নারীর প্রজ্ঞা

ক. পৃথিবী নারীর। স্বর্গ পুরুষের

অনেককাল আগের কথা। গণিতবিদ পিথাগোরাস খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ সালের কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান গ্রীসের সাময় নামে একটি ছোট দ্বীপ। পরবর্তী সময়ে তিনি সাময় থেকে দক্ষিণ ইটালির ক্রিস্টিনা শহরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তিনি একটি ভ্রাতৃসংঘ গঠন করেন। তাঁদের প্রধান কাজ ছিল গাণিতিক চিন্তাধারার তত্ত্বঘটিত অভিমত তৈরি করা। তাঁরাই প্রথম আবিষ্কার করেন যে পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়, গোলাকার। কোনো নারী এই ভ্রাতৃসংঘের সদস্য ছিল না।

ড. কাজী মোতাহার হোসেন তাঁর ‘গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন : “পিথাগোরিয়ানরা জোড় বেজোড় সংখ্যার নামকরণ করেছিলেন। তাঁরা জোড় সংখ্যাকে স্ত্রী আর বেজোড় সংখ্যাকে পুরুষ বলে মনে করতেন। তাদের ভ্রাতৃসংঘের মেম্বর সকলেই পুরুষ ছিলেন। এজন্য স্বভাবতই বেজোড় সংখ্যাকে স্বর্গীয় আর জোড় সংখ্যাকে পার্থিব বলে গণ্য করা হতো। নিঃসন্দেহে তাঁদের ‘জোড় সংখ্যা’ বা নারী জাতি এতে কোনো প্রতিবাদ তোলেনি। অন্তত বেজোড় সংখ্যা যে পয়মন্ত, তা স্বীকার করতে ঐ যুগের নারী সমাজের দ্বিধা ছিল না।”

এর কয়েকশ বছর পরে পৃথিবীখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর Merry Wives of Windsor নাটকে বেজোড় সংখ্যা যে পয়মন্ত তা উল্লেখ করেন। এই নাটকের পুরুষ চরিত্র Falstaff-এর মুখ দিয়ে বলান : This is the third time. I hope good luck lies in odd numbers. Away! Go. They say there is divinity in odd numbers, either is nativity, chance or death.”

অন্যদিকে বাংলার সংস্কৃতিতে জোড় সংখ্যা নারী বলে উল্লেখ পাওয়া যায় খনার বচনে। যেমন: “বাণের পৃষ্ঠে বাণ/পেটের ছেলে গনে আন/ নামে মাসে

করে এক/সাতে হরে সন্তান দেখ/এক তিন থাকে বাণ/তবে নারী পুত্রবান/দুই চারি ছয়/অবশ্য তার কন্যা হয় / থাকিলে তার শূন্য সাত/হবে নারীর গর্ভপাত। ৩ এই বচনে দেখা যাচ্ছে জোড় সংখ্যা নারী। কিন্তু বেজোড় সংখ্যা পুরুষ দেখানো হলেও তা পয়মন্ত নয়। বলা হয়েছে ‘থাকিলে তার শূন্য সাত/হবে নারীর গর্ভপাত।’

খনা জ্যোতিষীর দৃষ্টিকোণ থেকে জোড় বেজোড় সংখ্যার ভালোমন্দ বিচার করেছেন। কিন্তু পিথাগোরিয়ানরা পুরুষতান্ত্রিক ধারণা থেকে নিজেদের স্বর্গের প্রতিনিধি বানিয়েছে এবং এককভাবে স্বর্গীয় সুখলাভের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে এটা বলা যায় যে গণিতের মতো জটিল শাস্ত্রকে যারা চর্চা করেছিলেন তারা দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছিলেন যে পৃথিবী নারীর। নারীরা এটা সানন্দে স্বীকার করেছিল। এজন্য পিথাগোরিয়ানদের সময়ের নারীরা জোড় সংখ্যায় কোনো আপত্তি করেনি। আপত্তি করার যে কথা নয় সে সময়কে নিয়ে যারা বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁরা নারীর মনোভাব বুঝতে চাননি। নারীদের বোঝার মতো পরিসর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রাখেনি।

নারী বুঝেছিল পৃথিবীর জীবন সমষ্টির, সবাইকে নিয়েই আনন্দ এবং ন্যূনতম বেঁচে থাকার জগৎ গড়তে হয়। সমষ্টির মঙ্গল কামনায় নারীর আর্তি বিশ্বজনীন। ইহজীবনকে কেন্দ্র করে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন নারীকে তাড়িত করে বলে স্বার্থপরের মতো ব্যক্তিগত সুখচিন্তায় নারী তার মানবিক ধারণাকে বদলাতে চায়নি। সঠিক পথেই নিজের বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।

পিথাগোরিয়ানদের সময়ের আগে থেকেই এই ছিল নারীর প্রজ্ঞা। এবং এখনও এই প্রজ্ঞা নারীর সম্বল। ইহলোকের প্রতি নারীর তৃষ্ণা নারীর প্রজ্ঞাকেই বিম্বিত করে। পার্থিব জীবনকে মঙ্গল ও সুন্দরের পথে পরিচালিত করার আহ্বান নারীর, যে জীবন একটি পরিপূর্ণ জীবনের সত্য, যেখানে অগণিত শিশু তাকিয়ে থাকে মায়েরই দিকে, যারা মানবজাতির টিকে থাকার ভবিষ্যৎ। এই প্রজন্মকে গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞাই নারীর।

নারীর এই প্রজ্ঞা থেকে নারী পারমাণবিক বোমায় বিধ্বস্ত হিরোশিমার শান্তিপার্কে বসে যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরে বলেন, “ওরা শুধু যুদ্ধ বোঝে, শান্তি না। নারী এমন একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারত না।’ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ইউক্রেন রাজ্যের চেরনোবিলে সংঘটিত ভয়াবহ তেজস্ক্রিয় দুর্ঘটনার পরে একজন মা বলেছিলেন, ‘পুরুষরা জীবন কি তা বোঝে না। ওরা বোঝে শুধু যুদ্ধ আর শত্রুকে জয় করা।’ তেজস্ক্রিয়তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দীর্ঘ বছর ধরে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল জাপানিদের জীবন। জন্মেছিল অসংখ্য বিকলাঙ্গ শিশু। আর চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর যে কথা শোনা যায় তা হিরোশিমার পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের চেয়ে আরো ভয়াবহ। বলা হয় এই দুর্ঘটনায় বিস্ফোরিত নানা ধরনের তেজস্ক্রিয় পদার্থের মধ্যে শুধু প্লুটোনিয়ামের রেডিওঅ্যাকটিভিটি অর্ধেক কমতে সময় লাগবে ২৪,০০০ বছর। প্রকৃতি ও জীবনের বিরুদ্ধে পুরুষ যে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয় তার বিরুদ্ধে প্রকৃতির এই নির্মমতা, অন্য অর্থে প্রতিশোধ গ্রহণ। চেরনোবিলের দুর্ঘটনা যুদ্ধ ছিল না, ছিল যুদ্ধের পূর্বপ্রস্তুতির সামগ্রী উৎপাদন। পুরুষ নিজের শ্রম ও মেধার এমন অপব্যবহার করে।

দেখা গেছে কখনো কোনো নারী রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পুরুষতন্ত্রের কাছে বন্দি হন। তার প্রমাণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁরই সময়ে ১৯৭৪ সালে ভারত পরমাণু শক্তির বিকাশ ঘটায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পরমাণু শক্তি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ভারত। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো প্রসঙ্গে ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করে লেখেন ‘পারমাণবিক বোমা নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’। এই প্রবন্ধে শান্তির পক্ষে, মানুষের পক্ষে তাঁর আবেদন ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। এ ক্ষেত্রে নারীর প্রজ্ঞা পুরুষতন্ত্রের কাছে নতি স্বীকার করেনি।

তারপরও যেতে হবে অনেকদূর।

. প্রজ্ঞার শাস্তি মৃত্যু

অনেককাল আগের কথা। লীলাবতী নামে এক নারী ছিলেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী এই নারী চাষাবাদ, গার্হস্থ্য জীবন ও পশুপালন সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেসব প্রজ্ঞা-বচন খনার বচন নামে এখন পর্যন্ত প্রচলিত। এই প্রজ্ঞার জন্য তাঁর জিহ্বা কেটে তাঁকে বোবা বানানো হয়েছিল বলে তাঁর নাম হয় খনা। ওড়িয়া ভাষায় ‘খনা’ অর্থ বোবা। খনাকে নিয়ে দুই ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একটি উড়িয়া ভাষায়, অপরটি বাংলা ভাষায়।

উড়িয়া ভাষার কিংবদন্তিটি এমন: রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্নসভার অন্যতম জ্যোতির্বিদ ছিলেন পণ্ডিত বরাহ। তিনি ভুলবশত তাঁর নবজাত সন্তানের অকালমৃত্যুর কথা গণনা করেছিলেন। সেই সন্তানকে একটি বাক্সে করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ভেবেছিলেন যে এভাবে সন্তানটি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতেও পারে। একই সময়ে আর একটি রাজ্যের রাজাসহ অন্য লোকেরা বিদ্রোহী রাক্ষসদের হাতে নিহত হন। বেঁচে যায় শিশু রাজকন্যা লীলাবতী। এই শিশু রাক্ষসদের হাতে প্রতিপালিত হতে থাকে। এদের হাতে নদীতে ভেসে আসা শিশুসহ বাক্সটি দ্বীপবাসীর হাতে পড়ে। তারা দুজনকেই লালন পালন করতে থাকে। বরাহের ছেলের নাম রাখা হয় মিহির। বড় হয়ে দুজনে জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শী হন এবং গোপনে বিয়ে করেন। পরে দুজনে ওই দ্বীপ থেকে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারা জ্যোতিষী গণনায় পালানোর নিরাপদ সময় বের করে সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষে চলে আসেন। লীলাবতী তাঁর গণনায় মিহিরের পরিচয় জানতে পারেন যে, ভারত- বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও উজ্জয়িনী নগরের রাজসভার পণ্ডিত বরাহ তার বাবা। দুজনে রাজসভায় গিয়ে তাদের পরিচয় দিলে অতীতের ঘটনা স্মরণ করে বরাহ পুত্র ও পুত্রবধূকে স্বীকার করে নেন।

ক্রমে জ্যোতিষশাস্ত্রে লীলাবতীর বিপুল জ্ঞানের কথা চারদিকে প্রচারিত হতে থাকে। লীলাবতী রাজসভায় আমন্ত্রিত হন। ঈর্ষায় পুড়তে থাকেন রাজসভার পণ্ডিতরা। সবচেয়ে বেশি ঈর্ষান্বিত হন লীলাবতীর শ্বশুর বরাহ। তিনি পুত্র মিহিরকে ডেকে নির্দেশ দেন লীলাবতীর জিহ্বা কর্তন করে তাকে বোবা বানিয়ে দিতে। পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ মিহির বাবার নির্দেশ পালন করতে দ্বিধা করেননি। তবে লীলাবতীর জিহ্বা কেটে ফেলার আগে তিনি লীলাবতীকে কিছু কথা বলার সুযোগ দেন। লীলাবতী কৃষি, আবহাওয়া এবং জীবনের নানা দিক সম্পর্কে অসংখ্য বচন বলে যান। এগুলো লোকমুখে প্রচারিত হয়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত টিকে আছে।

বাংলা কিংবদন্তিতে খনা লঙ্কাদ্বীপের রাজকন্যা। শুভক্ষণে জন্ম হয়েছিল বলে তাঁর নাম খনা রাখা হয়। লঙ্কাদ্বীপের অধিবাসী ছিল রাক্ষসরা। তারা একদিন খনার পিতামাতাকে হত্যা করে এবং খনাকে নিজেরা লালন-পালন করে। একই সময়ে পণ্ডিত বরাহের ভাসিয়ে দেওয়া কাঠের বাক্স থেকে দ্বীপবাসী রাক্ষসরা মিহিরকে উদ্ধার করে। দুজনই রাক্ষসদের কাছে প্রতিপালিত হয়। এখানে বলা হয় খনা বয়সে বড় ছিলেন এবং তিনিই মিহিরকে দেখাশোনা করতেন। পরবর্তী সময়ে দুজনে জ্যোতিষশাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। উড়িয়া কিংবদন্তির মতোই এই কিংবদন্তিও। তবে একটুখানি পার্থক্য এই যে বরাহ ওদের কথা বিশ্বাস করতে না চাইলে খনা একটি বচনের মাধ্যমে বরাহের গণনা ভুল প্রমাণিত করেন। পরের ঘটনা আগের কিংবদন্তির মতোই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা এককালে অব্রাহ্মণরা বেদ পাঠ করলে তাদের জিহ্বা কেটে ফেলার ঘটনা অবিশ্বাস করার যুক্তি নেই।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পণ্ডিতরা যথাযথ মর্যাদায় খনার মূল্যায়ন করেননি। অথচ সমসাময়িককালে খনার মতো এমন গভীর জ্ঞানের অধিকারী কেউ ছিল না। ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে সুদীর্ঘকাল ধরে তাঁর মতো এত সুপ্রিয় কেউ ছিলেন না। তারপরও নারী হওয়ার কারণে ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রের ইতিহাসে খনার নাম নেই। কেউ কেউ উল্লেখ করলেও সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেননি। দায়সারাভাবে এড়িয়ে গেছেন। কেউ কেউ মনে করেন, খনা তাঁর বচনগুলো সাধারণ মানুষের জন্য রচনা করেছিলেন বলে অভিজাত পণ্ডিতরা তাঁকে হেয় চোখে দেখতেন। কারণ অভিজাত পণ্ডিতরা তাঁদের জ্ঞানচর্চাকে নিয়োজিত রেখেছিলেন রাজকীয় কার্যকলাপের সীমানায়। অপরদিকে পরবর্তী সময়ের কোনো গবেষক খনাকে পুরুষ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কারণ একজন নারীর মুখ থেকে এমন অসাধারণ বচন নিঃসৃত হয়েছে এটা স্বীকার করতে তাদের কুণ্ঠা ছিল। খনার বচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক এমন যে অন্যদের বচনে যে নারী-বিদ্বেষ পাওয়া যায়, খনার বচন তা থেকে মুক্ত। এমনকি খনা পুরুষসংখ্যাকে চিহ্নিত করে তাকে পয়মন্ত বলেননি। বরং গর্ভের সন্তান বেজোড় সংখ্যা হলে নারীর গর্ভপাত হবে বলে উল্লেখ করেছেন।

খনার একটি বচন এমন: ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।’ লক্ষণীয় যে মাঘের শেষে বৃষ্টির সঙ্গে শস্যের ধারণাটিকে তিনি কত চমৎকারভাবে রাষ্ট্রশাসন এবং দেশের সুঅবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। একটি রাজ্যে শস্যের উৎপাদন ভালো হলে দেশের মানুষ খেয়ে-পরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে এবং রাজার সুশাসনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। সেই রাজাই ধন্য যিনি এমন পুণ্য দেশের শাসক। খনার এই বচনটিতে তিনি রাষ্ট্রশাসন এবং দেশের সুদিন-পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। এতেই মনে হয় তিনি সময়ের চেয়ে অগ্রগামী মানুষ ছিলেন এবং তাঁর দূরদৃষ্টি জীবন ও জগৎকেন্দ্রিক, সেটা কোনো কালের সীমায় আবদ্ধ নয়। সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে খনা রাজসভার পণ্ডিতদের বিরাগভাজন হওয়া সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে নারীকে তার আপন প্রজ্ঞায় স্থিত থাকতে বলেছেন। তাঁর একটি বচন এমন : মাঘ মাসে বর্ষে দেবা/রাজ্য ছেড়ে প্রজার সেবা’। কৃষি বিষয়ক ৰচন এমন: ‘খনা ডাকিয়া কন/ রোদে ধান ছায়ায় পান’। অপর একটি এমন : ‘আশ্বিনে উনিশ, কার্তিকে উনিশ বাদ দিয়ে যত পারিস কলাই বুনিস।’ কিংবা ‘বাঁশের ধারে হলুদ দিলে/খনা বলে দ্বিগুণ বাড়ে।

এভাবে বাংলার কৃষি, বাংলার কৃষক খনার বচন অনুসরণ করে চাষবাস করে বেঁচে থাকার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। কিন্তু তাঁকে বলি হতে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের কাছে দিতে হয়েছে অসাধারণ প্রজ্ঞার খেসারত।

পুরুষতন্ত্র নারীর প্রজ্ঞা দমন করতে চাইলেও দমিত হয়নি তা বরং নীরব বিপ্লবের মতো প্রবাহিত হয়েছে। নারী প্রমাণ করেছে মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এই প্রজ্ঞার অনুশীলন কত প্রয়োজন। আজকের দিনে অর্গানিক শাকশবজি ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কৃত্রিম সারের প্রয়োগে উৎপাদিত সবজি কতটা মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা আজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। দেখতে হচ্ছে পুরুষকে, তার আগে সর্বনাশটা ঘটিয়ে ফেলেছে। বিশ্বজুড়ে নারীরা আজ পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে, তাদের সহজাত বোধ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ধরিত্রীকে রক্ষা করার তাগিদে অনেক অঞ্চলের প্রায় নিরক্ষর নারীরা এগিয়ে এসেছে। এটা নারীরই ধর্ম- প্রযুক্তির ক্ষতিকর দিকের বিরুদ্ধে এবং মারণাস্ত্রময় সভ্যতার ধ্বংসাত্মক ভূমিকাকে প্রত্যাখ্যান করার তাড়নায় নারী তার ভূমিকাকে মুখ্য রেখেছে।

ভারতে নর্মদা বাঁধের বিরুদ্ধে মেধা পাটেকারের লড়াই চলছে দীর্ঘ বছর ধরে। ইকুয়েডরের দরিদ্র নারীরা সংগ্রাম করছে ম্যানগ্রোভ বন বাঁচানোর জন্য। পাহাড় নেপালি নারীদের জীবিকার ক্ষেত্র, পাহাড়কে তারা মাতা বলে। সেই পাহাড় থেকে চুনাপাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে হিমালয়ের কাছে বসবাসরত চিপকো আদিবাসী নারীরা। লুইস গিবস একজন নারী শ্রমিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের লভি ফ্যাকালে পারমাণবিক বর্জ্য নিক্ষেপের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির কৃষক নারীরা আন্দোলন করছে জার্মানির হুইল এলাকায় পারমাণবিক প্ল্যান্ট স্থাপনের বিরুদ্ধে। কেনিয়ার নারীরা করছে ‘সবুজ বন্ধনী আন্দোলন’ (Green Belt

সিইnt)। মিনসোতা উপসাগরীয় দুর্ঘটনা ঘটে জাপানে। জাপানের ক্লাবের নারীরা অ্যান্টি কনসিউমারিস্ট আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ৫ পুরুষরা সামগ্রিক ফলাফল বিবেচনায় না রেখে অনেক কাজ করেছে যেটা ধরিত্রীর জন্য সবসময় মঙ্গল বয়ে আনেনি। উল্টো খেসারত দিতে হয়েছে। মানবজাতিকে। তাই এভাবে নারীদের এগিয়ে আসা বিশ্বজুড়ে মানবজাতির পক্ষে অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

গ. নারীর বিবেচনায় ধর্ম ধর্মান্ধতা

একটি লোকগল্প। গল্পটি এখন থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমার মায়ের কাছে শোনা। প্রচলিত গল্পটি আমার মা বিভিন্ন সময়ে ধর্মের প্রসঙ্গে আমাদের শোনাতেন।

গল্পটি এমন “গ্রামের একজন সাধারণ ধর্মপ্রাণ কৃষক পুণ্যলাভের বাসনায় একজন মৌলবিকে প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থা করে তার বাড়িতে। মৌলবি ভাত খেতে বসে কিছু একটা তাড়াচ্ছে এই ভঙ্গিতে, যা-যা, দূর-দূর। ভাগ-ভাগ—করে চিৎকার করে। তার এই আচরণে কৃষক তো ভীষণ গদগদ। খুশিতে তার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাড়ির গৃহিণী দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন মৌলবির এমন আচরণ দেখে। তার ভুরু কুঁচকে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে। একদিন স্বামীকে প্রশ্ন করে, মৌলবি সাহেব এমন করেন কেন? কৃষক বিগলিত হয়ে বলে, তিনি অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। এখানে বসে দেখতে পান যে কাবা শরীফে কুকুর ঢুকছে। তাই তিনি তাড়িয়ে দেন। স্বামীর এই উত্তরে গৃহিণী খুশি হয় না। প্রশ্ন তার ভেতরে জেগেই থাকে। একদিন কৃষকের মাঠে কাজ থাকায় সে মৌলবির দুপুরের খাওয়ার সময় উপস্থিত থাকতে পারেনি। ফলে বাড়ির গৃহিণীকে খাবারের আয়োজন করতে হয়। সে তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য ভাতের ভেতরে মাছ-তরকারি দিয়ে থালা সাজিয়ে মৌলবির সামনে ছোট ছেলেকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়। মৌলবি দেখতে পান থালাভর্তি ভাত। সুতরাং সে তরকারির অপে অপেক্ষায় বসে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে তরকারি আসে না দেখে সে রেগে যায়। চিৎকার করে বলে, ভাত পাঠিয়ে আমাকে বসিয়ে রাখার এ কি তামাশা? কৃষক নেই দেখে বাড়ির বৌয়ের সাহস বেড়েছে! গৃহিণী তখন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বলে, যে মানুষ এখানে বসে কাবা শরীফে কুকুর ঢুকেছে দেখতে পান, তাঁর ভাতের ভেতরে যে মাছ-তরকারি ঢুকিয়ে দিয়েছি তা দেখতে পান না কেন?

আবহমানকালের গ্রামবাংলার নারী তার সচেতনতা ও সহজাত প্রজ্ঞা দিয়ে ভণ্ড ধর্ম-ব্যবসায়ীদের চিনতে ভুল করেনি। স্বামী যে ব্যক্তিটিকে চেনেনি পর্দার আড়ালে থেকেও গৃহিণী তাকে ঠিকই চিনেছে। ধর্ম নারীর কাছে পবিত্র বিশ্বাস। ধর্মান্ধতা দিয়ে এই বিশ্বাসকে কলুষিত করে পুরুষ। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যর্থতার কারণে মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে মূলত নারীকে কেন্দ্র করে এবং লোক সম্পূর্ণ নিজেদের মনমতো আদালত এবং রায় কার্যকর করার জন্য তাদের নিপীড়নের লক্ষ্য ও নারীসমাজ। রাষ্ট্রীয় আদালতের বাইরে এক শ্রেণির নিজস্ব পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, যারা ফতোয়াবাজ নামে চিহ্নিত হয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নারীর প্রতি ফতোয়া জারি করে নির্যাতন চালাচ্ছে। ফতোয়াবাজদের দৌরাত্ম্যের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যত নীরব বোধ, সচেতনতা এই কারণে ইতিবাচক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়নি। যার ভূমিকা এ ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্রের অনীহাকে সমর্থন দিচ্ছে। তাই নারীর সহজাত বিরুদ্ধে তার এমন কঠোর অবজ্ঞা সেই ধর্ম ব্যবসায়ী হিংস্র গোষ্ঠীর কাছে পরাজিত হয়েছে নারী।

নারীর বিরুদ্ধে অনবরত ফতোয়া দিয়ে সমাজে একটি নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি করেছিল গ্রাম্য মোড়লরা। ২০০১ সালের ১লা জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায়ে সব ধরনের ফতোয়াকে বেআইনি ঘোষণা করেছে। যে ফতোয়ার প্রেক্ষাপটে এই রায় ঘোষিত হয় সেই ঘটনাটি ঘটে নওগাঁ সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিখা গ্রামে। এই গাঁয়ের কিশোরী গৃহবধূ সহিদার স্বামী সাইফুল বছরখানেক আগে স্ত্রীকে তালাক উচ্চারণ করেছিল। তারা কেউই গ্রাম্য মোড়লদের কাছে বিচার প্রার্থনা করেনি। কিন্তু ফতোয়াবাজরা বিষয়টি নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। তারা বলে, তালাক উচ্চারণের পরে সহিদার দাম্পত্য সম্পর্ক অবৈধ। ২০০০ সালের ১৬ নভেম্বর তাকে জোর করে হিল্লা বিয়া দেওয়া হয়, থাকতে বাধ্য করা হয় অন্য একজন বিবাহিত লোকের সঙ্গে। সেই লোক হিল্লামতে তিন দিন পরে তালাক দেয়। ফতোয়াবাজদের এই গর্হিত কাজ সংবিধান ও ফৌজদারি আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। স্থানীয় প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। দেশের প্রচলিত আইনেই ফতোয়াবাজদের শাস্তি নেওয়া যেতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফতোয়াবাজদের

ধরনের দুষ্কর্ম কখনো কঠোরভাবে দমন করা হয়নি। হাইকোর্টের রায়ে প্রমাণিত হয়েছে যে সংবিধান অনুসারে কেবল আদালতই বিচার করা ও রায় দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, অন্য কেউ নয়। আদালত এসব অনুমোদিত ফতোয়াকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ গণ্য করে আইন প্রণয়নের জন্য জাতীয় সংসদের কাছে সুপারিশ করেছে। তবে যেতে হবে আরো অনেক দূর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় খুব সহজে নারীর মুক্তি নেই।

. রোকেয়া: দূরদর্শিতা প্রাগ্রসরতার বিস্ময়

অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ রোকেয়া শুধু নারী জাগরণের ক্ষেত্রে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে অবলোকন করেছেন নিজের সমাজ পরিধিকে। যেখানে নারী-পুরুষের দুর্বলতা দেখেছেন তার বিরুদ্ধে প্রায়শ তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করেছেন নারী ও পুরুষ উভয়কে। ধর্ম যে অতিপ্রাকৃত কোনো বিষয় নয় পুরুষ মানুষের সৃষ্টি একথা নানাভাবে তিনি দুঃসাহসের সঙ্গে বলেছেন। ধর্মের বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রিত জীবনের সারৎসার রোকেয়ার প্রজ্ঞা ও মননকে পুড়িয়েছে। নিজের জীবনে তিনি অবরোধের নামে ধর্মের অভিশাপ কুড়িয়েছেন, ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে হয়েছেন বঞ্চিত। তিনি জোর দিয়ে নারীর অর্থনেতিক স্বাধীনতার কথা বলেছেন, ‘ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।’ অন্যদিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন নারীসমাজকে। বলেছেন, ‘আমরা দুর্বলভুজা, মূর্খ, হীনবুদ্ধি নারী। সে দোষ কাহার? আমাদের। আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া হীনতেজ হইয়াছি।

১৯০৪ সালে, বাংলা ১৩১৩ সনের ভাদ্র মাসে নবনূর পত্রিকায় ‘আমাদের অবনতি’ নামের প্রবন্ধে যে তীক্ষ্ণ মন্তব্য তিনি করেছেন তা আজকের এ সময়েও এক দুঃসাহসী উচ্চারণ। কয়েকটি উদ্ধৃতি দেওয়া হলো।

১… ‘যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। অবশ্য নিশ্চয় বলা যায় না, তবে অনুমানে ঐরূপ মনে হয়। আমরা প্রথমত যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।

২… ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।

৩. … ‘পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, “তিনিই আপনাকে দেবতা বা ঈশ্বর প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন।’

৪.  … “তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। মুনিদের বিধানে যে কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুনির বিধানে হয়তো তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। …… যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।”

৫. …’কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধৰ্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?” তদুত্তরে বলিতে হইবে যে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছেন; ধর্মের দোহাই দিয়ে পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম’ লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এজন্য ধার্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।

রোকেয়ার প্রবন্ধটি যখন পরবর্তী সময়ে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তখন এই অংশগুলো প্রবন্ধ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সহজেই অনুমান করা যায় যে, হয়তো সামাজিক চাপই তাকে বাধ্য করেছে। তবে একথা সত্যি হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে ধর্ম নিয়ে এমন দুঃসাহসী লেখা তাঁর সময়ে কেউ লেখেননি।

বেগম রোকেয়া শুধু লিখেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি, স্কুল প্রতিষ্ঠা করে ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর আবেদন করেছিলেন, আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে দুস্থ নারীদের কাজের উপযোগী করে গড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে নারী জাগরণের শিখা প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছিল। বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে রোকেয়া বাঙালি মুসলিম মেয়েদের জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছিলেন।

তাঁর প্রজ্ঞায় আলোকিত হয়েছিল সেই সময়ের সমাজ, সে আলো পৌঁছেছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দুয়ারে।

. ইতিহাসের দরজায় করাঘাত

তিনি একজন নারী, গৃহবধূ। সন্তানের জননী। নিজস্ব কোনো পরিচয়ে পরিচিত নন। স্বামীর পরিচয়েই তিনি ছিলেন পরিচিত। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব।

আপাতদৃষ্টিতে তিনি সহজ সরল বাঙালি নারীর প্রতিনিধি, কিন্তু ইতিহাসের বিশেষ মুহূর্তে জ্বলে উঠেছিলেন আপন প্রজ্ঞায়। তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন আবহমান বাংলার মননশীল নারীদের একজন হিসেবে। তিনি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিয়ে সময়ের সাহসী সন্তানের ভূমিকা পালন করেছিলেন।

ষাটের দশক ছিল এই ভূখণ্ডের মানুষের আত্মঅধিকার অর্জনের লড়াইয়ের দশক। সে সময়ে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক আইয়ুব খান। তাঁর স্বৈরাচারী শাসনে নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত হয়েছে পূর্ব বাংলার মানুষ। তাই বাঙালির রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ৬ দফা কর্মসূচি’ লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলের সম্মেলনে পেশ করেন ১৯৬৬ সালে। এই কর্মসূচি পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর মাঝে বিস্ফোরণ ঘটায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে অভিহিত করতে থাকেন। আইয়ুব খান হুঙ্কার দিয়ে বলেন, ‘ইহা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি পরিকল্পনা।’ কিন্তু পূর্ববঙ্গবাসী নতুন উদ্দীপনায় জেগে ওঠে এবং স্বাগত জানায় ৬ দফাকে।

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হয় তা মুখে মুখে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত ছিল। ১৯৬৯ সালে এই মামলার বিচার চলাকালে প্রবল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। গণঅভ্যুত্থান এত ব্যাপক ও বেগবান হয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানতো বন্দি। তাঁকে বাদ দিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং প্রস্তাব আসে যে, আলোচনায় বসার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হোক। বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে যাবেন কিনা, এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক শুরু হয়।

এই সময়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত নৌবাহিনীতে কর্মরত জনাব আবদুর রউফ একই সঙ্গে কারাগারে আটক ছিলেন। ১৪ মাস কারাগারে আটক থাকার পরে তিনি গণঅভ্যুত্থানের ফলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তি পান। তাঁর বই থেকে বেগম ফজিলাতুননেসা মুজিব সম্পর্কে তাঁর প্রজ্ঞার বিষয়টি এখানে উদ্ধৃত হলো :

“কিছু সময় পরেই শুনলাম যে, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আরও শুনলাম যে, বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তের কথা ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। হতাশা ভারাক্রান্ত মনেও বৈকালিক আসরে যোগ দিলাম। সন্ধ্যার প্রাক্কালে সামনের রাস্তায় একটি গাড়ি এসে দাঁড়াতে দেখলাম। গাড়ি থেকে নেমে এলেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু উঠে গেলেন ও তাঁকে ভিতরে আসতে বললেন। কিন্তু বেগম মুজিব ভিতরে না এসে চিৎকার করে বলতে লাগলেন- ‘শুনলাম তুমি নাকি প্যারোলে যাচ্ছ। যদি তাই যাও তাহলে আমিই তোমার বিরুদ্ধে মিছিল করব। আর সেই মিছিলে তোমার পুত্রকন্যারাও থাকবে।’ এই কথা বলেই বেগম মুজিব দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

এই ঘটনার পর বঙ্গবন্ধু আরও বিপন্নবোধ করতে লাগলেন। মনে হলো, তিনি যেন আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পরদিন সকালে রেডিওর খবরে বলা হলো যে, বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিলে যোগ দিতে

যাচ্ছেন। এই খবর শুনেই তিনি চিৎকার করে রুম থেকে বের হয়ে বললেন, ‘ডাক তাদের… জিওসিকে খবর দাও। আমাকে জিজ্ঞেস না করে রেডিওতে নিউজ দিল কেন?’ সম্ভবত বেগম মুজিব চলে যাওয়ার পরেই বঙ্গবন্ধু প্যারোলে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাই হোক এভাবেই প্যারোলের প্রসঙ্গ শেষ হলো। এরপর বঙ্গবন্ধু প্যারোলে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন।’

বঙ্গবন্ধু প্যারোলে মুক্তি না নেওয়ার কারণে গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তীব্র আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল সর্বাধিক আসন লাভ করে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করে এখানে গণহত্যা শুরু করলেন। অবশেষে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।

সেদিন যদি তিনি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে যেতেন ইতিহাস কি হতো তা কেউ জানে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জনগণের দাবিকে সম্মান দেখিয়েছিলেন এবং স্ত্রী বলে শুধু নয় একজন নারীর প্রজ্ঞাকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মেনে নিয়েছিলেন। দেশের ইতিহাসের বাঁকে এটি একটি গভীর সংযোজন নিঃসন্দেহে।

. কালের কথা

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার কর্তৃক প্রকাশিত ও সম্পাদিত সৰ্ব্ব শুভকরী পত্রিকার জন্ম হয় ১২৫৭ সনের ভাদ্র মাসে। এখন থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে। এই পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার স্ত্রী শিক্ষা শিরোনামে যে প্রবন্ধ লেখেন সেখানে উল্লেখ করেছেন : ‘বিশ্বপিতা স্ত্রী-পুরুষের কেবল আকারগত কিঞ্চিৎ ভেদ সংস্থাপন করিয়াছেন মাত্র। মানসিক শক্তি বিষয়ে কিছুই ন্যূনাধিক স্থাপন করেন নাই।”

আবহমান বাংলার নারীর প্রজ্ঞাকে জ্ঞানবান, নীতিবান, সৎ, বিবেকসম্পন্ন পুরুষ এভাবে স্বীকার করেছেন। নারীকে অবদমন করতে চেয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কৌশল অবলম্বন করেছে তারা, যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। আজকে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সেক্স ও জেন্ডার সম্পর্কে ধারণা শিখতে হচ্ছে আমাদের। যেমন সেক্স হচ্ছে নারী-পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্যসূচক ভিন্নতা, যা অপরিবর্তনীয়। জেন্ডার হচ্ছে সামাজিকভাবে নির্ধারিত নারী-পুরুষের পরিচয় ও সম্পর্ক, যা পরিবর্তনযোগ্য।

এই কথাইতো বলেছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারসহ অনেক মনীষী। তাঁরা নারীর সেই মানসিক শক্তির কথাই বলেছেন, যেটা বিশ্বপিতা নারীকে কম দেননি। এই মানসিক শক্তি দিয়েই নারী দূর করতে পারে জেন্ডার-বৈষম্য। এখন নারী তার আপন যোগ্যতায় সমাজের হাজার জঞ্জাল সরিয়ে নিজের অবস্থান তৈরির সাধনায় ব্রত হয়েছে।

সহায়ক গ্রন্থ

১. গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস ড. কাজী মোতাহার হোসেন

বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭০।

2. The Complete Works of William Shakespeare, London ৩. খনার বচন, কৃষি ও বাঙালি সংস্কৃতি ড. আলি নওয়াজ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, ঢাকা, ১৩৯৬। ৪. পূর্বোক্ত।

৫. নারীর কথা

আবুল হাসনাত সম্পাদিত

মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০০১।

৬. রোকেয়া রচনাবলী

আবদুল কাদির সম্পাদিত

বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৩।

৭. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও আমার নাবিক জীবন- আবদুর রউফ

প্যাপিরাস প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২।