৎ করে প্রান্তরে সবুজাভ ঘাস দেখতে পেয়ে অবাক হই! শুধু ঘাসই না, ফলে আছে গুচ্ছগুচ্ছ মানকচুর মতো দেখতে ‘টারো’ বলে একধরনের ছোট্টমোট্ট উদ্ভিদ। অনুমান করি, হয়তো মাটির তলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড নদী। এদিকে একটি-দুটি গাছপালাও দেখা যায়, এরা যেন দলছুট হয়ে দুশ্চিন্তায় পত্রালি ঝরিয়ে ছন্নছাড়ার মতো বিচরণ করছে প্রান্তরে। একটি গাছের ডাল থেকে তীব্র নীল আলো জ্বেলে উড়াল পাড়ে ভারি বর্ণাঢ্য একটি পাখি। এ-ধরনের আরেকটি পাখি ঘাসের গুচ্ছে ডাইভ দিলে খেচরটিকে শনাক্ত করি। নীলে কালো দাগ টানা কমলালেবু রঙের শক্তপোক্ত ঠোঁটওয়ালা পাখিটি হচ্ছে উডল্যান্ড কিংফিশার। এরা জলাশয় নয়, স্থলভূমির হালকা বনানীতে ঘুরপাক করতে পছন্দ করে।
ল্যান্ডস্কেপ ফের উষর হয়ে পড়ে। ব্রিয়ানার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর নিয়ে ভাবি। ফটোগ্রাফিতে দক্ষ মেয়ে ব্রিয়ানা নানা কিসিমের একাধিক ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। ফ্রিটাউনে সে যখন আমাদের কটেজে বাস করছিল, তখন একটি ট্রেইল ক্যামেরা দিয়ে বাগানে রাত্রিবেলা ছবি তোলার ফাঁদ পাতে। কোনো নিশাচর পশু বা পাখি ক্যামেরাটির ইনফ্রারেড রে ছুঁলে তাতে অটোমেটিক্যালি উঠে যায় ছবি। তো তার ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল – মাঝরাতে বাগানের দোলনায় চুপচাপ বসে থাকা জোড়া প্যাঁচার ছবি। আমাদের পেছনের আঙিনায় কলা ও ফলন্ত পেঁপের গুচ্ছে বাদুড়ের আক্রমণকে ছবিতে ধারণ করে ব্রিয়ানা আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল! এ-ধরনের একটি ট্রেইল ক্যামেরা আমি সংগ্রহ করতে চাচ্ছি জানতে পেরে সে তার ট্রেইল ক্যামেরাটি আমাকে উপহার দেয়। টেকনোলজি ব্যাপারটা আমার মাথায় তেমন ঢোকে না, তাই বেশ মেহনত করেও আমি ট্রেইল ক্যামেরাটি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হই। জানতে পেরে ব্রিয়ানা আমাকে পিডিএফ করে ক্যামেরার ম্যানুয়েলটি পাঠায়। এতেও নিশিরাতে বাগানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলায় আমার কামিয়াবি আসে না, একপর্যায়ে তেতোবিরক্ত হয়ে আমি ক্যামেরা ট্র্যাপে ছবি তোলার পরিকল্পনা ত্যাগ করি।
ব্রিয়ানা কনুই দিয়ে আমাকে খোঁচা মেরে জানতে চায়, ‘সো ইউ আর নট গোয়িং টু আনসার মি।’ আমি মৌন থাকি, তাতেও ত্যাঁদোড় মেয়েটির হাত থেকে নিস্তার পাই না। সে আমার নতুন কেনা স্মার্টফোনটির উল্লেখ করে জানতে চায়, ‘ফরগেট অ্যাবাউট দ্য ক্যামেরা, আমি তোমার সেলফোনে কিছু অ্যাপ ডাউনলোড করে দিতে চাইলে তুমি রাজি হবে কি?’ আমি জবাব দিই, ‘রিং তো করা যাচ্ছে, অন্য কোনো কাজে আমি টেলিফোন ব্যবহার করতে চাচ্ছি না, অ্যাপস না হলেও দিব্যি দিন কেটে যাবে।’ কিছু বলে না, তবে ভ্রুকুটি করে উঠে পড়ে ব্রিয়ানা। সে মাইক্রোবাসের আইলে হেলেদুলে গিয়ে বসে সার্জেন্ট সুগাররের পাশে।
তার সহায়তা রিফিউজ করে কাজটি ভালো করলাম কি? টেকনোলজির ঘোচগাছ আমি তেমন বুঝি না, এসব শেখার মতো প্রতিভাও আমার নেই। আমার ফাইনাল ডেসটিনেশন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো। ওখানকার সাংগ্রে দে খ্রিষ্ট পাহাড়ের নির্জনতায় আমি কিছুদিন কাটাতে চাই। জায়গাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এগারো হাজার ফুট ওপরে। সেসব জায়গায় সেলফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব ঘোড়ার ডিম শিখেই বা আমার ফায়দা কী? বিরক্ত হয়ে ফের জানালায় চোখ রাখি।
প্রান্তরে লাল মাটির স্তূপে স্তূপে গড়ে উঠেছে ফায়ার অ্যান্টহিল বলে পরিচিত একধরনের পিঁপড়ার ঢিবি। দূর থেকে ঢিবিগুলোকে দেখায় তাঁবুর মতো। কোথাও আবার ধূসর মাটিতে গড়া অ্যান্টহিলগুলো আগুন-পিঁপড়ারা এমন কৌশলে বানিয়েছে যে, মনে হয় তেপান্তরে খানিক দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে বেলেপাথরে গড়া ভাস্কর্য। দু-তিনজন প্যাসেঞ্জার ছবি তোলার জন্য আওয়াজ দিয়ে মাইক্রোবাসটি থামাতে অনুরোধ করেন; কিন্তু গাইড কাসিয়াডা হা-হা করে ওঠেন। তিনি যেন নরকের কোনো দৃশ্যপটের বর্ণনা দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বলেন, ‘মাই ডিয়ার ব্রাদারস অ্যান্ড সিস্টারস, ডোন্ট মেক দিস টেরিবল মিসটেক। অতীতে দু-চারজন পর্যটক আমার সাবধানবাণী না শুনে মাইক্রোবাস থেকে টেলিলেন্সে ফায়ার অ্যান্টহিলের ছবি তুলেছিলেন, দু-তিন সপ্তাহের ভেতর আগুন লেগে কারো ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ হয়, কারো স্টোভ বিস্ফোরিত হয়ে পুড়ে যায় শিশুসন্তান। দিস ইজ টু ডেঞ্জারাস।’ তার বক্তব্যে ছড়ায় দারুণ বিভ্রান্তি। সার্জেন্ট সুগাররে দাঁড়িয়ে পড়ে এতে ইন্ধন জোগান। তিনি এক হাতে পকেট-বাইবেলটি তুলে ধরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পড়ে যান, ‘আই উইল বি আ ওয়াল অব ফায়ার অ্যারাউন্ড ইউ, ডিক্লেয়ার দ্য লর্ড। হি উইল কভার ইউ উইথ হিজ ফেদারস অ্যান্ড আন্ডার হিজ উইংস …।’ ঈশ্বরের বচন শুনে ক্যামেরাবাজ প্যাসেঞ্জাররা রীতিমতো ঘা খেয়ে যায়। কারো মুখ দিয়ে চু-চেরা পর্যন্ত বের হয় না। আমিও আসমানি কিতাবের বচনটি বুঝতে চেষ্টা করি, যার সরল ভাবানুবাদ হতে পারে : ‘আমি তোমার চতুর্দিকে তৈরি করব আগুনের একটি দেয়াল, ঘোষণা দেন প্রভু। তিনি তাঁর পালক দিয়ে তোমাকে ঢেকে দেবেন এবং তাঁর ডানার ছায়াতলে আশ্রয় পাবে তুমি।’ কোথাকার পানি কোথায় গড়াচ্ছে – বুঝে ওঠা মুশকিল হয়! প্যাসেঞ্জাররা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। বাইবেলের বাণী শ্রবণে যাত্রী সকলের ধর্মজ্ঞান খানিকটা বাড়ে বটে, কিন্তু ফায়ার অ্যান্টহিলের ছবি তোলাসংক্রান্ত রহস্যের কোনো সুরাহা হয় না।

ল্যান্ডস্কেপ বদলে যায় ফের। ঘাসের বিশাল প্রান্তর কোথাও কোথাও শুকিয়ে হয়েছে খটখটে ধূসর। তাতে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিবাহী মিনারের মতো অজস্র অ্যান্টহিল। পিঁপড়ার এ-ঢিবিগুলো কোনোটা বর্ণে লালচে খয়েরি, আবার কিছু কিছু অ্যান্টহিলের বর্ণ ধূসর অথবা হলুদাভ। গাইড কাসিয়াডা ভরসা দিয়ে বলেন, মাইক্রোবাস থামতে যাচ্ছে, প্যাসেঞ্জাররা চাইলে ছবি তুলতে পারেন, এমনকি সাবধানে অ্যান্টহিল বেয়ে ওপরে ওঠাতেও তার আপত্তি কিছু নেই। আমরা কয়েকটি মনুমেন্টের মতো সুদীর্ঘ অ্যান্টহিল পেরিয়ে যাই। এগুলোর কোনো কোনোটা উচ্চতায় ১২-১৪ ফুটের চেয়েও দীর্ঘ। অতঃপর খুব সাদামাটা একটি অ্যান্টহিলের সামনে মাইক্রোবাস সাইড করে থামে। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে তীর্থ দেখার মতো তীব্র উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। কেউ অ্যান্টহিলের ছবি তুলছেন, কেউ-বা আলিঙ্গনের ভঙ্গি করে হিসাব করে নিচ্ছেন ঢিবিটির বেড়। আবার কেউ পাহাড় চড়ার কায়দায় বেয়ে উঠতে চাচ্ছেন চূড়ায়। আমি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে ভাবি, এ-ঢিবিগুলো থেকে কোনোদিন যদি একসঙ্গে বেরিয়ে আসে লক্ষ-কোটি পিপিলিকা, তাহলে আদমসন্তানদের হয়তো ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হতে পারে। গাইড কাসিয়াডা এবার আর কোনো বাণী-টানি দেন না। তিনি একটি অ্যান্টহিলের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রক্ষালনের উদ্যোগ নেন।
মাইক্রোবাসটি এবার সমুদ্রের তীর ঘেঁষে ছুটছে। নারকেলকুঞ্জের ফাঁক-ফোকরে দেখা যায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে উছলানো লোনাজলের কালচে রুপালি রেখা। দেখতে দেখতে পুরো দরিয়া দৃশ্যমান হয়। ঊর্মিসংকুল জলের বর্ণও বিবর্তিত হয় হালকা সবুজাভে। তার প্রেক্ষাপটে ভেসে ওঠে সাদা চুনখাপে রোদ-ঝলসানো বিরাট একটি কেল্লা। জানতে পারি – এ-দুর্গটি এলমিনা ক্যাসল নামে পরিচিত। এখানেও এক জামানায় বন্দি করে রাখা হতো হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে। দুর্গটি আকারে বিরাট, এটি আজ আমাদের গন্তব্য নয়, কোনো কোনো প্যাসেঞ্জার হতাশ হন। মাইক্রোবাস জোরালো গতিতে এলমিনার পরিসর ছাড়িয়ে এগিয়ে যায় সামনে। গাড়ির জানালা দিয়ে বেশ দূরে জলরেখার কিনারে ফোর্ট ক্রিস নামে আরেকটি দুর্গের নিশানা দেখতে পাই। গাড়ি হঠাৎ করে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে। সামনে একসারি ট্রাক ডিজেল-মবিলের পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে ধুঁকে ধুঁকে আগে বাড়ছে। আমাদের মাইক্রোবাসটিও গড়িয়ে গড়িয়ে চলে দরিয়ার একদম কিনার ঘেঁষে। দমকা হাওয়ায় ভেসে আসে জলমগ্ন গুল্মের গন্ধ। পাথুরে চরে ঢেউ ভাঙার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাই। এসে পড়ি বালুকাময় সৈকতের কিনারে। জনাতিরিশেক জেলে জালের মোটা দড়িটি টানতে টানতে আওয়াজ দিচ্ছে – ‘এ বালো … এ বালো … বালো এ … এ …।’ রোদে পোড়া মানুষদের মুখনিঃসৃত শব্দে এমন এক ধরনের ছন্দ আছে যে, মনোযোগ দিয়ে শুনতে ইচ্ছা হয়। মাইক্রোবাস প্রায় থেমেই পড়েছে, গাইড যাজকশোভন গম্ভীরমুখে অনুরোধ করেন, ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, প্লিজ লিসেন দ্য হার্টবিট অব আফ্রিকা।’ বেশিক্ষণ আমাদের আফ্রিকার হৃৎস্পন্দনে কান পাততে হয় না। ট্রাফিক জ্যাম খুলে যায়। খেঁকশিয়ালের তাড়া খাওয়া মুরগির মতো মাইক্রোবাসটি ফের ছুট লাগায়। শ্বেতাঙ্গ কোনো রাজপুরুষের চকমিলান প্রাসাদের মতো সমুদ্রপাড়ে ভেসে ওঠে কেইপ কোস্ট ক্যাসলের রূপরেখা। দূর থেকে একাধিক দালানের সমাহারকে ত্রিভুজের আকৃতির মতো বিচিত্র দেখায়।
মাইক্রোবাস এসে থামে কেইপ কোস্ট ক্যাসলের এনট্রান্সে। নামতেই গাইড কাসিয়াডা বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে ‘মে গড ব্লেস ইউ অল’ বলে আশীর্বাদ জানান। তিনি আর অধিক কোনো ভক্কর-চক্কর করার অবকাশ পান না। কেল্লার গাইড মি. সিবাসতিয়ান কোয়ানেমা টেটি এসে বাজখাঁই গলায় সকলকে ওয়েলকাম জানিয়ে ক্যাসল ট্যুরের চার্জ নেন। আদিযুগের বর্শাধারী আফ্রিকান যোদ্ধাদের মতো মারকুটে চেহারা তার। আচার-আচরণে মানুষটি করিৎকর্মা বিশেষ। কেল্লায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার ব্যাপার আছে, ব্রিয়ানা সার্জেন্ট সুগাররের সমস্যাটি তাকে জানায়। তিনি তৎক্ষণাৎ হাঁকডাক করে পারিতোষিকের বিনিময়ে জোগাড় করে দেন পেটা দেহের দুই নওজোওয়ান। তারা কোনো সময় নষ্ট না করে, ‘এ বালো … বালো এ …’ আওয়াজ দিয়ে সাবেক সৈনিককে চ্যাংদোলো অবস্থায় কাঁধে তুলে রওনা হয় কেল্লার বেজায় উঁচু ইট-সুরকিতে বাঁধানো কোর্টইয়ার্ডে। আমরাও হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পড়ি সেখানে। আঙিনাটি বিরাট, তার একপ্রান্তে কেল্লার চকমিলান অট্টালিকাকে ঔপনিবেশিক কোনো প্রশাসকের ম্যানশনের মতো দেখায়। মি. কোয়ানেমা টেটি হুংকার দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘লিসেন এভরিবডি, উই ডু নট অ্যালাও অ্যানিবডি টু এন্টার দিস ক্যাসল উইথআউট গেটিং অ্যা থরো হিস্ট্রি লেসন। এখন আপনারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক এই জায়গায় ২০০৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সঙ্গে ফার্স্টলেডি মিশেল ও তাঁদের দুটি কন্যাসন্তান। খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এ শর্মার কাছ থেকে কেল্লার হিস্ট্রি শুনে উপকৃত হয়েছিলেন।’ পর্যটক দলের মধ্যে জনাতিনেক জাপানি সম্ভবত কোয়ানেমা টেটির বক্তব্য বুঝতে না পেরে হাততালি দিয়ে ওঠেন। এতে উৎসাহিত হয়ে মুখখানা ডাঙায় তোলা শামুকের মতো আমসি করে টেটি মহাশয় লেকচার দিতে শুরু করেন। তথ্যের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমি নোটবুক বের করি। সার্জেন্ট সুগাররে অনুচরদের কাঁধ থেকে নেমে প্রথম সুযোগেই বের করে বসেন তাঁর পকেট-বাইবেলটি।
১৫৫৫ সালে পর্তুগিজ নাবিকরা দুর্গটি তৈরি করেছিল ট্রেডিং পোস্ট বা বাণিজ্যকুঠি হিসেবে। ঘানায় তখন আবিষ্কৃত হয়েছে গোল্ডডাস্ট। স্বর্ণধূলির সন্ধানে এসে তারা এ-দেশটিতে হাতির দাঁত ও মেহগনি কাঠের অফুরন্ত সরবরাহ দেখতে পেয়ে থিতু হয়ে কায়-কারবারের চিন্তা করে। স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের সঙ্গে বার্টার বা বিনিময় পদ্ধতিতে শুরু হয় ব্যবসায়িক লেনদেন। স্বর্ণ ও হাতির দাঁতের বিনিময়ে পর্তুগিজরা তাদের হাতে তুলে দিত কম্বল, শরাব, শর্করা, সিল্ক ও গ্লাসবিড। ১৬৫৩ সালে সুইডিশ আফ্রিকা কোম্পানি কেল্লাটি কিনে নেয় পর্তুগিজদের কাছ থেকে। তারা এখানে তৈরি করে ইউরোপে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের গোডাউন হিসেবে কাঠের বিশাল গোলাঘর। পাশাপাশি সুইডিশরা পর্তুগিজদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ক্রীতদাস ব্যবসাও জারি রাখে। কেইপ কোস্ট ক্যাসল থেকে ঠিক কত সালের কোন তারিখে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের জাহাজে করে চালান দেওয়া হয়েছিল, নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে গবেষকরা সকলেই একমত যে, এ-ব্যবসার শুরু হয় পর্তুগিজ নাবিকদের হাতে। বাণিজ্যিক প্রক্রিয়াটি ‘ট্র্যান্স আটলান্টিক সেøভ ট্রেড’ নামে পরিচিত। এটি চালু থাকে ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী অবধি। পর্তুগিজদের হাতে এ-কেল্লায় ক্রীতদাস ব্যবসা শুরু হলেও পরবর্তীকালে কেল্লাটির মালিকানা বদল হয়। এবং পালাক্রমে সুইডিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ ও ব্রিটিশরা এ-কেল্লার স্বত্বাধিকারী হয়। এরা সকলে চালু রাখে ক্রীতদাস ব্যবসা। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশদের উদ্যোগে ট্রান্স আটলান্টিক সেøভ ট্রেড বন্ধ করে দেওয়া হয়। তারপরও অনেক বছর চোরাগোপ্তাভাবে চলে মানুষকে বন্দি করে দেশান্তরে চালান দেওয়ার প্রক্রিয়া।
আমাদের নিয়ে আসা হয় কোর্টইয়ার্ডের শেষ প্রান্তে। এখানকার দেয়াল জুড়ে সমুদ্রমুখী করে লাগানো অনেকগুলো জংধরা কামান। কোয়ানেমা টেটি বিষণœস্বরে বলেন, ‘কল্পনা করুন, এ-কেল্লা থেকে বছরের পর বছর চালান দেওয়া হয়েছিল হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে। এরা কিন্তু কখনো তাদের জন্মভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ পায়নি।’ তিনি দম নিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে ফের বলেন, ‘দিস ক্যাসল ওয়াজ দ্য লাস্ট মেমোরি দ্য ক্যাপচারড সেøভস হ্যাড অব দেয়ার হোমল্যান্ড।’ আফ্রিকান উপকূলে বন্দি হওয়া ক্রীতদাসদের স্বদেশ নিয়ে সর্বশেষ স্মৃতিটির কথা ভাবতে ভাবতে আমি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়াই। সুরুজের তীব্র আলোকে নিচের সমুদ্রজলে যেন জ্বলছে সবুজাভ সোনালি আগুন। পাথুরে সৈকতে কেল্লার ছায়ায় বসে জিরোচ্ছে হাজার হাজার ধবধবে সাদা সিগাল। তাদের দিকে দিশা ধরে তাকাতেই আক্রান্ত হই দৃষ্টিবিভ্রমে। মনে হয়, ঈদের জামাতে সফেদ টুপি পরে নামাজি বসে বসে শুনছে খুতবা।
আমরা সিঁড়ি ধরে কেল্লার নিচের লেয়ারে নামতে নামতে গাইডের মুখে ধারাবর্ণনা শুনি। পর্তুগিজরা কেল্লার নিচে তৈরি করেছিল আলো-বাতাসের চলাচলহীন ড্যানজেন বা তলকুঠুরি। আমরা সিঁড়ি ভেঙে চলে আসি ভূগর্ভের দশ ফুট নিচে। টিমটিমে আলোয় একটি স্যাঁতসেঁতে পরিসরের দিকে ইশারা করে গাইড ফের জানান, এখানে বড়জোর শ-দেড়েক মানুষ চিপাচিপি করে বসতে পারেন। দাস ব্যবসায়ীরা এই সংকীর্ণ স্পেসে এক হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষকে শিকলবাঁধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখত। পাশের কামরায় একইভাবে সাফার করত প্রায় পাঁচশো নারী। পানীয়জল বা পয়ঃনিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আমরা তলকুঠুরির দেয়ালের কাছে স্তূপ করে রাখা কতগুলো মূর্তির মু-ু দেখতে পাই। এ ভাস্কর্যগুলো পরবর্তী জামানায় অসহায় অবস্থায় বন্দি হওয়া মানুষদের স্মৃতিতে স্বাধীন ঘানার শিল্পীরা তৈরি করেছেন। এদের চোখমুখের বিষাদগ্রস্ত অভিব্যক্তির দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। পর্যটকদের কেউ কেউ তাদের স্মরণে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকেন। গাইড টর্চ জ্বেলে দেখান – বেশ কয়েকটি পাথরে বন্দি মানুষের আঁচড়ের চিহ্ন, পাশে স্তূপ করে রাখা কামানের গোলা। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ওড়ে বাদুড়। গাইড বন্দিখানার একপাশে কবরের মতো ছোট ছোট খুপরিতে টর্চের আলো ফেলেন। কনডেম সেল নামে দলিলপত্রে উল্লিখিত এ খুপরিগুলোতে কোনো কোনো মানুষকে অবাধ্যতার অপরাধে শিকলে বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। দিনের পর দিন অনাহারে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে একসময় এরা মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করত। সঙ্গে সঙ্গে লাশ সরিয়ে সৎকারের কোনো রীতি ছিল না। মৃতদের কংকাল শাস্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হতো।
গাইড অতঃপর আমাদের সম্মতি নিয়ে তলকুঠুরির টিমটিমে আলো দুই মিনিটের জন্য অফ করে দেন। আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কল্পনা করার চেষ্টা করি, ষোড়শ শতকে কপালদোষে অত্র এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গ হয়ে জন্মালে এবং পরবর্তীকালে হার্মাদদের হাতে বন্দি হয়ে এখানে শিকলবাঁধা অবস্থায় বসবাস করতে হলে … শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। শুনতে পাই সার্জেন্ট সুগাররের কণ্ঠস্বর। তিনি কান্নাভেজা স্বরে প্রার্থনা করেন, ‘ওহ ফাদার গড …।’ হয়তো বন্দি মানুষরা দিনের পর দিন এভাবে প্রার্থনা করত। গাইড আলো জ্বালেন; কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি না, বন্দি হওয়া মানুষদের প্রার্থনা কেন কবুল হয়নি।
আমরা আরো নিচে নেমে জেটির দিকে চলে যাওয়া অর্ধচন্দ্রাকৃতির আর্চের তলায় চলে আসি। এখান থেকে সমুদ্রের ঢেউ তটে আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যায়। গাইডের বাচনিকে জানতে পারি, বন্দি মানুষরা জাহাজে ওঠার আগে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের ভবিতব্য সম্পর্কে জানতে পারত। ক্রীতদাস ব্যবসায়ী ঘোষণা দিতেন, ‘দিস ইজ গেট অব নো রিটার্ন, ইয়োর লাস্ট স্টপ বিফোর ক্রসিং আটলান্টিক ওশান।’ তার বক্তব্যের তর্জমা হলে শিকলবাঁধা মানুষদের মধ্যে পেছন ফিরে তাকানোর তোড়জোড় পড়ে যেত। কিন্তু দু-তিন পলকের বেশি সময় তাদের তাকিয়ে থাকার সুযোগ দেওয়া হতো না। সৈনিকরা চাবুক মেরে তাদের তুলে দিত জাহাজের ডেকে। চাবুকের ঘায়ে কোনো দাসের শরীর থেকে রক্ত না বেরোলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সৈনিককে তৎক্ষণাৎ শাস্তি দেওয়া হতো। গাইডের বক্তব্য শেষ হতেই আর্তচিৎকারে আমাদের চমকে দেন সার্জেন্ট সুগাররে। তিনি গেটের তলায় হাঁটু গেড়ে বসে জোরেশোরে বলেন, ‘জিসাস ক্রাইস্ট মাই গুড লর্ড ইন হ্যাভেন, লিসেন টু মি … ইয়োর সার্ভেন্ট সুগাররে হ্যাজ রিটার্নড টু হিজ এনসেসটারস ল্যান্ড।’
সিঁড়ি বেয়ে ওপরের কোর্টইয়ার্ডে উঠে আসি। আমাদের দশ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। ছায়ার খোঁজে চলে আসি সিঁড়িঘরের তলায়। দেখতে পাই, সেখানে ভিডিও ক্যামেরা হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছে ব্রিয়ানা। তার সঙ্গে আমার যে-সম্পর্ক, বিষয়টিকে না দেখার ভান করে ইগনর করা যায় না। টুকটাক কথাবার্তা বলি। টিনএজ গার্ল হিসেবে তার দিন কেটেছে ভারি কষ্টে। ক্রেক-কোকেনে অ্যাডিক্ট মা নানা পুরুষের সঙ্গে ডেট করে বেড়াত, রাতে বাড়ি ফিরত খুব কমই। তখন ব্রিয়ানা তার পিতার দূরসম্পর্কের এক চাচি, যাকে সে গ্র্যান্ডমামা ডাকে, তার বাসায় আশ্রয় নেয়। গ্র্যান্ডমামার আর্থিক সহায়তায় সে হাইস্কুলের পরীক্ষা উতরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। চলৎশক্তিহীন বৃদ্ধা আফ্রিকায় তাঁদের পূর্বপুরুষের জন্মভূমির ভিডিও দেখতে চেয়েছিলেন। গত রাতে সে ই-মেইল মারফত জানতে পেরেছে যে, তার গ্র্যান্ডমামা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তার স্মৃতি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে, জানাশোনা মানুষজনদের কাউকে চিনতে পারছেন না। সংসার সম্পর্কে তাঁর সচেতনতা ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্রিয়ানা ফের চোখের জল মোছে, বলে, ‘আই ডোন্ট নো ফর হুম আই অ্যাম ডুয়িং অল দিস ভিডিও। ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার ছবিগুলো কে দেখবে।’
মি. কোয়ানেমা টেটির তাড়ায় আমাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় একেবারে কেল্লার ওপরের লেয়ারে। ওখানকার বাঁধানো উঠান থেকে সামনে দিগন্ত অবধি প্রসারিত সমুদ্রের দুর্দান্ত ভিউ পাওয়া যায়। দরিয়াটি আদতে একটি উপসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে যুক্ত এ সবুজাভ জলধি ‘গালফ অব গিনি’ নামে পরিচিত। আমরা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেল্লার শ্বেতাঙ্গ অধ্যক্ষের বৈঠকখানার দিকে তাকাই। এখানে এক জামানায় ব্রিটিশ উপনিবেশ গোল্ড কোস্টের গভর্নর স্বয়ং বাস করতেন। ভিনটেজ ফার্নিচারাদি তথা আয়না, তৈলচিত্র ও মার্বেল পাথরের তৈজস প্রভৃতি থেকে বিলাসবহুল জীবনযাপনের দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। দেয়াল জুড়ে টানানো একটি চিত্রকর্মের দিকে চোখ পড়ে। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বন্দি করে দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে আনা হচ্ছে। এ-ধরনের ছবি কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ কোনো শিল্পী আঁকেননি। ঔপনিবেশিক জামানার কোনো কোনো প্রশাসকদের আঁকাজোখায় দক্ষতা ছিল। তাদের চিত্রকর্ম গভর্নর বা কেল্লাধিপতি তার বৈঠকখানায় ঝুলিয়ে রাখতেন, তাদের শিল্পরুচি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা বোধ করি বাহুল্য। আমরা এসে দাঁড়াই ডাইনিং পার্লারের সামনে। কল্পনা করি, ঠিক এই পরিসরের বেশ নিচে, ভূগর্ভের অন্ধকার স্পেসে – যেখানে দেড় হাজার নারী-পুরুষ অনাহারে ধুঁকছে, ঠিক তখন এখানে চলছিল শরাব পান ও সামুদ্রিক খাবারের মুখরোচক ভোজ। গাইড টেটি আমাদের নিয়ে আসেন শ্বেতাঙ্গ আধিকারিকদের গির্জায়। এখানকার পবিত্র বেদিতে নাকি মোম জ্বেলে পাদ্রির তত্ত্বাবধানে প্রার্থনা করা হতো নিরাপদ সমুদ্রযাত্রার। আমি গির্জাটি বিশদভাবে দেখার কোনো আগ্রহ বোধ করি না। খানিক পর টেটি আমাদের জড়ো করেন সিঁড়িঘরের ওপরকার বেলকনিতে। সন্ধ্যার দিকে কেল্লাধিপতি এখানে এসে দাঁড়াতেন। নিচে প্রহরীরা কৃষ্ণাঙ্গ নারীবন্দিদের বিবস্ত্র অবস্থায় প্যারেড করাত। তারপর নির্বাচিত নারীকে সাফসুতরো করে নিয়ে আসা হতো শয়নকক্ষে।
আমরা অতঃপর একটি ছোটখাটো স্কুলও দেখতে পাই। ধর্ষিত নারীদের সন্তানদের জননীর সান্নিধ্য থেকে জন্মের পর বিচ্ছিন্ন করে এ-স্কুলে পড়ালেখা শেখানো হতো। এরা সমাজে মুলাটো বা শংকর বলে পরিচিত। ঔপনিবেশিক প্রশাসনে তারা পিয়ন, কেরানি বা আর্দালির কাজ করত। স্কুলের পাশে একজন কেল্লাধিপতির মূর্তি অবহেলায় পড়ে আছে। আমি মূর্তিতে কুঁদে তৈরি শ্বেতাঙ্গ মানুষটির অভিব্যক্তি খুঁটিয়ে দেখি। তাকে ক্র্যাচ হারানো খোঁড়া মানুষের মতো অসহায় দেখায়। জাপানি পর্যটকরা ভারি হাসিমুখে খোশগল্প করতে করতে টেপফিতা দিয়ে মূর্তিটির মাপজোখ নেন। বুঝতে পারি না, এ মেজারমেন্ট কী কাজে লাগবে? একজন জাপানি মূর্তির পায়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন আবিষ্কার করে হেসে ওঠেন জোরেশোরে। ভাস্কর্যের জুতা দেখে হাসাহাসির ঘটনাটি নজিরবিহীন! তাদের অপ্রত্যাশিত পুলকের উৎসও আমার অজানা থেকে যায়। গাইড টেটি বুঝিয়ে বলেন, এ-মূর্তিতে কোঁদা ক্রীতদাস ব্যবসায়ীটিকে ঘানার মানুষজন তাদের নিজস্ব জবানে অভিহিত করে থাকেন ‘আদজেই’ বলে। আদজেই শব্দটির ভাবানুবাদ দুরূহ, অনেকটা ‘এনিমি’ বা ‘দুশমন’ শব্দের কাছাকাছি। সার্জেন্ট সুগাররে গাইডের বক্তব্য কপাল কুঁচকে শোনেন, তারপর পকেট-বাইবেল থেকে পাঠ করে যান, ‘… বাট ইউ হু আর লিসেনিং আই সে লাভ ইয়োর এনিমিজ, ডু গুড টু দোজ হু হেইট ইউ …, ’ বা ‘… কিন্তু যে তুমি শুনছ, আমি তোমাকে বলছি, ভালোবাসো তোমার শত্রুদের, যারা তোমাকে ঘৃণা করে – তাদের উপকার করো …।’ সার্জেন্ট সুগাররের বক্তব্য আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনি। ঐশী বচনের মহিমা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রফিট-প্রভাবিত যে-সমাজে স্রেফ মুনাফার জন্য মানুষ কেনাবেচা ছিল জলচল, সেখানে এ-ধরনের পবিত্র বাণী কতটা প্রাসঙ্গিক … শাস্ত্রবচনে ঠিক ভরসা পাই না। সার্জেন্ট সুগাররে ফের আওয়াজ দেন, ‘লুক গাইজ, জিসাস সেইড … লাভ ইয়োর এনিমিজ।’ আমি মূর্তির মুখের দিকে ফের তাকাই, এবং স্নায়ুর কোষে কোষে অনুভব করি, এহেন নরাধমকে ভালোবাসা আমার পক্ষে অসম্ভব। বিরক্ত হয়ে নেমে আসি নিচের কোর্টইয়ার্ডে।
মাইক্রোবাসে আমরা ফের গাইড কাসিয়াডার পাল্লায় পড়ি। তিনি আমাদের কেইপ কোস্ট শহরে এনে নামিয়ে দেন। আমরা বিরাট আকারের একটি কাঁকড়ার ভাস্কর্যের তলায় দাঁড়িয়ে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করি। কাসিয়াডা আমাদের শহরে আওয়ারা ঘুরে বেড়ানোর জন্য পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় দেন। সড়কের শেষ প্রান্তে আছে বেওবাভ হাউস। আমরা যেন পর্যটন শেষ করে সেখানে হেঁটে যাই। লেট লাঞ্চের পর মাইক্রোবাস ফের ছুটবে আক্রা নগরীর দিকে।
কাঁকড়াটির ছবি তোলার জন্য আমাদের একজন সহযাত্রী টুরিস্ট টেলিলেন্সওয়ালা ক্যামেরা তাক করেন। তা দেখতে পেয়ে বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে কাসিয়াডা হাঁক পাড়েন, ‘জিসাস ক্রাইস্ট, ফর দ্য লভ অব গড অলমাইটি ইন হেভেন, ইউ ডোন্ট ডু দিস … এখানকার জেলেরা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে এখানে এসে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। প্লিজ ডোন্ট ডু দিস।’ তার বিরাট বক্তৃতায় ক্যামেরাওয়ালা থতমত খেয়ে যান! কাসিয়াডা হাওয়ায় অদৃশ্য ক্রুশচিহ্ন এঁকে ফের বলেন, ‘আই নো ব্রাদার্স অ্যান্ড সিস্টারস, ইউ আর নট গোনা বিলিভ দিস, বাট বাই গড … দিস ইজ ট্রু … অতীতে যারা আমার উপদেশ না শুনে কাঁকড়ার ছবি তুলেছে, তারা আজ অবধি সাফার করছে ক্রনিক অনিদ্রায় … একটু ঝিমানির মতো আসলে দুঃস্বপ্নে ধড়মড় করে জেগে ওঠে। আমি আর কিছু বলতে চাই না, গড ব্লেস ইউ অল।’ কাসিয়াডা মাইক্রোবাসে ফিরে গেলে আমাদের ট্যুর গ্রুপ চারদিকে ছত্রখান হয়ে পড়ে। সার্জেন্ট সুগাররে নামেননি। ব্রিয়ানা এ-শহরের চার্চগুলো দেখতে চাচ্ছে। এসব ধর্মালয়ে এক জামানায় দাস ব্যবসার উন্নতি কামনা করে মানত দেওয়ার চল ছিল। এগুলো পরিদর্শনে আমি বিশেষ কোনো আগ্রহ বোধ করি না।
ব্রিয়ানা চার্চের দিকে রওনা হতেই দেখি টেলিলেন্সওয়ালা পর্যটক ফিরে এসে ফটাফট তুলছেন পেল্লায় কাঁকড়াটির ছবি। আমারও যে ছবি তোলার লোভ হয় না, তা নয়। তবে এমনিই ক্রনিক অনিদ্রায় আমার নিশি ভোর হচ্ছে, এক্ষেত্রে দুঃস্বপ্নকে অ্যাড করা হবে স্রেফ বেআকলামির শামিল। তো আমি জেলেঘাটের দিকে রওনা হই।
বছরবিশেক আগে আমি কেইপ কোস্টে প্রশাসক হিসেবে ঔপনিবেশিক জামানায় কর্মরত এক ওলন্দাজের হাতে লেখা ডায়েরির কিয়দংশ উদ্ধৃতিতে পড়েছিলাম। ওই রোজনামচায় ছিল এখানকার জেলেঘাটে আচমকা রেইড করে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের বন্দি করার বিবরণ।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছি সৈকতের জেলেঘাটে। অজস্র নৌকায় ভরপুর ঘাটে জেলেরা এখনো মাছ ধরে ফিরে আসেনি। তবে যাত্রীটানা নাওগুলোতে হইহল্লা হচ্ছে প্রচুর। এগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি, প্রায় দুশো বছর আগে ঠিক এ-জায়গায় জড়ো হয়েছিল জেলেদের নাও। সৈকতে আগে থেকে অস্ত্রহাতে ওঁৎ পেতে বসেছিল পেশাদার সেøভ ক্যাচার বা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অতর্কিতে হামলা করে বন্দি করার জন্য অপেক্ষারত সৈনিক। আক্রান্ত হয়ে জলপথে নাও বেয়ে পালিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় ছিল না। সেখানে ওলন্দাজ জলদস্যুরা দড়ির ফাঁদ নিয়ে বসে ছিল তাদের দ্রুতগামী সশস্ত্র বোটে।
খিন্নমনে অতঃপর চলে আসি বেওভাব হাউসে। এ-রোস্তারাঁ ও সংলগ্ন গিফট শপ চালাচ্ছে একটি নন-প্রফিট এনজিও। আমাদের ট্যুর কোম্পানি বুফে কাউন্টারে লেট লাঞ্চের আয়োজন করেছে। সহযাত্রী পর্যটকদের কেউ কেউ গিফট শপে কেনাকাটা করছে। এক কোণে বসে ব্রিয়ানা ও সার্জেন্ট সুগাররে স্ট্র দিয়ে চুষছেন তরমুজের রস। রেড-রেড নামে স্থানীয় একটি খাবারের বর্ণ আমাকে আকৃষ্ট করে। টমেটো সস ও পামঅয়েল দিয়ে রান্না করা সিমের বীজের থিকথিকে ক্বাথে ভাসছে চাকতি করে ভাজা কাঁচকলা। চাট্টে গরম ভাতের সঙ্গে রেড-রেড নিয়ে আমি খালি একটি টেবিলে বসি। মরিচ ও রসুনের ফোঁড়ন দেওয়া আহার্যটি স্বাদেগন্ধে চমৎকার।
তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার সুযোগ হয় না। সার্জেন্ট সুগাররের চিলচিৎকারে চমকে ওঠি! তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে মুঠোয় স্মার্টফোনটি মুচড়াতে মুচড়াতে গালাগাল করছেন, ‘নো, নো … দিস ইজ বুলশিট … ফাক ইট অল … অহ গড।’ ব্রিয়ানা তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছে। রেড-রেডের প্লেট ফেলে রেখে আমিও তাদের টেবিলে যাই। একটু সময় লাগে পুরো বিষয়টি বুঝতে। মিনিটখানেক আগে সার্জেন্ট সংবাদটি স্মার্টফোনের স্ক্রিনে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যের আদালত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার বেটি শেলভিকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। প্রায় বছরখানেক আগে ওকলাহোমার তুলসা কাউন্টিতে অফিসার শেলভি টহল দিচ্ছিলেন। একটি চলমান মোটরকারের পাশে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ টেরেন্স ক্রুচারকে দেখতে পান। তাঁর কী যেন সন্দেহ হয়। তো অফিসার শেলভি পিস্তল হাতে এগিয়ে যান, বিপদ আঁচ করতে পেরে টেরেন্স সারেন্ডারের ভঙ্গিতে দুহাত ওপরে তোলেন। কিন্তু অফিসার শেলভি তাকে তৎক্ষণাৎ শুট করে হত্যা করেন। নিহত হওয়ার সময় নিরস্ত্র ব্ল্যাকম্যান টেরেন্সের বয়স ছিল চল্লিশ বছর। তিনি ছিলেন চমৎকার একজন পিতা।
পুলিশ অফিসার শেলভির বিরুদ্ধে ম্যানসøটার বা খুনের মামলা হয়, আজ তাকে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত বেকসুর খালাস দিয়েছে। গত কয়েক বছরে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের গুলিতে আরো কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ অসহায় অবস্থায় নিহত হয়েছেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত থেকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসাররা ‘নির্দোষ’ তকমা নিয়ে ফের বহাল হয়েছেন পুলিশি কাজে। আমি সার্জেন্ট সুগাররেকে প্রবোধ দিয়ে কিছু বলার মতো ভাষা খুঁজে পাই না। তিনি ক্রুদ্ধ স্বরে আমাকে বলেন, ‘দ্য কান্ট্রি আই কল মাই হোম … দ্য ইউনাইটেড স্টেটস … লিসেন মাই গুড ফ্রেন্ড … ওখানে আমার মতো ব্ল্যাকম্যানের জীবনের দাম গর্দভের বিষ্ঠার চেয়েও কম।’
আক্রা নগরীতে ফেরার পথে মাইক্রোবাস থামে একটি আসাফো শ্র্যাইন বা মন্দিরের আঙিনায়। আসাফো হচ্ছে আকান গোত্রের সনাতনী যোদ্ধা। ঔপনিবেশিক যুগেও তারা চোরাগোপ্তা লড়াই জারি রেখেছিল। শ্বেতাঙ্গ পাদ্রিদের প্ররোচনায় তারা সামাজিকভাবে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে বটে, তবে তাদের নিজস্ব মন্দিরে আফ্রিকান কৌমের আদি ধর্মের আচারানুষ্ঠানও বহাল রাখে। দ্বিতল মন্দিরটি যোদ্ধাদের মূর্তি দিয়ে সাজানো। আমরা ঘুরেফিরে মন্দিরের পেছন দিকের আঙিনায় পাঁচ মাথাওয়ালা ড্রাগন, একাধিক শুঁড়ওয়ালা হস্তী ও মানুষের মাথা বসানো একটি তিমি মাছ দেখতে পাই। মন্দিরটির ভেতরে বেদিতে অধিষ্ঠিত আছেন রক-গড বা স্থানীয় পাথর-দেবতা নানা টাবির। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের রেইড করে বন্দি করার দুর্যোগপূর্ণ যুগে মাননীয় টাবির তার এ-থানে আশ্রয় দিয়েছিলেন কিছু পলাতক বন্দিকে। মন্দিরের তলকুঠুরিতে সযতেœ রাখা আছে কিছু ক্রীতদাসের মাথার খুলি ও হাড়গোড়।
জায়গাটি পান্ডা, পুরোহিত ও প্রস্টিটিউটে রমরম করছে। কাসিয়াডা ট্যুর গ্রুপের কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রো-আমেরিকানদের পুরোহিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছেন। মন্দিরের এন্ট্রি তিরিশ ডলার, ভূগর্ভে যেতে হলে খরচ করতে হবে আরো বিশ ডলার। আর কিছু ব্যাপার আছে। ক্রীতদাসে রূপান্তরিত হওয়া প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে টাকাকড়ির বিনিময়ে বিশেষ বন্দোবস্ত আছে। তবে শুধু এন্ট্রি ফি দিলেই ঢোকা যাবে না, জুতা ও ঊর্ধ্বাঙ্গের
শার্ট-গেঞ্জি, ব্লাউজ-ব্রেসিয়ার খুলে উদলা গতরে ধূপধুনায় রীতিমতো পরিশুদ্ধ হয়ে, গতরে মন্ত্রপূত পামঅয়েল মর্দন করে প্রবেশ করতে হবে।
আমি আগ্রহ হারাই। ট্যুর গ্রুপের কৃষ্ণাঙ্গ সহযাত্রীরা রীতিমতো তীর্থ করার উদ্যমে অগ্রসর হচ্ছেন। জাপানি পর্যটকরা বোধ করি বিশেষ কিছু বুঝতে পারছেন না, তারা কেবলই মিঠে করে হাসছেন, আর মাঝেমধ্যে রোবটের মতো হাততালি দিচ্ছেন। আমি চলে আসি মন্দিরের সামনের খোলামেলা চাতালে। আমার প্রয়োজন খানিক নিরিবিলিতে দাঁড়িয়ে আজ দিনভর যে-অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছি, তা নিয়ে নীরবে প্রতিফলন করা। দেখি, সার্জেন্ট সুগাররে দূরে বাইবেল-হাতে একা দাঁড়িয়ে আছেন। ঘানার একটি সনাতনী মন্দিরের ভেতরভাগ খুঁটিয়ে দেখার চেয়ে এ নিঃসঙ্গ মানুষটিকে খানিক সঙ্গ দেওয়া জরুরি মনে হয়।
এগিয়ে গিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়াই। তিনি খুব সুন্দর করে হেসে বলেন, ‘ব্রাদার ইফ ইউ রিড দ্য বাইবেল কেয়ারফুলি, ইট ইজ রিটেন ইন মেনি প্লেসেস। জিসাস ক্রাইস্ট বারবার প্রমিজল্যান্ডের উল্লেখ করছেন। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড মাই ব্রাদার … যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ঠিক স্বদেশ না, ওখানে কোনো দিন আমরা বিচার-ইনসাফ পাবো না। তো আমি এখানে প্রমিজল্যান্ড খুঁজছি। আগামী পরশু চলে যাবো আমার পূর্বপুরুষের বসবাসের থান বনানী আকিম আডার দিকে।’ তিনি কথা বলা থামিয়ে চুপচাপ সূর্যাস্তের দিকে তাকান। স্মৃতিতে অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ফুটে ওঠা বিগতকালের বাস্তবতার মতো সামনের চরাচর জুড়ে ভেসে বেড়ায় আশ্চর্য এক গোধূলি।