নোরা-বিমলা-কুসুম ও আমি

আঁখি সিদ্দিকা

…for eight years I’ve been living here with a stranger, and that I’d even conceived three children — oh, I can’t stand the thought of it! I could tear myself to bits.

– নোরা

আমার স্বামী বরাবর বলে এসেছেন, স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি সমান অধিকার, সুতরাং তাদের সমান প্রেমের সম্বন্ধ। এ নিয়ে আমি তাঁর সঙ্গে কোনোদিন তর্ক করিনি। কিন্তু আমার মন বলে, ভক্তিতে মানুষকে সমান হওয়ার বাধা দেয় না। ভক্তিতে মানুষকে ওপরের দিকে তোলে সমান করতে চায়। তাই সমান হতে থাকার আনন্দ তাতে বরাবর পাওয়া যায়, কোনোদিন তা চুকে গিয়ে হেলার জিনিস হয়ে ওঠে না। প্রেমের থালায় ভক্তি পূজা-আরতির আলোর মতো – পূজা যে করে এবং যাঁকে পূজা করা হয় দুয়ের ওপরেই সে-আলো সমান হয়ে পড়ে। আমি আজ নিশ্চয় জেনেছি, স্ত্রীলোকের ভালোবাসা পূজা করেই পূজিত হয় – নইলে সে ধিক ধিক। আমাদের ভালোবাসার প্রদীপ যখন জ্বলে, তখন তার শিখা ওপরের দিকে ওঠে – প্রদীপের পোড়া তেলই নিচের দিকে পড়তে পারে। 

– বিমলা

মানুষ কি লোহায় গড়া যে, চিরকাল সে একরকম থাকবে, বদলাবে না? বলতে বসেছি যখন কড়া করেই বলি, আজ হাত ধরে টানলেও আমি যাব না।

– কুসুম

এখন আমি আবার পুতুল যদিও চুলে রুপোর জরি। ছেলেমেয়ে দম দিয়ে যায়, দম ফুরোলে বাতিল ঘড়ি। পুতুল বাড়ি – পুতুল বাড়ির মালিক আমি কক্ষনো নই। দুধের মতো পাত্রগত, কখনো ক্ষীর, কখনো দই। আজো কিন্তু আকাশ দেখি, আজো ওড়ার মকশো করি। মৃণাল কিংবা নোরার মতো ভাবছি, যা হোক বেরিয়ে পড়ি।

 

বেরিয়ে পড়ার মন্ত্রতেই পরিচয় হয়েছিল আমার সঙ্গে নোরা-বিমলা ও কুসুমের। জানি না, কখন যে তাদের সঙ্গে সখ্যও তৈরি হলো চুপিসারে। যদিও তাদের আসা ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বৈকুণ্ঠের সুর যেন একই সত্তায় একই তানে গেয়ে উঠেছিল আমার-আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে। ১৮৭৯ সালে নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের হাত ধরে নরওয়ের কোনো এক শহরে অ্যা ডলস হাউসে নোরার আবির্ভাব। ১৯১৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন থেকে ঘরে বাইরে প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বের হয়ে এলেন বিমলা। আর কুসুম তো আমাদের পরিচিত আপনজন, যিনি এলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা থেকে – তার কথা শোনালেন ১৯৩৬ সালে কলকাতায়। তিন-দুই দশকের ব্যবধান খুব বেশি না হলেও চেতনায় ভিন্নতা থাকাটা স্বাভাবিক, তা সত্ত্বেও তিনজন পুরুষ সাবলীলভাবে এঁকেছিলেন তিন নারী চরিত্র, তা কালের সীমা পেরিয়ে এখনো গ্রহণযোগ্য, এখনো তাঁদের উপস্থিতি যেন রোজ আমাদের চোখের সামনে হেঁটে বেড়ায়, যেন মনে করিয়ে দেয় – From below, the sound of a door slamming shut। সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল নোরা। বের হওয়ার সময় সজোরে বন্ধ করেছিল দরজা। আর নাটকের শেষ বাক্য ছিল এটা। এই দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পুরুষতান্ত্রিক গণ্ড থেকে নারীর বেরিয়ে আসার জয়ধ্বনি।

ঘরে বাইরের বিমলার উঁকিঝুঁকির মাঝে ডাক আসে উত্তাল বঙ্গভঙ্গের। সম্প্রীতির রাখিবন্ধন করে সেই ভাঙনকে রুখে দেন সূর্যের মতো দীপ্ত এক পুরুষ। দেশ যে কোনো ভৌগোলিক সীমানা নয়, দেশ যে পরাধীন জাতির আত্মায় বসবাস করে, দেশের মূক মুখ যে মানুষেরই অপমান! সে সন্দীপ। নিখিলেশের বন্ধু। স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল বিমলা – ‘এতদিন আমি ছিলুম গ্রামের একটি ছোটো নদী; তখন ছিল আমার এক ছন্দ, এক ভাষা। কিন্তু কখন একদিন কোনো খবর না দিয়ে সমুদ্রের বান ডেকে এল; আমার বুক ফুলে উঠল, আমার কূল ছাপিয়ে গেল, সমুদ্রের ডমরুর তালে তালে আমার স্রোতের কলতান বেজে বেজে উঠতে লাগল। আমি আপনার রক্তের ভিতরকার সেই ধ্বনির ঠিক অর্থটা তো বুঝতে পারলুম না। সে আমি কোথায় গেল? হঠাৎ আমার মধ্যে রূপের ঢেউ কোথা থেকে এমন করে ফেনিয়ে এল? সন্দীপবাবুর দুই অতৃপ্ত চোখ আমার সৌন্দর্যের দিকে যেন পূজার প্রদীপের মতো জ্বলে উঠল। রূপেতে শক্তিতে আমি যে আশ্চর্য, সে-কথা সন্দীপবাবুর সমস্ত চাওয়ায় কওয়ায় মন্দিরের কাঁসর ঘণ্টার মতো আকাশ ফাটিয়ে বাজতে লাগল। সেদিন তাতেই পৃথিবীর অন্য সমস্ত আওয়াজ ঢেকে দিলে।’

যে-সমাজে পুতুলকে নাচানো হয় এবং যাদেরকে নাচানো হয় তাদের ইতিকথা বর্ণনা করা হয়েছে কথাশিল্পী মানিকের মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পুতুলনাচের ইতিকথায়। গাওদিয়া গ্রামের ডাক্তার শশীকে ভালোবাসে কুসুম, যে পরানের স্ত্রী। বিমলার পরকীয়া, কুসুমের দুঃসাহসী প্রেম আর নোরার চলে যাওয়ার সঙ্গে বড় রকমের পার্থক্য নেই। নরওয়ের একটি বাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দটি ছিল উচ্চকিত। গাওদিয়া গ্রাম থেকে কলকাতা শহরে পৌঁছতে যে-দূরত্ব অতিক্রম করতে হতো কুসুমের পরকীয়া সংবাদ সে তীব্র গতি নিয়ে না ছুটলেও বিমলার পরকীয়া খ্রিষ্টীয় সভ্যতার কলোনিয়ালিজমের দান বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কোনোভাবে। ‘যে ঘরের বউ, বাইরের পুরুষের পক্ষে একেবারে নক্ষত্রলোকের মানুষ। এই পথহীন শূন্যের ভিতর দিয়ে ক্রমে ক্রমে টানাটানি, জানাজানি, অদৃশ্য হাওয়া সংস্কারের পর্দা একটার পর আর একটা উড়িয়ে দিয়ে কোন এক সময়ে একেবারে উলঙ্গ প্রকৃতির মাঝখানে এসে পৌঁছালো, সত্যের এ এক আশ্চর্য জয়যাত্রা।’

স্ত্রী-পুরুষের এই মিলের টান সত্য, ধূলিকণা থেকে আকাশের তারা, জগতের সব বস্ত্তপুঞ্জ তার পক্ষে। মানুষ কতগুলো কুবচন দিয়ে তাকে আড়ালে রাখতে চায়, তাকে ঘরগড়া বিধিনিষেধ দিয়ে নিজের একার করে রাখে। ফলে মানুষের সব কথার ফাঁকি একমুহূর্তে উড়িয়ে পুড়িয়ে প্রেমের গুঁড়ো আপনার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। মনোজগতের এই উলঙ্গ চোখ চোখের সামনে সত্য হয়ে দাঁড়ায়। তখন ছলনা মানুষের নিজেকে নিয়ে সেখানে সত্য, মাংস, ক্ষুধা, প্রবৃত্তি নির্দয় প্রচ- পাথর যা বৃষ্টির ধারায় প্রেম হয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে লোকালয়ের মনের কন্দরে গড়িয়ে পড়ে। বিমলার মনোজগৎ যে এই গোপন উদ্দীপনায় রাঙিয়ে তুলতে পারে, তাকে রবীন্দ্রনাথ অর্থলোলুপতার মতো ক্ষুদ্র উপাধি দিয়ে হীনচরিত্র করে তুলেছেন। কিন্তু কুসুমের দীপ্রতার সামনে অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তার শশী মস্নান, যতই সে কলকাতা থেকে লেখাপড়া করে শিখে আসা ব্যক্তি হোক না কেন।

নারীর ব্যক্তিত্ব অর্জনের খবরটি পাশ্চাত্যের চেয়ে প্রাচ্যে এসেছে বেশ পরে। তাই নোরাকে স্বামীর কাছে খরচের হিসাব দিতে হলেও সে একটি সময় বুঝেছিল সে কেবল পুতুলমেয়ে, পুতুলবউ। নোরাকে দেখা যায়, তার করুণ অবস্থার জন্য সে তার বাবা এবং স্বামীকে অভিযুক্ত করছে। সে জানাচ্ছে যে, তারা দুজনেই পাপ করেছে, ‘আমার বাবা এবং তুমি আমার প্রতি ভয়ানক অন্যায় করেছ। তোমাদের পাপেই তোমাদের দোষেই আমার জীবনে কিছু হলো না।’ মেরি উলস্টোনক্রাফটও অভিযোগ করেছেন যে, নারীর জন্ম হয়েছে বুঝি শুধু পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। নারীকে এজন্য বলা হয় ‘ভদ্র-নম্র, গৃহপালিত পশু’। নোরাও নিজেকে অনেকটা এরকমই ভেবেছে – তার মনে হয়েছে সে যেন এক পুতুলস্ত্রী, যাকে ফন্দিফিকির করে বাঁচতে হয়। মার্গারেট ফুলারও এরকমই একটা উপমা ব্যবহার করেছেন নারীদের সম্বন্ধে, ‘পুরুষেরা কোনো নারী চায় না, চায় বালিকা, যার সঙ্গে সে কেলি করতে পারবে।’ নোরা মনে করে, ‘স্ত্রী ও মায়ের’ চেয়েও তার উচ্চতর আরো একটা দায়িত্ব আছে। সে-দায়িত্ব হচ্ছে তার ‘নিজের প্রতি দায়িত্ব’। কিন্তু বিমলাকে দেখা যায় ঘরের বাইরে গিয়েও ফিরে আসে, আসতে বাধ্য করেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নিখিলেশের মৃত্যুর পরে বিমলার চুল কাটিয়ে সাদা শাড়ি পরিয়ে বন্দি করেন আবার ঘরে।

আমার ঘর বলে, তুই কোথায় যাবি,

বাইরে গিয়ে সব খোয়াবি-

আমার প্রাণ বলে, তোর যা আছে সব

যাক-না উড়ে পুড়ে।

বিমলাকে বলতে শোনা যায় – ‘আমি আগুনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি, যা পোড়াবার তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যা বাকি আছে তার আর মরণ নেই। সেই আমি আপনাকে নিবেদন করে দিলুম তাঁর পায়ে যিনি আমার সকল অপরাধকে তাঁর গভীর বেদনার মধ্যে গ্রহণ করেছেন।’ রবীন্দ্রনাথ বিনোদিনীকেও কাশী পাঠিয়েছিলেন, তেমনি বিমলাকে বাইরে বের করে মুক্ত বাতাস খাইয়ে আবার ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ঘরে। সংস্কারের বাইরে তিনি বেরোতে পারেননি, যেমন বিমলাকেও তিনি রেখে দিয়েছিলেন অমত্মঃপুরে। প্রায় বিশ বছর পর প্রাচ্যের হয়েও মানিক কুসুমকে দিয়ে না বলিয়েছিলেন অকপটে। একসময় কুসুমের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেছিল শশী। ‘এমনি চাঁদনী রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।’ শশীর কাছ থেকে এই কথার উত্তর না পেয়ে ‘কুসুম নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু? শরীর! শরীর! তোমার মন নাই কুসুম?’ শশী কুসুমকে এভাবেই উত্তর দিয়েছিল। নিজেকে প্রকাশ করার সাহস ছিল কুসুমের। দ্বিধাহীন অসংকোচ প্রকাশ। মানিক নারীকে নারীর মর্যাদায় বুঝেছিলেন। গাওদিয়া গ্রামের একজন নারীর এই প্রকাশে কুসুমের স্রষ্টা মানিকের কোনো দ্বিধা ছিল না যেমনটি ছিল না ইবসেনের নোরার। ইবসেন সেই সময় একটা নোটে লেখেন – She has committed a crime, and she is proud of it; because she did it for love for her husband and to save his life. But the husband, with his conventional view of honour, stands on the side of the law and looks at the affair with male eyes.

নোরা এমনই এক সৃষ্টি, কালের পরম্পরায় যার আবেদন এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। অ্যা ডলস হাউস – নাটকের একেবারে শেষে নোরা তার স্বামীর বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেই যে পথে বেরিয়ে পড়েন, মনে করা হয় সেটাই ছিল নারীমুক্তির সরণি, অচিরকালের মধ্যে যার সূত্র ধরে দেশে দেশে নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত আর জয়ী হতে থাকে। ইবসেন অবশ্য নিজে একে নারীমুক্তি না বলে ‘মানবমুক্তি’ বলেই উলেস্নখ করেছেন। মহান শিল্পীর মহৎ উক্তিই বটে! নারীবাদীরা এখন তো একথাই বলছেন, নারীমুক্তি মানে মানবমুক্তিই। কিন্তু ইবসেন তাঁর অ্যা ডলস হাউসকে নারীবাদের প্রচারপত্রে পরিণত করেননি। নোরাও হয়ে ওঠেনি সেই প্রচারণার মুখপাত্র। ইবসেন  বলেছিলেন – ‘A woman cannot be herself in contemporary society, it is an exclusively male society with laws drafted by men, and with counsel and judges who judge feminine conduct from the male point of view.’

অন্যদিকে বিমলার সঙ্গে সন্দীপের সম্পর্কের পরিণতি নিখিলেশের ওপর গুরুতর অভিসম্পাত হয়ে নামে। আর মৃত্যু বিবর্ণতার মুখে প্রেমের অরুণারাগ কেমন উজ্জ্বল, তার ব্যবহারিক ফল উপন্যাসে অনুপস্থিত। স্বদেশি আন্দোলনের সময় নিখিলেশের নির্লিপ্ততা আর সন্দীপের জ্বালাময় প্রবল আবেগ ও ইচ্ছাশক্তি বিমলাকে প্রেমের আরশিতে বেঁধে ফেলে। তার অজ্ঞাতসারে সন্দীপ ক্রমেই তাকে আকৃষ্ট করেছে। সন্দীপ নৈতিকতা মাপকাঠির অধীন নয়, এই শক্তি বিমলার মনে একপ্রকার বিহবল অসাড়তা ছড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সন্দীপের কামজ উদ্দীপনায় সে নিজেকে করে তুলেছে আত্মাহুতির পতঙ্গ। এই মাহেন্দ্রক্ষণে রবীন্দ্রনাথ সন্দীপকে দিয়ে অর্থ চুরির দাবি তুলে প্রেমের কুঞ্জে বিসদৃশ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। কাহিনির এই অংশে, সন্দীপের উদ্ধত আলিঙ্গন বিমলার কাছে তাই নরকসদৃশ অবজ্ঞার বিষয় হতে পেরেছে। এর ফলে বিশ্বসংসারকে উপেক্ষা করে অনিবার্য বেগে রসাতলে না ডুবে বিমলা সংযমবন্ধনে চিরায়ত ধর্মসংস্কার ও কল্যাণবুদ্ধি নিয়ে পতিপ্রেমের মন্দিরে পুনঃআগমন করতে সমর্থ হয়েছে। উপন্যাসে সন্দীপ যা, সেই অর্থে নিখিলেশ স্বাধীন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষই নয়! আর নিখিলেশ, সন্দীপ, মাস্টার মহাশয় রবীন্দ্রনাথে সবাই বিশিষ্ট মতবাদী। সেই মতবাদের ভিড়ে বিমলা তার স্বকীয়তায় অনন্য হয়ে উঠেছে। তাই তাকে বলতে শুনি – ‘কিন্তু, এত সেবা আমার জন্যে কেন? সাজসজ্জা দাসদাসী জিনিসপত্রের মধ্যে দিয়ে যেন আমার দুই কূল ছাপিয়ে তাঁর আদরের বান ডেকে বইল। এই-সমস্তকে ঠেলে আমি নিজেকে দান করব কোন্ ফাঁকে! আমার পাওয়ার সুযোগের চেয়ে দেওয়ার সুযোগের দরকার অনেক বেশি ছিল। প্রেম যে স্বভাববৈরাগী; সে যে পথের ধারে ধুলার ’পরে আপনার ফুল অজস্র ফুটিয়ে দেয়, সে তো বৈঠকখানার চীনের টবে আপনার ঐশ্বর্য মেলতে পারে না।’ যৌনতার প্রকাশ সে গোপন রাখেনি সন্দীপের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দেখি আমরা।

শশী যখন দেখেছে কুসুম অন্যত্র চলে যাচ্ছে, তখন নিজের ইচ্ছা পূরণের দাবিতে উদ্যোগী হতে কুণ্ঠিত হয়নি শশী। ‘খপ করিয়া কুসুমের একটি হাত ধরিয়া ফেলিল’ কিন্তু কুসুম বলছে – ‘কতবার নিজে যেচে এসেছি, আজকে ডেকে হাত ধরা-টরা কি উচিত ছোটবাবু? রেগে-টেগে উঠতে পারি ছোটবাবু, বড় বেয়ারা রাগ আমার। শশী বোকার মতো শিশুর মতো বলিল, কেন যাবে, কুসুম? আজ নাম ধরে কুসুম বললেন! – বলিয়া ছোট বালিকার মতো মাথা দুলাইয়া জ্বলজ্বলে চোখে শশীর অভিভূত ভাব লক্ষ করিতে করিতে কুসুম বলিল, কী করে শুধোলেন কেন যাবো! আপনি বুঝি ভেবেছিলেন যেদিন আপনার সুবিধে হবে ডাকবেন, আমি অমনি সুড়সুড় করে আপনার সঙ্গে চলে যাবো, কেউ তা যায়?’ যৌনতাকে আড়াল করে নারীকে অবদমনের সুস্পষ্ট চিত্রটি মানিক যেভাবে প্রকাশ করেছেন সেটি বাঙালি নারীর জীবন-জিজ্ঞাসায় নোরার দরজা বন্ধ করার শব্দের মতো উচ্চারিত হয়। অ্যা ডলস হাউস নাটকে নোরা তার স্বামী হেলমারকে অচেনা মানুষ বলে আখ্যায়িত করেছে। হেলমার যখন তাকে একরাত অপেক্ষা করতে বলেছে তখন নোরার উত্তর – ‘I can’t spend the night in a strange man’s room।’ পুরুষের ভ-ামি প্রকাশ করতেও ছাড়েননি ইবসেন। হেলমারের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন –  ‘…for eight years I’ve been like brother and sister।’ নোরার প্রতিবাদী উচ্চারণ –  ‘…for eight years I’ve been living here with a stranger, and that I’d even conceived three children — oh, I can’t stand the thought of it! I could tear myself to bits.’

নোরার প্রতিবাদের সঙ্গে কুসুমের প্রতিবাদের বড় একটা পার্থক্য নেই। অন্যদিকে বিমলা আর নোরা স্বামীর সোহাগী পুতুলবউ হয়ে থেকেছেন শুরুর দিকে। বিষয়গুলো প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক পটভূমিতে নিঃসন্দেহে এক। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ-মানিক বিমলা-কুসুমকে একক নারীই রেখেছেন। তাদেরকে মা করেননি। মাতৃত্বে নারীর গৌরব আর সার্থকতার বলে যে-সমাজব্যবস্থা সোচ্চার, সে-প্রশ্নও তাঁরা রেখেছেন। অন্যদিকে ইবসেনের নোরার মাতৃত্ব যে তাকে স্বস্তি দেয়নি তা দেখাতেও ভুল করেননি ইবসেন।

স্ত্রী পুতুলের মতো, রক্ষিতার মতো দিন কাটাবে, এটিই স্বাভাবিক ঘটনা। তা রবি-ইবসেন-মানিক তিনজনই কমবেশি দেখিয়েছেন। আজকের দিনের নারীবাদী চিন্তার ডিসকোর্স এই বিশ্লেষণে সোচ্চার। বৈবাহিক ধর্ষণ নারীকে অবদমিত রাখে, marital rape নিয়ে নারীবাদী ডিসকোর্স সোচ্চার হলেও, বর্তমান লেখকেরা নানা আঙ্গিকে বৈবাহিক ধর্ষণ বিষয়ে লিখলেও, তা চলমান ঘটনা যা প্রবাহিত আজকের সমাজেও। নারীকে অবমূল্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে একইরকম। অদৃশ্য অর্থে নোরার কোনো উপার্জন নেই। ক্রিসমাস উপলক্ষে সে বাচ্চাদের জন্য উপহারসামগ্রী কিনে আনলে স্বামীকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। স্বামী হেলমার জানতে চেয়েছে কোনটা কতটা সস্তা। নোরা ছেলেদের জন্য তরবারি, খেলনা জামাকাপড় কিনলেও মেয়ের জন্য পুতুল ও পুতুলের খাট কিনেছে। মেয়ের উপহারটা খুবই সস্তা। ‘They are nothing much, but she’ll tear them to bits in no time anyway।’ নারীর কাছে সংসার যদি পুতুলের সংসার হয়, আর তা যদি হয় সস্তা তবে তা নারী ছিঁড়ে টুকরো করবে, যে-কারণে নাটকের শেষে পুতুলের সংসার ভেঙে ফেলে নোরা। শশী খাটে বসে তার বোন সিন্ধুর পুতুল খেলা দেখে – ‘খুকি বড় হয়ে তুই কী করবি? পুতুল খেলবো। এই একটি মাত্র জবাবে ক্ষণিকের জন্য শশীর মন একবারে হালকা হয়ে যায়।’ নারীর পুতুল খেলার ধারণায় পুরুষের মন হালকা হয়। নিশ্চিন্ত হয়। নোরাকে স্বামীর কাছে খরচের হিসাব দিতে হয়েছে কারণ নোরা ছিল গৃহিণী। তার কোনো উপার্জন ছিল না। একইভাবে কুসুমকেও নিজের উপার্জন না থাকায় শশীর প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। কুসুমের পেট ব্যথার জন্য শশীকে কুসুমের বাড়িতে আসতে হয় ও পরদিন কুসুম ডাক্তারের ফিস দুই টাকা পাঠালে শশী বলে, ‘টাকা পেলে কোথায় পরানের বউ?’ স্বদেশি আন্দোলনের জন্য বিমলাও তার গয়না সন্দীপকে দিলে সন্দীপ প্রশ্নের পাশাপাশি সেই অর্থ নিয়ে পালিয়ে যেতে দ্বিধা করে না। নারীর গৃহশ্রম যে অদৃশ্য তা দেখিয়ে দেন তাঁরা সমাজবাস্তবতার আলোকে। বিমলাকে রবীন্দ্রনাথ ঘরছাড়া না করলেও গৃহের বলয়ের মধ্যেই আপন সত্তাকে খুঁজেছে; কিন্তু পুরুষ রবীন্দ্রনাথের সংস্কারের কাছে হেরে গিয়ে বেড়িটা ভাঙতে পারেনি। কুসুমের পরকীয়ার সম্পর্কের আচরণ তার গৃহবন্দি জীবনের স্বামীর প্রভুত্বের মধ্যে নয়। সে ঘরে থেকেই শিকল ভেঙেছে। এখানেই নোরার সঙ্গে বিমলা-কুসুমের ভিন্নতা এবং সম্পর্কের জায়গা তৈরির  ভিন্নমাত্রা। একজনের সাহিত্য মাধ্যম নাটক অন্য দুজনের উপন্যাস হলেও নারী ভাবনায় তিনজনই শিল্পের রূপান্তর ঘটিয়েছেন।

এত কিছুর পরও বলিষ্ঠ চরিত্র হয়েও সন্দীপ তাই ভ্রান্ত রাজনীতির বড়ে নিরীক্ষার যন্ত্র, আর উপন্যাসে বিমলা সন্দীপের নিরীক্ষাশালায় গিনিপিগ এবং নিখিলেশ বিভ্রান্ত, নির্লিপ্ত মানুষ। এই নির্মাণপদ্ধতি ত্রম্নটিযুক্ত। এত কিছুর পরও সন্দীপের মধ্যে বিমলার মতো আবেগের আত্মগস্নানি স্পর্শ করে না। বিমলা নিজের আয়নায় নিজেকে দেখার সাহস রাখে। কিন্তু প্রাচ্যের রক্ষণশীলতা থেকে বেরোতে পারে না। রূপকামনার বিমলা ‘আমি সত্য কথা বলব। সেদিন আমার মনে হয়েছিল বিধাতা কেন আমাকে আশ্চর্য সুন্দর করে গড়লেন না? কারো মন হরণ করার জন্য যে, তা নয়। কিন্তু রূপ যে একটা গৌরব।’ সেই বিমলাকে স্বামীর মৃত্যুতে ন্যাড়া মাথা হতে হয়, পরতে হয় সাদা থান, খেতে হয় নিরামিষ তরকারি। একাদশীর দিন কুসুম উপবাস করেও মাছের আঁশ খেয়ে কৈফিয়ত দিতে হয় পরানের কাছে। প্রাচ্য সংস্কৃতির এই ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে মোকাবিলা করতে হয়নি নোরাকে।

ভাঙা হাটের নিস্তব্ধতা তিনজনের জীবনে বিরাজ করলেও জীবনে তারা তিনজনই ছিল সরব, সচল। সেখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এক হয়ে একই সুতায় গ্রথিত হয়ে গেছে। নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা সত্ত্বেও সংসারের কাঠামোটি খাড়া থাকে নারীর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা আর ত্যাগের জন্য। মানবসমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য নারী শিকল ভাঙে, নির্যাতন গায়ে মাখে আবার জীবনটাকে হাতের মুঠোয় ধরে রেখে ত্যাগও করে। তাই নারীবাদী বিবর্তনের দ্বিতীয় ধারায় উনিশ শতকে নারীর বৌদ্ধিক ও আত্মিক উন্নয়নের ওপরই জোর দিয়েছিলেন নারীবাদীরা। নোরাও ঠিক এমনটাই ভেবেছে, কোনো কাজের যোগ্য নয় সে। কারো স্ত্রী হওয়ার, সন্তানের মা হওয়ার। নিজেকে শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে আসলে নারীর মুক্তি নেই। আত্মোপলব্ধির মুহূর্তে নোরা হেলমারকে সে-কথাই জানাচ্ছে – ‘আর একটি কাজ আছে যেটা আমাকে সবার আগে শেষ করতে হবে – নিজেকে শিক্ষিত করা।’ হারিয়েট মার্তিনিউ বলেছেন, ‘নারীকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে পুরুষের সহযাত্রী হবার জন্য, খেলা বা দাসী হবার জন্য নয়।’ রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন নারীকে, কিন্তু তার বের হওয়ার পথ করে যাননি। কুসুম গৃহের পরিসরে বাস করেও ভালোবেসেছিল একজনকে আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পেরেছিল। তবে কি মানিক নারীর জন্য সেই সমাজ চেয়েছিলেন, যা সাম্য আর সমতার প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্র হবে? কিন্তু নিজে সেই পুরনো সমাজ ভেঙেচুরে তছনছ করে নারীকে ঘরের বাইরে বের হওয়ার পথ দেখাতে পারেননি। লিও ট্রটস্কির ‘Literature and Revolution’-এর একটি উপদেশ মনে পড়ে গেল – ‘The relationship between form and content is determined by the fact that the new  form is divorced, proclaimed and evolved under the pressure of an inner need, of a collective  psychological demand which, like everything else has its social roots’। কিন্তু শিল্পের বিচারে নারীচরিত্র প্রধান কালজয়ী আরো সৃষ্টিতে যেমন শেক্সপিয়রের ক্লিওপেট্রা, রেসিনের ফায়েদ্রা, স্ট্রিন্ডবার্গের জুলি, বার্নার্ড শ-র ক্যানডিডার পরিণতি যে-কোনো পুরুষেরও হতে পারত। ফলে কোনো চরিত্র নারী কিনা, সেদিক থেকে নয়, শিল্পের বিচারে উত্তীর্ণ চরিত্র কিনা, সেটাই মূল কথা। গভীর অভিনিবেশ আর জেন্ডার সংবেদনশীল মুক্তদৃষ্টিতে আর অবশ্যই শিল্পের বিচারে নোরা-বিমলা-কুসুম সব ‘আমি’র অনুকরণীয় পথ।