দাদা-দাদি

তৎকালীন যুগে আমরা সবাই ছিলাম গ্রামের ছেলে। আর জন্ম নিই মামার বাড়িতে। কারণ মায়ের বাবার বাড়িতে মায়ের যত্নটা ভালো হয়। অবশ্য এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। তবে এটাই ছিল বিংশ শতাব্দী ও তার আগের সময়ের ধারা। আজ অবশ্য গ্রামেও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে।

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কথা। এই মহান শিল্পী গ্রামীণ সংস্কৃতিকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। তাঁর হাতে তৈরি বাংলাদেশে চারুকলা স্কুল আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি অনুষদের একটি। আটটি বিভাগ নিয়ে এই চারুকলা অনুষদ।

জীবনবাদী শিল্পী হিসেবে তিনি লোকজ-দেশজ ও বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির মানুষ; কিন্তু এগিয়ে থাকা ইউরোপীয় ধারার শিল্পধারা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলেও দেশজ ভাবের প্রতি সবসময় তাঁর একটা পক্ষপাতিত্ব ছিল। অবশ্য ষাটের দশকে তাঁর ছাত্রদের বিদেশ থেকে আনা তৎকালীন ইউরো-মার্কিন ধারার কাজকেও তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। আর যারা পুরো বিমূর্তধারার কাজ করতে চাইত, তাদের তিনি উপদেশ দিতেন এই বলে : অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ করতে চাও, যাও কিবরিয়ার কাজ দেখো গে!

ষাটের দশকের প্রথম দিকে মোহাম্মদ কিবরিয়া জাপান থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করে আসেন। আর পরিপূর্ণ বিমূর্ত-প্রকাশবাদী চিত্র উপহার দিতে থাকেন। অল্প সময়ে তিনি বিদ্যাদ্ধ মহলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময় শিল্পী আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুল বাসেত প্রমুখ নতুন ধারা নিয়ে আসেন এবং নানান ধারার কাজ উপহার দিতে থাকেন। এভাবেই আমাদের দেশে শিল্পধারা নতুন একটা বাঁক নেয়। বিশ্বের সমকালীন ধারার সঙ্গে এক সূত্রে গ্রথিত হতে থাকে।

যারা এঁদের অনুকরণ করতে চাইত, তাঁদের তিনি রসিকতা করে বলতেন : ও তোমার জন্ম তো আবার হয়েছে হসপিটালে। অর্থাৎ পুরো জন্মধারার প্রক্রিয়া থেকে পৃথক হয়ে যাওয়া। ধাত্রীমার জায়গায় নার্স। মামাবাড়ির খুপরির বদলে হাসপাতাল। যাক, এবার আসি নিজের কথায়। মামাবাড়িতে জন্মেছি। কিন্তু আমি আমার পিতৃগৃহের সম্পত্তি। প্রতিটি মানুষ এভাবে দুটি পরিবার বা গণসমাজের সদস্য।

মামাবাড়ির কথা অনেক বলা হয়েছে। এবার বাবা বা দাদাবাড়ির কথা।

সত্যি বলতে কী আমার দাদা বা ঠাকুরদা শেখ মহম্মদ এহিয়া ছিলেন অতিদরিদ্র একজন মানুষ। আমি যখন বুঝতে শিখেছি, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। একহারা চেহারা। নাতি উচ্চতা। দেহবর্ণ ফর্সা ছিল, অভাবের কারণে দেহাবয়ব তামাটে। সুচালো মুখ। আরো সুচালো কাঁচাপাকা চুরুক দাড়ি। মুখে সংসারের অতৃপ্তির ছাপ। গম্ভীর। বয়স না হতেই কিছুটা বেঁকে গেছেন। কোনোমতেই সুদর্শন বলা যাবে না।

লেখাপড়া ছিল বলে শুনিনি। আমার দাদা সম্বন্ধে  যে-চিত্রটি প্রথম মনে পড়েছে, তা হলো, চটের থলি হাতে একজন প্রৌঢ় বেরিয়ে যাচ্ছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে। তখন তিনি সূত্রধর বা ছুতোরমিস্ত্রির কাজ করতেন।

শুনেছি প্রথম জীবনে তিনি ব্যবসা করে কিছু সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন একটি কাঠের গোলা। বেশ লাভও হতো। এই লাভই তাঁকে ধ্বংস করে দিলো।  আত্মীয়স্বজনের চোখ টাটাতে লাগল। তারা যৌথভাবে কৌশলে একসঙ্গে সবাই কাঠের অর্ডার দিয়ে দাদাকে সাপ্লাই দিতে না পারার অভিযোগে মামলা পর্যন্ত ঠুকে দেয়। এইসব প্যাঁচ সামাল দিতে না পেরে গোলা বন্ধ করে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান এবং তাঁর ক্যারিয়ার বলতে যা বোঝায় তার ইতি ঘটে। তিনি বিবাগী হয়ে যান। কখনো কখনো ছ-মাস পর্যন্ত ঘরে ফিরতেন না। এই সময় দাদি গ্রামের মহিলাদের রুপোর অলংকারের নষ্ট হয়ে যাওয়া সুতোর বন্ধনী নতুন করে বেঁধে দু-চার পয়সা রোজগার করতেন। আর বাবা তখনকার শেখ আজিজুর রহমান যিনি কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তিনি সকাল-বিকেল দুটো টিউশনি করে মা’র হাতে কিছু টাকা পাঠাতেন। সঠিক চিত্র এখন আর কারো কাছ থেকে জানা যাবে না। ওই প্রজন্মের এখন একজনও বেঁচে নেই। এই সময়কার মূল্যায়ন আমার পরবর্তী জীবনের পরিসংখ্যান, অর্থনীতি ও সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানকে ভিত্তি করে অনুমান করি। তাছাড়া কোনো উপায়ও নেই।

আমার দাদা ছিলেন সেজো। মেজোদাদা শেখ মোহাম্মদ ওসমান অল্প বয়সে মারা যান। ফলে আমার দাদা শেখ মোহাম্মদ এহিয়া সেজো হয়েও মেজদাদায় উন্নীত হন। যদিও তাঁকে সেজোচাচা বলতেই শুনেছি অন্য চাচা ও ফুপুদের মুখে। বড়দাদা শেখ ইরশাদ আলী কলকাতায় একটা ছোটখাটো লন্ড্রি চালাতেন। কলকাতার এই লন্ড্রি-ব্যবস্থা এখনো আছে। সাধারণত একজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে জামা-কাপড় সংগ্রহ করে আনত। তারপর এইসব কাপড় ধোপা নিয়ে বাড়ি থেকে ধুয়ে এনে দিলে লন্ড্রিতে ইস্ত্রি করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়। খুবই সামান্য পুঁজি – সামান্য মার্জিনের ব্যবসা। বাবা কলকাতায় এই বড়দাদার সঙ্গে থাকতেন। কাপড় নেওয়ার জায়গা আর পেছনে একটা কামরা এই তাঁদের বাসস্থান। বাবাকে বড়দাদা দিনে এক পয়সা দিতেন হাতখরচা হিসেবে।

পরবর্তীকালে বাবা আমাদের তাঁর জীবনের কাহিনি বলতেন – আর মুখজোড়া হাসি। বলতেন : জানো, এই এক পয়সার অর্ধেক দিয়ে মানে আধ পয়সা দিয়ে ছোলাভাজা কিনতাম – আর আধ পয়সার মুড়ি। তারপর কলকাতা করপোরেশনের বিনা পয়সার পানি … পেটপুরে খেতাম। সারাদিন আর ক্ষিদে লাগত না।

বড়দাদার প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন তাঁর কথা কিছু বলি। মানুষটি কৃষ্ণকায়। একহারা। উচ্চতা আমার দাদার চেয়ে আর
দু-ইঞ্চিখানেক বেশি। আমি যখন দেখছি, সামান্য বেঁকে গেছেন। মুখে শুভ্র দাড়ি। মাথার চুলও তেমনি। তবে ভালো দিক যে, আমাদের পিতৃধারায় টাকের রাজত্ব ছিল না, যেটা ছিল মাতৃকুলে, মানে নানাদের বংশে। প্রায় সবাই ছিল টেকো। একেবারে ফুল বল্ড। তার ধারা আমরা নাতিরাও বহন করছি, কিছু মাত্রায়। আমরা পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনজন টাকশোভিত।

বড়দাদার মুখে অদ্ভুত এক মায়ার জ্যোতি চোখে পড়ত। দুপুরবেলা আমরা কাজীদের দিঘিতে দলবেঁধে স্নানে যেতাম। তিনি আমাদের তিন ভাইকে – তখন সামান্য বড় হয়েছি –  চতুর্থজন খুবই ছোট – যত্ন করে নাকে, কানে আর নাভিতে সর্ষের তেলের ফোঁটা আঙুলের মাথায় নিয়ে ঘষে দিতেন। একটা ঝাঁজ পেতাম। সর্ষের তেলের।

দিঘির ঘাট বেশ বড়। অনেক লোক আসত। ঘাটের সিঁড়ির পর কাদা না থাকায় ঘোলাটে হতো না। বালির মধ্যে দু-একটা পাথরের কণা পেতাম। বেশ চকলেট রঙের। এগুলো সংগ্রহ করে মাকে দেখাতাম। মা হাসিমুখে নিয়ে রেখে দিতেন। সাত রাজার ধন যেন। এগুলো কোথাও মা জমিয়ে রাখতেন কি না মনে পড়ছে না।

বড়দাদা যখন মাকে কোনো কাজে ডাকতেন বা সামনে আসতেন – তার ডাকটার মধ্যে অদ্ভুত এক মায়া মাখানো থাকতো, আমার কানে এখনো সেই ধ্বনি শুনতে পাই। বাড়িতে একজনই বউ, আর দাদির পর তিনিই কর্ত্রী, তাই বেশ পাকা একটা অবস্থান।

দাদার ডাক, বউমা …

জি, চাচা …

মায়ের কণ্ঠেও তেমনি মায়া থাকত। এমন সুর আমি কারো ক্ষেত্রে শুনিনি।

বড়দাদার একটিই মাত্র ছেলে ছিল। ঠিক বাবার বয়সী। দু-ভাই ছিল গলায় গলায় ভাব। আমার সেই চাচা ২৪ বছর বয়সে যক্ষ্মায় মারা যান। তখন যক্ষ্মার ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। আজকের ক্যান্সারের মতো তখন যক্ষ্মা ছিল মারণব্যাধি। লাঙসে হলে কাশতে কাশতে মুখ দিয়ে রক্ত উঠত। পরিবারের থেকে  রোগীকে আলাদা করে রাখা হতো। কেউ সামনেও যেত না। শুধু  সেবাদানকারী ছাড়া। তা-ও অনেক সতর্কতা নিতে হতো। এই চাচা মারা যাওয়ায় বাবা খুব একা হয়ে পড়েছিলেন। কারণ তারপর দাদা-দাদির একেবারে শেষ সন্তান হলো ছোট চাচা শেখ গোলাম জিলানী। আমার চেয়ে তিন-চার বছরের বড় ছিল। তাই বাবার একটিই ছোট ভাই। আর হাঁটুর সমান। জিলানী চাচা ছিলেন দাদির মতো কালো।

আর দাদার মতো নাতি উচ্চতার। কিন্তু মুখশ্রী ছিল সার্প। সুন্দর বলতে হবে।

বড়দাদিও গত হয়ে গেছেন অনেকদিন হলো। দাদির ইতিহাস পৌত্র হিসেবে নেওয়া জরুরি। দেশভাগের কারণে এসব পারিবারিক ইতিহাস সংগৃহীত হয়নি। আমার এই কিস্তি লেখার পর তখন তথ্য জোগাড় হবে। আশা করি পুস্তক প্রকাশের পূর্বে সেসব তথ্য সংগ্রহ করতে পারব। এখন আমি নিরুপায়। দাদির নামটাও জানা হয়নি। জীবন বড় কঠিন ঠাঁই। বেচারা সালমান রুশদি আমার চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট – মিড নাইট চিলড্রেন লিখে বিখ্যাত হয়েছে। স্যাটানিক ভার্সেস লিখে বিতর্কিত হয়। আমি তার কষ্টটা অনুভব করতে পারি। ছোট হলেও তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। সে তার জীবনীতে
ভারত-বিভাগের যন্ত্রণা তুলে ধরেছে – গোটা বিশ্বের কাছে। আমারও ইচ্ছা আছে একটা বড় উপন্যাস লেখার। কিন্তু জীবন প্রদীপ নিভু নিভু … হয়তো সময় মিলবে না। যদি মেলে শুরু করে দেব, অসমাপ্ত হলে তেমনি থাকবে। আমার উত্তর- পুরুষ কেউ সমাপন করবে। যেমন আমার বাবা সাহিত্যিক শওকত ওসমান, যাঁর পিতৃদত্ত নাম শেখ আজিজুর রহমান, তিনি ছদ্মনাম নিয়ে যে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন ৭৫ বছর বয়সে – তাঁর মৃত্যুর (১৯৯৮ সালের ১৪ই মে) যাঁর বই হলো ৮০০ পৃষ্ঠার ওপরে – শিরোনাম তিনি দিয়ে গেছেন – ‘রাহনামা’। বোঝাই যাচ্ছে ঐতিহ্যধারায় স্নাত। শাহনামা থেকে রাহনামা। যথেষ্ট অর্থবহ। রাস্তায় পথ চলতে যা উপলব্ধি ও ঘটনা তার বিস্তার। ধ্রুপদী সংগীতের মতো। তান খেলাতে এত মত্ত ছিলেন যে মাত্র কলকাতা পর্ব পাওয়া যায়। তা-ও খণ্ডিত। কলকাতা অন্তত আরো ৪০০ পৃষ্ঠা জুড়ত। বই হলো দু-খণ্ডে ৪০০-৪০০ করে মোট ৮০০ পৃষ্ঠা। কিন্তু তার কর্মজীবনের ১২ আনা পড়ে রইল, যা তিনি কাটিয়ে ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে। ভারতীয় উপমহাদেশের এই বিভক্তির ইতিহাস ও এর প্রভাব তাঁর লেখায় পুরোটা ইতিহাসে পেতাম। আলাদা করে কোনো ঐতিহাসিকের দ্বারস্থ হতে হতো না। কিন্তু তাঁকে সে-সুযোগ দেয়নি। মনে পড়ে সারা বিশ্বে সমাদৃত রুশ একটি গানের কথা : ওয়ানতসা মেরা নাদিরা ওয়ানতোনা সেরা … অর্থাৎ হে পৃথিবী, নিষ্ঠুর এ-পৃথিবী … মেরা মানে জগৎ। যেমন কার্টো মেরা – অর্থাৎ পৃথিবীর মানচিত্র।

এবার নিজের মানচিত্রে ফেরত আসি। বড়দাদা একা হয়ে যাওয়ার পর সব সম্পত্তি তাঁর এই আজিজুর রহমান বা প্রিয় ভাইপোকে দান করেন। তাঁর দানে পাওয়া দোতলা মাটির  বাড়িতে আমরা ধনীর মতো বসবাস করতাম।

কাজী নজরুল ইসলাম তো তেতলার বাসিন্দাদের প্রতি রুষ্ট ছিলেন : তুমি রবে তেতলার পরে, সে-ভাবনা আজ মিছে। আজ আমি যে লেখনী চালাচ্ছি তা বিশতলা ভবনের দশতলার ফ্ল্যাটে বসে। আশা করি কাজী সাহেব মার্জনা করবেন।

সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার – মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যানিরোধক বার ভেঙে দামোদর ছুটে আসে। আর যে-সব ভিটেয় কোনোদিন জল ওঠেনি সেখানে প্রায় এক কোমর জল। আর তা-ও সরার নাম নেই।

আবার কাজী সাহেবের শরণাপন্ন হতে হয় – এতো জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলি বল কে … বানের জল একদিন দুদিন করে পুরো একমাস ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। ষোলোদিন পর্যন্ত আমাদের মৃত্তিকাপ্রাসাদ টিকে ছিল – তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে আস্তে করে হাঁটু গেড়ে বসে গেল। আমাদের সময় স্মৃতি চিরকালের জন্য বিলয় হলো। আজো চোখের সামনে সেই দোতলা বাড়িটি দেখতে পাচ্ছি। খড়ের ছাউনি। সামনে বারান্দা। বারান্দার ভেতর দিয়ে সিঁড়ি … এই বারান্দার ছাউনিটা তত সবল ছিল না। আমরা নাচলে থরথর করে কাঁপত। যত কাঁপত … আমরা তিন-চার ভাই মিলে নাচের বেগ বাড়াতাম। বেশ একটা মজার খেলা। বাদ সাধত মা। ধমক খেয়ে নাচ বন্ধ করতে হতো। এখনো মনে হলেই মনের মধ্যে নাচন লাগে। আবার ধেয়ে আসে বেদনা। যা যায় তা যায়। আর ফেরে না। পরবর্তী সময়ে এর চিত্রগ্রহণ আর সম্ভব হয়নি। এই জায়গা জুড়ে আমার ফুপাতো বোন কামরুন নাহার বেগমের সন্তানরা বাড়ি তুলেছে। তবে পাকা। সুতরাং ভিটের পুরনো চরিত্রকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মহানগরের ঘিঞ্জি বাড়ির মতো ভিটেও এখন পাকাবাড়িতে ঘিঞ্জি রূপ নিয়েছে। কোনো শ্রী নেই। আছে শুধু বসবাসের ঠিকানা।

দোতলাবাড়ি সংলগ্ন ছিল একতলা। এটার নাম নতুনঘর। সম্ভবত এখানে আগে কোনো পুরনো ঘর ছিল। তার বদলে এটা নতুন। আর জানালা ছিল বড়। তবে কতটা বদল ঘটেছিল তা বলতে পারব না। কারণ আগেরটা দেখিনি।

এই নতুনঘরের পাশে ছিল রান্নাঘর। ছোটবেলার একটা ছোট ঘেরা অঞ্চল। রান্নাঘর যেমন হয় – ছোট-চাপা একটা কালিঝুলি মাখা বাঁশের বেড়া দেওয়া ছাপড়া। আমাদেরটা ছিল কঞ্চির ওপর কাদা লেপা। তাই বাইরে থেকে দেখতে ভালো লাগত। এই রান্নাঘরের সামনে সামান্য ফাঁকা জায়গা – তারপর ছোটদাদির ঘর। একতলা। দাদাকে দেখিনি। তাই দাদিই মালিক। একমাত্র সন্তান মোর্তজাচাচা। আমার ছোটচাচার বয়সী। দাদি ভারি চেহারার হলেও চাচা একহারা। শ্যামলা রং। দেখতে সুন্দর। আমাকে খুব আদর করতেন। মনে পড়ে, আমি তার বিয়েতে মিতবর হয়েছিলাম। দুজনে এক পাল্কিতে চড়ে সমকপুর। ওখান থেকে বিয়ে খেয়ে চাচিকে নিয়ে আসি। চাচির রং চাপা। কিন্তু দেখতে সুন্দর। নাতি উচ্চতা। চাচির নামটাও মনে নেই। পরে গ্রামে গিয়ে সব ইতিহাস পূর্ণ করতে হবে।

জন্মের পর দু-দুটো স্বাধীন দেশ দেখলাম। কত অদল-বদল, মনে রাখা কঠিন। কারণ বিচ্ছেদ। নিজ ভিটে ছেড়ে ভিনদেশে যাত্রা। যা আগে একই দেশ ছিল। আজ এই লেখা সম্পূর্ণ ভিন্নধারার হতো ভারতবর্ষ ভাগ না হলে। এই খাপছাড়া জীবনের মাশুল তো গুনতেই হবে।

আমাদের দোতলা ঘরের পাশে সমান্তরালভাবে ছিল কবিরাজ দাদুর ঘর। যদিও গ্রামের উচ্চারণ ছিল কোবরেজ। তাঁর সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল বলতে পারব না। তবে দাদা বলেই ডাকতাম।

কোবরেজদাদা তখন বেশ বৃদ্ধ। এক চোখে চশমার কাঁচে কী যেন লাগাতেন। মুখে পাকা দাড়ি। মাথায় পাকা সাদা চুল।

দাদিরও বয়স বেশ। ছোটখাট গোলগাল মানুষ। দুজনই খুব  পান খেতেন।

রাতে আমরা যখন দোতলায় শুতে আসতাম তখন কোবরেজদাদুর ঘর থেকে পান-সুপারি কোটার শব্দ পেতাম … টুং টং টু …

এই সময় মা আমাকে সচেতন করতেন। বলতেন, দাদা-দাদিকে জিজ্ঞেস কর, তারা কেমন আছেন।

কথাটা হয়তো মা’রই বলার ইচ্ছা হতো। বউ মানুষ – কথা বলবে গ্রামসমাজে – তাই আমি হতাম মাধ্যম।

মা আমাকে যা শিখিয়ে দিতেন তা বলতাম।

হ্যাঁ জি, দাদো, কেমন আছেন জি?

ভালো। তুমি ভালো আছো দাদা?

হ্যাঁ দাদো, ভালো।

মা কেমন আছেন?

মা বলতেন, বলো – মা ভালো আছেন। আমি তাই বলতাম। মা ছিলেন প্রম্পটার। অর্থাৎ নাটকে উইঙ্গস থেকে একজন ডায়ালগ বলে দিতেন – নিচু স্বরে, অভিনেতা জোর গলায় তা বলতেন।

প্রতিরাতে চলত আমাদের সেই নাটক।

আজো কান পাতলে শুনতে পাই সেই কোবরেজদাদুর কণ্ঠস্বর। আর নেপথ্যে দাদির পান-সুপারি ভাঙার টুংটাং শব্দ।

আজ সব মহাবিশ্বে বিলীন। ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। দেশভাগের জন্যে তাঁদের সঙ্গে জীবন কাটানোর দীর্ঘ সময় পাইনি। গান আর সমাপ্ত  হয়নি। শুধু শুরু হয়েছিল প্রথম কলিটি। সেই মহৎপ্রাণ, পরিশুদ্ধ মানুষগুলোর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। জীবনে তাঁদের কোনো কাজে লাগার সুযোগ পাইনি। কোন অমানুষদের মাথায় এসব চিন্তা এসেছিল : দেশ ভাগ করে শান্তি লাভ করবে। রামায়ণ-মহাভারতে কে কী লাভ করেছিল – ধ্বংস ছাড়া। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, মানবজাতি ধ্বংসপ্রবণ জাতি। ধ্বংসের মধ্যে সে বেশি আনন্দ পায়।

এই একবিংশ শতকে দেখছি ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধবিরতি হয়ে গেছে … তারপরও ইসরায়েল গাজায় হাসপাতাল ও বিদ্যালয়ে সমানে বোমা মারা চালু রেখেছে। একতরফাভাবে। বিশ্ব শুধু নীরব দর্শক। অঙ্ক কষছে কার কী লাভ হচ্ছে বা লোকসান।

মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ … রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাসে আজ আমাদের চিড় ধরে গেছে।

আমাদের পাড়াটায় বেশ কয়েকটা গলি আছে। এক তো কোবরেজদাদু ও আমাদের ঘরের মাঝ দিয়ে গলিটা শেষ হয়েছে হাফেজ পিসান বা ফুপার বাড়ির উঠোনো গিয়ে।

দ্বিতীয় গলিটা আমাদের বাড়ির ডানদিক দিয়ে। এরপর আর একটা গলি। খুবই অল্পপরিসর। তিন থেকে চার ফুটের মতো। বৃষ্টির জল পড়তে খড়ের চালা ধরে যেটুকু জায়গা লাগে। সেইটুকু ফাঁক।

পাড়ার মধ্যে একমাত্র খোলা জায়গা হাফেজ চাচাদের ঘরের সামনেটা। তাদের বাড়ি এ-পাড়ায় একমাত্র পাকা বাড়ি। সামনে সবজির জন্যে মাচা। শীতকালে শিমগাছে খুব চমৎকার ফুল ফোটে। আর পুঁইশাকের ফলগুলো পেকে বেগুনি রং ধরে। ফল পেড়ে কাগজে ছবি আঁকা যায়। আমি কাগজ না পেয়ে ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকতাম।

আমাদের ঘরের পাশেও একটা ছোট জায়গা ছিল। কিছুটা উঁচু। দাদি এখানে পুঁইগাছ লাগাতেন। পাকা ফলগুলোর ফুল পেড়ে রান্না করতেন। পাকা-আধাপাকা বীজগুলো কট কট করে ভাঙত। বেশ একটা মজা পাওয়া যেত। পুঁইশাকের এই ফুলের শাখাকে লোকে বলত মেচড়ি। শুধু এই মেচড়িও বাজারে বিক্রি হয়। খুব একটা হেলাফেলার জিনিস নয়।

দাদির হাতে এই মেচড়ি আমাদের কাছে ছিল অমৃত। দাদির রান্নার হাতটা ছিল খুবই তৃপ্তিকর। কম দামের সব সবজি দিয়ে কি সুন্দর রান্না করতেন। একে বলে ‘আর্ট পভেরা’, মানে গরিব-শিল্প বা দরিদ্র-শিল্প। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই শিল্পের উদ্ভব। আমি অবশ্য দাদির রান্নাকে সেই পর্যায়ে ফেলি। আলবার্তো বুরি … ইতালির শিল্পীর ছেঁড়া চট-থলি নিয়ে কাজ যেমন বড় শিল্পধারা হয়ে দাঁড়ায় – আমি দাদিকেও সেই শিল্পীর দলে জায়গা দিতে চাই। কচুরলতি আর একটি চমৎকার রান্না। আরো ছিল মাটি আলুর লতায় যে আলু ফল হিসেবে ঝুলত দাদি সেগুলোকেও অপূর্ব রান্নাশ্রী দান করতেন।

দাদি গুলেজান বেগম আসলেই শিল্পী ছিলেন। রান্নাবান্না ছাড়াও তিনি গ্রামের মেয়েদের বিছে, নূপুর এসবের সুতো ছিঁড়ে গেলে রঙিন সুতো দিয়ে বেঁধে দিতেন। একটা দৃশ্য এখনো মনে গেঁথে আছে – দাদি বারান্দায় পার্টি বিছিয়ে বসে পা লম্বা করে পুরোনো শাড়ির পাড় থেকে রঙিন সুতো বের করছেন। সত্যিকার অর্থে দাদিকে কারুশিল্পী তকমা দেওয়া যায়। রন্ধনশিল্পের কথা তো আগেই বলেছি।

আজ সারাবিশ্বে দামি দামি সব খাবার রেসিপি দেখানো হয় টিভি-পর্দায়। কিন্তু এমন ‘আর্ট পভেরা’ দেখানো হয় না। পৃথিবীর সব লোকই যেন ধনী হয়ে গেছে। এই দরিদ্র দেশে সবই ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তের বিনোদনের জন্যে। গরিবের কথা কেউ ভাবে না। কোনো টিভি চ্যানেল দরিদ্রদের নিয়ে কোনো প্রোগ্রাম করে না। সবাই উচ্চবিত্তের দালালি করে চলেছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মানেই উচ্চবিত্তের শাসন। এখানে গরিবদের কথা বড় করে বলা হয় শুধু ভোটের আগে। তখন টাকা দেয়, গলায় গলা মেলায় – এমপি হয়ে গেলে আর তাদের কাছে ঘেঁষা যায় না। সঙ্গে থাকে পুলিশ। পোজপাজই আলাদা।

ভারি গম্ভীর ভাব। দেশের আইন নির্মাণের তারা কারিগর। কত বড় দায়িত্ব তাদের ঘাড়ে। তাদের কাছে অঞ্চলের
অভাব-অভিযোগের মতো সাধারণ কথার গুরুত্ব কোথায়! এসবের গুরুত্বের কথা আবার শোনা যাবে পাঁচ বছর পর যখন নির্বাচন আসবে।