শুভদীপ মৈত্র
ষাটের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি; বিশ্বজোড়া সমাদৃত নির্দেশক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। আমাদের প্রিয় বুদ্ধদা। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন এক বিস্ময়। সিনেমা থেকে, কবিতা থেকে শিল্পের নানা মাধ্যমে সাবলীল এক যাতায়াত তাঁর। তাঁর ভাবনা শুধু এই উপমহাদেশের সিনেমা নয়, বিশ্বসিনেমায়ও রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ। তাঁর দীর্ঘ শিল্পচর্চার চলার পথে তিনি কীভাবে দেখেছেন ও দেখছেন সেসব বিষয়, এবং কীভাবেই বা নিজের শিল্পকে নির্মাণ করে চলেছেন সে-নিয়ে তাঁর সঙ্গে এক আলাপচারিতা –
শুভদীপ মৈত্র : ১৯৭৮-এ দূরত্ব থেকে যদি ধরি, বা তারও আগে ডকু থেকে দীর্ঘ একটা চলার পথ। আপনি যে সিনেমা বানিয়েছেন বা বানাচ্ছেন তা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সেগুলো সমাদৃত বহুদিন ধরে। তারপরও এই যে নতুন সিনেমা তার জন্য নিজেকে তৈরি করা, এগুলো এখন আপনাকে কীভাবে মোটিভেট করে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : খিদে। এমন একেকটা সময় আসে, যখন মনে হয় খিদে মিটছে না। আমি সিনেমা করে চলেছি এত বছর ধরে তবু প্রত্যেক নতুন সিনেমা আরম্ভ করি যখন, মনে হয় নতুন সিনেমা করছি। ভয় করে, আতঙ্কিত থাকি। প্রত্যেকবার নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করি, বদলাতে থাকি। তেমনি খিদে প্রত্যেকবার আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর আমি বুঝতে পারি যে, এর মধ্য দিয়েই আমি বেঁচে থাকি। এটা না থাকলে আমার বেঁচে থাকাটাই মুশকিল হতো।
শুভদীপ মৈত্র : প্রথম সিনেমা বানানোর সময় থেকেই আপনার সিনেমায় দেখা যায় একটা স্ট্রং ভাষা এবং সম্পূর্ণ নিজের ভাষা। দূরত্ব বা গৃহযুদ্ধ বানানোর আগে থেকেই আপনি প্রিপেয়ার করছিলেন বলে মনে হয়, সেই প্রিপারেশনটা কেমন ছিল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমি খুব কৃতজ্ঞ সিনেমার কাছে, পেইন্টিংয়ের কাছে আর কবিতার কাছে। কবিতা তো লিখেছি, পেইন্টিং করতে পারিনি কোনোদিন, কিন্তু দেখেছি। এই দুটো আমাকে ভীষণভাবে তৈরি করেছে একটা জায়গায় – মানে নিজস্ব ভঙ্গি। আমি কবিতা লিখতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম একটা কথনভঙ্গি, যাকে আমরা বলি স্টাইল – তা ভীষণ দরকার। কবিতার সঙ্গে সেটা আমি চেষ্টা করছিলাম, লোকে বলছিল – হ্যাঁ বুদ্ধদেবের কবিতা আলাদা। দেখো, সিনেমায় আমি যখন আরম্ভ করেছিলাম, তখন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মত মানুষ ছিলেন। সত্যজিৎ এমন একটা ভাষা তৈরি করলেন, যা ভারতীয় সিনেমায় ছিলই না। সেখানে দাঁড়িয়ে আমাকে আমার কথা বলতে হবে, আমার ভাষা তৈরি করতে হবে, যা তাঁদের ভাষার পাশে সমামত্মরালের মত চলবে। আমি একটা জিনিস জানতাম যে, আমি সময়টাকে চিনতে চাই, আমার অসম্ভব আগ্রহ আছে। আর সময়কে যদি তুমি ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করো তাহলে সময়ই তোমায় বলে দেবে। সময় মানে অনেক কিছু, তার মধ্যে অনেক কিছু থাকে, চিনিয়ে দেয় পুরনো ভঙ্গি। কোনটা সেকেলে, কোনটা বাহুল্যবর্জিত। কীভাবে লিখলে বা বললে, একদম নতুন হবে বিষয়টা। দূরত্ব করতে গিয়ে আমি এ-ভাষা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। একটা জিনিসের সুবিধা ছিল – ষাটের দশক একটা দারুণ সময়।
আমি মনে করি ষাটের দশক অনেক কিছু করেছে। সমাজ, অর্থনীতি, শিল্প নিয়ে চেতনাকে বদলেছে। আমরা যারা কৈশোর থেকে বড় হচ্ছিলাম, তারা কিন্তু বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে। ষাটের দশকের সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের ভয়ংকর অমিল। ষাট একদম আলাদা ও নতুন। তাই এই নতুন সময়ে নতুন ভাষাটা দরকার।
আবার এমন ভাষা দরকার, যা ষাট বছর পর রিলেট করতে পারবে পাঠক বা দর্শক, তা না হলে কাজই হয় না। তাৎক্ষণিক কাজ সময়কে কেন্দ্র করে, কিন্তু সময়ও তো দাঁড়িয়ে থাকে না। সেও তো এগোচ্ছে। প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে, তুমি দেখবে কালিদাস রায়, কুমুদ মলিস্নক, এঁদের কবিতা একসময় তোলপাড় করেছে। কিন্তু এখনকার পাঠক আর রিলেট করতে পারে না, কারণ ভাবনাটাই বদলে গেছে। ষাট এটা বলছিল, ভাবনাটা বদলানোর কথা বলছিল।
শুভদীপ মৈত্র : ষাটের দশকে কবিতার ভাষা বদলায়, বিশেষ করে গদ্য কবিতার প্রবণতা যা ছিল নতুন, উৎপলকুমার বসুকে মাথায় রেখেও বলছি, ভাস্কর চক্রবর্তী বা আপনি নতুন ভাষায় লিখতে শুরু করলেন, ভাবনাটাও আলাদা ছিল…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, তবে মুশকিল কি জানো, আজকালকার কবিদের অনেককে দেখি গদ্য কবিতা লেখে কিন্তু ছন্দটা জানে না। ছন্দ না জানলে, সেট তৈরি করতে না পারলে, সেই মোহটা আসে না। কোনটা তৎসম, কোনটা তদ্ভব, কোনটা গুরু ধ্বনি, কোনটা লঘু ধ্বনি, পয়ার কী, ভাঙা পয়ার কী, মাত্রাবৃত্ত কী, এগুলো কিন্তু গুলে খেতে হয় – তারপর তুমি যথার্থ ভাঙো, গদ্যে কবিতা লিখতে পারো। আমাদের সময় তেমনি হয়েছিল।
আমি মনে করি, পঞ্চাশের কবি যাঁরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত – এঁরা যাঁরা কবিতা লিখেছেন, এঁদের পাশে যদি ষাটের কবিতা দেখো, একদম আলাদা, ভাস্করের কবিতা, যদি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পাশাপাশি রাখো, দেখবে অনেক আলাদা, লেখার ভঙ্গি নয় শুধু, বলার ভঙ্গি ভাবনার ভঙ্গিতে। ভাস্করের কবিতার পাতায় পাতায় এই ভাবনাবদলের ছাপ।
শুভদীপ মৈত্র : আর এটা একটা দশকের মধ্যেই হয়ে গেল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : একদম। আমাদের কয়েকজনের মধ্যে যেমন ভাস্কর, যেমন সামসের, সুব্রত চক্রবর্তী, আমরা যারা লিখতাম সে-সময় এঁদের মধ্যে পঞ্চাশের কোনো ছাপ খুঁজে পাবে না।
শুভদীপ মৈত্র : অথচ পঞ্চাশের কবিদের সঙ্গে আপনাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভয়ংকর ভাল, প্রায়ই একসঙ্গে আড্ডা মারা, একসঙ্গে সময় কাটানো এসব হলেও কবিতার জায়গায় আমরা ভয়ংকর আলাদা ছিলাম। ষাটের কবিতার সঙ্গে পঞ্চাশের কোনো মিল নেই।
শুভদীপ মৈত্র : সিনেমার ক্ষেত্রেও কি এটা হয়েছে? যেমন সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটক এঁদের সিনেমা-ভাবনার সঙ্গে আপনার সিনেমা-ভাবনার পার্থক্য ছিল, মানে যেমন আগের কবিদের সঙ্গে পার্থক্য ছিল আপনাদের কবিতার?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার তো ছিল। যেমন আমি মনে করি, সত্যজিৎ রায় যেমনভাবে দেখেছেন, আমি সেভাবে দেখতে চাইছি না, সত্যজিৎ রায় যেভাবে সম্পর্কের টানাপড়েনগুলো আনছেন বা রবীন্দ্রনাথের যে-কয়েকটা গল্প নিয়ে তিনি কাজ করেছেন বা কাঞ্চনজঙ্ঘা বলতে পারো, যেভাবে এসেছে ঠিক আছে, কিন্তু ততক্ষণে সময় এগিয়ে গেছে অনেকটা, সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে যে-গল্পগুলো তিনি যে-সময়ে করছেন, সম্পর্কের ভাবনাটাই তখন অনেক বদলে গেছে।
শুভদীপ মৈত্র : তার কারণ কি উপন্যাস বা গল্পকে ভিত্তি করে করার জন্য, যা কিছুটা পুরনো সময়ের, যেমন চারুলতা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : তা একটা কারণ হতে পারে। তবে সত্যজিৎ রায়ের সমস্যা ছিল। তিনি তাঁর সময়ের বৃত্তের বাইরে ভাবতে পারেননি, চানওনি, কারণ ওই বৃত্তের ভেতর আটকে থাকা ভাবনাগুলোয় তিনি খুব বিশ্বাস করতেন। সে-বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে ছবিগুলো তৈরি। অসম্ভব ভাল ছবি সেগুলো, সেদিক দিয়ে কোনো কথাই চলবে না, কিন্তু সেই বৃত্তটা তো বদলে গেল। বিশ্বাসগুলো, সন্দেহগুলো সেই বৃত্ত ছেড়ে আরেকটা বৃত্তে ঢুকে পড়ল, সেটা কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। ওঁর বাড়িতে বসে একদিন কথা হচ্ছিল, তিনি গদার দেখে এসেছেন, এবং গদার বুঝতেই পারছেন না, তিনি গদারকে প্রায় হাসাহাসির পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে, গদার ধরতে পেরেছেন সময়টাকে। সময় কীভাবে কথা বলে। আরো অনেক বৃত্ত তৈরি হচ্ছিল শুধু ইউরোপে নয়, পৃথিবীজুড়ে, ভারতবর্ষেও তৈরি হচ্ছিল। তুমি ভাবো, সে-সময় কমলকুমার মজুমদার বা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় অসম্ভবভাবে ভাঙছেন ভাবনাগুলোকে।
শুভদীপ মৈত্র : আপনার যে-নাগরিকতা, দূরত্ব থেকে গৃহযুদ্ধতে দেখি, বিক্ষুব্ধ একটা সময়কে ধরছে, তা আগের পরিচালকদের থেকে আলাদা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভাল প্রশ্ন করলে। সত্যজিৎ রায়ের মহানগর ধরো, তার বৃত্তটা বাংলা ছোটগল্পের যে-পরিধি তার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে, একজন স্বামী একজন বউ, তার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া, কিন্তু সে-সময় ওটাই শুধু ঘটছে না আরো অনেক কিছু ঘটছে, আরো ক্রাইসিস রয়েছে…
শুভদীপ মৈত্র : রাসত্মাঘাটে আতঙ্ক, বা খুনোখুনি, অর্থনৈতিক একটা পালাবদল…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : শুধু তাই নয়, সম্পর্কের ডাইমেনশনই ধরো। আমি ভেবে দেখেছি, সেখানেও একটা ভাবনাচিমত্মা ভেঙে দেখা চলছে। এই শহর ঘিরে, সব শহর ঘিরেই হয়, কিন্তু এই কলকাতা শহর ঘিরে যদি দেখি, মানুষগুলো একদম আলাদা ছিল। তাদের সিনেমা সময়ের ওই বিষয়গুলো দ্বারা জারিত হয়নি। ছবিগুলো তাঁর যে মাস্টারলি ক্রাফট তা তো থাকবেই; কিন্তু আমায় আর ভাবাচ্ছিল না।
শুভদীপ মৈত্র : ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে কী বলবেন তাহলে?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ঋত্বিক ঘটককে মনে হয়েছিল পারছেন। ধরতে, যেমন ধরো সুবর্ণরেখা। সুবর্ণরেখার বিষয় তুমি ভাবো, কী সাংঘাতিক একটা বিষয় – ওকে শুধু সময়ের একটা অবক্ষয় বললে চলবে না, আরো অনেক কিছু ছিল, যা আমার কাছে নতুন মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল এগুলো ভাবতে পারার মত মন থাকা দরকার। বা অযান্ত্রিক, ভারতীয় সিনেমায় প্রথম কেউ অযান্ত্রিক বানাল, সেই ভাষায় গল্প বলল। গল্প মানে কী? লোকটা গাড়িটাকে ভালবাসে, গাড়িটাও লোকটাকে ভালবাসে। এটুকু শুধু, অথচ কত কিছু লুকিয়ে আছে তার ভেতরে।
শুভদীপ মৈত্র : আপনার সিনেমাতেও দেখা যায় এই অ্যানিমেট আর ইনঅ্যানিমেটের সম্পর্ক, ভিজ্যুয়াল প্রেক্ষাপটটাই গল্প হয়ে ওঠে – এটায় কীভাবে এলেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটা আমার কবিতায়ও ছিল। গাধা নিয়ে, হাতি নিয়ে, এমন অদ্ভুত বিষয় নিয়ে লিখতাম। কেন এমন লিখেছিলাম? আমার মনে হয়েছিল যে, কথা শুধু মানুষ বলে না, ইঙ্গিত শুধু মানুষ দেয় না। সম্মতির ব্যাপারটা শুধু মানুষ থেকে আসবে তা নয়, পশুপাখি গাছপালার কাছ থেকেও আসতে পারে।
শুভদীপ মৈত্র : এমনকি ইনঅ্যানিমেট থেকেও আসতে পারে, জানলা সিনেমায় যেমন, ওই যে-জানালাটা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একজন, শুধু তার গল্প নয়, ওই জানালাটাও যেন কথা বলে উঠছে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, হ্যাঁ…
শুভদীপ মৈত্র : যেন আপনার ওগুলো প্রপস নয়, আপনার সিনেমায় প্রপস থাকে না, ওগুলো যেন চরিত্র হয়ে ওঠে, কথা বলে…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ভাল কথা বলেছ, বাংলা সিনেমায় প্রপসটা সত্যজিৎ রায় চালু করে গেছেন, অসম্ভব ভালোভাবে জোগাড় করতেন জিনিসপত্র। অনেকে ভাবল বোধহয় সেটাই আসল, কিন্তু ওঁর মনটা তো জোগাড় করতে পারল না। আমার ভাবনাটাই অন্য, আমি একজন আর্ট ডিরেক্টরকে নিলাম। সে দেখলাম ভারি ব্যস্ত হয়ে পড়ল কোথা থেকে ব্যাগ পাবে, চাবি পাবে। সে সাজাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যেন সাজানোটাই আসল। আমার তাকে বোঝাতে সমস্যা হয়েছিল, সে বুঝতে পারছিল না, ওগুলো বিষয় নয়। প্রপস কিন্তু যেটুকু দরকার সেটুকু থাকবে, তার বাইরে আলাদা করে আমি প্রপস দিয়ে কিছু নির্মাণ করতে চাই না, কোনোদিন চাইনি।
আরেকটা ব্যাপার কী, প্রপস একটা বাস্তবজাত ভাবনা, বাস্তবে একটা চেয়ার থাকবে, তার ওপর কুশন থাকবে, এমন আর কি – কিন্তু আমার সমস্যা হচ্ছে ওই বাস্তবটা নিয়ে। আমার কখনো মনে হয়নি, বাস্তব শেষ কথা। বারবার মনে হয়েছে, বাস্তবের বাইরের যে-ব্যাপারটা, আমার মনে হয়েছে এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটির কথা। যখন এটার কথা কেউ ভাববে, তখন প্রপসগুলো ইনসিগনিফিকেন্ট হয়ে যাবে। তখন আর ওগুলো কাজ করবে না, তখন দেখবে ওই ব্যাগ উড়ে বেড়াচ্ছে, চাদর উড়ে বেড়াচ্ছে, বালিশ উড়ে বেড়াচ্ছে। কোলবালিশ রাসত্মা দিয়ে হাঁটছে। এই যে বাস্তবাতীত জগৎ, এটা বাস্তবের আরেকটা দিক, সেটা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে।
শুভদীপ মৈত্র : বাস্তব থেকে এদিকে যায় আবার ফিরে আসে বাস্তবে, মানে আপনার সিনেমার জার্নিটায় দুটোই একসঙ্গে চলে, ঠিক স্যুররিয়াল বলা যায় না…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : স্যুররিয়াল যদি বলো, যেমন যদি দালির ছবি দেখছে কেউ, সে বুঝতে পারছে যে দালি যেটা আঁকছেন ওটা বাস্তব নয়। ওই যে বিখ্যাত ছবিটা, ওই যে সময় গলে পড়ছে, ওটা বাস্তবের ব্যাপার নয়, সঙ্গে সঙ্গে তুমি সজাগ হয়ে গেলে। এটাকে আমি বাস্তব হিসেবে নিচ্ছি না। কিন্তু তোমায় যদি অভ্যস্ত করে দেওয়া হয় বাস্তবাতীতের দিকে যেতে, বাস্তবের এর যে লিমিটগুলো ভেঙে প্যারালালি চললে একটা সময়, তুমি আর প্রশ্ন করো না। আমি, জানো তো, এই ভাবনার জন্য কৃতজ্ঞ আমার কবিতার কাছে। আমার জীবনে যদি কবিতা না আসত, তা সত্ত্বেও ছবি করতাম তবে সেগুলো কেমন দেখতে হতো আমি জানি না। আমাকে কবিতা অ্যালার্ট করেছে এভাবে ভাবতে।
অনেকেই বলেন যে ম্যাজিক। আমি ছোটবেলা থেকেই ম্যাজিকের প্রতি আকৃষ্ট হতাম। এই ম্যাজিকটা কিন্তু আমাদের জীবনে নানা সময়ে নানাভাবে ঘটে। এরকম একাধিকবার ঘটেছে, যা তুমি দেখছ, পরে রিয়ালাইজ করলে তা সম্পূর্ণ একটা ম্যাজিক। যেমন ধরো, একবার বাড়ি ফিরছি, যখন ঢুকেছি দরজা খুলে, দেখছি আমার ছোটবেলার খেলার মাঠে আমার ছোটবেলার বন্ধুরা বসে রয়েছে। কেউ গড়াগড়ি দিচ্ছে, কেউ পোকামাকড় সংগ্রহ করছে ঘাস থেকে, কেউ আমাকে ডাকছে। ওইটা ধরো কয়েক সেকেন্ড তারপর বুঝতে পারলাম। এরকম হাজারো ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে।
এই ম্যাজিকটা আমার ছবিতে এসে গেছে। মুশকিল হচ্ছে, ভারতীয় ছবিতে স্বপ্নের দৃশ্য আছে; যেমন ধরো নায়কে, কিন্তু তা যেন তৈরি করা। তুমি যদি বলো, এটা স্বপ্ন, এটা ড্রিম, এটা ম্যাজিক, আলাদা আলাদা করো – তাহলে আমার আপত্তি আছে। একসঙ্গে এদের যদি মিশিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই…
শুভদীপ মৈত্র : একটা মেটাফোরের লেভেলেই রয়ে যায় বলতে চাইছেন কি?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, এভাবে স্বপ্নকে আলাদা করে দেখিয়ে দেওয়া, বা ম্যাজিককে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়া আমি পছন্দ করি না। আমার মনে হয়, এই সবগুলোই একটা ইউনিটের পরিপূরক। এসব এলিমেন্ট নিয়ে একটা ইউনিট তৈরি হয়েছে, যার জন্য স্বপ্ন আমার কাছে ওইভাবে আসে না, ম্যাজিকও আসে না।
শুভদীপ মৈত্র : এবার আপনার সমসাময়িকদের কথায় আসি। যেমন আদুর গোপালকৃষ্ণন বা ভারতীয় ফিল্ম মুভমেন্টের সঙ্গে আপনি অনেকটা যুক্ত ছিলেন, আছেনও। সেই প্রেক্ষাপটটা কী, বা এখন তার কী অবস্থা?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, আমরা যখন সিনেমা করতে শুরু করি, আমি, শাম, অরবিন্দন, আদুর, আমরা প্রায় একই সঙ্গে শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এদের প্রথমদিকের ছবিগুলো চাইছিল আলাদা হতে। ভাবনাগুলো ছিল একদম তরতাজা, নতুন, কীভাবে দেখাব সেটাও নতুন। দেখার চোখ নতুন বলে স্বাধীনতা নতুন, স্বাধীনতা নতুন বলে শব্দগুলোও নতুন। এই এতগুলো জিনিস নিয়ে সিনেমাগুলো যখন তৈরি হলো তখন দেখা গেল একদম আলাদা। আমার হাস্যকর লাগে, যখন সবাই বলে সত্যজিৎ রায়ের উত্তরসূরি বুদ্ধদেব, বিদেশেও বলে। রিডিকুলাস। আমার সঙ্গে ওঁর কাজের কোনো মিল নেই। আমি অসম্ভব রেসপেক্ট করি ওঁর কাজকে। আমি ওঁর কাজের দ্বারা কখনো প্ররোচিত হইনি।
শুভদীপ মৈত্র : মনি কাউল বা কুমার সাহানি এঁরা কেউই সেটা বলেননি, এঁরাও বলেছেন ফিল্ম মুভমেন্টের কথা। কিন্তু কেউ কেউ তাদের মধ্যে সেটা থেকে সরে গেলেন আসেত্ম আসেত্ম। ওই আন্দোলন বা ওই ভাষা রইল না, এটা কেন হল?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দর্শক। সে-ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দর্শক যে হলে খুব ফেটে পড়ছিলেন তা কিন্তু হল না। তাই এক ধরনের
আশঙ্কা-হতাশা কাজ করেছিল কোনো কোনো পরিচালকের মনে – তখন তাঁরা মনে করলেন, তাহলে এটা ভুল। অন্যদের মতই সিনেমা করাটা বোধহয় ঠিক। আরেকটা ঘটনা ঘটছিল ভাঙতে গিয়ে, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা ছিল না। যেমন ধরো কুমার সাহনি। কুমার সাহনির ছবি প্রথাবিরোধী তো বটেই, বাইরেও খুব সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর দর্শক কোথাও ছিল না, দর্শককে কোথাও ছুঁতে পারল না। এটা আমার মনে হয়েছে যে, একটা সংকেত। ভাঙতে গিয়ে ভাঙাটা আসল গড়াটা আসল নয়, এই ভাবনায় ঢুকে যাওয়াটা কিন্তু ভাল নয়।
একটা দিক থেকে যখন ভাঙছে, তখন আরেকটা দিক থেকে গড়তে হবে। তোমার দেখার চোখকে দর্শককে বোঝাতে হবে। যেটা অরবিন্দন পেরেছে, আদুরের কিছু কিছু সিনেমায় আছে, শামের সিনেমায় আছে। মনির কয়েকটা ছবিতে পেয়েছি; কিন্তু মনির শেষের দিকের ছবিতে পাচ্ছিলাম না। মনি বদলাতেও পারল না। ধরো, ওর শেষ ছবি নোকর কা কামিজ, ওটা ছুঁচ্ছে না আর। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যেটা তুমি ভাঙছ আর গড়ছ তা দর্শককে ছুঁতে হবে, তার মেধাকে স্পর্শ করতে হবে। এটা কিন্তু ভীষণ ইম্পরট্যান্ট জিনিস, তা না হলে শুধু ভাঙাটুকুই হবে।
শুভদীপ মৈত্র : একই সঙ্গে কি নিজেকে বদলানোটাও দরকার? আপনার সিনেমায় দেখি ভাষা বদলে যাচ্ছে, একেকটা দশক বদলে যাচ্ছে আর আপনার ভাষাটা বদলাচ্ছে, ভাবনাটাও বদলে যাচ্ছে।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার বারবার কী মনে হয় জানো, আমাদের জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে নিজেদের খপ্পরে পড়ে যাই। যে-কবিতা লিখেছিলাম একটা সময় পপুলার হয়েছিল, যে-গল্প লিখেছিলাম ভালো সমালোচনা পেয়েছিল বা সিনেমাটা করেছিলাম তা সবাই খুব ভালো বলল – ব্যস, তার খপ্পরে পড়ে গেলাম। ভাল কাজটাকে পেরিয়ে না গেলে খুব ভালয় পৌঁছানো যায় না। আগেই বলেছিলাম তোমায়, সময়টা তো পেরিয়ে গেছে, তোমার ভাবনাগুলো বদলায়, যেমন ধরো সম্পর্কের ব্যাপারগুলো, রিলেশনশিপ ব্যাপারটা থার্টিজে, ফিফটিজে, নাইনটিজে কীভাবে বদলাল? এগুলো কিন্তু মাথায় রাখতে হয়।
আরেকটা জিনিস, সময় সবসময় এগিয়ে থাকে, সময় শুধু এগিয়ে থাকে না, সময় বুঝিয়ে দেয়, নতুন সময়ের ভাবনাগুলো সামনে রাখে, আমরা বুঝি বা বুঝি না। যারা বুঝি না, তারা আঁকড়ে থাকি ওই সময়টাকেই। বুঝতে পারি না, তা এগিয়ে যাচ্ছে, কুড়ি বছর পর আর তা রিলেট করতে পারব না।
শুভদীপ মৈত্র : এটা কি আপনার সিনেমারও একটা অমত্মর্লীন বিষয়? এখন যে সিনেমাগুলো দেখি, একটা জার্নি রয়েছে, মন্দ মেয়ের উপাখ্যান, স্বপ্নের দিন বা জানালা, ওই যে চরিত্রগুলোর মধ্যে থাকে একটা জার্নি। কোথাও পৌঁছানোর চেষ্টা করছে কিন্তু আবার সেটাই শেষ নয়, একটা কন্সট্যান্ট জার্নি…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটাও কিন্তু আমায় সময় বলে দিয়েছে। এই ধরো জানালাতে, জানালার কিন্তু একটা গল্প আছে। লোকটার একটা গল্প যেমন আছে, জানালারও একটা গল্প রয়েছে। এবং আমার কাছে জানালার গল্পটা লোকটার গল্পের থেকে কম মূল্যবান নয়। জানালা কী চেয়েছিল, যেখান থেকে তৈরি হয় সেখানেই ফিরে যেতে, তাই শেষে আমরা দেখতে পাই জঙ্গলের মধ্যে গাছের নিচে। লোকটার গল্পটা আলাদা।
এটা কিন্তু বড় জিনিস, যে-কারণে ভাবো যে, জীবনানন্দ দাশ প্রথম কবিতার বই নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন। সেই কবিতাগুলো ভালো নয়। ভীষণ রবীন্দ্রনাথের ইনফ্লুয়েন্স। সেই মানুষটি কিন্তু কীভাবে ভাঙলেন নিজেকে, নিজেকে বারবার জীবনানন্দ দাশ ভেঙেছেন, ভেঙেছেন শুধু নয়, গড়েওছেন। তিনি হাত বাড়িয়ে ছুঁচ্ছেন পরের সময়টা। আবার তার পরের সময়, তারপর তারও পরের। এভাবে সময়কে ছুঁয়েছিলেন বলে জীবনানন্দকে পড়তে গিয়ে আজো কেঁপে যাই। সে যত বড় কবিই হোক না কেন, এখনো জীবনানন্দ পড়তে গেলে কেঁপে ওঠে। এটা খুব বড় ব্যাপার। বারবার তাই বদলাতে হয়।
দেখো মুশকিল হচ্ছে যে, পুরস্কার-টুরস্কার সমালোচনা, পিঠ চাপড়ানি ভাল, ভাল বলা, এগুলো একটা আবেশ তৈরি করে। এই আবেশের খপ্পরে ঢুকে পড়লে নিজেই নিজেকে ডিফেন্ড করতে থাকে, কিন্তু বুঝতে পারছে না যে কিছু হচ্ছে না।
শুভদীপ মৈত্র : আপনি এত পুরস্কার পেয়েছেন, আপনার মত এত পুরস্কার খুব কম বাঙালিই পেয়েছে, তার গুরুত্ব বা সংখ্যা দুদিক থেকেই কম নয়, আপনি এটা বলছেন, অথচ লোকে বলে পুরস্কার পাওয়াটা ইম্পরট্যান্ট?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : না, পুরস্কার পেলে খারাপ লাগবে আমি এমন বলছি না। ঠিক আছে, কিন্তু ওতে আটকে গেলে মুশকিল। আমি যেটা বলছি, পুরস্কারগুলো একধরনের আবেশ তৈরি করে। সেটা ক্রিয়েটিভ লোককে অনেক সময় নিজেকে জাস্টিফাই করতে সাহায্য করে, সেটা একটা সমস্যা।
শুভদীপ মৈত্র : এজন্যই কি পুরস্কার নেওয়ার সময় আপনি সজাগ থাকেন?
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমাদের সময়ের একজন ফিল্ম-মেকারের কথা বলি। উৎপলেন্দু। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী বোধহয় প্রথম আমাদের সময়ের একজন পরিচালক বা সত্যজিৎ রায়ের পর বোধহয় আর কেউ পুরস্কারটা পাননি। বার্লিনে বেস্ট ফিল্ম পেয়েছিলেন। পুরস্কার পেলেন, কিন্তু এটা ওঁকে গিলে ফেলল। আমার মনে হয় এই পুরস্কার-টুরস্কার থেকে দূরে থাকা উচিত। ওগুলো পেলে ভাল, রেখে দাও সাজিয়ে-টাজিয়ে, কিন্তু কক্ষনো এদের খপ্পরে পড়ো না। প্রচুর লেখাটেখা হবে, এসব ঠিক আছে কিন্তু তার বাইরে তোমায় যেতেই হবে। কিন্তু ওই খোঁজটা, যাকে তুমি জার্নি বলছ, তা কিন্তু ভীষণ দরকার।
শুভদীপ মৈত্র : ইন্টারন্যাশনালি আপনি বহু ফেস্টিভালে গেছেন, যাচ্ছেন, জাজ বা জুরি হিসেবেও, আমাদের সাব-কন্টিনেন্টের সিনেমা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা, ধরুন পাকিসত্মানের সিনেমা বা বাংলাদেশের সিনেমা…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখো, আমার মনে হয়েছে যে, একটা ট্র্যাডিশন তৈরি হয়, জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যেমন হয়, শিল্পচর্চার দিক থেকেও হয়। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ওই ট্র্যাডিশনটাকে বিশ্বাস করে ফেলা। ক্রিয়েটিভ জায়গাতেও তাই মনে হচ্ছিল। ওই যে ট্র্যাডিশন, তার মধ্যে ঢুকে পড়লে ঠিকঠাক হবে, কেননা, তার বাইরে কাজ করলে অনেক সমস্যা আছে। দর্শক বুঝবে না, প্রযোজকও পাবে না। ফলে অনেক সমস্যা। তাই নতুন কিছু করতে গেলে সাহসের দরকার লাগে। সাহসটা কিন্তু জোগায় অনেকগুলো জিনিস। এক হচ্ছে সচেতনতা। আমি বলতে চাই যে, এই উপমহাদেশে কয়েকটা দেশ বাদ দিয়ে এইটা, কেন ভারতবর্ষের কথাও যদি বলো, কলকাতায় যাঁরা সিনেমা করছেন তাঁদের সিনেমাগুলোও কোন অর্থে ফিল্ম আমি জানি না। আমি দুবার কেন একবারও দেখতে চাই না। কাউকে দেখতে বলতেও চাই না। কারণ আমি জানি, প্রত্যেকে কিন্তু চার-পাঁচ বছরের জন্য, কারণ ভয় – দর্শক পাব না, প্রযোজক পাব না; যদি এর থেকে বেরিয়ে সিনেমা করি, হয়তো পুরস্কারও পাব না, হয়তো ফেস্টিভাল পাব না, এসব হয়তোতে দাঁড়িয়ে আছে। দুই বাংলা মিলিয়ে বলব, এর বাইরের কাজ কম। ঢাকায় কিছু কাজ দেখেছিলাম, ভাল লেগেছিল। ভাঙতে চাইছে, বলতে চাইছে নতুন ভাষায় নিজের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে, সে-পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলতে গিয়ে কিন্তু আলাদা হয়ে যাচ্ছে। একা হয়ে যাচ্ছে। এই একটা সমস্যা – একা হয়ে যাওয়া। এই ভয়টা থেকে বেরোতে হবে।
আমি এক ধরনের যথেচ্ছাচারে বিশ্বাসী জানো তো, আমি খারাপ অর্থে যথেচ্ছাচার বলছি না। ক্রিয়েটিভলি হওয়া দরকার, এটা না হলে ওই চারপাশের ট্র্যাডিশনের মোড়কটা আটকে দেয়। এই মতলববাজ ট্র্যাডিশন ওগুলো শিখিয়ে দেয় যে, তুমি আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকো। যেই তুমি ভয়টাকে ভেঙে অন্য কিছু করার চেষ্টা করছ, তখনই একা হয়ে যাবে, তুমি ডিস্ট্রিবিউটর পাবে না, তুমি প্রডিউসার পাবে না, তোমার ছবি রিলিজ করাতে পারবে না। অথচ তুমি যদি পথের পাঁচালীর কথা ভাবো, অযান্ত্রিকের কথা ভাবো, এগুলো তো হয়েছে, বারবার ভারতীয় সিনেমা কেন পৃথিবীর সিনেমার ইতিহাসের ক্ষেত্রে দেখেছি।
শুভদীপ মৈত্র : হ্যাঁ, এমন তো ঘটেছে, ধরুন আপনার সিনেমা সম্পর্কেও অনেকে বলে, আজকাল ওনার ছবি তো রিলিজ হয় না হলে, আমি অনেককে বলতে শুনেছি যে, আমরা হলে দেখতে চাই কিন্তু ওনার সিনেমা আমরা পাচ্ছি না হলে। একটা বড় দর্শক রয়েছে আপনার, যাঁরা হলে সিনেমা দেখেন এখনো…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, জানি একটা আক্ষেপ রয়েছে, জানি এ-প্রসঙ্গে বলতে গেলে আরো অনেক কিছু বলতে হবে। কিন্তু একটা জিনিস বলছি, আমি অনেক আগে জানো তো, এমনকি তখনো এভাবে ইন্টারনেট চোখে পড়েনি, কিন্তু তখনো আমার মনে হতো ফিল্ম একসময় কবিতা লেখার মত হবে। একটা পেন থাকলেই যেমন লিখতে পারা যায়, তেমনি, প্রায় তেমনি সহজভাবে আমি সিনেমাটা করতে পারব – ফিল্মটা একদিন সে-জায়গায় পৌঁছে যাবে। এই কাজটা কিন্তু শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে থেকে, যেমন আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমা শুরু হয়েছিল, সেখানে কটা দর্শক, খুব কম, পৌঁছানো বেশ মুশকিল হতো। এখন কিন্তু আরো সহজে পৌঁছে দিতে পারছে নেটের মধ্য দিয়ে।
আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমার জন্ম হয়েছিল আমেরিকায়, সে-দেশগুলো কিন্তু অনেক সচ্ছল। তা সত্ত্বেও কিছু পরিচালক একেবারে নিজের ভাষায় কথা বলতে গিয়ে একটা বিপস্নব ঘটিয়ে ফেলল। এবং তার দর্শক তৈরি হচ্ছিল, সংখ্যায় কম হলেও তারা সিনেমার এলিমেন্টগুলোকে নতুন করে দেখতে চাইছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমা সেই সময়ের থেকেও এখন কিন্তু অনেক বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে যেতে পারছে নেটের মাধ্যমে। আমি এমন অনেক পরিচালককে জানি, যাঁরা সিনেমা করছেন এবং দেখাচ্ছেন নেটে। আমরা খবর রাখি না হয়তো, সেগুলো নেটেই রিলিজ করা হচ্ছে। ক্রমশ, আমি বলছি আজ থেকে কুড়ি বছর পর, বা পনেরো বছর পর, বা দশ বছর পর, এই হলে যাওয়ার কনসেপ্টটাই ভেঙে যাবে। ভাঙছেও, লোকে ঘরে বসে সিনেমা দেখতে চাইছে।
শুভদীপ মৈত্র : লেখক যখন লেখেন বা শিল্পী আঁকেন, তখন জিনিসটা তাঁর, কিন্তু সিনেমায় তা হয় না…
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : হ্যাঁ, হলিউডের স্ট্রাকচারটাই চলছে এখন পর্যমত্ম। কিন্তু একটা জিনিস বিদেশে আছে, আমেরিকাতেও আছে – ডিরেক্টরের রাইট। এটা দরকার, যেখানে সিনেমা নিজের পয়সায় তৈরি করছে, ধরো বাকিটা ব্যক্তিগত, বা আসা-যাওয়ার মাঝে। আমি বলতে চাইছি, ছবিগুলো করার পর মালিকানা আমার হাতে থাকছে না, মালিকানা যার হাতে, স্বত্ব যার হাতে, তার সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় বিরোধ বাধছে।
রিলিজ করাটা কিন্তু পরিচালকের কাজ নয়। সোহিনী দাশগুপ্তের ছোটিমোটি বাতেই ধরো, খুব ভালো ছবি, একদম অন্যরকম ছবি। আমি জানি, দর্শকদের ভালো লাগবে সেটা। কিন্তু এখানে পরিচালক অসহায়। আমার যার জন্য মনে হচ্ছে আসেত্ম আসেত্ম, পরিচালক যে-উদ্দেশ্য নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন তা সফল নাও হতে পারে, কিন্তু নিজে অর্থ সংগ্রহ করে সিনেমা বানানোটা দরকারি। এটা করতেই হবে। r
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.