প্রিয় সম্পাদক হাসনাতভাইকে ভোলা যায় না

’৬৯ সালে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তাঁকে আমি হাসনাতভাই বলে সম্বোধন করতাম। সে-সময় থেকে ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন রক্তকরবীর মঞ্চায়ন, ছায়ানটের বৈশাখ-উদযাপন, নজরুল ও রবীন্দ্র জয়ন্তী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে দেখা হতো। এভাবেই চলতে থাকল কিছুদিন। হঠাৎ ১৯৮১ সালের মে মাসের দিকে প্রয়াত শিল্পী কাজী হাসান হাবীব বলেন, ‘বীরেনদা আপনাকে হাসনাতভাই দেখা করতে বলেছেন, আগামীকাল রোববার আমি সংবাদে আপনাকে নিয়ে যাব।’

আমি বললাম, ‘হঠাৎ আমাকে তলব কেন?’ কোনো কিছু ব্যাখ্যা না করে হাবীব বললেন, ‘আপনি গেলেই বুঝতে পারবেন, তিনিই সব বলবেন।’ পরদিন হাবীব এলো আমার বাসায়। দুজন মিলে একটি রিকশায় চেপে বংশালে সংবাদ অফিসের উদ্দেশে রওনা হলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম হাসনাতভাই তাঁর চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে বললেন, ‘বীরেন কেমন আছেন?’

পিয়নকে ডেকে আরেকটি চেয়ার আনতে বললেন, সঙ্গে আরো দু-কাপ চা পাঠাতে বললেন। আমরা তিনজন কথা বলছি আর চা খাচ্ছি। হাবীব ছিল সাহিত্যপাতার আর্টিস্ট। হাবীব যথারীতি কাজে লেগে গেল। আমরা দুজন কথা বলতে থাকলাম এবং বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে কথা হচ্ছিল। আরো বললেন কিবরিয়া স্যার, আমিনুল ইসলাম স্যার, সফি স্যার কে কী করছেন। আবার জেনে নিলেন আমরা – অর্থাৎ আমি, শহিদ কবীর, মাহমুদুল হক, চন্দ্রশেখর দে – এরা কেমন আছেন, কে কী করছেন। এই কথোপকথনের মধ্যেই উপলব্ধি করতে পারলাম তিনি কতটা শিল্পানুরাগী ও সাহিত্যপ্রেমী। হাবীব যে কখন চলে গিয়েছিল আমি বুঝতেই পারিনি। একটু পরে পিয়ন এসে এক রোল ট্রেসিং পেপার, চায়নিজ ইংক, রাবার, পেনসিল, এক সেট স্কয়ার ইত্যাদি টেবিলে রেখে গেল। তখন পেন ব্যবহার করা হতো না। ক্রোকুয়েল নিব চাইনিজ ইংকে ডুবিয়ে চাপ দিলেই লাইন চিকন মোটা হতো – ড্রইং ও ইলাস্ট্রেশন করার জন্যে।

হাসনাতভাইকে বললাম, ‘আমাকে তলব করেছেন কেন?’ উনি বললেন, ‘হাবীব এই মাসে সাপ্তাহিক রোববারে চিত্রশিল্পী হিসেবে যোগদান করেছে। সম্পাদক কবি রফিক আজাদ। বীরেন  আপনাকে সংবাদের রোববারের সাহিত্য সাময়িকীতে শিল্পী হিসেবে কাজ করতে হবে।’ আমি জানালাম আমার দ্বারা হবে না। আমরা নবীন শিল্পীরা মনে করতাম বুক ইলাস্ট্রেশন করলে হাত স্টাফ হয়ে যায় তাই ছবি আঁকতে চাই। ‘আরে এ তো মাসে চারদিন। সাময়িকী বের হয় প্রতি রোববার, মাসে চারটি সংখ্যা। বিকেলে আসবেন, যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হবে চলে যাবেন। আপনি এক মাস করে দেখুন না।’ ‘কী করতে হবে আমায়?’ ‘তেমন কিছু নয়, যেমন – একটি গল্পের, একটি কবিতা আর কিছু হেডিং। আপনার ভালোই লেগে যাবে। আরে এক মাস করুন না, ভালো না লাগলে ছেড়ে দেবেন।’ তিনি এত সুন্দর করে বোঝালেন আর বললেন, ‘মাত্র তো এক মাসে চারটি সংখ্যা অর্থাৎ চারদিন আপনি যা আঁকবেন তাই ছাপা হবে। আপনার পূর্ণ স্বাধীনতা, আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করব না। ইলাস্ট্রেশন যতটা খুশি ততটাই মনমতো করবেন।’ আমি আমার মনমতো বিশেষ করে ইলাস্ট্রেশনগুলো এক্সপেরিমেন্ট করে করতে থাকলাম। হাসনাতভাইকে দেখালাম – ‘চলবে তো?’ তিনি বললেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করব না। ছাপা হোক, পাঠক দেখুক, মন্তব্য করুক, তখন বোঝা যাবে।’ এভাবেই এক মাস চলল।

ট্রেসিংয়ে সরাসরি ইলাস্ট্রেশন করা মানে রং-তুলি সঠিকভাবে সঞ্চালন করতে হতো, ধীরস্থির চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে হতো, একটু ভুল হলে ব্লেড দিয়ে স্ক্র্যাচ করতে হতো অথবা কাটতে হলে কেটে টেপ দিয়ে পেস্ট করতাম। ফিল্মে পজিটিভ করা হতো না। আমি দেখলাম ভালোই লাগছে। অতি অল্প সময়ে দ্রুত তাৎক্ষণিকভাবে কাজ করা – এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, ভালোই লাগছে। ভালো লেগে গেল। এক মাস পার হলো। হাসনাতভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগছে?’ আমি জানালাম, ‘ভালোই লাগছে। যেহেতু কাজ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ আছে। আরো কিছু করি না, দেখি কেমন হয়।’ হাসনাতভাই বললেন, ‘এখন থেকে আর ট্রেসিং পেপার ব্যবহার না করে সরাসরি কাগজে করবেন। আপনার পরীক্ষা দেওয়া শেষ হয়ে গেল।’ তখন থেকে আর্ট পেপার দিলেন, সঙ্গে পোস্টার কালার কালো ও সাদা রং। সরাসরি আর্ট পেপারে ওয়াশ দিয়ে রং ছিটিয়ে নানাভাবে চরিত্র অনুযায়ী হিউম্যান ফিচার ব্যবহার করে এক্সপেরিমেন্ট করতে থাকলাম। আমারও ভালো লাগছে। কাজগুলো ছাপা হচ্ছে এবং ছাপার পর দেখলাম এ এক অন্যরকম ভুবন – ওয়াশ দেওয়ায় এক ধরনের ডট তৈরি হতো। সবমিলিয়ে আমার ভেতর অন্য জগতের দোলা দিলো। আমি মনের আনন্দে কাজ করতে থাকলাম। আমার নামডাক হতে লাগল, প্রচুর ফোন আসতে লাগল কবি-সাহিত্যিক ও সুধী কতজনদের। শিল্পীরাও ভালো বলতে লাগলেন। আমি  মনের অজান্তে সংবাদকে ভালোবেসে ফেললাম।

হাসনাতভাইয়ের অনুপ্রেরণা আমার ভালো লাগত। কোনো সময় কোনো ইলাস্ট্রেশন পরিবর্তন করতে বলতেন না, সাহস জোগাতেন। ২২টি বছর এক টেবিলে সংবাদে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছি। এভাবেই তাঁর সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সময় পেলে সমকালীন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাববিনিময় করতেন।

আমার দেখা শিল্পবোদ্ধাদের মধ্যে হাসনাতভাই অন্যতম। কোন শিল্পকর্ম ভালো তিনি বুঝতে পারতেন। ছবি দেখতে এবং ছবি সংগ্রহ করতে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গে জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের – কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, মনিরুল ইসলাম প্রমুখের সখ্য ও যোগাযোগ ছিল।

সংবাদে প্রায় সকল প্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যিক, কবি, ঔপন্যাসিক আসতেন, লেখা দিতেন। তিনি প্রতিটি লেখাই ধীর-স্থিরভাবে সময় নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে বাছাই করতেন। কোনো কোনো সময় আমার সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনাও করতেন। একবার বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় সনজীদা খাতুনের একটি লেখা বারবার পড়ছিলেন। আমি তখন পাশের টেবিলে কাজ করছি। দু-কাপ চা দিতে বললেন। আমি একসময় বললাম, ‘এত কী ভাবছেন?’ তিনি সনজীদা খাতুনের লেখাটির একটি প্যারায় পেনসিলের দাগ দিয়ে আমাকে পড়তে বললেন। আমি তো হতবাক! তারপরও নিবিড় মনোযোগে লেখাটি পড়লাম। তিনি পায়চারি করছিলেন। সে-সুযোগে আমি লেখাটি দুই-তিনবার পড়লাম। তিনি একসময় বললেন, ‘কী করি বলুন তো?’ আমি নির্দ্বিধায় বললাম, ‘অংশটুকু ফেলে দিন।’ ‘আমি টেনশনে ছিলাম। তাই আপনার সঙ্গে শেয়ার করলাম। বাঁচালেন! বুঝতেই পারছেন তো একদিকে সন্জীদা আপার লেখা আর দেশে চলছে সামরিক শাসন।’ তখন টেবিলে পেস্টিং চলছে। ওই অংশটুকু পেস্ট হয়েও গেছে, রানিং চলছে। পেস্টারকে নির্দেশ দিলেন ওইটুকু ফেলে দিতে। ফেলে দিয়ে বাকি অংশ ওপরে উঠিয়ে দিয়ে লেখাটি রানিং করলেন। তিনি স্বস্তি প্রকাশ করে দু-কাপ চা অর্ডার দিলেন। চা খেতে খেতে বললেন, ‘বীরেন, বাঁচালেন! বড়ই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম।’ এরকম আরেকদিন হলো। হাসনাত আবদুল হাইয়ের একটি গল্প একটি বিশেষ প্যারায় দাগ দিয়ে আমাকে পড়তে বললেন। লেখাটির বিষয় ছিল তরুণ-তরুণীর ভালোবাসা-কথন এবং তার ভেতর দিয়েই তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ণনা। আমি লেখাটা পড়ে তা থেকে একটি বিশেষ অংশ বাদ দিতে বললাম। হাসনাতভাইও একমত হলেন এবং ফেলে দিলেন। আমাকে বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন দেশে সামরিক শাসন চলছে। সংবাদ বন্ধ হয়ে গেলে এই লোকগুলোর রুজি-রোজগার  সব বন্ধ হয়ে যাবে।’ তিনি প্রচণ্ড রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি হলেও সবার কথা বিশেষভাবে ভাবতেন।

একসময় আমি সংবাদ ছেড়ে দিই। তখন সংবাদের আর্থিক সংকট শুরু হয়েছে। আমার কিছুদিন পর হাসনাতভাইও সংবাদ ছেড়ে দেন। তারপর দায়িত্ব নেন কালি ও কলমের, সম্পাদক হিসেবে। শুরু হয় তাঁর নতুন যাত্রা। হাসনাতভাই ফোন করে জানান, ‘বীরেন আমি কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেছি। একদিন আসুন, চা খেয়ে যান।’ আরো জানালেন, ‘বীরেন, আমাকে সাহায্য করতে হবে। আবারো কিছু লেটারিং এবং ইলাস্ট্রেশন করে দিতে হবে।’ প্রথম প্রথম কিছু লেখা আমার লেটারিং দিয়ে চালালেন এবং পরে টাইপোগ্রাফি দিয়ে কালি ও কলমের মেকাপ করা শুরু হলো। মাঝে মাঝে ফোন করতেন বিশেষ সংখ্যার ইলাস্ট্রেশন করে দেওয়ার জন্য। আমিও দিতাম। আমি ছাড়াও কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, রোকেয়া সুলতানা, রণজিৎ দাস, আবদুস শাকুর প্রমুখ ইলাস্ট্রেশন করেছেন কালি ও কলমে। শিল্পী আবুল বাসেত সংখ্যায় একটি ইলাস্ট্রেশন করে দিয়েছি দুই পাতা জুড়ে। তাঁর সঙ্গে আমার শেষ কাজ শিল্পকলা সংখ্যায়। আমার কাছে লেখা চেয়ে তিনদিন সময় দিলেন। আমি লেখাটি তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়ে বললাম, ‘একটি ক্যাটালগ গ্রাফিক আর্টিক্যাল লিখব ’৭১ নিয়ে।’ তাঁকে ক্যাটালগ দিলাম। তিনি দেখে খুশি হলেন। কালি ও কলমের এই সংখ্যাতেই ছিল আমার শেষ কাজ।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা : ১৯৭১ সালে কলকাতায় রাজপথে দেখা। ‘বীরেন কবে এসেছেন?’ ‘এই তো কিছুদিন হলো।’ বললেন, ‘আসুন একটি দোকানে বসে চা খাই।’ চা খেতে খেতে বললেন, ‘আমি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ পত্রিকার সঙ্গে আছি। একটি লোগো করে দিন।’ আমি জানালাম, ‘কালি ও কলম, পেনসিল কিছুই নেই, কিভাবে দেব।’ উনি বললেন, ‘আমার  একটি ঝরনা কলম আছে এটা দিয়েই কোনো একটা করে দিন।’ আমি কোনো কিছু না পেয়ে একটি ম্যাচ কিনে ম্যাচের খোসা দিয়ে ঘষে ঘষে মুক্তিযুেদ্ধর লোগো করলাম। ওই লোগো দিয়ে পত্রিকা মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত হতে থাকল।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক-চিত্রশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব ছিল। সংগ্রহে ছিল বহু গুণীশিল্পীর শিল্পকর্ম। যেমন বিকাশ ভট্টাচার্য, যোগেন চৌধুরী, সনৎ কর, পরিতোষ সেন, বিজন চৌধুরী, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুল বাসেত, রফিকুন নবী প্রমুখ। তিনি ছিলেন লাজুক, মিতভাষী ও প্রচারবিমুখ। আমাদের সমকালীন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন একজন অসাম্প্রদায়িক, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সঙ্গে ২২ বছর একত্রে সংবাদে কাজ করে আমি পেয়েছি একজন অগ্রজ পথপ্রদর্শক ও বন্ধুকে।