আবুল মোমেন
এক
এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। উপলক্ষটি বাংলাদেশের ইতিহাস-চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন এদেশের সাধারণ গ্রামীণ পরিবারে। লেখাপড়ার সূচনাও পল্লিগাঁয়েই। নিজেই বলেছেন, ছাত্র হিসেবে তেমন মেধার স্বাক্ষর তিনি রাখেননি। তবে তখন থেকেই দেশ ও মানুষের কল্যাণ চিন্তা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে। তবে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল তাঁর নেতৃত্বগুণ। পরবর্তী জীবনে তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা ও নেতৃত্বগুণের আরো বিকাশ ঘটেছে। কলকাতায় দাঙ্গার সময় তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আর দেশভাগের পরে পাকিস্তানে তাঁর এই দুই দক্ষতার উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটেছে। সবরকম বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে তিনি একপর্যায়ে সাধারণ রাজনৈতিক নেতা থেকে জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হন।তাঁকে সামনে রেখেই বাঙালি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এবং স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাঁর অনুপস্থিতিতেও মুজিব ছিলেন মানুষের হৃদয়ে প্রেরণার উৎস হয়ে।
এই পর্যায়ে তাঁর নেতৃত্বগুণের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে ৭ই মার্চে প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে। এই ভাষণ আজ বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে গুণীজন কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গে ফিরে ফিরে আমরা ৭ই মার্চের ভাষণের কথা আলোচনা করে থাকি। তাঁর জন্মের শতবর্ষের প্রাক্কালে আজ আবারো এই ভাষণটির কথা বিশেষভাবে মনে করতে চাইছি। কেননা এই ভাষণের মধ্যে রয়েছে একটি জাতির গড়ে ওঠার ইতিহাস এবং দুঃসময়ে রুখে দাঁড়ানোর পথনির্দেশ। এক অর্থে বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমেই ইতিহাসের সুসময় পার করছে। কিন্তু অভিজ্ঞমহল জানে বাংলাদেশের এই উন্নয়ন এখনো যেমন টেকসই হয়নি, তেমনি বিপদমুক্তও নয়। একদিকে অর্থনীতিতে শিল্পখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভবিষ্যৎকে রাজনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের উত্থানের আশঙ্কাকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। আমরা লক্ষ করছি, এই দুই ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
উন্নয়নের একটি ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে জাতি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনছে। সেই স্বপ্ন যেন সঠিক ভূমির ওপর তৈরি হয় যার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে উদ্দীপক ও প্রেরণাদায়ী উপাদানের কাছেই হাত পাততে হবে। সেই বিবেচনায় আমরা ৭ই মার্চের ভাষণের কাছে একবার ফিরে যাব।
দুই
কোনো ভাষণ, যা তাৎক্ষণিকভাবে বক্তা মুখে মুখে বলে যান, যা সবচেয়ে অবস্তুগত (Intangible) সাংস্কৃতিক সম্পদ তা শিল্পের মতো কালের উজান বেয়ে টিকে থাকে, তেমনটা দেখা যায় না। অতীতে যখন শব্দ-ধারণ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না, তখনকার কথা আমরা বাদ দিতে পারি। কারণ সেরকম বক্তৃতার বিবরণী আমরা পেতে পারি, কিন্তু তা বক্তার স্বকণ্ঠে শোনার সুযোগ তো নেই। রোমান ঐতিহাসিক ও লেখক প্রেত্রার্কের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন রোমের সিনেটর সিসেরো ছিলেন অসাধারণ এক বাগ্মী। প্রথম শতাব্দীর এই রোমান দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক সম্পর্কে লিখে গেছেন পরবর্তীকালের গুণী কবি ও লেখক। আর সিসেরোর মতাদর্শের এই পুনরাবিষ্কার ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আলোকনে প্রভাব ফেলেছিল। পোলিশ ঐতিহাসিক তাদেউশ জিয়েলিনস্কি (Tadesz Zielinski) লিখেছেন, ‘ÔRenaissance was above all things a revival of Cicero, and only after him and through him of the rest of classical antiquity.’ সিসেরোর ভাগ্যের বা দুর্ভাগ্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনেরও মিল আছে। জুলিয়াস সিজার যখন একনায়কতন্ত্র চালু করেছেন, তখন থেকে সিসেরো প্রজাতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন। সিজারের মৃত্যুর পরে ক্ষমতা দখলকারী মার্ক অ্যান্টনির ভাড়াটে খুনিরা ৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গণতন্ত্রের এই মহান প্রবক্তাকে হত্যা করে।
পরবর্তীকালেও অনেকের লেখায় সেকালের বা লেখকের সমকালের অনেকেরই তুখোড় অসাধারণ বাগ্মিতার বিবরণী পাই। এরকম দুটি ভিন্ন স্বাদের বিবরণী এখানে আমরা শুনে নিতে পারি।
১৯২৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন। সে-সময় তাঁকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির উদ্যোগে করোনেশন পার্কে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিতমতো যে-ভাষণ দেন তার বর্ণনা আছে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ আবুল ফজলের (১৯০৩-৮৩) আত্মজীবনী রেখাচিত্রে। প্রাসঙ্গিক অংশ আমরা শুনতে পারি – ‘কবির জন্যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল পার্কের পূর্ব ধারে – কাজেই কবি যখন বক্তৃতা দিতে দাঁড়ালেন তখন তিনি সূর্যের মুখোমুখি। যখন ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে, যে সূর্যের তখনকার কিরণের সঙ্গে তাঁর গায়ের রঙ একাকার হয়ে মিশে গেছে, সে সূর্যের দিকে চেয়ে, তার অস্তগমনের সঙ্গে নিজের অস্তগমনোন্মুখ জীবনের তুলনা দিয়ে এক অতুলনীয় ভাষায় বক্তৃতা শুরু করলেন তখন বিপুল জনতা কবি-মুখনিঃসৃত ভাষার সৌন্দর্যে ও কণ্ঠের মাধুর্যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কোনো কথা কি ভাবের জন্যে তাঁকে ভাবতে দেখিনি। ঝরণার ধারার মতো তাঁর কণ্ঠ থেকে বাণীর স্রোত বয়ে চলেছে।’ (পৃ ১৪২)
আর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের এক অপূর্ব স্মৃতিচারণ করেছেন নির্মলেন্দু গুণ তাঁর এক অবিস্মরণীয় কবিতায় –
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন
তাঁর অমর-কবিতাখানি –
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।
(‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’)
তিন
ইংরেজিতে যাকে বলে oratory তারই বাংলা বাগ্মিতা। oratory -র আভিধানিক অর্থ, অক্সফোর্ড অভিধানের মতে, Public speaking, especially when used skilfully to affect an audience. জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর বঙ্গভাষার অভিধানে বাগ্মী শব্দের অর্থ দিয়েছেন ‘যে পরিমিত সারবাক্য বলিবার কৌশল জানে।’ তাহলে তিনি জনগণ বা শ্রোতার উদ্দেশে যা বলেন সেটাই বাগ্মিতা। সেদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ রাজনৈতিক বিষয়ে বাগ্মিতার শ্রেষ্ঠ এক নিদর্শন।
সাধারণত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আলোচনায় যেসব ভাষণের প্রসঙ্গ অনেকেই নিয়ে আসেন সেগুলো লিখিত পূর্বপ্রস্তুতকৃত ভাষণ, ঠিক বাগ্মিতার নিদর্শন নয়। আমরা এই সূত্রে আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ (নভেম্বর ১৮৬৩), স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ (সেপ্টেম্বর ১৮৯৩) কিংবা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের আই হ্যাভ এ ড্রিম (আগস্ট ১৯৬৩ ভাষণ)-এর কথা বলতে পারি। লিংকন যুক্তরাষ্ট্রের দাসপ্রথা উচ্ছেদের পটভূমিতে চলমান গৃহযুদ্ধের অবসান চেয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এ-ভাষণটি দিয়েছিলেন। সেদিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ছিল বৈরী শ্বেতাঙ্গ জনমতকে সরকারের এ-সিদ্ধান্তের অনুকূলে আনা। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভাষণটি ঐতিহ্যানুযায়ী লিখিতই ছিল এবং বক্তৃতার খসড়া নিয়ে লিংকন বরাবর খুঁতখুঁতে ছিলেন বলে এর পাঁচটি খসড়া পাওয়া যায়। তাছাড়া এ-ভাষণের সার্ধশত বছর পরে আজ নিশ্চয় প্রশ্ন তোলা যায় – দাসপ্রথা আইনগতভাবে রহিত হলো বটে, কিন্তু তাঁর সে-লক্ষ্য কি আজো পূরণ হয়েছে? ১৯৬৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা কিং জুনিয়র তাঁর ভাষণে যখন কালো মানুষের মুক্তি ও সমানাধিকারের স্বপ্নের কথা বলেন তখন তো স্পষ্ট হয়ে যায় লিংকনের বাণী শতবর্ষ পরেও উপেক্ষিত থেকে গেছে, নয়তো সে-দেশের কৃষ্ণাঙ্গরা নাগরিক অধিকার আন্দোলন কেনই বা করবে আর তার একজন নেতা কেন শতবর্ষ পরেও মুক্তি ও সমানাধিকারের স্বপ্ন দেখবেন? এদিকে রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন আরো অর্ধশতবর্ষ পরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গেটিসবার্গ ভাষণ অমর হয়ে আছে তাতে উচ্চারিত গণতন্ত্রের শাশ্বত সংজ্ঞাটির জন্য। জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা তাতে ব্যক্ত হয়, যেমনটা হয়েছে কিং জুনিয়রের ভাষণে, কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথনির্দেশ কোথাও ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষণ মূলত মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তির বিষয়ে। আজকের ভোগবাদী বিশ্বে মানুষের মনোজাগতিক সংকট যখন তীব্রতর হচ্ছে তখন এ-ভাষণে ব্যক্ত আহ্বানের প্রাসঙ্গিকতা, বিশেষত এতে ক্ষুদ্র ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উদার মানবতার যে-বাণী ধ্বনিত হয়েছে তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে এর আবেদন মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার কাছে, যা প্রত্যেক মানুষকে ব্যক্তি হিসেবেই অর্জন করতে হয় – কিন্তু জাগতিক ক্ষেত্রে সামষ্টিক মুক্তির যে-সংগ্রাম তা ব্যাহত হলে সেটি অর্জন করা অধিকাংশের জীবনেই অপূর্ণ থেকে যাবে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সেদিন কী ভূমিকা পালন করেছিল?
এই প্রশ্নের উত্তরটি দেওয়ার আগে এই ভাষণের যিনি নির্মাতা অর্থাৎ নায়ক তাঁকে জানতে হবে। নয়তো এটিকে কোনো বাগ্মীর আকস্মিক পারঙ্গমতার দৈব সার্থকতা ভাবার ত্রুটি ঘটতে পারে। বঙ্গবন্ধু এবং ৭ই মার্চের ভাষণ ইতিহাসের এ দুই অভিন্ন পাত্রকে ইতিহাসেরই প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। তবেই এ-ভাষণের তাৎপর্য যথাযথভাবে বোঝা যাবে।
চার
এই বাংলার গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের ডানপিটে কিন্তু আদরের ছেলে খোকা ছোটবেলা থেকেই কয়েকটি বিশেষ গুণের পরিচয় দিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের সুবোধ বালক গোপাল-টাইপ নয়, ছেলেটি ছিল দুষ্ট বালক রাখালের মতো, যার প্রতি পক্ষপাত গোপন করেননি খোদ রবীন্দ্রনাথ।
গোপালদের জীবন যখন নিজের লেখাপড়া এবং পরিবারের গণ্ডিতে বাবা-মায়ের নির্দেশিত বাঁধা পথে মসৃণ গতিতে চলে তখন রাখালদের চোখ যায় নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে এদিক-সেদিক, মন নিছক পড়াশোনার কর্তব্য পালন করে আত্মোন্নয়নে আনন্দ পায় না, ছুটে যায় বাইরের দিকে। খোকা কল্পনার কবি হতে চায়নি, তার চোখে পড়েছে সাধারণ ছেলেদের দুঃখকষ্ট, মন গিয়েছে প্রতিবেশী ও সহপাঠী সমবয়সীদের বঞ্চনা-সমস্যার দিকে। না, রাখালদের পক্ষে আত্মমগ্ন থেকে স্বার্থবুদ্ধিতে চলা সম্ভব নয়। জ্বরের মধ্যেও এ-তরুণ রাখাল রিলিফের কাজ করেছে। তাঁর মুখেই শুনি, ‘জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না, দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা এসময় আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, Sincerity of purpose and honesty of purpose থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই ‘ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ ২১)
আমরা লক্ষ করি টুঙ্গিপাড়ার বালক খোকা পরিবারের চেয়ে প্রতিবেশীর কথা, নিজের চেয়ে সহপাঠীদের প্রয়োজন নিয়ে ভাবে বেশি। কী দ্রুত বালকের ক্ষেত্র প্রসারিত হতে থাকে। পরিবারের সন্তান খোকা পাড়ার ও সমাজের মুজিব হয়ে ওঠে। স্কুলের ছাত্র হয়েও ইতিহাসের সেই উত্তাল সন্ধিক্ষণে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ছেড়ে দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতির জগতে পা রাখতে ভয় পায়নি। কেবল অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই আমরা দেখতে পাব কীভাবে বাংলার সাধারণ পরিবারের এক সন্তান গ্রামীণ মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মাপা জীবনের ছকে বাঁধা আকাঙ্ক্ষার ছোট ছোট গণ্ডি অতিক্রম করে উত্তরোত্তর বড় জীবনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান কালের সন্ত্রাস ও চরমপন্থার সংকট নিয়ে আলোচনায় নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন একজন মানুষের যুগপৎ অনেক পরিচয় থাকে এবং সেইসব পরিচয় বিকশিত হলে মানুষটির পক্ষে উদার মানবিক হওয়া সহজ। সেভাবে আমরা বালক মুজিবের তৎকালীন পরিচয়গুলোর সংক্ষিপ্ত তালিকা করতে পারি।
গ্রামের ছেলে, গৃহস্থ সচ্ছল কৃষক পরিবারের ছেলে, মুসলিম ছেলে, স্কুলছাত্র, খেলাধুলায় পারদর্শী এবং তাঁর নিজের ভাষায় একটু মাথা গরম – ‘আমার নিজেরও একটা দোষ ছিল, আমি হঠাৎ রাগ করে ফেলতাম।’ (পৃ ৮০) যদি সেকালে যেসব গুণের প্রকাশ ঘটেছিল তার তালিকা করি তাহলেও নানামুখী বৈশিষ্ট্য ধরা পড়বে – উদ্যমী, উৎসাহী, সেবাপরায়ণ, বন্ধুবৎসল, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ইত্যাদি। এর সঙ্গে যে-কটি মানবিক গুণ যোগ না করলে পরবর্তীকালের উত্তরণ বোঝা যাবে না তা হলো – বালকের সাহসিকতা, মনোবল, দায়িত্ববোধ, পরোপচিকীর্ষা, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম। প্রথম তালিকার গুণাবলি তাঁকে উন্নত মানুষ হতে সাহায্য করেছে আর পরবর্তী তালিকার গুণাবলি তাঁকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে দায়িত্বপালন ও নেতৃত্বদানের যোগ্য করে তুলেছে। অন্তর থেকে এমন প্রণোদনা না থাকলে পিতা-মাতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন থানা, হাজত, জেল আর মামলা-হুলিয়া মাথায় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কঠিন জীবন যাপন সম্ভব হতো না। স্ত্রী বলেছেন, ‘ভুলে যেও না, তুমি হার্টের অসুখে ভুগছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।’ আবার তিনি লিখছেন, কন্যা ‘হাচু আমাকে মোটেই ছাড়তে চায় না। আজকাল বিদায় নেওয়ার সময় কাঁদতে শুরু করে। কামালও আমার কাছে এখন আসে।’ (পৃ ১৮৫) সেই স্নেহমায়াবন্ধন কাটানো বড় সহজ কাজ নয়। অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘ছেলেমেয়েদের জন্যে যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।’ (পৃ ১৬৪)
পাঁচ
এবার তাঁর সময়ের ইতিহাসের যাত্রাপথে রেখে যদি এই মানুষটির জীবন পাঠ করি তাহলে আমরা দেখব বালক তাঁর সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোর যথার্থ বিকাশ ঘটাতে সফল হয়েছেন। নিশ্চয় কখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব এসেছে, পিছুটান তাড়িয়ে ফিরেছে, কখনো হতাশায় ভুগেছেন, কখনো বা আক্ষেপ হয়েছে কিন্তু এসবের কাছে তিনি হারেননি, হাল ছাড়েননি, এসবকে বাস্তবের স্বাভাবিক কিন্তু সাময়িক অনুষঙ্গের বেশি মূল্য দেননি। এর পেছনে আরো দুটি বড় গুণ কাজ করেছে, যা বৃহত্তর জীবনে বড় কাজে জড়িয়ে বাধাবিপত্তি সামলাতে গিয়ে তাঁর আয়ত্ত হয়েছে। এ দুই গুণ হলো আত্মবিশ্বাস এবং সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। তাঁরই লেখা থেকে কয়েকটি সাক্ষ্য হাজির করি। ৯২(ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরে নেতাদের মধ্যে যে নীতিহীনতা ও দোলাচল দেখেছেন তাতে ক্ষুব্ধ শেখ মুজিবের উপলব্ধি – ‘এই দিন থেকেই বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হল। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা এবং কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ ২৭৩) হকসাহেবকে নেতা মেনেও তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত শেখসাহেবকেই নিতে হয়েছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী শেষ হয়েছে এ-ঘটনাটি উল্লেখ করে। এভাবেই একের পর এক সময়োচিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী মুসলিম লীগ ছাড়লেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলেন, যথার্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে উত্তরণের জন্য দলের নাম থেকে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পরিচয় মুছে দিলেন, তাঁর নেতা শহীদসাহেবের ভ্রান্তি ধরিয়ে দিলেন, দূরে সরলেন তাঁর কাছ থেকে, কমিউনিস্ট না হয়েও একসময় সমাজতন্ত্রের রাজনীতি সমর্থন করলেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজে কম্যুনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি।’ (পৃ ২৩৪)
বাঙালি পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান, বিশেষত যদি কন্যা হয় তবে পিতার কেবল মুগ্ধ অনুসারী হয় না, একসময় সতর্ক অভিভাবকও হয়ে ওঠে। আর এক্ষেত্রে সেই কন্যাকে একসময় একদিকে দেশবাসী আর দশজনের মতো পিতাকে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে অভিভূত হয়ে দেখার সাক্ষী হতে হয় আর অন্যদিকে ইতিহাসের ফেরে নির্মম বিয়োগান্ত ঘটনার শিকার হয়ে সেই পিতার আরব্ধ কাজ শেষ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়। এমন মানুষটির পর্যবেক্ষণ এই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে বোঝার জন্য কাজে আসবে।
বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনে জনসভা, গোপন বৈঠক, জেলা সফর, বারবার জেলে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু শত ব্যস্ততার মধ্যেও দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় কখনো দ্বিধা বা দেরি করেননি বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা লেখেন, ‘১৯৭০-এর সেই দিনগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনীতির এক ক্রান্তিকাল। তা সত্ত্বেও সকল রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ফেলে দিয়ে ছুটে চলে গিয়েছিলেন তিনি।’ (শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃ ১০৬) বিজয় বা ক্ষমতা নিয়ে তিনি ভাবেননি, সময় নষ্ট করেননি, ছুটে গেছেন দুর্গত অঞ্চলে বিপন্ন মানুষের কাছে।
ছয়
তরুণ শেখ মুজিব তাঁর সমকালের ইতিহাসের সহযাত্রী হয়েই পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হয়েছিলেন। তাঁর ইতিহাস-চেতনায় বরাবর ব্যক্তিকে ছাপিয়ে জনগণই মুখ্য ভূমিকায় ছিল। এটি তাঁর নিজের একক যাত্রাপথ নয়, তিনি একটি জাতির সহযাত্রী হয়েছিলেন, একসময় অগ্রণী যাত্রী হিসেবে সেই জাতির মধ্যে মুক্তি ও একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুনেছিলেন।
পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহর পূর্ব বাংলায় প্রথম সফর এবং প্রথম ভাষণ আরো অনেকের মতো তাঁরও স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়েছিল, তাঁর বিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিয়েছিল। আরো অনেকের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন সাধের পাকিস্তানে তাঁর ঠাঁই হলো কারাগারে। কারাগার তাঁকে থামাতেও পারেনি, দমাতেও নয়, বরং এ-সময় পড়ালেখা ও আলোচনার মাধ্যমে তাঁর ভাবনার জগৎ সমৃদ্ধ হতে থাকল, রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় স্বজনদের কল্যাণে বিকল্প পথের বিষয়ে অনুসন্ধানী হয়ে উঠল।
পরবর্তী সব বড় রাজনৈতিক বাঁকবদলে শেখ মুজিব সক্রিয় ভূমিকা নিলেন – যুক্তফ্রন্ট গঠন, চুয়ান্নর নির্বাচনী প্রচারণা-বিজয় ও সরকার গঠন, আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার রাজনীতি প্রচলন ইত্যাদিতে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ক্রমেই শেখ মুজিবই মূল সক্রিয় সংগঠক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিলেন এবং তাতে সম্মিলিত বিরোধী দল ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করে মাঠে নেমে এই বাংলায় আলোড়ন তুলেছে, তখনো তরুণ নেতা মুজিব সবাইকে ছাপিয়ে জনগণের এমন নেতা হয়ে উঠেছেন যাঁর ওপর মানুষ ভরসা করতে চাইছে অর্থাৎ তাঁর কাছেই মানুষের প্রত্যাশা বাড়ছিল। দ্বিতীয় বিষয়টি এর সঙ্গেই সম্পর্কিত, পাকিস্তান সরকার অন্য বাঙালি নেতাদের চেয়ে তাঁর স্বাতন্ত্র্য সহজেই বুঝতে পারছিল। যখন তিনি ছয় দফা নিয়ে মাঠে নামলেন, তখন জনগণ এ-দাবি লুফে নিল, তাঁর পিছনে শামিল হলো এবং তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রাখল। এই শুরু হলো শেখ মুজিবের প্রকাশ্যে বাংলাদেশ অভিযাত্রা। সেই পঞ্চাশের দশক থেকে এই বাংলার জনপদে-জনপদে কত জনসভা তিনি করেছেন, কত ভাষণ দিয়েছেন। পাকিস্তান সরকারের কারাগার, ষড়যন্ত্র, মামলা-মোকদ্দমা কিছুই তাঁর পথের বাধা হতে পারেনি, কারণ দিনে দিনে জনচিত্তে তাঁর আসন কেবল পোক্ত হয়েছে, বিস্তৃতি লাভ করেছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নেতা-জনতার এই ঐক্যে ফাটল ধরাতে পারেনি, কারণ নেতার ওপর জনতার বিশ্বাসের ভিত্তি ততদিনে অনেক দৃঢ় হয়ে গিয়েছে।
ছাত্র-জনতা শুধু দুঃশাসক পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত হানার জন্য উপযুক্ত সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ছাত্ররা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেই সুযোগটি তৈরি করেছে এবং তা কাজেও লাগিয়েছে।
মুক্ত মুজিবকে আর কেবল ক্ষমতার রাজনীতির গণ্ডিতে বিচার করা যাবে না, কারণ ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, গণঅভ্যুত্থান এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের আন্দোলন মিলে ততদিনে রাজনীতি ছাপিয়ে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা রূপ নিয়েছে গণমানুষের দাবিতে। তাদের সবার নেতা তো শেখ মুজিব। তাই এখন তিনি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন, এক জাগ্রত স্বাধীনতাকামী জাতির, সমগ্র জাতির নেতা, বঙ্গবন্ধু; ইতিহাসের পাত্র নন, নির্মাতা, দেশের একজন নেতামাত্র নন, বাঙালি রাষ্ট্রের রূপকার।
আজ পেছনে ফিরে তাকালে বুঝি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন – ক্ষুদ্র স্বার্থে-কোন্দলে অভ্যস্ত বিভক্ত জাতির আস্থা অর্জন। আর অবদান? সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত চিরকালের পদানত বাঙালিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ স্বাধীন জীবনের এবং ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে ঘরকুনো অলস বাগাড়ম্বরপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে রূপান্তরিত করেছিলেন বীরের জাতিতে। সেই ঐক্য, ত্যাগ ও বীরত্বের প্রথম প্রতিফলন ঘটল সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে – তখন আওয়ামী লীগ কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, ঐক্যবদ্ধ বাঙালির স্বপ্ন বাস্তবায়নের সোনারতরী। আর এর ফসল ফলল একাত্তরে – মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে।
সাত
১৯৭১-এ যখন নির্বাচনোত্তর ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করছে দেশ তখন এই রূপান্তরিত জাতি তার সকল স্বপ্নপূরণের প্রতীক নেতার কাছে কী প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল, তাদের ভেতরে উত্তেজনার পারদ কোন পর্যায়ে তা আমরা বুঝতে পারি।
৭ই মার্চের পটভূমি আমাদের কাছে পরিষ্কার। এই অসামান্য ভাষণটি আমার বিবেচনায় এক কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম। শিল্পকর্ম কারণ এতে একটি জাতির সংগ্রাম ও স্বপ্নকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে, তার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। ফলে একটি শিল্পকর্মের মতোই এটি হয়ে উঠেছে অমর, অনিঃশেষ, এর স্বাদ বারবার নেওয়া যায়, নতুনতর বাস্তবতায় এর নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণেরও সুযোগ তৈরি হয়। আজ তাই এ-ভাষণটি কেবল শিল্পকর্ম নয়, কালোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম। আমার আজকের বক্তব্যে প্রথম পর্বে অন্য যেসব ভাষণের কথা বলেছি সেগুলো বেশিরভাগ ইতিহাসের অংশ, গবেষকের প্রয়োজন মেটায় এবং প্রায় সবই পূর্বপ্রস্তুতকৃত লিখিত ভাষণ। কিন্তু দলমত-ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে অনুপ্রেরণার জন্য যেমন আমরা শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধে যাই, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যেন জাতির জীবনে তেমনি সর্বজনীন একটি প্রতীক।
আট
আজো কেন আমরা এ-ভাষণটি শুনি? এ-ভাষণ শুনলে আজো কেন অনুপ্রাণিত বোধ করি? এবং, কেন মনে হয়, যিনি বাঙালি – তাঁর দেশ ধর্ম যাই হোক – এ-ভাষণ একবার অন্তত না শুনলে তাঁর চেতনায় ঘাটতি থেকে যাবে?
বাংলার লোকগান না শুনলে বা তাতে রস না পেলে যেমন ঠিক বাঙালি হওয়া যায় না, তেমনি এ-ভাষণ না শুনলে, এটি শুনে অনুপ্রাণিত বোধ না করলে, সেও বোধহয় খাঁটি বাঙালি হয় না। জঙ্গি হয়, মৌলবাদী হয়, কিংবা দিশেহারা মানুষ হয়ে যায়। এটি কেবল বাঙালির নয়, এদেশে বসবাসরত সকল মানুষের, রাজনৈতিক দিগদর্শনের আলেখ্য।
শহীদ মিনার যেমন আমাদের চেতনার প্রতীক, সারাদেশে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এটি ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ বাঙালিমাত্রের অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে। এ-ভাষণের সূত্রে এর পেছনের মানুষটি, যিনি এর শিল্পী, তাঁর জীবনের আলেখ্যও সকলকে আবেগের অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঙালি-জীবনের প্রতীক, আর তাই তার চেতনায় আবেগ ও উদ্দীপনার নতুন সঞ্জীবনী সঞ্চার করে।হয়তো তাই এদেশের ইতিহাসের বড় বড় সংগ্রামী কিংবদন্তির নেতা, যেমন তিতুমীর, নেতাজি, মাস্টারদাকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুই হয়ে যান সৃজনশীল মানুষের চেতনার অফুরন্ত খোরাক। সমকালের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা, যাঁদের তিনি একসময় গুরু মেনেছেন, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীকেও ছাপিয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু – তাঁদের স্মৃতি ঝাপসা করে দিয়ে, ইতিহাসের পাতায় সীমাবদ্ধ করে তিনি হয়ে ওঠেন এদেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের নেতা, চলমান ইতিহাসে এখনো প্রাসঙ্গিক, এখনো প্রেরণার জীবন্ত উৎস। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই যুগ যুগ ধরে রচিত হচ্ছে অমর জনপ্রিয় সব গান, কবিতা, ছড়া। মানুষ তাদের নেতাকে স্মরণ করতে চায়, চায় স্মরণীয় করে রাখতে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.