চেতনাধারার সম্মিলন

মাহমুদ আল জামান

ঘোড়ার গাড়ি, কালি-কলম, জয়নুল আবেদিন, ১৯৭০
ঘোড়ার গাড়ি, কালি-কলম, জয়নুল আবেদিন, ১৯৭০

সৃজনে ও শেকড়ে এই কথাটি কত ব্যাপক এবং অর্থবোধক হয়ে আছে এদেশের শিল্পকলা প্রয়াসে তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। সৃজন ও শেকড়ের অনুষঙ্গে এবং এই চেতনাকে ধারণ করেই, সৃজনের উৎকর্ষ এবং অনুভবশক্তি ফলবান বৃক্ষের মতো প্রাণময় হয়ে ওঠে। এই শিরোনামে বেঙ্গল গ্যালারির উদ্যোগে ১০টি প্রদর্শনী ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা এই প্রদর্শনীর সৃষ্টিগুচ্ছে প্রত্যক্ষ করেছি কত না পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রবণতা এবং শিল্পিত প্রকরণকে ছুঁয়ে সৃষ্টির অপার আনন্দ-বেদনার ঐশ্বর্যময় ভুবন।
সৃজনে ও শেকড়ে এই শিরোনামের একাদশ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী বারোজন শিল্পী এদেশের শিল্প-আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। তাঁরা তাঁদের সৃজনী উৎকর্ষ ও উদ্ভাবনী কৌশল দ্বারা যে ভুবন নির্মাণ করে গেছেন, এদেশের শিল্পকলা আন্দোলনে তা প্রতিনিয়ত রস সিঞ্চন করছে। তাঁদের সৃজন সেদিক থেকে শুধু তাৎপর্যময় নয়, খুবই প্রেরণাসঞ্চারী। এই শিল্পীদের মানস গঠিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞানে, কখনো পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে, কখনো জীবনাভিজ্ঞতার আততি থেকে। বাংলাদেশের চিত্রকলার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য অবশ্য খুবই প্রয়োজন দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার উপলব্ধি। বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে এদেশের বুকে সামরিক শাসন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। লেখনি, বাক-স্বাধীনতা ছিল না। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় চিত্রচর্চা ও সাধনা নবীন কোনো উৎসমুখে যাত্রা করার জন্য আগ্রহী হবে – এ ছিল খুব স্বাভাবিক। এ-সময়ে বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে যে মানবিকতার চর্চা হয়েছে, তা বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছিল। এঁরা ঐতিহ্য-চেতনা ও আধুনিকতার যে-বীজ বপন করেছিলেন। নানাভাবে শিল্পীদের অনুভব শক্তি নবীন ব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে। ষাটের দশকে রাষ্ট্রের বিরূপতাকে প্রতিহত করার জন্য সংস্কৃতি অঙ্গনে বহুমাত্রিক সংগ্রাম হয়েছিল। এই সংগ্রাম এ অঞ্চলের বাঙালির জাতীয়তার বোধেও এক মাত্রা সঞ্চার করেছিল। বাঙালিত্বের সাধনা ও জাতীয় স্বরূপ তাদের চেতনা এবং সৃজনকে করে তুলেছিল গহন, তীব্র এবং ঐতিহ্যলগ্ন। প্রকাশে নানা নিরীক্ষা ছিল। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে এই শিল্পীদের যাত্রাপথ সেজন্য খুব মসৃণ ছিল না। কতভাবেই না তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। প্রথাশাসিত সমাজে চিত্রবিদ্যা চর্চা ও সাধনার জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যের সঙ্গে এবং নানা প্রবণতা উপলব্ধির জন্য নিজের সঙ্গে যুঝতে হয়েছে। এই সংগ্রাম ও পথ নির্মাণের অন্তর্মুখীন ছাপ ও সৃজন তাঁদেরকে বৃহত্তর লক্ষ্যে উপনীত করেছিল। যদিও আজ তাঁরা সকলেই আর ইহজগতে নেই। তবু তাঁরা উত্তরকালের জন্য রেখে গেছেন এক সমৃদ্ধ ভুবন। জাতীয় জীবনকে প্রাণময়, সুষমামণ্ডিত করবার জন্য, সুন্দরের অভ্যর্থনার জন্য যা সুখকর ও প্রাণদ প্রক্রিয়ার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
জয়নুল আবেদিন তাঁর সৃষ্টি ও সাংগঠনিক প্রতিভার গুণে এদেশের চারুকলা অঙ্গনে আচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত। তিনি এ দেশে চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রাণপুরুষ ও আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার অন্যতম ব্যক্তিত্ব। উনিশশো তেতাল্লিশে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের শিল্পানুরাগী মহলে যে-মর্যাদা পেয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁর সেই সৃজনপ্রতিভা আরো বলীয়ান হয়ে শিখরস্পর্শী হয়েছে। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের ফলে লাখ লাখ লোক প্রাণ হারান। জয়নুল এই দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের কিছু মর্মস্পর্শী ড্রইং করেন, যা সেই সময়ের দর্পণ হয়ে ওঠে। তাঁর চিত্রমালায় একদিকে এদেশের ঐতিহ্যিক প্রবাহের যে-ছোঁয়া পাওয়া যায় অন্যদিকে আধুনিকতার অভিব্যক্তি এবং বৈচিত্র্যগুণও তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল।
জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান ও এসএম সুলতানের শিল্পযাত্রা ও চিত্রসাধনার শুরু চল্লিশের দশকে কলকাতার বৃহত্তর পরিমণ্ডলে। প্রথমোক্ত তিনজন শিক্ষাগ্রহণ করেন কলকাতা আর্ট স্কুলে। এসএম সুলতান ধারাবাহিকভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ না করলেও তিনি পরবর্তীকালে তাঁর সৃজন প্রতিভার মধ্য দিয়ে একজন বিশিষ্ট শিল্পী হয়ে ওঠেন।
কামরুল হাসান পঞ্চাশের দশকেই লোকশিল্প ও পটচিত্রের  অন্তর্নিহিত শক্তি, সৌন্দর্য এবং শিল্পগুণে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন। তাঁর রেখার দীপ্তি ছিল ঈর্ষণীয়। এই রেখাই তাঁর সৃষ্টিতে এক বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি নিজেকে পটুয়া বললেও আসলে তাঁর ছবি তা যে-কোনো মাধ্যমেই হোক না কেন, কোনোদিক থেকে আধুনিকতার অভিব্যক্তি রূপ ও রসের অনুষঙ্গে কম তাৎপর্যময় নয়। তিনি এদেশের আধুনিক শিল্পযাত্রায় অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। মোটেও পটুয়া নন।
ড. নীহাররঞ্জন রায় লোকায়তের সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে যেভাবে চিহ্নিত করেছেন তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। তিনি সাবলীল গতিময়তা, স্বচ্ছন্দ প্রাণপ্রবাহ ও প্রত্যক্ষ দৈনন্দিন জীবনের সমৃদ্ধ বস্তুময়তাকে লোকায়তের যে-লক্ষণ বলেছেন কামরুল হাসানের অজস্র সৃষ্টিতে তা ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে এক সমৃদ্ধ ভুবন সৃষ্টি করেছে। এই ভুবন যেমন ঐতিহ্য-আশ্রিত, অন্যদিকে আধুনিক। কামরুল বাংলাদেশের চিত্রকলায় এখানেই বিশিষ্ট।
আনোয়ারুল হকেরও শিল্পশিক্ষা গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে, কলকাতায়। দেশ বিভাগের পর চলে আসেন ঢাকায় এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে চাকরি নেন এ-শিক্ষায়তনে। তিনি ছবি আঁকেন খুব অল্প; এই অল্প সৃজনে ধরা আছে তাঁর শক্তিমত্তা ও সৃজন কুশলতার অভিনবত্ব। জলরং ও তেলরঙে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় কলকাতায় যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তখনই শিক্ষক ও চিত্রানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। পটের বিভাজন ও শিল্পগুণে তাঁর ছবি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘদিন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন বলে হয়তো তাঁর সৃজনে ভাটা পড়েছিল।
এসএম সুলতান গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে সামান্য কিছুদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করলেও তা তাঁর সৃজনের ভূমিতে খুব বৃহৎ ভূমিকা পালন করেনি। ছন্নছাড়া বোহিমিয়ান জীবন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরিভ্রমণ শেষে থিতু হন এবং সৃজন নিয়ে নব্য ভাবনা ও নিজস্ব এক শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হন। তিনি চিত্রকর হিসেবে উজ্জ্বল ও বিশিষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেন গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে। তাঁর চিত্রের বিষয়াবলিতে বাংলাদেশের জীবন-সংলগ্নতার যে-চিহ্ন ধরা পড়েছে তা প্রকরণে শুধু ভিন্নধর্মী নয়, এ হয়ে ওঠে প্রত্যক্ষ ও প্রতিভাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গ্রামজীবনের নানা অনুষঙ্গকে তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধে ও নব্য ভাবনায় তাঁর পটে তুলে ধরেছেন। রেখা, রং ও পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে তিনি সিদ্ধহস্ত। বাঙালির লুপ্ত ঐতিহ্য, সাহস ও শারীরিক গঠন শৌর্য চিত্রিত করতে বিশেষভাবে তিনি পারঙ্গম। অভিনবত্বে, ভাবনায় মননে ও অভিব্যক্তিতে আধুনিক।
এই চারজন ছাড়া যে আটজন শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে এই প্রদর্শনীতে এঁরা সকলেই ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউটের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ আবর্তনের ছাত্র। সকলেরই জন্ম গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের প্রারম্ভে ও মধ্যপাদে। তিনজন বাদে সকলেই যুক্ত ছিলেন শিক্ষকতায়। তাঁদের একনিষ্ঠ প্রয়াসে ও শিল্পযাত্রায় এদেশের চিত্রশিল্প নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে চিত্রকলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাশ্চাত্যে গমন করেন। তাঁদের শিল্পযাত্রা ও সৃজনী-উদ্যোগ আরো গভীর ও অতলস্পর্শী হয়েছে পাশ্চাত্যের নানা প্রবণতার পরিগ্রহণে।
তাঁরা পথ নির্মাণ করেছিলেন স্বকীয় প্রয়াসে। কয়েকজন শিক্ষক হিসেবেও অসামান্য। সর্বদা শিল্প-সৃষ্টিতে উৎসাহিত করেছেন অগণিত বিদ্যার্থীকে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাস্তবধর্মিতা থেকে বিমূর্ততায় এবং পাশ্চাত্যের শিক্ষা তাঁদের মানসভুবনকে পুষ্ট করেছে। তারই প্রতিফলন আছে সৃষ্টিতে। সেদিক থেকে এই প্রজন্মের শিল্পীদের সৃষ্টি বৈচিত্র্যময়, মনোগ্রাহী ও উজ্জ্বলতা অর্জন করেছে বিষয়ের গুণে এবং রঙের ব্যবহারে। তাঁদের সৃষ্টি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই কতভাবে মনোজ সুষমায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তা ধরা আছে তাঁদের নির্মাণ ও সৃষ্টিকৌশলে। সৃষ্টিতে যেমন প্রতিবাদ আছে, তেমনি প্রথাকে ভাঙার সাহস আছে। বাংলাদেশের চিত্রকলাকে বিষয়ে ও আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করার জন্য এই শিল্পীদের প্রয়াস হয়ে ওঠে সেজন্য সাহসী। রূপারূপ নির্মাণ, কখনো বাস্তব কোনো বিষয়কে ক্যানভাসে উপস্থাপনায় এঁদের নিরলস প্রয়াসে যে-আন্তরিকতা পরিস্ফুট হয়েছে, তা থেকে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তাঁদের অঙ্গীকারের মনোভঙ্গি। কখনো পটে মানবের বিম্ব গঠন বা কখনো বিমূর্তে অবগাহনের মধ্যে এঁদের পথ নির্মাণের যাত্রা যে কত বিচিত্রমুখী তা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। এই শিল্পীদের সৃজন এদেশের চিত্রকলার ভুবনকে শুধু সমৃদ্ধ করেনি, বাংলাদেশের চিত্রকলার গতিপ্রকৃতিরও পরিচয়বহ হয়ে উঠেছে। তাঁদের সৃষ্টির দিকে তাকালে খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারি তাঁদের সৃষ্টি বহুভাবনায় কীভাবে গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে, কতভাবেই না উজ্জ্বল হয়ে মনোগ্রাহী হয়েছে।
এই বারোজন শিল্পীর অভিব্যক্তি ও নিজেদের সৃষ্টির উন্মুখতাকে তুলে ধরার মধ্যে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি শিল্পীদের নানা লক্ষণ ও প্রবণতা। তাঁদের অভিজ্ঞতা, রং-ব্যবহার ও পরিসর-ভাবনা অবলম্বন করে কেউ তাঁর সৃজনে নবমাত্রা সঞ্চার করেছেন। কেউ আধাবিমূর্ত ও বিমূর্ততার মধ্যে দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছেন। এই প্রয়াসের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চিত্রকলা যে কত বৈচিত্র্যময় নিরীক্ষাপ্রবণ ও ভিন্নমাত্রা-সঞ্চারে আগ্রহী তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শিল্পীদের চিন্তা ও চেতনার জগৎকে উদ্দীপ্ত করতে থাকে মানুষের বাঁচার আকাক্সক্ষা, সুখ-দুঃখ, হতাশা ও বেদনা। এ হয়ে ওঠে মানবিক অভিজ্ঞতার দলিল। বাংলাদেশের চিত্রকলার উদ্যানকে এই উত্তরণ-প্রয়াস নানা দিক থেকে সমৃদ্ধ করে চলছে। এই বারোজনের সৃজনভুবনে প্রবেশ করলে আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্ত প্রসারিত হয় এবং বাংলাদেশের চিত্রকলার অগ্রণী শিল্পীদের প্রবণতা সম্পর্কে জানা যায়।
শিল্পী হামিদুর রহমানের জন্ম ১৯২৮ সালে ঢাকায়। শিল্প শিক্ষা গ্রহণ করেন ১৯৪৮-৫০ সালে; চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রথম আবর্তনের ছাত্র। পরবর্তীকালে প্যারিস ও লন্ডনে উচ্চতর শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেন। এই শিক্ষাগ্রহণ তাঁর শিল্পিত মানস গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর ছবির গঠন প্রক্রিয়ায় পশ্চিমের তৎকালীন নানা প্রবণতারও ছাপ দেখা যায়। আধা বিমূর্ততার মধ্যেও কিছু ছবির সারল্যগুণ তাকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।
পঞ্চাশের দশকে করা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের নকশারও অন্যতম রূপকার তিনি। গবেষণা ও নানা সূত্র থেকে জানা যায়, ভাস্কর নভেরা আহমেদেরও শহীদ মিনারের নকশায় বিশেষ অবদান রয়েছে।
প্রদর্শনীতে হামিদুর রহমানের যে-চারটি কাজ ছিল তার মধ্যে চাঁদ, দম্পতি ও বন্যা খুবই হৃদয়গ্রাহী।
শিল্পী রশিদ চৌধুরী ১৯৩২ সালে রাজবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতা, মাদ্রিদ ও প্যারিসে উচ্চতর শিল্পশিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশেষত পাশ্চাত্যের শিল্পশিক্ষা তাঁর সৃজনের পরিধি বিস্তৃত করে। তিনি বাঙালির প্রবহমান লোক ঐতিহ্যের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এই প্রবাহের ছায়াপাত ও আধুনিকতার প্রকাশে তাঁর সৃষ্টিগুচ্ছ হয়ে ওঠে নব্য ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল। রং ও রেখায় তাঁর মৌলিকত্ব তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। এছাড়া ট্যাপেস্ট্রিতে সৃজনের যে নবমাত্রা সঞ্চার করেছেন তিনি তা এ-দেশের চিত্রকলা-আন্দোলনে তাঁকে পথিকৃতের মর্যাদা দিয়েছে।
আবদুর রাজ্জাক চিত্রশিল্পের সকল মাধ্যমে দক্ষতা, সৃষ্টিশীলতা ও উৎকর্ষের ছাপ রেখে গেছেন। তিনি প্রথম প্রজন্মের একজন বিশিষ্ট শিল্পী ছিলেন। চিত্রের সকল মাধ্যমে ছিল তাঁর অনায়াস দক্ষতা। মাধ্যম ব্যবহারে তিনি সব্যসাচী। ভাস্কর্য, জলরং, ছাপচিত্র এবং চিত্র – এই চারটি ক্ষেত্রেই তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
তাঁর চিত্রে প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য নতুন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃতিকে তিনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি জলরঙে সিদ্ধি অর্জন করেন। বিশেষত জলরঙে করা পঞ্চাশের ঢাকা শহর ও শহরতলির অঞ্চলভিত্তিক চিত্রগুচ্ছ তৎকালীন ঢাকার বাস্তবতার দলিল হয়ে আছে।
প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি কাজের মধ্যে একটি ট্যাপেস্ট্রি ছিল। এই সৃজনে তাঁর ভাবনা ও ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা বিধৃত হয়েছে। শুধু শৈলীর দিক থেকেই নয়, শিল্প সৃষ্টির মাধ্যম নির্বাচনেও তাঁর বিশিষ্টতা উল্লেখ করার মতো। মাধ্যম হিসেবে তিনি ট্যাপেস্ট্রিকে শিল্পের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা দেন এবং বিরতিহীন চর্চার মধ্য দিয়ে এই মাধ্যমের তিনি এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী স্রষ্টা হয়ে ওঠেন।
চিত্রাঙ্কনেও তিনি ছিলেন নতুনত্বের সন্ধানী। প্রচলিত তেলরং ছাড়াও চিত্ররচনা করেছেন গোয়াশ এবং টেম্পেরার মতো অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত মাধ্যমে। শিল্পকর্মে তিনি বাঙালির লোক-ঐতিহ্য ও পরম্পরা নিয়ে নানাধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। লোক-ঐতিহ্যের আধুনিকায়নে ও বিষয়ের বৈচিত্র্যে তাঁর যে-কোনো সৃষ্টি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
ষাটের দশকে এদেশের সাহিত্য ও চিত্রকলা যখন শেকড়সন্ধানী ও বৈচিত্র্য-উন্মুখ হয়ে উঠেছিল, তখন তাঁর চিত্রভাষা নবীন পথ নির্মাণ করেছিল। তাঁর সৃষ্টিতে দেশের চিরকালীন রূপ ও সমকালীন মর্মচেতনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
শিল্পী আবদুর রাজ্জাক ১৯৩২ সালে শরীয়তপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। চিত্রকলায় উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়ওয়ায়। এই শিল্পীর ছাপ পড়ে তাঁর জল, তেল ও ছাপাই ছবিতে। ভাস্কর্যেও তিনি সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠেন।
প্রদর্শনীর চারটি ছবির মধ্যে জলরঙে করা তাঁর নিসর্গ-৭ চিত্রটিতে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও মুন্শিয়ানা প্রতিফলিত হয়েছে।
শিল্পী মবীনুল আজিম ১৯৩৪ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৫ সালে চারু ও কারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথম প্রজন্মের এই শিল্পী স্বকীয় এক চিত্রভাষা নির্মাণে সমর্থ হন ও গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এক অগ্রণী শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হন। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
শিল্পী মবীনুল আজম অকাল প্রয়াত। প্রদর্শনীতে তাঁর চারটি ছবিই নিসর্গকেন্দ্রিক। প্রতিটি ছবিতে তাঁর অনুভবশক্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
এদেশের চিত্রকলা আন্দোলনে প্রথম প্রজন্মের শিল্পী কাজী আবদুল বাসেত শিল্প-ঐশ্বর্যের গুণে ও মৌলিকত্বে বিশিষ্ট এক চিত্রকর। বাস্তবধর্মী ও বিমূর্ত এই দুধারাতেই তিনি কাজ করেছেন। ১৯৬২ সালে চিত্রকলায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য তিনি আমেরিকায় যান। এই সময়ে পাশ্চাত্যের শিল্পপ্রবণতায় নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং আলোড়িত হওয়ার মতো নানা ঘটনা ঘটেছে। কাজী আবদুল বাসেত খুব কাছে থেকে তা প্রত্যক্ষ করেছেন, কিন্তু এই আন্দোলন থেকে তিনি সরাসরি পরিগ্রহণ করেননি। বরং পরবর্তীকালে তিনি দেশীয় ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে তাঁর সৃষ্টির বৈভবকে সমৃদ্ধ করার জন্য সচেষ্ট থেকেছেন।
১৯৬৫ সালে তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে স্বরূপ-চেতনার যে-আন্দোলন চলছিল তা তাঁর হৃদয়মনে গভীর প্রভাব ফেলে। ষাটের মধ্যভাগ থেকে তিনি বিমূর্ত ধারার কাজে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। পরবর্তীকালে আবার বাস্তবধারার কাজে মনোযোগ দেন। এই রীতির ছবিই তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল।
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে তিনি মায়ের অপেক্ষা নিয়ে বেশকিছু তেলরং, প্যাস্টেল এবং কালি ও কলমে ড্রইং করেছেন। এই কাজগুলো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দিনের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত তেলরঙের ছবিটি এ-সিরিজের।
১৯৩৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকায় কাজী আবদুল বাসেতের জন্ম। মৃত্যু ২০০২ সালের ২৩ মে।