দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
মেয়েরা গল্প লিখছেন শুনে উনিশ শতকের প্রায় আশি শতাংশ পুরুষের মনোভাব ছিল ‘আরশোলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস নায়িকাপ্রধান, তাঁর নায়িকারা আত্মশক্তি এবং গরিমায় নায়কদের ছাপিয়ে গেছে। তারপরও বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত বলেছিলেন ‘নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না, স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়।’
বাংলার প্রথম আত্মকথার লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী স্বামীর ঘোড়াকে দেখে ঘোমটা দিতেন – উনিশ শতকে সংসারে নারীর অবস্থানের চিত্রটি ছিল এরকম। একবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পৌঁছেও পুরুষশাসিত সমাজের কতজন পুরুষ সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পারে? নানাভাবে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ, খাটো করার চেষ্টা করে থাকে পুরুষ। সাফল্যের কথা যদি বাদও দিই, মেয়েদের যে একটা আলাদা আইডেন্টিটি আছে, ধারণক্ষমতা আছে, নিজস্ব আকাক্সক্ষার জগৎ আছে, তারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, নারী জীবনের এই সহজ, সাধারণ সত্যকে পুরুষ অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই করে এসেছে চিরকাল। নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য আর অপমান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে আলবেয়ার কামু একবার সিমোন দ্য বোভোয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, নারীর পিছিয়ে থাকার কারণে পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ তারা উপযুক্ত সঙ্গিনী পায় না। উপযুক্ত সঙ্গিনীর অভাবের কথা বলেছিলেন কামু। নারীর উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে প্রতিবন্ধকতার কথা তিনি বলেননি। আর উপযুক্ত হলেও পুরুষতন্ত্র যে নারীকে নিুকোটিতে নামিয়ে রাখতে পছন্দ করে এ-কথা তিনি ভেবে ছিলেন কিনা জানি না।
নারীর প্রতি পুরুষের এই লাঞ্ছনা, অবমাননার একটি সামাজিক ভিত্তি আছে। দুই হাজার ৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন। অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে যুগের পর যুগ ধরে পুরুষেরা তোতাপাখির মতো একই কথা আউড়ে গেছেন। সমাজপতিদের দেওয়া অনুশাসন নারীর জীবন, স্বপ্ন, অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে বিকশিত হতে না দিয়ে যুগ-যুগ ধরে তাকে অন্দরমহলের অন্ধকারে আবর্জনার স্তূপে আবদ্ধ করে রেখেছে। মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সব পথ বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না। নারী প্রগতির এই সময়ে আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অগ্রগতি, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য, কৃতিত্ব রুখে দেওয়ার জন্য সদাতৎপর। দেশের শিক্ষিত শ্রেণি নিজেরাই পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আজও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। পুরুষ পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন এ-কথা বললে সমাজপতিরা ক্ষিপ্ত হবেন, কারণ সমাজটা আজও তাদের নিয়ন্ত্রণে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই তাদের এই কূপমণ্ডূক চিন্তাভাবনা প্রকাশ পায়। নারী আজ যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখছে, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, খেলাধুলা, সব রকমের পেশায় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে তখনও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল সম্প্রদায় নারীর বিকাশকে সর্বপ্রকারে স্তব্ধ করতে তৎপর। গত প্রায় ৫০-৬০ বছরে সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীকে হেয় করার প্রবণতা, নারীনির্যাতন, লাঞ্ছনা বেড়েই চলেছে। নারী ভোগের বস্তু, অতএব তাকে দখলে রাখতেই হবে। এখনো নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষে উপভোগ্যতাসাপেক্ষে। নারীকে দেখা হয় পুরুষেরর পরিপ্রেক্ষিতে। কুমারী হলে পিতৃপরিচয়, বিবাহিত হলে স্বামীর পরিচয়ে, প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের সমাজে নারীর পরিচয়ে পুরুষের পটভূমিকা অত্যন্ত জরুরি এবং আবশ্যক।
‘আরশোলার পাখি’ হওয়ার ইচ্ছা ব্যাপকভাবে না হলেও এদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েরা লেখালেখি শুরু করেছিল। সকলের দৃষ্টির আড়ালে, সারাদিনের কাজের শেষে অবসর খুঁজে তারা তাদের কথা লিখত। কেউ পড়বে – এই আশা নিয়ে হয়তো লিখত না। তাদের কুণ্ঠিত লেখালেখির আড়ালে হয়তো থাকত অন্তর্গত তাগিদ অথবা অবদমিত আত্মপ্রকাশের যন্ত্রণা। উনিশ শতকের সূচনাকালে এদেশে মেয়েরা ছিল শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কশূন্য, মানবিক প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত। কন্যাসন্তানের পৃথিবীতে আগমনকে শঙ্খধ্বনি দিয়ে কেউ স্বাগত জানাত না। অনাকাক্সিক্ষত জীবনের ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতো। ভালোভাবে কিছু বোঝার আগেই বিয়ে হয়ে যেত, কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হতো। আর কৈশোর না পেরোতেই শুরু হতো সন্তানের জন্মদান। নারীর জীবনের চাকা এভাবেই ঘুরত। রাসসুন্দরীর আত্মকথায় সেকালের নারীজীবনের এই চিত্র আমরা দেখতে পাই।
সভ্যতার পীঠস্থান ইংলন্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে-নারী শুধুমাত্র কলমের শক্তিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সচকিত, জাগ্রত করেছিলেন তিনি মেরি ওয়ালস্টোনক্র্যাফট (১৭৫৯-৯৭)। তিনি ছিলেন নারীমুক্তি এবং মানুষের মুক্তির প্রথম উচ্চকণ্ঠ, স্পষ্টভাষী প্রচারক। নারীমুক্তির প্রথম পথপ্রদর্শক। ইংলন্ডে এনলাইটেনমেন্ট যুগের চিন্তানায়ক। নারীশিক্ষা, স্বাধীনতা, নারীর অধিকার বিষয়ে প্রথম পুস্তকের লেখিকা হিসেবে ইতিহাসে মেরি সুনির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইউরোপের ইতিহাসে যে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল, টমাস পেইন (১৭৩৭-১৮০৯) ছিলেন তার পুরোধা ব্যক্তি। তাঁর নিজের জীবনে যেমন তেমনি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে তিনি স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রীর আদর্শ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণের সংগ্রামে। তাঁর দ্য এইজ অব রিজন (প্রথম খণ্ড ১৭৯৩, দ্বিতীয় খণ্ড ১৭৯৬) প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ তথা সমগ্র পৃথিবীতে তুমুল আলোড়ন তোলে। তার ঢেউ এসে লেগেছিল সাতসমুদ্দুর পার হয়ে কলকাতায়। হিন্দু কলেজের ছাত্র তথা ডিরোজিয়ানদের হাতে-হাতে তখন ঘুরত সে-বই। সেকালে তারা আট টাকা দিয়ে বইটি কিনতেও দ্বিধা করেননি। (ক্যালকাটা ক্রিসটিয়ান অব সার্ভার, আগস্ট ১৮৩২)
প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল যুগান্তকারী মহাশক্তিধর আরো একটি গ্রন্থ। বইটির নাম এ ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব উওম্যান। লেখিকা মেরি ওয়ালস্টোনক্র্যাফট। ১৭৯১ সালে লেখা হলেও বইটির সংশোধিত দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৭৯২ সালে। পশ্চিমের যে উন্নত দেশে বইটি লেখা হয়েছিল খোদ সেই ইংলন্ডের শিক্ষিত সমাজ বইটি প্রত্যাখ্যান করে। ৫০ বছর সময় লেগেছিল বইটির স্বীকৃতি পেতে। এই বইয়ের আগে মেরি ফরাসি বিপ্লবের সমর্থনে আরো একটি বই লিখেছিলেন। বই ঠিক নয়, পুস্তিকা বলাই ভালো, নাম এ ভিনডিকেশ্যানস অব দ্য রাইটস অব মেন (১৭৯০)।
ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মেরি ওই পুস্তিকায় লিখেছিলেন যে, সমাজ এবং রাষ্ট্রে দরিদ্র ও শোষিত জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জনসাধারণের নৈতিক দায়িত্ব সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলোৎপাটন করা।
ফ্রান্সে সেটা ঘটেছে, জনগণ সেটা পেরেছে বলেই জনগণের সেই বিপ্লব প্রতিটি সচেতন এবং বিবেকবান মানুষের সমর্থন আদায় করতে সমর্থ হয়েছে। মেরি বললেন, নারীজাতি সমাজের সংখ্যাগুরু অংশ, অথচ তারাই সব থেকে বেশি বঞ্চিত এবং শোষিত। নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি মেরির আগে কেউ কখনো উচ্চারণ করেননি। মেরিই প্রথম তাঁর লেখায় নারীর মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বললেন। দুশো বছরেরও আগে লেখা মেরির অসাধারণ বই ভিনডিকেশ্যান পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারা নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাসী তারা আজও বিস্মিত এবং অনুপ্রাণিত বোধ করেন। প্রায় একই সময়ে টমাস পেইন এবং মেরি ওয়ালস্টোনক্র্যাফটের যুগান্তকারী দুটি বই প্রকাশিত হলেও মেরিকে স্বীকৃতি এবং স্বাগত জানাতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিল পশ্চিমের বিদগ্ধ সমাজ। দুটি বইয়েই মানবতার জয়গান গাওয়া হয়েছিল, মানবজাতির সাম্য ও মানবিক অধিকারের প্রশ্নে দুজনই তাদের লেখায় সোচ্চার হয়ে ছিলেন। মেরি তাঁর বইয়ে বিশেষভাবে নারীজাতির কথা বলেছেন, তিনি দেখেছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে, রাষ্ট্রে, ঘরে-বাইরে নারীরাই সব থেকে বেশি শোষিত ও বঞ্চিত। কার্ল মার্কস প্রায় মেরির কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, কোন দেশ কত উন্নত তা দেখতে হলে আগে দেখতে হবে সেদেশের নারী এবং শিশুদের। তাদের এই উপলব্ধি আজও কত সত্য সময় এবং সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে তার বাস্তব চিত্র প্রতিনিয়ত আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয়।
মেরির অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বইটি সমাজ ও রাষ্ট্রের শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষের কাছে কেন সমাদৃত হলো না? কেন তাঁর স্বীকৃতি পেতে ৫০ বছরেও বেশি সময় লেগে গেল? কারণ বোধহয় একটাই। নারীর লেখা মূল্যায়নে পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গির প্রয়োগ।
মেরি ছিলেন দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। নিরন্তর তাঁর পরিবারকে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হতো। বাবা ছিলেন দায়িত্ব-জ্ঞানহীন বাউন্ডুলে প্রকৃতির মানুষ। রোজগারের কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। মায়ের ওপর বাবার নির্যাতন নিয়মিত ব্যাপার ছিল। ছয়টি সন্তানের জনক দায়িত্ব-জ্ঞানহীন বাবার অত্যাচার থেকে মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তেছিল মেরির ওপর। মেরি ছিলেন ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। অত্যাচারী বাবার ভয়ে মাকে সর্বদা কুঁকড়ে থাকতে হতো। নিয়মিত অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করতে করতে তিনি প্রতিবাদ-প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরিবারে সর্বদা এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে-যেতে প্রতি মুহূর্তে মেরি উপলব্ধি করছিলেন, পুরুষের তুলনায় মেয়েদের অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে। বাবার রোজগার না থাকায় পরিবারে সবার বড় সন্তান হিসেবে সংসার চালানোর জন্য মেরিকে পথে নামতে হয়েছিল। ফলে মেরির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি। মনে ছিল স্বাধীনতার চেতনা এবং জ্ঞানলাভের প্রবল ইচ্ছা। এই ইচ্ছাই তাকে শিক্ষিত এবং সচেতন করে তোলে। মেরি ছিলেন স্বশিক্ষিত। উনিশ বছর বয়সে মেরি ঘর ছেড়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মেয়েদের একটি স্কুল চালানোর চেষ্টা করেন। অভিজাত পরিবারে গভর্নেন্স কাজ করেন। রোজগারের বিভিন্ন পন্থার মধ্য দিয়ে যেতে-যেতে লেখাকেই তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন।
একজন নারী সে-যুগে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন – এ-ভাবনাটাই ছিল অবাস্তব এবং হাস্যকর। কল্পনাই করা যায় না। মেরি মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে লিখলেন, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাসও লিখেছিলেন, পত্রিকার জন্য লেখেন সমালোচনা এবং অনুবাদ। অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডে একলা একটি মেয়ে কলম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানাচ্ছে সমাজের শিক্ষিত সচেতন জনগণকে, ভাবতেও অবাক লাগে। মেরি বললেন, সমাজের সবচেয়ে শোষিত শ্রেণি নারী জাতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে তারা প্রতি মুহূর্তে নিগৃহীত হচ্ছে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীকে অবদমিত করে রেখেছে, জনগণই পারে সে-রাষ্ট্রব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করতে।
লেখার সূত্রে মেরি ইংলন্ডের তদানীন্তন র্যাডিক্যাল চিন্তাবিদ, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের সংস্পর্শে আসেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক নারী। সুদূরপ্রসারী ছিল তার চিন্তাভাবনা, নারী-পুরুষের সমঅধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থায় ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর লেখনী সক্রিয় ছিল সবরকম অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। মেরির কাছে প্যারিস ছিল বিপ্লবের তীর্থস্থান। বিপ্লবের শক্তিতে ছিল তাঁর অপরিসীম আস্থা। প্যারিসে গিয়ে তিনি কারারুদ্ধও হয়েছিলেন। ভিনডিকেশ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর ইংলন্ডের বিদগ্ধ সমাজ মেরিকে আখ্যায়িত করেছিল ‘A Hyena in Petticoat’ অর্থাৎ পেটিকোট পরা হায়েনা বলে। ভিনডিকেশ্যানে মেরি তাঁর যে বিশ্বাস ও আদর্শকে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা এতই বৈপ্লবিক ছিল যে, তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া কিংবা তাঁর যুক্তিকে খণ্ডন করতে এগিয়ে এলো না কেউই। উপরন্তু তাঁকে কাবু করতে না পেরে পুরুষ সবসময়ই নারীর বিরুদ্ধে শেষ যে-অস্ত্রটি প্রয়োগ করে মেরির বিরুদ্ধেও সেই অস্ত্রটিই প্রয়োগ করলেন তাঁরা। তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা, কলঙ্ক রটাতে দ্বিধা করলেন না তাঁরা। ভিনডিকেশ্যানের উৎসর্গপত্রে মেরি নারী স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। তাঁর সময়ের জন্য মেরি ছিলেন যথেষ্ট র্যাডিক্যাল। ঘোর রক্ষণশীল বিপ্লববিরোধী তৃতীয় জর্জের রাজত্বে বাস করেও মেরি বিপ্লবের পক্ষেই শুধু কথা বললেন না, নারীজাতির পক্ষে তিনি ঘোষণা করলেন, মেয়েরা জীবনে স্বাধীনতাকে মূল্য দিতে শিখুক। এটাই ছিল তাঁর মূল কথা। সংসারে নারীর ভূমিকা কী হবে সে-বিষয়ে ধর্মগ্রন্থে, নীতিশাস্ত্রে নারীর জন্য যেসব নির্দেশনা দেওয়া আছে এবং পরম্পরাগতভাবে পালিত হয়ে আসছে, সেসব যে প্রকৃতপক্ষে কত অমানবিক যুক্তি দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে সবাইকে সে-কথা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। সবার শুভবুদ্ধির কাছে আবেদন রেখেছিলেন এই মিথ্যা মনুষ্যত্ববিরোধী আইন-কানুনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য। মেয়েদের নারীত্ব আর পুরুষের ‘পৌরুষ’ নারী-পুরুষের সম্পর্ককে কখনো শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। মেরি বললেন, ত্যাগ করতে হবে এসব প্রচলিত কূপমণ্ডূক ধ্যানধারণা। পুরুষশাসিত সমাজ ও সংস্কৃতি নারীকে নির্বোধ, প্রশ্নবিমুখ, পরনির্ভর, দুর্বল, আত্মমর্যাদাবোধহীন করে রেখে শুধু মেয়েদের নয়, সমগ্র মানবসমাজের প্রভূত ক্ষতি করেছে – এ-ব্যাপারে মেরি ছিলেন নিঃসংশয়। বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন মেরি, তিনি চেয়েছিলেন স্ত্রী-পুরুষ সমঅধিকারের ভিত্তিতে বন্ধুতা। নারী নিজেকে বিলুপ্ত করবে না। সংসারের ঘূর্ণাবর্তে, মর্যাদা ও সম্মানের আসনে থেকে ক্রমাগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আত্মবিকাশের পথে এগিয়ে যাবে। সমাজে-সংসারে সম্মান ও আত্মমর্যাদার আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় স্বাবলম্বী হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখবে। মেয়েরা তাদের জীবনকে এই সাধনায় নিয়োজিত করবে – এটাই মেরির একান্ত কাম্য ছিল ভিনডিকেশ্যান নারীমুক্তির প্রথম পূর্ণাঙ্গ ঐতিহাসিক দলিল যাকে অনেকে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন।
মেরির মানবিক আহ্বানকে অসম্মানের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাঁর সমসাময়িক সমাজ। তাঁর এই আহ্বান ইংলন্ডের নারীসমাজের মধ্যেও সেদিন কোনো সাড়া তুলতে পারেনি। এমনকি সমাজ সংস্কারের সঙ্গে যেসব নারী সম্পৃক্ত ছিলেন কিংবা নারী ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রীরাও মেরির বৈপ্লবিক মতামতকে গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধা এবং সঙ্কোচে ভুগেছেন। ভিনডিকেশ্যান প্রকাশের এক শতাব্দী পর নৈরাজ্যবাদী এমা গোল্ডম্যান দীর্ঘদিনের অবহেলিত মেরিকে ‘আধুনিক নারীত্বের প্রথম প্রবক্তা’ বলে আখ্যায়িত করেন। স্বশিক্ষিত মেরি অবহেলা আর অসম্মান সত্ত্বেও নিজের বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন।
স্বাধীন, স্বনির্ভর কোনো নারী আজও যদি তাঁর মুক্তবুদ্ধির নির্দেশ অনুযায়ী বাঁচতে চান তবে তার বিরুদ্ধে কুৎসা, কলঙ্ক ছড়াতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজও কি পিছিয়ে থাকে? তসলিমা নাসরিনকে দেশ ছেড়ে নির্বাসনে যেতে হয়। তিনি তাঁর নিজের মতো বাঁচতে চেয়ে পারেননি। সংসারে পিতার অত্যাচার প্রত্যক্ষ করতে-করতেই বিবাহের ওপর বিরূপ মনোভাব জন্ম নিয়েছিল মেরির মনে। বিবাহ নয়, সমঅধিকার, সমমর্যাদা, পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের বন্ধুতার যে সম্পর্ক তাকেই তিনি নারী-পুরুষের আদর্শ সম্পর্ক বলে মনে করেছিলেন। যে কোনো দেশে বঞ্চিত, শোষিত, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগুরু অংশ নারী – নিজের জীবনের উপলব্ধির আলোকে নারীর পক্ষে তাঁর এই অবস্থান পুরুষের সমর্থন পায়নি। উপরন্তু নানা ব্যঙ্গাত্মক বিশ্লেষণে তাঁকে ভূষিত করা হলো। বেঁচে থাকতে জীবনে সম্মান, সামাজিক প্রতিষ্ঠা কিছুই পাননি মেরি। ভিনডিকেশ্যানে স্পষ্ট ভাষায় তিনি লিখেছিলেন, কোনো একজন বিশেষ পুরুষের প্রতি আনুগত্য কিংবা আসক্তি নারীর স্বাধীনতা, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মমর্যাদাবোধের পথে প্রধান বাধা, বিবাহবিরোধী ছিলেন তিনি। বিপ্লবী মেরি শেষ পর্যন্ত প্রেমের শক্তির কাছে হার স্বীকার করেছিলেন। গিলবার্ট ইমলে নামে যে-লোকটিকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন সে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করা ছাড়া আর কিছুই করেনি। ইমলে ছিল বিবেকবোধহীন, ধূর্ত এক প্রেম-ব্যবসায়ী। তিনি ইমলেকে গভীরভাবে ভালোবেসে ছিলেন। ইমলের লাম্পট্য এবং অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মেরি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন।
বন্ধু র্যাডিক্যাল দার্শনিক উইলিয়াম গডউইন তাঁর সে-চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যে-বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন মেরি নিজেই সে-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ায় এ-কথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, তাঁর জীবনে ভালোবাসার অভাবই তাঁকে প্রেমের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল। গডউইনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলেও দুজনই আদর্শগতভাবে ছিলেন বিবাহের বিরোধী। মেরি এবং গডউইন তাঁদের জীবনযাত্রার মধ্যেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তিত্বকে ধরে রেখেছিলেন ঠিক যেমন রেখেছিলেন জাঁ পল সার্ত্র এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার।
মেরির সময়কাল ইংলন্ডে শিল্পবিপ্লবের সূচনা এবং প্রসারের সময়কাল। শিল্পের ব্যাপ্তি এবং জ্ঞানচর্চা মানুষকে নূতন নূতন চিন্তাভাবনায় সমৃদ্ধ করছিল। বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞানের তথ্য সংগৃহীত হচ্ছিল। সময়টা ছিল রাজার বদলে আইনের রাজত্ব এবং পুরোহিতদের আধিপত্যের পরিবর্তে যুক্তি এবং বিবেকের আধিপত্যের যুগ। এনলাইটেনমেন্ট এবং এজ অব রিজনের এই সময়ে মেরি যে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটালেন তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে ইংলন্ডের বিদগ্ধ সমাজের কাছে তা গৃহীত তো হলোই না উপরন্তু বিরূপ এবং ব্যঙ্গাত্মক সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয় তাঁকে। টমাস পেইনের সাম্য ও মৈত্রীর বাণী যে সাড়া জাগিয়েছিল, যদিও ইংলন্ডে তাঁর বিরোধিতা করার মতো মানুষেরও অভাব ছিল না, বিখ্যাত বক্তা এডমন্ড বার্ক ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মেরি বার্কের প্রগতিবিরোধী প্রতিক্রিয়ার সমর্থনে লেখা বইয়ে এর কড়া জবাব দিয়েছিলেন। তাঁর লেখনী সকলের মনকে স্পর্শ করেছিল। এরপরই প্রকাশিত হয় ভিনডিকেশ্যান। যে-কোনো লেখায় আলোচনা-সমালোচনা হওয়াই স্বাভাবিক। সমালোচনার নামে লেখককে যদি বিদ্রƒপ আর ব্যঙ্গে বিদ্ধ করা হয় তবে তা সৌজন্য, শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে। মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে মেরি তাঁর শ্রম, সাহস, সততা দিয়ে যে অসাধারণ কাজ করে গেছেন পুরুষশাসিত সমাজ তার কোনো মূল্যায়ন করেনি, বেঁচে থেকে তিনি অপমান আর অপবাদ পেয়ে গেছেন। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণিত হওয়ার পর আজও নারীর শরীরে লেপ্টে থাকে ‘Frailty thy name is woman..’ ধারণাটা পুরুষ নারীর মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছে। নিজের অজান্তে নারীর মনেও এই বিশ্বাস গাঁথা হয়ে গেছে। নারী বৃত্তে বন্দি প্রাণী, তার দৃষ্টির সীমানা সংকীর্ণ, মেধাচর্চার চাইতে ঘর-গেরস্থালি, সন্তানের জন্মদান আর প্রতিপালনেই তার জীবনের সার্থকতা – পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে এভাবেই দেখতে চায়। নারীও নিজেকে এই জীবনে মানিয়ে নেওয়ার জন্য জন্মের পর থেকে তৈরি হয়। মেয়েদের অসহায় নীরবতার আড়ালে থাকে যন্ত্রণা আর অপমান। নীরব সেই যন্ত্রণা তাকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করে। ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১) বলেছিলেন, ইতিহাসের অজানা চরিত্রটি হলো নারী। পুরুষ কখনো নারীকে জানার, বোঝার চেষ্টা করেনি। নারীও নিজেকে বুঝতে চায়নি। আত্মপরিচয় আবিষ্কারের চেষ্টা কমেনি। পৃথিবীর অনেক দেশে আধুনিক শিক্ষার প্রসারের ফলে সমাজের অনেক ক্ষেত্রেই নারী আজ অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু সামগ্রিক বিশ্ব-পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখতে পাই অধিকাংশ দেশে আজও নারী দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়েই আছে।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই আধুনিক চিন্তাভাবনা আমাদের দেশেও মেয়েদের মনে প্রবেশ করছিল। বেগম রোকেয়ার আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক বিস্ময়কর ঘটনা। উনিশ শতকের শেষ দিকে জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন বেগম রোকেয়া (১৮৮০)। পিতা মেয়ের শিক্ষার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। রোকেয়ার যা কিছু শিক্ষা সবই বড় ভাইয়ের কাছে। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে মেরির জীবনের কোথাও-কোথাও কিছু মিল পাওয়া যায়। মেরি আর রোকেয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১০০ বছরেরও কিছু বেশি হলেও মেরি যেমন তাঁর সময়ের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন, রোকেয়াও তাই। দুজনই লেখনীর মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন, দুজনেরই লেখার বিষয় ছিল নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা এবং সমাজে নারীর অবস্থান। মেরির ব্যক্তিজীবন সুখের ছিল না, যে বৈপ্লবিক বিশ্বাস এবং আদর্শের কথা তিনি বলেছিলেন নিজের জীবনে তার বাস্তবায়ন করতে পারেননি। বেগম রোকেয়ার ব্যক্তিগত জীবন কি সুখের ছিল? দোজবর স্বামী, বয়সে তাঁর চাইতে ২২ বা ২৪ বছরের বড়, চিরঅসুস্থ, মাত্র নয় বছরের দাম্পত্য জীবন। অবরোধবাসিনীর লেখিকা নিজেও অবরোধমুক্ত হতে পারেননি। পুরুষের সঙ্গে কথা বলার সময় মাঝখানে রাখতে হতো পর্দার আড়াল। মেরিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। রোকেয়াকে সেই অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়নি। পুরুষতন্ত্র স্বীকৃতি না দিলেও নারীমুক্তির আন্দোলনের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে তাঁর লেখাকে সমাজ ও রাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছিল। মেরি এবং রোকেয়া দুজনই নারীজাতির জন্য শাস্ত্র-নির্দেশিত প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ধর্মগ্রন্থ, নীতিশাস্ত্র, লোকাচারের মাধ্যমে যেসব ধারণা পরম্পরাগতভাবে প্রচলিত সেসব যে মনুষ্যত্ববিরোধী, দুজনই তাদের লেখার মধ্যে দিয়ে সে-কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। প্রথম গ্রন্থ স্ত্রী জাতির অবনতি গ্রন্থে রোকেয়া লিখেছেন, ‘আমাদের যথাসম্ভব অবনতি হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনো মাথা তুলিতে পারি নাই তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে, যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে।… যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি।… আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।
তবেই দেখিতেছেন এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধিব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। রোকেয়ার এই সাহসী উচ্চারণ, বৈপ্লবিক ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ উঠেছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় তাঁর লেখার কিছু অংশ বাদ দিয়ে ছাপাতে হয়। মেরির বক্তব্যে আধুনিকতার সে প্রবল প্রকাশ তার সূচনা হয়েছিল ইউরোপে রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে। মেরি নারী-পুরুষের সাম্য বিশেষভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেছিলেন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এবং বিশ্বাসের সঙ্গে প্রচুর লড়াই করার পর সেখানে কিছুটা হলেও তার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। রোকেয়া মেরির মতোই নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনার প্রাক্কালে বাংলায় সমাজ এবং রাষ্ট্রে নারীর অবস্থানের প্রকৃত স্বরূপটি নির্ণয় করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সাত দশকেরও বেশি আগে ভার্জিনিয়া উলফ নারীর সাহিত্য মূল্যায়নে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির যে-প্রয়োগ লক্ষ করেছিলেন তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। উপন্যাস ও নারী বিষয়ে নির্ধারিত দুটি বক্তৃতার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে ব্রিটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরিতে গিয়ে প্রতিটি বুক শেলফ তন্নতন্ন করে খুঁজে, প্রতিটি বইয়ের পাতা উলটেপালটে পড়ার পর নারী-বিষয়ে পুরুষ-রচিত বইগুলোর মধ্যে তিনি যা পেয়েছিলেন তা হলো, নারীর প্রতি ঘৃণা, অবজ্ঞা আর অবহেলা। ভার্জিনিয়া বলেছেন, নারীর মূল্যবোধ পুরুষের তৈরি করে দেওয়া মূল্যবোধ থেকে স্বাভাবিকভাবেই আলাদা। পুরুষ যখন যুদ্ধ বিষয়ে বই লেখে, তখন সে-বই সমালোচকের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ, অন্দরমহলের নারীদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে লেখা বই স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বহীন। অথচ এসব মূল্যবোধই তো অবধারিতভাবে সাহিত্যে প্রতিস্থাপিত হয়। চারশো বছর আগেকার ইংলন্ডের নারীদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে ভার্জিনিয়া দেখিয়েছেন কেন এই দীর্ঘকালের মধ্যে কোনো নারী অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির কোনো নজির সৃষ্টি করতে পারেননি। ভার্জিনিয়া বলছেন, নারী দীর্ঘদিন লেখার কোনো সুযোগই পায়নি। দীর্ঘকাল তারা কিছুই লেখেনি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নারীদের মতোই এরপর বিলেতের নারীরাও স্মৃতিকথা, আত্মকথা লিখতে শুরু করলেন। ভার্জিনিয়া দেখেছেন সেসব লেখায় নারীর মনে পুরুষের তৈরি করে দেওয়া প্রবল বিদ্বেষ এবং তিক্ততার প্রকাশ ঘটেছে। পুরুষের তৈরি এই ভয় ও ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়ে সবরকম তিক্ততা আর বিদ্বেষ ভুলে মুক্ত মনে নারীর লিখতে সময় লেগেছিল আরো এক শতাব্দী। তার আগে পর্যন্ত লেখার জন্য নারী দুটি পথ বেছে নিয়েছেন, হয় তিনি খুবই বিনীতভাবে শুধুই একজন নারী অথবা তার লেখায় প্রতিবাদী সুর – যেমন তিনি সব বিষয়ে পুরুষের সমান যোগ্যতার অধিকারী। ভার্জিনিয়া জেন অস্টেনের উল্লেখ করেছেন। নারীর প্রতি বিরুপ-সমালোচনা, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বাস করেও বিন্দুমাত্র বিচলিত কিংবা সংকুচিত না হয়ে নিজের অবস্থান এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে অবিচল থেকে যাঁরা লিখলেন তাঁদের মধ্যে প্রধান ভূমিকা জেন অস্টেনের।
গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল থেকে নাদিন গর্ডিমার, – চিলি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, নারী আজ লেখনীর শক্তিতে মুক্তবিহঙ্গ হয়ে ডানা মেলেছে আকাশে। নারী লিখছে, মানুষ পড়ছে, লেখার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আর সম্মান আদায় করে নিচ্ছে। তারপরও নারী কি পুরুষের কাছে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পেরেছে? নাকি আজও শুধুই ঘরশোভা, গৃহসজ্জার উপকরণ। আধুনিক এক নারীকবির লেখনীতে নারীর সেই ছবিটি চিত্রিত হয়েছে।
বুকের ভেতর মেদুর দুপুর বুকের ভেতর বাজপাখি
আকাশগঙ্গা উথাল পাতাল যখন তখন বানভাসি
হাজার কণা দুঃখদানা দুঃখ খোঁটে চড়াইটি
মেয়ে যেন মানুষই না অবলা ওই ঘাস মাটি।
ঝুপ্ ঝুপ পাড় ভাঙছে কেউ শোনেনি কান পেতে
অকাল ও অজন্মা এল পঙ্গপালও ধানক্ষেতে
পাখিরা কই? শস্য ফসল, বুকটি ফাটা, হাঁ খোদল
হাঁপিসে করে মৎস্যনারী, শুকিয়ে গেছে রাজ্যিজল।
কেউ কি এল? কেউ কি আসে? আমার আশায় একলা সে
কান্নারা তার শিশির ঝুরোয় ঝরাল শ্যামল নীল ঘাসে
বর্গি এল, ভাবল মেয়ে সঙ্গী পেল পক্ষীটি
এক চুমুকে তৃষ্ণা খেল, চুপ সে মেয়ে লক্ষ্মীটি।
অহর্নিশি অশ্র“রা তার মুক্তো হল কি ইচ্ছায়
সারাটি দিন জ্যান্তে মরা রাতটি এলেই জিয়ন পায়
বোবা মেয়ের চোখ দুটিতেই সাগর এসে জল ঢালে
নদী নদী নোনতা নদী পা বাড়াল পাকশালে।
পাখি জাগে কি সূর্যটা বুকের গভীর জল ডোবা
একটি পাথর পরির শরীর দাঁড়িয়ে থাকে ঘরশোভা।
(কাব্যশ্রী ভট্টাচার্য বক্সী)
কবিতাটির দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিলাম কারণ এখনও আমাদের সমাজে, সংসারে নারীর সাধারণ অবস্থান এমনই। একেবারেই নামিদামি নয় এমন একজন নারীকবির উপলব্ধি তাকেই শব্দে সাজিয়ে প্রকাশ করা নারীর অবদমিত চিত্রটা এখনো এমনই আছে। নরীর লেখা, পুরুষের মূল্যায়ন – সমাজে নারীর অবস্থানের বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত। নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যে-কলুষতা, হীনতা তাকে দূর করা শুধু ব্যক্তিগত বিদ্রোহে সম্ভব নয়। মেরি পারেননি। রোকেয়া পারেননি। এই হীনতা দূর করতে চাই সচেতন মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস।
নারী এগিয়েছে অনেক, এখনো তার অনেকটা পথ অতিক্রম করা বাকি। মেয়েদের অধিকার, সামাজিক মর্যাদা আদায়ের জন্য যে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছে তার একটি কারণ সম্ভবত মেয়েদের সমস্যার উৎস কোথায় মেয়েরা নিজেরাই তা জানত না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের শাসনে থাকতে থাকতে সমাজে তার প্রকৃত অবস্থান কী সে-ব্যাপারে তার ধারণা ছিল না। সে আসলে কী চায় বুঝতে পারেনি। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, শাস্ত্র এবং লোকাচার-শাসিত সমাজ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীকে বঞ্চিত করেছে তার মানবিক অধিকার থেকে, ঠেলে দিয়েছে অন্তঃপুরের অন্ধকারে, সমাজে, পরিবারে সর্বত্র তারা অসাম্য আর নিষ্ঠুর নির্যাতনের বলি হয়েছে। আজকের নারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সমস্যা। জৈবিক কারণে নারী ও পুরুষের সামাজিক অবস্থান এবং ভূমিকা আলাদা হতে বাধ্য। নারীত্ব নারীর জন্মগত পরিচয়। এই পরিচয় নারীকে আজন্ন বহন করে চলতে হয়। নারীত্ব নারীর শারীরিক ও মানসিক গুণ যা পুরুষের সঙ্গে তার পার্থক্য গড়ে তোলে। জৈবিক যে-কারণটি নারীকে পুরুষের থেকে নিুকোটিতে নামিয়ে রাখে সেটি হলো তার ধারণক্ষমতা। নারী সন্তান ধারণ করে। এই একটি মাত্র প্রাকৃতিক ঘটনাই পুরুষকে কোথাও কোথাও বাড়তি সুবিধা দেয় যা নারী পায় না। নারীর এই শরীরকেন্দ্রিক ব্যাপারটিকে পুরুষ কাজে লাগায়। নারীর শরীরকে কাজে লাগিয়ে সে কিছু বাড়তি সুবিধা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। এ যাবৎকাল সবকিছুই পুরুষের স্বার্থে, সমাজ-ক্ষমতা সবকিছুই পুরুষের হাতে, পুরুষের প্রয়োজনে হয়ে এসেছে, নারীর জন্য শুধুই থেকেছে গৃহকোণ। পুরুষতন্ত্র কখনো নারীকে বুঝতে দেয়নি পরিবার এবং সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকা সমান।
নারী আজ নিজের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে খুঁজে নিতে চাইছে সঠিক পথে চলার দিশা। একদিন সে-পথ সে তৈরি করে নিতে পারবেই। শেষ করতে চাই একালের এক নারীর নিঃসঙ্কোচ দৃপ্ত উচ্চারণ দিয়ে – ‘অবমাননা থেকে মুক্তির দায়িত্ব নারীকে নিজেই নিতে হবে। অচেতন জড়ত্বের অবমাননা থেকে বেরিয়ে এসে পালন করতে হবে সচেতন অস্তিত্বের ভূমিকা। হোক সে-ভূমিকা সংঘাতময়, হোক সে-ভূমিকা আত্মকেন্দ্রিক। প্রজাতির প্রতি পরিপূর্ণ নিবেদন থেকে অব্যাহতি নিয়ে ব্যক্তিগত বিকাশে মনোযোগী হতে হবে। সমতুল্য হয়ে উঠতে হবে সচেতন অস্তিত্বের। মুছে ফেলতে হবে অমর্যাদার চিহ্ন।’ (স্বাতী ঘোষ : নারী-প্রান্তিকতার সন্ধানে, নারী পৃথিবী, বহুশ্বর, স. বাসবী চক্রবর্তী)
কৃতজ্ঞতা
মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, হার লাইফ অ্যান্ড টাইমস, Her Life and Times এডনা নিকসন, জেএম ডেন্ট অ্যান্ড সনস লিমিটেড লন্ডন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.