ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম যথাক্রমে এই প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্বের ঐতিহাসিকতা যেমন আছে, বাংলাদেশের বাঙালির আবেগও কিন্তু এই দু-ক্ষেত্রে আছে সমমাত্রায়। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর কয়েক বছর পরেই কাজী নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসেন পূর্ববঙ্গের এই উচ্চশিক্ষাঙ্গনে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাংলাদেশ কাজী নজরুল ইসলামকে নাগরিকত্ব প্রদান করে এবং জাতীয় কবি হিসেবেও মর্যাদা দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলামকে ডি.লিট উপাধি দিয়েও সম্মানিত করে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দুভাবেই এসেছেন নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে দারোগা কাজী রফিজউল্লাহর সঙ্গে ময়মনসিংহের ত্রিশালে আগমনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নজরুলের প্রথম আসার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখানে নজরুল বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এবং সে-বছর আবার চলেও গেছেন, আর ফিরে আসেননি ত্রিশালে। এর ঠিক এক যুগ পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। অবশ্য ঢাকাতেই সেবার তাঁর প্রথম আসা। যদিও ঢাকা ছাড়া অন্য কয়েকটি শহরে এর আগেই নজরুল এসেছিলেন, তবু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল আসেন ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘শ্রমিক প্রজা স্বরাজ দল’ গঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই দলের সাংগঠনিক কাজের জন্য ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসে ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকায় এসে তিনি ছিলেন আদালতপাড়ার বাসিন্দা ও স্বরাজ দলের নেতা বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. মোহিনীমোহন দাশের বাড়িতে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলীয় সহকর্মী হেমন্তকুমার সরকার। নজরুল ঢাকায় এসেছেন – এমন সংবাদ পেয়ে তরুণ আবদুল মজিদ, মোহাম্মদ কাসেম, আবদুল কাদির সাক্ষাৎ করেন তাঁর সঙ্গে এবং ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র বৈঠকে অতিথি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মাত্র ছ-মাস আগেই (১৯ জানুয়ারি, ১৯২৬) ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ গঠিত হয় এবং এরই মধ্যে তিনটি সভাও হয়ে যায়। নজরুলের সঙ্গে কথা বলে ২৭ জুন রোববার সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে (তখনো সলিমুল্লাহ্ নামকরণ হয়নি। এই নামকরণ হয় ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে) বৈঠক আহ্বান করা হয়। এটি সাহিত্য-সমাজের চতুর্থ বৈঠক। হেমন্তকুমার সরকারসহ নজরুল সেই বৈঠকে উপস্থিত হন। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তাঁর প্রথম আগমন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে নজরুলের আগমন সম্পর্কে আবদুল কাদির স্মৃতিচারণ করে লেখেন : নজরুলের সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা মুসলিম হলে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র যে-চতুর্থ বৈঠকের আয়োজন করেন তাতে নজরুল সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বলেছেন – ২২ মে অর্থাৎ প্রায় এক মাস আগে তিনি কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গান গেয়ে। এই গানের পরও কেউ হুঁশিয়ার হচ্ছে না। তাই তিনি আশংকা করছেন, যদি সাম্প্রদায়িক বিভেদ প্রবলতর হতে থাকে তাহলে সমগ্র দেশ ভয়াবহ বিপর্যয় ও ভাঙনের মুখে পড়বে। এরপর তিনি এখানেও ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গান গেয়ে শোনান এবং সঙ্গে ‘আমরা ছাত্রদল’, ‘কৃষাণের গান’ এরকম গণজাগরণমূলক গান গেয়ে মুসলিম ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেন। আবদুল কাদির আরো লিখেছেন – ‘কিন্তু সেদিন নজরুলের মুখে সাম্প্রদায়িক মিলনের বাণী ও জনজাগরণের গান শুনে অনেক মুসলিম তরুণ খুব খুশি হননি, তাঁরা তাঁর কাছে আশা করেছিলেন মুসলিম রিনেসাঁর বাণী।’ এখানে একটি পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ যে-আদর্শ ধারণ করত, নজরুলও সেই আদর্শ ধারণ করেই বক্তব্য ও গান পরিবেশন করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম হলের তরুণ ছাত্রবৃন্দ সেই বাণী গ্রহণ করতে মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন না। নজরুল ও তাঁর সহকর্মীদের আহ্বান যে সফলতা পাইনি, এর ইঙ্গিত এখানে ছিল। শহর-ঢাকা থেকে নজরুল নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যান। তারপর তিনি যান চট্টগ্রামে।
নজরুল ইসলাম ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক কারণে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। অর্থাৎ এটি ঢাকায় তাঁর তৃতীয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে দ্বিতীয় আগমন। নজরুলকে এই সম্মেলনে উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশক হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানালে তিনি উপস্থিত হন। কিন্তু কলকাতা থেকে আসতে লঞ্চ-বিলম্বে তাঁর দেরি হয়ে যায়। প্রথম দিনের অধিবেশন শুরু হয় কাজী আবদুল ওদুদের ‘বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য সমস্যা’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ দিয়ে। প্রবন্ধের দিকে ছাত্রদের মনোযোগ ছিল না। তাই হলে মৃদু গুঞ্জন ওঠে। এরই মধ্যে উপস্থিত হন কাজী নজরুল ইসলাম। তারপর তিনি পরিবেশন করেন ‘খোশ আমদেদ’ গান। উপস্থিত সবাই যেন প্রাণ ফিরে পায়। তিনি ঢাকায় আসার সময় স্টিমারে গানটি লেখেন। তাই গানের নিচে লেখা হয় ‘পদ্মা : ২৭-২-২৭’। এই গানটিই তিনি দিয়ে যান শিখা পত্রিকার জন্য। শিখার প্রথম সংখ্যার (চৈত্র, ১৩৩৩) প্রথম লেখা হিসেবে ছাপা হয় গানটি। কাজী মোতাহার হোসেন এক স্মৃতিচারণায় লেখেন – গোয়ালন্দ থেকে লঞ্চে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে ‘খোশ আমদেদ’ নামের উদ্বোধনী সংগীতটি তিনি রচনা করেন। ছাত্রদের করতালির মধ্যে গানটি আরম্ভ করেন নজরুল। এই সভা পণ্ড করার জন্য ছাত্রদের মধ্যে একটি উপদল ছিল। মোতাহার হোসেন আরো লিখেছেন – এই বিরুদ্ধপক্ষও নজরুলের গানের সুরের মাদকতায় বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের তৎকালীন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক এএফ রহমান আর মূল সভাপতি ছিলেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক খান বাহাদুর তসদ্দুক আহমদ। প্রথম দিন শুরু থেকে না-থাকতে পারলেও শেষ অবধি যেসব প্রবন্ধ ও আলোচনা নজরুল শুনেছিলেন তাতে তিনি আশ্বস্তই হয়েছিলেন। তাই দ্বিতীয় দিনের আলোচনাতে তিনি উল্লেখ করেন যে, গতরাতে তাঁর ভালো ঘুম হয়েছে এবং তিনি তরুণ সমাজ নিয়ে আশাবাদী। ২৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হয় মুসলিম হলে। সেখানে তিনি বলেন : ‘আজ আমি [নজরুল] এই মজলিশে আমার আনন্দবার্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটি কথা – এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, মৌ. আনোয়ারুল কাদীর প্রমুখ কতকগুলি গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।’ এই বক্তৃতার আগে দ্বিতীয় দিনের
অধিবেশন শুরু হয়েছিল নজরুলের গজল পরিবেশনা দিয়ে। গজলের পর তিনি তাঁর নতুন কবিতা ‘খালেদ’ আবৃত্তি করেন। নজরুলের গান ও বক্তৃতা শুনে আনন্দিত হলেও বিরুদ্ধপক্ষ এই বক্তৃতা নিয়ে খানিকটা বিরূপ মন্তব্য পত্রিকায় প্রকাশ করে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত শেখ হাবিবর রহমান-সম্পাদিত বঙ্গনূর পত্রিকার ১০ মার্চ, ১৯২৭ সংখ্যায় নজরুলের এই সভার বিবরণ দিয়ে লেখা হয় : ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল এসলাম সাহেব একটি ক্ষুদ্র বক্তৃতায় অভিযান শুরু হল বলে ঘোষণা করিলেন। পূর্বে নাকি তিনি একাই কাফের আখ্যা পাইয়াছিলেন। এখন হইতে অনেক সঙ্গী পাইলেন ইত্যাদি বীরত্বব্যঞ্জক বাক্য উচ্চারণ করিতেও কবিবর বিরত হয়েন নাই। […] বহুরূপী কবি এতদিন হিন্দুভক্ত ছিলেন। এক সময় ইন্দ্রপতনে সি আর দাশকে হজরত মহম্মদের (দঃ) সহিত তুলনা করিয়াছিলেন। বৎসর কয়েক পূর্বে আমরা মোহাম্মদী কাগজে পড়িয়াছি তিনি নামাজ রোজা ইত্যাদিকে হারাম বলিয়াছিলেন, ও সরস্বতীর পায়ে কোরান শরিফ রাখিতেও কুণ্ঠাবোধ করেন নাই। জানি না ব্যাপার কতদূর সত্য। যাহা হউক গত কাউন্সিল নির্বাচনে ধাক্কা খাইয়া যেন কবিসাহেব অনেকটা প্রকৃতস্থ হইয়াছেন। বোধহয় ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছেন। নজরুল এসলাম সাহেবের বিভিন্নমুখী কবিপ্রতিভাকে আমরা অবনতমস্তকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এতদিন তিনি হিন্দুপ্রেমে মশগুল ছিলেন বলিয়া বিরাট মুসলমান সমাজ তাহাকে appreciate করে নাই। সম্প্রতি তাহার সুর পরিবর্তন হইয়াছে। খালেদ কবিতায় ও ইতোমধ্যে যতগুলি কবিতা তিনি লিখিয়াছেন তাহাতে তৌহিদের ঝংকার দেখিয়া আমরা পুলকিত হইয়াছি। এখন এই বিদ্রোহের ভাবটা গেলেই হয়। কেননা দীন এছলামের বিরুদ্ধে অভিযান শুদ্ধি সংগঠনী দল অনেক পূর্বে আরম্ভ করিয়াছেন। সুতরাং কবিবরের অভিযান না করাই শ্রেয়।’ নজরুল দ্বিতীয়বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় আসার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। এই পরিচয় পরে খুবই ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। পরে নজরুল মোতাহার হোসেনকে সম্বোধন করেন প্রিয় বন্ধু ‘মোতিহার’ নামেও। সম্মেলনে এসে নজরুল একদিন মুসলিম হলে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে ও একদিন হলের অপর আবাসিক শিক্ষক আবুল হুসেনের বাসায় অবস্থান করেন। তিনি কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন ১ মার্চ। এরই মধ্যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সংবর্ধিত হন। হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের আহ্বানে একটি ঘরোয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুল অংশ নেন। কাজী মোতাহার হোসেন জানান – সেই অনুষ্ঠান তাৎক্ষণিক, ঘরোয়া কিন্তু আন্তরিকতাপূর্ণ। কবি সেখানে ‘কে বিদেশি মন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’র মতো একাধিক গান গেয়ে চলেন।
কাজী নজরুল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে তৃতীয়বারের মতো আগমন ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে; তারিখটি সম্ভবত ফেব্রুয়ারির ১ থেকে ৭-এর মধ্যে। আগমনের উদ্দেশ্য : ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেওয়া। এই আগমনটি নানা কারণে নজরুলজীবনেও উল্লেখযোগ্য। মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত এই বার্ষিক সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদ হাসান আর সভাপতি ছিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সম্পাদক আবদুর রহমান খাঁ। এই সম্মেলনে অংশ নিতে এসে নজরুল প্রথমে উঠেছিলেন আবুল হুসেনের বাড়িতে এবং সেখানেই তিনি সম্মেলনের জন্য ‘নতুনের গান’ (চল্ চল্ চল্) লেখেন। পরে এটি তিনি পরিবেশন করেছিলেন এবং শিখায় প্রকাশের জন্য দিয়ে যান। শিখার দ্বিতীয় সংখ্যায় (আশ্বিন, ১৩৩৫) যথারীতি এটি প্রকাশ পায়। এ-সময় ঢাকায় নজরুল ছিলেন প্রায় তিন সপ্তাহ। ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতার উদ্দেশে স্টিমারে ওঠেন। সম্মেলন শেষ হয়ে গেলে নজরুলের ঢাকাবাস ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের তরুণ শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউজের (এই ভবনটি ইংরেজ আমলে বর্ধমানের রাজাদের তৈরি। পরে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তার বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখন বাংলা একাডেমির একটি ভবন হিসেবে গণ্য) আবাসিক কক্ষে। এই ভবনটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনাভুক্তই বলা চলে। সাহিত্য-সমাজের অধিবেশনে ‘নারীজীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ’ শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী, গণিত বিভাগের বেগম ফজিলাতুন্নেসা। নজরুল সেদিনও সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেনের ছাত্রী ও আত্মীয়তার সূত্রে নজরুলের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেসা ও তাঁর বোন সফিকুন্নেসার পরিচয় হয়। তাঁরা তখন পুরান ঢাকার দেওয়ান বাজারে একটি ভাড়াবাসায় থাকতেন। এই সফরেই নজরুল অন্তত তিনদিন গেছেন সেই ভাড়াবাসায় এবং ফজিলাতুন্নেসার ‘হাত দেখা’র কাজও করেছেন। নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। পরে এই অনুরক্তির কথা মোতাহার হোসেনের প্রতি লেখা একাধিক চিঠিতে নজরুল প্রকাশ করেছেন; ফজিলাতুন্নেসাকে কলকাতা থেকে নজরুল নিজের সবগুলো বই এক কপি করে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন; ফজিলাতুন্নেসাকে পত্র দিয়েছেন; তাঁকে নিজের কাব্যসংগ্রহ সঞ্চিতা উৎসর্গ করার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছেন। ফজিলাতুন্নেসা অবশ্য নজরুলের এই অনুরক্তিকে প্রশ্রয় দেননি। প্রশ্রয় না দেওয়ারই কথা। প্রথমত নজরুল ছিলেন বিবাহিত ও একাধিক সন্তানের জনক; দ্বিতীয়ত ফজিলাতুন্নেসা ছিলেন মেধাবী ও কুমারী। গণিতে নারীদের পঠনপাঠনের আগ্রহ কম বলে যেখানে শোনা যায়, সেখানে তিনি নিয়েছিলেন গণিত বিষয় এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন। পরে তো তিনি উচ্চশিক্ষার্থে বিলেতেও যান। স্টেট স্কলারশিপ পেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে ইংল্যান্ড গমনের আগে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে কলকাতার সওগাত কার্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নজরুল সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এবং ‘জাগিলে পারুল কি গো সাত ভাই চম্পা ডাকে’ গানটি পরিবেশন করেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরিরত ছিলেন ফজিলাতুন্নেসা।
চতুর্থবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় কাজী নজরুল ইসলামের আগমন হঠাৎ আলোর মতো। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের (১৯২৮) আষাঢ় মাসে কলকাতায় এক উত্তেজনাকর ফুটবল খেলায় মোহনবাগান জয়ী হয়। সাহেবি-দলকে স্বদেশি দলটি ৬ গোল দিয়ে আলোড়ন তোলে। এই জয়ের নায়ক-খেলোয়াড় ছিলেন ঢাকাবাসী রবি বোস। তাই মহা-আনন্দ প্রকাশ করার জন্য ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশরঞ্জন দাশসহ কয়েকজন যেন খেলার মাঠ থেকেই শিয়ালদহ স্টেশনের ট্রেনে চেপে সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। নজরুল ওঠেন কাজী মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউজের আবাসিক কক্ষে। বুদ্ধদেব বসু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র এবং জগন্নাথ হলের সাহিত্য সম্পাদকও। এই সুবাদে নজরুলের সম্মানার্থে জগন্নাথ হলে তিনি একটি সভার আয়োজন করেন। এক স্মৃতিচারণায় তিনি লিখেছেন – নজরুলকে তিনি সেবারই প্রথম দেখেন এবং তাঁর শারীরিক সৌন্দর্য দেখে ‘প্রেমে’ পড়ে যান যেন! নজরুল সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘সব-মিলিয়ে মনোলুণ্ঠনকারী একটি মানুষ।’ জগন্নাথ হলে তিনি নজরুলের সম্মানার্থে একটি সভার আহ্বান করেছিলেন এবং তাতে ভিড় জমেছিল প্রচুর। ইডেন কলেজ থেকেও অধ্যাপিকাগণ যোগ দিয়েছিলেন। নজরুল পরিবেশন করেন কবিতা আবৃত্তি আর গান। সবাই তাঁর কাব্যশক্তি উপলব্ধি করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আরো লিখেছেন – ‘মৃত অথবা বৃদ্ধ অথবা প্রাতিষ্ঠানীভূত না হওয়া পর্যন্ত কবিদের বিষয়ে যারা স্বাস্থ্যকরভাবে সন্দিগ্ধ, সেসব প্রাজ্ঞদের মানতে হয়েছিল যে, লোকটার [নজরুলের] মধ্যে কিছু আছে।’ সেবার বেশ কিছুদিন ঢাকায় ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ছাড়াও ঢাকার সাহিত্য-পরিমণ্ডলে একাধিক বৈঠক করেছেন নজরুল।
১৯২৮-এর বারো বছর পরে, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর কাজী নজরুল ইসলাম আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসেন। এবার মূল আমন্ত্রণ ছিল ঢাকা বেতার কেন্দ্রের। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’ নামে ঢাকায় বেতার কেন্দ্রের সূচনা হয়। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের একটি বাড়িতে ছিল এর কার্যালয়। এর বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪০) ছিল নজরুলের আমন্ত্রণ। এই আমন্ত্রণ অনুসারে বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের লেখা সংগীতবিচিত্রা পূবালী প্রচার করা হয়। এতে ‘পদ্মার ঢেউ রে’, ‘আমি পূরব দেশের পুরনারী’ ইত্যাদি গান অন্তর্ভুক্ত ছিল। সংগীতে অংশগ্রহণ করেন চিত্ত রায় ও শৈল দেবী; আর বর্ণনা-উপস্থাপনায় ছিলেন রণেন কুশারী। নজরুল বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলেও নানা আয়োজনে যোগ দেন। আবদুল কাদিরের স্মৃতি থেকে জানা যায় – একদিন সকাল ১০টায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠান করে কোনো বিরতি ছাড়াই সরাসরি ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠান করে দুপুর ৩টা বাজিয়ে দেন নজরুল। অধ্যক্ষ তফাজ্জল হোসেন তাঁর স্মৃতিকণা : কবি নজরুল-এ লেখেন : ‘আমাদের ছাত্রাবস্থায় নজরুল একবার রেডিওতে গান দেবার জন্য ঢাকায় আসেন। ঢাকায় কবি-সাহিত্যিক, সাহিত্যমোদী ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। নজরুলকে এখানে সেখানে নেবার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আমরা সলিমুল্লাহ হলের ছেলেরা আমাদের হলে আসার জন্য কবির সানুগ্রহ স্বীকৃতি লাভ করে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে দিলাম। কবিকে এনে হলের মঞ্চে তুলে অপূর্ব আত্মতৃপ্তি লাভ করতে লাগলাম। কবি প্রথমে ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই কেন মনে রাখ তারে’ – এ গানটি গেয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন। সলিমুল্লাহ হলের মিলনায়তনে তিল ধারণ করবার জায়গা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অধ্যাপকগণ ও কবি জসীমউদ্দীনসহ [জসীমউদ্দীন] বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি আহূত হয়ে এসেছিলেন। গানের পর কবি বক্তৃতা আরম্ভ করলেন। বক্তৃতা তো নয়, সে এক মধুর আলাপ। প্রথমেই তাঁর বন্ধু কবি জসীমউদ্দীনকে নিয়ে হাস্য-রসিকতা আরম্ভ করলেন। বললেন – ‘জসীম, তোমার মধ্যে নবুয়ত নাজিল হতে পারে। দুনিয়াতে ন্যায়প্রতিষ্ঠা করার জন্য আর দুষ্কৃতামকে বিনাশ করার জন্য হাতে শান দাও। আমাদের সবারই হাতে মরচে ধরে গেছে। হাতে শান দাও। দুনিয়ায় অন্যায় ভীরুর দল তাতেই ভয় পেয়ে পালাবে। ভদ্র মহোদয়গণ, আমার বক্তৃতার সারকথা হচ্ছে হাতে শান দেওয়া। এ শুনতে আপনাদের যদি ধৈর্য থাকে, তবে বসুন।’ তারপর কবি তাঁর অনন্যসাধারণ বাক্‌শক্তির সাহায্যে এবং ইসলাম, খ্রিষ্টান ও হিন্দুধর্মের গ্রন্থাদি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করে সভাস্থ সবাইকে বিমুগ্ধ করেন। কোরানের ন্যায় বাইবেল ও গীতাও নজরুল গভীরভাবে পাঠ করেছিলেন। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন মুসলিম হলের মিলনায়তনে (কক্ষটি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অন্তর্ভুক্ত) নজরুলের বক্তৃতা।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুলের আগমনের এই স্মৃতি জসীমউদ্দীনও তাঁর ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায় গ্রন্থের শেষ অংশে উল্লেখ করেছেন। তফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের বর্ণনার খানিকটা পার্থক্য আছে, বিশেষ করে, জসীমউদ্দীনকে নজরুল কী বলেছিলেন – এই জায়গায়। একটু দীর্ঘ হলেও জসীমউদ্দীনের স্মৃতিচারণা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন : ‘কবিকে আমি [জসীমউদ্দীন] শেষবার সুস্থ অবস্থায় দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনিলাম মুসলিম হলে কবি আসিবেন ভোর আটটায়। কিন্তু কবি আসিলেন বেলা দশটায়। সময়-অনুবর্তিতার জ্ঞান কবির কোনোদিনই ছিল না। নোঙরহীন নৌকার মত তিনি ভাসিয়া বেড়াইতেন। সেই নৌকায় যে-কেহ আসিয়া হাল ঘুরাইয়া কবির গতি নিয়ন্ত্রিত করিতে পারিত। এক জায়গায় যাইবার জন্য তিনি যাত্রা করিলেন, তাঁহার গুণগ্রাহীরা তাঁহাকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী অন্য স্থানে লইয়া গেলেন। এজন্য কবিকেই আমরা দায়ী করিয়া থাকি। যবনিকার অন্তরালে থাকিয়া যাঁহারা কবিকে নিয়ন্ত্রিত করিতেন, তাঁহারা কোনোদিনই দায়ী হইতেন না। শিশুর মতো আপন-ভোলা কবিকে সেজন্য কত লোকের বিরাগভাজন হইতে হইয়াছে! আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়] অধ্যাপক রূপে দেখিয়া কবি কত সুখী হইলেন। তিনি আমার কানে কানে বলিলেন, ‘মায়েরা ছেলেদের প্রতি যে স্নেহ-মমতা ধারণ করে, তোমার চোখে-মুখে সমস্ত অবয়বে সেই স্নেহ-মমতার ছাপ দেখতে পেলাম।’ কবি আসিয়াই তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ রূপে ছেলেদের সামনে কবিতা-গান আবৃত্তি করিতে লাগিলেন। আমার ক্লাস ছিল, ঘণ্টাখানেক থাকিয়া চলিয়া গেলাম। দুপুরবেলা ক্লাস করিতেছি, দেখিলাম ক্লাসে ছাত্রের সংখ্যা খুবই কম। মেয়েরা সবাই অনুপস্থিত। কারণ অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম, ফজলুল হক হলে নজরুল আসিয়াছেন। সবাই তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে গিয়াছে। বেলা তিনটার সময় ফজলুল হক হলে গিয়া দেখি, ছেলেমেয়েদের চাহিদা অনুসারে কবি গানের পর গান গাহিয়া চলিয়াছেন, কবিতার পর কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিয়াছেন। কবির মুখ শুষ্ক; সমস্ত অঙ্গ ক্লান্তিতে ভরা। খোঁজ লইয়া জানিলাম – সেই যে সকাল দশটায় কবি আসিয়াছেন, বারোটা পর্যন্ত মুসলিম হলে থাকিয়া তারপর ফজলুল হক হলে আগমন করিয়াছেন – ইহার মধ্যে কয়েক পেয়ালা চা আর পান ছাড়া কিছুই কবিকে খাইতে দেওয়া হয় নাই। আমার তখন কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এই অবুঝ-বয়স্ক শিশুটিকে লইয়া ছেলেরা কী নিষ্ঠুর খেলাই না খেলিতেছে! কিন্তু অবেলায় কোথাও কিছু খাবার পাইবার উপায় ছিল না। আমি একরকম জোর করিয়াই সভা ভাঙিয়া দিলাম। খাওয়ার ব্যাপারটা আমি যে এত বড় করিয়া ধরিয়াছি, এজন্য কবি খুব খুশী হইলেন না। দোকান হইতে সামান্য কিছু খাবার আনাইয়া বহু সাধ্যসাধনায় কবিকে খাওয়ান গেল। সেবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা করিবার সময় আমি কবির বাক্যের ভিতরে কতকটা প্রলাপ-উক্তির আভাস পাইয়াছিলাম। এক জায়গায় কবি বলিয়া ফেলিলেন, ‘আমি আল্লাকে দেখেছি। কিন্তু সেসব কথা বলবার সময় এখনও আসে নাই। সে সব বলবার অনুমতি যেদিন পাব, সে দিন আবার আমাদের সামনে আসবে।’ ইহার কিছুদিন পরেই শুনিলাম, কবি পাগল হইয়া গিয়াছেন।’ তফাজ্জল হোসেন ও জসীমউদ্দীনের স্মৃতিচারণ পাঠ করে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুলের আগমন ও কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের একটি চিত্র পাওয়া যায়। ১৯৪০-এর ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা বেতারে ‘হারামণি’ অনুষ্ঠানে নজরুলের অংশগ্রহণ করার প্রমাণ মেলে। অতএব, এর আগেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। মোটকথা, এক সপ্তাহের কম স্থায়ী ছিল নজরুলের ঢাকায় অবস্থান, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর আগমন ঘটেছিল। কিন্তু অবাক হওয়ার মতো তথ্য, জীবিতাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুলের আর আসা হয়নি। জীবনের একেবারে শেষদিকে নজরুলকে যে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়েছিল, সেটাও তাঁর হাতে সমর্পণ করা হয় বঙ্গভবন থেকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা থেকে নয়।
আরো একটি বেদনার কথা, কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সুস্থ অবস্থায় কখনোই কোনো সম্মান বা সংবর্ধনা জানানো হয়নি। স্থান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ব্যবহার হয়েছে সত্যি, কিন্তু অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল অন্যসব প্রতিষ্ঠান। হ্যাঁ, এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা শিক্ষকদের অংশগ্রহণও ছিল, তবে তার একটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান ছিল না। এই অনুশোচনা খানিকটা লাঘব করে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের (১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) ‘মুসলিম হল বার্ষিকীর দশম বর্ষ-সংখ্যা দেখবার সুযোগ আমি পেয়েছি। সেখানে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথসহ মোট চোদ্দোজনের নাম ছাত্রসংসদের ‘আজীবন সদস্য’ হিসেবে মুদ্রিত। আর নজরুলের নামের আগে লেখা হয়েছে ‘বিদ্রোহী কবি’ বিশেষণ। বার্ষিকীর ক্রম রক্ষা করে তালিকাটি এখানে তুলে ধরা হলো :
সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ
আজীবন সদস্য
লর্ড লিটন
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্যার আবদুর রহিম
স্যার পি. জে. হার্টগ
স্যার মোঃ সোলায়মান
স্যার পি. সি. রায়
স্যার সুলতান আহমদ
স্যার রাধা কৃষ্ণণ
স্যার আকবর হায়দরী
স্যার সিরিল নরউড
স্যার জন সার্জেন্ট
জনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকী
ওস্তাদ ডঃ আলাউদ্দিন খান
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম
মুসলিম হল কর্তৃক নজরুলকে ‘আজীবন সদস্য’ পদে বরণ এবং বার্ষিকীতে তা প্রকাশ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কবে নজরুলকে ছাত্র সংসদের ‘আজীবন সদস্য’ হিসেবে বরণ করা হলো তার উল্লেখ বার্ষিকীতে নেই। নজরুলের জীবনীকার বা তারিখ অভিধানকারগণও তথ্যটি উল্লেখ করেননি। তবে সেটা ১৯৪০-এ তাঁর সুস্থাবস্থায় শেষ আগমনের আগেই। কারণ, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের বার্ষিকীতে তালিকাটি ছাপা হয়েছে। আড়ম্বর-আয়োজনে এটি করা হয়ে থাকলে কোথাও না কোথাও সংবাদ মুদ্রিত হতো।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলামকে স্বাধীন বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি’র মর্যাদায় আনা হয়। এরপর বাংলা একাডেমি, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জসহ প্রায় ২০টি অনুষ্ঠানে নজরুলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর একটিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নয়। অবশ্য এ-সময় তিনি বাকহারা। তবু তাঁর শরীর-প্রতিমাকে প্রত্যক্ষ করার জন্য উল্লিখিত স্থানগুলোতে জনসমাগমের অভাব হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনের আয়োজন হয়। এটি স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন। এর আগের সমাবর্তন ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা করা হয় ১৯৭৪-এর ছাত্রশিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে। অবশ্য, একই সমাবর্তনে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (মরণোত্তর), অধ্যাপক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (মরণোত্তর), ওস্তাদ আলী আকবর খান, হীরেন্দ্রলাল দে, মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজলকেও সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুলের সশরীরে উপস্থিত হওয়া সম্ভবপর হয়নি। তাই নজরুলকে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি মাহমুদ উল্লাহ বঙ্গভবনে আয়োজিত বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠানে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেন। এই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী নজরুলের উদ্দেশে যে-মানপত্র পাঠ করেন, তাতে তিনি বলেন : ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আপনিই একমাত্র কবি-প্রতিভা যিনি ঐতিহ্য সন্ধানে এবং নির্মাণে ছিলেন স্বচ্ছন্দ, নির্দ্বন্দ্ব। হিন্দু ও মুসলমান, জাতিক ও আন্তর্জাতিক উভয় ঐতিহ্যকেই আপনি আপনার স্বায়ত্তশাসিত চেতনার শব্দরূপে ব্যবহার করেছেন। আপনার জীবনসম্পৃক্ত ঐতিহ্যবোধ, ধর্ম-কথার সীমাবদ্ধতা থেকে ঐতিহ্যকে মুক্তি দিয়েছেন। আপনি বাঙালি ঐতিহ্যের পুনঃনির্মাতা, নব-ভাষ্যকার। […] সংগীতজগতে আপনার অবদান অতুলনীয়, বিচিত্রধর্মী এবং স্বতন্ত্র। আপনার দেশাত্মবোধক সংগীত সর্বকালের বাঙালিকে করবে উদ্দীপিত, উদ্বোধিত। আপনি কেবল বিপুলসংখ্যক গানের রচয়িতাই নন, সুরের সৃজনীশক্তিতে আপনি সংগীত-জগতের নতুন পথনির্দেশক। আজও আপনি বাংলাদেশের বিচিত্রমুখী সংগীতের অনতিক্রমণীয় নিরীক্ষাধর্মী সার্থক সুরকার। […] আজ আপনাকে সম্মান জানাবার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি।’ এই আয়োজনের কয়েকদিন পর নজরুলের শারীরিক অবস্থার ধীরে ধীরে অবনতি হলে তাঁকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট (১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র) কাজী নজরুল ইসলাম মৃত্যুবরণ করেন। সে-সময় তাঁর শয্যাপাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলামসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। নজরুলের মরদেহ প্রথমে আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনের মাঠে। পরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে নজরুলকে সমাহিত করা হয়। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মিশে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় নজরুল-স্মরণে সর্বদলীয় নাগরিক শোকসভা। প্রতি বছর নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু দিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হাজার মানুষের আগমন ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ওই দুটো দিন ছাড়াও আগ্রহীরা নজরুলের সমাধি পরিদর্শনের জন্য অন্য দিনগুলোতেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন করেন। ‘নজরুল সমাধিসৌধ’ হিসেবে যে-স্থানটুকু চিহ্নিত তা বৃক্ষ ও পুষ্পপত্রে সুশোভিত থাকে প্রতিদিন।