ছয় দশকেরও আগে একষট্টিতে কবি সুফিয়া কামালের স্নেহচ্ছায়ায় সন্জীদা খাতুন ও ওয়াহিদুল হক, সঙ্গে আরো কয়েক সাহসী বাঙালি ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁরা প্রতিকূল পরিবেশে সদ্য পালন করে এসেছেন রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল সর্বজনে যেন নিজেকে বাঙালি রূপে চিহ্নিত করে, বাঙালি জাতিসত্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে। এ-কর্তব্য সাধনে তাঁদের অবলম্বন ছিল বাংলা গান তথা বাঙালি সংস্কৃতি। নিরানব্বইয়ে সুফিয়া কামাল প্রয়াত হলেন, দুই হাজার সাতে চলে গেলেন ওয়াহিদুল হক। এরপর আঠারোটি বছর নিঃসঙ্গ পথিকের মতো সন্জীদা খাতুন স্থির প্রত্যয়ে যাত্রাটি অব্যাহত রেখেছিলেন।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এই অভিযাত্রীর চিন্তা ও কর্মোদ্যোগের বীজ বপন হয়েছিল পিতৃগৃহে শিশু বয়সে। জীবনস্মৃতি নিয়ে সকল গ্রন্থ, সাক্ষাৎকার ও রচনায় এর উল্লেখ রয়েছে। পিতা কাজী মোতাহার হোসেন পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির ভিত্তিতে ভারতভাগের সময় ধর্মীয় উন্মাদনা যখন চরমে, তখন তিনি স্বল্পসংখ্যক মানুষের ‘শিখাগোষ্ঠী’র মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিমগ্ন, সঙ্গে পেয়েছেন আবদুল ওয়াদুদ, আবুল হোসেনের মতো যুক্তিবাদী মানুষদের। সাহসের সঙ্গে এই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি উচ্চারণ করেন ‘সংস্কৃতি শিক্ষিত মানুষের ধর্ম।’ কাজী নজরুল ইসলামের নিত্য যাতায়াত সেগুনবাগিচার বাসভবনে, তাঁকে ডাকেন ‘মতিহার’ বলে। বাসায় সংগীতচর্চার পরিবেশ, মূলত উচ্চাঙ্গসংগীতের। পিতা নিজে নিত্য গান করেন, কন্যাদের সংগীতশিক্ষার ব্যাপার পারিবারিক রীতি। বড়দি সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করছেন, তিনি নিবিষ্ট মনে পাশে বসে, কালক্রমে তাঁর পালা দ্রুত আসে, প্রথমে উচ্চাঙ্গসংগীত, পরে নিয়মিত বাণীপ্রধান সংগীত শিক্ষার সূচনা সোহরাব হোসেনের কাছে নজরুলসংগীতের, তারপর আপন তাড়নায় রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার জন্য ছুটেছেন হুসনা বানু খানমের আজিমপুরের বাসায়। তখন তিনি রফিকুল ইসলামের সূত্রে মুকুল ফৌজ ও পটুয়া কামরুল হাসানের ব্রতচারীতে যোগ দিয়েছেন। সে-সময়টি যে আবার ভাষা-আন্দোলনের, বাঙালি মুসলমানের মোহমুক্তির সূচনাপর্ব, তাঁর ভাষায় স্বাধীনতার যখন বীজ বপন করা হয়। সনজীদা খাতুন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী। তিনি ভাষা-আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। তবে সনজীদা খাতুন জানাচ্ছেন, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের ভাষা-আন্দোলনের যে দুর্লভ ছবিতে তাঁর উপস্থিতি লক্ষ করা যায় সেটি ১৯৫৩ সালের ভাষা শহিদ দিবস পালনের। তখন সনজীদা খাতুনের চিন্তা ও মনন সুনির্দিষ্ট রূপ নেওয়া শুরু করেছে। পরিবারে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সাংগীতিক পরিবেশের সঙ্গে বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষা, পাশাপাশি নিজের সংগীত প্রশিক্ষণ। এভাবে সনজীদা খাতুনের চিন্তাধারা পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৫৪ সালে স্নাতক হওয়ার পরের বছর বিশ্বভারতীতে স্নাতকোত্তর অর্জন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি আত্মস্থ করার চিন্তা গভীরতর করলো। ষাটের দশকের প্রারম্ভে সনজীদা খাতুন বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংগীত বিষয়ে অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে লক্ষ্যস্থির করেছেন এবং সারাটি জীবন সে-লক্ষ্য পূরণে নিরন্তর কাজ করে গেছেন। এ-কর্মসম্পাদনে তিনি ওয়াহিদুল হককে জ্ঞানী নির্ভরযোগ্য ও একান্ত প্রয়োজনীয় সাথি হিসেবে পেয়েছেন। আর তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আরো কয়েক সাহসী সংস্কৃতি ও সমাজ সচেতন বিশিষ্টজন।
যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সন্জীদা খাতুন ও তাঁর সহযাত্রীরা অগ্রসর হয়েছেন, সেটি বাঙালির সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে চেতনা ও মননকে প্রভাবিত করেছে এবং তার সুদূরপ্রসারী সুফল দেশবাসী লাভ করেছে। এই সামগ্রিকতায় সন্জীদা খাতুনের কর্ম ও জীবনকে বিবেচনা করতে হবে। সনজীদা খাতুন তাঁর জীবনগ্রন্থে বলেছেন, তাঁর কাজের ক্ষেত্র রাজনীতি নয়, সংস্কৃতি তাঁর কর্মক্ষেত্র। আর নব্বইতম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সংস্কৃতিকর্মীদের রাজনৈতিক সচেতনতা প্রয়োজন। পাকিস্তান আমলে দুই অংশের মানুষকে সৃষ্টির তত্ত্ব দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে একমাত্র ধর্মের ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টায় যে-আঘাত আসে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর, তাকেই উপজীব্য করে যেমন আত্মপরিচয়ের সংকট ঘনীভূত হয়েছে, তেমন তাকে প্রতিরোধ করেই সর্বজনের হৃদয়ে বাঙালি জাতিসত্তার উন্মোচন ঘটিয়েছেন সনজীদা খাতুনরা। বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষ করে বাংলা গানকে অবলম্বন করে কি নিখুঁত পরিকল্পনায় দেশকে মুক্তিযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। ১৯৬১-তে প্রতিকূল পরিবেশে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালন, সে-শীতে প্রতিষ্ঠা করলেন ছায়ানট। দেশভাগের পর বিশিষ্ট সংগীতগুণীরা অনুকূল পরিবেশের অভাব অনুভব করে দেশত্যাগ করেছেন, সংগীত ধর্মে অনুচিত এমন প্রচারণা চলে। তাই ১৯৬৩-তে শিল্পী সংকট নিরসনে প্রতিষ্ঠা পেল ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তন, যার ছাত্রসংখ্যা চার হাজার অতিক্রম করছে, হয়ে উঠেছে দেশের বৃহত্তম সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৬৭-তে গ্রামীণ জনপদের পালা-পার্বণ আর বাণিজ্যিক হালখাতা আয়োজন থেকে রমনার বটমূলে সূচিত হলো নগরজীবনে সংগীতের আবহে বাঙালির মিলনমেলা। মূলধারার বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রাম যতটা বেগবান হয়েছে, তেমনই স্থান সংকুলানের সমস্যা হয়েছে রমনার বটমূলে। স্বাধীনতার পর নববর্ষ একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসব যা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। এই সমগ্র কর্মযজ্ঞে বিশাল অবদান সনজীদা খাতুনের।
অথচ, স্মরণে রাখতে হবে, সনজীদা খাতুন সরকারি চাকরি করেন বিধায় ছায়ানটের নির্বাহী পরিষদে তিনি প্রকাশ্য সদস্য নন। তবু তাঁর নিস্তার নেই, বদলি করা হলো সুদূর রংপুরে, ঢাকায় ফিরলেন একাত্তরের মার্চে। তিনিও নিরস্ত নন, গণহত্যা শুরুর পর প্রথমে সাভারে, পরে দেশত্যাগ করে যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে। দেহ ও মনে চরম বিপর্যস্ত সন্জীদা খাতুন দেশত্যাগী শিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। তাঁরা শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গান গেয়ে উদ্দীপ্ত করেন।
এভাবে সন্জীদা খাতুন তাঁর সংগীত তথা সংস্কৃতি সাধনার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারে পরিণত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের অংশ। তিনি নিছক সংগীতশিল্পী, শিক্ষক বা সংগঠক নন। তিনি ও তাঁর প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দেয় না, মিছিল করে না। সংগীত সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি জনমনকে প্রভাবিত করার মৌলিক কাজটি সম্পাদনে প্রয়াসী হয়েছেন। দেশভাগ বস্তুতপক্ষে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ। তখন ধর্মপরিচয় ও জাতিপরিচয়ের দ্বন্দ্ব সাংঘর্ষিক রূপ নিয়েছিল, ষাটের দশকে সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবোধ অগ্রসর চিন্তাকে বহন করেছে, ছোট ছোট বিজয় বড় বিজয়কে নিশ্চিত করেছে। সনজীদা খাতুনরা তার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি এজন্য বাংলা গান বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, অনুশীলন ও বিস্তারকে অ্যাকাডেমিক ও সাংগঠনিকভাবে অনন্য পর্যায়ে উন্নীত করেছেন। ১৯৭৮-এ তাঁর বিশ্বভারতীর পিএইচ.ডির অভিসন্দর্ভ রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ রূপে প্রকাশ পেয়ে বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁর গবেষণাকে পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন তিনি নিজে ও ছায়ানটের শিক্ষকদের মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। প্রতিটি গানের বাণীর সম্পূর্ণ উপলব্ধির পর যথাযথ সুরে নিবেদনের নির্দেশনা ছিল তাঁর প্রতিটি ছাত্রের জন্য। তাঁরা পরে শিক্ষকরূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। যখন জগৎজুড়ে শিল্পকর্ম বাণিজ্যিক বিনিয়োগের বিষয়, তখন তিনি বিনোদন তারকা নন, শিল্পী সৃষ্টিতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে গেছেন কেবল ছায়ানটে নয়, জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সূত্রে সারা দেশে। সমাজদেহে ধর্মের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ নিয়ে গভীর ও বিস্তীর্ণ বিভক্তি, তার মাশুল দিতে হয় ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণে। তখন তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি জানান, ‘আমরা ত্রস্ত, তবে সন্ত্রস্ত নই।’ যথারীতি পরের বছর থেকে আয়োজন চলে। তখন তাঁদের নূতন চিন্তা জাগে, আরো গভীরে কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা পেল সংস্কৃতি সমন্বিত শিশু শিক্ষা কার্যক্রম ‘নালন্দা’। ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের আটি বাজারে নির্মিত হয়েছে অকালপ্রয়াত জ্যৈষ্ঠ কন্যার পরিবারের দানের জমিতে নালন্দার অপালা ভবন।
সন্জীদা খাতুন কখনো এ-সকল কাজের একক কৃতিত্ব দাবি করেননি। তবে গত প্রায় দুই দশক ধরে একা হাল ধরেছেন। এ-সময়কালে অনেকের সংস্কৃতি-বোধ, সংগীত-রুচি, জীবনাচার, চিন্তা ও মননে বিশাল পরিবর্তন এসেছে, সমাজে বিভক্তি ও সংকট গভীরতর হয়েছে। ভাষা-আন্দোলন থেকে উঠে আসা সনজীদা খাতুন তাঁর বিভাগের জ্যৈষ্ঠজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বাণীতে আস্থা রেখেছিলেন – ‘আমি হিন্দু না মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমি বাঙালী।’ বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে সনজীদা খাতুন আমৃত্যু তা প্রতিষ্ঠার জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। কিন্তু আজো ধর্ম না জাতি পরিচয়ের কোনটি আমার জীবনাচারে প্রাধান্য পাবে – সে-দ্বিধাটি গেল না। বরং শংকা জাগে, সমাজ সাংস্কৃতিক উদ্বাস্তুতার দিকে প্রত্যাবর্তনে সমঝোতা থেকে পৃষ্ঠপোষকতার দিকে ধাবিত হচ্ছে কি না। সনজীদা খাতুন গত দেড় বছর ধরে বয়স ও অসুস্থতার কারণে সক্রিয় থাকতে পারেননি। এমন সংজ্ঞায়িত মুহূর্তে এ-বছরের স্বাধীনতা দিবসে ধানমণ্ডির সাতাশ নম্বরের মীনা বাজার থেকে যে দীর্ঘ জনস্রোত গানে গানে তাঁর মৃত্যুকে উদ্যাপন করলো, তাতে আমরা অনুভব করেছি, সংস্কৃতিজন, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, সম্প্রীতিকামী মানুষদের তিনি ভরসার জায়গা জুড়ে ছিলেন। সেই মহীরূহ লোকান্তরিত হয়েছেন।
সে-ছায়াটি সরে গেল।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.