না-স্বপ্ন না-স্মৃতির সারাজীবন

এক

জানালা দিয়ে তাকালে অনেক দূর অবধি দেখা যায় – দূরের বিমানবন্দর কি বায়ুযানের ওঠানামা। কাচের জানালাঘেরা দশতলার ঘর আমার পদধারীর জন্য। আগে এই ঘরে যার স্থান ছিল, তার জারগায় এখন আমি। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রতিষ্ঠানের – নানা কারণে সকলে সম্মান করে, জানি কেবল পদমর্যাদার জন্যেই নয় – আমার অন্য কিছু পরিচয়ও আছে। তবুও সময়ে সবই হয়। বেশ কয়েক বছর এই প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হিসাবে অবসর নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল আগেই তবুও আমাকে যেতে হয়নি। যদিও জানি এরকম অস্থির দিন কাটে না।

যাঁরা আমার ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসলেন, তাঁরাও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাই। ভিন্ন বিভাগের। বিনয়ের শেষে তাঁদের কর্তব্য এটি জানিয়ে বলেন, আমি কি অবসর নেওয়ার সময়ের কথা জানি না!

জানি নিশ্চয়ই, বলি তাঁদের। আপনারা যেমন চাইবেন তেমনি হবে। ওঁকে বলে দেবেন। অস্থায়ী ঘর ভেঙে চলে যাওয়া কতোই না সহজ, এ-কথা সবাই জানে।

 

দুই

বাল্যের কিছু স্মৃতি আছে আমার যদিও আমি ধ্রম্নব জানি, সেসবই স্বপ্ন। যেমন, দশ গ্রামের মাঝখানে গঞ্জের হাটই তো, সেখানে রাজপ্রাসাদ কি তার তোরণ, যেখানে রৌশনচৌকি বাজে, দেখা যাবে কী করে? মাত্র একদিনই সেই হাটে যাওয়ার কথা মনে পড়ে। নদীর পাড় ধরে, ভাঙনে ঘোলা পাকখাওয়া স্রোত দেখে হাটে পৌঁছলে বাবা একটি দোকানে বসিয়ে রেখে যান। ঘুরেফিরে বেড়ানোর কথা মনে পড়ে না। অথচ চোখ বুজলে দেখি সুবিশাল হাটের মাঝখানে প্রশস্ত রাস্তা, দুপাশে সারিবদ্ধ সুসজ্জিত দোকানপাট এবং সেই রাস্তার শেষে দেখা যাচ্ছে নহবত অথবা প্রাসাদচূড়াই বুঝিবা – পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝকঝক করে। এই স্মৃতি তাহলে স্বপ্ন ছাড়া কি? এক রাত্রিশেষের কথা মনে পড়ে। নদীতীরে বসা আমরা, অন্ধকারে। কেন বসা, কোনখানে, কোন শহরে কি গ্রামে, গঞ্জে কিছু মনে পড়ে না। আমার মা পাশে, বড় বোনও। আর চোখ বুজলে দেখি মা ঝুড়ি থেকে লিচু তুলে দিচ্ছেন আমার হাতে। চার বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি আমি এবং তাঁর মৃত্যুর পূর্বে বোনের সঙ্গে কোথাও গেছিলাম এরকম কখনো শুনিনি। এটিও স্বপ্নই হবে নিশ্চয়।

আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে ছিল থানা শহর। এই কিছুকাল আগেও দেখে এসেছি সম্পূর্ণ গ্রাম দিগ্বলয়ে সোনালি ঢেউ মাথায় নিয়ে অতল জলের নিচে। গ্রামের যে সামান্য অংশ রয়ে গেছে তা থানা শহরের লাগোয়া প্রায়। তাহলে কেন মনে পড়ে রোদভরা বিকেলে বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে থানা শহরে পিসিমার বাড়িতে পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যারও পরে? কখনো মনে হয়, সেই রাত্রিতেই আমি বাড়ি ফিরেছিলাম বাবার সঙ্গে। অনেক রাত্রিতেই। আর থানার সামনে দিয়ে চলে যাবার সময়ে গুমটি ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দারোয়ান গেয়েছিল, ‘নৈকট কৈসান’। কোন ভাষা সেটি?

আবার মনে পড়ে, ঘরে যখন ফিরেছিলাম আমরা – আমি, ছোড়দি, বেড়াতে আসা  মামারা, বাবা; তখন আকাশে চাঁদ। রাস্তা থেকে চাঁদের আলোয় মাঠ পার হয়ে জ্যোৎস্নার জাফরিকাটা আম-কাঁঠালের বাগান পেরিয়ে যখন বাড়ির সীমানায় পৌঁছেছিলাম তখন অনেক রাত্রি। অথচ কোনোদিন কোনো মামার সঙ্গে থানা শহরে যাওয়া হয়েছিল শুনিনি।

আমাদের বাড়ি ছিল নদীতীরে প্রায়, এ-কারণেই আমাদের ঘরকটি, আম-কাঁঠালের বাগানসহ নদীগর্ভে যায় প্রথমে। সেই নদীর অপর পাড়ে একটি মসজিদ ছিল বলে মনে পড়ে, এ-পার ও-পার অনেক বিসত্মৃত হলেও স্থাপনাটি দেখা যেত। কিন্তু চোখ বুজলে সেটি দেখি না, দেখি মৃদু জ্যোৎস্নায় আলোর ফুলের কেয়ারির মাঝখান দিয়ে হেঁটে, নদী পার হয়ে নামি গম্বুজ, মিনার, খিলানসহ যে স্থাপনার সামনে, তার একটি মিনার বুঝি আকাশছোঁয়া। যদিও সকলেই জানে, আমাদের ওই গ্রামে কি ওই অঞ্চলে কি সারাদেশে লালবাগ ছাড়া ওসব স্থাপনা আর কোথাও ছিল না। তাহলে? নদীতীরের ওই বিশাল হর্ম্য তো স্বপ্নই।

কৈশোরের কিছু স্মৃতিও আছে। সেসবই স্পষ্ট। সামান্য স্বপ্নেরও ছোঁয়া যেখানে পাই না। সব ধরা যায় যেন, মিলিয়ে নেওয়া যায়। সময়, স্থানসহ।

মাইনে দিতে না-পারায় দুবার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। স্কুলের পুরনো খাতা মেলালেই সেটি দেখা যাবে। আর ওই স্কুলে না-যাওয়ার কালে এক ছোট পানবিড়ির দোকানে কাজের খোঁজ   দিয়েছিল এক সহপাঠী, যে নিজেও স্কুল ছেড়ে দিয়ে বড় এক পানের দোকানেই চাকরি করতো। ছোট পানদোকানির সঙ্গে শহর থেকে ত্রিশ মাইল দূরের মেলায় যাওয়ারও স্মৃতি আছে।  প্রতিটি দিন স্পষ্ট।  মেলাশেষে মূলধনও শেষ যখন, ময়রার দোকান থেকে সৌজন্যের সন্দেশ হাতে সতেরো মাইল হেঁটে রেলস্টেশনে পৌঁছেছিলাম। খালি পায়ে ধুলোওড়া তপ্ত লালমাটির পথে হাঁটা – সকাল থেকে পড়ন্ত দুপুরতক; আদৌ স্বপ্ন নয়।

দেশভাগের ফলে পিতা বেকার হয়ে যান। যে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ছিলেন তিনি, সেটি অন্যদিকে পড়ে যায়। ফলে দুই পুত্র স্ত্রীর অন্নসংস্থান করাও তাঁর পক্ষক্ষ সম্ভব হতো না মাঝে মাঝেই। পুত্রদ্বয়ের স্কুলের মাইনে দেওয়ার তো কথাই আসে না। অমন একদিনে ঘরে খাবার নেই জেনে দুই ভাই শহরের পথে পথে ঘুরে শেষে বড় পোস্ট অফিসের বারান্দার বেঞ্চে শুয়ে ছিলাম। মুকুলশেষে আমগাছে গুটি কেবল বড় হচ্ছে তখন। শোয়া অবস্থায় চোখে পড়লো সামনের আমগাছে হলুদ রঙের আম একটি। বড়ই। উঠে ঢিল মেরে মাটিতে নামাই সেটি। দেখি কেবলই হলুদ – পাখিতে ঠোকরানো। পচন ধরেছে। ফেলে দিতে হয়। পোস্ট অফিসের বারান্দার নিচে একটি টিউবওয়েল ছিল। সেখানেই ক্ষুণ্ণিবৃত্তির চেষ্টা করি দুই ভাই। এই স্মৃতিও কোনো স্বপ্ন নয়।

যৌবনকালের স্বপ্নই আসলে স্মৃতি। ধরা যাক যে-বালিকা গভীর রাত্রির খেলাঘরে সঙ্গিনী হবে ভেবে ঘর, চারপাশ, জানালা চাই কি বাতিটিরও যে-ছবি চোখে ছিল সে কেবল চোখ বুজলেই দেখা যায়। অথবা সমুদ্রসৈকতে দীর্ঘকাল পরে দেখা যে সহপাঠিনী আমাকে চিনতেও পারেনি সে-ও তো একসময়ে নিদ্রাকালে সুখসঙ্গীই ছিল বলা যায়।

যে আমার ঘরে আসবে বলে সবকিছু স্থির ছিল, ঘর সাজানো ছিল, তাকে দেখবার জন্যে ছাদের ওপরের ছবিঘরে তিনবার ওঠানামা করেছি, তাকে কোনোদিন চোখে দেখিনি অথচ তার মুখরেখা ও ভাঁজও তো আমি জানি। সে কি স্বপ্ন নয়?

পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়োগপ্রাপ্তির আশায় যাই একবার। যোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। নিজ অফিসের চেয়ারটিও দেখতে পাই চোখে। যদিও নিযুক্তির চিঠি কখনো আসেনি। স্বপ্নভঙ্গের শুরুতে তো থাকে স্বপ্নই।

বিদেশে লেখাপড়ার শেষে ফিরি কেবল সবচেয়ে বড় ডিগ্রিই নিয়ে নয়, ওইরকম ডিগ্রিই ছিল না ওই সময়ে আর কারো। বিদেশেই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাধিকারীর সঙ্গে দেখা হয়। সস্নেহে তিনি চলে আসতে বলেছিলেন, ডিগ্রি লাভের শেষেই। তাই ক্লাসরুমে উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকানো শত মুখের ছবি যদি আমি দেখে থাকি তাহলে সেটি স্মৃতি নয়, স্বপ্নই। ওই বিদ্যালয়ের আঙিনায়ও  পা দিইনি দীর্ঘকাল, ডিগ্রি লাভের পরে। প্রজ্বলিত বাসনা নির্বাপণে সহায়ক ছিল এককালের সহপাঠী, তৎকালীন কিছু অসুয়াপীড়িত শিক্ষক। বিভাগীয় প্রধান।

শহরতলিতে প্রতি শীতেই দেখা যায় বিসত্মীর্ণ প্রান্তরে ইটভাটার চিমনি। এখন যেমন দেখা যায়, তখনো যেতো। অমনি শীতে লাল রঙের শক্ত ইট খুঁজে বেড়ানোর কথা মনে আছে। মনে আছে নানা দোকান ঘুরে উৎকৃষ্ট সিমেন্ট, কি রড, কি কাঠ কেনার কথা। আর সেই ইট, সিমেন্ট, বালি, লোহা, কাঠ মিলিয়ে যে দালান হয় সেটির সবকটি ঘরে থাকার কথা ছিল আমারই, সপরিবারে। সেই দালান আছে, আছে ঘরকটিও, সেখানে বাসও করে কেউ সপরিবারেই হয়তো। তবে আমি নই। বিনা কালিতে লেখা দলিল পরীক্ষা করছেন মাননীয় বিচারক আজ কতকাল। ধর্মাশ্রয়ী দখলদারকে সরাবে এমন সাহস কার? তা ওই বাড়ির সবকটি ঘরে বাস করার যে স্মৃতি সে-ও তো স্বপ্নই।

সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ক্ষণকালের জন্যে হলেও, বাহারি রঙিন, সেটিও স্মৃতিতে আছে – চড়া দামে কেনা। কেবল দরজা খুলে চেয়ারে বসাই বাকি ছিল। সম্মানের সঙ্গে সম্বোধনও করেছিল প্রতিষ্ঠানের কেউ কেউ। প্রায় ঈশ্বর যিনি, তারও, শুনেছিলাম, সমর্থন ছিল। তবুও আনুষ্ঠানিকতা তো আছে। আর সেই সাক্ষাৎকারের অনুষ্ঠানে সর্বসম্মতি মিললেও মেলে না সরকারি শক্তিধর কারো। তা এটিও তো স্মৃতিই। আসলে স্বপ্ন।

 

তিন

বহুতল ভবনটি অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। আমিও দেখি এবং কাছে এসে সামনে দাঁড়ালে কিঞ্চিৎ বিস্মিতও হই। দারিদ্র্যবিমোচনের জন্য এমন আয়োজন, মুহূর্তে ভুলে যাই। বড় কাজের জন্য যোগ্য প্রস্ত্ততির প্রয়োজন, এ-কথাই বুঝি।

প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করি। কোনো এক পরিচয়ের সূত্রে আমার কথা শুনে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি আমাকে। জনকল্যাণের কর্মে তাদের সঙ্গে আমি কি যোগ দিতে পারি না। মাঠঘাটের মানুষের জন্যে ছাত্রজীবনে ত্যাগের যে-সংকল্প ছিল, বুঝি কর্মের স্মৃতিও কিছু সেই কালের, স্বপ্ন হয়ে আবার চোখে ভাসে। ভবনটির বহুতলে ছড়ানো বিভিন্ন বিভাগের কর্মকা- দেখান আমাকে প্রধান পরিচালক। দারিদ্র্যবিমোচনের নানা প্রসঙ্গ, উপায়ের কথাও উঠে আসে। ত্যাগই সব নয়, কর্মকৌশলও যে কত প্রয়োজন স্পষ্ট হয়।

অবশেষে মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নিয়ে যান পরিচালক। বৃত্তাকার বহুতল ভবনের মাঝামাঝি প্রায় অর্ধতল জোড়া তাঁর অফিস, ব্যক্তিগত সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর প্রভৃতির জন্যে ব্যবহৃত অংশ পার হয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁর কক্ষের সামনে দাঁড়াই। নিজে এসে দরজা খুলে দেন তিনি। কুশলবিনিময়ের শেষে বসেন তিন পাশে টেবিল দিয়ে ঘেরা তাঁর চেয়ারে।  প্রতিদিনের সাধারণ সুতি কাপড়ের পোশাকে, কেবল কাজের সুবিধার জন্য    তিনপাশে জোড়া প্রশস্ত টেবিল, মুহূর্তে বুঝে যাই।

আমার কথা শুনতে চান তিনি। ফিরে আসার গল্প বলি তাঁকে – নানা স্বপ্নে ছড়ানো সব গল্প, বলি তাঁকে স্বপ্নভঙ্গের কথাও। সব শুনে তিনি বলেন, আসুন আমাদের সঙ্গে, দেখি ভাঙা স্বপ্ন আবার জোড়া দেওয়া যায় কি না।

 

চার

আলো আর আঁধারের মাঝখানে কিছু এক রকম অস্তিত্ব আছে – সেখানে কিছু থাকে না, কিছু ঘটে না, কিছু বোঝা যায় না, কিছু দেখা যায় না। কোনো দৃশ্য নয়। বাইরে তাকালে বুক ভারী হয়, মন না-বোঝা দুঃখে ভরে যায়।

পাশে বসা সহকর্মী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে, এইরকম সময়ে বড় মন খারাপ করে। দ্রম্নত মিলিয়ে যাওয়া আলো আর আসন্ন অন্ধকারের পথে চলতে থাকা গাড়ির জানালার দিকে মুখ ফেরানো তাকে দেখি আমি। প্রায় দৃশ্যহীন ধূসর চরাচরের কিছু স্পষ্ট নয়, আরো কিছুক্ষণ আগে বৃক্ষরেখা ছিল সেখানে, দিগমেত্মর সীমায় কিছু রং-ও হয়তো ছিল, এখন সবই প্রায় বর্ণহীন আকাশের কোলে মিশে গেছে। হয়তো ছিল রাস্তার দুপাশের ক্ষীণ জলস্রোতে শাপলার বাগান কি ছিল ঘর-বাগিচার আড়ালে কি পাশে কর্মরত জন কি বিকেলের স্নিগ্ধতায় টলটলে জলের আধারে নিজ মুখের ছবি দেখায় বিভোর পলিস্নবালা।

পেছনের আসনে বসা আমরা দুজন। সামনের আসনে চালকের পাশেই বসা প্রতিষ্ঠানের সর্বপ্রধান। তাঁরই বসার কথা পেছনে। মূলত একাকী। আজ আমরা দুজন জরুরি প্রয়োজনে সভার দ্বিতীয় দিনেই শহরে ফিরবো বলে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর গাড়িতে আমাদের নিয়ে চলেছেন। অস্বস্তি এড়ানোর জন্যেই নিশ্চয় নিজে চালকের পাশে গিয়ে বসেছেন। এই মুহূর্তে তিনিও শব্দহীন। মন খারাপের আবহ কি তাঁকেও স্পর্শ করে? আমাদেরই মতন?

কিছুক্ষণ কোনো কথার রেশ গাড়িতে ছিল না। মন খারাপের হাওয়া সব ঢেকে দিয়েছিল। জনগণের কল্যাণ পরিকল্পনা, নানা কর্মসূচির বাস্তবায়ন, ত্রৈমাসিক সভার কিছু সমস্যার আলোচনা যে-কোনো স্থানেই করা চলে, চাই কি এই পথযাত্রাতেও। সর্বকর্মনিয়ামকের উপস্থিতিতে কথাবার্তায় সাবধানী আমরা নিঃসন্দেহে; কিন্তু তিনি সেসব শুনুন এ-ও তো চাই।

দু-একটি বিষয়ে কিছু বলার পরে সন্ধ্যা নামবে বলেই বুঝি আমরা চুপ করে যাই। আর তখনই মন খারাপের সময় উঠে আসে। তিনদিনের ষাণ্মাসিক সভা – শহর থেকে দূরের কেন্দ্রীয় সভাভবনে সারাদেশের সব কর্মকর্তারই উপস্থিতি আবশ্যক। আহার-নিদ্রার সব ব্যবস্থা সেখানেই – বিনোদনেরও। বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত বলেই সভার মাঝ থেকে আমাদের উঠে আসা।

সময় বৈরী, পরিবেশ বৈরী এইসব কথাই বারবার উঠে আসে নানা আলোচনায়। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাবের কথাও। অনেকদিন ধরেই এমন চলছে। সম্প্রতি নানা হয়রানি, নানা অসহযোগিতার ঘটনা জানে সকলেই। কী করে সেসব সামলানো যায় সেসব আলোচ্য বিষয়ে থাকে। কিন্তু আলো-আঁধারের সন্ধ্যায় মন খারাপের ব্যাপারটি? গত তিন মাসের কথা ভেবেই কি মন খারাপ আমার সহকর্মীর? কেবল আলো-আঁধারের প্রদোষে কেন সর্বদাই বিষণ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলেও কারো কিছু বলার ছিল না। অথচ কত সহজে সে প্রতিদিনের জীবনে ফিরে এসেছে এ নিয়েও কথা বলাবলি করি আমরা।

তিন মাস আগের এক সন্ধ্যাশেষে তার মোটরসাইকেল থামিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পেছনে বসা অফিস-পিয়নের ব্যাগে আসন্ন সভা-সমাবেশ ইত্যাদিবিষয়ক প্রচারপত্র খুঁজে পাওয়ায় দুজনকেই থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে জেলহাজতে। প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তাদের কোনো চেষ্টাই সেটিকে ঠেকাতে পারে না। প্রায় ছসপ্তাহ ধরে আইন-আদালতের নানা কসরত শেষে তাদের জামিনে ছাড়িয়ে আনা যায়। এবারের ষাণ্মাসিক সভায় ওই দুজনকে প্রায় বীরোচিত সংবর্ধনাই দিয়েছে সকলে। তবুও মন খারাপ তো হতেই পারে। কিন্তু কেবল দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণেই কেন?

কিছুক্ষণ আগের আলাপ আবার ফিরিয়ে আনি, বলি, ‘লোকে কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে, রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই।’ আমার কথায় কোনো জড়তা ছিল না, নিচু গলায়ই বলা যদিও। সামনের দিকে বসা তাঁর কানে আমার কথা পৌঁছলে তিনি বুঝি একবার পেছনের দিকে মুখ ফেরানোর চেষ্টা করেন, ‘তাই বুঝি?’ সামান্য হাসির শব্দও বুঝি শুনি আমরা। ‘কেউ বুঝি বিশ্বাস করে না যে দরিদ্র মানুষকে মোবিলাইজ করা কেবল তাদেরই জীবনের জন্য।’

‘এরকম তো ঘটে না। সবাই ভাবে পড়ে থাকা মানুষকে সামনে নিয়ে যাওয়ার কথা যে বলে সে-ও নিশ্চয় কিছু চায়। ইতিহাসের বড় সব গণজাগরণের পেছনেই তো এমন কিছু দেখা যায়।’ ঝোঁকের মাথায় বলে ফেলেই নিজেকে সামলে নিই। দারিদ্র্যবিমোচনের চেষ্টায় অনেক কাল কেটেছে তাঁর, আমরা জানি। আমার সহকর্মীও এককালে জনকল্যাণের চিন্তায় এক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। এখন এই প্রতিষ্ঠানে এসে সে-ও ওইরকম কর্মে যুক্ত ভাবে। নিজের দিকে তাকালেও ওইরকমই দেখি। কর্মজীবনে নানা পথে ঘুরলেও যৌবনকালের সেই মানবকল্যাণ চিন্তা কখনো ছাড়েনি। ঠিক ওই কারণেই এই প্রতিষ্ঠানে না-এলেও একরকম স্বপ্নপূরণের চিন্তা তো ছিলই।

 

পাঁচ

স্বপ্নশেষের প্রভাতে অর্ধবৃত্তাকার বারান্দার দরজা খুলে দিলে পুবের আলোয় ঘর ভরে যায়। ওই মুহূর্তের বাতাসটি ঈষৎ শীতল, স্পষ্ট বোঝা যায়। তাপ সঞ্চারিত হবে কিছু পরেই। মাধবীলতায় ঢাকা সদর দরজার ওপরে তোরণটি চোখে পড়ে। রঙিন ফুলে ঢাকা। যেন কুঞ্জগৃহের প্রবেশপথ; কিন্তু সেই ভুল মুহূর্তে ভেঙে যায় সদর দরজা খুলে দিলে। দেখা যায় দাঁড়ানো সশস্ত্র প্রহরী। একাধিক। আমি আমার বারান্দা থেকে দেখতে পাই। এই নিরাপত্তা আমার জন্যে নয়, পদমর্যাদার জন্যেও নয়। দ্বিতলবাসী উচ্চস্থানিক অন্য কারোর জন্যে। আমি বিনামূল্যে উপকারভোগী মাত্র।

তবুও বাসস্থানটি আমার পছন্দ। নিজেই নির্বাচন করেছি বাসস্থান। জানালার শার্সি ভাঙবে না কেউ, দরজায় কড়ার আওয়াজ তুলে কি বেল টিপে দরজা খোলা, তারপরে হাত বাঁধা মাটিতে পড়ে দ্যাখো নিয়ে যাচ্ছে আজীবনের সংগ্রহ খুদকুঁড়ো। মুখ দিয়ে শব্দ বেরোবে না। মুখে কাপড় গোঁজা। ওরকম কোনো ভয় আমার নেই। এখন কাজের সময়, স্বপ্ন দেখার নয়।

রাস্তার দুপাশের দেয়ালে নানা ভাইয়ের স্ত্ততি, মুক্তির দাবি কি আত্মপরিচয়, সহস্র জলসার বিজ্ঞাপন, পাঠম-ল, প্রসাধনী কি তেজবর্ধক ওষুধের পরিচিতি। সকালের আলোয় গাড়ির ঝাঁকুনিতে চোখ বন্ধ হতো ঠিকই, কিন্তু দেখা যায় রাস্তার উপরিতল কেবল অসমানই নয়, সহস্র নিচু গর্ত, খানাখন্দে পূর্ণ। বাস ডিপো ছাড়ানোর মুখে দেখা যায় যত্রতত্র থেমে আছে নানা যান। নানা কৌশলে তাদের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায় ভিন্ন যানের চালক। আরো কিছু এগোলে দেখা যায়, মহাসড়কের কায়া শীর্ণ করে দাঁড়িয়ে আছে দুপাশে অযুত ট্রাকের বহর। ওই মুহূর্তে সবকটির হালকা শরীর। শুনি শত ট্রাকের অধিপতি খলনায়কের গল্প, শুনি আমার সহকর্মীর চালকও চাবি ঘোরায় হাতে নিজের দুটি ট্রাকের।

এই অংশের রাস্তা সদ্যপ্রস্ত্তত, মসৃণ। দ্রম্নতবেগে গাড়ি চলে। চোখ বন্ধ করে ওই স্মৃতি স্বপ্নে পাঠাই। আর সেই মুহূর্তে গাড়িটি থামে। রাস্তার পাশে জলপাই রং ত্রিপলের ছাউনি। সামনে বসে আছেন পদস্থ কর্তা। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী দুপাশে অস্ত্রধারী এসে দাঁড়ায়। কোন প্রয়োজনে কোন গন্তব্যের দিকে চলা জিজ্ঞাসা করে। জানি এ কঠিন সময়, বাদানুবাদের নয়। সঙ্গের ব্যাগটিতে রাখা কাগজপত্র প্রাতিষ্ঠানিক সভায় নিয়ে যাওয়ার জন্যই। এমনকি এই ব্যাগটিতে কাগজপত্র ছাড়া আর কিছু নেই এ-কথা মুখে বলাই যথেষ্ট নয়, চাইলে দেখাতেও হবে। কিন্তু সান্ত্রি আর দেরি করায় না।

গন্তব্যে পৌঁছানোর পূর্বে আরো একবার – এবারেও সৈনিক কাছে আসে, মুখের দিকে তাকায়। হাত বাড়ায় বুঝি তারপরে সরিয়ে নেয়, বলে, ‘ঠিক আছে যান।’

ভাঙা স্বপ্ন জোড়া দেওয়ার জন্যে এটিকেও স্মৃতিতে পাঠাই।

 

ছয়

সভাকক্ষ পরিপূর্ণ। ষাণ্মাসিক সভায় সারাদেশের উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে  প্রতিনিধি পাঠানো নিয়ম। পালিতও হয়। নিজ নিজ কেন্দ্রের অগ্রগতি, আর্থিক বিবরণ, অসুবিধা, সমস্যা সবই তুলে ধরতে হয়। সভাকক্ষটিকে অন্যসময়ে প্রেক্ষাগৃহ হিসেবে ব্যবহার করা চলে বলেই শেষের দিকের সারিতে যাঁরা বসেন, তাঁদের কথা শোনা যায় না। এজন্যে সকলকে সুশৃঙ্খলভাবে মঞ্চে এসেই যা বলার বলতে হয়। সভার জন্যে বিশেষভাবে প্রস্ত্তত মঞ্চ, খুব উঁচু নয়। একটি মাত্র ধাপে পা রেখেই উঠে যাওয়া যায়।

মঞ্চে এসে মহাপরিচালক তাঁর পাশে পরিচালকবৃন্দকে বসতে বলেন; কিন্তু কয়েকদিন আগের মহাসমাবেশে তাঁর পাশে এসব কর্মকর্তা নয়, ছিল দেশের শক্তিধর, ক্ষমতাবান বলে খ্যাত মহাজন সব। বিশাল প্রান্তর প্রায় পূর্ণ ছিল প্রতিষ্ঠানটির সভ্য ও সমর্থক দিয়ে সেদিন। মঞ্চ থেকে কিছুদূরে সামান্য ডাইনে সম্পূর্ণ কার্যাবলি চলচ্চিত্রে ধারণের জন্যে টেলিভিশন ক্যামেরা। বিশেষ ব্যবস্থায় সেটিকে মাটি থেকে অনেক উঁচুতে তোলবারও ব্যবস্থা আছে। মহাজন সকলে এসে মঞ্চে বসলে সঞ্চালক সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন। গণতন্ত্রের জন্যে, মানুষের অধিকার আদায়ের জন্যে, বঞ্চিতদের জন্যে ন্যায্য হিস্যা আদায়ের দাবিতে এই সমাবেশ তাঁরা বলেন, কিন্তু শহর কি শহরতলির কি আরো দূরের গ্রামগঞ্জ থেকে ঢোল-কাঁসর পিটিয়ে প্রথমে বাসে, পরে মিছিল করে হাঁটিয়ে যাদের সভাস্থলে আনা হয় তারা কিছু শুনতে পায় না। কোলাহল কি ক্লামিত্ম, বাধ্যতামূলক উপস্থিতির উদ্বেগ, অসমেত্মাষ তাদের স্থির থাকতে দেয় না। উদ্দীপনী সব সেস্নাগানে গলা মেলায় তারা। একের পর এক বক্তা এই মহতীসভার আয়োজনের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত নাগরিক গোষ্ঠীকে ধন্যবাদ জানান। জনতার আন্দোলন থামবে না। দাবি পূর্ণ হবেই, এই তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস। সূর্যের তাপে স্বেদস্নাত, ঝলসানো মুখ জনতা তাদের দাবি কি না-বুঝেই সম্ভবত বক্তার দৃঢ় বিশ্বাসকে সমর্থন করে। হাততালি, সেস্নাগানের শব্দে ময়দানের ঘাস, মাটি সব ভরে গেছিল ওইদিন।

সাধারণ দৈনন্দিন সুতির পোশাকে উঠে দাঁড়ান সর্বকর্মের নিয়ামক। কিছুদিন আগের জনসভাকে সার্থক করবার জন্যে সকলকে ধন্যবাদ জানান। নাগরিক গোষ্ঠী ওই সমাবেশে সাহায্যের জন্যে তাদের প্রতিষ্ঠানটিকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে, বলেন তিনি। এ জন্যে কিছু ত্যাগ, কিছু কষ্ট স্বীকার তো মেনে নেওয়াই যায়।

সভাকক্ষের সকলেই তাতে গলা মেলায়। এ তো তাদের কর্তব্য, জনগণের জন্যেই জীবনপাতে প্রস্ত্তত তারা – তিনি তো জানেন। সকলে একসঙ্গে এ-কথা বলতে চাইলে তিনি তাদের থামান এবং একে একে মঞ্চের সামনে না-এসেও নিজ নিজ স্থান থেকে যা বলার বলবার অনুমতি দেন। সারাদেশে ছড়ানো সব উন্নয়ন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলেই তাদের কোনো কষ্টের কথা স্বীকার করে না। সানন্দে সকলে সমাবেশে যোগ দিয়েছিল এ-কথাই জানায়। আর যদি থাকে আরো কোনো কষ্টের কাজ, ত্যাগের প্রয়োজন, সদাপ্রস্ত্তত তারা সেই কষ্ট স্বীকারে, ত্যাগে। শেষে সভাকক্ষে উপস্থিত কয়েকশো কণ্ঠ একত্রে দেশ, তাদের নেতা – সকলের জয় কামনা করে নানারকম ধ্বনি দেয়। তাদের নিয়ামককে তারা বিধায়ক হিসেবে দেখতে চায় – এ কথাও বলে। নিয়ামক সকলকে শান্ত হয়ে বসতে বলেন। সভার কিছু আলোচ্যসূচি, করণীয় আছে তো।

 

সাত

মধ্যাহ্নের আহারকালে নানা টেবিল ঘিরে পরিচালক, উপপরিচালক, সহপরিচালক ইত্যাকার নানা কর্মকর্তা নানা কর্মসূচি, আলোচ্য বিষয় ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে থাকেন। মহাসমাবেশের কথাও বলেন অনেকেই। তার সাফল্যের কথাও। তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির কথা। সামনে কেমন দিন আসতে পারে এমনসব কথাও। যদিও মুখে কেউ বলেন না যে, সেসব দিনে কী ঘটবে; কিন্তু করণীয় কী তাঁরা জানেন।

 

আট

সেদিনের মতোই আজো ফেরার মুখে আলো পড়তে থাকে। ছোট রাস্তা ছেড়ে বড় সড়কে উঠলে আলোর চিহ্নটুকু মুছে যায়। আজ গাড়িতে আমরা দুজনই। সামনের আসনে চালক একা। একই অঞ্চলে থাকি বলে একসঙ্গে যাতায়াত।

সিমেন্টের মেঝেতে কম্বল পেতে শোয়া কি দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে সারি সারি হাজতির সঙ্গে সময় কাটানো কিছু নয়। কয়েক সপ্তাহই তো বলেছিল আমার সহকর্মী। কিছু না সেসব যদি মেলে স্বপ্নপূরণের সন্ধান তাতে।

বড় রাস্তায় উঠবার মুখেই বলে সে, ‘জীবন অনেক শেখায়, তাই না।’

আমি কিছু বলি না। মাঠের ফসল ক্রমে কৃষ্ণ সমুজে চলে যায়। নয়ানজুলিতে শালুক ফোটা কিনা দেখা যায় না। দেখা যায় আলোহীন দিনশেষে পারাপারের বাঁশের সাঁকো। গাড়ি থামে আবার।

সদাসতর্ক প্রহরী কাছে এলে আমিই জানালা খুলি। বলি, ফিরছি সারাদিনের কাজ শেষে। পরিচয়পত্র দেখাই। অস্ফুটে নামটি পড়ে সে বারবার।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করলে জানালা তুলে দিই। মাঠের শেষে দূরের গাছপালা আলাদা করে দেখা যায় না। মাথার ওপর থেকে নেমে আসা আকাশ মিশেছে বৃক্ষশীর্ষে। সামান্য তার ছায়া বুঝি আছে সেখানে। না-দিন না-রাত্রির এই সময়ে ভয়ানক মন খারাপ করে। আমরা কেউ সে-কথা বলি না, অন্ধকারের দিকে তাকাই না, আলোর দিকেও নয়। ভাবি, এই দিনের স্মৃতি কী করে স্বপ্নে পাঠাবো আমি।

 

নয়

দূর থেকেই বহুতল ভবনটিকে দেখি আবার। না, কাছে যাই না, ভিতরেও নয়। ভিতরে আর কিছু দেখার নেই জানি। লাল ইটের বহুতল অট্টালিকা – মালিন্য তার বাইরে থেকে বোঝা যায় না। সব ঘরে আলো জ্বলে না, শীতাতপনিয়ন্ত্রিতও নয়। শুনি সবই, কাছে যাই না। সব স্মৃতিকেই স্বপ্নে পাঠানো যায় না।