সৃষ্টির শুরুতে মানুষ ছিল যাযাবর। জীবিকা ও আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষকে নিরন্তর ছুটে বেড়াতে হয়েছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। এভাবেই মানুষ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। আর মানুষের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে মূলত ভাষার মাধ্যমে। অথচ সেই ভাষা কীভাবে মানুষের মুখে এলো তা আজ অবধি গবেষণার বিষয়। সৃষ্টির সূচনালগ্নে বাসাহীন মানুষ ভাষাহীনও ছিল কি না সে-বিষয়ে এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। এক্ষেত্রে ধর্মাশ্রয়ী হয়েও ধর্মবিশ্বাসের ভিন্নতা হেতু কোনো অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছা দুরূহ। তবে সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষের বিশ্বাস, ভাষা সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া এক ঐশী দান। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ আল কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রথম মানব ও মানবী যথাক্রমে আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)। তাঁরা স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে এলে তাঁদের কথন কী ভাষায় সম্পন্ন হয়েছে সে-বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। বাইবেল থেকে জানা যায় যে, নুহ (আ.)-এর সময় পর্যন্ত মানুষের ভাষা ছিল একটাই। তাই সবাই সবার কথা বুঝতে পারায় তাদের ভাববিনিময়ে কোনো অসুবিধা হতো না। তবে কালক্রমিক বিবর্তন আর রূপান্তরের মাধ্যমে মানবভাষায় যে বৈচিত্র্য ও শৃঙ্খলা আসে তা অস্বীকার করা যায় না। হয়তো ভাব প্রকাশের কাজটি প্রথম শুরু হয়েছিল দৈহিক নানা অঙ্গভঙ্গি আর ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রথমদিককার সে-প্রকাশটা ছিল দৈহিক অঙ্গভঙ্গি ও নিছক কিছু উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যাকে বলা যায় সাংকেতিক ভাষা। মার্কসবাদী লেখক রেবতী বর্মণ তাঁর সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ গ্রন্থে বলেন, ‘পশুর মতোই মানুষ প্রথমটায় শুধু অস্পষ্টভাবে চেঁচাইতে পারিত। হাইডেলবার্গ মানুষেরা খাদ্য-আহরণে বাহির হইয়া পরস্পরকে মনের ভাব জ্ঞাপন করিত পশুর মতন চিৎকার করিয়া, – চিৎকারের পরিপূরক ছিল অঙ্গভঙ্গি ও হাত নাড়ানো। এই রকম ভাষাকে বলা যায় সাংকেতিক ভাষা। পশুর স্তর হইতে শিকারীর পর্যায়ে না উঠা পর্যন্ত ইহাই ছিল মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম।’
কালপরিক্রমায় মানুষের সীমিতসংখ্যক ধ্বনিসর্বস্ব শব্দসম্ভারে আসে বৈচিত্র্য। যাযাবর ও শিকারি মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজন ও চিন্তার তাড়নায় বাক্যন্ত্রগুলো উৎপাদন করে চলে নতুন নতুন অর্থবোধক শব্দ। নব নব শব্দের গাঁথুনিতে তাদের ভাবপ্রকাশে আসতে থাকে শৃঙ্খলা, বিকশিত হতে থাকে মানুষের বাচিক ভাষা। যাযাবর মানুষের স্থান থেকে স্থানান্তরে গমনের কারণে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষার আদান-প্রদান হয়। শিকারি জীবন থেকে মানুষ একসময় কৃষিতে পদার্পণ করে। শুরু হয় স্থায়ী বসতি। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বা আঞ্চলিক সীমারেখার মধ্যে একটি জনগোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ জীবন-যাপনে তাদের মৌখিক ভাষা একটি স্বতন্ত্র রূপ ও অবয়ব লাভ করে। লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ কাসেম রচিত ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর কৃষি ও শিল্পকর্ম আরম্ভ হওয়ার পর মানুষ একসাথে সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করার সময় পরস্পরের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য
শব্দ ও পদের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। ফলে ভাষা আস্তে
আস্তে এগিয়ে যেতে থাকে সুবিন্যস্ত ও বিধিবদ্ধ সাবলীলতার দিকে। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, এই বিধিবদ্ধ সাবলীল ভাষা সর্বপ্রথম শুরু হয়েছিল প্রায় আট হতে দশ হাজার বছর পূর্বে মিশরের নীল অববাহিকায় যুগপৎ কৃষি ও শিল্পকর্ম আরম্ভ হওয়ার পর।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাংলাভাষা পরিচয় গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘এই ভাষা (বাংলা ভাষা) আজও আপন অঙ্গুলি নির্দেশ করছে দূর পশ্চিমের সেই এক আদিজন্মভূমির দিকে যার নিশ্চিত ঠিকানা কেউ জানে না।’ প্রাচীন বৃহৎ বঙ্গভূমির একটি অংশ নিয়ে আজকের বাংলাদেশ। বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত এই বৃহৎ বঙ্গভূমির পরিচয়ও ছিল তখন ভিন্ন ভিন্ন নামে। এসব জনপদে বসতিও ছিল নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের। তাদের কোনো একক প্রামাণ্য ভাষাও ছিল না। তবে বৃহৎ বঙ্গে যে আদি নরগোষ্ঠীর প্রাধান্য ছিল তারা হচ্ছে অস্ট্রিকভাষী। প্রাচীন সাহিত্যে এদের নিষাদ (ব্যাধ) বলা হয়েছে। পরেই রয়েছে দ্রাবিড় ভাষার জনগোষ্ঠী। বঙ্গভূমিতে মানববসতির ইতিহাস এদের (অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়) দিয়েই শুরু হলেও এরা সবাই ছিল আগন্তুক। প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ শরীফ তাঁর বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব গ্রন্থে এদেরকে ভূমধ্যসাগরীয় জনগোষ্ঠী বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গভূমিতে এদের আগমনের কোনো কালসীমা নির্ধারণ করা যায়নি। তবে এই অস্ট্রিক-দ্রাবিড়রাই যে বঙ্গের আদি অধিবাসী তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কোনো মতদ্বৈততা আজ অবধি শোনা যায়নি। নীহাররঞ্জন রায়-রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস, ড. অতুল সুর-রচিত বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন প্রভৃতি গ্রন্থে এদের এই ভূখণ্ডের প্রাচীনতম অধিবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বঙ্গের এই প্রাচীন জনজীবনের চমৎকার রূপায়ণ ঘটেছে রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা শীর্ষক উপন্যাসে। বঙ্গে আর্য-উত্তরকালে এদেরকে চিহ্নিত করা হয় অনার্য (যারা আর্য নয়) নামে। ককেশয়েড নরশ্রেণির আর্যভাষী দুটি শাখাগোত্র হচ্ছে অ্যালপাইন (Alpine) ও নর্ডিক (Nordic)। অ্যালপাইনদের বিচরণ ছিল ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে। আর নর্ডিকরা উত্তর এশিয়ার তৃণভূমির অধিবাসী। আর্যভাষী এই দুই শাখাগোষ্ঠী উত্তরকালে বাংলার জনপ্রবাহে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ভাষাগত পরিচয়েই ভারতে এদের জাতিগত পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় আর্য (Aryan)। এর অর্থ সম্মানিত, সুসভ্য। অস্ট্রিক-দ্রাবিড়ও মূলত ভাষাজ্ঞাপক শব্দ, জাতিবাচক নয়। বলা যায়, জাতিগত পার্থক্য থাকলেও অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ভাষী অনার্য ও আর্য ভাষী আর্যদের শত শত বছরের সহবাস ও সংমিশ্রণ এবং কালানুক্রমিক নানা বিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলা ভাষা, যা বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের ভাবপ্রকাশের বাহন এবং ভাষাভাষীর বিচারে যা পৃথিবীর পঞ্চম স্থানীয় ভাষা।
আধুনিক ভারতে ভাষা নিয়ে গবেষণাধর্মী আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেন ইংরেজ পণ্ডিত উইলিয়াম জোন্স (১৭৪৬-৯৪ খ্রি.)। তাঁর ভাষা-বংশ (Family of Language) ধারণাটি সমকালীন বিশ্বের ভাষা-বিশ্লেষক ও
ভাষা-গবেষকদের মধ্যে নতুন এক চিন্তার সূত্রপাত করে। তিনি সংস্কৃত, গ্রিক ও লাতিন ভাষার মধ্যে ধ্বনিতাত্ত্বিক, রূপতাত্ত্বিক এবং ব্যাকরণগত গভীর ঐক্য ও সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন : বাংলায় মা, সংস্কৃতে মাতৃ/মাতা, গ্রিকে মিতির, ল্যাটিনে মাতের। আবার বাংলায় দুই, সংস্কৃতে দ্ব, গ্রিকে দ্যে (Dyo), ল্যাটিনে দুও (Duo) ইত্যাদি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, এরূপ ঐক্য নিছক কাকতালীয় হতে পারে না। বরং তা আমাদের সুদূর অতীতে ভাষাত্রয়ীর এক অভিন্ন উৎসের অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। তাঁর এই প্রতীতি থেকেই আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকদের পর্যালোচনায় পৃথিবীর সকল জীবন্ত ভাষা কতকগুলো ভাষাবর্গ বা ভাষাগুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত হয়। অর্থাৎ পৃথিবীর যাবতীয় ভাষা কেবল একটি ভাষা পরিবারের সদস্য নয়, আবার এদের প্রত্যেকটি একেকটি স্বতন্ত্র ভাষাও নয়। তাবৎ ভাষা কতিপয় ভাষাবংশপ্রসূত। এই ভাষাবংশগুলো হচ্ছে –
ইন্দো-ইউরোপীয়, সেমিয়-হামিয়, বাল্টু, ফিন্নো-উগ্রীয়, তুর্ক-মোঙ্গল-মাঞ্চু, ককেশীয়, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক, ভোট-চীন, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত, এস্কিমো ও আমেরিকার আদিম ভাষাগোষ্ঠী। এরকম প্রায় ২৬টি ভাষাগোষ্ঠী নির্দিষ্ট করা হয়েছে বলে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তাঁর বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ নিয়ে লেখা প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, যা মনসুর মুসা-সম্পাদিত বাংলাদেশ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলো ব্যবহারকারীর সংখ্যাই পৃথিবীতে সর্বাধিক। বলা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। ১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ফ্রানজ বপ্ (Franz Bopp, ১৭৯১-১৮৬৭) সর্ববৃহৎ এই ভাষাগোষ্ঠীর নামকরণ করেন ইন্দো-ইউরোপীয় (Indo-European)। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিমান ও প্রভাবশালী জাতিগুলোর ভাষা এ-ভাষাপরিবারের সদস্য। যেমন : ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ ইত্যাদি। সংগত কারণেই এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলো নিয়েই গবেষণা হয়েছে বেশি। সর্বোপরি এই ভাষাবংশের বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করেই আধুনিক ভাষাতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ। আমরা গর্বিত যে, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এ ভাষা-পরিবারেরই গর্ভজাত একটি সমৃদ্ধ আধুনিক ভাষা।
ইন্দো-ইউরোপীয় বলতে ইন্ডিয়া বা ভারত ও গোটা ইউরোপ এবং ভারত ও ইউরোপের মধ্যবর্তী ইরান ও পূর্ব এশিয়ার কিছু অঞ্চলের ভাষাকে বোঝায়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান গ্রন্থে বলেন, ‘বিশেষ একটি ভাষাবংশ যে ভৌগোলিক এলাকায় বিস্তৃত, তার দুই দূরতম প্রান্তের নামের সমাস করে সাধারণত নামকরণ করা হয় ভাষাবংশটির। এ বংশের পূর্ব প্রান্তে ভারত ও পশ্চিম প্রান্তে ইউরোপ; তাই এর নাম ইন্দো-ইউরোপীয় বা ভারতি-ইউরোপীয়।’ শতাধিক ভাষার গর্ভধারিণী এ ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার কোনো নিদর্শন এ-যাবৎ পাওয়া যায়নি। একটি বংশের জীবিত কিছু লোকের মধ্যে বিদ্যমান সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে তাদের অজ্ঞাত পূর্বপুরুষের একটি দৈহিক রূপাবয়ব দাঁড় করানো যায়।
ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছে। অর্থাৎ এ-ভাষাগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি লাভ করা একাধিক ভাষার পূর্বতন রূপ বিচার-বিশ্লেষণ করে মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার একটি সম্ভাব্য রূপ পুনর্গঠন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেন যে, ভাষার স্বভাবের কাঠামোর মধ্যেই এর ঐক্য নিহিত। ভাষাবিজ্ঞানীরা এই কাঠামোর বিচার করেই মূলত এর জাত নির্ণয় করেন। ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার আদি রূপ যেমন অনুমাননির্ভর, তেমনি অনুমাননির্ভর এর মূল ভাষাভাষীর আদি পীঠস্থান। উপরন্তু এ-ভাষাগোষ্ঠীর উৎসস্থল সম্পর্কিত অনুমান নিয়েও পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অধিকাংশ ভাষাতাত্ত্বিকের মত হচ্ছে, ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাভাষীর আদি বাসভূমি মধ্য এশিয়ার কিরগিজ তৃণভূমি, কাস্পিয়ান সাগরের উত্তর ও আরব সাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল। অধ্যাপক স্ক্রদার এ-মতটি গ্রহণ ও প্রচার করেছেন বলে মুহম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘বাঙলা ভাষার ক্রমবিকাশ’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে এ-ভাষাগোষ্ঠীর গতিপথ বিচারে এই অনুমানই অধিক সমর্থিত। কোনো ভাষারই উদ্ভবের ক্ষেত্রে এর দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কেবল একটি কালপরিসর নির্ধারণ করা যায়। ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষার আবির্ভাবকাল ৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুমান করেছেন। আর এ মূল ভাষা থেকে প্রাচীন ভাষাগুলোর জন্ম আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে। ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন তাঁর ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেন, ‘অনুমান হয় ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি কোন সময়ে মূলভাষা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া এই বংশের প্রাচীন ভাষাগুলোর জন্ম হইয়াছিল এবং অনতিদীর্ঘকাল পরে সেগুলি
ইউরোপ-এশিয়ায় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল।’
ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাকে প্রথম দুটি শাখায় বিভক্ত করা হয়েছে – কেন্তুম (Centum) ও শতম (Satam)। দুটি শব্দেরই বাংলা অর্থ শত বা একশ। পার্থক্য হচ্ছে, ‘কেন্তুম’ ল্যাটিন শব্দ এবং এ-শাখার অন্তর্গত ভাষাগুলোর কণ্ঠ্যধ্বনি ক (ka) উচ্চারণে পরিবর্তন আসেনি। যেমন : কেন্তুম, হেকাতোন, কেত, কত। এগুলো যথাক্রমে ল্যাটিন, গ্রিক, আইরিশ ও তুখারি ভাষার শব্দ এবং একই অর্থবোধক প্রতিটি ভিন্ন ভাষার শব্দে ‘ক’ ধ্বনি রক্ষিত হয়েছে। পৃথিবীর পশ্চিমাঞ্চলীয় ভাষাগুলো এ-শাখার অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে ‘শতম’ আবেস্তীয় শব্দ এবং এ-শাখার অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলোর কণ্ঠ্যধ্বনি ক (শধ) পরিবর্তিত হয়েছে শিস বা উষ্ম ধ্বনিতে। অর্থাৎ ক হয়ে যায় শ বা স। যেমন : লাতিন উচ্চারণ কেন্তুম আবেস্তীয় উচ্চারণে হয়ে গেছে শতম। একইভাবে সংস্কৃতে শতম, লিথুনীয়তে শিমতাস, প্রাচীন সøাভীয়তে সুতো। পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলীয় ভাষাগুলো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর শতম শাখার অন্তর্ভুক্ত। কেন্তুম শাখার উপশাখাগুলো হচ্ছে – কেলটিয়, ইতালীয়, জার্মানীয়, হেলেনীয় (গ্রিক), তোখারীয় ইত্যাদি। আর শতম শাখার উপশাখাগুলো হচ্ছে – কালটোস্লাভীয়, আর্মেনীয়, আলবেনীয় ও ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য। এই ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য উপশাখার ভারতীয় আর্য উপ-উপশাখা থেকে কয়েকশো বছরের কালানুক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা স্বকীয় রূপ লাভ করে।
এই ইন্দো-ইরানীয় বা আর্য উপশাখার দুটি প্রধান ধারা হচ্ছে – ভারতীয় আর্য ও ইরানীয় আর্য। এছাড়া প্রবীণ ভাষাতত্ত্ববিদেরা দারদীয় নামে এ-উপশাখার আরেকটি ধারার কথা বলেছেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের দিকে মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে এর প্রাচীন শাখাগুলো বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। অনুমান করা হয় যে, এ-সময় ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর একটি শাখা তাদের আদিম বাসস্থান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, কাজাকিস্তান ও ককেশাস পর্বতমালা অতিক্রম করে উত্তর মেসোপটেমিয়ায় যায়। সেখানে কয়েকশো বছরের ব্যবধানে স্থানীয় সেমেটিক ভাষী অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয়দের সঙ্গে মিশে যায়। তবে ইন্দো-ইউরোপীয়দের কয়েকটি উপজাতি মেসোপটেমিয়া থেকে তাদের মূলভাষাসহ ইরানে প্রবেশ করে। এই ইন্দো-ইরানীয় উপশাখার কালপরিসর ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে অনুমিত হয়। এই ইন্দো-ইরানীয় ভাষাভাষীরা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দিয়ে গৌরব বোধ করত। ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেনের মতে, আর্য শব্দটি এসেছে ‘অর্য’ থেকে, যার অর্থ বিদেশি। ইরানে প্রবেশকারী এই আর্যদের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠে সেখানকার প্রাচীন ভাষা ও সংস্কৃতি। প্রাচীন ইরানীয় দুটি ভাষা হচ্ছে – আবেস্তা ও প্রাচীন ফারসি। আবেস্তা মূলত প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার নিদর্শন বৈদিক ধর্মীয় সাহিত্যের মতোই প্রাচীন ধর্মীয় সাহিত্য। এই ধর্মীয় সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশকে বলে গাথা যা ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ধর্মাচার্য জরা থ্রুষ্ট-রচিত এ-গাথার মূলে ছিল ইরানের উত্তর অঞ্চলের কথ্যভাষা। আর প্রাচীন ফারসি ছিল মূলত ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল পারস্য প্রদেশের ভাষা। এই প্রদেশের অধিবাসী একটি বংশের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে তাদের মাতৃভাষা প্রাচীন ফারসি হয়ে ওঠে সমগ্র ইরানের রাজভাষা। এই বংশের শাসকদের বিশেষত দারিউস (৫২১-৪৮৬ খ্রি.পূ.) এবং তাঁর পুত্র জেরেক্সেসের (৪৮৬-৪৬৫ খ্রি.পূ.) শিলালিপি ও ধাতুলিপি থেকে প্রাচীন ফারসি ভাষার নিদর্শন মিলেছে। মধ্য ইরানীয় আর্যভাষার কালপরিসর ধরা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৯০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ। ভাষাবিদ সুকুমার সেনের মতে, প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বৈদিক ও সংস্কৃত) যেমন কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষায় (পালি-প্রাকৃত) পরিণত হয়েছিল, তেমনি প্রাচীন ফারসি পরিবর্তিত হয়ে এর প্রাকৃত স্থানীয় পহ্লবী (মধ্য ফারসি) উৎপন্ন হয়েছিল। এছাড়া আছে শক ভাষাসহ আরো
দুই-একটি ভাষা। শক ভাষায় অনেক বৌদ্ধ গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে। তবে এই পহ্লবী বা মধ্য ফারসিই হচ্ছে নব্য ফারসির জননী যা খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে উৎপত্তি লাভ করেছে বলে অনুমান করা হয়। পাঈকুলী শিলালিপি, চীনা তুর্কিস্তানে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি ও জরথুস্ট্রীয় ধর্মবিষয়ক গ্রন্থে মধ্য ফারসি ভাষার নিদর্শন পাওয়া গেছে। বর্তমান ইরান ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মাতৃভাষা নব্য ফারসি তথা আধুনিক ফারসি। এছাড়া পাকিস্তানের বেলুচি (বেলুচিস্তান প্রদেশের ভাষা), পশ্চিম ইরানের কুর্দি, আফগানিস্তানের সরকারি ভাষা পশতু ইরানীয় আর্যের অন্তর্ভুক্ত বর্তমানে প্রচলিত ভাষা।
পূর্বে বলা হয়েছে যে, প্রবীণ ভাষাতত্ত্ববিদেরা ইন্দো-ইরানীয় উপশাখার ইরানীয় ও ভারতীয় আর্যের মধ্যবর্তী দারদীয় নামে তৃতীয় একটি উপ-উপশাখার অস্তিত্বের কথা বলেছেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে হিন্দুকুশে ও পামির উপত্যকায় দারদীয়ভুক্ত ভাষার প্রচলন আছে। যেমন : কাশ্মিরি ভাষা। তবে এগুলোর ওপর ইরানীয় আর্য ও ভারতীয় আর্যের কম-বেশি ছাপ থাকায় দারদীয় শ্রেণির ভাষাগুচ্ছের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নিয়ে আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকরা নিঃসন্দিহান নন। এগুলোর বেশিরভাগই যুদ্ধপ্রবণ ঝুঁকিপূর্ণ দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষা। তাই ভাষাগুলো নিয়ে আধুনিক গবেষণাকর্মেরও সুযোগ ও আগ্রহ কম। দারদীয় ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র কাশ্মিরি ভাষারই একটি উন্নত সাহিত্যকর্ম আছে এবং এ-ভাষার ওপর আবার প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা সংস্কৃতের অধিক প্রভাব রয়েছে। তাই ইন্দো-ইরানীয় ভাষাবিষয়ক আলোচনার পূর্ণাঙ্গতার জন্যই কেবল দারদীয় শাখার উল্লেখ করা হয়।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের ইন্দো আর্য তথা ভারতীয় আর্য ধারাটি। কারণ এ-ধারার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তনে উদ্ভব ঘটে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার প্রাচীন রূপের।
ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষাভাষীর বিভিন্ন দল মেসোপটেমিয়া থেকে ইরানে প্রবেশ করে সেখানেই থিতু হয়ে যায়নি। ছোট ছোট দলে বিভক্ত এই যাযাবর আর্যরা আফগানিস্তান ও হিন্দুকুশ গিরিপথ দিয়ে প্রথমে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল ও পশ্চিম পাঞ্জাবে বসতি গড়ে তোলে। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনকাল মোটামুটি ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ বলে ধরা হয়। পরে তারা ক্রমশ পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে পূর্ব পাঞ্জাবে ও মধ্যদেশে এবং আরো পরে
মগধ-অঙ্গ-রাঢ়-বরেন্দ্র প্রভৃতি উত্তরাপথের পার্বত্য অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য গ্রন্থে বলেন যে, উত্তর ভারত থেকে গঙ্গা নদীর তীর ধরে আর্যরা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের গৌড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। তাদের একাংশ পরে ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ে, আরেক অংশের বিস্তার ঘটে পূর্বদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে, যা বর্তমান বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ। বলা যায়, যাযাবর আর্যদের বিস্তৃতির শেষ প্রান্ত এই বঙ্গভূমি। কারণ বাংলাদেশ, আসাম ও নেপালের সীমান্ত পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আর্য ভাষা বিস্তারের তেমন কোনো নজির এখনো পাওয়া যায়নি। প্রথমে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশকারী এই বহিরাগত আর্যদের জনধারা পূর্বদিকে বাংলা পর্যন্ত পৌঁছতে শত শত বছর পার হয়ে যায়। আর বঙ্গের অনার্যরাও বহিরাগত আর্যদের বশ্যতা সহজে মেনে নেয়নি। প্রায়শ বাংলায় বহিরাগত আর্য ও স্থানীয় অনার্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধত। এ অবস্থা বহুকাল ধরে চলে। একসময় অনার্যরা এই নবাগত আর্যদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয়। শুরু হয় বঙ্গে আর্য-অনার্যদের সহাবস্থান ও সংমিশ্রণ এবং বাচিক ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও রূপান্তর। বঙ্গভূমিতে আর্যবসতির প্রায় দেড় হাজার বছর পর সেখানে যে-ভাষা গড়ে ওঠে তার থেকে আরো কয়েকশো বছরের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা স্বরূপে প্রকাশিত হয়।
ভারতীয় আর্য ভাষার তিনটি কালানুক্রমিক পর্ব হচ্ছে – প্রাচীন ভারতীয় আর্য (আনুমানিক ১৫০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব), মধ্য ভারতীয় আর্য (আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং নব্য ভারতীয় আর্য (১০০০ খ্রিষ্টাব্দ)। ভারতে নিরঙ্কুশ আর্যাধিপত্য প্রতিষ্ঠার একপর্যায়ে সাধারণজনের ভাষা হয়ে দাঁড়ায় দেশীয় ভাষার প্রচলিত শব্দসম্ভারমিশ্রিত আগন্তুক বৈদিক ভাষা। এটা ঠিক পোশাকি বৈদিক ভাষা নয়। যে-ভাষায় আর্যরা প্রাচীনতম ধর্মশাস্ত্র বেদ রচনা করেছিল। এটাকে বলা যায়, লৌকিক বৈদিক যা ছিল মূলত সর্বজনের কথ্যভাষা। যে-বৈদিক ভাষার পরিচিতি বেদের ভাষা হিসেবে, যে-ভাষার নামে ‘বৈদিক যুগ (Vedic Period)’ নামে একটি যুগের সৃষ্টি হয়েছিল, সে-ভাষা বিকৃত হয়ে জনসাধারণের মুখে সহজ-সরল রূপ পায়। প্রাকৃতজনের মুখে সে-ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহার পণ্ডিতদের ভাবিয়ে তোলে। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, বৈদিক ভাষা আর্য মুনি-ঋষি, দেবতাদের ব্যবহৃত পবিত্র ভাষা। ব্রাত্যদের মুখে এ-ভাষার ব্যবহার হলে তাঁদের সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রই কলুষিত হয়ে যাবে। তাছাড়া লোকমুখে ব্যবহৃত এ-ভাষা হয়ে উঠবে ভাবগাম্ভীর্যহীন সাদামাটা আটপৌরে ভাষা। বাস্তবিকই এ-ভাষা হয়ে ওঠে লৌকিক
আখ্যান-উপাখ্যান রচনার এক নবীনতর সাহিত্যভাষা। তখন আদি বৈদিক ভাষা সংস্কারে কাজ করেন পাণিনি, যাস্ক প্রমুখ প্রাচীন ব্যাকরণবিদ। বিশেষত পাণিনি (৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) আদি বৈদিক ভাষাকে শিষ্ট, মার্জিত ও কাঠামোবদ্ধ রূপ দেন। তাঁর ব্যাকরণসূত্রগুলো আট অধ্যায়ে বিভক্ত বলে তা ‘অষ্টাধ্যায়ী’ নামে পরিচিতি পায়। ব্যাকরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলাবদ্ধ এ-ভাষাটি সাধারণ লোকের দ্বারা আর যথেচ্ছ ব্যবহারের সুযোগ রইল না। এ-ভাষা বলার ও লেখার জন্য রীতিমতো শিক্ষালাভ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আদি বৈদিক ভাষাকে পরিকল্পিত সংস্কারের মাধ্যমে সৃষ্ট এ-ভাষাই হচ্ছে সংস্কৃত। অর্থাৎ যা সংস্কার করা হয়েছে। সুতরাং প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার দুটি লৈখিক সাধুরূপ হচ্ছে – বৈদিক ও সংস্কৃত। ভারতবর্ষে আর্যদের বেদসাহিত্য (ঋগে¦দ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ) রচনার যুগ হচ্ছে বৈদিক যুগ (১৫০০-৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। আর এ-বৈদিক যুগই মূলত প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার কালপর্ব। প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার নমুনা ঋগে¦দে সংরক্ষিত এবং ঋগে¦দের বৈদিক ভাষার নবতর সংস্করণ হচ্ছে সংস্কৃত। আর ভারতে আর্য-অনার্য মিলনে কালের ব্যবধানে জনসাধারণের মুখে মুখে বিকৃত বৈদিক যে কথ্যরূপ লাভ করে তা-ই প্রাকৃত। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর নাম দিয়েছেন আদিম প্রাকৃত। সহজভাবে বলা যায়, আর্যদের মৌখিক ভাষা হচ্ছে প্রাকৃত যা বৈদিকের বিকৃত রূপ। আর সংস্কৃত হচ্ছে বৈদিকের পরিমার্জিত, পরিশীলিত ও বিধিবদ্ধ রূপ। সুতরাং বৈদিকের সঙ্গে উভয়ের সম্পর্ক থাকলেও উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বেশ দূরের। তাই প্রাকৃত অনুসরণে আসা বাংলা উচ্চারণরীতি ও সংস্কৃত অনুসরণে আসা বাংলা বানানরীতির মধ্যে এত ফারাক। এই প্রাকৃত ও সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে এক মনোমুগ্ধকর বক্তব্য পাওয়া যায় অতীন্দ্র মজুমদার রচিত মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থে, ‘প্রাকৃত এবং সংস্কৃত – দুজনেরই জননী বৈদিক, কিন্তু জন্মের পর থেকে সহোদরারা হয়ে গেল বৈমাত্রেয় ভগ্নীর মত। একজন মুক্তি পেল সমৃদ্ধ হল রূপান্তরিত হল জনসাধারণের প্রেমে, অন্যজন নিয়মশৃঙ্খলার বেদীতে দেবীর আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ভক্তির বাঁধনে বাঁধা পড়ল। একজন হলো প্রাণদায়িনী, অন্যজন জ্ঞানদায়িনী। পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়মে একদিন প্রাণেরই জয় হল, জ্ঞান বাঁধা পড়ে রইল পুথির শুষ্ক পাতায়, পণ্ডিতদের নীরস মনে আর গবেষকদের ঘর্মসিক্ত অনুশীলনে।’
ভারতীয় আর্য ভাষার আনুমানিক সময়সীমা ধরা হয় ৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ। প্রাকৃত থেকেই মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাস্তরের সূচনা। বৈদিক যুগেই এই অবৈদিক অসংস্কৃত প্রাকৃতে লৌকিক আখ্যান-উপাখ্যান রচিত হলেও এর কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে অনেক পরে রামায়ণ-মহাভারত ও প্রাচীন পুরাণের ভাষায় এর পরিণত রূপটি ধরা পড়ে। সংস্কৃত নাটকে নিম্ন শ্রেণির পাত্র-পাত্রীর মুখে প্রাকৃতের ব্যবহার করা হতো। প্রাচীন প্রাকৃত থেকে পালি ভাষার উদ্ভব। অতীন্দ্র মজুমদার তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেন, ‘বৈদিক আর্য ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত যে সম্বন্ধে আবদ্ধ, সাহিত্যিক প্রাকৃতের সঙ্গে পালির সেই একই ধরনের সম্বন্ধের সম্পর্ক।’ মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রথম স্তরের (৬০০ খ্রি.পূ. থেকে ২০০ খ্রি.পূ.) সাহিত্যিক রূপ হচ্ছে পালি। পালি মানে যা পালন করে। ভগবান বুদ্ধদেবের উপদেশ ও বাণী যে-ভাষায় পাঠ ও পালন করা হয় তা-ই পালি ভাষা। এক কথায় বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শন ও সাহিত্যের ভাষা হচ্ছে পালি। বৌদ্ধবিহারগুলোতেই এর উৎপত্তি। বুদ্ধদেবের লিখিত কোনো গ্রন্থ নেই। তবে তাঁর মহাপ্রয়াণের দুশো বছরের মধ্যে তাঁর উপদেশ ও বাণী সংবলিত বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র ‘ত্রিপিটক’ সংকলিত হয়ে যায়। তিনটি পিটক – বিনয়পিটক, সুত্তপিটক ও অভিধর্মপিটক নিয়ে পালি ভাষায় সংকলিত হয় এ-ধর্মীয় শাস্ত্র ত্রিপিটক। তাছাড়া বুদ্ধদেবের পূর্বজন্মের বিবরণ সংবলিত বহু গ্রন্থ (জাতক) পালি ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন।
স্থানিক প্রভাবে একসময় মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা প্রাকৃত আবার ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয়। লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেন, ‘ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষার ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তাদের নামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘সংস্কৃতের যুগে যেমন ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃত প্রচলিত ছিল, তেমনি প্রাকৃত বাংলারও নানা রূপ আছে বাংলার ভিন্ন ভিন্ন অংশে। এদেরই মধ্যে একটা বিশেষ প্রাকৃত চলেছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে।’ অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন নামে চিহ্নিত এসব প্রাকৃত হয়ে ওঠে নাটকীয় প্রাকৃত ভাষা। এগুলোকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার দ্বিতীয় স্তর হিসেবে ধরা হয়, যার কালসীমা হচ্ছে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ। আঞ্চলিক বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রাকৃতের চারটি নাম হচ্ছে – মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত, শৌরসেনী প্রাকৃত, পৈশাচী প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত। মাগধীর আরেকটি ভাগ হিসেবে কোনো কোনোা ভাষাবিদ অর্ধ-মাগধীর কথাও বলে থাকেন। সাহিত্য রচনায় এসব প্রাকৃত ব্যবহারের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়। তাই এগুলোকে সাহিত্যিক প্রাকৃত বলা হয়। সংস্কৃত নাটকে নিম্নবর্গের চরিত্রের কথোপকথন, গানে ব্যবহৃত হতো এসব সাহিত্যিক প্রাকৃত। সংস্কৃতের মতো এগুলো মার্জিত, শৃঙ্খলিত ছিল না। তবে পরবর্তীকালে এগুলোও সংস্কৃতের মতো মৃত ভাষায় পরিণত হয়।
বর্তমান ভারতের দক্ষিণ বিহার অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রাচীন পূর্ব-ভারতীয় রাজ্য মগধ্-এর ভাষাকে বলে মাগধী। এ-অঞ্চলের প্রাকৃতকে বলে মাগধী প্রাকৃত। সংস্কৃত নাটকে কিঞ্চিৎ হাস্যরস সৃষ্টির জন্য অশিষ্ট ইতরজনের মুখে মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতো। আর অর্ধ-মাগধী প্রাকৃতের বেশি ব্যবহার দেখা যায় জৈনশাস্ত্র রচনায়। জৈনরা মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত ও শৌরসেনী প্রাকৃতও ব্যবহার করতেন। তবে তাঁদের যেসব রচনায় অর্ধ-মাগধীর সঙ্গে মহারাষ্ট্রী ও শৌরসেনীর মিশ্রণ আছে সেসব মহারাষ্ট্রী ও শৌরসেনীকে যথাক্রমে জৈন মহারাষ্ট্রী ও জৈন শৌরসেনী বলে। এই অর্ধ-মাগধী প্রাকৃত থেকে এসেছে পূর্বী হিন্দি ভাষা। ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা মথুরা ও এর আশপাশ নিয়ে যদুবংশীয় রাজা শূরসেনের নামানুসারে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন ভারতীয় অঞ্চল শূরসেন। এ অঞ্চলের প্রাকৃতকে বলা হয় শৌরসেনী প্রাকৃত। সংস্কৃত নাটকে শৌরসেনী নারী ও অশিক্ষিত পুরুষের মুখে শৌরসেনী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতো। মহারাষ্ট্রীর সঙ্গে শৌরসেনীর মূলগত পার্থক্য খুব কম। শৌরসেনী প্রাকৃতে সংস্কৃত প্রভাব অত্যধিক। ভারতের অন্যতম রাজ্য মহারাষ্ট্রের মারাঠি ভাষা এবং গোয়া ও কর্ণাটকের উপকূলীয় অঞ্চল (কোঙ্কন)-এর কোঙ্কনি ভাষার পূর্বসূরি হচ্ছে মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত। প্রাকৃত ব্যাকরণবিদরা মহারাষ্ট্রীকেই মূল প্রাকৃত বলেছেন। সংস্কৃত নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃত গান ও কবিতাগুলোর প্রায় সবই মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে লেখা। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত কথ্যভাষা হচ্ছে পৈশাচি প্রাকৃত। পিশাচদের ভাষা হিসেবে লোকসাহিত্যে এর উচ্চ স্থান ছিল। তবে সাধারণ সাহিত্যে এ-প্রাকৃতের স্থান হয়নি। পৈশাচিতে বিচিত্র কাহিনিসংবলিত ‘বড্ডকহা’ (বৃহৎকথা) রচনা করেছিলেন গুণাঢ্য। সংস্কৃতে এর একাধিক অনুবাদ হয়েছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে গৌড়ী প্রাকৃত নামে একটি প্রাকৃতের কথা বলেন।
ইন্দো-ইউরোপীয় যেমন ভাষাবিদদের কল্পিত একটি মূলভাষা। গৌড়ী তেমনি তাঁর কল্পিত একটি প্রাকৃত। তাঁর মতে, ব্যাকরণবিদদের বর্ণিত কোনো প্রাকৃতের সঙ্গেই এই মূল ভাষার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে এ প্রাকৃতের লক্ষণ আবিষ্কার করতে হবে। অর্থাৎ বর্তমান রূপ থেকেই এর পূর্বতন রূপ অনুমান করে নিতে হবে। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি হলো, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে ইন্দো-ইউরোপীয় মূল ভাষা পুনর্গঠিত হতে পারলে এই মূল গৌড়ী প্রাকৃতও পুনর্গঠিত হতে পারে। তিনি বলেন, সংস্কৃত কাব্যতত্ত্ববিদ দণ্ডী তাঁর কাব্যাদর্শ গ্রন্থে গৌড়ী প্রাকৃতের নাম উল্লেখ করেছেন। এই গৌড়ী প্রাকৃতের পরবর্তী স্তর হচ্ছে গৌড়ী অপভ্রংশ। প্রাকৃত ব্যাকরণবিদ মার্কণ্ডেয় যে ২৭টি অপভ্রংশের নাম করেছেন সেখানে গৌড়ী অপভ্রংশ আছে। তাই তিনি মনে করেন যে, গৌড়ী প্রাকৃতের এই গৌড়ী অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এজন্যই বাংলা ভাষাকে একসময় গৌড়ীয় ভাষা বলা হতো। প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ শরীফ তাঁর বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য গ্রন্থে বলেন, ‘লিখিত বাংলায় মাগধী প্রাকৃতের বিবর্তন ধারার লক্ষণ দুর্লভ দেখেই ডক্টর শহীদুল্লাহ গৌড়ী প্রাকৃত তত্ত্ব চালু করেছিলেন।’ তবে বাংলা ভাষার উৎপত্তিসংক্রান্ত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এ ভিন্নমতটি পণ্ডিতমহলে খুব বেশি সমাদৃত হয়নি।
মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার ক্রমপরিণতির শেষ স্তর হচ্ছে অপভ্রংশ (৬০০ খ্রি. থেকে ১০০০ খ্রি.)। স্থানিক বা আঞ্চলিক নামে বিভাজিত প্রাকৃত ভাষার ভাঙা বা টুকরো অংশগুলো আবার কালিক ব্যবধানে আরো বিস্তৃত হয়ে স্থানীয় প্রভাবে বিকৃতি লাভ করে। আঞ্চলিক প্রাকৃতগুলোর এই বিকৃত রূপই হচ্ছে অপভ্রংশ। প্রাকৃত ব্যাকরণবিদেরা এটিকে একটি স্বতন্ত্র প্রাকৃত ভাষা হিসেবে দেখেছেন। স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১ খ্রি.) মধ্য প্রাকৃতের শেষ উপস্তরকে বলেছেন অপভ্রংশ। তাঁর মতে, বাংলা ভাষা মাগধী প্রাকৃতের মাগধী অপভ্রংশজাত। সুকুমার সেন এ-মত সমর্থন করেছেন। তিনি অপভ্রংশের শেষ স্তর অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন অপভ্রংশকে বলেছেন অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ। বলা যায়, প্রাচীন অপভ্রংশ ও নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার ঠিক মাঝখানে আছে এই অবহট্ঠ। কোনো অপভ্রংশ কখনোই অভিজাত শ্রেণির মুখের বা শাস্ত্রবানদের সাহিত্যের ভাষা হিসেবে গৃহীত হয়নি। লোকায়ত সমাজে লোকসাহিত্যের বাহন হিসেবে অপভ্রংশের ব্যবহার লক্ষণীয়। ড. সেন তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে বলেন, ‘অর্বাচীন অপভ্রংশে গান-কবিতা ছড়াময় যে লোকসাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছিল নব্য ভারতীয় আর্য সাহিত্যের শুভারম্ভ তাহারই পথ বাহিয়া।’
ভারতীয় আর্য ভাষার শেষ স্তর হচ্ছে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা। অপভ্রংশের বিকৃত রূপ অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ আবার বিভিন্ন অঞ্চলে কালগত রূপান্তরের মাধ্যমে জন্ম নেয় কাশ্মিরি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, মালদ্বীপি, সিংহলি, গুজরাটি,
হিন্দি-উর্দু, ভোজপুরি, মৈথিলি, মারাঠি, ওড়িয়া, অসমিয়া, বাংলা প্রভৃতি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা। এগুলোর মধ্যে বঙ্গভূমিতে মাগধী অপভ্রংশের অর্বাচীন স্তর অবহট্ঠের কালিক বিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে প্রাবন্ধিক ও গবেষক আহমদ শরীফ মনে করেন, বাংলার বুলিরূপ (কথ্যরূপ) মাগধী অবহট্ঠের বিকৃতিপ্রসূত হলেও বাংলা লেখ্যরূপের আদর্শ হচ্ছে শৌরসেনী অবহট্ঠ। তাঁর মতে, প্রাচীন বাংলা রচনায় স্থানীয় বুলির প্রভাব সামান্য এবং সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের প্রবণতাই বেশি। পূর্বোক্ত গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘রাজপুত রাজাদের প্রশাসনিক কার্যে ব্যবহৃত হয়ে এবং নাটকে সংলাপে স্থান পেয়ে শৌরসেনী প্রাকৃত ও অপভ্রংশ লেখ্য বা শিষ্ট ভাষার মর্যাদা পায় প্রায় পাঁচ শতক থেকে। পরে তা অনুকৃত হয়ে সর্বভারতীয় ব্যবহারের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাই বাঙালী কানুফা প্রমুখ সবাই ঐ প্রাকৃত ও অপভ্রংশ বা অবহট্ঠকে তাঁদের রচনার বাহন করেন। প্রাপ্ত দোহা ও ডাকার্ণব তা-ই শৌরসেনী অবহট্ঠে রচিত। চর্যাপদগুলোও গণবোধ্য করে অর্বাচীন অবহটেঠ রচিত এবং লোকপ্রিয় গীতিগুলো বহু কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে হয়ে বিশেষভাবে স্থানীয় বুলির প্রভাবে পড়েছে।’
একথা সত্য যে, পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে (বিহার-ওড়িয়া-বাংলা-আসাম-মিথিলা) অপভ্রংশে রচিত যেসব মূল্যবান গ্রন্থ হস্তগত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে শৌরসেনী অপভ্রংশের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় বেশি। পিঙ্গল-রচিত দর্শনশাস্ত্রের কাব্য প্রাকৃতপৈঙ্গল, বিদ্যাপতি-রচিত রাজা শিবসিংহের স্তূতিমূলক গ্রন্থ কীর্তিলতা, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত দোহাকোষ, ডাকার্ণব শৌরসেনী অপভ্রংশে রচিত। চৌদ্দ-পনেরো শতক অবধি সাহিত্যের জনপ্রিয় বাহন ছিল এই শৌরসেনী অবহট্ঠ। পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংস্কৃত প্রভাব শৌরসেনী অপভ্রংশের অন্যতম লক্ষণ। এটি বাংলা বানানরীতিতে সংস্কৃতনির্ভরতারও পরোক্ষ কারণ হতে পারে। নব্য ভারতীয় আর্যস্তরে মাগধী অবহটেঠর বিবর্তিত রূপ বাংলা কথ্যভাষার লেখ্যরূপের পরিচয় পাওয়া যায় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ কাব্যের ভাষায়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পদ্যভাষায় এর পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং সর্বোপরি উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের বিকাশে এর যথার্থ প্রকাশ। ভাষার রূপান্তর ঘটে মুখে। তারপর তা মুখ থেকে আসে কলমে তথা লেখার ভাষায়। প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী তাই মুখের ভাষার আদলে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন বাংলা লৈখিক ভাষা। বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রবর্তিত চলিত গদ্যরীতি লেখ্যবাংলাকে করে তোলে কথ্যবাংলার অনুসারী, ঘুচিয়ে দেয় কথ্য প্রমিত বাংলা ও লেখ্য বাংলার পার্থক্য।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১. বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
২. বাঙ্গালীর ইতিহাস, নীহাররঞ্জন রায়।
৩. ভাষার ইতিবৃত্ত, সুকুমার সেন।
৪. ভারতীয়-আর্য সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন।
৫. মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা সাহিত্য, অতীন্দ্র মজুমদার।
৬. বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন, ড. অতুল সুর।
৭. বাংলাভাষা পরিচয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৮. বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব, আহমদ শরীফ।
৯. বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, আহমদ শরীফ।
১০. ফিনিসিয়া থেকে ফিলিপাইন, মোহাম্মদ কাসেম।
১১. আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ।
১২. তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, হুমায়ুন আজাদ।
১৩. বাঙলাদেশ, মনসুর মুসা-সম্পাদিত।
১৪. বাঙলা নামে দেশ, আলী ইমাম।
১৫. প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, রফিকুল ইসলাম ও পবিত্র সরকার (সম্পাদিত)।
১৬. বেদ ও বৈদিক সমাজ, ভবেশ রায়।
১৭. বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য, গোলাম মুরশিদ।
১৮. ভাষাবিজ্ঞানের কথা, মহাম্মদ দানীউল হক।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.