প্রাথমিক জীবন-অণু উৎপত্তির সন্ধান ও অপারিন-হ্যালডেন তত্ত্ব

পৃথিবীতে শিল্প-বিপ্লব শুরু হওয়ার পর কয়েকটি শতাব্দী ধরে আধুনিক বিজ্ঞানের নানা শাখার অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধিত হওয়ার ফলে আমাদের চিন্তা-চেতনায় নানা পরিবর্তন এসেছে। আমরা বুঝতে সমর্থ হয়েছি যে, জীবজগৎ ও মানুষের উৎপত্তিসংক্রান্ত পৌরাণিক কাহিনিগুলো মূলত শূন্যগর্ভ কল্পকাহিনি মাত্র, যেগুলো বিজ্ঞানলব্ধ নানা জ্ঞানকে আত্মস্থ করে নিতে অসমর্থ। ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগেই তরুণ এক ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন জীববিজ্ঞানের এমন একটি বৈপ্লবিক হাইপোথিসিস তুলে ধরেন, যা চিন্তাশীল মানুষের মনে প্রবলভাবে নাড়া দেয় – আর সেটি হচ্ছে, জৈবিক বিবর্তনের তত্ত্ব।

জীববিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগুলোর একটি বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমেই বুঝতে পারা গেল কী করে প্রাণিজগতে বিরাজমান প্রজাতিগুলো টিকে থাকার এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত এবং কীভাবে তাদের মধ্যে ধীরগতিতে পরিবর্তন সংঘটিত হয়ে নতুন প্রজাতি জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু এটি বুঝতে সমর্থ হলেও আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়েই বুঝে উঠতে পারিনি যে, কী করে ‘মৃতদের জগৎ’ থেকে ‘জীবিতদের জগৎ’ আলাদা হলো – অর্থাৎ কী করে পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হলো? চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী পুস্তক The Origin of Species ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হওয়ার পর অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সুধীসমাজ এ-প্রশ্নটির একটি যুক্তসংগত ব্যাখ্যার সন্ধান পেতে ব্যর্থ ছিলেন এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পরিবর্তে ঈশ্বরসৃষ্ট জীবজগতের ধর্মীয় ব্যাখ্যাই মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। অজৈব পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের উৎপত্তি হয়েছে বা তা হওয়া সম্ভব – এরকম যে-কোনো ধারণাই সে-সময়ে ধর্মবিরোধী (heretic) বলে মনে করা হতো। আর ঠিক এমন একটি সময়েই এর একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে আলোকবর্তিকা হাতে আবির্ভূত হলেন একজন তরুণ রুশ জৈব-রসায়নবিদ – আলেকজান্ডার অপারিন।

দুনিয়া-কাঁপানো রুশ বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর ১৯১৮ সালে রাশিয়ার রাজধানীসহ প্রধান শহর মস্কো যখন
বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব-ক্ষুধা-দারিদ্র্য-মৃত্যুর কূটচক্রে পিষ্ট হচ্ছে, তখন আলেকজান্ডার অপারিন এগিয়ে এলেন একটি বিপ্লবী ধারণা নিয়ে – সেটি হচ্ছে যে, অজৈব পদার্থ থেকেই জৈব পদার্থের প্রাথমিক জৈব-অণুর উৎপত্তি হওয়া সম্ভব। এর আগে অবশ্য জৈব ও অজৈব – এ-দুটো পদার্থকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি বস্তু বলে মনে করা হতো। মনে করা হতো যে, জৈব পদার্থের মাঝে রয়েছে এমন একটি প্রাণশক্তি (Elan Vital ev Vital Force), যা অজৈব পদার্থে নেই। আর এ-কারণেই অজৈব পদার্থ কখনো জৈব পদার্থে রূপ নিতে পারে না – বিশ শতকের প্রথম দিকেও এমনটাই ছিল ধারণা। এ-ধারণার প্রভাবেই তরুণ বিজ্ঞানী অপারিনের এই নতুন বিপ্লবী ধারণাটি রুশ বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পরও নবগঠিত বলশেভিক সরকারের বিপ্লবী কর্তৃপক্ষ খুব একটা প্রীতির চোখে দেখেনি – হয়তো তারা ধর্মবিরোধী এ-ভাবধারাটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে প্রভাবশালী রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের বিরাগভাজন হতে চায়নি।

আলেকজান্ডার অপারিন বেড়ে উঠেছিলেন রাশিয়ার উগলিক অঞ্চলে, নিতান্তই অজপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রামীণ পরিবেশে বার্চ-পাইন-ওকের জঙ্গলে ও ফুল-প্রজাতির-ঘাসের জগতে। তাঁর জন্ম ১৮৯৪ সালে এবং প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর তিনি ১৯১৪ সালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হন। রুশ বিপ্লবের বছর; অর্থাৎ ১৯১৭ সালে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই সর্বহারার একনায়ত্বের ধারণায় বিশ্বাসী বিপ্লবী নেতা লেনিনের তিনি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন এবং সারাজীবন ধরেই লেনিনের মতো গোঁফ-দাড়ি রেখে চলেছিলেন।
এ-সময়েই আরেক বিপ্লবী রুশ বিজ্ঞানী আলেক্সেই বাখের বহুল প্রচারিত পুস্তিকা Tsar Hungar পড়ে তিনি তাঁর অনুরক্ত হয়ে ওঠেন, এবং পরে তাঁর অধীনে তিনি শৈবালের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু করেন।

আলেক্সেই বাখের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আরো একটি বিপ্লবী ধারণা তাঁর মনে জন্ম নেয়, সেটি হচ্ছে, রাসায়নিক বিক্রিয়াই উত্তর দিতে সক্ষম একটি অতি পুরনো প্রশ্নের – কীভাবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব? আর এটির সমাধান খুঁজতে গিয়েই তিনি সম্মুখীন হলেন যে-বিষয়টির, সেটি হচ্ছে – অজৈব পদার্থের গঠন থেকে জৈব পদার্থের গঠন সম্পূর্ণ আলাদা।

মানুষ অথবা যে-কোনো জীবের শরীরের প্রায় ৬০ শতাংশ উপাদানই হচ্ছে পানি। এছাড়া তার এক শতাংশ উপাদান হচ্ছে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদি আয়ন। আর জীবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাকি সবকিছু হচ্ছে এমনসব জৈব উপাদান, যেগুলো কার্বন পরমাণুকে কেন্দ্র করে শৃঙ্খলের আকৃতিতে গড়া। এ-কার্বন পরমাণু হচ্ছে খুবই ‘আত্মীয়তাপ্রবণ’ একটি পরমাণু, যেজন্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, মহাবিশ্বের অন্যত্র যদি ‘জীবন’ দেখতে পাওয়া যায়, তাহলে সেটিও এই কার্বন পরমাণুকে ঘিরেই রচিত হবে।

কার্বন পরমাণুর বিশেষ দিক হচ্ছে তার একটি অনন্য গঠনপ্রকৃতি – যেন তার চারদিকে চারটি হাত রয়েছে, যা দিয়ে হাতে হাত ধরে অনেকের সঙ্গে লম্বা একটি শৃঙ্খল তৈরি করতে পারে। এটি সম্ভব হয়েছে কার্বন পরমাণুর বহির্দেশের কক্ষপথে চারটি ইলেকট্রন রয়েছে, যেগুলো অন্য মৌলসমূহের পরমাণুগুলোর সঙ্গে সহজেই বন্ধন (Bond) স্থাপন করতে পারে। এভাবেই তারা একটি লম্বা ও স্থায়ী শৃঙ্খল (Long and stable chain) স্থাপন করতে সমর্থ, যা জীবজগতের সমস্ত জৈবসত্তার মেরুদণ্ডস্বরূপ। আমাদের শরীরের শর্করা, অ্যামাইনো অ্যাসিড, ফ্যাটি অ্যাসিড, নিউক্লিক অ্যাসিড ইত্যাদি সবকিছুই এই কার্বন পরমাণুকে ঘিরে তৈরি হয়। এগুলো দিয়েই তৈরি হয়েছে আরএনএ, ডিএনএ, আমিষ, চর্বি, শর্করা ইত্যাদি আমাদের শরীরের যাবতীয় উপাদান। এজন্যই বলা হয় যে, আমরা সবাই বিশুদ্ধ কার্বনেরই একটি শংকর রূপ।

এর আগে বিজ্ঞানীরা জানতেন যে, এই জৈব পদার্থসমূহ শুধু জীবিত বস্তুসমূহের শরীরেই পাওয়া যায়, বা তারাই তা তৈরি করতে সমর্থ। এগুলো কোনোভাবেই মাটি বা পাথরে পাওয়া সম্ভব নয়। তাই এগুলো কী করে পৃথিবীতে এলো, এ-প্রশ্নটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা ছিলেন দ্বিধান্বিত। জৈব ও অজৈব বস্তুর মধ্যে এই সাগর-সমান ব্যবধানকে একত্র করার কোনো উপায় তাদের কাছে ছিল না। এজন্যই তারা মনে করতেন যে, এটি শুধু জীবিত বস্তুর শরীরে থাকা জৈবনিক স্ফুলিঙ্গ (vital spark) থেকেই উৎপন্ন হতে পারে। ধ্রুপদী গ্রিক যুগে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে অন্য খ্যাতনামা বিজ্ঞানী-দার্শনিকও এ ভাইটালিজমে বিশ্বাস করতেন।

এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বিশ শতকের প্রারম্ভেও আমাদের কাছে বংশগতি বা জেনেটিকস, জিনের বাহক তৈরি অণু ডিএনএ বা আরএনএ, আধুনিক যন্ত্রপাতি, যেমন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, এমআরআই, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি ধারণা ছিল নিতান্তই অপরিচিত। অষ্টাদশ শতকের খ্যাতনামা সুইডিশ রসায়নবিজ্ঞানী জোনস বার্জেলিয়াস বলেছিলেন, ‘জীবিত প্রকৃতিতে মৌল পদার্থসমূহ মৃত প্রকৃতির চেয়ে একটি ভিন্ন নিয়ম মেনে চলে।’ ঊনবিংশ শতকের খ্যাতনামা পদার্থবিদ লর্ড কেলভিন বলেছিলেন, ‘মৃত বস্তু কখনো জীবিত বস্তুতে রূপান্তরিত হতে পারে না, যদি তারা পূর্বতন জীবিত পদার্থের সংস্পর্শে না আসে। এটি মধ্যাকর্ষণ সূত্রের মতোই একটি স্বতঃসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক নিয়ম।’ এমনকি বিশ শতকের অগ্রণী কোয়ান্টাম পদার্থবিদ নিলস বোরও মনে করতেন যে, জীবনকে বুঝতে হলে আমাদের একটি স্বতন্ত্র ভৌত নিয়ম আবিষ্কার করতে হবে।

শুধু এ মহারথীরাই নন, বিবর্তনবাদের জনক অভিধা পাওয়া জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন নিজেও এই ‘জৈব ও অজৈব বস্তুর’ উৎপত্তিজনিত সমস্যাটি সমাধান করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বিভিন্ন অজৈব রাসায়নিক পদার্থের গঠন থেকে কী করে জৈব পদার্থের উদ্ভব হলো, তা চিন্তা করতে গিয়ে তিনি অনেকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। বন্ধু ও সহমর্মী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ হুকারকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন – ‘বর্তমানকালে জীবন-অণুর উৎপত্তির বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করাটা সত্যি আবর্জনার মতো বিরক্তিকর। আর আমাদের আরো বেশি করে চিন্তা করতে হবে পদার্থের উৎপত্তির বিষয়টি নিয়েও।’

এ-প্রশ্নটি নিয়ে ঊনবিংশ শতকের বহু বিজ্ঞানী এতই হতাশ ছিলেন যে, তাঁরা জুয়াড়িদের মতোই আচরণ করছিলেন। লর্ড কেলভিন একসময়ে প্রস্তাব করেছিলেন যে, মহাবিশ্ব ও জীবন – এ দুটোই অনাদিকাল থেকে বিরাজমান। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী-দার্শনিক হেরমান ভন হেল্মহোল্জও একই ধরনের চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন। বস্তুর মতোই জীবনও অনাদিকাল থেকে বিরাজমান, এরকমই ছিল তাঁদের ধারণা। তাঁরা ভাবতেন, পৃথিবীতে আসার আগে জীবন হয়তো অন্যত্র বিরাজমান ছিল, যা একটি রহস্যজনক উপায়ে ধূমকেতু বা উল্কার মাধ্যমে পৃথিবীতে ‘রোপিত’ হয়েছে। হেল্মহোল্জ বললেন – ‘যেখানেই কোনো নতুন পৃথিবীকে দেখতে পায়, সেখানেই মহাশূন্যে ভেসে বেড়ানো এসব জৈববস্তু জীবনের বীজ রোপিত করে।’ এভাবেই হেল্মহোল্জ, কেলভিন প্রমুখ বিজ্ঞানীর ভাবনা থেকে একসময়ে সর্বপ্রাণবাদ (Panspermia ev seeds everywhere) শব্দটি বেরিয়ে এসেছে।

অপারিনের বৈপ্লবিক ধারণাটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনি ১৯২২ সালে তাঁর ‘বলশেভিক হিরো’ আলেক্সেই বাখের মস্কোস্থ গবেষণাগারে কাজ করতে শুরু করেন। এ-সময় তিনি গবেষণার কাজে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বিদেশেও ভ্রমণ করেন। মস্কোর সে-সময়কার গৃহযুদ্ধপীড়িত কঠিন দিনগুলোতেও তিনি বো-টাই সহযোগে একটি ইউরোপিয়ান স্যুট পরিধান করতেন, যাতে তাঁকে খুব অভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে মনে হতো। সে-সময়কার নিদারুণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে সোভিয়েত সরকারকে সাহায্য করতে তিনি তাঁর
জৈব-রসায়নের জ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

এ-সংকটপূর্ণ সময়েও তিনি গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রশ্নসমূহ নিয়ে তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা নিবৃত্ত করে চলেছিলেন। অনেকের মতো তিনিও লক্ষ করলেন যে, ডারউইনের যুগান্তকারী গ্রন্থ অন দি অরিজিন অফ স্পিসিসের প্রথম অধ্যায়টিই অনুপস্থিত। অর্থাৎ জীবিত বস্তুর উৎপত্তি কী করে হলো, সেটি সে-বইটিতে আলোচনা করা হয়নি। তাই এ-বিষয়টি নিয়ে কিছু করতে এগিয়ে আসা তাঁর নিজের কাছেই কর্তব্য বলে মনে হলো। জীবনধারী বস্তুর উৎপত্তি সম্পর্কে খুঁজতে গিয়ে অপারিনের মনে হলো যে, প্রাথমিক জীবের উৎপত্তি হয়েছে তাদের চারপাশে অস্তিত্বমান তৈরি পদার্থসমূহ থেকেই। কিন্তু তারা কোথা থেকে এসেছে এবং কীভাবে এসেছে?

ঊনবিংশ শতকের রসায়নবিদরা ইতোমধ্যে ধারণা পেয়ে গেছেন যে, পর্যায়-সারণিতে অনেকগুলো মৌল থাকা সত্ত্বেও আমাদের শারীরবৃত্তিক আয়তনের প্রায় সবটাই তৈরি হয়েছে মাত্র ছয়টি পরমাণু দিয়ে – সেগুলি হচ্ছে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, সালফার ও ফসফরাস। আমাদের শর্করা ও স্নেহজাতীয় পদার্থগুলো প্রায় সবটাই কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন দিয়ে তৈরি। আমিষ তৈরি কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও সালফার দিয়ে। আমাদের ডিএনএ তৈরি কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও ফসফরাস দিয়ে। এই ছয়টি মৌল পদার্থই আমাদের শরীরের ৯৯ শতাংশ বস্তুকে তৈরি করে। তাই ১৫০ পাউন্ড ওজনের একজন ব্যক্তির শরীরে রয়েছে ৯৪ পাউন্ড অক্সিজেন, ৩৫ পাউন্ড কার্বন, ১৫ পাউন্ড হাইড্রোজেন, ৪ পাউন্ড নাইট্রোজেন, ২ পাউন্ড ফসফরাস এবং আধা পাউন্ড সালফার।

আরেকটি মজার তথ্য এই যে, আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকা এই ছয়টি মৌল মহাবিশ্বের উপাদানসমূহেরও সবচেয়ে বেশি থাকা মৌল। এর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হাইড্রোজেন, তৃতীয় অবস্থানে অক্সিজেন, ষষ্ঠ অবস্থানে কার্বন, ত্রয়োদশ অবস্থানে নাইট্রোজেন, ষোড়শ অবস্থানে সালফার এবং উনিশতম অবস্থানে ফসফরাস। এ-তথ্যটি থেকে অনেকেই মনে করেন যে, জীবনের উৎপত্তি এই রাসায়নিক তাস খেলারই একটি ‘শাফলিং’। এখন আমাদের শুধু জানতে হবে যে, এ-খেলাটি কীভাবে শুরু হয়েছে; এবং তা বিশদভাবে ব্যাখ্যাও করতে হবে। তবে এটি ঠিকমতো বুঝে ওঠা সত্যি কঠিন। এ-ছয়টি মৌলের সম্ভাব্য ‘কম্বিনেশন’ অচিন্ত্যনীয় সংখ্যক পদার্থের জন্ম দিতে সক্ষম। কার্বন এতই বহুগামী একটি মৌল যে, আমাদের জানামতে পৃথিবীতে এটি প্রায় এক কোটি বিভিন্ন ধরনের জৈব অণুর জন্ম দিয়েছে।

বলশেভিক রাশিয়া যখন ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আসার চেষ্টা করছে, তখন ১৯২৪ সালে তারা মস্কো ওয়ার্কার পত্রিকায় অপারিনের ৭১ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপিটি ছেপে দেয়, সেইসঙ্গে এ-স্লোগানটিও থাকে – দুনিয়ার মজদুর, এক হও। এর ১২ বছর পর অপারিন তাঁর তত্ত্বটিকে আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আরো পরিমার্জিত ও পরিশীলিত করে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন, যা ১৯৩৬ সালে ইংরেজিতে ছাপা হয়। এতে তিনি তুলে ধরেন জীবন-অণুর উৎপত্তিকালে পৃথিবীর আবহাওয়ার চিত্র, যা কয়েক বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বিরাজ করছিল। তিনি তাঁর ভূগোল ও জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান ব্যবহার করে এটি বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই পরিবেশটি কিছুতেই আজকের পৃথিবীর মতো ছিল না। আর এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এতে কী ছিল না, সে-প্রশ্নটি। অনেকেই বলেন যে, বায়ুমণ্ডলে আগে থেকেই অক্সিজেন নামক গ্যাসটি ছিল, যা আমাদের শ্বাসক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য। কিন্তু অপারিনই প্রথমে এটি সবার গোচরে আনেন যে, এটি একটি ভুল ধারণা এবং এই গ্যাস পরবর্তীকালে প্রাথমিক উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণের ফলে তৈরি হয়েছে। কাজেই জীবন উৎপত্তির আগে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কোনো অক্সিজেন ছিল না। পৃথিবীর তখনকার আবহাওয়া অনেকটা বৃহস্পতি গ্রহের মতোই ছিল, যেখানে রয়েছে অ্যামোনিয়া ও মিথেন। এ-দুটো গ্যাসের সঙ্গে পানি ও হাইড্রোজেন মিলেই জটিল জৈববস্তুর অণু তৈরি হয়েছে। জীববিজ্ঞানের কৃতী পুরুষ The Origin of Species বইটির সঙ্গে সংগতি রেখে অপারিন তাঁর বইটির নাম দিলেন The Origin of Life

 ঠিক একই সময়ে বিখ্যাত মুক্তচিন্তাবিদ, জীববিজ্ঞানী, জৈব-রসায়নবিদ, গণিতবিদ ও লেখক জে বি এস হ্যালডেন (১৮৯২-১৯৬৪) প্রায় একই ধরনের একটি তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন, যা Rationalist Annual নামে সাময়িকীটিতে The Origin of Life নামে ১৯২৯ সালে ছাপা হয়। এতেও দাবি করা হয়, প্রাথমিক মহাসাগরগুলোর উত্তপ্ত সরোবরে অ্যামোনিয়া, মিথেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড জাতীয় গ্যাসগুলো মিলে ‘জীবিত অথবা আধা-জীবিত’
জীবন-অণুর জন্ম দিয়েছে। নানা রকম বিরুদ্ধবাদীর সমালোচনার মুখে হ্যালডেন অবশ্য বিরক্ত হয়ে পরবর্তীকালে অন্য কাজে সরে যান এবং তাঁর এ-তত্ত্বটি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। তবে অপারিন তাঁর সারাজীবনই, অর্থাৎ ১৯৮০ সালে মৃত্যুবরণ করার আগে পর্যন্তই এ নিয়ে কাজ করে গেছেন। জীবন-অণু উদ্ভব হওয়ার এই তত্ত্বটি অপারিন হ্যালডেন তত্ত্ব নামে পরিচিতি পেলেও হ্যালডেন নিজে এ-বিষয়ে অপারিনের পূর্বগামিতার বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। আর ১৯৫৩ সালে ধ্রুপদী মিলার-উরে পরীক্ষা এই যুগান্তকারী ধারণাটিকে গবেষণাগারে সঠিক বলে হাতে-কলমেও প্রমাণ করেছেন।