জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের ভিটা : পদ্মার বুকে সেই ‘গাউপাড়া’ গ্রাম

জীবনানন্দ দাশকে ‘খুঁজতে’ মানুষ মূলত দুটি জায়গায় যায় – ১. তাঁর জন্মস্থান বরিশাল এবং ২. শেষ জীবনের আবাসস্থল কলকাতা (বৃহত্তরভাবে পশ্চিমবঙ্গ)। কিন্তু তাঁর শেকড় বা পূর্বপুরুষের ভিটা এই বরিশাল কিংবা কলকাতা – কোনোখানেই নয়; বরং তাঁর দাদা সর্বানন্দ দাশ বরিশালে এসেছিলেন বাংলাদেশের বিক্রমপুর (আজ যেটা মুন্সীগঞ্জ) থেকে। পদ্মার তীরের গাউপাড়া (এখন অফিসিয়ালি গাওপাড়া লেখা হয়) গ্রাম থেকে।

ঢাকা শহরের অন্যতম প্রবেশদ্বার বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ৩২ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই মাওয়া চৌরাস্তা। এটি পড়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলায়।

মাওয়া চৌরাস্তা থেকে পদ্মার তীর ধরে সুন্দর পিচঢালা পথ। আট-নয় কিলোমিটার পুবদিকে গেলে লৌহজং-তেওটিয়া ইউনিয়ন। নদীর পাড়েই ঘোড়দৌড় বাজার। এই বাজারে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে তাকালে পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য চোখে পড়ে। চা খেতে খেতে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে।

– এখানে গাউপাড়া কোনদিকে?

– গাওদিয়া আরেকটু সামনে। এই রাস্তা দিয়ে যান।

– গাওদিয়া না। গাউপাড়া। গাওদিয়া আর গাউপাড়া কি এক?

– না না এক না। আপনি গাউপাড়া খোঁজেন? সেটা তো নদীতে।

– নদীতে?

দূরে পদ্মার দিকে আঙুল ইশারা করে একজন বললেন, ‘ওইখানে গাউপাড়া ছিল। কবেই তলিয়ে গেছে!’ মুন্সীগঞ্জের মানুষের কাছে গাউপাড়া এখন স্মৃতি। তাঁরা জানান, ১৮৫৫ সালের পর থেকে গাউপাড়া গ্রাম অন্তত ১৫ বার ভাঙনের শিকার হয়েছে। ফলে এই গ্রামের মানুষ বারবার অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নতুন করে চর জেগে ওঠার পরে অনেকে ফিরে এসেছেন। অনেকে ফেরেননি। লৌহজং-তেওটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন সময়ে গাউপাড়া ভাঙলেও পুনরায় চর জেগে উঠেছে। সবশেষ এটি ভাঙনের শিকার হয় ২০১৭-১৮ সালে। এখন গ্রামটি পুরোপুরি বিলুপ্ত। তবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে রফিকুল ইসলাম মনে করেন, গাউপাড়া ভবিষ্যতে আবারো হয়তো জেগে উঠবে (সাক্ষাৎকার ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩)।

তিনি জানান, লৌহজং-তেওটিয়া ইউনিয়নে একসময় ১৪টি গ্রাম ছিল। এগুলো হচ্ছে – বড়নওপাড়া, দিঘলী, সংগ্রামবীর, গাউপাড়া, পাটুলী, দুয়াল্লীর চর, ভোজগাঁও, রাউৎগাঁও, পাইকারা, ঝাউটিয়া, তেওটিয়া, সাইনহাটী, ব্রাহ্মণগাঁও, কোরহাটি। এর মধ্যে আটটি গ্রাম – দিঘলী, সংগ্রামবীর, গাউপাড়া, দুয়াল্লীর চর, ভোজগাঁও, সাইনহাটী, ব্রাহ্মণগাঁও ও কোরহাটি নদীতে বিলীন। পাটুলী চলে গেছে অন্য উপজেলায়। তবে ব্রাহ্মণগাঁও এবং কোরহাটি নতুন করে জেগে উঠছে। গাউপাড়ার উত্তরে গাঁওদিয়া, পশ্চিম-উত্তরে রানাদিয়া ও সংগ্রামবীর, দক্ষিণে কলিকাল ও পদ্মা নদী, পশ্চিমে দুয়াল্লী ও চৈতপুর আর পূর্বে ছিল পাটুলী ও ধাইদিয়া গ্রাম।

জীবনানন্দের পূর্বপুরুষ গাউপাড়া গ্রামের পশ্চিম-দক্ষিণে বসবাস করতেন। তাঁদের বাড়িটি ছিল সি. এস. মৌজা ম্যাপের এক নম্বর সিটের খালের কাছে। গাউপাড়া বাজার পাটের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাছাড়া এখানে তৈল, তিল, গুড়, চিনি, তামাক ও লবণের ব্যবসা হতো। শনি ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসতো। (রমজান মাহমুদ, বিক্রমপুর : ‘জীবনানন্দ দাশ ও দাশ পরিবার’, শালুক জীবনানন্দ দাশ সংখ্যা/ এপ্রিল ২০২১, পৃ ২৭৬)।

প্রসঙ্গত, আজকে যেটি মুন্সীগঞ্জ – জীবনানন্দ এবং তাঁর পূর্বপুরুষের সময় এটি ছিল বিক্রমপুর। মজার ব্যাপার হলো, জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের উপাধিও ছিল মুন্সী। তাঁদের বাড়িটি ‘মুন্সীবাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। ক্লিন্টন বি সিলি জানাচ্ছেন, সব ধরনের সরকারি ভাষা হিসেবে ফার্সির জায়গায় ইংরেজি প্রতিস্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত মোগল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারি ভাষা হিসেবে ফার্সি ভাষায় সমৃদ্ধ লোকজনকে ‘মুন্সী’ উপাধি দেওয়া হতো। জীবনানন্দের বাবা সত্যানন্দ দাশ লিখেছেন : ‘আমার পিতামহ, শুনিয়াছি, কিছুকাল নেমকের দারোগা ছিলেন; আমার জেঠামহাশয় বাটোয়ারার আমিন এবং দাদামহাশয় জজ আদালতের আমলা, পিতৃব্য ট্যাক্স কালেক্টর ছিলেন। তিন পুরুষকাল এই মুন্সী পরিবার বিশ্বস্ততার সহিত সরকারী কর্ম্ম করিতেছেন।’ (ক্লিন্টন বি সিলি, অনন্য জীবনানন্দ, ফারুক মঈনউদ্দীন অনূদিত, প্রথমা, ২০১১, পৃ ২২)।

বিক্রমপুরে মুন্সী পরিবার একসময় বেশ অবস্থাসম্পন্ন ছিল। তাদের জমিদারিও ছিল। কিন্তু বয়স্কদের অনবধানতা আর পদ্মার ভাঙনে সেই জমিদারি বিলুপ্ত হয়। এই পরিবারের বলরাম দাসগুপ্তের তিন পুত্র – তারিণীচরণ, ভোলানাথ ও সর্বানন্দ। সর্বানন্দ দাসের জন্ম ১৮৩৮ সালে। তাঁর কাকা বরিশালে সরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাঁর কাছে থেকে বরিশাল জিলা স্কুলে পড়াশোনা করেন সর্বানন্দ। এন্ট্রান্স পাশ করার পরে তিনি বরিশালের সিভিল কোর্টে চাকরি নেন। এরপর বিয়ে করেন প্রসন্নকুমারীকে। তাঁরও জন্ম গাউপাড়া গ্রামে। প্রসন্নকুমারীর বয়স যখন ১৫-১৬, তখন প্রথম পুত্র হরিচরণের জন্ম। দ্বিতীয় পুত্র দুর্গামোহনের জন্ম ১৮৬৩ সালে। এই দুর্গামোহনই জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাস। দ্বিতীয় পুত্রের জন্মের পরপরই সর্বানন্দ সপরিবারে বরিশাল চলে আসেন। এরই মধ্যে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাঁর স্ত্রী ও পুত্ররাও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ধর্ম পরিবর্তনের পরে দুর্গামোহনের নতুন নাম হয় সত্যানন্দ দাশ। অর্থাৎ ‘দাস’ থেকে তাঁরা ‘দাশ’ হয়ে যান।

জীবনানন্দের ছোট বোন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজে এসে আমাদের বাবার দুর্গামোহন নাম পরিবর্তন করে সত্যানন্দ রাখা হয়, পরে এই পরিবারের পুত্রদের নামকরণে সবসময় ‘আনন্দ’ শব্দ যুক্ত হয়েছে।’ তাঁর ভাষায় : ‘আমাদের ঠাকুরদাদা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত। পদ্মাপারে বাড়ি। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে, গাউপারা গ্রামের খ্যাতনামা মুন্সীবাড়ী, দৈবক্রমে ভ্রান্ত সোনার কাত্যায়নী যেখানে নিত্যপূজিত। সে গ্রাম আজ আর নেই। কীর্তিনাশা পদ্মার সলিলে সমাধি লাভ করেছে।’

সর্বানন্দ বহু গুণান্বিত পুরুষ ছিলেন উল্লেখ করে সুচরিতা লিখছেন, ‘আপন শ্রেষ্ঠত্বে ও মহিমায় তিনি ছিলেন মহীরুহের মতো। বহু লোককে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বহু পরিবারকে সাহায্য করতেন। একটা বড় শহরের উন্নতিকল্পে যত রকম প্রতিষ্ঠান ছিল সবকটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জীবনের মধ্য ও শেষ ভাগে তিনি কর্মযোগীর জীবন আরম্ভ করেছিলেন।’ (‘দাশ পরিবার ও জীবনানন্দ’, ভোরের পাখি : সুচরিতা দাশ, সুবর্ণরেখা, ২০০৮, পৃ ৬)।

সর্বানন্দ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সুচরিতা জানাচ্ছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষেরা অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁদের একজনকে নাকি পরিতে পেয়েছিল। জ্যোৎস্নারাতে ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেত পরিরা, ভোরের আলোয় তাঁকে পাওয়া যেত শিশির-ঝলমল সোনালি ধানক্ষেতের পাশে। তাঁর বিছানায় ছড়ানো থাকতো কাচা লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি। তারপর বহু যুগ পার হয়ে গেছে। এঁদেরই উত্তরপুরুষ জীবনানন্দ। (সুচরিতা দাশ, ‘কাছের জীবনানন্দ’, ময়ূখ ১৩৬১-৬২, পৌষ-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা, পৃ ১৭২)।

গাউপাড়া গ্রাম সম্পর্কে সুচরিতা লিখেছেন, ‘সে গ্রাম আজ আর নেই। কীর্তিনাশা পদ্মার সলিলে সমাধি লাভ করেছে।’ অর্থাৎ পদ্মাকে তিনি কীর্তিনাশা বলেছেন। নদীগুলো যখন ভীষণ সংহার মূর্তি ধারণ করে, বিভিন্ন প্রাচীন জনপদের ঘরবাড়ি, অট্টালিকা ইত্যাদি নানাবিধ প্রাচীন কীর্তি নাশ বা ধ্বংস করে তখন তার নাম হয় ‘কীর্তিনাশা’। বাংলাদেশের দুটি নদীর নাম ‘ক্ষ্যাপা’ ও ‘পাগলা’ এভাবেই রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ১৭৮৭ সালে প্রবল বন্যায় যখন পদ্মা তার গতিপথ পরিবর্তন করে তখন বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়-কেদার রায়, রাজা রাজবল্লভের কীর্তিসহ প্রায় ৫০টি গ্রামের নানান কীর্তি নাশ করেছিল। এই নদী নওপাড়ার চৌধুরীদের কীর্তিও ধ্বংস করেছে। এই নদীর ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে কবি নবীনচন্দ্র সেন লিখেছিলেন :

এত অভিমান যদি, ধর তবে নদী

ধর একবার সেই ভীষণ আকার,

রাজবল্লভের পুরী গ্রাসিলে যেরূপে।

ভীষণ ঘূর্ণিত স্রোতে, ছাড়িয়ে হুঙ্কার

অসংখ্য তরঙ্গাঘাতে, তরঙ্গ ফুৎকারে

প্রকম্পিত দিঙ্মণ্ডল করি বিধুমিত, –

যে মূর্তিতে বালকের ক্রীড়া যষ্টি মত,

ডুবালে সে কীর্তিরাশি, কল্পনা অতীত।

জীবনানন্দের ভাই অশোকানন্দ লিখেছেন, ‘ঠাকুমা রাত্রে ঘুমোবার আগে বা রোগশয্যার পাশে বসে অনেক সময়েই আমাদের গল্প শোনাতেন। কীর্তিনাশা নদীর গল্প শুনেছি তাঁর কাছে। বিক্রমপুরের মেয়ে ছিলেন ঠাকুমা। সেখানকার বৃষ্টির দিনের গল্প, পদ্মানদীর গল্প, আমাদের পূর্বপুরুষদের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনতাম তাঁর কাছে। রোগের কষ্ট ভুলে যেতাম।’ (অশোকানন্দ দাশ, বাল্যস্মৃতি, ময়ূখ, প্রাগুক্ত)।

ঠাকুমার কাছে শোনা এসব গল্পের মধ্যে ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজা ও শিল্পরসিক রাজবল্লভের নাম, যাঁর একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদকে বলা হতো ‘একুশ রত্ন’, যার উল্লেখ আছে জীবনানন্দের কবিতায় :

তবু তাহা ভুল জানি – রাজবল্লভের কীর্তি ভাঙে কীর্তিনাশা;

তবুও পদ্মার রূপ একুশরত্নের চেয়ে আরো ঢের গাঢ়

আরো ঢের প্রাণ তার, বেগ তার, আরো ঢের জল, জল

                                                           আরো।

জীবনানন্দের আরো কবিতায় কীর্তিনাশা তথা নদীর ভাঙনে জনপদ বিলীন হওয়া এবং তারপরে নতুন সম্ভাবনার কথা আছে। যেমন ‘মনে হয় একদিন’ কবিতায় লিখেছেন :

মৃত্যুকে কে মনে রাখে? – কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে

                                                                                বারো মাস

নতুন ডাঙ্গার দিকে পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার 

                                                                        কেটে যায় –

শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?

প্রশ্ন হলো কীর্তিনাশা কোথায়? পদ্মার আরেক নামই কি কীর্তিনাশা?

‘পদ্মার যে অংশ বিক্রমপুর ভেদ করিয়া মেঘনাদের সহিত মিলিত হইয়াছে, উহার নাম কীর্তিনাশা, প্রকৃত প্রস্তাবে পদ্মার গতি বিক্রমপুরের পশ্চিমদিকে পরিত্যাগ করিয়া মরাপদ্মা নামে এবং প্রবলাংশ যাহা প্রায় শত বৎসর মধ্যে উদ্ভব হইয়া প্রাচীন কালীগঙ্গা নদীর বিলোপ সাধন করিয়াছে, উহাই কীর্তিনাশা নামে পরিচিত।’ (যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকার ইতিহাস, বইপত্র, ২০১২, পৃ ৮০)।

১৭৮০ সালে মিস্টার রেনেল পূর্ববঙ্গের যে-মানচিত্র এঁকেছিলেন, তাতে দেখা যায়, পদ্মানদী বিক্রমপুরের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভুবনেশ্বরের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তখন ‘কীর্তিনাশা’ বা ‘নয়াভাঙ্গনী’ নামে কোনো নদীর অস্তিত্ব ছিল না। বিক্রমপুরের অন্তর্গত রাজনগর ও ভদ্রেশ^র গ্রামের মধ্যে একটি অপ্রশস্ত জলপ্রণালি ছিল। সেটি প্রাচীন কালীগঙ্গার শেষ চিহ্নমাত্র। শ্রীপুর, নওপাড়া, ফুলবাড়িয়া, মুলফৎগঞ্জ গ্রাম ছিল কালীগঙ্গার তটে। পরে শত বছরে কীর্তিনাশা নদীর উৎপত্তি হয়, যেটি বিক্রমপুরের বক্ষদেশ ভেদ করে এবং নয়াভাঙ্গনী নদী উদ্ভূত হয়ে ইদিলপুরের প্রান্তদেশ দিয়ে পদ্মা ও মেঘনাকে পরস্পর যুক্ত করেছে।

যতীন্দ্রমোহন লিখছেন : ‘ব্রহ্মপুত্র মেঘনাদের (মেঘনা) সহিত মিলিত হইয়া যখন প্রবাহিত হইত, তখন উহার স্রোতবেগে প্রবল থাকায় পদ্মাকে বহু পশ্চিমে রাখিয়াছিল। পরে আবার যখন ব্রহ্মপুত্রের সহিত মেঘনাদের ততটা সম্বন্ধ রহিল না, এবং ব্রহ্মপুত্র যমুনার অঙ্গে অঙ্গ মিশাইয়া গোয়ালন্দের নিকট পদ্মার সহিত সম্মিলিত হইল, তখন পদ্মার বেগই প্রবল হইয়া ক্রমে পশ্চিম দিক পরিত্যাগ করিয়া পূর্বদিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। তাহার ফলস্বরূপই কীর্তিনাশা ও নয়াভাঙ্গনী নদীর উদ্ভব।’

বাংলাদেশের নদীকোষ বইতে লেখা হয়েছে : পদ্মা নদীর যে অংশ বিক্রমপুর ভেদ করে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে, তার নাম ‘কীর্তিনাশা’। প্রকৃত প্রস্তাবে পদ্মার গতি পশ্চিম দিক পরিত্যাগ করে মরাপদ্মা নামে এবং প্রবলাংশ যা প্রায় দুশো বছরের মধ্যে উদ্ভব হয়ে প্রাচীন কালীগঙ্গা নদীর বিলোপ করেছে, তাই ‘কীর্তিনাশা’ নামে পরিচিত।

১৮৪০ সালে টেইলরের টপোগ্রাফি অব ঢাকা গ্রন্থে কীর্তিনাশা নদীর নাম পাওয়া যায়। এই নদী প্রথমে রথখোলা, পরে ব্রহ্মবধিয়া, কাথারিয়া এবং অবশেষে কীর্তিনাশা নামে পরিচিত হয়েছে। শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে শরীয়তপুর সদর ও মাদারীপুর জেলার কালকিনী উপজেলা হয়ে আড়িয়াল খাঁ নদে মিশেছে। কীর্তিনাশার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার।

(ড. অশোক বিশ্বাস, বাংলাদেশের নদীকোষ, গতিধারা, ২০১১, পৃ ১৬৮)।

কীর্তিনাশার তীরে জন্ম ইয়াসিন আযীয লিখেছেন, কীর্তিনাশা পদ্মা থেকে নড়িয়া উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে শরীয়তপুর জেলার ঠিক মাঝ দিয়ে সর্পিলাকারে ভোজেশ্বর বাজার (বন্দর), মুন্সিরহাট হয়ে শরীয়তপুর জেলা শহরকে বাঁয়ে রেখে রাজগঞ্জ-আড়িগাঁও বাজার, আংগারিয়া বাজার (বন্দর) দিয়ে দাদপুর হয়ে সোজা পশ্চিম দিকে মাদারীপুরের রাজারচর এলাকায় গিয়ে মিশেছে। প্রমত্তা পদ্মার জল দ্বারা পুষ্ট কীর্তিনাশা শরীয়তপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় শরীয়তপুরের আদি নদী ‘পালং’-এর কিছু অংশ এবং ‘নড়িয়া খাল’কে বুকে ধারণ করে। (মাহমুদ নোমান-সম্পাদিত দেয়াঙ, মাঘ ১৪৩০,

পৃ ১৪০)।