মশিউল আলম
এক
পাথারিয়া পাহাড়ের কোলে বিস্ময়ের কুয়াশায় জেগে উঠেছিল এক খোকা, যখন নিকড়ি নদীটি খুব চঞ্চল ছিল। সে-খোকার মুখদর্শন করতে এসে বুড়োবুড়িরা উপহার দিয়েছিল রুমাল : লাল নীল সবুজ হলুদ বেগুনি কমলা – বিচিত্র সব রং। স্বপ্নের মতো রঙিন সেইসব রুমাল সুতায় বেঁধে খোকার দোলনায় ঝুলিয়ে রেখেছিল তার সবচেয়ে বড় দিদি।
খোকা একটু বড় হয়ে দিদির কাছে শুনবে, দোলনা দুলত আর হাওয়ায় দোল খেত নানা রঙের রুমালগুলি, তাই দেখে শূন্যে হাত-পা নাচাত খোকা। তার কচি মুখখানা সব সময় অনাবিল হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত।
পরে দিদি আরো বলবে, জন্মের সময় খোকা কাঁদেনি। পৃথিবীতে তার প্রথম চিৎকার ছিল আনন্দধ্বনি।
এসব কথা শুনে খোকা শুধু আপনমনে হাসবে, কিছু বলবে না।
তার দিদি আরো পরে বলবে, খোকা স্বপ্নের মধ্যে হেঁটে বেড়াত। শীতের এক পূর্ণিমা রাতে স্বপ্নের ঘোরে সে হেঁটে হেঁটে গিয়েছিল নদী দেখতে।
খোকা ভেবে দেখবে, দিদির ভুল হয়েছে; স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল বড় দাদা প্রভাতের। খোকার এই ভাইটি নিকড়ি নদীটিকে খুব ভালোবাসত। শীতকালের নিকড়ি ছিল তার বিশেষ প্রিয়। রাতের এক প্রহর ঘুমিয়ে সে উঠে পড়ত, তারপর ভূতগ্রসেত্মর মতো ছুটে যেত নদীকে দেখতে।
বাবা বলতেন, ‘প্রভাত, রাতের বেলা ঘোরাঘুরি করিও না। সাপে কাটিবে।’
বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ, অখ্যাত কবি। চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিল তাঁর নাম, লম্বা দাড়ি ছিল মুখে। নিজেকে নিয়ে তিনি এরকম পদ্য রচনা করেছিলেন :
চন্দ্রকান্ত কবিরাজ মুখে লম্বা দাড়ি
ঔষধের ডিবি লৈয়া বেড়াইন বাড়ি বাড়ি।
পান-তামাক দিলে তিনি কিছু নাহি খাইন
সুন্দরী রমণী দেখলে আড়নয়ানে চাইন \
বাবার ছিল ছটি ছেলেমেয়ে আর ছিল অনেক ফুলগাছ, আম-কাঁঠালের গাছ আর বনৌষধি। লোকে বলত কবিরাজ ঠাকুর। পৌষ-মাঘের শীতে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতেন; খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ছেলেমেয়েদের ডাকতেন, ‘এই উঠো উঠো, গাছে জল দাও।’
গাছগুলো ছিল নবীন, গরু-ছাগলের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের ঘিরে রাখা হতো ‘হুপি’ দিয়ে; চিকন চোঙের মতো হুপিগুলো ছিল খোকার চেয়ে লম্বা, খোকা বদনা ভরে জল নিয়ে জলচৌকির ওপর দাঁড়িয়ে তাদের গায়ে জল ঢেলে দিত।
গাছের চারাদের গায়ে জল ঢেলে দিতে দিতে খোকা বড় হবে, পাঠশালায় যাবে; কিন্তু বশোই খোকার মতো পাঠশালা যাবার বয়েসি হয়েও পাঠশালা যাবে না, সে চুরি করে আনবে মরিচমার্কা সিগারেট। খড়ের গাদার আড়ালে বসে বসে তারা মরিচমার্কা সিগারেটে আগুন ধরাবে, খোকা দুই টান দিয়ে বেদম কাশবে আর বলবে, বশোই, এটা ভালো না, সিগারেট খেতে নেই। কিন্তু বশোই জামগাছে উঠে মরিচমার্কা সিগারেট খেতে খেতে বড় হয়ে যাবে, তারপর শিমুলগাছে চড়ে পাখির বাচ্চা ধরে নিয়ে আসবে, সেই পাখির বাচ্চার গায়ে সাদরে হাত বোলাতে বোলাতে খোকা বলবে, ‘তুই বড় হ, ওই আকাশে উড়ে চলে যা…।’
স্থবির গাছেদের দেখে খোকার মনে বিস্ময় জাগেনি, প্রথম জেগেছিল পাখি দেখে।
পাখি নিয়ে তাঁর মা এই ছড়াটি বলতেন :
কাঁঠালগাছে দেখছি দুটো হলদে
পাখির ছানা
মায়ের মুখে খাচ্ছে আধার নাড়িয়ে
দুটি দানা।
সেই থেকে খোকা হলদে পাখির ছানা খুঁজে খুঁজে হয়রান। সঙ্গে বশোই, যে বশোই খুব দুষ্টু, যে মরিচমার্কা সিগারেট চুরি করে এনেছিল। তারপর ছেলেবেলার সেই খেলার সাথি কখন অজান্তে হারিয়ে গেছে, কিন্তু অশীতিপর বয়সেও সেই হারিয়ে যাওয়া কৈশোর মাঝে মাঝেই ফিরে আসত। তিনি আমাকে সেসব গল্প বলতেন, ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীর খন্দকারের গলির ভাড়া বাসায়। গত শতকের ষাট দশক থেকে তাঁর কেটেছে এই খন্দকারের গলিতেই, প্রথমে খন্দকার মঞ্জিল নামের এক দোতলা বাড়িতে, তারপর ক্রিস্টাল গার্ডেন নামের বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ভাড়া বাসায়।
দুই
তাঁর জন্ম ব্রিটিশ ভারতের সিলেট জেলার মৌলভীবাজারের বড়লেখার শিমুলিয়া গ্রামে, ১৯২৯ সালের ২৯ মে। নাম রাখা হয় দ্বিজেন্দ্র শর্মা। বাবা চন্দ্রকান্ত শর্মা ছিলেন ওই অঞ্চলের বিখ্যাত ভিষক, তাঁর বাড়িটি আজো কবিরাজ বাড়ি বলে পরিচিত। মায়ের নাম ছিল মগ্নময়ী দেবী। তাঁদের সন্তান ছিল ছয়জন : প্রভাতকুমার শর্মা, মৃণালিনী দেবী, বলরাম শর্মা, প্রভাবতী দেবী (মিঠু), দ্বিজেন্দ্র শর্মা (খোকা) ও সন্ধ্যারানী দেবী (খুকি)। দ্বিজেন্দ্র ছিলেন তাঁদের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র।
খোকার পড়াশোনা শুরু হয় গ্রামের পাঠশালায়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন সেখানকার পিসি হাইস্কুলে। নবম শ্রেণিতে উঠে ভর্তি হন করিমগঞ্জ পাবলিক হাইস্কুলে, সে-সময় করিমগঞ্জ ছিল আসামের একটি মহকুমা। ভারতবিভাগের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে সেই স্কুল থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তারপর করিমগঞ্জ কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। কলেজটি তাঁর ভালো লেগে যায়; কিন্তু গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় উচ্চতর গণিত নিয়ে। এই বিষয়টার মাথামুণ্ডু কিছুই তাঁর মাথায় ঢোকে না। কিন্তু গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত করিমগঞ্জ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখলেন, ত্রিপুরার আগরতলায় মহারাজা বীরবিক্রম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক নয়। ওই কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। তিনি করিমগঞ্জ কলেজ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে আগরতলায় গিয়ে মহারাজা বীরবিক্রম কলেজে ভর্তি হলেন। সেখান থেকেই ১৯৪৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর মা তাঁকে বললেন, ‘কলকাতা যাও, ডাক্তারিতে ভর্তি হও।’
বহু বছর পরে সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দ্বিজেন শর্মা আমাকে বলেন, ‘আমার পিতামহ, পিতা, অগ্রজ সকলেই ছিলেন প্রখ্যাত ভিষক। আমারও তা-ই হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমার মা সেটা চাননি। তিনি আমাকে আধুনিক চিকিৎসক বানাতে চেয়েছিলেন।’
মায়ের আদেশে তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন কলকাতা পৌঁছেন তার আগের দিনই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার শেষ সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়া তাঁর হলো না। ভর্তি হলেন বিএসসিতে, তা-ও নামী কোনো কলেজে নয়, কলকাতা সিটি কলেজে, এবং অনার্স ছাড়াই। এই প্রসঙ্গে তাঁর খেদোক্তি : ‘অনার্স যে নেওয়া যায়, আমার সে বুদ্ধিও ছিল না। গ্রাম থেকে কলকাতা গেছি, প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম জানতাম না, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের নাম পর্যন্ত জানতাম না, এমনই গেঁয়ো ছিলাম।’
তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভর্তি হতে পারেননি বলে তাঁর কোনো আফসোস ছিল না। তিনি নিজের মুখেই বরং আমাকে বলেন, ‘ভালো যে ডাক্তারিতে ভর্তি হইনি। ভর্তি হলে সর্বনাশ হতো।’ কারণ, কলকাতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ার আর্থিক সামর্থ্য তাঁর পরিবারের ছিল না, ভর্তি হতে পারলেও মাঝখানে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হতো। সিটি কলেজে পড়ার সময় তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ভালো ছিল না, কারণ মূলত আর্থিক। কলকাতায় তাঁর ভালো লাগত না, সবুজ রঙের ট্রেন পূর্ববঙ্গের দিকে যাচ্ছে – এমন দৃশ্য দেখলেই তাঁর বাড়ির কথা মনে পড়ত, আর বাড়ির কথা মনে পড়লে তিনি বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন।
সিটি কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে বিএসসি পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলকাতা ত্যাগ করেন। বাড়ি ফিরে যান, তখন করিমগঞ্জ কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন ডেমোন্স্ট্রেটর প্রয়োজন ছিল। তিনি সেই চাকরিটা পান। কিন্তু দেড় বছর চাকরি করার পর তাঁর একঘেয়ে বোধ হয়, তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে মার্কসবাদী বইপত্র পড়া শুরু করেন। অবশ্য তাঁর মার্কসবাদের দীক্ষা ঘটে কলকাতা সিটি কলেজে পড়ার সময়ই। তখন বামপন্থি বইপত্র পড়েছিলেন প্রচুর। বাম রাজনীতির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় ও মেলামেশাও হয় অনেক। গড়ের মাঠে দাঁড়িয়ে নেতাদের বক্তৃতা শুনতেন। একদিন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতা শুনেছিলেন।
তিন
বাড়িতে নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়া হতো। তাঁর বাবা ও বড় ভাই ছিলেন একাধিক সাময়িকপত্রের গ্রাহক। একদিন আজাদ পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ে : বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন ডেমোন্স্ট্রেটর চায়। তখন তিনি জানতেন না বরিশাল কোথায়। কোনো দিন বাংলার মানচিত্র খুলে দেখেননি। তাঁরা দেখতেন আসামের মানচিত্র। পত্রিকায় সেই বিজ্ঞাপন পড়ার পর খুলে বসলেন বেঙ্গলের ম্যাপ। দেখলেন, বরিশাল বঙ্গোপসাগরের কাছে। পাহাড়ের সন্তান কোনো দিন সমুদ্র দেখেননি। তাই ভীষণ উৎসাহের সঙ্গে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টেলিগ্রাম চলে এলো : ‘আপনি অবিলম্বে এসে কাজে যোগদান করুন।’ তিনি বরিশাল গিয়ে সমুদ্র খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথায় সমুদ্র? বঙ্গোপসাগর বরিশাল থেকে অনেক দূরে। তবু তিনি আর বরিশাল থেকে ফিরে এলেন না। বরং জীবনানন্দ দাশের ওই শহরের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য গড়ে উঠল। ১৯৫৪ সালে ব্রজমোহন কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ডেমোন্স্ট্রেটর হিসেবে যোগ দিলেন।
কিন্তু ডেমোন্স্ট্রেটরের কাজে তাঁর মন ভরেনি। যদিও হাতেকলমে উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়াতে তাঁর ভালো লাগত, তবু শুধু ব্যবহারিক ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করা একধরনের অসম্পূর্ণ কাজ বলে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। তাঁর ইচ্ছে ক্লাসে লেকচার দেওয়ার। কিন্তু ডেমোন্স্ট্রেটরদের দায়িত্বের মধ্যে সেটা নেই। কলেজের প্রভাষক হতে হলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির অধিকারী হতে হবে। তাই করিমগঞ্জ কলেজ ও বরিশালের বিএম কলেজে মোট চার বছর ডেমোন্স্ট্রেটরের চাকরি করার পর তিনি ঢাকা এসে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন, ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে চিরতরে হারাতে চায় না। তারা তাঁকে বলল, তিনি যেন মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার পরে আবার ওই কলেজে ফিরে যান। তাঁকে ফিরে পাওয়ার জন্য তারা একটা কৌশলও অবলম্বন করল : দ্বিজেন শর্মা যতদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন, ততদিন বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ৫০ টাকা মাসোহারা দেবে।
১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর কোর্সে পড়াশোনা শুরু করার পর তাঁর মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে যায়। উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে তাঁর নতুন উপলব্ধি জাগে। এই প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, ‘বিএসসি পাশ করার পর চার বছর চাকরি করে আমার ধারণা জন্মেছিল, আমি তো প্রচুর পড়াশোনা করেছি, আমি অনেক কিছু জানি, আর বিশেষ কিছু জানার দরকার নাই। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে প্রথম জানলাম যে আমি কিছুই জানি না। শুধু বায়োলজি কেন, মার্কসবাদ, ইতিহাস, অর্থনীতি, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ে যে পড়াশোনা করেছি সেসব কিছুই নয়। এ ধরনের পড়া কোনো কাজেই লাগে না। ইউনিভার্সিটি এডুকেশন ইজ এ মাস্ট। তোমাকে অবশ্যই সিস্টেম্যাটিক্যালি পড়াশোনা করতে হবে, কোনো ডিসিপিস্ননে যেতে হবে।’
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেন সত্যিকার অর্থে সিস্টেম্যাটিক পড়াশোনা। সে-সময় ঢাকায় অনেক বিদেশি বইপত্র পাওয়া যেত। একদিন তাঁর হাতে আসে এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি বিষয়ে আইরিশ এক ভদ্রলোকের লেখা ছোট্ট একটা বই। হ্যাসলফ হ্যারিসন নামের সেই ভদ্রলোক তখন ডাবলিন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। বইটি পড়ে দ্বিজেন শর্মা বেশ আলোড়িত হন। এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি বিবর্তনবাদকে বর্তমান ধারায় প্রতিষ্ঠা করার একটা পদ্ধতি। তিনি আমাকে বলেন, ‘এটা আমাকে হন্ট করতে লাগল। আমি আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে হ্যারিসনের কাছে চিঠি লিখলাম। তিনি পাল্টা চিঠিতে আমাকে লিখলেন, তুমি এখানে চলে এসো। তখন আমি ঠিক করি, এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাক্সোনমি পড়ব, আমি বিজ্ঞানী হব।’
তিনি মাস্টার্স শেষ করার পর আয়ারল্যান্ডে পিএইচ.ডি করতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষকের সঙ্গে বিভাগীয় প্রধানের দ্বন্দ্বের ফলে তিনি এমএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেলেন। ফলে পিএইচ.ডি করার জন্য তাঁর আর বিদেশ যাওয়া হলো না। এ-বিষয়ে তাঁর খেদোক্তি : ‘এটাই আমার ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দিল।’
এ নিয়ে তাঁর মনে গভীর দুঃখ ছিল। আলাপের সময় কখনো কখনো সেই দুঃখ প্রকাশ পেত। তাঁর একাধিক লেখায়ও এই দুঃখের আভাস আছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর প্রায় দুই দশক পরে আশির দশকে মস্কো বসবাসকালে তিনি লন্ডন বেড়াতে যান। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ন্যাচারাল হিস্ট্রি বিভাগের হলঘরে ঢুকেই স্যার রিচার্ড ওয়েনের আবক্ষ মূর্তি দেখে মনে পড়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের কথা, এবং তিনি বিরক্ত হন। ‘গল্পবিজ্ঞান’ নামের ছোট্ট একটি লেখায় এই প্রসঙ্গটা আছে; নিজের দুর্ভাগ্য সম্পর্কে তৃতীয় পুরুষে তিনি লিখেছেন :
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে থিসিসের মালমশলা সংগ্রহকালে অমত্ম্যজ উদ্ভিদবর্গের একটি নতুন প্রজাতি সে খুঁজে পেয়েছিল। তার তত্ত্বাবধায়ক এই সাফল্যে শোরগোল তোলেন, বিভাগে হইচই পড়ে যায় এবং পরীক্ষা শেষে একটি প্রথম শ্রেণি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে সে স্বগ্রামে ফেরে। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণার স্বপ্নে মশগুল থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল এবং এই সুবাদে নিজেকে প্রাণের উৎসসন্ধানী এক বিজ্ঞানী বানিয়ে একটি চটকদার গল্পও লিখে ফেলেছিল। কাগজে গল্পটি ছাপা হলেও তার স্বপ্ন সফল হয়নি। তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে রেষারেষি কিংবা অবোধ্যতর কোনো কারণে বিভাগীয় প্রধান তার গলায় দ্বিতীয় শ্রেণির যে ঘণ্টিটি ঝুলিয়ে দেন, তাতে মধ্যযুগীয় কুষ্ঠরোগীর মতো গুহাবাস তার নিয়তি হয়ে ওঠে এবং মফস্বলের কলেজের বিবর্ণ প্রাত্যহিকতায় কালাতিপাত ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
এই প্রসঙ্গে আমি একবার তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনি যদি পিএইচ.ডি করতে আয়ারল্যান্ড চলে যেতেন, তাহলে আমরা সম্ভবত আপনাকে আর ফিরে পেতাম না। বাংলাদেশ আপনাকে হারাত। কারণ বিদেশের যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি পিএইচ.ডি করতেন, তারা আপনার মেধা আর পড়াশোনা ও গবেষণায় একাগ্রতা দেখে আপনাকে আর ছাড়ত না। সারাজীবন আপনাকে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনা করতে হতো। আপনার আর শ্যামলী নিসর্গ লেখা হতো না, বাংলা ভাষায় হয়তো কোনো বই-ই আপনার লেখা হতো না। প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদক হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া, সমাজতন্ত্রে বসবাস করা এবং সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে বই লেখা হতো না। বই অনুবাদ করা হতো না, আপনার সুন্দর অনুবাদ থেকে বাংলা ভাষার পাঠকেরা বঞ্চিত হতো। তরুপলস্নবের মতো সংগঠন গড়ে তোলা হতো না।’
আমার কথা শুনে তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘তাই আমি আমার অতীত নিয়ে আফসোস করি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর অনেক বন্ধুবান্ধব জুটে যায়। ওই সময় তিনি সিকান্দার আবু জাফর-সম্পাদিত সাময়িকপত্র সমকালে প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন ওই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, তাঁর সঙ্গে দ্বিজেন শর্মার গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। হাসান হাফিজুর রহমানের পীড়াপীড়ির ফলেই তিনি সমকালের জন্য প্রবন্ধ লেখা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ‘শেষ গোলাপগুচ্ছ’ নামের স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধের এক জায়গায় লিখেছেন : ‘তখন সমকাল পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হচ্ছে। হাসান সহকারী সম্পাদক। ইতিপূর্বে আমি উলেস্নখ্য কিছুই লিখিনি। হাসানের ঈর্ষণীয় বন্ধুপ্রীতি, অনমনীয় জবরদস্তি আর অহেতুক প্রশংসার কল্যাণেই সাহিত্যের অঙ্গনে আমি প্রবেশাধিকার পাই। বলতে দ্বিধা নেই, হাসানের হাত ধরেই এ পথে আমার যাত্রা শুরু।’
সমকাল পত্রিকায় যেসব প্রবন্ধ লেখেন সেগুলোর বিষয়বস্ত্ত ছিল বিচিত্র-সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান পর্যন্ত। কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম উলেস্নখ করলেই তাঁর আগ্রহের বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে : ‘সংস্কৃতি বিচার’, ‘বঙ্কিম সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’, ‘লিসেন্কোর বংশগতিতত্ত্ব’, ‘তমসার শেষ অঙ্কে’ ইত্যাদি।
স্বাধীনতার পরে হাসান হাফিজুর রহমান মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস অ্যাটাশে হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ১৯৭৪ সালে দ্বিজেন শর্মা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে মস্কো গেলে তাঁদের সখ্য আরো নিবিড় হয়।
১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ী বরিশাল বিএম কলেজে ফিরে গিয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। দ্বিতীয় শ্রেণি পাওয়ায় পিএইচ.ডি করতে বিদেশ যাওয়ার সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার ফলে তাঁর মন সে-সময় ভীষণ খারাপ ছিল। তবে তখনো সব আশা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। বরিশালে ফেরার পরেও তাঁর মনে আশা ছিল যে পিএইচ.ডি করার জন্য আয়ারল্যান্ডে অধ্যাপক হ্যারিসনের কাছে যাবেন।
কিন্তু গোল বাধাল দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি : ইতিমধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। তারপর স্বৈরাচারী সরকার একটা শিক্ষানীতি ঘোষণা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সারা পূর্ববাংলাজুড়ে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্র-আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। তিনি তখন বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্র হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট, আন্দোলনরত ছাত্রদের সহযোগিতা করছেন এই অভিযোগে গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে ধরতে যায়। তিনি পালিয়ে বরিশাল থেকে চলে যান মৌলভীবাজারের বড়লেখায় নিজের গ্রামে। সেখানে ও ময়মনসিংহের আত্মীয়বাড়িতে মাসতিনেক লুকিয়ে থাকার পর পরিস্থিতি থিতু হয়েছে ভেবে কলেজে ফিরে কাজে যোগদান করেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার ও কারাগারে নিক্ষেপ্ত হন। ফলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য তাঁর বিদেশ যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেন, ‘বাষট্টি সালে বরিশালে আমাকে সিকিউরিটি প্রিজনার হিসেবে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢুকিয়ে দিল। তারপর আইয়ুব খানের পাকিস্তানে আমার পক্ষে আর পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব ছিল না। আমি উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে ঠিক করলাম, বরিশালেই পিএইচডি করব বরিশাল ফ্লোরা (বরিশালের উদ্ভিদকুল) নিয়ে। কিন্তু সেখানে কোনো গাইড নাই। নিজেই নিজেই কিছু কাজ করলাম। জেল থেকে বেরিয়ে আমি আর বরিশালেই থাকিনি, ঢাকায় এসে নটর ডেম কলেজে যোগ দিলাম। ঢাকায় এসেই আমার ইচ্ছা হলো, ঢাকা শহরের গাছপালা নিয়ে লেখালেখি করব। মোটরসাইকেলে করে সারা ঢাকা চষে বেড়াতাম, গাছপালা দেখতাম।’
বরিশালে গ্রেপ্তার ও কারাবরণের আগে ১৯৬০ সালের ২৭ নভেম্বর তাঁর বিয়ে হয় বরিশালবাসী আইনজীবী সুধীর কুমার চক্রবর্তীর কন্যা দেবী চক্রবর্তীর সঙ্গে। দেবী চক্রবর্তী তখন বরিশাল বিএম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। সেখানে ১৯৬১ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান সুমিত্র শর্মার (টুটুল) জন্ম হয়। দ্বিতীয় সন্তান শ্রেয়সী শর্মা (মুন্নী) জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭১ সালে।
চার
১৯৬২ সালে বরিশাল ছেড়ে ঢাকা চলে আসার পর দ্বিজেন শর্মা কিছু সময় কায়েদে আজম কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজ ও বাংলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারপর যোগ দেন নটর ডেম কলেজে। ওই কলেজের প্রাঙ্গণে অনেক গাছ লাগান, বাগান গড়ে তোলেন। তাঁর লাগানো কিছু গাছ এখনো ওই কলেজের প্রাঙ্গণে রয়ে গেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কলেজের ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর প্রথম গ্রন্থ শ্যামলী নিসর্গ লেখেন। বাংলা ভাষায় এরকম বই এটাই প্রথম। এ-বইয়ের প্রকাশনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আমাকে বলেন, ‘গাছপালার ছবি আঁকার জন্য পেয়ে গেলাম আঁকিয়ে গোপেশ মালাকারকে। বাংলা একাডেমীকে বললাম, তারা সঙ্গে সঙ্গে বইটা প্রকাশ করতে রাজি হয়ে গেল। শ্যামলী নিসর্গ-ই আমার প্রথম বই, এটাই এখনো পর্যন্ত আমার প্রধান বই, লোকে এখনও এটার কথা বলে।’ কিন্তু তিনি পাণ্ডুলিপি ১৯৬৫ সালে জমা দিলেও বাংলা একাডেমি বইটি প্রকাশ করে অনেক পরে, ১৯৮০ সালে।
শ্যামলী নিসর্গ লেখার সময়েই তিনি পপুলার সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্পের আঙ্গিকে আরো দশ-বারোটা নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখেন। সে-লেখাগুলো নিয়ে আরো পরে প্রকাশিত হয় জীবনের শেষ নেই নামে আরেকটা বই।
ছাত্র পড়াতে তাঁর ভালো লাগত, বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল আরো বেশি। একবার তিনি আমাকে বলেন, ‘আমার মূল লক্ষ্য ছিল গাছপালা নিয়ে গবেষণা করব, বিজ্ঞানী হব, এবং এই ধারার লেখালেখি করব। তাই নটর ডেম কলেজে যোগ দেওয়ার কিছুকাল পরে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের অধীনে ক্যারোফাইটা নিয়ে পিএইচ.ডি গবেষণা শুরু করি। মস্কো যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সেটা চালিয়ে গেছি। আমি একজন বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। এটাই ছিল আমার মনের গড়ন।’
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। অবশ্য তিনি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রবেশ করেননি, কিন্তু তাঁর বন্ধুবান্ধবদের অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল।
কলেজে পড়ার সময় বামপন্থি বইপত্র পড়েছিলেন প্রচুর। বাম রাজনীতির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশাও হয়েছে কম নয়। সে-সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘ওটা ছিল বিদ্রোহের বয়স। তার ওপর দেশবিভাগের ফলে আমাদের পরিবারে দারিদ্র্য নেমে আসে। আমার সে সময়ের দারিদ্রে্যর অভিজ্ঞতা ভীষণ তিক্ত। ফলে আই ওয়াজ ভেরি অ্যাংরি। আমি প্রথম যে গল্পটা লিখেছিলাম, সেটার নাম ছিল কী, জানিস? ‘যে নদী মরুপথে’। এক গরিব ছাত্রের জীবনসংগ্রামের কাহিনি। যা হয় আর-কি। গল্পের আড়ালে নিজের দারিদ্রে্যর বয়ান। তার পরও কয়েকটা গল্প লিখেছিলাম। সেগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আর কলকাতা পড়ার সময় আমি থাকতাম ব্যারাকপুরে। সেখানে বামপন্থিরা গল্প লেখার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। আমি ‘সীমান্ত’ নামে একটা গল্প লিখি, সেটা ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যায়। সো আই বিকেম পপুলার অ্যামং দেম। প্রচুর বন্ধুবান্ধব জুটে গেল।’
পাঁচ
১৯৭৪ সালে দ্বিজেন শর্মা সোভিয়েত ইউনিয়নের সুবৃহৎ পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা প্রগতি প্রকাশনের অনুবাদকের চাকরি নিয়ে সপরিবারে মস্কো চলে যান। ফলে অ্যাকাডেমিক জগতের সঙ্গে তাঁর চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটে যায়। অনুবাদের কাজ তাঁর ভালো লাগেনি, কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে এ-কাজটি তাঁকে করতে হয়েছে। প্রগতি প্রকাশনের জন্য তিনি প্রায় ৪০টি বই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করতে ভালো না লাগলেও সোভিয়েত ইউনিয়নে তাঁর বসবাস আনন্দময় ছিল। তিনি মনে করতেন, তাঁর জীবনে এটা ছিল এক বিরাট সৌভাগ্যজনক ঘটনা। এ-কথা তিনি নিজ মুখেই আমাকে বলেছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘নটর ডেম কলেজে পিএইচ.ডি গবেষণা, উদ্ভিদবিদ্যা পড়ানো, ঢাকার গাছপালা নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি, অসংখ্য ভক্ত, বন্ধুবান্ধব – এইসব ছেড়েছুড়ে অনুবাদের মতো নিরানন্দ, একঘেয়ে, কষ্টকর কাজ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়াকে আপনি সৌভাগ্য বলছেন?’
উত্তরে তিনি বলেন, ‘সৌভাগ্য মানে? বিরাট সৌভাগ্য! সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে আমি এমন সমাজ দেখার সুযোগ পেয়েছি, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আরো কত কিছু দেখার সুযোগ হয়েছে, কত দেশে গেছি, কত মানুষ দেখেছি, কত বই কিনতে পেরেছি, পড়তে পেরেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে না গেলে হয়তো মূর্খই থেকে যেতে হতো। পিএইচ.ডি হয়তো করে ফেলতাম। লিখতামও হয়তো, কিন্তু সেসব লেখা এ-রকম হতো না। আর জীবনটা সেখানে কী সুখেরই না ছিল। টাকা-পয়সার চিন্তা নাই, প্রাচুর্য নাই, প্রাচুর্যের চিন্তাই নাই, অভাবও তেমন নাই। কাজের অমানুষিক চাপ নাই। অদ্ভুত সমাজ ছিল সেটা। সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার সুবাদে ইউরোপ ভ্রমণে যেতে পেরেছি, কতকিছু দেখার সুযোগ পেয়েছি। আমি তো বলি শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া উচিত। সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানো উচিত।’
২০০৬ সালের ২৯ মে তাঁর ৭৭তম জন্মদিনে তাঁর সঙ্গে আমার ওই আলাপচারিতায় তিনি আমাকে আরো বলেন, ‘ওই দেশটিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতায় এক অভূতপূর্ব পরীক্ষা হয়ে গেছে। পুঁজিবাদের চূড়ান্ত বিজয় প্রমাণিত হয়েছে, এটা যারা বলে, তারা ঠিক বলে না। এই পুঁজিবাদ শুধু মানুষের শোষণ-বঞ্চনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে মানবসভ্যতাকেই ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে সে। সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে হলে উৎপাদন ও পরিভোগের এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে। বদলাতে হবে সব বিষয়ে এথনোপোসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সবার ওপরে মানুষ সত্য নয়, পৃথিবীর ইকোসিস্টেমে একটি কীটস্ব কীটেরও ন্যায্য জায়গা রাখতে হবে। নোবেলবিজয়ী বিজ্ঞানী অ্যান্ডিকো ফারমিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের গ্যালাক্সির অন্যান্য গ্রহে কি সভ্যতা আছে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আছে, নিশ্চয়ই অনেক আছে। পরের প্রশ্ন, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না কেন? এবার ফারমির উত্তর : সে-রকম প্রযুক্তি তৈরি করার আগে তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলে।’
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির সময় তিনি মস্কোতেই ছিলেন। তারপর প্রগতি প্রকাশনেরও বিলোপ ঘটে এবং তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেশে ফিরে আসেননি, ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মস্কোই ছিল তাঁর আবাসস্থল। ওই বছর স্বদেশে ফেরেন বটে, তবে ২০০৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই একবার করে মস্কো যেতেন এবং টানা কয়েক মাস সেখানে বাস করতেন। ২০০৫ সালের পর মস্কোর পাট পুরোপুরি গুটিয়ে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন। এই যাওয়া-আসার সময়েই তিনি ঢাকায় এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রকল্পের অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং বাংলাপিডিয়ার অনেক ভুক্তি নিজে অনুবাদও করেন। ২০০৪ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আমার মনে হয়, দ্বিজেন শর্মার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসের দুই দশক। এই পর্ব শেষ করে স্বদেশে ফিরে আসার পরে পত্রপত্রিকায় প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে তাঁর অনেক লেখা প্রকাশিত হওয়া এবং এসব বিষয়ের প্রতি তরুণ সমাজের আগ্রহ বাড়ানোর লক্ষ্যে সাংগঠনিক সক্রিয়তার ফলে প্রকৃতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচয়টাই প্রধান হয়ে ওঠে। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবনা, বিশেষত সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার গুরুত্বও বিরাট বলে আমার মনে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি সমাজতন্ত্রে বসবাস নামে একটি বই লেখেন। ঢাকার প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল তা প্রকাশ করে ১৯৯৯ সালে। বইটিকে সংক্ষিপে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত বলা যেতে পারে। ২০০৪ সালের জুন মাসে প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে বইটির বিষয়ে আমার একটি ছোট্ট আলোচনা প্রকাশিত হয়। আমি সেই আলোচনার এক জায়গায় লিখি : ‘দীর্ঘকাল মস্কোপ্রবাসী লেখক-অনুবাদক দ্বিজেন শর্মার সমাজতন্ত্রে বসবাস বইটি পাঠ করে মনে হয়েছে কিছুরই সুরাহা হলো না; লেখক তো জানালেন না এত বছর সমাজতন্ত্রে বসবাস করে এই ব্যবস্থাটি সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত কী দাঁড়াল। কেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে, কেন প্রথমে রাশিয়াতেই ঘটল, কী করে ৭০ বছর টিকে থাকল আর কেনই-বা ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো? সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ কি আসলেই সম্ভব? এমন ব্যবস্থা কি মানব প্রজাতির অন্তর্গত স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? নাকি সমাজতন্ত্র জবরদস্তি করে কৃত্রিম উপায়ে চাপিয়ে দেওয়া একটি ব্যবস্থা, যা চাপানো গেলেও এবং জোর করে কিছুকাল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলেও দীর্ঘকাল চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়?’
আমার এই আলোচনার প্রতিক্রিয়ায় দ্বিজেন শর্মা প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতেই লেখেন, ‘মশিউল লিখেছেন, ‘লেখক তো জানালেন না এত বছর সমাজতন্ত্রে বসবাস করে ব্যবস্থাটি সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত কী দাঁড়াল।’ যথার্থ জিজ্ঞাসা। আমি যে বিভ্রান্ত তেমন সাক্ষ্য বইটিতেই আছে। অধিকন্তু এমন একটি জটিল বিষয় সম্পর্কে সুচিমিত্মত সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো বিদ্যাও আমার নেই। এ ক্ষেত্রে প্রসাধারণীকরণের ঝুঁকি রয়েছে। গোটা বিশ্বের কত মনীষী, কত মহৎ ব্যক্তি সমাজতন্ত্রের জন্য প্রাণপাত করেছেন তা ভুলি কেমনে।
‘সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর প্রগতি প্রকাশনের সহকর্মীদের কেউ কেউ এ দেশ ছাড়ার সময় তাঁদের সংগৃহীত মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বইগুলো আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে যাচ্ছেন দেখে দুঃখ পেয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ ভেঙে পড়া সত্ত্বেও আমি আজও সমাজতন্ত্রকে সর্বাধিকসংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোত্তম রাষ্ট্রব্যবস্থা বলে মনে করি। তবে ইদানীং এমন একটি ভাবনা আমাকে সর্বদাই আলোড়িত করে এবং তা হলো, সমাজতন্ত্রের মতো একটি মানবিক ব্যবস্থায় উত্তরণ কি সহিংস শ্রেণিসংগ্রাম ও বিপুল রক্তপাতের মাধ্যমে সম্ভব? লেনিন মার্কসীয় তত্ত্বকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন এবং তার অভিজ্ঞতাকে খুবই মূল্যবান মনে করি। যদিও তাঁর সমগ্র রচনা পাঠ আমার সাধ্যাতীত, যেটুকু পড়েছি তা সামান্য এবং অধিকাংশই অনুবাদ ও সম্পাদনার সুবাদে। লেনিনের কোনো কোনো লেখায় এমন ইংগিতও আছে যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শামিত্মপূর্ণ উপায়েও সম্পন্ন হতে পারে। রুশ বিপ্লবের পরিণতি দেখে এমন একটি চিন্তা অযৌক্তিক মনে হয় না যে, ধনতন্ত্র অপেক্ষা উন্নততর কোনো সভ্যতার জন্য অহিংসাই হবে মূল চালিকাশক্তি, অন্যথা উপায় ও লক্ষ্যের দ্বন্দ্ব নিরসন অসম্ভব হবে এবং বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা বিপ্লবেরই উদরস্থ হবেন।’
‘সমাজতন্ত্র চিরতরে বিদায় নিয়েছে এমন ভাবনার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। সমাজ বিবর্তনের মার্কসীয় ধারণা, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ একটা পর্যায়ে পৌঁছালে উৎপাদন-সম্পর্কের পরিবর্তন অনিবার্য, তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। পুঁজিতন্ত্র এখনও তেমন কোনো ক্রামিত্মলগ্নে পৌঁছায়নি, সে নানা কৌশলে বা অপকৌশলে এই দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে সক্ষম, কিন্তু অনন্তকাল তা পারবে না।’ পুঁজিতন্ত্র মানবসভ্যতার সর্বোত্তম ও শেষ পর্যায় এমন ভাবনা অবশ্যই অযৌক্তিক, বিশেষত আমরা উন্নয়নশীল দেশের মানুষ তা মর্মে মর্মে অনুভব করি। পশ্চিমের কোনো কোনো পণ্ডত মনে করেন বর্তমান বিশ্বায়ন আসলে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের ফল, অর্থাৎ নতুন উৎপাদিকা শক্তির উচ্ছ্রয়ের অভিঘাতের ফসল। বিশ্ব পুঁজিতন্ত্র বিশ্বায়নকে কতটা বিশ্বমানবের কল্যাণের উপযোগী করতে পারবে তার ওপর নির্ভর করছে এই ব্যবস্থার সাফল্য। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের তো এটা আরম্ভমাত্র, তার বিকাশ বিশ্ব পুঁজিতন্ত্রের বিপর্যয় ডেকে আনবে কি না তা এখনও কেউ জানে না। আরেকটি শক্তি-উৎসের উদ্ভাবনও আসন্ন আর সেটা হলো অ-ফসিল জ্বালানি আবিষ্কার। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স একযোগে ফিউশন এনার্জি নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে, তাতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হবে পানি এবং তাতে কোনো তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য থাকবে না, শক্তির পরিমাণও হবে বিপুল। এই প্রযুক্তি কি মুষ্টিমেয় পরাশক্তি দীর্ঘকাল তাদের একচেটিয়া দখলে রাখতে পারবে? অবশ্যই না। আমরা তখন বুঝতে পারব পৃথিবীর চেহারাটা অতঃপর কেমন হবে আর উৎপাদিকা শক্তির বৃদ্ধি সত্যিই উৎপাদন সম্পর্ক বদলায় কি না। সেই দিন কিন্তু বেশি দূরে নয়।
‘মশিউল আলম জানতে চেয়েছেন, ‘পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কেন প্রথম রাশিয়াতেই ঘটল, কী করে ৭০ বছর টিকে থাকল আর কেনইবা ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো?’
‘এ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত’, তবে সবচেয়ে সহজ অনুমান : ইউরোপের সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী সামন্ততন্ত্র ছিল রাশিয়ায় আর লেনিনের ভাষায় সে জন্য ‘বিশ্বপুঁজিতন্ত্রের দুর্বলতম গ্রন্থি’, যথাসময়ে সেখানে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেনি, যখন ঘটল তখন কমিউনিস্টরা তা ছিনিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন, তাঁরা সমাজ বিকাশের একটি অপরিহার্য পর্যায় পুঁজিতন্ত্র এড়াতে চাইলেন আর সে জন্যই শেষ পর্যন্ত টেকসই সমাজতন্ত্র নির্মাণে সফল হননি। ৭০ বছর রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র টিকে ছিল প্রথমে বিপ্লব থেকে উৎপাদিত শক্তি ও জনগণের প্রবল আশাবাদের কল্যাণে, শেষে রাষ্ট্রশক্তির কঠোরতম নিয়ন্ত্রণে। কালে কালে প্রথম দুটি উবে যায়, থাকে শুধু শেষেরটি। সমাজে ব্যাপক দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটে, আমলাতান্ত্রিকতার দরুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের সুফল কুড়োতে ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে রাশিয়া ব্যর্থ হয়। টফলারের মতে, ‘সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন-সম্পর্ক উৎপাদিকা শক্তির বিকাশে বাধা হয়ে ওঠে’, নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্টদের সঙ্গে পুরনোদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য বৃদ্ধি পেতে থাকে, গর্বাচেভ সমাজতন্ত্র সংস্কারে উদ্যোগী হন; কিন্তু ততদিনে পুরো ব্যবস্থাই ক্ষয়ে গিয়েছিল, তাই সংস্কার আর সম্পন্ন হলো না, ভেঙে পড়ল গোটা কাঠামো।
‘এভাবেই রাশিয়ায় পুঁজিতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটল, যে-ব্যবস্থাকে এড়াতে চাওয়া হয়েছিল এবং ‘অপুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের পথ’ নামে একটি তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে বিপুল শক্তি ও অর্থের অপচয় ঘটানো হয়েছিল, আমরা জানি পৃথিবীর কোথাও তা সফল হয়নি। এর বেশি কিছু বলার মতো জ্ঞানের পুঁজি আমার নেই। তবে এও বলা প্রয়োজন যে, রাশিয়া ব্যর্থ সমাজতন্ত্র আমাদের জন্য কিছু ইতিবাচক অবদানও রেখে গেছে; সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার দ্রম্নত পতন, তৃতীয় দুনিয়ার
উত্থান (বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ঘটনা-পরম্পরাও প্রসঙ্গত স্মর্তব্য), সমতাভিত্তিক সমাজে জীবনযাত্রার কিছু মূল্যবান দৃষ্টান্ত যা অতীতে কোথাও ছিল না, আজও নেই।’
ছয়
দ্বিজেন শর্মা বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলেন, তাঁর মনটা ছিল বিজ্ঞানীর মন। ভাগ্যচক্রে তা ঘটেনি, কিন্তু বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর চিন্তা, পড়াশোনা ও লেখালেখি কখনো থামেনি। এ শুধু ব্যক্তিগত বিষয় নয়, তিনি এক বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ কামনা করতেন। বিজ্ঞান শিক্ষা ছিল তাঁর গভীর ভাবনার বিষয়গুলোর অন্যতম। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা যে-বয়সে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ পায় তার অনেক আগে, কৈশোরের শুরুতেই বিজ্ঞানের রহস্যময় জগতের সঙ্গে তাদের একটি মধুময় সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।
কীভাবে তা গড়ে তোলা সম্ভব? বিজ্ঞান বিষয়ে সুখপাঠ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সায়েন্স ফিকশন বা বিজ্ঞান-রহস্যোপন্যাস পড়া, বিজ্ঞানবিষয়ক চলচ্চিত্র, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি দেখার মাধ্যমে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব উপকরণ ও উদ্যোগ অপ্রতুল। বিজ্ঞানবিষয়ক লেখালেখির পরিমাণ খুব কম এবং সেগুলো অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য সুখপাঠ্য ও প্রাঞ্জল নয়।
জীবনের শেষ নেই নামের বইয়ের ভূমিকায় দ্বিজেন শর্মা এসব কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, ‘আমাদের কাছে বিজ্ঞানের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা অর্থকর বিদ্যা হিসেবেই গণ্য। অজানাকে জানার, প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের প্রবল কৌতূহল থেকে আমরা বিজ্ঞান শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হই না। আমাদের দেশের বিজ্ঞানের সেরা ছাত্ররাও যে কর্মজীবনে সৃজনশীল বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা অর্জনে ব্যর্থ হন, এর মূলে পূর্বোক্ত কারণসমূহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তা ছাড়া এ সত্য অত্যন্ত স্পষ্ট যে আমাদের সমাজমানস মূলত বিজ্ঞান-বিমুখ। আমাদের অর্থনীতি তথা সাংস্কৃতিক জীবনে মধ্যযুগের অস্তিত্ব আজও সুপ্রকট। আমরা যান্ত্রিক প্রগতির যা-কিছু জীবনের দায়ে গ্রহণ করেছি, তা আজও আমাদের সমাজের বহিরঙ্গেই পৃথকীকৃত হয়ে রয়েছে। আমাদের অন্তরের সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি। তাই আমাদের দৈনন্দিন আলোচনা থেকে কলাকৃষ্টির বিসত্মৃততর পরিসরেও বিজ্ঞান নির্বিশেষে অনুপস্থিত। বিজ্ঞান যেন আমাদের ক্রীতদাস; তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত হলেও সে অচ্ছুত, তার সখ্য অনাকাঙিক্ষত।
‘তাই আমাদের ছেলেমেয়েরা শৈশব-কৈশোরে পারিবারিক সূত্রে বিজ্ঞানমুখী হবার অনুপ্রেরণা লাভে স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়। এ ব্যর্থতা এবং পরবর্তীকালের ত্রম্নটিপূর্ণ বিজ্ঞান শিক্ষার যুগ্ম প্রতিক্রিয়ার ফলেই সম্ভবত আমাদের বিজ্ঞান বন্ধ্যা, নিষ্ফলা।’
দ্বিজেন শর্মা মনে করতেন, এই সমস্যার যে-কোনো সমাধান নেই তা নয়। তবে এজন্য ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন। এই ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে সুখপাঠ্য ও প্রাঞ্জল বই লেখার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, এবং নিজে সেই চেষ্টা কিছুটা করে গেছেন। ডারউইন, বিবর্তনবাদ, উদ্ভিদজগৎ ও প্রকৃতি-পরিবেশ বিষয়ে তিনি প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য ভাষায় অনেক লেখা লিখেছেন। অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ, প্রাবন্ধিক মফিদুল হকসহ অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞান বিষয়ে সুন্দর ভাষায় লেখালেখিতে দ্বিজেন শর্মা ছিলেন অনন্য।
বিজ্ঞান শিক্ষা তো বটেই, সামগ্রিক শিক্ষা সম্পর্কেও দ্বিজেন শর্মা চিন্তাভাবনা করতেন। তিনি মনে করতেন, ‘আধুনিক শিক্ষা সর্বৈব শিল্পবিপ্লব-উত্তর ইউরোপের এবং সেজন্য তা নাগরিক পরিবেশের তথা শিক্ষিত পারিবারিক প্রতিবেশের অধিক উপযোগী। একটি গ্রামীণ শিশুমন প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে, সেখানকার জীবনধারা থেকে যে উদ্দীপনা ও অন্যান্য উপকরণ আত্তীকরণে লালিত হয়, তার সঙ্গে শিল্পপ্রধান সমাজের শিক্ষা-উপকরণের বৈপরীত্য আছে। তাই এ-শিক্ষা তার কাছে অনাকর্ষী ও পরকীয় হয়ে ওঠে (শিক্ষকদের উদ্যত বেতের কথা না-ই বা ধরা হলো)। তার জগতের লাগসই শিক্ষাদর্শীর অভাবে তার পাঠ্য বিষয়ে ‘গোবরেপোকা’ এত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, কোনো দিন ‘ব্যাঙের খাঁটি কথাটি’ কিংবা ‘নেড়ি কুকুরের ট্রাজেডি’ লেখা হয় না। যে শিশু দুপায়ে দাঁড়ানোর পরই উঠোনে কাদামাটি ছানে, ফড়িং ধরে, চাষবাসের ও মাছ ধরার উপকরণ দেখে, তার পক্ষে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, নদীতে মাছ ধরা, গাছের মগডালে পাখির বাচ্চা খোঁজার সঙ্গে স্কুলের বন্দি বেষ্টনীতে বইয়ের পাতার সজ্জাহীন নীরস তথ্যের বিমূর্ত বস্ত্ত থেকে জ্ঞানার্জনের বিরক্তিকর মলস্নযুদ্ধ কি তুলনীয়? এভাবেই আধুনিক শিক্ষার উপকরণ ও পদ্ধতি এ দুয়ের সঙ্গেই তার অন্তর্লীন এক বিরোধ গড়ে ওঠে এবং শেষাবধি তা শিক্ষাজীবনে ব্যর্থতা দেখা দেয়।’
দ্বিজেন শর্মা কবিতা লেখেননি, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ও মন কাব্যিক সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল। তাঁর বিজ্ঞানচিন্তায় ও পরিবেশ ভাবনায় সৌন্দর্যবোধের স্থানটি ছিল একদম কেন্দ্রে। প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে তিনি মূলত যা দেখতে পেয়েছেন তা হলো সৌন্দর্য। তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন নিসর্গশোভা। তাঁর দৃষ্টিতে জগতের কোনো গাছ, কোনো ফুল, কোনো নদী, কোনো প্রাণী অসুন্দর ছিল না। প্রাকৃতিক জঙ্গল যেমন, তেমনই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা উদ্যান বা বাগানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল। উদ্যানের মধ্যে প্রাকৃতিক জঙ্গলের বিশৃঙ্খলা তাঁর ভালো লাগত না।
একই কথা প্রযোজ্য নগরের সৌন্দর্যায়ন কিংবা পথতরু রোপণের ক্ষেত্রেও। তিনি রমনা উদ্যানের অনেক গাছ কেটে ফেলার পরামর্শ দিতেন, কারণ সেগুলো উদ্যানের পরিপাটি সৌন্দর্যের পক্ষে বেমানান, কিংবা অন্যান্য গাছের জন্য ক্ষতিকর। নগরীর মধ্যে পথতরু লাগানোর ক্ষেত্রেও তিনি সুবিবেচিত পরিকল্পনার পক্ষে ছিলেন। কোথায় কোন গাছ লাগাতে হবে, কোন গাছের পাশে কোন গাছ লাগানো হলে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি নানা বিষয়ের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল।
তাঁর সৌন্দর্যবোধ সর্বাঙ্গীনভাবে মানুষের উন্নততর জীবনের আকাঙক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের পক্ষে তাঁর জোরালো অবস্থানের পেছনে কোনো রোমান্টিকতা ছিল না, ছিল অতি জরুরি বাস্তববুদ্ধি। মানুষের দ্বারা প্রকৃতির যথেচ্ছ শোষণ ও দোহনের মধ্যে তিনি মানব জাতির অস্তিত্বের সংকট দেখতে পেতেন। এর পেছনের প্রধান শক্তি হিসেবে তিনি প্রথমে চিহ্নিত করেন পুঁজিতন্ত্রকে। তারপর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়ও দেখতে পেয়েছেন প্রকৃতির যথেচ্ছ দোহন ও শোষণ। তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, বৈষয়িক উন্নতি তথা সীমাহীন ভোগবিলাসের লালসাই এই ক্ষেত্রে মূল সমস্যা। বৈষয়িক সম্পদ তথা আরাম-আয়েশের বৃদ্ধি ঘটাতে হলে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ শোষণ ও দোহন ছাড়া গত্যন্তর নেই – মানুষের এই দুর্বুদ্ধিই তাকে তার অস্তিত্বের সংকটে উপনীত করেছে এবং সীমাহীন ভোগলালসার লাগাম টানার আগ পর্যন্ত এই সর্বনাশা প্রক্রিয়া থামার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করতেন। প্রকৃতিকে জয় করা নয়, তাকে ভালোবেসে তার অংশ হয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর জীবনযাপনের দিকে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাঁর খুব প্রিয় একটা বই ফরাসি লেখক অতোয়ান দো সাঁৎ একঝুপেরির ছোট রাজকুমার; এ-বইয়ের মূল বাণী ভালোবাসা। মানুষ ও প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা দ্বিজেন শর্মাকে সুন্দর মনের অধিকারী করেছিল। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.